১১. বাবাদের গল্প

১১. বাবাদের গল্প

[এক]

ক্লাসে রীতিমতো একটা যুদ্ধ লেগে গেছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়গুলোতে বাংলার ক্লাসরুম, চায়ের দোকান, লাইব্রেরি থেকে শুরু করে পাড়ার ঘরে ঘরে একটা যুদ্ধের আবহ বিরাজ করে। সমর্থিত দল, তাদের খেলোয়াড় এবং খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স, বিগত বছরগুলোতে দলের অর্জন, ফুটবল ইতিহাসে দলগুলোর ঝুলিতে কী আছে আর কী নেই তার চুলচেরা হিসেব-নিকেশ করার কাজে বাঙালির চাইতে বেশি পারদর্শী জাতি এই মহাবিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।

ক্লাশরুমের যুদ্ধটারও চিরচেনা বিষয়বস্তু—’ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা।’ তর্ক-বিতর্ক হলে তো তাও ঠিক ছিলো, এসব যুদ্ধ ঠাট্টা, মশকারি থেকে শুরু করে একেবারে হাতাহাতি, এমনকি ধস্তাধস্তি পর্যন্ত গড়ায়। ক্লাসে এই মুহূর্তে হচ্ছেও তা-ই। দু’পক্ষের সমর্থকদের একে-অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারিতে পরিবেশটা খুবই বিদঘুঁটে হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর্জেন্টিনা সমর্থকরা তাদের দু’বার বিশ্বকাপ জয় এবং নিকট অতীতে ফাইনালিস্ট হওয়ার গল্প ফাঁদতে ব্যস্ত। অন্যদিকে ব্রাজিল সমর্থকরা নিজেদের পাঁচবারের বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের গল্প বলে বিগত বছরগুলোর ব্যর্থতা লুকাতে মরিয়া। কিছু আছে জার্মানি সমর্থক। এরা আকারে ইঙ্গিতে আবার আর্জেন্টিনার দিকেও ঢলে পড়ে মাঝেমধ্যে। অন্যদিকে হাতেগোনা কিছু পর্তুগাল সমর্থকরা যেন চোখমুখ বন্ধ করে ব্রাজিলকেই তাদের ‘সেকেন্ড হোম’ মনে করে। এই বিতর্ক মাঠ, ক্লাস আর চায়ের আড্ডা ছাপিয়ে জন-জীবনে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যেই।

[দুই]

কড়া রোদের মধ্যে ফারুক সাহেব অফিস থেকে ফিরছেন। বাইরের তাতানো গরমে দরদর করে ঘামছেন তিনি। মধ্যবিত্ত সংসারের ঘানি টানতে হয়, মাঝেমধ্যে কিছু পথ রিকশায় চড়ে আসতে মন চাইলেও শরীর সায় দেয় না। এ যে মধ্যবিত্তের শরীর, মরুভূমির মধ্যখানে পানির পিপাসা পেলেও এদের দু’বার ভাবতে হয়, ‘ঝোলায় যে পানি মজুদ আছে, তা দিয়ে সামনের অবশিষ্ট দিনগুলো চলা যাবে তো?’ যদি মনে হয় চলা যাবে, তাহলে টুক করে এক চুমুক খেয়ে কোনোভাবে পিপাসা নিবারণ করে, যদিও তাতে মুখ ভিজলে গলা ভিজে না।

ঘরে পা দিতেই ফারুক সাহেবের স্ত্রী সাজিয়ে বসেছেন অভিযোগের পসরা। ছেলের নাকি শখ জেগেছে এই মহল্লার সবচাইতে বড় পতাকা ওড়ানোর। মধ্যবিত্ত বাবার উচ্চবিত্ত-মনা সন্তান। নিজেরা যতো কষ্টই করুন, ছেলেপেলের শখ-আহ্লাদ পূরণে ঘাটতি হলে কেমন যেন একটা অপরাধবোধে ভোগেন এই শ্রেণিটা। নিজের শার্টের কলারের সুতো উঠে গেলেও, সন্তানের শখ পূরণে তারা মোটেও অসচ্ছল নন। ঋণ করে হোক কিংবা শরীরের রক্ত বেচে–সন্তান যখন কোনোকিছু চেয়েছে, দিতে তো হবেই। এই দেওয়া-নেওয়ার মাঝখানে মধ্যস্থতা করে একটা দীর্ঘশ্বাস। ফারুক সাহেব সেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোসলে ঢুকে পড়লেন।

