১১. বন্দুক

অন্ন কিংবা জল কিছুই নয়, এখন তারা অপেক্ষা করে থাকে মধ্যরাতের জন্য। বিলকিস বলেছিল, পাটের গুদামের ভেতরে কথা বললে বাইরে থেকে শোনা যায় না, তবু জেগে ৪ঠার পর, নিজেদের এই মসৃণ খসখসে আঁশের স্তুপের ভেতরে আবিষ্কার করবার পর বাইরে পায়ের শব্দ, কণ্ঠস্বর শোনবার পর, একটি কথাও নিজেদের ভেতরে তারা বলে নি। গত রাতের মাটি, কাদা, স্বেদে বীভৎস মূর্তি দুটি নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে বসে থাকে সারা দিন।

সন্ধে হয়ে যায়। মনে হয়, বাইরে উপস্থিত লোকের সংখ্যা একে একে কমে যাচ্ছে। তারপর, এক সময় বাইরেও অখণ্ড এক স্তব্ধতা ঝপ করে ঝুলে পড়ে।

এতক্ষণ দুজন দূরত্ব রেখে বসে ছিল, স্তব্ধতার নিঃশব্দ ঘণ্টাধ্বনির পর একই সঙ্গে তারা পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসে, তাদের নিঃশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়, হাতে হাত রাখে এবং উৎকৰ্ণ হয়ে তীব্ৰ অপেক্ষা করে।

কথা বলে বিলকিস প্রথম। অনেকক্ষণ নীরব থাকবার জন্যে তাঁর কণ্ঠস্বর বিকৃত এবং প্রেতলোকের মতো শোনায়। কানের কাছে মুখ রেখে সে বলে, আজ রাতেই শেষ করে ফেলতে হবে।

বাইরে, কবরটা ওরা আবিষ্কার করতে পেরেছি। কিনা, লাশের সংখ্যা কম দেখে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সিরাজকে জাগ্ৰত প্রতিটি মুহূর্তে শঙ্কিত এবং ভাবিত করে রেখেছিল। সন্ধের আগেই গুদামের ভেতর নিকষ অন্ধকার দেহ বিস্তার করে ফেলেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বিলকিসের দিকে তাকিয়ে সে আবিষ্কার করে, তার মুখ আর দেখা যাচ্ছে না। সেই আবিষ্কার মুহূর্তের ভেতরে তাঁর আত্মায় ফিরিয়ে আনে মৃত্যুর সান্নিধ্য, চিতার আগুন, কবরের মাটি এবং যোজন ব্যাপী নিঃশব্দ প্ৰবল ঘণ্টাধ্বনি।

সময় বয়ে যায়। পনেরো মিনিট কি পাঁচ ঘণ্টা, অথবা একটি জীবনকাল, বোধিতে ধরা পড়ে না।

বিলকিস সিরাজের পাশ থেকে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কানে কানে বলে, ওদিকে টিনের একটা ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই। ভালো করে দেখেছি। এই সময়।

দরোজার কাছ থেকে পাটের বেল দুটো আবার সেই পরিশ্রম করে সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোয় তারা। বেরিয়ে দরোজার পাশেই অন্ধকারে চুপ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। বাইরে খোলা হাওয়া জলের মতো তাদের ধৌত করে যায়। শরীরের সমস্ত ক্লোদ, ক্লান্তি, কাদার অনুভব নিঃশব্দে মুছে যায়। আবার পূত পবিত্র বলে বোধ হয় নিজেদের। একটু একটু করে হামাগুড়ি দিয়ে তারা এগোয়। গুদামের সমকোণ ঘুরে, সরু গলি পথ অতিক্রম করে, ঠিক বাজারের চত্বরের মুখে স্থির হয় তারা। বিলকিসই প্রথম মাথা বাড়িয়ে দেখে নেয় চত্বরটা।

অবিকল গত রাতের মতো। লাশগুলো তেমনি পড়ে আছে। অন্ধকার তেমনি খণ্ডিত হয়ে ইতস্তত লম্বমান, যেন সেগুলোও একেকটি লাশ। বস্তৃত, কোনটা লাশ, কোনটা অন্ধকার ভালো করে বোঝা যায় না। পেট উঁচু সেই আধখানা চাঁদও আবার ফিরে আসছে, বাজারের পেছনে গাছপালার ঝাঁকড়া মাথার ভেতর থেকে ধীরে বেরিয়ে আসছে।

সিরাজকে ইশারা করে কাছে আসতে। সিরাজও আবার সেই দৃশ্য দ্যাখে।

চিবুকের সংক্ষিপ্ত একটা দোলন তুলে নীরবে বিলকিস তার পরামর্শ জানতে চায়। এগুবো? নিঃশব্দে সিরাজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।

বসে বসেই এগিয়ে যায়। তারা। গলি ছেড়ে দোকানের বারান্দায় পড়ে। এমনও একবার মনে হয়, তারা নয় বরং দৃশ্যটাই সচল হয়ে তাদের সমুখ দিয়ে সরে যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে ফিরে আসে আস্থা, অভ্যাস এবং লক্ষ্য। তারা পায়ের ওপর উঠে দাঁড়ায়।

এবার আরো অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। আরো লাশ চোখে পড়ে। আজ মৃতের অনৈসৰ্গিক ঘ্রাণ টের পায় তারা। ঠিক গলিত শবের নয়, লোবানেরও নয়। বিয়োগের বিষণ্ণতার ঘ্রাণ।

কান খাড়া করে রাখে তারা। দূরে কাছে কোনো শব্দ ওঠে না। পৃথিবীকে জীবিতের বসতি বলে মনে হয় না। সেই শেয়াল কিংবা অন্য কোনো শেয়াল দ্রুত দৌড়ে চলে যায়। তার পেছনে আজ আরো একটিকে দেখা যায়। তারা খালপাড়ের দিকে গলি পথ দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।

ফিসফিস করে বিলকিস বলে, ধারে কাছে কেউ থাকলে ওরা আসত না।

সিরাজের কাছে আজ। এটি নির্ভরযোগ্য সংকেত বলে বোধ হয়।

দোকানের বারান্দা ছেড়ে আরো খানিক এগিয়ে যায় তারা। কেন যায়, কীসের টানে যায়, তারা জানে না। সিরাজের এমন বোধ হয়, বিলকিস খোকাকে সন্ধান করতে এগোয়।

বিলকিস বলে, কাল ওদিকে দেখা হয় নি।

মাছের আঁশটে গন্ধ পেরিয়ে বাঁক নিতেই আবার একটা এলাকা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। সেখানে দুটি লাশ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মাঝখানে বেশ কিছুটা ব্যবধান। তাদের একজন হয়তো খোকা। না বিলকিস, না সিরাজ, কেউই প্ৰথম উদ্যোগ নেয় না। হয়তো নিজেদের অজ্ঞাতেই তারা আশা করে অপরজন এগোবে।

শেষ পর্যন্ত দুজনই ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুজনেই আবার বিস্তৃত চত্বরের ওপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মানুষ ও অন্ধকারে লাশ দেখে কিংবা দেখে না। এখন সমস্ত কিছুই বাস্তবের অনিবাৰ্য অংশ বলে দর্শকের ঔদাস্য জন্ম নেয়। মৃতেরাও একই ঔদাস্যের সঙ্গে জীবিতের উপস্থিতি সহ্য করে।

আবার তারা ফিরে আসে চত্বরের মাঝামাঝি পূর্ব দিকে ঘেঁষে দোকান ঘরগুলোর ছায়ার ভেতর দিয়ে। স্থির হয় আবার। মানুষ যে স্বাভাবিকতা নিয়ে তার নিজের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন সমুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে থাকে, অস্বাভাবিক এই সংস্থাপনে সেই স্বাভাবিকতাই একমাত্র হয়।

সিরাজ।

দিদি।

তার দিদি সম্বোধনে এই একটা ফল হয় যে, বিলকিস বাস্তবের নির্মমতার ভেতরে ফিরে আসে।

বিলকিস সংশোধন করে আবার ডাকে, প্ৰদীপ!

একই সঙ্গে সেও সংশোধনে সাড়া দেয়–আপা। এবং একই সঙ্গে দুজনের দিকে স্মিত চোখে তাকায়। নির্মল সেই মুহূর্তটি ক্ষণজীবী হয়।

পলকের ভেতরে বিষণ্ণ গলায় বিলকিস বলে, তোমাকে সিরাজ বলেই ডাকব।

বিলকিস সেই দিনটির জন্যে ক্ষণকাল প্রার্থনা করে যখন তাকে প্ৰদীপ বলে সে ডাকতে পারবে।

সিরাজ, মনে হয় খোকা ওদিকে আছে।

আমারও মনে হলো।

নীরবতা।

ওরা কি টের পেয়েছে, সিরাজ, যে আমরা কাল কবর দিয়েছি?

সিরাজ, এখানে শেষ হয়ে গেলে আমাকে নবগ্রামে নিয়ে যাবে।

নবগ্রামে?

তোমার মনসুরদার কাছে।

নীরবতা।

সিরাজ, আমি কাজ করব।

নীরবতা।

নদীর ওপারে যাবেন না?

বিলকিস প্রসঙ্গটা বুঝতে পারে না।

নদীর ওপারে কেন?

আপনার মা, বোনকে খুঁজবেন না?

তখন মনে পড়ে যায় বিলকিসের। মনের ভেতরে তাকিয়ে দ্যাখে, মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কোনো আকুতি সেখানে অবশিষ্ট নেই।

ওদের জন্যে আমি কাজ করতে চাই।

নীরবতা।

আজ একটি লাশও যেন পড়ে না থাকে।

নীরবতা।

চল।

সিরাজের ধারণা হয়, প্রথমে তারা নতুন আবিষ্কৃত লাশ দুটির কাছে যাবে। বিলকিস কিন্তু সেদিকে যায় না। সে এগিয়ে যায়, যেখানে বসে ছিল, তার নিকটতম লাশটির দিকে। পড়ে ছিল ফাঁকা একটা জায়গায়। লাশটির সারা শরীর অন্ধকারে ঢাকা। দূর থেকে অন্ধকার বলেই ভুল হয়। বিলকিস একা সেই লাশ টেনে সোজা করে চিৎ করে শুইয়ে দেয়।

এসো, এর পাশে আমরা সবাইকে রাখি।

মুহূর্তের ভেতরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজন। নিঃশব্দে একের পর এক লাশগুলো টেনে এনে তারা জড়ো করতে থাকে। সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। চাঁদ আরো সরে আসে আকাশে। আজ মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেড়া আলো পড়ে থাকে।

যখন সমস্ত চত্বর খালি হয়ে যায়, অবসন্ন চোখে একবার তাকিয়ে দ্যাখে দুজন সারি সারি মানুষগুলোর দিকে। গণনার যে স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষের, তা তারা দুজনেই বিস্মৃত হয়। তারপর এগোয় সেই শেষ প্রান্তের দিকে, যেখানে আরো দুটি লাশ। তারা আজ আবিষ্কার করেছে।

কতদিন খোকাকে দেখে নি বিলকিস। হার্মোনিয়াম কেনার টাকা চেয়ে পায় নি বলে রাগ করে যে চিঠি দিয়েছিল সেই শেষ চিঠি।

বুকে পড়ে স্থির তাকিয়ে থাকে বিলকিস।

বুকের ওপর নীল জামোটা কুঁচকে আছে। ধীর হাতে মসৃণ করে দেয় সে।

খোকাকে দ্যাখ, সিরাজ।

সিরাজ তার পাশে বসে পড়ে। দুহাত মাটিতে রেখে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে।

খুব ভালো গান গাইত?

হাঁ।

নীরবতা।

আমার কাছে হার্মোনিয়াম চেয়েছিল।

নীরবতা।

মাকে খুব ভালোবাসত। মার কাছে থাকবে বলে ঢাকায় আমার কাছে আসে নি।

বিলকিস মৃতদেহের বুকের ওপর হাত রেখে নিজের ভেতরের বিকট শূন্যতার সঙ্গে নীরবে লড়াই করে।

ঠিক তখন পিঠের ওপর শক্ত একটা কিছু অনুভূত হয়।

অস্ফুট ধ্বনি করে পেছন ফিরে দ্যাখে, ছায়ার মতো চারটি যুবক। তাদের হাতে বন্দুক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *