১১. বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি সংক্রান্ত নতুন নীতিগুচ্ছ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অবস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের পশ্চাদপট

একাদশ অধ্যায়

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি সংক্রান্ত নতুন নীতিগুচ্ছ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অবস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের পশ্চাদপট

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংক ছাড়াও তৃতীয় যে-আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল সেটি ‘শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সম্মতি’, বা ‘গ্যাট’ [General Agreement on Tariff and Trade (GATT)]। এই সংগঠনটি গড়ে তোলার পিছনে মূল ঘোষিত কারণ ছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যের আবহাওয়া গড়ে তোলা। বিভিন্ন সভ্য দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বাণিজ্য ও শুল্ক সংক্রান্ত মতবিরোধগুলিকে মিটিয়ে ফেলে মুক্ত বাণিজ্যের পথের বাধা দূর করা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে মুক্ত বাণিজ্য-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। এই সংগঠনের অষ্টম দফার অধিবেশন উরুগুয়েতে শুরু হয় ১৯৮৫ সালে, শেষ হয় ১৯৯৪-তে। এই সংস্থাটি একটি নতুন স্থায়ী রূপ পায় ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা [World Trade Organisation (WTO)] প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর নবম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় দোহা-তে, ২০০১ সালে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটিই ছিল প্রথম অধিবেশন। ১৯৮৫ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত অষ্টম অধিবেশনেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এসেছিল। এর মধ্যে প্রধান বিষয়গুলি হল: ক) কৃষি-উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাণিজ্যের আওতায় পড়ে এমন পণ্যের ওপর সরকার যে-ভরতুকি দিয়ে থাকে সেই অন্তর্দেশীয় সরকারি সহায়তা সংক্রান্ত, খ) খাদ্যের অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য এবং রেশনিং সংক্রান্ত, গ) সেবামূলক কাজে বাণিজ্য সংক্রান্ত, ঘ) কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত, ঙ) মেধা-স্বত্ব সংক্রান্ত। এই প্রথম কৃষি-উপকরণ ও কৃষিপণ্যের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতাভুক্ত করে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক আলাপআলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা হল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের পর যে-বিষয়গুলিকে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক আলাপ আলোচনার বিষয়ভুক্ত করা হল সেগুলিও উল্লেখ্য: ১) উন্নত দেশগুলিকে সংগঠিত শিল্পে নির্মিত পণ্য আমদানির ওপর গড়ে মোট শতকরা ৪০ ভাগ শুল্ক কমাতে হবে, পাঁচটি সমান বার্ষিক কিস্তিতে। দশটি পণ্যের ওপর শুল্ক একেবারেই বিলোপ করতে হবে। এগুলোর মধ্যে প্রধান হল বিয়ার, নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, বিশুদ্ধ স্পিরিট, কৃষিতে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, কাগজ, ঔষধপত্র, ইস্পাত ও খেলনা। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শুল্কের হার আর না বাড়িয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিত হারে বেঁধে রাখা। কিন্তু এইসব নিয়মাবলি প্রণীত হলেও দেখা গেল উন্নয়নশীল দেশগুলি উন্নত দেশগুলির বাজারে তাদের পণ্য বিক্রির বিষয়ে একইরকম শুল্কের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নত দেশগুলিতে শুল্ক-হার আন্তর্জাতিক গড় শুল্কের থেকে অনেক বেশি ছিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম চালু হওয়ার পরেও উন্নত দেশগুলি একই হার বজায় রাখে। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিও উন্নত দেশের বাজারে যে-শুল্কহারের মুখোমুখি হচ্ছে তা বিশ্ব-গড়ের তুলনায় শতকরা ৩০-এরও বেশি। খ) কৃষিপণ্যের বাণিজ্যকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আলোচ্য বিষয়ের আওতাভুক্ত করে ধীরে ধীরে এই পণ্যগুলির আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানির ওপর থেকে বাধানিষেধগুলি লঘু করে দিতে হবে। উন্নত দেশগুলি কৃষিপণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক ছাড়া আরও যেসব শুল্কহীন বাধানিষেধ আরোপ করেছিল, তা পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত সংরক্ষণের নীতি মেনে নেওয়া বা না-মেনে চলা সংক্রান্ত। এই ধরনের শর্তগুলি যথাযথ না মানলে আমদানির পরিমাণের ওপর বা পুরোপুরি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার নীতির বদলে স্থির হয়েছিল এই নিষেধাজ্ঞাকে শুল্কে পরিণত করে শুল্কের প্রকরণটি ব্যবহার করে এসব পণ্যের আমদানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শুল্কের পরিমাণ ’৮৬–’৮৮ স্তরের গড়ের ৩৬% স্তরে বেঁধে রাখতে হবে। গ) মুক্ত বাণিজ্যের পথ বাধামুক্ত রাখার জন্য ভরতুকি-যুক্ত পণ্যের রপ্তানি ২১% কমাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলি তাদের বাণিজ্যের ওপর বাধানিষেধ শিথিল করলেও উন্নত দেশগুলি তাদের বাণিজ্য-পণ্যগুলির উৎপাদনে এত বেশি ভরতুকি দেয় যে, সেসবের প্রকৃত উৎপাদন-ব্যয় বেশি হলেও বিশ্ব-বাজারে দাম কম রাখা সম্ভব হয়। এইভাবে উন্নত দেশগুলি ভরতুকি-যুক্ত পণ্যগুলির দাম কম রেখে বিশ্ব-বাজারে প্রতিযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মুক্ত-বাণিজ্য সংক্রান্ত কয়েকটি বিশেষ নীতি উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর প্রয়োগ করার পর উন্নত দেশগুলি নিজদেশে ভরতুকি কমানোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখায়। প্রকৃতপক্ষে তারা ভরতুকি কমাতে রাজি ছিল না বরং ভরতুকির পরিমাণ অস্বাভাবিক বাড়িয়ে বিশ্ব-বাজারে তাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রেখেছিল। ঘ) নানাপ্রকার বুনটের বস্ত্র ও পোশাক উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে আমদানির ওপর এর আগে কিছু পরিমাণগত সীমা বেঁধে দিয়েছিল উন্নত দেশগুলি। নতুন ব্যবস্থায় ২০০৫ সালের মধ্যে এই সীমা ধীরে ধীরে বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাস্তবে দেখা গেল, উন্নত দেশগুলি এইসব পণ্য আমদানির ওপর যে-শুল্ক জারি করেছে তাতে উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে উন্নত দেশের বাজারে এইসব পণ্য বিক্রি করা দুষ্কর। ঙ) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক্তিয়ারে থাকা অন্যান্য নানা বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি হল: বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধা-স্বত্ব আইন, বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগের নিয়ম, সেবামূলক কাজকর্ম বিষয়ে সাধারণ মতৈক্য এবং অত্যাবশ্যক পণ্যের সরকারি বিতরণ ও রেশনিং ব্যবস্থা। শেষোক্ত বিষয়গুলির মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধা-স্বত্ব আইন নিয়ে আমরা এই অধ্যায়ের পরবর্তী বিভাগে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে সেখানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপানো কৃষি-বাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়মগুলি ভারতীয় কৃষি ও কৃষকের জীবনযাত্রায় যে প্রভাব ফেলেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে। তার আগে আমরা সাধারণভাবে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপানো নতুন নিয়মগুলি ভারতীয় কৃষির ওপর কী প্রভাব ফেলেছে তা একবার দেখে নেব।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার

বিশ্বায়ন কর্মসূচির একটি দিক হল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রণীত নতুন কৃষিপণ্য ও কৃষি-উপকরণের উৎপাদন ও বাণিজ্য সংক্রান্ত শর্তাবলি, যা নীতিগুচ্ছের আকারে পৃথিবীর কয়েকটি দেশ বাদে এই সংস্থার সভ্য হিসেবে স্বীকৃত প্রায় প্রতিটি দেশের ওপর প্রযোজ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের আগে এই সংস্থার পূর্বতন রূপটি ছিল ‘শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সম্মতি’ নামক একটি সংস্থা, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তৈরি হয়েছিল পুঁজিবাদী দুনিয়ার বাজার-সংক্রান্ত দীর্ঘকালীন সমস্যা সমাধানের জন্য মুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ খোলা রাখার উদ্দেশ্যে। বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনও মতবিরোধ ঘটলে সংশ্লিষ্ট দু’টি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান ছিল এই সংস্থার মূল কাজ। ১৯৮৫ সালে এই সংস্থার তৎকালীন সেক্রেটারি-জেনারেল আর্থার ডাংকেল বাধাহীন মুক্ত বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত রাখার উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেন, সেগুলি প্রস্তাবিত নতুন বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই প্রথম কৃষিজ পণ্য ও কৃষি-উপকরণ নিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য, অথবা মেধা-স্বত্ব বা পেটেন্ট করা, অথবা সেবামূলক কাজের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ নীতি সংস্থাটির বহুপাক্ষিক আলোচনায় জায়গা পেল। সমস্ত সভ্যের কাছে এই নতুন নীতিগুলি ‘হয় সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করো অথবা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করো’ এই শর্তে পেশ করা হয়, আংশিক গ্রহণ-বর্জনের কোনও পথ খোলা থাকে না। ইতিপূর্বে কখনও কৃষি সমেত এই নতুন বিষয়গুলি বিরোধ নিষ্পত্তিকারক সংস্থাটির কাজের আওতায় ছিল না। বহুপাক্ষিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান এক দীর্ঘ প্রক্রিয়াসাধ্য কাজ। বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় ও কৃষি-সম্পর্কিত বিপুল সংখ্যক পণ্য এই আলোচনা-মঞ্চের এক্তিয়ারভুক্ত হওয়ায় বেশিরভাগ দেশই এই মঞ্চের সদস্য হয়ে নিজ নিজ দেশের স্বার্থহানির সম্ভাবনা রোধ করা উচিত বলে মনে করে। তাদের আশা ছিল, কোনও না কোনও সময়ে তাদের স্বার্থসম্পর্কিত কোনও বিষয় আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলে এই মঞ্চের সদস্য হিসেবে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের নিজেদের মত যথাযথ পেশ করতে পারবে এবং সম্ভাব্য সিদ্ধান্তকে তাদের নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে। কিন্তু কৃষি, আন্তর্জাতিক মেধা-স্বত্ব অথবা অত্যাবশ্যক পণ্যের (যেমন খাদ্য) সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় দেশের আপামর জনগণের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত, অথবা যা যুক্ত রয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ-উন্নয়নের পথ-নির্ধারক অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রার সঙ্গে, সেগুলিকে কেন একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুপাক্ষিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত করা হল সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

এই বিষয়টি কৃষিপণ্য ও কৃষিপণ্য সম্পর্কিত অন্যান্য উপকরণ যেমন, সার, বীজ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা ও এই বাজারে উন্নত দেশগুলির ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে কানাডা ও আমেরিকা প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছিল। তারা এই প্রাথমিক পণ্যের বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক বাজারকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান কমিউনিটি খাদ্যশস্যের বাণিজ্যে নিট ক্রেতা হিসেবেই বিরাজ করছিল। সত্তরের দশক থেকে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সেই পরিচয় ছেড়ে নিট বিক্রেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ’৮০র দশকে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি খাদ্যশস্যের বিশ্ব-বাজারে তাদের কৃষি-নীতি এবং বিশেষ করে কৃষিপণ্যের রফতানি-নীতি এমন ভাবে ঢেলে সাজায় যে, অচিরেই তারা খাদ্যশস্যের বিশ্ব-বাজারে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এইভাবে ও ই সি ডি দেশ, অর্থাৎ বিশ্বের বৃহৎ ইউরোপিয়ান পুঁজিবাদী দেশগুলি কৃষিপণ্যের প্রধান রফতানিকারক হিসেবে পরিচিতি পায়। এরা বিশ্ব-বাজারে খাদ্যশস্য রফতানির সবচেয়ে বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। একদিকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি, এই দুই ব্লকের দেশগুলির কৃষির সঙ্গে যুক্ত পণ্যের বহুজাতিক ব্যবসায়ীরা বিশ্ব-বাজারে নিজেদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতায় রত হয়। বাস্তবে ’৯০-এর দশকে দেখা যায়, মুষ্টিমেয় সংখ্যক বহুজাতিক বড় বাণিজ্য কোম্পানিগুলি, যাদের শেকড় রয়েছে বিশ্বের প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, বিশেষ করে আমেরিকা ও কানাডায়, তারা খাদ্যশস্যের বিশ্ব-বাজারে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমেরিকা ও কানাডার পরই ফ্রান্স অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য রফতানিকারী দেশ হিসেবে বিকাশ লাভ করলে দুই ব্লকের বহুজাতিক ব্যবসায়ী কোম্পানিদের মধ্যে লড়াই বাস্তবে আমেরিকা ও ফ্রান্স, এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-যুদ্ধের আকার নেয়।

বস্তুত ’৮০-র দশকেই আমরা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান কমিউনিটিকে বিশ্বের শস্য-বাজারে প্রধান দু’টি প্রতিযোগী হিসেবে লড়াইয়ে লিপ্ত থাকতে দেখি। বহুদিন থেকেই এই দুই পক্ষ তাদের নিজ নিজ দেশের শস্যভাণ্ডারের কলেবর বৃদ্ধি করে আসছে। যখন এই দুই ব্লকের দেশগুলি ভরতুকির সাহায্য নিয়ে তাদের শস্যের উৎপাদন ও রফতানি বাড়িয়ে তুলছিল তখন ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়া কম উন্নত দেশগুলি তাদের উৎপাদিকা শক্তি কিছুটা বাড়িয়ে নিয়ে খাদ্যে স্বয়ংভরতা অর্জনের পথে চলেছিল। ফলে বিশ্ব-বাজারে খাদ্যশস্যের জোগান যখন দ্রুত বাড়ছে তখন বিশ্ব-বাজারে বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা খাদ্যশস্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এই দুই ব্লকের রফতানিকারী দেশগুলোর মধ্যে বাজারের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। যতই জমে থাকা অবিক্রীত খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার দাম কমায় ও ব্যবসায়িক উদ্বৃত্তের হার নামিয়ে আনে, ততই দুই ব্লকের দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলি তাদের নিজ নিজ দেশের সরকারের ওপর ভরতুকি আরও বাড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। বিশ্বের শস্য রফতানির বাজারে নিজেদের দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য প্রত্যেক রফতানিকারক দেশের সরকার বিশাল পরিমাণ ভরতুকি দিতে থাকে এবং তার পরিমাণ বাড়াতেই থাকে। এইভাবেই দুই ব্লক তাদের দৈত্যাকৃতি বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে বিশ্বের শস্যবাজারে সীমাহীন কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে, ও একই সঙ্গে অপেক্ষাকৃত দুর্বল খাদ্যশস্য রফতানিকারক দেশগুলিকে প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। বাজারে চাহিদা ক্রমশ কমতে থাকলে দু’টি প্রধান প্রতিযোগী অলিগোপলি কোম্পানি যেমন মোট জোগান কমিয়ে রাখাকেই তাদের স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করে, তেমনই বিশ্ব-বাজারে খাদ্যশস্যের চাহিদা কমতে থাকায় এই প্রধান দু’টি রফতানিকারক প্রতিযোগী ব্লকেরও প্রয়োজন পড়েছিল বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের মোট জোগান কমিয়ে রাখার। বিশ্ব-বাজারে চাল-গমের মতো খাদ্যশস্য ও তুলার মতো শিল্প-কাঁচামালের জোগানের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার স্বার্থে বৃহৎ শক্তিগুলি এইসব পণ্যের জোগানদাতা তৃতীয় বিশ্বের ভূমিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। একইসঙ্গে নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সুরক্ষিত রাখা বা প্রসারিত করার পরম উদ্দেশ্যও ছিল তাদের সামনে। এই উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অভ্যন্তরীণ সহায়তা বা আমদানি সংক্রান্ত নীতিগুলি প্রযুক্ত হয়েছিল। তাই ভারতে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দ্বারা প্রস্তাবিত ও অনেকাংশে গৃহীত নীতিগুলি এ দেশের কৃষিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে সেই প্রশ্নটি আলোচনার আগে একবার কৃষিসম্পর্কিত প্রশ্নে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির সাপেক্ষে বিশ্ব-বাজারে প্রতিযোগিতা রত দু’টি প্রধান রফতানিকারক দেশের অবস্থান বিচার করা জরুরি। বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি রফতানিকারী দেশের বৈদেশিক অর্থনীতি বিশ্ব-বাজারের সঙ্গে যুক্ত, তাই বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান কমিউনিটি দীর্ঘদিন ধরে তীব্র প্রতিযোগিতায় রত ছিল। এই দুই বৃহৎ শক্তি কৃষিপণ্যের রফতানি-বাজারটিকে প্রায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। ’৭০-এর দশক বা তার আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ক্রমে ইউরোপিয়ান কমিউনিটির অতিরিক্ত ভরতুকি-যুক্ত পণ্য নিয়ে ‘অনুপ্রবেশ’ ও বাজারের একটি বড় অংশের ওপর ইউরোপিয়ান কমিউনিটির আধিপত্য বিস্তার তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। ’৮০-র দশকে আমেরিকা তার হৃত বাজার পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ ভরতুকি ও অভ্যন্তরীণ বাজার-সুরক্ষার নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পূর্বতন রূপ গ্যাটের অন্তর্গত বাণিজ্যসংক্রান্ত বিবাদ মেটানোর প্রক্রিয়াকে আবার চালু করতে চায়। সেই অনুসারে শেষপর্যন্ত ইউরোপিয়ান কমিউনিটিকে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি করায় ও ১৯৮৫ সালে উরুগুয়ে অষ্টম অধিবেশন শুরু হয়। আমেরিকা কৃষিতে অভ্যন্তরীণ সরকারি সহায়তা দেওয়ার সমস্ত ধরনের রীতি ১০ বছরে ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার প্রস্তাব আনে ও ৫ বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে রফতানি ভরতুকি তুলে নেওয়ার কথা বলে। প্রাথমিকভাবে মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা অধিবেশনটি পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে ভেস্তে যায় ও কয়েক মাসের জন্য সে-চেষ্টা বাতিল করা হয়। আমেরিকা এবার ইউরোপিয়ান কমিউনিটির ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের দেশে রফতানিতে উৎসাহব্যঞ্জক কর্মসূচিগুলির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। ইতিপূর্বে ১৯৬২ সালে গ্যাটের ডিলন অধিবেশনে শুল্কের ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার বিপরীতে তৈলবীজের ওপর উৎপাদকের ভরতুকির সূচনা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনার চেষ্টা করলে আমেরিকার প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। আমেরিকা এইরকম ধারাবাহিকভাবে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের নীতিগুলি ও এই উদ্দেশ্যে অভ্যন্তরীণ সহায়তা দেওয়ার রীতির তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। অথচ আমেরিকাই উরুগুয়ে রাউন্ডের শেষ বছরে তার পুরনো অবস্থান থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসে। আর্থার ডাংকেল ডিসেম্বর ১৯৯১-তে যে-সহজতর প্রস্তাবটি এনেছিলেন, তাকেও তারা নানাভাবে পরিবর্তন এনে আরও সহজ করে তোলে। শেষপর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল তা আমেরিকার ১০ বছরে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ সহায়তা দেওয়ার রীতি পরিত্যাগ করার প্রস্তাব, যা উরুগুয়ে রাউন্ডে পেশ করা হয়েছিল, তার থেকে বহুদূরের। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গীতে আমূল পরিবর্তনের পিছনে ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান কমিউনিটির মধ্যে ব্যবসায়িক জোট, সেটা তৈরি হয়েছিল কৃষিপণ্যের জোগানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সম্ভাব্য ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে। গ্যাট চুক্তির অন্তিম রূপ গৃহীত হওয়ার আগে এই দুই বৃহৎ শক্তি কয়েকটি আলোচনাসভায় মিলিত হয় ও এদের মধ্যে ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালের ‘ব্লেয়ার হাউস চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। এই সূত্রেই আমেরিকা ইউরোপিয়ান কমিউনিটির মতের সঙ্গে কিছুটা একমত হয়ে আর্থার ডাংকেলের দেওয়া প্রস্তাবটিতে নানা রকম সংশোধনী আনে, ফলে সেটিতে অভ্যন্তরীণ সহায়তা বিষয়ে অনেক নরম দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ ঘটে। শেষপর্যন্ত যেসব নীতি নেওয়া হয় সেগুলিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কৃষি বাণিজ্যনীতি বিষয়ে এমন কিছু প্রস্তাব ছিল যেগুলি কার্যত আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান কমিউনিটির যুগ্ম স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নির্মিত অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত শর্তাবলি। এই দু’টি রফতানি ব্লকের অন্তর্গত শস্য রফতানিকারক অলিগপলি কোম্পানিগুলি তাদের ব্যবসায়িক মুনাফা বজায় রাখার জন্য কেন বিশ্ব-বাজারে খাদ্যশস্যের জোগান কমিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে যদি আমরা ’৮০-র দশকের বিশ্ব শস্যবাজারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিই। প্রথমত বিশ্ব-বাজারে শস্যের রফতানি পাঁচটি মাত্র বড় বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল, যাদের মধ্যে দু’টি কোম্পানির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল বিশাল ক্ষমতা। এরা হল কারগিল ও কন্টিনেন্টাল গ্রেন। এই দুই কোম্পানি একত্রে মোট রফতানির শতকরা ৪৫ ভাগ জোগান দিত। দ্বিতীয়ত এটা দেখা গিয়েছিল যে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে মোট উৎপাদিত শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রফতানি বাজারের জন্যই উৎপাদিত হত। তৃতীয়ত, খাদ্যশস্যের মধ্যে বিশেষ করে গমের ক্ষেত্রে উন্নত রফতানিকারক দেশগুলি মোট রফতানির শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি জোগান দেয়, আর পিছিয়ে-পড়া দেশগুলি আন্তর্জাতিক বাজারে মোট আমদানির প্রধান অংশ আমদানি করে। অর্থাৎ বিশেষ খাদ্যশস্য গমের ক্ষেত্রে জোগানদার ও গ্রাহক হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারের উন্নত ও পিছিয়ে-পড়া দেশগুলির মধ্যে এই তীক্ষ্ণ বিভাজনের কারণে এটা খুবই স্বাভাবিক যে, উন্নত দেশগুলি পিছিয়ে-পড়া দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিগুলিকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে চাইবে যাতে পিছিয়ে-পড়া দেশগুলি তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বেশিটাই আমদানি করে মেটায় ও নিজ নিজ দেশের শস্য উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। এর ফলে উন্নত দেশগুলিও তাদের ভরতুকির ভার কমাতে পারবে। ’৮০-র দশকে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারের এই বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অষ্টম অধিবেশন ও তার পরবর্তী অধিবেশনগুলিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ও গৃহীত নীতিগুলিকে বোঝার চেষ্টা করেছি।

এইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আসলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপের মতো বিশ্ব-বাজারে প্রতিযোগী বড় শক্তিগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক নানা প্রশ্নে বোঝাপড়ার জন্য একটি সাধারণ মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটি বড় শক্তি সেখানে নিজ দেশের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও বোঝাপড়া চালাতে থাকে। আলাপ-আলোচনার যে-অংশে পিছিয়ে-পড়া স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থ জড়িত থাকে, সেইসব বিশেষ ক্ষেত্রে তারাও বোঝাপড়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই বোঝাপড়া প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশ পরিচালিত হয় মুক্ত-বাণিজ্যের কথা সামনে রেখে আসলে স্বল্পোন্নত দেশের সম্পদের ওপর উন্নত দেশের বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের একটি সর্বজনগ্রাহ্য উপায় স্থির করার জন্য এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলির কাছে এই উপায়টিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে। আমরা একটি একটি করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রস্তাবিত ও অনেকাংশে গৃহীত নীতিগুলি আলোচনা করে আমাদের এই পর্যবেক্ষণটির সত্যতা পরীক্ষা করতে পারি।

প্রথমত, বাজারের নাগাল বা আমদানি সংক্রান্ত নীতি: এই নীতির দু’টি প্রধান দিক হল বাজারে প্রবেশের অধিকার সংক্রান্ত নীতি ও বাজারে প্রবেশের ন্যূনতম অধিকার নীতি। প্রথম নীতিটির উদ্দেশ্য কৃষিজাত পণ্য ও কৃষি সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি ও রফতানিকে সম্পূর্ণভাবে বাধাহীন করে তোলা। এর জন্য সব ধরনের পরিমাণগত বাধাকে প্রথমে শুল্কে পরিবর্তিত করা এবং তারপর শুল্কের পরিমাণ ধার্য নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা। নামমাত্র শুল্কে একটা ন্যূনতম পরিমাণ আমদানির অনুমতি দেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলা। এই নীতিটি উন্নত-স্বল্পোন্নত সবদেশের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। শুল্ক কমানো ছাড়াও ‘চলতি সময়ে বাজারে প্রবেশের অধিকার’ নীতিটিতে সভ্য দেশগুলি ১৯৮৬–৮৮ সালে আমদানির পরিমাণ যা ছিল অন্তত সেই পরিমাণ আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য থাকল। যদি এই নীতিটি প্রয়োগের পরও দেখা যায় আমদানির পরিমাণ অকিঞ্চিৎকর তাহলে ‘বাজারে প্রবেশের ন্যূনতম অধিকার’ নীতিটি অনুযায়ী এই দেশগুলিকে একটি ন্যূনতম পরিমাণ আমদানির অনুমতি দিতে হবে। এই দুই প্রকার নীতির মধ্যে যে-নীতিটিতে অত্যল্প শুল্কে আমদানির পরিমাণ বেশি, সেই নীতিটিই অনুসরণ করতে হবে। আমদানি সংক্রান্ত নীতিটি প্রয়োগের সুবাদে ভারতের কৃষি-আমদানি সহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি-ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পরিমাণগত বাধানিষেধ শুল্কে পরিণত করা হল এবং শুল্ক-হারে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটানো হল। আমদানি শুল্কের হার ক্রমশ কমিয়ে এনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুমোদিত হার চালু করা হয়। এর ফলে এদেশের বাজারে বিদেশের পণ্যের প্রবেশ বাধাহীন করে তোলা গেল।

আমদানি সংক্রান্ত নীতির পরই রয়েছে ‘অভ্যন্তরীণ সহায়তা’ নীতি। এই নীতিটির ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল সহায়তা ব্যবস্থা মুক্ত-বাণিজ্যের ওপর যে-সম্ভাব্য বাধা সৃষ্টি করে, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই নীতির বলে সভ্য দেশগুলির সরকার সামগ্রিক যে-পরিমাণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভরতুকি দিতে পারে তার একটি ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হল। কিন্তু ভরতুকির পরিমাণ নির্ধারণের পদ্ধতিটি ভিন্ন। কোনও দেশ প্রকৃত কতটা ভরতুকি দিচ্ছে সেটি বিচার্য নয়, বরং ভরতুকির পরিমাণ মাপা হয় অভ্যন্তরীণ সহায়ক মূল্যকে ১৯৮৬–৮৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের যা দাম ছিল তার গড়ের সঙ্গে তুলনা করে। এই পদ্ধতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভরতুকি মাপার এই পদ্ধতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থাটির এই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করে যে, অভ্যন্তরীণ মূল্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের সমান হতে হবে, না হলে দু’টি দামের মধ্যে তফাতকে ভরতুকি বলে ধরে নিয়ে তার পরিমাণ কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কোনও বিশেষ সুবিধা বা ছাড় দেওয়া চলবে না। রফতানি-ভরতুকি যেহেতু মুক্ত-বাণিজ্যের প্রক্রিয়াকে সরাসরি বিঘ্নিত করে তাই রফতানি-ভরতুকি, কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে প্রায় সবক্ষেত্রেই সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভ্যদের মধ্যে মাত্র ২৫টি দেশের রফতানি-ভরতুকি দেওয়ার এক্তিয়ার আছে। ভরতুকি দেওয়ার পদ্ধতি এতটাই জটিল যে, ভরতুকিগুলিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক, যে-ভরতুকিগুলি পরোক্ষভাবে ভোক্তাদের কাছ থেকে উৎপাদকের কাছে মূল্যের একটি অংশের হস্তান্তর ঘটায়— এটা ঘটে যখন আমদানি শুল্ক বা আমদানির ঊর্ধ্বসীমা স্থির করে দেশের বাজারে জোগান সীমিত রেখে দাম বাড়িয়ে রাখা হয় এবং তার মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে উৎপাদকের কাছে এই হস্তান্তর সম্পন্ন করা হয়। এবং দুই, যে-ভরতুকিগুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার থেকে উৎপাদকের কাছে মূল্যের একটি অংশের হস্তান্তর ঘটায়। এই দুই ক্ষেত্রেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি ভরতুকি হ্রাসের নীতি নিয়েছে। উন্নত দেশের কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্যও কিছু কিছু ভরতুকি দেওয়া হয়ে থাকে। এগুলি এমন কিছু ভরতুকি যা সরাসরি কৃষকদের আয় সুরক্ষার জন্য দেওয়া হয়। কৃষি-কাজে বাজারের অনিশ্চয়তা হেতু আয়ের অনিশ্চয়তা থাকে, তা থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কৃষকদের এই প্রত্যক্ষ আয়-ভরতুকি দেওয়া হয়। উৎপাদনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না থাকায় বিশ্ব-বাজারের অভ্যন্তরীণ সহায়তা সংক্রান্ত নীতি অনুযায়ী এই ধরনের ভরতুকিতে সম্পূর্ণভাবে ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক অনেকের মতে এতে উন্নত দেশের পক্ষে পক্ষপাতমূলক প্রভাবের জন্য এই ধরনের ভরতুকিগুলি বিশ্ব-বাজারে উন্নত রফতানিকারক দেশগুলির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দৃঢ়তর করে। স্বল্পোন্নত দেশগুলির সরকার তাদের কৃষকদের এই ধরনের আয়-সুরক্ষামূলক ভরতুকি দিতে পারে না। কিন্তু কৃষিপণ্য রফতানিকারক উন্নত দেশগুলিতে এই ধরনের ভরতুকি কৃষকদের উৎপাদনের ও বাজারের অনিশ্চয়তাজনিত ঝুঁকি নিতে সাহায্য করে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম থাকলেও কৃষকদের আয় সুরক্ষিত থাকার জন্য তারা সেই অনিশ্চয়তার ঝুঁকি বহন করতে পারে। আন্তর্জাতিক দাম কমিয়ে রেখে বিশ্ব-বাজারে নিজেদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়।

এই ভরতুকিগুলি ‘নীল বাক্স’ ও ‘সবুজ বাক্স’ ভরতুকি নামে পরিচিত। ভারত কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে-পরিমাণ ভরতুকি দিয়ে থাকে তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুমোদিত হারের তুলনায় যথেষ্ট কম, তাই আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী ভরতুকি হ্রাসের কোনও প্রয়োজন হয় না।

এছাড়াও উন্নত দেশগুলি আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার আরও কয়েকটি পন্থার সাহায্য নেয়। যেমন, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রস্তুত খাদ্যপণ্যের জোগান সুনিশ্চিত রাখার নিয়মকানুন মানার বাধ্যবাধকতা। এই নিয়মের সাহায্যে উন্নত দেশগুলি পণ্যের গুণমানের অত্যন্ত উঁচু মানদণ্ডে বেঁধে রেখে বিশেষ বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলি থেকে আমদানি কমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এইভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধাহীন আমদানি-রফতানির ব্যবস্থা বজায় রাখার কথা বলে তারা আসলে নানাভাবে স্বল্পোন্নত দেশে তাদের পণ্যের বাধাহীন অনুপ্রবেশ সুনিশ্চিত করে, একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের পণ্যগুলিকে নিজেদের দেশের বাজারে বিক্রির সুযোগ কমিয়ে রাখে। এইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কয়েকটি নীতি কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে উন্নত-অনুন্নত দেশের মধ্যে অসম বাণিজ্য-সম্পর্কের সূচনা করেছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলির মধ্যে আমদানি সংক্রান্ত ও অভ্যন্তরীণ সহায়তা সংক্রান্ত প্রশ্নে তখনও সমাধান না হওয়া বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার জন্য, এবং একই সঙ্গে বাণিজ্যে অসাম্যের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত-বাণিজ্যের শর্তগুলিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ২০০১ সালে দোহা-তে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নবম রাউন্ডের অধিবেশন বসে। কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য কোনও নতুন নীতি গ্রহণ করার সমস্ত চেষ্টা সেখানে ব্যর্থ হয়। এর পিছনে ছিল প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান কমিউনিটির মধ্যে মতানৈক্য। ফলে ২০০৬ সালে কানকুনে আবার – বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পরবর্তী অধিবেশনের আগেই, মুক্ত-বাণিজ্যের কথা মাথায় রেখে অভ্যন্তরীণ সহায়তা ব্যবস্থাকে সীমায়িত রাখা, কৃষি-সম্পর্কিত ও অ-কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে মুক্ত আমদানি নীতি অনুসরণ করা এই বিষয়গুলি নিয়ে ৬টি সভ্য দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকা শিল্পসামগ্রী আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর শর্তটি মেনে নেওয়ার জন্য ভারত ও ব্রাজিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমেরিকা নিজে তার অভ্যন্তরীণ সহায়তার নীতি থেকে সরে আসার কোনও লক্ষণ দেখায় না। প্রধানত আমেরিকার এই মনোভাবের জন্যই কানকুন অধিবেশনটিও দীর্ঘ আলোচনার পর কোনও ঐকমত্যে আসতে পারে না। ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ভবিষ্যৎ অধিবেশন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মেধা-স্বত্ব: বহুজাতিক সংস্থার ভূমিকা

প্রায় ১৮৮০ সাল থেকে গোটা পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, ও আমেরিকার অর্থনীতিতে, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে চলেছিল। এই পরিবর্তন ঘটেছিল মূলত শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতিতে নয়, উৎপাদন-কাঠামো ও উৎপাদন-ব্যবস্থার পরিচালন পদ্ধতিতেও। একদিকে উৎপাদন-ব্যয়ের হ্রাস ঘটানো, অন্যদিকে পণ্য গুণমানে বৈচিত্র আনা, এবং একই সঙ্গে আরও বেশি চাহিদা সৃষ্টি, আরও সস্তায় উৎপাদন করে আরও বেশি বিস্তৃত বাজারের অংশের ওপর অধিকার বিস্তার, এটাই ছিল এই নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে উৎপাদন-কাঠামোর ও পরিচালন পদ্ধতিতে যে-পরিবর্তন ঘটতে থাকে তার আর-একটি দিক ছিল করপোরেট উৎপাদন সংগঠনের উদ্ভব, ক্রমাগত অধিগ্রহণ ও একাধিক করপোরেট ব্যবসার উৎপাদন-সংগঠনকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর দৈত্যাকৃতি উৎপাদন-কাঠামোর জন্ম ও বৃদ্ধি। বাজারের জন্য তীব্র লড়াইয়ে এগিয়ে থাকার উপায় ছিল আরও সস্তায় উন্নত গুণমানসম্পন্ন পণ্যসম্ভার বাজারে নিয়ে আসা। এর জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় উৎপাদন-পদ্ধতি ও উৎপাদন-কাঠামোয় অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটানোর জন্য। ক্রমাগত গবেষণা ও উদ্ভাবনার প্রক্রিয়া এই প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুতগামী করে তোলে। প্রতিটি উৎপাদন-সংগঠন বাজারের আরও বড় অংশ অধিকারের তাড়নায় গবেষণা ও উদ্ভাবনার প্রক্রিয়াকে নতুন দিকে চালিত করার চেষ্টা করে। একদিকে যেমন অধিগ্রহণ ও সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে উৎপাদন-কাঠামোর কলেবর বাড়তে থাকে, তেমনই একই সঙ্গে নতুন নতুন ভোগ্যপণ্য বাজারে আবির্ভূত হয় এবং বিপুল অর্থ ও উৎপাদনশীল সম্পদ এই উচ্চ প্রযুক্তির ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করা হয়। এইভাবে মুষ্টিমেয় দৈত্যাকার করপোরেশনের কলেবর ক্রমাগত বৃদ্ধি হতে থাকে, একই সঙ্গে এদের হাতে বিপুল উৎপাদনশীল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। আমেরিকাতে ১৯৪৯ থেকে ’৫৪ সালের মধ্যে ১৭৭৩টি সংযুক্তিকরণের ঘটনা ঘটে, এর মধ্যে ’৫৪ সালে ’৪৯ সালের তিনগুণ সংযুক্তিকরণ ঘটেছিল— এতটাই বেশি ছিল সংযুক্তিকরণ ও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার গতি। একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, আমেরিকায় ১৯৫২ সালে ৬৭০০০টি বড় ব্যবসায়িক করপোরেশন ছিল, এদের মধ্যে শতকরা ০.১ ভাগের হাতে শতকরা ৫২.২ ভাগ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, এবং শতকরা ৭ ভাগের হাতে ছিল শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি সম্পদ। যেখানে শতকরা ৫৯.১ ভাগের হাতে ছিল মাত্র শতকরা ১.৯ ভাগ সম্পদ। এইভাবে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা তথাকথিত মুক্ত প্রতিযোগিতার ঘোষিত নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেখান থেকেই উদ্ভব হল বৃহৎ অলিগোপলি শিল্প-কাঠামো, সমগ্র অর্থনীতির ওপর কায়েম হল তার বিশাল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রিয়াশীল বহুজাতিক সংস্থার উদ্ভবে অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের এই প্রক্রিয়া আরও বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠল। ১৯৫০ সালে দেখা গেল, অতিকায় আমেরিকান করপোরেশনগুলি বিদেশে এবং দেশে উৎপাদন-ব্যবস্থার ওপর বিপুল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সুবাদে আমেরিকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিচ্ছে। আমেরিকার দেশীয় ও বৈদেশিক অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে প্রভাবিত করার সময়ে তাদের উদ্দেশ্য শুধু বিদেশের সম্পদ ও বিদেশের বাজারের ওপর তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা বিস্তারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বিদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদেশে পাওয়া যায় এমন উৎপাদন-উপকরণগুলির ওপরেও তারা তাদের একচেটিয়া অধিকার জারি রাখার লক্ষ্যে আমেরিকার বহির্বাণিজ্য নীতিকে প্রভাবিত করে। নিজেদের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক শর্ত নির্মাণ করে সেই শর্তে তারা সারা পৃথিবীতে বাণিজ্য করতে চায়, এক দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে পণ্য জোগানের নির্দেশ তুলে নিয়ে তা অন্য দেশের সহযোগীর হাতে দেয়। এরকম সব সিদ্ধান্তই নির্ভর করে কোন দেশে কর আইন, শ্রম আইন ও অন্যান্য নীতি তাদের স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বা কোথায় তাদের মুনাফা সর্বাধিক হবে তার ওপর। এককথায় তারা তাদের নিজেদের শর্তে ব্যবসা করতে চায়। এই কারণে তাদের হাতে এতটাই ক্ষমতা থাকা দরকার, যাতে নিজের দেশের ও বিদেশের নীতিগুলিকে তারা তাদের স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে। সারা দুনিয়ায় অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা এই ব্যবসায়িক ক্রিয়াকর্ম চালাতে পারে না। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি ইউরোপীয় রাষ্ট্র এবং জাপানের মতো এশীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। দেখা যায়, এইসব রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় বিশাল বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বের বেশির ভাগ উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কাজকর্মের ওপরেই শুধু নয়, বিশ্বের গবেষণা ও উদ্ভাবনামূলক কাজকর্মের বেশিটাই নিজেদের প্রভাবে রাখে। ১৯৯০ সালে সমস্ত বহুজাতিক সংস্থার বিক্রির পরিমাণ সারা পৃথিবীর মোট রফতানির সমান ছিল। এবং ২০০১ সালে তাদের মিলিত বিক্রির পরিমাণ বিশ্বের মোট রফতানির দ্বিগুণের সমান হয়ে ওঠে। ১৯৮২ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে তাদের মোট উৎপাদন ৬ গুণ বাড়ে, এই সময়ের মধ্যে তাদের হাতে জমে ওঠা মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছিল ১২ গুণেরও বেশি।

দেশীয় বহুজাতিক সংস্থাগুলি নিজেদের মূল দেশে অর্থনীতির ওপর বিপুল প্রভাব ফেলে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে মূল্যহ্রাসের উপক্রম ঘটলে বড় অলিগোপলি কোম্পানিগুলি ব্যবসায়িক চুক্তির সাহায্যে তা রোধ করতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে তখন বাজার দখলের লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তাই আন্তর্জাতিক অলিগোপলি কোম্পানিগুলি সর্বদা নতুন গুণমানসম্পন্ন পণ্য বাজারে আনার জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের কাজ চালিয়ে যায়। ক্রমশ দেশের অধিকাংশ গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কাজগুলিকে তারা সবচেয়ে লাভজনক উৎপাদন-ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করার চেষ্টা করে, উন্নত দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনী কাজের ওপর ওই দেশের বৃহৎ করপোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। উন্নত দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনী কাজগুলিতে ব্যয়ের ধরনে দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। প্রথমত, গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কাজের ওপর ব্যয় ক্রমশ মূলত বেসরকারি করপোরেট বিভাগের বিনিয়োগের রূপ নেয়। দ্বিতীয়ত, এই বিনিয়োগ দেশের প্রগতির পক্ষে সবচেয়ে আবশ্যিক প্রযুক্তির বদলে এমন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটাতে চায় যা উচ্চ ক্রয়ক্ষমতার মানুষের জন্য বিলাস-পণ্য উৎপাদনে সাহায্য করে, এমন পণ্য, যা থেকে এদের লাভ হয় সর্বাধিক। করপোরেট সংস্থাগুলি সর্বদা বিজ্ঞাপন ও প্রচারের মাধ্যমে সেই পণ্যগুলিরই চাহিদা নির্মাণ করে চলে।

উন্নত দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কাজগুলির ওপর ব্যয় যদিও ক্রমশ এই বিশেষ চরিত্র নিচ্ছে, মৌলিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা, যার ওপর দ্বিতীয় ধাপের গবেষণামূলক কাজগুলি দাঁড়িয়ে আছে, তা এখনও অবধি সরকারি সহযোগিতার ওপরই নির্ভরশীল। হয় সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে, অথবা বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাসংস্থার তত্ত্বাবধানে, সরকারি ব্যয়ে তা সংগঠিত হয়। এর ফলে সেইসব বিশেষ মৌলিক ক্ষেত্রগুলিতে গবেষণা চালানো সম্ভব হয়, যে-সব গবেষণায় করপোরেট সংস্থাগুলির উৎসাহী কম, কেননা বাজারের চালিকা শক্তির প্রভাব তার ওপর বেশি নয়। কিন্তু মূল সরকারি ব্যয়ে চালিত গবেষণার বড় অংশের ফলগুলি করপোরেট সংস্থা নিজেদের মৌলিক জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবেই কাজে লাগায়, যার ওপর নির্ভর করে তাদের দ্বিতীয় স্তরের গবেষণা। এই প্রয়োজনীয়তার সূত্রেই করপোরেট সংস্থাগুলো সরকারি ব্যয়ে চালিত গবেষণাগুলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তারা চায় এই গবেষণার বিষয়বস্তু ও অভিমুখকে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্য থেকে তাদের প্রয়োজন মেটানোর কাজে চালিত করতে। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কার্যক্রম বিভাগের পর্যবেক্ষণটি (২০০১) বিশেষ উল্লেখ্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কার্যক্রম বিভাগ (২০০১)-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়-চালিত গবেষণার বাণিজ্যীকরণ ঘটছে ক্রমশ বেশি বেশি করে। বিশেষ করে আমেরিকায় সরকারি ব্যয়ে সংঘটিত গবেষণার ফলগুলিকে পেটেন্ট করা বা লাইসেন্সের আওতায় আনাকে আইনসিদ্ধ করার পর— ১৯৮০ সালের বেল ডোল আইন অনুসারে— আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে, করপোরেট ব্যবস্থার সঙ্গে অধিক সংযোগের ফলে সরকারি ব্যয়ে চালিত এইসব গবেষণার বিষয়বস্তু ও অভিমুখ সামাজিক প্রয়োজন থেকে সরে এসে বাণিজ্যিক প্রয়োজনসিদ্ধির দিকে চালিত হচ্ছে। এইসব উদ্দেশ্য মেটানোর জন্য করপোরেশনগুলি ক্রমশ আরও বেশি বেশি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সরকারি সংস্থার গবেষণাব্যয়ের ভাগ বহন করছে। এটাও দেখা যাচ্ছে যে, সরকারি স্তরের গবেষণা অতি দ্রুত কমে আসছে, বেসরকারি গবেষণা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কার্যক্রম বিভাগের মতে এর কারণ, সরকারি স্তরে মূল বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কিছু কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয় যেগুলি বেসরকারি করপোরেট সংস্থার মালিকানায় পেটেন্ট করা থাকে। ফলে এগুলির ব্যবহার অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা সরকারি সংস্থার পক্ষে সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ফলগুলি বেসরকারি করপোরেট সংস্থা বিনা খরচে তাদের গবেষণা ও উদ্ভাবন ক্রিয়ার মূল ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ, করপোরেট সংস্থার গবেষণা ও উদ্ভাবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ফলগুলি সরকারি গবেষণার প্রয়োজনে না পাওয়ার জন্য সরকারি স্তরে গবেষণার পরিধি সংকীর্ণ হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সরকারি প্রাথমিক স্তরের মূল গবেষণার ফলগুলিকে কোনও নতুন বস্তুতে পরিণত করতে হলে বেসরকারি স্তরে বিশাল বিনিয়োগকারীর ওপরেই নির্ভর করতে হয়। এই অবস্থার সুযোগ নেয় বেসরকারি করপোরেট সংস্থাগুলি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত যেসব মৌলিক গবেষণার বিষয়বস্তুকে তারা তাদের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বলে মনে করে, সেগুলিতে তারা বাধা দেয়। দেশের প্রাথমিক বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার গতিমুখ নির্ধারণে বহুজাতিক বড় করপোরেট সংস্থার এই নিয়ন্ত্রক ভূমিকার ফলে বিশ্ব-স্তরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধরনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কার্যক্রম বিভাগ (বিশ্ব উন্নয়ন সমীক্ষা ২০০১)-এর সমীক্ষাটির মূল কথা: প্রথমত, গবেষণা ও উদ্ভাবনের কাজগুলি উন্নত দেশেই কেন্দ্রীভূত। দ্বিতীয়ত, কিছুদিন যাবৎ গবেষণা ও উদ্ভাবনের কাজের বিপুল ব্যয় বেসরকারি সংস্থাগুলিই চালিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে গবেষণাগুলি মূলত উচ্চ ক্রয়ক্ষমতার মানুষের ভোগ্যপণ্যের আকাঙ্ক্ষা মেটানোর বস্তু উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের উদ্দেশ্যে চালিত হচ্ছে। উচ্চআয়ের ভোক্তারাই মূলত বহুজাতিক বড় উৎপাদন সংস্থাগুলির উৎপাদিত পণ্যের বাজার।

সারণি ১১.১ ১/১/১৯৭৭ থেকে ১২/১২/২০১৫ পর্যন্ত মোট অনুমতিপ্রাপ্ত পেটেন্টের সংখ্যা

Source: Patent Counts By Country. States, and Year–All Patent Types (December- 2015), Patent Technology and Monitoring Team (PTMT), US Patent and Trademark Office

২০০২ সালে আমেরিকা, ৮টি প্রধান ইউরোপীয় দেশ ও জাপান একত্রে সমস্ত স্বীকৃত পেটেন্টের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি অধিকার করত, এদের পেটেন্টের সঙ্গে কানাডা ও মেক্সিকোর সংখ্যাটি যোগ করে বলা যেতে পারে উল্লিখিত মুষ্টিমেয় উন্নত পুঁজিবাদী দেশ একত্রে মোট পেটেন্টের শতকরা ৯৩ ভাগ অধিকার করত। ২০১৫ সালে অন্যান্য দেশ পেটেন্টের ক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ায় মোট পেটেন্টে নিজেদের ভাগ কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পেরেছে, কিন্তু তবুও দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা, ৮টি প্রধান ইউরোপীয় দেশ ও জাপান, মেক্সিকো ও কানাডা একত্রে ২০১৫ সালে মোট পেটেন্টের শতকরা ৮৮ ভাগের বেশি অধিকার করে আছে। আসলে দেখা যাবে, এই ২০০২ থেকে ২০১৫ এই ১৩ বছরে জাপান তার মোট পেটেন্টের সংখ্যা বাড়িয়েছে শতকরা ১৩০ ভাগ, আমেরিকা বাড়িয়েছে শতকরা ১১১ ভাগ, ৮টি ইউরোপীয় দেশ বাড়িয়েছে শতকরা ৯৬ ভাগ। মোট মেধা-স্বত্বের অধিকার এইভাবে অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক পুঁজিবাদী দেশের হাতে কেন্দ্রীভূত। ফলে এই দেশগুলিই আবিষ্কৃত নতুন প্রযুক্তির সিংহভাগের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে, বিভিন্ন দেশে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির প্রসার অনেকটাই এদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নতুন মেধা-স্বত্ব আইনের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে জোরদার করে।

কৃষিতে বৈদেশিক মূলধনের সরাসরি বিনিয়োগ ও বহুজাতিক কোম্পানির প্রবেশ আইনের অনুমতি পাওয়ায় উৎপাদন-ক্ষেত্রে কৃষি উপকরণের বিনিয়োগ-সহযোগিতা শুরু হয়েছে। কৃষির উৎপাদন ও বাণিজ্যের কোনও কোনও ক্ষেত্রে শতকরা ১০০ ভাগ বিদেশি বিনিয়োগ-সহযোগিতা অনুমতি পেয়েছে। এর ফলে যে-পরিমাণ বিনিয়োগ ঘটেছে তা নীচে সারণি ১১.২-তে দেওয়া হল।

শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সম্মতি বা গ্যাট-এর অষ্টম দফা অধিবেশনের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-ব্যবস্থাকে বাধাহীন মুক্ত-ব্যবস্থায় পরিণত করা। এই অধিবেশনে উপস্থাপিত প্রস্তাবগুচ্ছের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব আসলে বাণিজ্যরত দেশগুলির অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সংক্রান্ত। এই নীতিগুলি হল বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগের নীতি, আন্তর্জাতিক বাজারে সেবামূলক কাজকর্মের বাণিজ্য সম্পর্কিত নীতি, বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা-স্বত্বের আদানপ্রদান সংক্রান্ত নীতি। বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি-উপকরণ নির্মাণে জড়িত শিল্পে বেসরকারি সংস্থা ও বিদেশি বহুজাতিক সংস্থার বিনিয়োগ সংক্রান্ত বাধা সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। একইসঙ্গে বিদেশি বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থার ওপর থেকে এদেশে সার ও বীজের ব্যবসা করার বাধা অনেকটা দূর করা হয়, ফলে নতুন অধিক ফলনশীল বীজ ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ বাড়ে। অন্যদিকে কৃষি উৎপাদনে ও উৎপাদনশীল বিনিয়োগে সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের বাধাগুলি কমিয়ে ফেলার নীতি নেওয়া হয়। যে-প্রক্রিয়া নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগের আগেই শুরু হয়েছিল তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নীতির প্রয়োগে আরও জোরদার হল, বিদেশি কোম্পানিগুলির এদেশে বিনিয়োগের পথ হল আরও মসৃণ। বাজারে বিভিন্ন ধরনের বীজ-সারের জোগান ও ব্যবহার বাড়ল, সরকারের ভূমিকার জায়গায় বাড়ল দেশি ও বিদেশি সার ও বীজ কোম্পানির প্রাধান্য। কৃষিপণ্যের আমদানি-রফতানির ওপর বাধানিষেধ কমার ফলে দুটোই বাড়ল। এছাড়া সেবামূলক উৎপাদনে বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ নীতি প্রয়োগের ফলে নতুন এই পণ্যটির ওপর দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে দেশি-বিদেশি বেসররকারি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অবাধ হয়ে পড়ল।

সারণি ১১.২ কৃষিতে বৈদেশিক মূলধনের সরাসরি বিনিয়োগ

Source: Open Government Data (OGD) Platform India, July 12, 2017

কিন্তু বাণিজ্যিক মেধা-স্বত্ব সংক্রান্ত নীতির অন্তর্গত একগুচ্ছ একচেটিয়া আইন কৃৎকৌশলের উদ্ভাবককে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধা-স্বত্ব নীতি আসলে পৃথিবীব্যাপী উৎপাদন-ক্ষেত্রে কৃৎকৌশল প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চাপানো একগুচ্ছ নিয়ন্ত্রক নীতি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আন্তর্জতিক স্তরে পেটেন্ট আইন সংক্রান্ত একগুচ্ছ কড়া শর্ত চাপায়। এর বলে তারা প্রত্যেক সভ্য দেশকে তাদের নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ পেটেন্ট আইন এমনভাবে পরিবর্তন করতে বাধ্য করে যাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রণীত নতুন নিয়ন্ত্রক শর্তগুলি যথাযথ মানা হয়। এই নতুন মেধা-স্বত্ব-রাজের নীতিগুলি হল: ক) পেটেন্টের কার্যকারিতার মেয়াদ হবে ৪০ বছর। খ) শুধুমাত্র কৃৎকৌশল প্রয়োগপদ্ধতির বা কোনও নতুন উপাদানের ব্যবহার-পদ্ধতির ওপরেই নয়, কৃৎকৌশল ও উপাদানগুলি ব্যবহার করে তৈরি পণ্যটির ওপরেও পেটেন্ট প্রযোজ্য হবে। গ) পেটেন্ট বা লাইসেন্স শুধুমাত্র পেটেন্ট প্রদানকারী দেশেই প্রযোজ্য হবে না, প্রযোজ্য হবে আমদানিকারক দেশেও। অর্থাৎ পেটেন্ট বা লাইসেন্স-যুক্ত কৃৎকৌশল বা সেই কৃৎকৌশল-নির্মিত পণ্য শুধুমাত্র যে-দেশে ওই পেটেন্ট বা লাইসেন্স আইনসিদ্ধ হয়েছে সে দেশেই বলবৎ থাকবে তা নয়, পেটেন্টের ধারক কোম্পানি বা ব্যক্তি যে-কোনও দেশেই এই পণ্য বা কৃৎকৌশল আমদানির মাধ্যমে তা বাজারজাত করার একচেটিয়া অধিকার ভোগ করবে। ঘ) পেটেন্ট সংক্রান্ত কোনও বিরোধের ক্ষেত্রে অভিযোগকারী ব্যক্তি বা কোম্পানিকে তার অভিযোগের যাথার্থ্য প্রমাণের দায়িত্ব নিতে হবে না, বরং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে নির্দোষ।

গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এই নতুন নীতিগুচ্ছ এমন ভাবে প্রণীত হয়েছে যে, কোনও কোম্পানি একবার পেটেন্ট নিতে পারলে প্রায় স্থায়ীভাবে তার ওই পেটেন্ট-কৃত প্রকৌশল বা প্রকৌশল ব্যবহার করে তৈরি পণ্য ব্যবহারের, বিক্রির, অন্যদেশের বাজারে আমদানি করার পূর্ণ ও একচেটিয়া অধিকার সুনিশ্চিত হয়ে যায়। এই ব্যবস্থা ভবিষ্যৎ-গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ সীমিত করে। কোনও কোম্পানি দীর্ঘ কুড়ি বছরের পেটেন্ট পাওয়ার পর ওই পেটেন্ট-কৃত প্রকৌশলে বা পণ্যে সামান্য হেরফের ঘটিয়ে নতুন পণ্য তৈরি করে আবার পেটেন্ট দাবি করতে পারে। এইভাবে তারা চিরকালের জন্য কোনও প্রকৌশলের ওপর একচেটিয়া অধিকার ভোগের সুযোগ পায়। পেটেন্ট আইনের বিশেষ প্রয়োগ করে কোনও বহুজাতিক সংস্থা সারা বিশ্বের বাজারে অনুপ্রবেশের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে, শুধু তাই নয়, পেটেন্ট যুক্ত পণ্যটির সঙ্গে অত্যন্ত ক্ষীণ সম্পর্কযুক্ত অন্য কোনও পণ্য উৎপাদনের পথও বন্ধ করে। এইভাবে কোনও নতুন কোম্পানির পক্ষে ওই বিশেষ ক্ষেত্রে নতুনভাবে গবেষণা ও উদ্ভাবনের সাহায্যে উন্নততর প্রকৌশল যুক্ত পণ্য তৈরির রাস্তা বন্ধ হয়।

এইভাবে নতুন পেটেন্ট আইন সারা বিশ্ব জুড়ে দীর্ঘদিনের জন্য ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত, উৎপাদন-ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রকৌশলগুলির, বা পণ্যগুলির, সুসংরক্ষিত বাজারকে সুনিশ্চিত করে। বড় বড় বাজারে আধিপত্য রাখা বিভিন্ন অগ্রণী দেশের বহুজাতিক সংস্থাগুলি বহুদিন ধরেই বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রকৌশলগুলি অনুমতি ছাড়া বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়া ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপানোর নীতি দাবি করে আসছিল। যেহেতু মোট পেটেন্টের একটা বড় অনুপাত উন্নত দেশগুলির বহুজাতিক সংস্থার কুক্ষিগত, তাই এই নতুন নীতিগুলি বাস্তবে উন্নত দেশগুলির হাতে সারা বিশ্বের প্রকৌশলগত গবেষণা-উদ্ভাবনের গতিপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার একটি শক্তিশালী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এই নীতিগুলি ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বহুজাতিক সংস্থার হাতেও তাদের ব্যবসায়িক প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণা-উদ্ভাবনার গতিপথ পরিচালিত করার ক্ষমতা তুলে দেয়। অলিগোপলি সংস্থা হিসেবে তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ স্তরে বেঁধে রাখার স্বার্থে সর্বদাই গবেষণা ও উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে পুরনো পণ্যের গুণমান ও বৈশিষ্ট্যকে তারা আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। পণ্যের বাজারের বিস্তার ও বাজারের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার স্বার্থে অলিগোপলি কোম্পানিগুলি সর্বদাই নতুন নতুন ভোগ্যপণ্য উদ্ভাবন করে। একদিকে তারা ধনী ক্রেতা, যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, তাদের রুচি-পছন্দের পরিবর্তন ঘটিয়ে পণ্যের বাজার বিস্তৃততর করার চেষ্টা করে, অন্যদিকে ক্রেতার রুচি ও পছন্দে পরিবর্তন আনার জন্য বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় বাড়ানোর খাতে বিশাল অর্থ ব্যয় করে। এই ধরনের কাজে উন্নত দেশের মোট গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে ব্যয়ের একটি বিশাল অংশ চলে যায়, ফলে অন্যান্য খাতে মোট গবেষণা ও উদ্ভাবনী ক্রিয়া অনেকাংশে ব্যাহত হয়।

বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা-স্বত্ব নীতি ও ভারতীয় কৃষি: কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা-স্বত্ব চুক্তির একটি শর্ত হল, নতুন ধরনের কোনও চারার সূচনা ঘটালে ওই চারার উৎপাদনকারীকে চারাটির জন্য আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এই নীতি সমস্ত সভ্য দেশের ওপরেই প্রযোজ্য। উপরন্তু মেধা-স্বত্ব আইন অণুজীবের (Microorganism) এবং অণুজৈবিক প্রক্রিয়ার (Microbiological process) উদ্ভাবনের জন্য পেটেন্ট পাওয়ার অধিকার স্বীকার করে। চারাগাছ উদ্ভাবন করার জন্য এই আইন চারাগাছ নিয়ে গবেষণারত কোম্পানিকে নতুন চারাগাছ উদ্ভাবনের জন্য পেটেন্ট পাওয়ার অধিকার দেয়। যদিও কোনও বস্তুর জন্য পেটেন্ট পাওয়ার শর্ত হল বস্তুটির নতুনত্ব, সেইসঙ্গে এটি তৈরির কাজটি উদ্ভাবনমূলক হতে হবে ও বস্তুটিকে শিল্পে ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। চারাগাছ বা অণুজীবের জন্য পেটেন্ট পাওয়ার কয়েকটি শর্ত আছে। প্রথমত, অণুজীব বা চারাগাছটির বৈশিষ্ট্য অনুরূপ চারাগাছ বা অণুজীব থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন বলে দাবি করা হচ্ছে যে প্রজাতিটিকে তার অন্তর্গত সব ক’টি জীব যেন একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়। এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলি যেন অপরিবর্তিত থাকে— যার অর্থ, বৈশিষ্ট্যের সামান্য হেরফের ঘটলে ওই পেটেন্ট প্রযুক্ত হবে না। শুধুমাত্র এই ধরনের প্রাণী অথবা চারাগাছ উদ্ভাবনের জন্যই উদ্ভাবক পেটেন্ট পান তা নয়, এগুলি বিক্রি ও রফতানি করার জন্যও এই একচ্ছত্র অধিকার বজায় থাকে। শুধুমাত্র পেটেন্টধারীই এটি বিক্রি করা বা রফতানি করার অধিকার ভোগ করে, অন্য কেউ বিনা অনুমতিতে ও পেটেন্টধারীকে রয়াল্টি না দিয়ে বিক্রি বা রফতানি করতে পারে না। যদিও আগে থাকতেই উপস্থিত অন্য কোনও বস্তু আবিষ্কারের ওপর পেটেন্ট দেওয়া হয় না, কিন্তু চারাগাছ বা কোনও জীব, যা মানুষের জানার বাইরে থেকে গেছে, তা আবিষ্কারের জন্য পেটেন্ট দেওয়া হয়। চারাগাছ বা অণুজীবের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন প্রক্রিয়াটি পেটেন্টের সুযোগ পায় না, কিন্তু উদ্ভাবিত বস্তুটি পেটেন্টের সুযোগ পায় (অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আইনে product patent ও process patent এই দুই ধরনের পেটেন্টই স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মাইক্রোঅর্গানিজমের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উদ্ভাবিত বস্তুর জন্য পেটেন্টই স্বীকৃত, উদ্ভাবনের প্রক্রিয়ার জন্য তা স্বীকৃত নয়)। অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে যেখানে বিক্রি করার ফলে বস্তুটির ওপর নির্মাতার অধিকার শেষ হয়ে যায়, অণুজীবের ক্ষেত্রে বা চারাগাছের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পেটেন্ট অধিকার বজায় থাকে।

কৃষিক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বস্তুকণার ওপর পেটেন্টের অর্থ জৈব সারের ওপর পেটেন্ট এবং জীবনপ্রক্রিয়ার আবিষ্কারের জন্য পেটেন্টের অর্থ জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন চারা ও নতুন পশু সৃষ্টির পদ্ধতির ওপর পেটেন্ট। অবশ্য এই আইন চারাগাছ বা প্রাণীদের জন্য পেটেন্ট স্বীকার করে না, এদের উদ্ভাবন পদ্ধতির ওপর পেটেন্ট স্বীকার করে।

২০০১ সাল অবধি ভারতে এই ধরনের আবিষ্কৃত অণুজীব বা অন্যান্য জৈব প্রজাতির ওপর অধিকার রক্ষার স্বার্থে কোনও আইন ছিল না। ২০০১ সালের শস্যবৈচিত্র ও কৃষকের অধিকার আইনটি একটি ‘সুই জেনেরি’ ব্যবস্থা, অর্থাৎ শুধুমাত্র নতুন ধরনের জন্যই সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, নতুন ধরনের জীবকণা থেকে যেসব ধরনের জীবকণা পাওয়া যেতে পারে বা কৃষকরা নিজেরাই তৈরি করতে পারে সেসবের ওপর পেটেন্ট স্বীকার করে। এই আইনটিতে বিস্তৃতভাবে কৃষকের অধিকার, উৎপাদনকারীর ছাড়, সুরক্ষার জন্য লাইসেন্স ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ আছে। কৃষক এই সুরক্ষিত বীজ বা চারা বিক্রি করার, বপন করার, পুনরায় বপন করার, জমিয়ে রাখার, বিনিময় করার বা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অধিকার ভোগ করে।

পশ্চিমি দেশে সবসময়েই জীবন্ত বস্তু, জন্তু এবং উদ্ভিদবৈচিত্র পেটেন্টের আওতার বাইরে রাখা ছিল, এসব জিনিস পেটেন্ট করা যেত না। ইউরোপিয়ান পেটেন্ট কনভেনশনে এটা স্পষ্ট ভাবে উল্লিখিত হয় যে, পেটেন্ট আইনের ৫৩(বি) ধারায় বলা হয়েছে চারা ও জন্তু নতুন করে তৈরি করার জন্য যে-মৌলিক জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়, সেই প্রক্রিয়া পেটেন্ট করা যাবে না। কিন্তু বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা-স্বত্ব জিনগত পরিবর্তনের সাহায্যে নির্মিত নতুন চারা ও জীবজন্তু নির্মাণের পদ্ধতিকে পেটেন্টের আওতায় নিয়ে আসে এই যুক্তিতে যে, জিনগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয় না, এটিতে অণুজীবের জীবনপ্রক্রিয়া ব্যবহার হয়। ইউরোপিয়ান কমিউনিটি নির্দেশ দেয়, এইভাবে জিনগত পরিবর্তন করে নতুন জীববৈচিত্রের সৃষ্টিপদ্ধতির ওপর স্রষ্টার অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে। এতে পুরনো পেটেন্ট আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার প্রয়োজন পড়ে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮০ সালের পরই মেধা-স্বত্ব আইনের বলে নতুন চারা-বৈচিত্র ও জিনগত পরিবর্তনের সাহায্যে নির্মিত প্রাণীর সৃষ্টি-পদ্ধতিকে পেটেন্টের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এসবের পরিণামে ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর মেধা-স্বত্ব আইনে পরিবর্তন আনা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সব সভ্য দেশকে নির্দেশ দেওয়া হয় ২০০০ সালের মধ্যে সেই পরিবর্তনগুলি তাদের নিজ নিজ দেশের পেটেন্ট আইনের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

মেধা-স্বত্ব আইনের পরিধিকে এইভাবে বিস্তৃত করার পর অজস্র নতুন ধরনের বীজ, জিন-পরিবর্তিত অথবা বিভিন্ন জিনের সংমিশ্রণে নির্মিত নতুন শস্য ও জৈব সার উৎপাদনের বিপুল বিস্তার ঘটেছে। উন্নত দেশগুলির বৃহৎ করপোরেট বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক বড় বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি এই ধরনের নতুন বীজ, শস্য, ও জৈব সার উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। আশা ছিল, এইসব বিভিন্ন জিনের সংমিশ্রণে তৈরি নতুন বীজ ও নতুন জৈব প্রযুক্তির ব্যবহারে তৈরি নতুন চারা কৃষিতে উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে উৎপাদিকা শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে, এইসব নতুন প্রজাতি ও কৃষি-উপকরণ কৃষিতে দীর্ঘকালীন উন্নতির রাস্তা খুলে দেবে। এই আশাতেই সারা পৃথিবী জুড়ে নতুন জৈব প্রযুক্তিতে চাষের উপকরণগুলির বাজার বিস্তৃত হয়ে চলেছে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই দ্রুত প্রসারণশীল বাজারে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলিই প্রধান ভূমিকায় রয়েছে। ঔষধ ও জৈব প্রযুক্তিতে তৈরি কৃষি-উপকরণ উৎপাদনে বহুজাতিক সংস্থাগুলির কর্তৃত্ব দ্রুত বেড়ে চলেছে। সংযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে তাদের কলেবরও ক্রমবর্ধমান।

ভারতে বীজ ও সারের উৎপাদন ও ব্যবহারে বিদেশি কোম্পানির ভূমিকা

ভারতে কৃষিতে ব্যবহারের জন্য শস্য, বীজ, চারাগাছ ইত্যাদির উৎপাদন হয় বহুলাংশে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। বীজ তৈরির ক্ষেত্রে যুক্ত ৫০টিরও বেশি সরকারি গবেষণাকেন্দ্র আধুনিক জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা করছে, কোনও কোনও সংস্থা চাল, তৈলবীজ, তুলা ইত্যাদি শস্য নিয়ে জিন-ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫০টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি তত্ত্বাবধানে গবেষণার বিপুল গুরুত্ব অস্বীকার না করেও দেখা যাচ্ছে, বিচিত্র জিনের মিশ্রণে নতুন প্রাণসৃষ্টি সংক্রান্ত উচ্চস্তরের গবেষণা ও এই গবেষণার একটি স্তরে এসে বাস্তব ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা সাধারণত বেসররকারি সংস্থার হাতেই সীমাবদ্ধ। ভারতে যদিও বীজ নির্মাণের প্রাথমিক ও দ্বিতীয় স্তরটি সরকারি তত্ত্বাবধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকে, তবু বীজের বাজার সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি হাতে রয়েছে। ১৯৮৫–’৮৬ সাল থেকে সরকার প্রাথমিক স্তরের বীজ ধান থেকে দ্বিতীয় স্তরের মূল বীজ নির্মাণের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রাথমিক স্তরের বীজ ধান বিলি করা শুরু করে। তখন থেকেই দেশি কোম্পানিগুলি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে বীজ উৎপাদনে অতি দ্রুত প্রাধান্যের জায়গায় চলে আসে এবং বীজ উৎপাদনের বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৯৮৭ সালের পর বহুসংখ্যক ভারতীয় কোম্পানি বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করে বীজের বাজারে প্রাধান্য করতে থাকে। সেগুলি হল, ই আই ডি-প্যারি, হিন্দুস্থান লিভার, আই টি সি, জে কে, রাবিস, স্যান্ডোজ় ইত্যাদি। কিছু কিছু বিদেশি কোম্পানি ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগে এদেশে বীজের ব্যবসা চালাচ্ছে। এই বিদেশি কোম্পানিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পাইওনিয়ার পি জি এস (Pioneer PGS company), এবং কারগিল। বীজশিল্পে এই গঠনগত পরিবর্তনের জন্য সরকারি নীতি বিশেষ সাহায্য করেছে। ১৯৮৭ সালে সংকর বীজ ও জৈবপ্রযুক্তি দিয়ে তৈরি বীজ, সার, চারা প্রভৃতির উৎপাদন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয় এবং এদেশের বাজারে বিদেশি কোম্পানির ক্রিয়াকর্ম বাধামুক্ত করা হয়। এছাড়া ১৯৮৮ সালে যে সব বীজ-কোম্পানি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতায় বীজ তৈরি করে, তাদের অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট মোটা ধরনের খাদ্যশস্য, ডাল ও তৈলবীজের বীজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতায় আবদ্ধ কোম্পানিগুলি তাদের পেটেন্ট-যুক্ত বিশেষ বীজ সরবরাহ করবে। ১৯৮৯ সালের আইন সবজি, ফুল ও গৃহসজ্জায় ব্যবহৃত ছোট গাছপালার বীজ বা চারাগাছ বিনা লাইসেন্সে আমদানি করার অনুমতি দেয়।

সারের বাজার

সারা পৃথিবীতে দুই ধরনের সারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। ১) ক্রুড সার, যা প্রাকৃতিক ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার নির্মাণে কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগে, ২) শিল্প-কারখানায় তৈরি কৃষিতে ব্যবহৃত সার, যা ক্রুড সার কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়। ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি ক্রুড সারের বাণিজ্যমূল্য বাড়লেও ২০০৯ সাল থেকে ক্রুড সারের রফতানি কমতে থাকে। এর কারণ, ক্রুড সারের মূল রফতানিকারী দু’টি অঞ্চল আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি ক্রুড সার রফতানি না করে নিজ দেশেই প্রকরণ করা শুরু করে। এতদিন এই ক্রুড সারের মূল আমদানিকারী দেশ ছিল পশ্চিম ইউরোপ।

কারখানায় তৈরি করা কৃষিকাজে ব্যবহৃত সারের মূল রফতানিকারী দেশগুলি হল, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ, উত্তর আমেরিকা, কানাডা এবং এশিয়ার কিছু দেশ। কিন্তু মূল আমদানিকারী দেশগুলির মধ্যে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশ। চিন, ফিলিপাইনস, জাপান ও ভারতের জন্যই সারের ক্ষেত্রে এশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিট আমদানিকারী অঞ্চল।

আমরা আগেই দেখেছি, গত কয়েক বছরে ভারতীয় কৃষিতে সার, কীটনাশক, মেশিনারি ইত্যাদি আধুনিক উপকরণের ব্যবহার অত্যধিক বেড়েছে। এর কারণ নানাবিধ, যেমন: এইসব উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে বাধানিষেধ কমে যাওয়া, শুল্ক হ্রাস, এদেশে বিদেশি কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্যের পথে বাধানিষেধ কমে যাওয়া, কৃষি-উপকরণের বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের অবাধ যাতায়াতের পিছনে সরাসরি উৎসাহদান ইত্যাদি। আমরা এই বিষয়টি সম্বন্ধে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য ১৯৮১ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি ভারতীয় কৃষিতে সারের ব্যবহার, সারের উৎপাদন, সারের আমদানির দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির প্রবণতা ও এসবের পরিণামে খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতার দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির প্রবণতা মেপেছি রিগ্রেশন পদ্ধতির সাহায্যে। পরিসাংখ্যিক রিগ্রেশন সমীকরণগুলি একাদশ অধ্যায়ের ‘সংযোজন’ অংশে দেওয়া হল।

সারণি ১১.৩ সারের আমদানি, রফতানি, উৎপাদন ও ব্যবহার

দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি প্রবণতা (১৯৮১–২০১৬)বৃদ্ধির হার
সারের ব্যবহার৪.২৮%
সারের উৎপাদন৩.৯৫%
সারের আমদানি৫.৪৭%
খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা১.৯৯%

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

১৯৮১ সালে সারের ব্যবহার হয়েছিল ৬০.৬৪ লাখ টন। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ৪০.৯৩ লাখ টন, ২০.০১ লাখ টন ঘাটতির বিপরীতে ওই বছর আমদানি করা হয় ২০.৪১ লাখ টন সার। কিন্তু তার পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমদানি বৃদ্ধি-হারের প্রবণতা, উৎপাদন-বৃদ্ধিহার ও সারের ব্যবহারের দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি-হার ছাপিয়ে যায়। দেখা যায়, উৎপাদন বৃদ্ধি-হারের তুলনায় সার ব্যবহারের বৃদ্ধি-হার বেশি। অর্থাৎ ঘাটতির বৃদ্ধি ঘটতে থাকে, সুতরাং আমদানি বাড়িয়ে ঘাটতি মেটাতে হয়। সার ব্যবহারের এই বৃদ্ধি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে খুব সহায়ক হয়নি। দেখা যাচ্ছে, ’৮১ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতার দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি-হার শতকরা ১.৯৯ স্তরে থেকে গেছে।

বিভিন্ন শস্যের আমদানি, রফতানি, নিট আমদানি-প্রবণতা বৃদ্ধি/হ্রাসের হার

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার খোলা-বাজার বাণিজ্যনীতির ফলস্বরূপ ভারতের কৃষি-উৎপাদন অনেকটাই রফতানিমুখী ও কৃষিপণ্যের বাজার অনেক পরিমাণে আমদানি-নির্ভর হয়ে উঠেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার খোলা-বাজার নীতি অনুযায়ী ভারত কৃষিতে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি-শুল্ক কমিয়েছে। খোলা-বাজার নীতির সাধারণ প্রয়োগে রফতানি বেড়েছে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে আমদানির পরিমাণও বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। আমদানি-রফতানি বিষয়ে কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা স্বস্তিজনক মনে হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান নিট আমদানিকারীর। আমরা কয়েকটি বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি দেখার আগে সমগ্র কৃষি-আমদানি ও কৃষি-রফতানির তুলনামূলক অবস্থা দেখার চেষ্টা করেছি।

চিত্র ১১.১ সারের ব্যবহার, উৎপাদন ও আমদানি

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

চিত্র ১১.২ সারের আমদানি, ব্যবহার ও খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

চিত্র ১১.৩ কৃষি ও অ–কৃষির আমদানি ও রফতানির অনুপাত

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

আমরা দেখছি, মোট রফতানির তুলনায় কৃষিজ রফতানি সময়ের সঙ্গে কমে আসার দীর্ঘকালীন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ১৯৯৬–৯৭ সালে এই অনুপাতটি সবচেয়ে বেশি মানে পৌঁছানোর পর কমতে থাকে। ২০০৮, ২০০৯, ২০১০-এ সবচেয়ে নিচু স্তরে পৌঁছানোর পর সাময়িকভাবে তুলনামূলক বৃদ্ধির প্রবণতা দেখায়, ২০১২–১৩ সাল থেকে আবার কমতে থাকে। মোট আমদানিতে কৃষিজ আমদানির পরিমাণ ১৯৯৭–৯৮ সালের পর বাড়তে থাকে। ২০০৪–০৫, ২০০৬–০৭ ও ২০০৭–০৮ সালে সবচেয়ে কম স্তরে পৌঁছে আবার বাড়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং ২০১৩, ’১৪, ’১৫, ’১৬, ও ২০১৭ সালে এই অনুপাতটির বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট। অন্যদিকে কৃষিজ আমদানির তুলনায় কৃষিজ রফতানি স্বল্প বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও দু’টি পরিমাণের মধ্যে তফাত খুব বেশি না হওয়ায় ’৯০-এর দশকের প্রথম দিকে আমদানির তুলনায় রফতানি বেশি থাকার দরুন অনুপাতটি ৪/৫-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করার পর আরও কমতে থাকে এবং ১/২-এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ২০১৩ থেকে স্পষ্টভাবে কমার প্রবণতা দেখায়। অর্থাৎ রফতানি বাড়লেও তুলনায় আমদানি আরও বাড়ার ফলে অনুপাতটি ১.৩-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, আমদানি ও রফতানি মূল্যের মধ্যে তফাত থাকে মোট রফতানির প্রায় শতকরা ২৭ ভাগ। অন্যভাবে বলা যায়, ২০১৭ সালে কৃষিজ পণ্যের রফতানি মূল্য থেকে আমদানির মূল্য মিটিয়ে বাণিজ্যখাতে উদ্বৃত্তের পরিমাণ মোট রফতানি মূল্যের শতকরা ২৭ ভাগে নেমে এসেছে।

সারণি ১১.৪ কৃষিজ পণ্যের আমদানি-রফতানি

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017

রফতানি ও আমদানির বৃদ্ধি-হারের মধ্যে তুলনায় আমদানি-হার কোনও কোনও সময়ে বেশি থাকছে। ’৯০-এর দশকে কৃষিজ আমদানি-বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। এই হার রফতানি বৃদ্ধি-হারের তুলনায় বেশি ছিল। মোট রফতানিতে কৃষিজ পণ্যের রফতানি-ভাগ ’৯০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছরে শতকরা ৩৫ ভাগ হারে বাড়লেও পরবর্তী পাঁচ বছরে এই হার শতকরা বাৎসরিক ৫ ভাগের বেশি হারে হ্রাস পায়। পরে, এই শতাব্দীর প্রথম পাঁচ বছরেও মোট রফতানিতে কৃষিজ রফতানির ভাগ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এই শতাব্দীর প্রথম পাঁচ বছর ছাড়া অন্য কোনও সময়ে মোট আমদানিতে কৃষিজ আমদানির ভাগ হ্রাস পায়নি, ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

কৃষিতে ’৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি রফতানি ও আমদানি বৃদ্ধির হারের দীর্ঘকালীন প্রবণতা দেখলে আমরা এই বিষয়ে আরও একটু স্পষ্ট ধারণা করতে পারি। এই প্রবণতা দেখার জন্য আমরা ’৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি ধারাবাহিক রফতানি ও আমদানির মূল্যের (কোটি টাকায়) দু’টি ক্রমের পরিসংখ্যান থেকে বৃদ্ধি-হারের দীর্ঘকালীন প্রবণতা মাপার চলতি পদ্ধতি অনুসরণ করে নিম্নোল্লিখিত সমীকরণ দু’টি হিসাব করি, ও তার ভিত্তিতে আমদানি ও রফতানির দীর্ঘকালীন চক্রবৃদ্ধি হারের মাপগুলি পাই। সমীকরণটি একাদশ অধ্যায়ের ‘সংযোজন’ অংশে দেওয়া হয়েছে।

আমদানি সমীকরণ ও রফতানি সমীকরণ থেকে পাই

আমদানির দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি-হার = ১৮%

এবং রফতানির দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি-হার = ১৫%

আমদানির দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি-হার রফতানি বৃদ্ধি-হারের তুলনায় যথেষ্ট বেশি।

অবশ্য নিট রফতানি বৃদ্ধির গতি অতি ধীর হলেও এবং বিভিন্ন সময়বিন্দুতে ওঠা-নামা করে শেষ পর্যন্ত ২০১২–১৩-তে উচ্চতম বিন্দুতে পৌঁছে তার নেমে আসার প্রবণতা দেখা গেলেও প্রারম্ভিক বিন্দুর তুলনায় তা ওপরেই থাকে। কিন্তু মোট রফতানিতে নিট রফতানির ভাগ ওঠানামার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও সব মিলিয়ে একটা দীর্ঘকালীন হ্রাসের প্রবণতা দেখায়। অর্থাৎ, মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের শতকরা ভাগ ধীরে ধীরে নেমে এসেছে। নীচের ছবিটিতে (চিত্র ১১.৪) আমরা মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের ভাগের দীর্ঘকালীন প্রবণতা দেখার চেষ্টা করেছি। সব মিলিয়ে একটা নিম্নগামী রেখা চিত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমরা সমীকরণ গঠন করে অর্থনৈতিক রাশিবিজ্ঞানের পদ্ধতির সাহায্যে বৃদ্ধির/হ্রাসের প্রবণতার মাপ এবং বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার মাপার চেষ্টা করেছি। নীচের চিত্রটি থেকে ’৯২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সমগ্র সময়ে মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের শতকরা ভাগের ধারাবাহিক পরিসংখ্যানের ক্রমটি পর্যবেক্ষণ করে দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রবণতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমরা ’৯১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একটি প্রবণতা-মাপ ও ২০০৫ থেকে ২০১৮ অবধি ভিন্ন প্রবণতা-মাপ অনুমান করেছি এবং দু’টি ভিন্ন সমীকরণ গঠন করে দু’টি কালপর্বের জন্য দু’টি ভিন্ন প্রবণতা-মাপ ও দু’টি ভিন্ন বৃদ্ধি-হার মাপার চেষ্টা করেছি।

মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের ভাগে হ্রাসের প্রবণতা একাদশ অধ্যায়ের ‘সংযোজন’-এ দেওয়া হয়েছে।

’৯১ থেকে ২০০৫-এ বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের বৃদ্ধির হার = –৪.৮

২০০৫ থেকে ২০১৮-য় বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের বৃদ্ধির হার = –৫.১

দেখা যাচ্ছে, দু’টি ক্রমের প্রবণতাই ঋণাত্মক। অর্থাৎ বৃদ্ধি-হার দু’টি কালপর্বেই ক্রমহ্রাসমান শুধু নয়, প্রথম কালপর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে হ্রাসের হার আরও বেশি। যার অর্থ, সময়ের সঙ্গে শুধু যে মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের ভাগ হ্রাস পেয়েছে তাই নয়, প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের অনুপাত আরও দ্রুত হারে কমেছে। যেহেতু আমরা এই প্রারম্ভিক অনুমান নিয়ে আমাদের পরিমাপ শুরু করেছিলাম যে, সমগ্র সময়ে এই অনুপাতটি যেভাবে চলেছে তাতে এই চলরাশিটির গতিধারাকে দু’টি সরলরেখা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। দু’টি ক্রম অনুযায়ী ক্রমটিকে ভাগ করে দু’টি সরলরেখায় আমরা যে-চারটি বিন্দুতে বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার দেখেছি, সেগুলি হল: ১৯৯১, ২০০৫, ২০০৭, ২০১৭। এই নির্দিষ্ট সময়বিন্দুগুলিতে মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের অনুপাত হ্রাসের হার হল, যথাক্রমে, –২.৮৬, –৩.৮৩, –৪.২৭, –৪.৮৪। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে রফতানিতে উদ্বৃত্তের অনুপাতটির হ্রাস ঘটেছে ক্রমশ দ্রুততর হারে।

চিত্র ১১.৪ নিট রপ্তানি/মোট রপ্তানি

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

দু’-একটি বিশেষ বিশেষ ফসলের ক্ষেত্রে আমরা নিট রফতানি-মূল্যের দীর্ঘকালীন প্রবণতা নীচের কয়েকটি লেখচিত্রের সাহায্যে দেখার চেষ্টা করেছি।

এই লেখচিত্রগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে, ’৯২ থেকে ২০১৭–১৮-র মধ্যে যেসব পণ্যের বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত সবসময়েই ধনাত্মক থেকেছে সেগুলি হল সাধারণ চাল, অন্যান্য দানাশস্য ও মশলা। যে পণ্যগুলির ক্ষেত্রে বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত সবসময় ধনাত্মক নয়, অর্থাৎ হয় রফতানি ও আমদানির পরিমাণ প্রায় সমান অথবা অনেক সময় রফতানির তুলনায় আমদানি যথেষ্ট বেশি, সেগুলি হল ডাল, গম, ও চিনি। এর মধ্যে ডালের ক্ষেত্রে গোটা সময়েই আমদানি, রফতানির তুলনায় বেশি এবং সময়ের সঙ্গে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। অন্যান্য দানাশস্যের ক্ষেত্রে ১৯৯২–৯৩ থেকে ২০১৭–১৮ এই পঁচিশ বছরে প্রথম দিকে নিট রফতানির পরিমাণ ছিল স্বল্প, পরবর্তীতে ২০০৩ সালের পর থেকে অন্যান্য দানাশস্যের নিট রফতানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ২০০৭–০৮-এর পর থেকে ২০১২–১৩ অবধি এই বৃদ্ধি-হার ছিল দ্রুততম, ২০১২–১৩-র পর ২০১৬–১৭ পর্যন্ত আবার অন্যান্য দানাশস্যের নিট রফতানি-হার অতি দ্রুত হ্রাস পায়। ডালশস্যের ক্ষেত্রে সব বছরই নিট রফতানি ঋণাত্মক এবং সময়ের সঙ্গে নিট রফতানি কমেছে, অর্থাৎ রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি থেকেছে ও নিট আমদানি ক্রমশ বেড়েছে। এর ফলে ভারতের নিট বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত ক্রমশ কমছে।

চিত্র ১১.৫ নিট কৃষিজ রফতানি

Source: Agricultural Statistics at a Glance 2017, GOI

চিত্র ১১.৬ ডাল ও দানাশস্যের নিট রফতানি

Source: Directorate General of Commercial Intelligence & Statistics

চিত্র ১১.৭ চাল ও গমের নিট রফতানি

Source: Directorate General of Commercial Intelligence & Statistics

চিত্র ১১.৮ মশলার নিট রফতানি

Source: Directorate General of Commercial Intelligence & Statistics

চিত্র ১১.৯ চিনির নিট রফতানি

Source: Directorate General of Commercial Intelligence & Statistics

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধিনিষেধগুলি প্রয়োগের ফলে ও আমদানির বাধ্যবাধকতার নিয়মে ভারতীয় কৃষির আমদানি-নির্ভরতা বেড়েছে। যদিও রফতানির বৃদ্ধি ঘটেছে উচ্চহারে, তবু আমদানি-বৃদ্ধির হার রফতানি-বৃদ্ধির তুলনায় বেশি হওয়ায় বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত দ্রুত কমে এসেছে। এছাড়া আলাদা করে এক-একটি পণ্যের ক্ষেত্রে নিট রফতানি ঋণাত্মক থেকেছে। দেখা যাচ্ছে, মোট রফতানি-মূল্যে বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের অংশ ক্রমহ্রাসমান। এই অবস্থা একটি দেশের পক্ষে মোটেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থার সূচক নয়। বরং আমদানি-রফতানির এই প্রবণতার গতিমুখ পরিবর্তিত না হলে দেশের সামনে বাণিজ্যখাতে ঘাটতির সম্ভাবনা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠবে, যা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করবে।

তথ্যসূত্র

১. Hoda, A., A. Gulati. 2008. WTO Negotiations on Agriculture and Developing Countries. Oxford University Press.

২. Bagchi, A. K. 2005. Perilous Passage: Mankind and the Global Ascendancy of Capital. Rowman & Littlefield Publishers.

৩. World Development Report. 2001.

সংযোজন

ক। সারের ব্যবহার, উৎপাদন, আমদানি

খ। দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির প্রবণতা

গ। মোট রফতানিতে বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *