১১.
বিমলেশের ফ্ল্যাট থেকে সোয়া চারটেয় বেরিয়ে পড়ল সুবর্ণা। দেবীর স্কুল এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একটা ফাঁকা সাইকেল রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ল সে। দেবীকে নিয়ে এই রিকশাতেই সোজা বাড়ি ফিরে যাবে। আজ আর মেয়েদের অর্গানাইজেশনে যাওয়া হবে না! কাল সময় করে একবার যাওয়ার চেষ্টা করবে।
বিমলেশ তাকে রাজীবের হাত থেকে মুক্তির কোনও রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেনি। শুধু ধৈর্য ধরে তার ওপর লক্ষ রাখতে বলেছে। এছাড়া উপায়ই বা কী? ধৈর্য, অন্তহীন ধৈর্য। তার সঙ্গে সুকৌশলে মেশাতে হবে যাবতীয় বুদ্ধিমত্তাকে। অপরিসীম দুর্ভাবনার মধ্যেও ক্ষীণ আশার চকিত একটা রেখা যেন দেখা দিল। বিমলেশের সঙ্গে রাজীবের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারলে হয়তো কাজের কাজ কিছু একটা হতে পারে। বিমলেশ অত্যন্ত দুঃসাহসী, মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। প্রতিপক্ষের ভাবগতিক বুঝে হাসি মুখে পালটা গলে তাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে। সুবর্ণাদের পরিবারের স্বার্থে দু’জনের আলাপ হওয়া একান্ত জরুরি। কিন্তু কীভাবে?
অল্পবয়সী রিকশাওলাটা গাড়ি চালাতে চালাতে কল, বৌদি–
এই শহরের বেশির ভাগ রিকশা, অটো আর টাকা সুবর্ণাকে চেনে। চোদ্দ বছরে এদের সবার গাড়িতে কতবার যে সে চড়েছে তার হিসেব নেই। ওরা যেমন তাকে চেনে, সে-ও তেমনি ওদের সবাইকে চেনে, এমনকি অনেকের নামও তার। জানা।
সুবর্ণা একটু চমকে উঠে বলে, কি রে ভানু?
আপনাদের রাজবাড়িতে নাকি একটা খুনী ঢুকে আছে?
কে বলল?
সবাই। কাগজে খবরটা বেরিয়েছে; খুনীর একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। আপনি দেখেননি বৌদি?
বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, হত্যাকারী হিসেবেই তা হলে রাজীবের নামটা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে! একটু চুপ করে থেকে সুবর্ণা বলল, দেখেছি।
প্যাডল করতে করতে আঁতকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ভানু, দেখেছেন!
হ্যাঁ, ছবিতে। সুবর্ণা বলল, আমাদের বাড়িতে ওরকম কেউ ঢোকেনি।
বিহ্বলের মতো কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ভানু বলল, কিন্তু সবাই যে বলছে।
সুবর্ণা বলল, সত্যিই যদি ঢুকত আমি কি বেঁচে থাকতাম?
এবার যেন বিশ্বাস হল ভানুর। তা তো ঠিকই–’বলতে বলতে ফের সামনের দিকে তাকায়।
দেবীর স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সবে ছুটি হয়েছে। ওকে রিকশায় তুলে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে পাঁচটা বেজে গেল।
গেটের সামনে হরেন দাঁড়িয়ে ছিল। সাইকেল রিকশা থেকে নেমে দেবীকে নিয়ে সুবর্ণা যখন বাড়ির দিকে যাচ্ছে, সে-ও ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
সুবর্ণার মনে হল, হরেন কিছু বলতে চায়। সে কোনও প্রশ্ন করল না। তার ইচ্ছা হরেন নিজের থেকে বলুক। তার চোখ মুখের চেহারা সুবর্ণাকে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন করে তুলল।
দরজার কাছাকাছি এসে নিচু গলায় হরেন বলে, বৌদি, একটা কথা বলবার ছিল।
সুবর্ণা বলল, হ্যাঁ, বলো না—
দুপুরে দোতলায় অচেনা লোকের গলা শুনতে পেলাম।
সুবর্ণা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একটু চিন্তা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওপরে গিয়েছিলে নাকি?
হরেন বলল, না না। নিচে বসেই কানে এল। কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে, তাছাড়া যেখানে যাচ্ছি, লোকজন বলাবলি করছে একটা সাঙ্ঘাতিক খুনী নাকি কাল রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। গলাটা তারই কিনা–বলতে বলতে থেমে যায় সে।
একজন সন্ত্রাসবাসী হত্যাকারীর ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ কাল রাত্তিরে ঢুকে পড়ার গুজব চারিদিকে যে চাউর হয়ে গেছে সেটা রিকশাওলা ভানু আর কলেজের কলিগদের নানা প্রশ্নে টের পাওয়া গিয়েছিল।
বিমলেশ ছাড়া অন্য সবার কাছেই ঘটনাটা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে সুবর্ণা। কিন্তু হরেন এ বাড়িতে থাকে। সে নিশ্চয়ই রাজীবের গলা শুনেছে। হঠাৎ কখনও ওকে দেখেও ফেলতে পারে। হরেনের কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখা ঠিক হবে না। তাকে খোলাখুলি সব জানিয়ে সাবধান করে দেওয়াটা খুবই জরুরি।
সুবর্ণা চাপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু দরকারি কথা আছে। বলুন বৌদিদি’। এখন না, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর বলব। আমি কি ওপরে যাব?
না। আমিই নিচে আসব।
সুবর্ণা আর দাঁড়াল না, দেবীকে নিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে দেখতে পেল শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ তার ঘরে বাচ্চাদের মতো টলমল করতে করতে হাঁটছেন আর সিঁড়ির দিকে মুখ করে সোফায় বসে কী একটা বই পড়ছে রাজীব। পায়ের শব্দে দ্রুত চোখ তুলে তাকাল সে। ততক্ষণে দোতলায় চলে এসেছে সুবর্ণারা। ওদের দেখেও সে কিছু বলল না।
সুবর্ণা দেবীকে বলল, ঘরে গিয়ে স্কুল ড্রেসটা চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি মায়াকে খাবার দিতে বলে আসি। মেয়েকে বেডরুমে পাঠিয়ে সে কিচেনে চলে গেল।
রোজই এই সময় বিকেলের খাবার তৈরি করে মায়া। একেক দিন একেক রকম। কোনওদিন পরটা, আলুর দম। কোনও দিন টোস্ট, ঘুগনি। কোনও দিন লুচি, পায়েস। বিকেলে সংগ্রামনারায়ণ আর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ হরলিকস আর বিস্কুট ছাড়া কিছু খান না, ডাক্তারের বারণ। খাবার যা হয় সবই সুবর্ণা আর দেবীর জন্য। অবশ্য মায়াও খায়।
কিচেনে এসে সুবর্ণা দেখল, কচুরি ভাজার তোড়জোড় করছে মায়া। সতর্কভাবে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোনও গোলমাল হয়নি তো?
প্রশ্নটার উদ্দেশ্য মায়ার কাছে পরিষ্কার। সে বলল, না, তবে ছোট বাবা বার কয়েক হল-ঘরে এসে লোকটাকে দেখে গেছেন।
সুবর্ণার মনে পড়ল, কলেজ থেকে যখন সে ফোন করেছিল তখন রাজীবও এই কথাগুলো জানিয়েছিল।
মায়া ফের বলল, একবার ছোট বাবা খানিকক্ষণ কথাও বলল লোকটার সঙ্গে। সুবর্ণা চমকে উঠল, কী কথা?
বলতে পারব না। আমি রান্নাঘরের দরজা ফাঁক করে বসেছিলাম। এতদূর থেকে কি শোনা যায়?
বাবা রাগারাগি চেঁচামেচি করেননি তো?
না।
দুশ্চিন্তা একটু কাটল ঠিকই, তবে মনের ভেতর সামান্য খিচ থেকে গেল। সুবর্ণা বলল, তুমি তাড়াতাড়ি সবার খাবার নিয়ে এসো।
নিজের ঘরে আসতেই তার চোখে পড়ল, দেবীর মুখটুখ ধোয়া হয়ে গেছে। সুবর্ণাও দ্রুত শাড়িটাড়ি পালটে, বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এল।
কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল মায়া। দেবীকে খেতে দিয়ে, নিজের কচুরি তরকারি ঢাকা দিয়ে রেখে প্রথমে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে গেল সুবর্ণা। হরলিকসের গ্লাস, বিস্কুট, চারটে ট্যাবলেট আর জল খাটের পাশের একটা সাইড টেবলে গুছিয়ে দিয়ে বলল, বাবা, খেয়ে নেবেন। আমি যাচ্ছি—
সংগ্রামনারায়ণ তাঁর খাটের মাঝখানে চেক-বই নিয়ে বসে ছিলেন। প্রতি মাসের প্রথম এবং তৃতীয় সপ্তাহে দু’বার খরচের জন্য চেক লিখে তিনি সুবর্ণাকে দেন। সে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিয়ে আসে। বললেন, বৌমা, তোমার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে।
দাদাভাইকে খাইয়ে আসছি। খাবার নিয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এসে কচুরির প্লেটটা রাজীবকে দিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণকে ধরে জোর করে ডিভানে বসিয়ে হরলিকস খাওয়াতে শুরু করল সুবর্ণা। জিজ্ঞেস করল, আমার কি আর কোনও ফোন এসেছিল?’
রাজীব বলল, হ্যাঁ। থানা থেকে আরও কয়েক বার খোঁজখবর নিয়েছে। আর আপনাদের অর্গানাইজেশনের সেই মনোরমা অধিকারীও খানিকক্ষণ আগে আবার ফোন করেছিলেন। আপনি কলেজ থেকে ফিরলেই কনট্যাক্ট করতে বলেছেন।
সুবর্ণা বলল, ঠিক আছে।
রাজীব হাতের বইটা সোফার একধারে রাখতে রাখতে বলল, আপনার পারমিসন না নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি মিসেস সিংহ।’ বলে অল্প হাসল।
সুবর্ণা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, কারও পারমিসন নেওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?
তার কথার মধ্যে যে তীব্র ধাক্কাটা ছিল সেটা লক্ষই করল না রাজীব। সোফায় যে বইটা রেখেছিল সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, সময় কাটছিল না বলে আপনার লাইব্রেরি থেকে এটা নিয়ে এসেছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং বুক–’মেনি ফেসেস অফ কলোনিয়ালিজম। এমন বই আগে কখনও পড়িনি। বইটা সবার পড়া উচিত।
ইংরেজরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে কলোনিয়ালিজমও শেষ। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর আর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাজীব। তারপর জিজ্ঞেস করে, ইন্ডিয়ায় কলোনিয়ালিজম শেষ হয়ে গেছে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল সুবর্ণা, আপনি কি বিশ্বাস করেন না?
একটু চুপ করে থেকে রাজীব বলল, সারাদিন কলেজ করে এসেছেন। নিশ্চয়ই ভীষণ টায়ার্ড। তার ওপর শ্বশুর আর দাদাশ্বশুরের সেবা করতে হচ্ছে। পরে কোনও একদিন কলোনিয়ালিজম ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
সুবর্ণা জবাব দিল না। শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের খাওয়া শেষ হলে মনোরমা অধিকারীকে ফোন করল।
মনোরমা তাদের মহিলা সমিতি নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসেই ছিলেন। বললেন, তোমাকে আজ দু’বার ফোন করেছি, পাইনি।
সুবর্ণা বলল, শুনেছি। কিন্তু ওই সময় তো আমি কলেজে থাকি। বাড়িতে পাবেন কী করে?
আরে তাই তো, আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। শোন, তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
বলুন না—
মনোরমা বললেন, ফোনে বলা যাবে না। তুমি কি কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে আসতে পারবে? অসুবিধা থাকলে আমিও তোমাদের বাড়ি যেতে পারি।
মনোরমার ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ চলে আসাটা ঠিক হবে না। এখানে এলে রাজীবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কেননা বাইরের যে কয়েক জন। সংগ্রামনারায়ণের আগাম অনুমতি না নিয়ে সোজা দোতলায় উঠতে পারে, মনোরমা তাদের মধ্যে পড়েন। যদি সত্যিই তিনি আসেন আর বুঝতে পারেন রাজীব সুবর্ণাদের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, তিনি ছাড়বেন না। আসলে মহিলা অত্যন্ত তেজী এবং খানিকটা বেপরোয়াও। যেভাবে হোক রাজীবের হাত থেকে তাদের মুক্ত করতে চাইবেন। কিন্তু তার ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সুবর্ণা ত্রস্তভাবে বলল, না না, আপনাকে আসতে হবে না। আমিই যাব। তবে–
মনোরমা জিজ্ঞেস করলেন, তবে কী?
কাল যেতে পারব কিনা, বুঝতে পারছি না। কবে যাব, আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো।
আসলে রাজীবের সঙ্গে কথা না বলে সুবর্ণার পক্ষে আপাতত কথা দেওয়া সম্ভব নয়। তার স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পুতুলনাচের পুতুলের মতো তার হাতে পায়ে অদৃশ্য সুতো বাঁধা রয়েছে। আর সেই সুতোর ডগাগুলো রয়েছে রাজীবের আঙুলে জড়ানো। সে যেভাবে তাকে চালাবে, অবিকল সেভাবেই তাকে চলতে হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের কলেজ আর দেবীর স্কুলে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়ি ফিরে আসা-এর মধ্যেই তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে রাজীব। তাকে না জানিয়ে ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে যদি দেরি হয়ে যায়, রাজীব তার মধ্যে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেতে পারে। ভাবতে পারে তাকে বিপদে ফেলার জন্য কিছু একটা হোড়জোড় করছে সুবর্ণা। লোকটা এতই সন্দেহপ্রবণ যে সে কলেজে আছে কি না সে খোঁজও দু-তিন বার ফোন করে আজ নিয়েছে।
মনোরমা ব্যস্তভাবে বললেন, দেরি করলে চলবে না। কালই তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব আর্জেন্ট।
মিনিট পনের বাদে আপনাকে ফোন করছি। মনোরমাকে কিছু বলার সময় না দিয়ে লাইন কেটে দেয় সুবর্ণা।
আগাগোড়া তাকে লক্ষ করে যাচ্ছিল রাজীব। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল, মনে হচ্ছে আপনার মনোরমাদি আপনাকে কোনও একটা সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে সুবর্ণা, হ্যাঁ।
রাজীবের চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে, প্রবলেমটা কী?
মনোরমা কী বলেছেন তা জানিয়ে দিল সুবর্ণা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু ভাবল রাজীব। তারপর বলল, ঠিক আছে, কাল কলেজ ছুটির পর নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ গিয়ে আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। আশা করি, আপনাদের পারিবারিক নিরাপত্তার ব্যাপারে যে ওয়ার্নিংগুলো কাল থেকে বার বার দিয়ে আসছি সেগুলো ভুলে যাবেন না।
সংগ্রামনারায়ণ এবং শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ যে তার হোস্টেজ হয়ে আছেন; সুবর্ণা মনোরমার সঙ্গে দেখা করে তার বিরুদ্ধে কোনওরকম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা। করলে এঁদের পরিণতি কী হতে পারে, সেটাই আরেক বার মনে করিয়ে দিল রাজীব। স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলল, না, ভুলব না। আমি তা হলে মনোরমাদিকে ফোন করে কাল দেখা করার কথাটা বলে দিচ্ছি।
বলুন।
সুবর্ণা মনোরমাকে আরেক বার ফোন করল। কথা শেষ করে ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে রাজীবকে বলল, আমি এখন যাচ্ছি। কলেজ থেকে ফেরার পর এক কাপ চাও খাওয়া হয় নি। বলে একটু হাসল।
রাজীব ব্যস্তভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, যান।
নিজের ঘরে চলে এল সুবর্ণা। কচুরি তরকারি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে খেয়ে সংগ্রামনারায়ণের বেডরুমে এল।
চেক লেখা হয়ে গিয়েছিল। সুবর্ণার হাতে সেটা দিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বসো বৌমা–
একটা পুরু গদিওলা মোড়া খাটের কাছে টেনে এনে সুবর্ণা বসে পড়ল।
সংগ্রামনারায়ণ সামনের বিশাল জোড়া জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলেন। সন্ধে হতে খুব বেশি দেরি নেই। সূর্য পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু গাছপালার মাথায় ফ্রিজ শটের মতো স্থির হয়ে রয়েছে। যে নিস্তেজ আলোটুকু এখনও আকাশের গায়ে আবছাভাবে লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে যাবে, ঝুপ করে নেমে আসবে অঘ্রাণের সন্ধে। অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চোখের সামনে দৃশ্যমান প্রতাপপুর সিটির বাড়িঘর, রাস্তা, পার্ক।
একটু লক্ষ করলে এখন চোখে পড়ে, দূরে মিহি সিল্কের মতো কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। হাওয়া দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সুবর্ণা বুঝতে পারল, জরুরি কথাটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন সংগ্রামনারায়ণ। সে অপেক্ষা করতে লাগল। মনে মনে কিছুটা টেনসন যে হচ্ছিল না তা নয়। কী বলবেন সংগ্রামনারায়ণ? রাজীব সম্পর্কেই কি কিছু?
একসময় সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে সংগ্রামনারায়ণ বললেন তোমার যে আত্মীয়টি এসেছে তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না।
যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তা-ই। শ্বাসক্রিয়া যেন পলকের জন্য বন্ধ হয়ে গেল সুবর্ণার। নিঃশব্দে সে সংগ্রামনারায়ণকে লক্ষ করতে থাকে। রাজীব সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলে তাকে খুবই সমস্যায় পড়তে হবে।
সংগ্রামনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আত্মীয়টি তোমার বৌদির কিরকম যেন ভাই হয়?
সংগ্রামনারায়ণ কি তাকে পরীক্ষা করতে চাইছেন? একটু হকচকিয়ে গেলেও সুবর্ণা টের পায় তার স্মৃতিশক্তি এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। চাপা গলায় বলল, পিসতুতো ভাই।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তোমার বৌদির পিসিমার কি আসাম বা নর্থ-ইস্টের অন্য কোনও স্টেটের লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?
সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ কথা জানতে চাইছেন কেন বাবা?’
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, তুমি রাজীবের চেহারা আর বাংলা উচ্চারণ লক্ষ করেছ?
তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন তা বুঝতে পারছিল সুবর্ণা। তবু বলল, হ্যাঁ, মানে–কেন বলুন তো?
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, ওর মুখেচোখে একটা মঙ্গোলিয়ান ছাপ রয়েছে না? বাংলা প্রোনানসিয়েসনও পারফেক্ট নয়। তাই মনে হচ্ছে তোমার বৌদির পিসিমার বিয়েটা হয়তো নর্থ-ইস্টেই হয়েছে।
সুবর্ণার গলা শুকিয়ে আসছিল। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্পর্কে পুরোপুরি সংশয় মুক্ত হতে পারেন নি, সন্দেহটা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল সুবর্ণার। ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি অত ভাল জানি না। তবে এরপর কী বলবে, ভেবে নেওয়ার জন্য থেমে গেল সে।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন সংগ্রামনারায়ণ। বললেন তবে কী?
ভীষণ ঘাবড়ে যায় সুবর্ণা। এক রকম মরিয়া হয়েই বলে, আমি অত ভাল জানি না। বৌদির মুখে শুনেছিলাম, ওর পিসিমার ওদিকেই কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না সংগ্রামনারায়ণ। শুধু বললেন, আজ দুপুরে তুমি যখন কলেজে, রাজীবের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করলাম। এমনি বেশ ভদ্র। ওকে বললাম, নতুন জায়গায় এসেছ, সারাক্ষণ ঘরে বসে আছ কেন? আমাদের ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, সে তোমাকে গাড়িতে করে প্রতাপপুর সিটি, লেকটেক ঘুরিয়ে দেখাবে। রাজীব রাজি হল না। বলল, ভীষণ টায়ার্ড। দু-একদিন রেস্ট নিয়ে নিজেই ঘুরেটুরে দেখবে। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে নাকি কোনও নতুন জায়গা ভাল করে দেখা হয় না। আমি বললাম, তবে তাই দেখো–’
শ্বাস আটকে গিয়েছিল সুবর্ণার। কোনওভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে।
সংগ্রামনারায়ণ বললেন, বাবার ঘরে আমাদের টেলিফোনটা দেখলাম।
তিনি যে এটাও লক্ষ করবেন ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। কাঁপা গলায় কোনওরকমে জানাল, সে নিজে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে না, কলেজে বেরুতে হয়। এদিকে রাজীবের কটা জরুরি ফোন আসার কথা আছে। তাই ওটা শেীর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে রেখে এসেছে।
সংগ্রামনারায়ণ কয়েক পলক কী ভেবে বললেন, ভালই করেছ।
কথায় কথায় সন্ধে নেমে গিয়েছিল। সুবর্ণা ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। নিজের ঘরে এসে দেবীকে পড়তে বসিয়ে দিল। আর তখনই মনে পড়ে গেল, নিচে গিয়ে হরেনের সঙ্গে রাজীব সম্পর্কে কথা বলতে হবে। কিন্তু তার আগে রাজীবকে সেটা জানানো দরকার। ওই সশস্ত্র টেরোরিস্টটা এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সুবর্ণার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছুই আর কাজ করে না। নিজের থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই তার নেই। সে কোথায় যাবে, কেন যাবে, কার সঙ্গে কী কথা বলবে–সমস্ত কিছুই নির্ভর করছে ওই লোকটার অনুমতির ওপর। সর্বক্ষণ তার মনে হয়, অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোলে সে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তুই পড়। আমি এক্ষুণি একটা কাজ সেরে আসছি।’ এক নিঃশ্বাসে দেবীকে কথাগুলো বলে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।
কলোনিয়ালিজমের ওপর সেই বইটা পড়ছিল রাজীব। সুবর্ণাকে দেখে উৎসুক চোখে তাকাল।
সুবর্ণা বলল, তখন একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
রাজীব জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
হরেনের ব্যাপারটা জানিয়ে সুবর্ণা বলল, ওকে এখন গিয়ে বোঝাতে হবে আপনার সম্পর্কে যেন চুপচাপ থাকে, কারও কাছে মুখ না খোলে।
ঠিক আছে। আপনারা যখন কথা বলবেন আমি কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের পিলারটার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনব।
আচ্ছা।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর রাজীব বলল, আমার মাথার ওপর পঞ্চাশ লাখ টাকার পুরস্কার রয়েছে। টাকার মতো খারাপ জিনিস আর নেই। লোভে পড়ে হরেন ডেসপারেটলি কিছু করে বসবে না তো?
সুবর্ণা বলল, হরেন খুবই বিশ্বাসী, কিন্তু ওর মতো ভীরু আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তবু ভাল করে বুঝিয়ে দেবো, টাকার জন্যে বেপরোয়া হলে তার ফল কী হবে।
রাজীব উত্তর দিল না।
.
১২.
পরদিন কলেজ ছুটির পর একটা সাইকেল রিকশা নিল সুবর্ণা দেবীকে তার স্কুল থেকে তুলে সোজা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সামনে এসে থামল।
মহারানী হেমপ্রভা অ্যাভেনিউতে মনোরমা অধিকারীদের বিশাল তেতলা বাড়ি। গোটা বাড়ি জুড়েই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিস এবং কর্মশালা। দুঃস্থ, স্বামী পরিত্যক্ত, ধর্ষিত বা নানাভাবে নির্যাতিত যে মেয়েদের আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, তাদের সযত্নে তুলে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন মনোরমা। তিনিই এদের শেষ আশ্রয়।
বাড়িটার পেছন দিকে অনেকখানি কঁকা জায়গা। অসহায় মেয়েগুলো যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে, ভাত-কাপড়ের জন্য তাদের কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সে জন্য ওখানে বড় বড় টিনের শেড তুলে কোনওটায় তাঁত বসানো হয়েছে। কোনওটায় বেত, বাঁশ, কোনওটায় বা চামড়ার কাজের জন্য রয়েছে ওয়ার্কশপ। এখানকার মেয়েদের তৈরি শাড়ি, নকশা-করা চাদর, টেবল ক্লথ, বেতের মোড়া বা চেয়ার, চামড়ার ব্যাগ, ঘর সাজানোর নানা জিনিস আর বটুয়ার বিরাট চাহিদা। শুধু প্রতাপপুরেই নয়, শিলিগুড়ি, কলকাতা, এমন কি সুদূর দিল্লি থেকেও ভাল অর্ডার আসে। ফলে আর্থিক দিক থেকে মেয়েরা অনেকখানি নিশ্চিন্ত। তাদের আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেবীকে নিয়ে একতলায় নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অফিসে চলে এল সুবর্ণা।
মনোরমা টেবলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে একটু হেসে বললেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আরে দেবীকেও এনেছ!’
মনোরমার বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। সময় এলোপাথাড়ি ব্রাশ চালিয়ে তার চুল আধাআধি সাদা করে দিয়েছে। শরীর কিছুটা ভারী। চেহারায় যৌবনের পেলবতা মুছে গিয়ে রুক্ষতা ফুটে উঠেছে। তবু ডিম্বাকৃতি মুখ, ধারাল নাক, বড় বড় উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, অনেকটা মলিন হয়ে গেলেও ফর্সা রং, সব মিলিয়ে বলা যায় একসময় তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন।
একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে সুবর্ণা বলল, আসার সময় পথে ওর স্কুলটা পড়ল, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। মনোরমার সঙ্গে একটু মিথ্যাচারণই করল সে। রাজীবের জন্য ইদানীং যে দেবীকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে এবং ছুটির পর নিয়ে আসছে সেটা আর বলল না।
বাড়ির পেছন দিকের ওয়ার্কশপগুলোতে এখন প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততা। দু শিফটে ওখানে মেয়েরা কাজ করে। প্রথম শিফটটা সকালে সাতটায় শুরু, শেষ একটায়। দুপুর দু’টো থেকে আটটা পর্যন্ত যে শিফট, এখন সেটা চলছে। বাঁশ চেরাইর আওয়াজ, পেরেক ঠোকার আওয়াজ, তাতে চলার আওয়াজ, সব মিলিয়ে বিচিত্র অর্কেস্ট্রার মিশ্রিত শব্দ সেখান থেকে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মেয়েদের টুকরো টুকরো কণ্ঠস্বর।
মনোরমা দেবীকে কাছে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে আদর করতে করতে সস্নেহে বললেন, তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। কী খাবে বল?
দেবী লাজুক মুখে বলল, দুপুরে টিফিন খেয়েছি। এখন আর কিছু খাব না।
খাব না বললে শুনছি না। একটি মেয়েকে ডেকে দোকান থেকে সন্দেশ আর কাজু বাদাম কিনিয়ে এনে দেবীকে দিতে দিতে বললেন, তুমি খাও। আমি মায়ের সঙ্গে দরকারি কথা বলি- সুবর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমাকে যে জন্যে কাল অত বার ফোন করেছিলাম সেটা শোন–
বলুন–উৎসুক চোখে তাকাল সুবর্ণা।
মনোরমা জানালেন, প্রতাপপুর সিটির বেশ কিছু মহিলা নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক অর্থাৎ নিরপরাধ পাগলকে দীর্ঘ দশ পনের বছর জেলে আটকে রাখার পর আসছে সপ্তাহে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এদের কারও মা-বাবা নেই। আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তারা কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলোর দায়িত্ব নিতে চায় না। খবরটা পাওয়ার পর ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছেন মনোরমা। বললেন, এই হেল্পলেস মেয়েগুলোর জন্যে আমাদের কিছু একটা করা দরকার।
সুবর্ণা মনোরমাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। সে শুনেছে তার মা-বাবা দু’জনেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ইংরেজের জেলে তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টাই কেটে গেছে। স্বাধীনতার পর ইচ্ছা করলে তারা অনেক কিছুই পেতে পারতেন। তাম্রপত্র, অর্থ, মন্ত্রিত্ব এবং আরও অজস্র সুযোগ সুবিধা। কিন্তু তারা কিছুই নেন নি; রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে বাকি জীবন সমাজসেবা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। মা-বাবার সততা আর আদর্শবাদকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন মনোরমা। তিনি ওঁদের একমাত্র সন্তান। কলেজে পড়ার সময় থেকেই সমাজকল্যাণে, বিশেষ করে লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছেন। এম. এ পাশ করার পর কয়েক বছর রানী স্বর্ণময়ী কলেজে’-এ পড়িয়ে ছিলেন কিন্তু নির্যাতিত মেয়েদের সংখ্যা এত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল যে চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হল। মা-বাবার মৃত্যুর পর নিজেদের বাড়িতেই নারী বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তুললেন। এই সংগঠনটার জন্য শেষ পর্যন্ত বিয়ে করারও সময় পান নি।
নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর জন্য নিজের যা কিছু সবই দিয়েছেন মনোরমা। গভর্নমেন্ট থেকে কিছু গ্রান্ট পাওয়া যায়, বিদেশ থেকেও ডোনেশন আসে। বড় বড় বিজনেস হাউস তাদের সোশাল ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে কিছু টাকা দেয়। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দান তো আছেই। এই সব গ্রান্ট ট্রান্ট জোগাড় করতে কত জায়গায়, কত প্রভাবশালী লোকের কাছে যে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তার হিসেব নেই।
এই বিশাল কাজ তো একা করা সম্ভব নয়। তাই সুবর্ণার মতো আরও অনেককেই নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এ টেনে এনে নানা দায়িত্ব দিয়েছেন।
এতদিন নির্যাতিত মেয়েদের জন্য জীবনের সব কিছু অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুখ, আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। এখন নতুন করে যুক্ত হল নিরপরাধ পাগল মেয়েরা। ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারলে যেন জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে মনোরমার।
সুবর্ণা বলল, নিশ্চয়ই কিছু করতে হবে।
মনোরমা বললেন, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। সেই জন্যেই তোমাকে কাল ফোন করেছিলাম।
সমস্যাটা কী?
এত মেয়ে কোথায় রাখব? নারী বিকাশ কেন্দ্র’ তো বোঝাই। এখানে আর জায়গা নেই।
সুবর্ণাকে চিন্তিত দেখায়। সে বলে, তা হলে কী করবেন?
মনোরমা বলল, একটাই সলিউসন রয়েছে। তবে সেটা পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভর করছে।
উৎসুক সুরে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে, আমি কী করে সলভ করব?
তোমাদের প্যালেসের একতলায় অনেকগুলো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যতদিন না অন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে ওখানে যদি ওদের থাকতে দাও’ বলতে বলতে চুপ করে গেলেন মনোরমা।
সুবর্ণা হকচকিয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে বলে, আমার নিজের আপত্তি নেই কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের পারমিসন ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না মনোরমাদি।
মনোরমা বললেন, খুব বেশিদিন ওরা থাকবে না। ম্যাক্সিমাম একমাস। তার মধ্যেই ওদের জন্যে একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলব। খাওয়া টাওয়ার যা খরচ, আমাদের অর্গানাইজেশনই দেবে। রান্নার লোকও আমরা পাঠাব। তুমি শ্বশুরমশাইকে একটু বুঝিয়ে বলো। তুমি বললে আশা করি উনি না’ বলবেন না।
আচ্ছা বলব।’বলতে বলতে রাজীবের মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সুবর্ণার। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রচণ্ড দুর্ভাবনা তাকে গ্রাস করে। শুধু সংগ্রামনারায়ণের অনুমতি নিলেই চলবে না, রাজীবের মতামতই সব থেকে জরুরি। তার আপত্তি থাকলে একটা মাছিকেও ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ ঢোকানো যাবে না। সে মনস্থির করে ফেলল, প্রথমে রাজীবকে বুঝিয়ে বলবে। তারপর সংগ্রামনারায়ণের কাছে যাবে।
বাড়ি ফিরে দেবীকে নিজেদের বেডরুমে পাঠিয়ে শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের ঘরে চলে এল সুবর্ণা।
রাজীব ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে বই পড়ছিল। ধীরে ধীরে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই আপনার মনোরমাদির সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
হ্যাঁ।
কী জন্যে উনি আপনাকে ডেকেছিলেন?
মনোরমার সঙ্গে তার যা কথা হয়েছে, সব জানিয়ে ছিল সুবর্ণা। তারপর বলল, কী যে করব, বুঝে উঠতে পারছি না। বলে রাজীবের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।
রাজীব তক্ষুণি উত্তর দিল না। মিনিটখানেক চুপ করে থেকে বলল, আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। উইমেন্স অর্গানাইজেশনের অ্যাক্টিভ মেম্বার হিসেবে আপনি মনোরমা দেবীকে না বলতে পারেন না। হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউন্ডে ওই হেল্পলেস মানুষগুলোকে শেলটার দেওয়াই উচিত। কিন্তু আপনার দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে নিয়ে–তাই তো?’
সুবর্ণা আগেও লক্ষ করেছে, লোকটা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন থট রিডার। কেউ মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার মনের কথা জেনে যায়। কিছু না বলে আস্তে মাথা নাড়ল সে। তবে আবছাভাবে এই প্রথম তার মনে হল, রাজীব শুধু একটা নিষ্ঠুর হননকারী নয়, তার মধ্যে দয়ামায়া সহানুভূতির মতো কোমল কিছু কিছু ব্যাপার এখনও থেকে গেছে।
রাজীব বলল, এক উইক পর মেয়েরা ছাড়া পাবে। এখনও অনেক সময় আছে। দু-একদিন ভেবে আপনাকে বলব।
সুবর্ণা আন্দাজ করল, নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সব দিক খুঁটিয়ে দেখার জন্য সময় নিল রাজীব। যদি বোঝে মেয়েরা এলে তার ক্ষতির আশঙ্কা নেই, সে সম্পূর্ণ। সুরক্ষিত থাকতে পারবে, তা হলে হয়তো আপত্তি করবে না।
সুবর্ণা বলল, তাই বলবেন। আপনার মতামত জানতে পারলে মনোরমাদিকে ফোন করব। আমি এখন যাচ্ছি। নিজের বেডরুমের দিকে চলে গেল সে।
.
১৩.
আরও তিনটে দিন কেটে গেল।
এর মধ্যে বিপজ্জনক বা চমকে দেবার মতো কিছুই ঘটেনি। যান্ত্রিক নিয়মে সুবর্ণা রোজ যা যা করে তাই করে গেছে। ঘুম থেকে উঠে শ্বশুর এবং দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, রাজীবের প্রতি আতিথেয়তা, কোথাও এতটুকু ত্রুটি হয়নি। তারপর স্নান করে, খেয়ে, মেয়েকে তার স্কুলে নামিয়ে, কলেজে চলে গেছে। ফিরে এসেও প্রায় একই রুটিন।
এর মধ্যে ওসি রামেশ্বর বসাক যথারীতি টেরোরিস্টের খোঁজে দিনে দু’বার করে ফোন করেছেন। বিমলেশ রাজীবের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। রোজই সে এ জন্য তাড়া দিয়ে চলেছে। সংগ্রামনারায়ণ রাজীব সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করেননি। তিনি সন্দেহমুক্ত হতে পেরেছেন কি না, মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না।
রাজীব ঘর থেকে প্রায় বেরোয়ই নি। সুবর্ণার লাইব্রেরি থেকে একের পর এক বই এনে পড়ে পড়ে সময় কাটিয়ে দিয়েছে। এ বাড়ি থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর ছকটা সে ঠিক করে ফেলতে পেরেছে কি না টের পাওয়া যায়নি। তবে তার চেহারায় বা কথাবার্তায় আগের সেই উগ্রতা ততটা নেই। হয়তো ভেবেছে, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ তার নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটবে না। কেউ তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা করবে না।
মায়া অবশ্য একটা খবর দিয়েছিল। একদিন দুপুরে নাকি রাজীব ছাদে উঠে কী সব দেখে এসেছে।
এই ক’দিন সামান্যই একটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে রাজীবের ঘরে চার বেলাই তার খাবার টাবার দিয়ে আসতে হত। তার অনুরোধে দু’দিন ধরে রাতের খাওয়াটা হল-ঘরের ডাইনিং টেবলে বসে এক সঙ্গে খাচ্ছে সুবর্ণা।
.
আজ রাতেও তারা খেতে বসেছিল। পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। টেবলের দু’ধারে বসলে কথা বলতে সুবিধা হয়।
মায়া দু’জনের প্লেটে এবং বাটিতে বাটিতে রুটি, ছোলার ডাল, মুরগির মাংস, তরকারি ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে গিয়েছিল। রাজীবের সামনে পারতপক্ষে সে থাকতে চায় না। কিছু দরকার হলে তাকে ডাকতে হবে।
চুপচাপ খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সুবর্ণা। মানসিক ভারসাম্যহীন সেই নিরপরাধ মহিলারা ঠিক তিনদিন পর মুক্তি পাবে। অথচ তাদের থাকার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। মনোরমাদি অনবরত ওদের এ বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য চাপ দিচ্ছেন। রাজীব বলেছিল, দু-একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে তার মতামত জানিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুই জানায়নি। সুবর্ণা যে সাহস করে জিজ্ঞেস করবে, তাও পারেনি। লোকটা খুবই সন্দিগ্ধ ধরনের। যার খোঁজে পুলিশ খ্যাপা কুকুরের মতো চারিদিকে হন্যে হয়ে ঘুরছে তার এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করলে যদি ভেবে বসে এর মধ্যে কোনও অভিসন্ধি আছে, সেই ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ বুজে থাকতে হয়েছে।
রাজীব টেবলের উলটো দিকে বসে বোধহয় লক্ষ করছিল। হঠাৎ বলল, মিসেস সিংহ, কী হয়েছে বলুন তো–
সুবর্ণা চমকে ওঠে, কই, কিছু না। আপনাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ, মানে–
কী?
সুবর্ণা এবার ঠিক করে ফেলল, রাজীব যা ভাবার ভাবুক, সে এখনই মেয়েগুলো সম্বন্ধে তার মত জেনে নেবে। বলল, সেদিন নন-ক্রিমিনাল লুনাটিক ক’টা মেয়ের কথা বলেছিলাম। আপনি কিন্তু এখনও আমাকে কিছু জানাননি। তিন দিন পর ওরা ছাড়া পাচ্ছে। মনোরমাদি ভীষণ তাড়া দিচ্ছেন।
রাজীব বলল, ওদের কথা আমি যে ভাবিনি তা নয়। সেদিনই আপনাকে বলেছি হেল্পলেস মেয়েগুলোকে শেলটার দেওয়া উচিত।’ বলে একটু থামল। কী চিন্তা করে ফের বলল, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে আসবেন। কিন্তু–
কিন্তু কী?
ওরা এলে আপনাদের অর্গানাইজেশনের অন্য ওয়ার্কাররাও নিশ্চয়ই আসবেন।
তা তো আসবেনই।
তারা কিংবা নন-ক্রিমিনালরা, কেউ কিন্তু দোতলায় উঠতে পারবে না।
দেখুন, মনোরমাদি বন্দনাদি এমনি আরও যাঁরা নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর সঙ্গে জড়িত তারা এ বাড়িতে এলে ওপরে উঠে শ্বশুরমশাই আর দাদাশ্বশুরকে দেখে যান। আমার শ্বশুরমশাই বাইরের কেউ দোতলায় উঠলে ভীষণ রেগে যান। ওয়ান্স হি ওয়াজ আ কিং, এখনও নিজেকে রাজাই মনে করেন। কমোনারদের সম্পর্কে তার ভয়ঙ্কর ঘৃণা। কিন্তু আমাদের নারী বিকাশ কেন্দ্র’-এর অ্যাক্টিভিস্টদের, বিশেষ করে মনোরমাদিকে খুব পছন্দ করেন। লাঞ্ছিত মেয়েদের জন্যে সারাটা জীবন যেভাবে ডেডিকেট করেছেন, সম্ভবত সেই কারণে। ওঁরা এলে কীভাবে আটকাবো?
স্থির দৃষ্টিতে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব। হয়তো বুঝতে চেষ্টা করে মনোরমাদের এ বাড়িতে আসার ভেতর কোনওরকম সূক্ষ্ম চাল রয়েছে কিনা। সুবর্ণা সেটা আঁচ করে নিয়ে দ্রুত বলে ওঠে, আমাদের অ্যাক্টিভিস্টদের সম্পর্কে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, টরচার্ড ডিসকার্ডেড মেয়েদের বেঁচে থাকা আর ওদের বাঁচিয়ে রাখা, এর বাইরে ওঁরা আর কিছু ভাবতে পারেন না। আপনি মনোরমাদিদের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
রাজীব বলল, ঠিক আছে। শুধু ওঁরা দোতলায় ওঠার আগে আমাকে জানিয়ে দেবেন। আমি অন্য কারও চোখে পড়তে চাই না।
আচ্ছা।
এখন পর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে আপনাকে অবিশ্বাস করার কারণ ঘটেনি। যে ক’দিন আছি, আশা করি, তেমন কিছু ঘটবে না।
রাজীব যে ক্রমশ তার প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে, এতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সুবর্ণা। এই সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একটা বিপজ্জনক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বক্ষণ ভয় আর আতঙ্ক। রাজীব যদি মনে করে, সুবর্ণারা কোনওরকম ক্ষতি করবে না, ‘প্রতাপপুর প্যালেস’-এ সে নিরাপদে থাকতে পারবে, তাহলে তার উগ্রতা কমে আসবে। সুবর্ণার প্রচণ্ড টেনসনও অনেকটাই হালকা হয়ে যাবে। হঠাৎ বিমলেশের মুখটা মনে পড়ল। এই হচ্ছে সুযোগ। তার সম্পর্কে রাজীবের সংশয় কেটে যেতে শুরু করেছে। এখনই বিমলেশের কথাটা বলা যেতে পারে।
খানিক নৈঃশব্দের পর সুবর্ণা বলল, আপনি যদি ভরসা দেন, একটা অনুরোধ করব।
রাজীব বলল, করুন।
আমার এক কলিগ একসময় উগ্রপন্থী আন্দোলনের একজন লিডার ছিল। দারুণ অনেস্ট আর আইডিয়ালিস্ট। এখন অবশ্য কোনওরকম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত নেই। সে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। যদি–
হোয়াট? সুবর্ণার কথা শেষ হতে না হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রাজীব। চাপা, ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, আমি যে এ বাড়িতে আছি, সে জানলে কী করে? আপনি বলেছেন?
বসুন। খুব শান্ত গলায় সুবর্ণা বলল, আমার সব কথা শুনলে বুঝতে পারবেন আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।
তার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে রাজীবের রাগ এবং উত্তেজনা অনেকটাই কমে আসে। সুবর্ণার চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে ফের বসে পড়ে সে।
সুবর্ণা বলে, বিমলেশ অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট। আপনি এ বাড়িতে আসার পরদিন খবরের কাগজে যে রিপোর্ট বেরিয়েছিল সেটা পড়ে ও সিওর হয়ে যায়, আপনি আমাদের বাড়িতেই আছেন। আমাকে তার ধারণার কথা বলে। আমি প্রথমে স্বীকার করিনি। পরে এমনভাবে বোঝায় যে আমাদের বাড়ি ছাড়া আপনার পক্ষে অন্য কোথাও থাকা সম্ভব নয়। আমাকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হয়। না থেমে এক নিঃশ্বাসে সে বলে যায়, বিমলেশ আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী। আমাকে যদি বিশ্বাস করতে পারেন, ওকেও পারবেন।
রাজীব উত্তর দিল না।
একটানা বলতে বলতে হাঁফিয়ে পড়েছিল সুবর্ণা। জোরে শ্বাস টেনে ফের শুরু করে, একটা কথা ভেবে দেখুন, চারদিন আগে বিমলেশ আপনার খবরটা পেয়ে গেছে। ওর লোভ থাকলে পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারত। তারা প্যালেস ঘিরে ফেললে আমরা হয়তো শেষ হয়ে যেতাম কিন্তু আপনিও রক্ষা পেতেন না। বিমলেশ ইনফরমেশনটা দেবার জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে যেত।
এতক্ষণে রাজীবের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। মাংসের ঝোলে রুটির একটা টুকরো ডুবিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে সে জিজ্ঞেস করে, আপনার বন্ধু আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান কেন?
খুব সম্ভব কোনও বিষয়ে আলোচনা করতে চায়।
কী বিষয়?
সেটা ও-ই বলবে।
রাজীব বলল, মনে হচ্ছে বিমলেশবাবু আমার সঙ্গে আলাপ করেন সেটা আপনিও চান। ঠিক আছে, ওঁকে নিয়ে আসবেন।
এত সহজে রাজীব রাজি হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সুবর্ণা। বলল, কবে আনব?’
কাল কলেজ ছুটির পর আনতে পারেন।
চুপচাপ কিছুক্ষণ দু’জনে খেয়ে যায়। চারদিন রুদ্ধশ্বাসে কাটানোর পর এই প্রথম অনেকটা সহজভাবে বাইরের হাওয়া ফুসফুসে টানতে পারছে সুবর্ণা। ইদানীং সারারাত প্রায় জেগে জেগেই কেটে যায়। আজ খুব সম্ভব ভাল করে ঘুমোতে পারবে সে।
রাজীব ডাকল, মিসেস সিংহ–
বলুন।
আপনি আমাকে শেলটার দিয়েছেন, আপনার হসপিটালিটির তুলনা হয় না। একই বাড়িতে আমরা আছি, অথচ আপনার সম্বন্ধে কিছুই প্রায় জানি না।
আমিও তো একই কথা বলতে পারি। আপনার সম্পর্কে খবরের কাগজের রিপোর্টটা ছাড়া আর কিছুই আমারও জানা নেই।
রিপোের্টটা তো হাজার হাজার পাঠক পড়েছে। কিন্তু আমি যে কতটা ভীতিকর লোক, আমার মধ্যে কী ধরনের নিষ্ঠুরতা রয়েছে সে অভিজ্ঞতা শুধু আপনারই হয়েছে। সেটা কিন্তু কম জানা নয়। তবু যদি আরও জানতে চান, পরে কখনও বলা যাবে। আজ কিন্তু আপনার কথা শুনব।
সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব টেবলের ওপর সামান্য ঝুঁকে বলে, এ বাড়িতে আসার পর আপনার শ্বশুর, দাদাশ্বশুরকে দেখছি। কিন্তু আপনার স্বামী–মানে তিনি কি বাইরে থাকেন?
সুবর্ণা আস্তে মাথা নাড়ে, না। আমি ডিভোর্সি। সে অন্য একজনকে বিয়ে করে যতদূর জানি দিল্লিতে ছিল। এখন কোথায় আছে বলতে পারব না। এ বাড়ির সঙ্গে বহু বছর তার কোনও সম্পর্ক নেই।
রাজীব অবাক হয়ে যায়; কিছু বলে না।
তার মনোভাবটা মুহূর্তে বুঝে নেয় সুবর্ণা। এই সন্ত্রাসবাদী লোকটা তার ভেতরকার কোনও একটা স্পর্শকাতর জায়গায় যেন হাত দিয়ে ফেলেছে। সে বলে, ডিভোর্সের পর কেন এখানে পড়ে আছি, তাই জানতে চান তো?
রাজীব আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
শুধু এটুকু বললে বুঝবেন না। পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটাই তাহলে শুনুন।
রাজীব উদ্গ্রীব তাকিয়ে থাকে।
সুবর্ণার ওপর হঠাৎ কী যেন ভর করে বসে। ঘোরের মধ্যে সে বলতে শুরু করে।
কখনও কখনও মানুষ নিজের অতীতকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চায়। রাজীব উপলক্ষ মাত্র। অচেনা এই লোকটাকে সামনে বসিয়ে সুবর্ণা যেন নিজেকেই নিজের কথা শোনাতে থাকে। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। তবে মনে মনে নয়, স্পষ্ট উচ্চারণে।
সমস্ত শোনার পর মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল রাজীবের। সে বলল, সংগ্রামনারায়ণ আর বিক্রম, দুজনেই দেখছি জঘন্য টাইপের স্কাউড্রেল। একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনাকে ফেলে পালিয়ে গেছে। কমোনার হওয়ার জন্যে। আরেক জনের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু পাননি। তবু আপনি এখানে পড়ে আছেন?
মৃদু হাসির একটা রেখা সুবর্ণার মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। সে বলে, একজন বোধবুদ্ধিহীন বুড়ো মানুষ, আরেক জন অসহায় হার্ট পেশেন্টকে ফেলে কি যাওয়া যায়?
মানবিকতা?
সুবর্ণা উত্তর দিল না।
অদ্ভুত হেসে রাজীব বলল, আপনি দেখছি পৃথিবীর মতো সর্বংসহা। ঘৃণা, বিশ্বাসভঙ্গ–কোনও কিছুই আপনাকে বিচলিত করে না।
সুবর্ণা এবারও কিছু বলল না; নিঃশব্দে খেতে লাগল।
রাজীব ফের বলল, মিসেস সিংহ, আপনি আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। সকাল থেকে শ্বশুর, দাদাশ্বশুরের সেবা, মেয়েকে পড়ানো, কলেজ, সোশাল ওয়ার্ক, এত সব কী করে যে সামলান ভেবে পাই না। ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি। আপনার মতো মহিলা আমি আগে কখনও দেখিনি।
ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী যে ‘প্রতাপপুর প্যালেস’কে সর্বক্ষণ চরম আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে, নিজের নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কিছু যে ভাবে না, তার মুখ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্য শোনার পরও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। সুবর্ণা চুপ করে থাকে।
রাজীব থামেনি, আপনার সম্বন্ধে একটা কথা যে কতবার ভেবেছি তার ঠিক। নেই।
সুবর্ণার চোখেমুখে ঔৎসুক্য ফুটে ওঠে। তার সম্পর্কে রাজীব যে কিছু ভাবতে পারে–সেটা খুবই চমকপ্রদ ব্যাপার। সে জিজ্ঞেস করে, কী ভেবেছেন?
আপনি ইচ্ছা করলে দেবীকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশে খবর দিতে পারতেন। তারা বাড়ি কর্ডন করলে আপনার শ্বশুর আর দাদাশ্বশুর নিশ্চয়ই বেঁচে থাকত না। পুলিশের গুলিতে আমিও হয়তো ঝাঁঝরা হয়ে যেতাম কিংবা ব্লাস্ট করে এই প্যালেস উড়িয়ে নিজেও মরতাম। পুলিশকে ইনফরমেশন দেবার জন্য মাঝখান থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা তো পেতেনই, যে ব্লাডি সোয়াইন শ্বশুর আপনাকে এত অপমান করেছে, যে হ্যাঁজব্যান্ড চরম বিট্রে করেছে তাদের বংশকে ভাল রকম শিক্ষা দিতে পারতেন। এত বড় সুযোগ পেয়েও কাজে লাগালেন না।
সুবর্ণা চমকে ওঠে, এ আপনি কী বলছেন! আপনাকে তো আগেই জানিয়েছিলাম, এই বংশের অজস্র অপরাধ আর ত্রুটির মধ্যে একটা আউটস্ট্যান্ডিং কোয়ালিটি রয়েছে। এরা যাকে আশ্রয় দেয় তার ক্ষতির কথা চিন্তা করে না। এ বাড়ি থেকে আমি কিছুই পাইনি, কোনওরকম প্রত্যাশাও নেই। তবে ওদের এই গুণটাকে শ্রদ্ধা করি। মনে করি–আশ্রয় প্রার্থীর, সে যেমনই হোক, সর্বনাশের কথা ভাবা অন্যায়। একটু থেমে বলল, আর সংগ্রামনারায়ণদের শিক্ষা দেবার কথা বললেন তো? রিভেঞ্জ বা ভেনডেটা, এসব গল্পেই পড়েছি, ফিল্মেও দেখেছি। নিজের জীবনে? ইমপসিবল। প্রতিহিংসা শব্দটাকে আমি ঘৃণা করি। আই হেট ইট।
নিষ্ঠুর ভাবাবেগহীন এক বিচ্ছিন্নতাবাদীর চোখে মুখে শ্রদ্ধা কিংবা মুগ্ধতার মতো কিছু একটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। রাজীব বলে, সেই জন্যেই তো বললাম ইউ আর আ লেডি এক্সট্রা-অর্ডিনারি।’
এমন অনর্গল প্রশংসার উত্তরে স্বাভাবিকভাবে ধন্যবাদ জানানোই নিয়ম। সুবর্ণা কিন্তু কিছু বলল না।
খানিক নৈঃশব্দের পর রাজীব ফের শুরু করে। যেন আপন মনে বলে যায়, কতদিন এ বাড়িতে থাকতে পারব জানি না। রাতে আপনারা ঘুমিয়ে পড়লে রোজ ছাদে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। চোখে পড়ে চারদিকে প্লেন ড্রেসের পুলিশ ফাঁদ পেতে রেখেছে। রাজবাড়ি বলে, কিংবা আপনার কথা বিশ্বাস করে পুলিশ এখানে সেভাবে হানা দেয়নি। তবে ওরা মনে করে এদিকেই কোথাও আমি লুকিয়ে আছি।
রাজীব ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় সুবর্ণা।
রাজীব থামেনি, খুব বেশিদিন আমি আপনাদের এখানে থাকব না। এ বাড়ি থেকে বেরুলে পুলিশ বা মিলিটারি, যাদের সঙ্গেই হোক, এনকাউন্টারে আমার মৃত্যু অনিবার্য। যতদিন বাঁচি, আপনার কথা আমার মনে থাকবে মিসেস সিংহ। শেষ দিকে তার কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে আসে।