বাঙালি মাত্রই প্রবল উৎসাহের সঙ্গে একটি কাজ করে–বিয়ের ঘটকালী। যে মানুষটির কোন কাজে উৎসাহ নেই, সাপ্তাহিক বাজারে যান না, ঈদের জামা কেনার জন্যে বাচ্চাদের হাত ধরে বের হন না, তিনিও বিয়ের ঘটকালীতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন। সম্ভবত ঘটকালী করতে গিয়ে নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে, প্রথম জীবনের সুখস্মৃতিতে নস্টালজিক হবার সুযোগ ঘটে বলেই এত উৎসাহ।
আমি নিজে খুব আগ্রহ করে এ-রকম একটি বিয়ে দেই। গ্রামের একটি কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়ে একটি রূপবতী তরুণীকে আমার খুব পছন্দ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক তখন পিএইচ.ডি. করতে কেমব্রীজ যাচ্ছে। বউ সঙ্গে নিয়ে যাবার সুযোগ আছে। সে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে ডেকে বললাম, একটা ভাল মেয়ে দেখেছি। ঠিকানা দিচ্ছি, তুমি মেয়েটিকে দেখে এসো।
সে অবাক হয়ে বলল, আপনি যেখানে ভাল বলছেন সেখানে আমার দেখার কি দরকার? আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি যাকে বিয়ে করতে বলবেন আমি তাকেই বিয়ে করব।
আমার প্রতি তার আস্থা দেখে শংকিত বোধ করলাম। চিঠি লিখলাম মেয়ের বাবাকে। মেয়ের বাবা রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠির জবাব পাঠালেন। চিঠির ভাষা
এরকম–
পরম পূজনীয় স্যার,
ভগবানের আশীর্বাদস্বরূপ আপনার পত্র পাইয়াছি। আপনি আমার জ্যেষ্ঠা কন্যার জন্য পাত্র দেখিয়াছেন–আপনার পছন্দের পাত্রকে আমার দেখার কোনই কারণ নেই। আপনি যদি রাস্তার কোন অন্ধ ভিক্ষুককে আমার কন্যার জন্য স্থির করেন–ভগবানের শপথ, আমি তাহার হাতেই কন্যা তুলিয়া দিব। আমার কন্যাও তাহাতে কোন অমত করিবে না।
শুধু শ্রীচরণে একটি অনুরোধ–বিবাহ অনুষ্ঠানে আপনাকে উপস্থিত থাকিতে হইবে এবং কন্যা আপনাকে সম্প্রদান করিতে হইবে।
এ কি সমস্যায় পড়া গেল! কেউ কাউকে দেখল না–এক চিঠিতে বিয়ে? তারপর যদি দেখা যায় তেলে-জলে মিশ খাচ্ছে না তখন কি হবে? স্বামী-স্ত্রীর অশান্তির দায়ভাগের সবটাই কি আমাকে নিতে হবে না?
বিবাহ অনুষ্ঠান গ্রামে হবে। অনেক দূরের পথ–লঞ্চে করে যেতে হয়। আমি তিন কন্যা এবং কন্যাদের মাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম। নিজে বিয়ে দিচ্ছি সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকব না তা হয় না। তাছাড়া হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর হয়। বাচ্চারা দেখে আনন্দ পাবে। আগে কখনো দেখেনি–।
শেষরাতের দিকে লগ্ন।
লগ্ন পর্যন্ত পৌঁছার আগেই ভয়াবহ সব ঝামেলা হতে শুরু করল। ঝামেলার প্রকৃতি ঠিক স্পষ্ট হল না।–রাত বারোটার সময় বর এসে আমাকে কানে কানে বলল, স্যার, বিয়ে করব না।
সেকি?
পালিয়ে যাব। বন্ধু বান্ধবরা তা-ই বুদ্ধি দিচ্ছে। এরা অবশ্যি পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। ধরতে পারলে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে।
সত্যি পালাবে না-কি?
না পালিয়ে উপায় নেই। আপনি ভাবী এবং বাচ্চাদের প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় পাঠিয়ে দিন। ওদের প্রটেকশনে তারা থাকুক। চলুন, আমরা পালিয়ে যাই। পরে পুলিশ দিয়ে ভাবী এবং বাচ্চাদের উদ্ধার করব।
বলছ কি তুমি?
সত্যি কথা বলছি। দুটার সময় লগ্ন। হাতে সময় বেশি নেই। পালিয়ে যেতে হবে একটার দিকে। এদের কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। তবে আমার মনে হয় আঁচ করে ফেলেছে–লাঠি-সোটা নিয়ে তাগড়া তাগড়া ছেলেপুলে ঘুরঘুর করছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখুন।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই তাই। আমার গা হিম হয়ে গেল। এ কি যন্ত্রণা! কে আমাকে বলেছিল বিয়ের ঘটকালীতে যেতে?
গুলতেকিন হতাশ গলায় বলল, জুতা খুলে ফেল। খালি পায়ে ভাল দৌড়াতে পারবে। অকারণে কি ভয়ংকর সব যন্ত্রণা যে তুমি তৈরি কর। মাঝে মাঝে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
বর যে সত্যি সত্যি পালিয়ে যেতে চাচ্ছে তা তখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারি নি। বরের বাবা অতি বৃদ্ধ এক স্কুল শিক্ষক যখন আমাকে বললেন, বাবা আমার ছেলে যে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে এই কাজটা কি ঠিক হবে? হিন্দুমতে লগ্ন পেরিয়ে গেলে দুপড়া হয়ে যায়। সেই মেয়ের তো আর বিয়ে হবে না।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথায় আমার কাল ঘাম বের হয়ে গেল। হায় হায় আমি তো একশ হাত পানির নিচে! বৃদ্ধকে বললাম, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।
রাত দুটার লগ্ন পার হয়ে গেল। ভোর সাড়ে তিনটায় শেষ লগ্ন। বিয়ে হলে ঐ লগ্নে হবে, নয়তো না। মেয়ের বাবা এসে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করলেন–আমি এই ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিব না। আমার মেয়ের কপালে ভগবান যা রেখেছেন তাই হবে। এই বলেই তিনি শার্ট গায়ে বের হয়ে গেলেন। আমরা খবর পেলাম, মেয়েটি বিয়ের কারণে সারাদিন উপোস ছিল। এই খবর শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। তার জ্ঞান আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা সব চিৎকার করে কাঁদছে।
ইউনুস নবী মাছের পেটে যখন চলে যান তখন সেই মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে একমনে একটা দোয়া পড়েন, যে দোয়ার নাম দোয়ায়ে ইউনুস। আমি অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে সেই দোয়া পড়ছি–লা-ইলাহা ইল্লা আতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজুয়ালেমিন। এমন ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন আগে হই নি। এই বিপদ থেকে বের হবার কোন পথও আমি জানি না। আমার পাশে আছে একদল বাজনাদার। তারা তাদের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। হিন্দু বিয়ে বাজনা ছাড়া হয় না। খানিকক্ষণ মন্ত্রপাঠের পরপর বাজনা বাজাতে হয়। এই বাজনাদারের ক্ষুদ্র দল বাজনা বাজানোর কোন সুযোগ পায় নি। মনে হচ্ছে পাবেও না। পুরো দলটি অসম্ভব বিষণ্ণ। মাথা নিচু করে বসে আছে।
শুধু পুরোহিত তাঁর পোশাক-আশাক পরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত মুখে বিয়ের আসরে বসে আছেন। তাঁর সামনে পেতলের নানান ধরনের কাশি-কুশি। তিনিও ঐ জায়গায় সন্ধ্যা থেকে বসে আছেন। নড়েন নি। লগ্ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত হয়ত নড়বেন না। আমি ঐ ভদ্রলোকের অসীম ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। ভদ্রলোক যেন মানুষ নন। পাথরের মূর্তি।
লগ্ন শেষ হবার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে বর বলল, আচ্ছা ঠিক আছে বিয়ে করব। টোপর কোথায়?
মেয়ের বাবা বললেন–না। অসম্ভব! আমি ঐ বদ ছেলের হাতে আমার আদরের মেয়েকে দেব না। মেয়ে কেটে রূপশা নদীতে ভাসিয়ে দেব।
লোকজন ধরাধরি করে মেয়ের বাবাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল–মাঠের দিকে। সেখান থেকেই ভদ্রলোক চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।
তাঁর কান্নার শব্দ চাপা পড়ে গেল বাজনায়।
বাজনাদাররা বাজনা বাজাতে শুরু করেছেন।
ক্রমাগত উলু পড়ছে।
বাজনার শব্দ, উলুর শব্দ, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা কন্যার বাবার কান্নার শব্দ–সব মিলিয়ে পরিবেশ কেমন যেন হয়ে গেল।
খোলা উঠোনে বিয়ে হচ্ছে। আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হ্যাজাক লাইট। আমি দূর থেকে দেখছি। কনেকে এনে বসিয়ে দেয়া হল বরের সামনে। মেয়েটিকে আজ আর মানবী বলে ভ্রম হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হল ঈশ্বর তাঁর ভাণ্ডারের সমস্ত রূপ অন্তত আজ রাতের জন্যে হলেও মেয়েটির সারা শরীরে ঢেলে দিয়েছেন। হোমের আগুনের পাশে মেয়েটি যেন পদ্মফুল হয়ে ফুটে আছে। শুভ দৃষ্টির আগে স্বামীর দিকে তাকানোর নিয়ম নেই–তবু সে একবার চোখ বড় বড় করে তাকালো স্বামীর দিকে–সেই দৃষ্টিতে ছিল গভীর বেদনা, অনুযোগ এবং তার সতেরো বছরের জীবনের অভিমান!
মেয়ের বাবাকে হাত ধরে ছেলের বাবা নিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। গাঢ় স্বরে বললেন, স্যার, আমি দরিদ্র মানুষ। আজ আপনার জন্যে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পেয়েছি। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। বলেই এই বৃদ্ধ মানুষ নিচু হলেন আমার পা স্পর্শ করার জন্যে–আমি তাঁকে ধরে ফেললাম। কোমল গলায় বললাম–যান, মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন।
সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন–আচ্ছা, এই বাজনাদারগুলি কোত্থেকে জোগাড় করেছে?–এরা এখনো বাজনা বাজাচ্ছে। মন্ত্রপাঠের সময় থামবে না? এরা কি নিয়ম-কানুন কিছু জানে না?
তাকিয়ে দেখি, বাজনাদারের পুরো দলটির যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নেচে নেচে বাজাচ্ছে। তাদের মধ্যে সবচে বয়স্ক মানুষটির হাতে করতাল। সে রীতিমত লাফাচ্ছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না তারা এই জীবনে বাজনা থামাবে।
আমি এই জীবনে অনেক মধুর সংগীত শুনেছি। কর্নেগী হলে শুনেছি পৃথিবী-শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞের কনসার্ট–মোজার্টের ফিফথ সিম্পোনী। লাসভেগাসে লেবোরেটরীর পিয়ানো শুনেছি বিথোভেন–কিন্তু সেদিনের কিছু অখ্যাত গ্রাম্য বাজনাদারদের বাজনার মত মধুর সংগীত এখনো শুনি নি–আর যে শুনব সে আশাও কম।