বিজ্ঞাপনে সেকাল
প্রথম প্রস্তাব
সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের বিজ্ঞাপন ঠিক আয়নার মতন। তার মধ্যে সমাজের প্রতিচ্ছবি যেমন দেখা যায়, আর কোনো সংবাদের মধ্যে বোধহয় তেমন দেখা যায় না।
এক সপ্তাহের ‘কর্মখালি’ ও ‘কর্মপ্রার্থী’ বিজ্ঞাপনের মধ্যে দেশের প্রকৃত সমস্যা যেমন নানাদিক থেকে ধরা পড়ে, এক বছরের সংবাদের স্তূপের মধ্যে তা পড়ে না। ‘পাত্র ও পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনগুলি যদি কেউ মন দিয়ে পড়েন, তাহলে সমাজের নাড়ির খবর জানতে পারবেন, যা কোনোকালে কোনো সংবাদের মারফত জানা যায় না। যেমন, একদিন ‘পাত্রপাত্রী’র বিজ্ঞাপনের মধ্যে দেখলাম, জনৈকা লেডি ডাক্তার নিজেই নিজের বিবাহের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এই মর্মে যে, তিনি ভাল রোজগার করেন, বয়স তিরিশ প্রায়, স্বাস্থ্যও ভাল এবং বর্তমানে বিবাহ করবেন, সুতরাং রোজগারি, কর্মক্ষম যুবকদের তিনি দরখাস্ত করতে বলেছেন। এই ধরনের বিজ্ঞাপন সাধারণত চোখে পড়ে না। বিজ্ঞাপন পড়ে ভাবলাম, কী হতে পারে? কিছুই না, খুব সহজ ব্যাপার। একালের মধ্যবিত্ত সমাজের এটা একটা বিষম সমস্যা। মেয়েদের লেখাপড়া শিখে রোজগার করতে হয়, বয়স বেড়ে যায় এবং বিবাহ আর ঘটে ওঠে না। হঠাৎ একদিন হয়তো যৌবনের প্রান্তে পৌঁছে চমকে উঠতে হয়—তা—ই তো। লেডি ডাক্তার সেইরকম চমকে উঠে একটা ‘ডেস্পারেট’ সমাধান করেছেন এবং ‘বিজ্ঞাপন’ দেওয়া ছাড়া তাঁর উপায় কী? এখন তো স্বয়ংবরসভা ডাকা যায় না। এইরকম আরও অনেক বিজ্ঞাপনের ভিতর দিয়ে আমাদের সমাজের নানা রকমের সমস্যা উঁকি মারে। ‘সংবাদের’ মধ্যে যেসব সমস্যা আত্মগোপন করে থাকে, ‘বিজ্ঞাপনের’ মধ্যে আত্মপ্রকাশ না করে তাদের উপায় নেই। কারণ ‘বিজ্ঞাপন’ হল ‘বিশেষভাবে জ্ঞাপন’, নিরাভরণ আত্মপ্রকাশ, লুকোচুরির অবকাশ নেই তার মধ্যে।
এই বিজ্ঞাপনের ভিতর দিয়েই সেকালের সমাজের এমন সব অদ্ভুত বিচিত্র পরিচয় পাওয়া যায়, যা কোনো ইতিহাসগ্রন্থে পাওয়া যায় না। কারণ ইতিহাস যাঁরা এতদিন ধরে লিখে এসেছেন তাঁরা অধিকাংশই যান্ত্রিক ঘটনাক্রমকে ‘ইতিহাস’ বলে মনে করেছেন, মানুষের মনোভাব রীতিনীতি আচার—ব্যবহার শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদিকে ইতিহাস আখ্যা দেননি। সমাজের ইতিহাস সাধারণ মানুষ কিন্তু নানাভাবে লিখে গেছে। তার মধ্যে ‘বিজ্ঞাপন’ একটি। সংবাদপত্রের ‘সংবাদ’ হল সমাজের হোমরাচোমরা যাঁরা তাঁদের জন্য, সুতরাং তার মধ্যে সমাজের পূর্ণাঙ্গ ছবির বদলে বিকলাঙ্গ ছবি পাওয়াই সম্ভবপর। ‘বিজ্ঞাপন’ সকলের জন্য, পয়সা দিলেই হয়। সুতরাং ‘বিজ্ঞাপনের’ মধ্যে সমাজের যে ছবি ফুটে ওঠে তা ‘সংবাদের’ চেয়ে অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ। এই ধরনের কয়েকটি টুকরো ‘বিজ্ঞাপনের’ ভিতরে দিয়ে সেকালের সমাজের ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ‘সেকাল’ বলতে আমি ইংরেজ আমলের প্রথম পর্বে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, বাংলার সমাজের কথা বলছি। বাঙালিদের কথা নয়, কারণ বাঙালি সমাজের কথা আরও অনেক সূত্রে জানা যায়। এখানে ইংরেজ ও অন্যান্য জাতের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলি প্রধানত ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকা থেকে সংকলিত।
১৭৯৪ সালে কলকাতার কোনো পত্রিকায় এই মর্মে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয় : ‘একজন মহিলার জন্য পরিচারিকা চাই। পরিচারিকার ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে জানা চাই এবং কোনো ইউরোপিয়ানের কন্যা, অথচ এ দেশি স্ত্রীলোক হলেই ভাল হয়। টিরেটা বাজারের কাছে মিঃ দা সুজার কাছে খোঁজ করুন।’ বিজ্ঞাপনটির মধ্যে সেকালে সমাজের এমন একটা ছবি ফুটে উঠেছে যা অনেক সংবাদ ঘেঁটেও পাওয়া যাবে না। ‘ইউরোপিয়ানের কন্যা অথচ নেটিভ বা এ দেশি স্ত্রীলোক’ বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করে বলার নিশ্চয় দরকার নেই। আমাদের দেশি সমাজে তখন ইংরেজদের ‘ইম্পিরিয়ালিজম’ যে পারিবারিক জীবন পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল তা এই বিজ্ঞাপন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ইংরেজদের নৈতিক অবস্থা, এবং কতকটা আমাদেরও, বুঝতে কষ্ট হয় না।
আর—একটি ‘বিজ্ঞাপনে’ (১৮০১ সালে) দেখা যায়, জনৈক শেরিফ আব্রাহাম শ্রীরামপুর থেকে জানাচ্ছেন: ‘সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে আমার স্ত্রী শ্রীমতী হর্রপসীমি শেরীন, চুঁচুড়ার আর্মেনিয়ান মুল্লুকসেটের কন্যা, গত ৪ ডিসেম্বর (১৮০০) আবার বাড়ি থেকে অকারণে, কিছু না বলে—কয়ে চম্পট দিয়েছে। সুতরাং শ্রীমতী যদি কারও কাছ থেকে টাকাপয়সা ধার নেয় তার জন্য আমি দায়ী হব না।’ লম্পট না হয়েও গৃহিণীর চম্পট দেওয়ার ব্যাপারটা শুধু আমাদের সমাজে নয়, ওদের সমাজেও বেশ চালু ছিল দেখা যায়। অর্থাৎ উভয় সমাজেরই অবস্থা এক, কে কাকে দেখে ঠিক নেই। তবে বিদেশিদের চারিত্রিক চিত্রটা আরও অনেক স্পষ্ট। তখন অর্থশোষণই যে তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য ও কাম্য ছিল, তা এই বিজ্ঞাপনের মধ্যে উগ্রভাবে ফুটে উঠেছে দেখা যায়। স্ত্রী পলাতক, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, সাহেবের মাথায় তখন টাকা ধারের কথা খেলছে। বিজ্ঞাপনও সেইজন্য দেওয়া, পলাতক স্ত্রী—র কোনো খোঁজখবরের জন্য নয়।
বই চুরিরও একটা মজার ‘বিজ্ঞাপন’ পাওয়া যায়। ‘Lent or Lost some years since’ এই হল বিজ্ঞাপনের হেডিং। ভদ্রলোক বইখানা কাউকে ধার দিয়েছেন, কি সত্যি চুরি গেছে, তা সঠিক জানেন না, তাই ‘Lent or Lost’ এবং কবে গেছে তা—ও জানা নেই বলে ‘some years since’। বিজ্ঞাপনটির মর্ম এই : ‘১৭৬০ সালে মিলার কোম্পানির ছাপা পোপের গ্রন্থাবলির প্রথম খণ্ড। কভারের ভেতরের দিকে মালিকের নাম লেখা আছে। যদি কারও কাছে বইখানা থাকে, তিনি যেন ফেরত দেন। আর তার জন্য যদি কেউ পুরস্কার চান তাহলে বইয়ের মালিক প্রকাশককে জানাতে পারেন। প্রকাশক পুরস্কার হয়তো দিতেও পারেন, কারণ এই বইয়ের অভাবে তিনি পরবর্তী সংস্করণ ছাপতে পারছেন না।’ এখানেও লক্ষণীয় হচ্ছে, অর্থলোভ ও কার্পণ্য। বই ফেরত দিলে তার মালিক যিনি তিনি যে কোনো পুরস্কার দেবেন এমন কথা বলছেন না, প্রকাশককে জানাবেন বলছেন। একে ‘লেন্ট বা লস্ট’, তার ওপর ‘কয়েক বছর আগে’ এবং সবার উপর, ফেরত দিলে অন্যকে পুরস্কারের জন্য জানানো—সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিচিত্র মনোভাব ও চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় না কি? এই শ্রেণির বিদেশিরাই প্রথম যুগে আমাদের চরিত্র ও মানসতার দীক্ষাগুরু ছিলেন।
জনৈক ডাঃ ডিনউইডি ১৭৯৫ সালে এক বিজ্ঞাপনে জানাচ্ছেন যে, দর্শন ও রসায়ন বিজ্ঞান সম্বন্ধে তিনি ২৫ থেকে ৩০টা বক্তৃতা দেবেন। বক্তৃতা শোনার ফি হল ১০ সোনার মোহর। জানি না, এখন কোনো দর্শন বা বিজ্ঞানের পণ্ডিতের পক্ষে এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সাহস হবে কি না, অন্তত আমাদের দেশে। সাহস হলেও, দশটা পয়সা দিয়েও কেউ তাঁর বক্তৃতা শুনতে যাবে না, মোহর তো দূরের কথা। সিনেমার কোনো অভিনেত্রী যদি বক্তৃতা দেন, তাহলে হয়তো দশ টাকা পর্যন্ত টিকিট বিক্রি হতে পারে।
এই সময়কার আর—একটি বিজ্ঞাপনের অন্তর্নিহিত রহস্য আমি অনেক ভেবেচিন্তেও উদ্ঘাটন করতে পারিনি। বিজ্ঞাপনটির মর্ম এই : ‘বৈঠকখানা রোডে ডিরোজিওর (কোন ডিরোজিও?) বাড়ির ঠিক সামনে নিচের তলায় দু’খানা ঘর, একটা বড় হলঘর, কয়েকটি দোকানঘরসহ একত্রে ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করা হবে। কোনো মহিলা ভাড়াটে বা ক্রেতা চাই। বিস্তারিত বিবরণের জন্য বউবাজারের মিঃ জন অ্যাথানাস সাহেবের কাছে খোঁজ করুন।’ কে বলবে, বউবাজারের এই সাহেব বাড়িওয়ালা মহিলা ভাড়াটে বা ক্রেতা চান কেন? ‘‘Premises would be a desirable gift to a woman’’ এ কথাটা লেখারই বা উদ্দেশ্য কী? কেরি সাহেব এই বিজ্ঞাপনটি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন—‘‘Rather a strange gift to a woman!’’ বাস্তবিকই তা—ই।
এখন তো অনেকেই লন্ড্রিতে কাপড়চোপড় কাচান এবং অনেকেও স্টিমে না কাচালে চলে না। তখন এইভাবে কাপড় কাচানো সম্ভব ছিল না। তখন ১৭৮৭ সালে মেসার্স ডেভিডসন অ্যান্ড কোং বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছেন যে, এন্টালিতে তাঁরা কাপড় ধোলাইয়ের ব্যবসা খুলেছেন। স্বচ্ছন্দে তাঁদের কাছে কাপড় কাচানো যেতে পারে। কাপড় কাচার ‘রেট’ হচ্ছে এই : পুরুষ বা মহিলা—প্রতি মাসে ৬ টাকা, কিশোর (৭—১২)—প্রতি মাসে ৪ টাকা, বালক (১—৬)—প্রতি মাসে ২ টাকা এবং ভৃত্য প্রতি মাসে ১ টাকা। ‘রেট’ মাসিক এবং কাপড় হিসেবে নয়, বয়স ও সামাজিক মর্যাদা হিসেবে।
১৭৯৫ সালের এক বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে যে, ৫ নং কোর্ট হাউস লেনে একটি সুন্দর দোতলা বাড়ি বিক্রি করা হবে। বাড়িটির অন্যতম সুবিধা হচ্ছে যে কোনো ধুলো বা গোলমাল নেই—‘Free from dust and noise’—এবং পাশেই রাধাবাজার। বাড়িটির সংলগ্ন একটি চমৎকার বাগানও আছে। মাত্র ১৫০ বছর আগে রাধাবাজারের কাছাকাছি জায়গার অবস্থা কী ছিল বোঝা যায়, এখন ভাবলেও ভয় হয়। এখন রাধা বা শ্যাম যে—কোনো বাজারের দিকে তাকালে মনে হয়, কোথায় বা বাগান ছিল, আর কোন বাড়িই বা ‘free from dust and noise’ ছিল।
কলকাতার রাস্তায় তখন গোরু বা ষাঁড়ের চেয়ে ঘোড়া (হাতিও) চলে বেড়াত বেশি। অনেকদিন ধরে এই ভ্রাম্যমাণ ঘোড়াদের দেখতে দেখতে এক সাহেবের উর্বর মস্তিষ্কে এক অভিনব প্ল্যান গজিয়ে উঠল। ১৭৯১ সালের ২৮ এপ্রিল, ‘ক্যালকাটা গেজেট’—এর সাহেব এই মর্মে এক বিজ্ঞাপন দিলেন : ‘ঘোড়াগুলো এইভাবে বেফায়দা নিষ্কর্মার মতন ঘুরে বেড়ায়, দেশের কোনো কাজে লাগে না। আমি তাই ভেবেছি, যদি ধরে ধরে তাদের বংশবৃদ্ধি করানো যায়, তাহলে তাতে দেশের অনেক উপকার হতে পারে। আমার বিশ্বাস ঘোড়ার মালিকরা আমার এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন। যদি করেন তাহলে ক্যালকাটা গেজেটের প্রিন্টারের কাছে তাঁরা যে—কেউ আমার এই বিজ্ঞাপনের খরচটা পাঠিয়ে দেবেন। খরচ পেয়ে গেলেই আমি পূর্ণোদ্যমে আমার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে লেগে যাব।’ অভিনব পরিকল্পনা যে কেবল একালেরই একচেটে তা নয়, সেকালেও ছিল এবং সাহেবদের মাথা যে কীরকম সাফ ছিল তা এই প্ল্যান থেকেই বোঝা যায়। ‘ক্যালকাটা গেজেট’—এর মতন কাগজেও এই বিজ্ঞাপন ছাপা হত।
.
দ্বিতীয় প্রস্তাব
সিটন—কার সাহেব ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকার সংবাদ, সরকারি নোটিশ, সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও বিজ্ঞাপন সঙ্কলন করেছেন সামাজিক ইতিহাসের উপকরণ হিসাবে। আজকাল কোনো ঐতিহাসিক বা সমাজবিজ্ঞানী এসব কাজ করা প্রয়োজন বোধ করেন না। এর মধ্যে সিটন—কার সাহেব বলেছেন যে, বিজ্ঞাপনগুলি হল: ‘the most interesting of the whole. It throws light on the minutest details of the inner and domestic life of the English community of Calcutta and the Bengal Presidency.’ সুতরাং আবার বলছি, বিজ্ঞাপন উপেক্ষণীয় নয়, সামাজিক ইতিহাসের দিক দিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান উপকরণ। আরও কয়েকটি বিজ্ঞাপন তাই এখানে সঙ্কলন করে দিলাম।
১ এপ্রিল, ১৭৮৪ : চীন দেশবাসী টম ফ্যাট কলকাতা শহরের বাসিন্দাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছেন যে, যাঁদের বসতবাড়িতে, বাগানে বা অন্যত্র কোথাও ডোবা—পুষ্করিণী ইত্যাদি আছে, তাঁরা যদি তাঁকে জানান, তাহলে তিনি পরিষ্কার করে দেবার উত্তম ব্যবস্থা করতে পারেন, খুব অল্প খরচে। টম ফ্যাট বিজ্ঞাপনে এ কথাও জানিয়েছেন যে, তিনি যে—কোনো বাঙালিবাবুর চেয়ে কাজটা আরও সহজে করতে পারবেন, কারণ তাঁর ‘চীনা পাম্প’ আছে। যদি কোনো ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে চান তাহলে তিনি যেন কলকাতার ঠিক উল্টোদিকে সালখেতে (হাওড়া) তাঁর রমের (মদ) কারখানাতে খোঁজ করেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : টম ফ্যাট রুটি দিয়ে খাবার মতন বেশ ভাল চিনিও তৈরি করেন, বিদেশি চিনির চেয়ে কোনো অংশেই খারাপ নয়। এ ছাড়া চিনা কারিগরের কাঠের আসবাবও তৈরি করা হয়।
কলকাতার ‘চীনা টাউন’ গড়ে ওঠার আগেকার ইতিহাসের আভাস এই বিজ্ঞাপনের ভিতর থেকে পাওয়া যায়। টম ফ্যাটের ‘চীনা পাম্প’টি বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ এই পাম্প দিয়ে তিনি বাঙালিবাবুদের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার কনট্রাক্টরি ব্যবস্থা থেকে হাটিয়ে দিচ্ছেন। তখন কলকাতার অধিকাংশ লোকের বাড়িতে যে ডোবা, পুকুর, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি থাকত তা—ও বোঝা যাচ্ছে। তা ছাড়া, জুতোর ব্যবসা চীনাদের প্রথম ও প্রধান ব্যবসা নয়, তা—ও জানা যায়। টম ফ্যাটের শুধু যে ট্যাঙ্ক সাফ করবার ‘চীনা পাম্প’ ছিল তা নয়, সালখেতে মদ চোলাইয়ের (রম) কারখানা ছিল, চিনির ব্যবসা ছিল এবং ফার্নিচারেরও কারবার ছিল।
২৯ এপ্রিল, ১৭৮৪ : একখানা ফিটনগাড়ি, একখানা চার স্প্রিংযুক্ত বগি, একখানা দুই স্প্রিংযুক্ত বগি, একটা সুদৃশ্য পাল্কি (মহিলাদের) এবং একটা চেয়ার—বসানো ভদ্রলোকের পাল্কি বিক্রি করা হবে। প্রত্যেকটি গাড়ি ও পাল্কি খুব মজবুত করে তৈরি এবং প্রায় নতুনের মতন আছে। রাধাবাজারে ম্যান সাহেবের কাছে খোঁজ করুন।
আজকালকার সংবাদপত্রে ‘বিক্রয়ের’ বিজ্ঞাপন খুঁজে এর মধ্যে একটি জিনিসও কেউ বার করতে পারবেন না—ফিটন, বগি, লেডিদের পাল্কি, ভদ্রলোকদের পাল্কি, কোনোটাই না।
৩ জুন, ১৭৮৪ : আগামী ১১ জুন শুক্রবার ডানকান সাহেবের নিলামঘরে এই বিশাল বাগানটি বিক্রি করা হবে। বাগানটির বিবরণ এই : বাগানটি হল ঠিক ‘বৈঠকখানা’র মধ্যে—পূর্বদিকে তার মারাঠা খাত, উত্তরে পিটার সুকিয়ার (যার নামে সুকিয়া স্ট্রিট?), পশ্চিমে চৈতন বসাকের এবং দক্ষিণে মুঙ্গরো জমাদারের বাগান। বাগানটি প্রায় চার বিঘা সাড়ে এগারো কাঠা জমির উপর এবং তার মধ্যে একটি মাছভরা, শান—বাঁধানো খাটওয়ালা বেশ বড় ট্যাঙ্ক আছে। এ ছাড়া বাগানের মধ্যে ৫০০ ফলের গাছ আছে নানা রকমের।
মারাঠা—খাত, পিটার সুকিয়ার বাগান, চৈতন্য বসাকের বাগান দিয়ে ঘেরা এই বাগানটি বৈঠকখানা অঞ্চলে কোথায় ছিল, কোনো প্রশ্নতত্ত্ববিদ খুঁজে বের করতে পারবেন কি? একটা বাগান কেন, চারদিকেই তো বাগান ছিল, এমনকি মুঙ্গরো জমাদারের বাগান পর্যন্ত। এতগুলি বাগান বৈঠকখানা অঞ্চলে কোথায় ছিল? বেশ বোঝা যায়, কলকাতা শহরে বৈঠকখানা অঞ্চল তখন বাগানে বাগানে বাগানময় ছিল, এখন তার কোনো চিহ্ন কোথাও নেই।
২ সেপ্টেম্বর, ১৭৮৪ : মেসার্স উইলিয়াম অ্যান্ডলি একটি চমৎকার ঘোড়া বিক্রি করবেন। বগির পক্ষে ঘোড়াটি খুব ভাল, দৌড়নোয় ওস্তাদ। মূল্য ৩০০ সিক্কা টাকা।
এই জীবটিও এখন আর বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপিত হয় না। তখন খুবই হত, কারণ বগি, ফিটন বিক্রি হলে, ঘোড়া বিক্রি তো হবেই।
২৫ নভেম্বর, ১৭৮৪ : আধ ডজন ভাল লেখক চাই। হাতের লেখার এক পৃষ্ঠা নমুনাসহ দরখাস্ত না করলে, কোনো দরখাস্ত বিবেচনা করা হবে না। এজেন্সি অফিসে ‘এ বি’র কাছে দরখাস্ত করুন। যাঁদের হাতের লেখা ভাল নয় এবং তাড়াতাড়ি লিখতে পারেন না, তাঁরা দরখাস্ত করবেন না।
আজকাল শুধু এই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে চাকরি পাওয়া খুব মুশকিল।
৩ মার্চ, ১৭৮৫ : আগামী ৬ মার্চ সোমবার মিঃ বন্তফিল্ড ওল্ডকোর্ট হাউসে ওয়ারেন হেস্টিংসের এই মূল্যবান জিনিসগুলি বিক্রি করবেন। নগদ টাকায় ক্রেতাদের কিনতে হবে, এবং পাঁচ দিনের মধ্যে নিলামঘর থেকে মাল সরিয়ে না নিলে আবার তা নিলাম করা হবে। জিনিসের একটা তালিকা দেওয়া হল।
প্লেট, ফার্নিচার, ছবি (অরিজিনাল পেন্টিং) ও প্রিন্ট, বড় অর্গান, মূল্যবান অশ্বসজ্জা, কারুকার্যখচিত হাতির হাওদা, ভাল ভাল বাহারে পাল্কি, কয়েকটা দামি কার্পেট ও শতরঞ্চি, বিলাসভ্রমণের উপযুক্ত সাজানো নৌকা, ভাল বিলেতি ঘাস—কাটা যন্ত্র, কয়েকটি তাঁবু এবং আরও নানা রকমের খুচরো জিনিস। নগদ টাকা ছাড়া কোনো জিনিস হাতছাড়া করা হবে না।
নিলামে বিক্রি হচ্ছে, তবু নগদ টাকার উপর ঝোঁকটা খুব বেশি এবং বিজ্ঞাপনে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। হয়তো ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশেই নিলামওয়ালা করতে বাধ্য হয়েছেন। যা—ই হোক, নিলামের বস্তুগুলি খুব ‘ইন্টারেস্টিং’ নয় কি? যেমন—অশ্বসজ্জা, হাতির হাওদা, পাল্কি, নৌকা ইত্যাদি। তখনকার দু’চারজন বাঙালিবাবু (রাজা নবকৃষ্ণের মতন) নিলাম থেকে এসব জিনিস কিছু নিশ্চয় কিনেছিলেন। যদি সেগুলো সঞ্চিত হত এবং মিউজিয়ামে আসত, তাহলে আজ আমরা দেখতে পেতাম।
কর্মপ্রার্থী—১০ মার্চ, ১৭৮৫ : বিবাহিত দম্পতি। স্ত্রী যিনি তিনি খুব ভাল ‘হেয়ারড্রেসিং’ জানেন এবং কোনো সম্ভ্রান্ত লেডির পরিচারিকা হতে পারেন। স্বামী জন্মে থেকেই কচুয়ানি বা গাড়োয়ানি শিখেছেন এবং এ কাজ ভালই করতে পারেন।
দম্পতি যে দারুণ দম্পতি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বামী কচুয়ানি করবেন এবং স্ত্রী মনিবপত্নীর কেশপরিচর্যা করবেন, খুব চমৎকার আইডিয়া। আজকাল কোনো মোটর ড্রাইভারের স্ত্রী—র পক্ষে এ কাজ পাওয়া সম্ভব নয়, বড়জোর আয়ার কাজ পেতে পারেন। তার কারণ এখনকার মেমসাহেবদের কেশ অধিকাংশই উৎপাটিত, পরিচর্যার সুযোগ নেই। তখন কিন্তু মেমসাহেবরা কায়দা করে চুল বাঁধতেন, খোঁপাও করতেন।
২১ এপ্রিল, ১৭৮৫ : কলকাতা শহরের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করে হোম সাহেব তাঁদের অবগতির জন্য জানাচ্ছেন যে, সপ্তাহে তিন দিন করে তিনি তাঁর আস্তানায় ড্রয়িং পেন্টিং শিক্ষা দেবেন। যাঁরা হোম সাহেবের কাছে সুকুমারকলা শিখতে চান তাঁরা চিঠি পাঠিয়ে তাঁর কাছ থেকে পারিশ্রমিকের রেট জানতে পারেন, অথবা সোজা নিজেরা এসে রাধাবাজারে দেখা করতে পারেন তাঁর বাড়িতে।
এ দেশে আর্টশিক্ষার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে তা আর্টের ছাত্র, মাস্টার ও আর্টিস্টদের জেনে রাখা দরকার। মোট কথা, আর্ট স্কুল হবার অনেক আগে থেকেই তা আরম্ভ হয়েছে।
১ ডিসেম্বর, ১৭৮৫ : ইয়োরোপের বিখ্যাত হেয়ারড্রেসার মালভের সাহেব কলকাতায় এসে কেবল শহরের সম্ভ্রান্ত লেডিদের জানাচ্ছেন যে, তিনি মাসে দুই সোনার মোহরের বিনিময়ে নিয়মিত কেশপরিচর্যার ভার নিতে রাজি আছেন। ফিতে ও ফুল দিয়ে হাল ফ্যাশনে চুল বাঁধতে তাঁর সমকক্ষ নাকি আর কেউ নেই। অল্প পারিশ্রমিকে তিনি ‘স্লেভদের’ (‘দাসদের’) শিক্ষা দিতেও পারেন। হারমনিক ট্যাভার্নের পিছনে খোঁজ করতে বলা হয়েছে।
ইংরেজ মহিলাদের হেয়ারড্রেসিঙের শখ কতটা ছিল বোঝা যায়। ইয়োরোপ থেকে ড্রেসাররাও আসতেন কলকাতায়, ব্যবসায়ের জন্য। ফিতে ও ফুল দিয়ে মেয়েদের চুল বাঁধতে তাঁরা ওস্তাদ ছিলেন। আবার এ দেশে শিক্ষাও দিতেন তাঁরা (‘স্লেভ’ কথাটি এখানে লক্ষ করার মতন)। কোথায় গেলেন এইসব গুণী সাহেব?
৩০ অক্টোবর, ১৭৮৮ : বিখ্যাত হেয়ারড্রেসার লা’ফ্লোর সম্প্রতি প্যারিস থেকে কলকাতায় এসেছেন। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা চুল ছাঁটবার জন্য তাঁর রেট হল এই:
মহিলাদের কেশবিন্যাস : ৪ টাকা
ভদ্রলোকের ” : ৪ টাকা
চুল ছাঁটাই ” : ৬ টাকা
যাঁরা মাসিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে চান তাঁরা আলাদা দেখা করুন—কর্নেল পিটার মারির বাড়ির পাশের লেনে ৭৩ নম্বর।
শুধু বিলেত থেকে নয়, প্যারিস থেকেও হেয়ারড্রেসার আসতেন। রেট অবশ্য ভয়ানক, তবু যাঁরা চুল ছাঁটাতেন ও কেশবিন্যাস করাতেন, তাঁদের কাঁচা পয়সার তখন অভাব ছিল না। মগের মুল্লুকের লুটের পয়সা চুল ছেঁটেই তাঁরা যা খরচ করতেন, তা থেকে অন্যান্য খরচের বহর বোঝা যায়। এ—ও জানা যায় যে, কলকাতা শহরে হেয়ারড্রেসিং অন্যতম ব্যবসা তো বটেই, প্রাচীনতম ব্যবসা।
৬ সেপ্টেম্বর, ১৭৮৭ : ওয়ারেন হেস্টিংসের সম্পত্তি—কালো কাঠের একটি বুরো, হয় তাঁর বাংলা দেশ ছেড়ে যাবার সময় চুরি অথবা নিলামে অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে ভুলক্রমে বিক্রি হয়ে গেছে। এই কাঠের বুরোর মধ্যে হেস্টিংস সাহেবের অনেক দরকারি গোপন কাগজপত্র ও চিঠি ছিল এবং কয়েকখানা ছোট ছোট ছবিও ছিল। মিঃ লার্কিনস ও মিঃ টমসন জানাচ্ছেন যে যদি কেউ উক্ত বুরোর সন্ধান দিতে পারেন, অথবা তার ভিতরের কাগজপত্র উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে তাঁকে অবশ্যই দুই হাজার সিক্কা টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
কাগজপত্রগুলো যে রীতিমতো দরকারি বা ঐতিহাসিক দলিলের মতন মূল্যবান ছিল, তা ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যাকুলতা দেখেই বোঝা যায়। পরে হেস্টিংস সাহেব চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন এই বুরো সম্বন্ধে : ‘It contained many letters and other papers which I would not for the world have seen by strangers.’ কিন্তু বুরোটা গেলই বা কোথায়? হয় কেউ নিলামের মালের সঙ্গে কিনেছিলেন, অথবা চুরি করেছিলেন। অথচ তার খোঁজখবর যদি এখনও কোনো সূত্রে পাওয়া যেত তাহলে হয়তো ইতিহাসের অনুসন্ধানী ছাত্রদের সুবিধা হত অনেক। অবশ্য দু’হাজার সিক্কা টাকা পুরস্কার এখন আর কেউ পাবেন না।