খাওয়া-দাওয়া সেরে ছেলের রুমে এসে ঢুকলেন তিনি। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে আবির, চোখ তার রাজেশদের বাড়ির ছাদে। রাজেশ জার্মানি সমর্থন করে। একটা বিশাল সাইজের জার্মানির পতাকা সারাদিন পতপত করে ওড়ে ওদের ছাদটায়। পতাকা নিয়ে রাজেশের সে কী বড়াই! ক্লাসে তর্ক-বিতর্কের মধ্যে একদিন মইনুদ্দিনের সাথে বাজি ধরে ফেলে সে। কে কার চাইতে বড় পতাকা ওড়াতে পারে। সেদিনই নাকি ওর বাবা ওকে মকবুল কাকার দোকান থেকে সবচাইতে বড় জার্মানির পতাকাটা কিনে এনে দেয়। আবির জানে, তার বাবা রাজেশের বাবার মতো নয়। ‘সে বললো আর কিনে দেবে’–এমনটা কখনো হবে না। কিন্তু কেন তার বাবা এ রকম? রাজেশের বাবা, মইনুদ্দিন, সাকিব আর রানাদের বাবা তো এ রকম নয়।

ছেলের পিঠে আলতো করে হাত রাখেন ফারুক সাহেব। চমকে ওঠে আবির। পেছনে ফিরে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে।

‘কী ভাবছিলে?’

‘কই, কিছু না তো।’

‘কিছু তো ভাবা হচ্ছেই। পতাকার কথা বুঝি?’

দ্বিতীয়বার চমকে যায় আবির। বাবা কি তাহলে কোনোকিছু আঁচ করে ফেলল? কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে সে। বলে,

‘মা বলেছে?’

‘তু-ম-ম। কোন পতাকাটা চাই তোমার?’

খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে আবিরের মন। এতো সহজে বাবা পতাকা কিনে দিতে রাজি হয়ে যাবে–তা তো স্বপ্নেই ভাবা যায় না। কী আবোল-তাবোল এতোক্ষণ ভাবছিল সে বাবাকে নিয়ে তা মনে পড়তে নিজেকে ধিক্কার দিতে মন চাইলো তার।

‘আমার আর্জেন্টিনার সবচাইতে বড় পতাকাটা চাই, বাবা।’

‘বেশ। কোথায় পাওয়া যাবে এটা?’

‘মকবুল কাকার দোকানে।’

‘মকবুলের দোকান? ওটা তো মুদি দোকান, ওই দোকানে পতাকা বিক্রি হয়?’

‘মকবুল কাকা এখন পতাকাও বেচে বাবা। ওই দেখো, রাজেশদের ছাদে কত্তো বড় একটা পতাকা উড়ছে, ওটা তো মকবুল কাকার দোকান থেকেই কেনা।’

ফারুক সাহেব জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে রাজেশদের ছাদে উড়তে থাকা পতাকাটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাই তো দেখছি! কিন্তু ওখানে যে পতাকা পাওয়া যায়, আমি তো জানতাম না।’

পিতা আর পুত্র উভয়ের দৃষ্টি ওই বিশাল সাইজের জার্মান পতাকার দিকে। রং-বেরঙের ওই পতাকায় চোখ ফেলে আবির আঁকছে এমন একখানা পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন, আর ফারুক সাহেব কষছেন অনাগত মাসের খরচের খসড়া। তাকে পরের মাসেও নতুন করে ধার-দেনায় জড়াতে হবে। কার কাছে হাত পাতা যাবে সেই চিন্তায় তার মন এখন থেকেই বিপন্ন।

‘বাবা’, মৃদু স্বরে ডাক দেয় আবির।

‘বলো, বাবা।’

‘আমি কি পতাকা ওড়াবো না?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই ওড়াবে।

‘তাই?’

‘হুম।’

‘থ্যাংকিউ, বাবা।’

[তিন]

গুনে গুনে দুই হাজার টাকা ফারুক সাহেব আবিরের হাতে দেয়। আবির খোঁজ নিয়ে এসেছে, মকবুল কাকার দোকানে যে বিশাল সাইজের আর্জেন্টিনার পতাকাটা আছে, ওটার দাম দুই হাজার। পতাকাটা এখনো পর্যন্ত কেউ কেনার সাহস করতে পারেনি। এই পতাকা আর্জেন্টিনার পতাকাগুলোর মধ্যেই যে সবচেয়ে বিশাল তা নয়, অন্য কোনো পতাকা এটার ধারে-কাছেও নেই। তার মানে–আবির যদি এই পতাকা কিনতে পারে, তাহলে সে তো আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতাকাটা ওড়াবেই, সাথে অন্যসকল দলের মধ্যেও আবির হয়ে উঠবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এমন একটা অর্জন আবিরের হতে যাচ্ছে তা ভাবতেই আবিরের যেন চোখ দিয়ে পানি এসে যায়। কালকে ক্লাসে গিয়ে সবার সামনে বুক ফুলিয়ে সে যখন তার পতাকার গল্প করবে, তখন সকলের চেহারার যা অবস্থা হবে তা ভেবে আবিরের এখনই হেসে কুটি কুটি হতে মন চাচ্ছে।

আবির মকবুল কাকার দোকানে এসে দাঁড়ালো। অনেকগুলো ছেলে-পিলে এখানে পতাকা কিনছে। এক-দেড়শো টাকা দামের পতাকা। সেগুলো আর কতোই বা বড় হবে, বড়োজোর দুই-তিন হাত। কিন্তু আবির যেটা কিনতে এসেছে সেটাই হলো দেখার মতো পতাকা! সাড়ে বিয়াল্লিশ হাত লম্বা এই পতাকা যখন বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ঘরে ফিরবে আবির, রাস্তার সবাই নিশ্চয় বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে।

আবির সন্তর্পণে আরও ঘনিষ্ঠ জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যেখান থেকে মকবুল কাকার সাথে সরাসরি কথা বলা যাবে।

‘মকবুল কাকা!’

ব্যস্ত দোকানি তাকানোর ফুরসত পায় না। আবির আবার ডাক দেয়, ‘কাকা!’

মকবুল মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবিরের দিকে, ‘কী হইছে?’

‘আমার পতাকা লাগবে।’

‘কোন দেশ?’

‘আর্জেন্টিনা।’

‘দেও একশো ট্যাহা।

‘একশো টাকার পতাকা না তো। দুই হাজার টাকা যেটার দাম।’

এবার অবাক হয় মকবুল মিয়া। কপালের ভাঁজ আরও দীর্ঘ করে বলে, ‘দুই হাজার ট্যাহা আছে তোমার কাছে?’

‘হ্যাঁ, এই যে দেখো’, বলতে বলতে আবির পকেট থেকে চারটে চকচকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেখায়।

মকবুল মিয়া কোনোকিছু না বলে, একবার আবিরকে আগাগোড়া দেখে নেয় আগে। তারপর বলে, ‘তুমি ফারুকের পোলা না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার বাপে কই?’

‘বাবা ঘরে।’

‘তোমার বাপে জানে তুমি দুই হাজার ট্যাহা দামের পতাকা কিনতে আইছো?’

‘বাবাই তো দিলো টাকা।’

‘বাপে দিছে? তোমার বাপে যে আমার দোকান থেইকা বাকিতে জিনিস-পাতি নিয়্যা যায়, সেই ট্যাহা দেওনের খবর নাই, পোলারে দুই হাজার ট্যাহা দিয়া পতাকা কিনতে পাঠায়!

কথাগুলো শুনে আবির মাথা নিচু করে ফেলে। ওর আশপাশের সবাই ওর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, যা ওকে খুব আহত করছে। ওর কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে এখন। কিন্তু এতোগুলো মানুষের সামনে ও কীভাবে কান্না করবে? কোনোমতে চোখের জল আটকে রাখে আবির।

মকবুল মিয়া আরও বলে, গত মাসে হাতের ঘড়ি বন্ধক রাইখা গেছে আমার কাছে। ট্যাহা দেওনের কথা আছিলো, দিতে পারে নাই। ওই ঘড়ি দিয়া আমি কি পানি খামু? তোমার বাপেরে কইবা এসব ফুটানি বাদ দিয়া যেন আমার ট্যাহা দিয়া যায়।

‘কতো টাকা পাওনা আছে আমার বাবার কাছে?’, আবির কোনোমতে প্রশ্ন করে।

একটা পুরাতন খাতা খুলে মকবুল মিয়া তাতে চোখ বুলায়। কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে ওঠে, ‘গুইনা গুইনা আড়াই হাজার ট্যাহা পামু।’ একটা ড্রয়ার টান দিয়ে খুলে, তার ভেতর থেকে বের করে একটা ঘড়ি। এই ঘড়ি আবির চেনে। তার বাবার ঘড়ি এটা। বাবাকে সব সময় পরতে দেখে সে। কিন্তু এই ঘড়ি যে বাবা কখন এখানে বন্ধক রেখে গেছে তা আবির জানে না। বাবার হাতের দিকে কখনো সে ওভাবে নজর দেয়নি হয়তো, তাই বুঝতে পারেনি।

ঘড়িটা হাতে নিয়ে মকবুল বলে, ‘এই দেখো, এই ঘড়ি রাইখা গেছে তোমার বাপে। কও তো, এই ঘড়ি বেচলে কি আড়াই হাজার ট্যাহা পাওয়া যাইব?’

আবির কিছু বলে না। উপস্থিত পাড়ার অন্য ছেলেদের সামনে অপমানিত হয়ে সে যেন একখানা পাথরে পরিণত হয়েছে। যদি একদৌড়ে এখান থেকে পালানো যেতো, যদি আর কোনোদিন, কোনোদিন এই তল্লাটের, এই মকবুল কাকার দোকানের আশপাশে তার না আসতে হতো, যদি সে নিজেকে লুকোতে পারতো উপস্থিত এই ছেলেদের শ্লেষ-ভরা দৃষ্টি থেকে, তাহলে কতোই না সুন্দর হতে পারতো পৃথিবীটা!

হাতে থাকা টাকাগুলো আবির মকবুল কাকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘কাকা, আমার পতাকা চাই না। বাবা তোমার কাছে দেনায় আটকা আছে, এই টাকা দেনা-পরিশোধ হিশেবে রেখে দাও।’

[চার]

ফারুক সাহেব ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি অদূর পানে। দূরে কতোগুলো পাখি উড়ে যাচ্ছে। শরতের আকাশে ছুটোছুটি করছে কয়েক টুকরো মেঘ। বাড়িগুলোর ছাদে ছাদে উড়ছে রং-বেরঙের বাহারি পতাকা। এখন পতাকার মৌসুম।

ফারুক সাহেবের কাঁধে একটি কোমল হাতের, পরিচিত স্পর্শ। তিনি ঘুরে দাঁড়ান। হাতে সুতো আর পাশে দাঁড় করানো বাঁশের একটা লম্বা কঞি। ছেলে পতাকা আনলে বাপ-বেটা মিলে তা ওতে বেঁধে আকাশে ওড়ানোর যাবতীয় প্রস্তুতি। কিন্তু আবিরের হাতে পতাকা নেই।

‘পতাকা আনলে না?’, প্রশ্ন করে ফারুক সাহেব।

আবির আর বাঁধ মানাতে পারলো না চোখের জলকে। বাবার বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। ফারুক সাহেবের চোখও থেমে নেই। নোনা জলের একটা স্রোত, চোখ বেয়ে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে আবিরের শাদা শার্ট। বাবা-ছেলের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। বোধোদয়ের এমন সুন্দর মুহূর্তে পরিবেশ কিছুটা ভারী থাকলে মন্দ কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *