বি. করিম সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন, আরে এস এস। তোমার নাম তো পরী তাই না? ইলী, বিকরিম সাহেবকে বিস্মিত করে, তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। নিচু গলায় বলল, আমার নাম ইলা। শুধু বাবা আমাকে পরী ডাকতেন।
তোমাকে আমি মনে মনে খুঁজছিলাম। ঠিকানা রেখে যাও নি। ঠিকানা রেখে গেলে নিজেই যোগাযোগ করতাম। তোমার জন্যে সুসংবাদ আছে। মজিদ নতুন নায়িকা ট্রাই করতে রাজি হয়েছে। তার কাছে তোমাকে একদিন নিয়ে যাব। তবে তারও আগে তোমার একগাদা দুবি দরকার। ভাল ফটোগ্রাফার দিয়ে কিছু ছবি তোলাবে। আমি একজন ফটোগ্রাফারের নাম-ঠিকানা দিয়ে দেব। ওকে দিয়ে ছবি তোলাবে। ব্যটা কাজ ভাল করে। তবে স্বভাব-চরিত্র খারাপ। ছবি তোলা শেষ হলেই ঘাড় ধরে বিদেয় করে দেবে।
নায়িকা হবার জন্যে আমি কিন্তু আপনার কাছে আসি নি। আমি আগেও অপিনাকে বলেছি। আপনি বোধহয় আমার কথা মন দিয়ে শুনেন নি।
তাহলে আস কেন আমার কাছে?
এম্নি আসি।
কোন কারণ ছাড়াই আমার কাছে আস?
কারণ একটা আছে। তবে সেই কারণ আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
বি. করিম খানিকক্ষণ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থেকে বললেন, আমি বাংলাদেশের ছবির স্ক্রিপ্ট লিখি। আমার কাছে সব কারণই বিশ্বাসযোগ্য। ব্যাপারটা কি বল।
ভুতুরে এসে বলি?
এস ভরে এস।
ইলা ঘরে ঢুকল। আজকে ঘরদোয়ার অন্য দিনের মত অগোছালো নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঘর ঝাঁট দেয়া হয়েছে। বইপত্র ছুড়ানোছিটানো নয়। সাজানো। তবে মেঝেতে খবরের কাগজ বিছানো। একটা টিফিন ক্যারিয়ার, খালা গ্লাস। ভদ্রলোক বোধহয় খেতে বসবেন।
শোন পরী, আমি এখনো ভাত খাই নি। ভাত নিয়ে বসব। তোমার যা বলার তুমি চট করে বলে চলে যাও।
ইলা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা বি-টু সাইজের ছবি বের করে এগিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, ছবিটা দেখুন।
করিম সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলাম।
আপনার সঙ্গে কি এই ছবিটার মিল আছে না?
খানিকটা আছে। তবে এই ভদ্রলোকের চোখ বড় বড়। আমার চোখ ছোট। কার ছবি?
আমার বাবার ছবি।
ও।
বাবা যখন মারা যান তখন আমরা সবাই খুব ছোট। আমার ছোট বোনটার বয়স এক বছর, আমার চার বছর, আর আমার বড় ভাইয়ের বয়স সাত। আমার অবশ্যি বাবার চেহারা মনে আছে।
চার বছর বয়স হলে মনে থাকারই কথা।
ইলা শান্ত গলায় বলল, মানুষের সঙ্গে মানুষে চেহারায় মিল থাকতেই পারে। এটা এমন কিছু না। এটাকে কোন রকম গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। তারপরেও আপনার কাছে আসতে আমার ভাল লাগে। আপনি বিরক্ত হন। ভাবেন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসছি।
আর ভাবব না। তুমি বোস। তোমার মুখটা শুকনা লাগছে। তুমি কি দুপুরে কিছু খেয়েছ?
জ্বি-না।
আমার সঙ্গে চারটা খাবে?
ইলা কিছু বলল না। চুপ করে রইল। বি. করিম সাহেব বললেন, এস পরী হাত ধুয়ে আসি। হোটেলের খাবার। ভাল হবে না। তবু খাও।
ইলা হতি ধুয়ে খেতে বসল। করিম সাহেব খেতে খেতে কৌতূহলী হয়ে মেয়েটিকে দেখছেন। তাঁর নিজেরই খানিকটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।
পরী!
জ্বি।
তোমার যদি কখনো কোন সমস্যা হয় আমাকে বলে। আমার ক্ষমতা এবং সামর্থ্য দুইই সীমিত। তবু আমার সাধ্যমত আমি চেষ্টা করব।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার কি কোন সমস্যা আছে?
আছে। আমার খুব আপন একজন মানুষ লালবাগ থানা হাজতে আটকা আছেন। আপনি তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে পারবেন?
কোন অপরাধে তাকে ধরা হয়েছে সেটা না জানলে বলতে পারব না। টাকা পয়সাও লাগবে। এদেশের পুলিশ টাকা ছাড়া কথা বলে না।
আমি টাকা নিয়ে এসেছি।
ইলা করিম সাহেবকে একটা খাম বাড়িয়ে দিল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, এ তো অনেক টাকা।
জ্বি, অনেক টাকা।
কত আছে এখানে?
ছাপ্পান্ন হাজার ছিল। আমি কিছু খরচ করেছি–এখন কত আছে জানি না।
করিম সাহেব সিগারেট ধরাতে ধারাতে বললেন, তুমি চাচ্ছ ওকে বের করে আনতে যে টাকা লাগে তুই এখান থেকে দেব আর বাকি টাকাটা ওর হাতে দেব?
জ্বি।
তুমি চাচ্ছ না যে ব্যাপারটা কেউ জানুক?
আপনি ঠিকই ধরেছেন।
বেশ। করা হবে। ছেলের নাম দিয়ে যাও। ঠিকানা দাও।
খামের ভেতর একটা কাগজে লেখা আছে।
তুমি কি ওকে কোন চিঠি দেবে?
জ্বি-না।
তুমি নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চাও?
জ্বি।
ইলা বলল, আমি এখন উঠব। সে কদমবুসি করবার জন্যে নিচু হল। বি. করিম সাহেব হাসিমুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রলোক চিরকুমার। সারাজ্জীবন একা কাটিয়েছেন। তার জন্যে কোন রকম অতৃপ্তি তিনি বোধ করেন নি। আজ করলেন। আজ হঠাৎ করে মনে হল–বিরটি ভুল হয়েছে। সংসার করলে হত। এই মেয়ের মত একটা মেয়ে তাহলে তাঁর থাকত।
চাচা যাই?
করিম সাহেবের খুব ইচ্ছা করল বলেন–আবার এস মা। বলতে পারলেন না। দীর্ঘদিন মা ডাকেন না। আজ হঠাৎ করে কাউকে মা ডাকা সম্ভব না। তিনি কোমল গলায় বললেন, আবার এস। ইলা বলল, আমি আর আপনাকে বিরক্ত করব না।