বউদি চলে যাবার একটু পরেই বুলবুল ঘরে ঢুকলো।
যত বয়স বাড়ছে মেজদার বউ তত খুকী হচ্ছে। বাড়িতেও আজকাল ডলপুতুলের মতো সেজেগুজে বসে থাকতে ভালোবাসে। এই দীপান্বিতা ঘোষাল আবার কলেজে ইউনিয়ন ইলেকশনের অন্যতম নায়িকা ছিল! ভোটের জন্যে দীপান্বিতা তখন সোমনাথকেও ধরেছিল। “দেশকে যদি ভালোবাসেন, যদি শোষণ থেকে মুক্তি চান তাহলে আমাদের দলকে ভোট দেবেন,” এইসব কী কী যেন তখনকার দীপান্বিতা ঘোষাল তড়বড় করে বলেছিল। বিয়ে করে ঐসব বুলি কোথায় ভেসে গিয়েছে। এখন বর, বরের চাকরি এবং নিজের শাড়ী ব্লাউজ ছাড়া কিছুই বোঝে না ভূতপূর্ব ইউনিয়ন-নেত্রী বুলবুল ঘোষাল।।
বুলবুল নিজে পড়াশোনায় ভালো ছিল না। সোমনাথ ও সুকুমার দুজনের থেকেই খারাপ রেজাল্ট করেছিল। কিন্তু বুলবুলের রুপ ছিল—মেয়েদের ওইটাই আসল। মোটামুটি ভালোভাবে বি-এ পাস করেও সোমনাথ ও সুকুমার জীবনের পরীক্ষায় পাস করতে পারলো না। আর বি-এতে কমপার্টমেন্টাল পেয়েও বুলবুল কেমন জিতে গেলো। কেউ তাকে প্রশ্ন করে না কেন পরীক্ষায় ভালো করোনি? মেয়েদের মলাটই ললাট।
বুলবুলের হাতে একটা ইনল্যান্ড চিঠি। সোমের চিঠি, কোনো মহিলার হস্তাক্ষর। বুলবুল বললো, “এই নাও! লেটার বক্সে পড়েছিল। আমি তো ভুলে খুলেই ফেলেছিলাম!” এই বলে বুলবুল আবার ফিক করে হাসলো।
এই হাসির মাধ্যমে বুলবুল যে একটা মেয়েলী প্রশ্ন করছে, তা সোমনাথ বুঝতে পারে। কিন্তু মেজদার বউকে সে বেশি পাত্তা দিলো না।
খামের ওপর হাতের লেখাটা সোমনাথ আবার দেখলো। তারপর চিঠিটা না-খুলেই বালিশের তলায় রেখে দিলো।
“আমার সামনে এসব চিঠি পড়বে না, আমি যাচ্ছি,” একটু অভিমানের সুরে বললে বুলবুল।
বুলবুল চলে যাবার পরেও সোমনাথ একটু অস্বস্তি বোধ করলো। চিঠিটা কারুর হাতে না-পড়লেই খুশী হতো সোমনাথ। খামটার দিকে সে আর-একবার তাকালো। এই চিঠি লেখবার মতো মেয়ে পৃথিবীতে একটি আছে। তার হাতের লেখার সঙ্গে সে পরিচিত। কিন্তু যার চাকরি নেই, ভবিষ্যৎ নেই, যে বাবার এবং দাদাদের গলগ্রহ সে তো এমন চিঠি পাবার যোগ্য নয়। এ ধরনের চিঠি সোমনাথকে মানায় না।
চিঠিটা খুলতে সাহস হচ্ছে না সোমনাথের। এক কাজল চোখের খেয়ালী মেয়ের নিপাপ মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর চোখের এই মেয়ের নাম কে যে রেখেছিল তপতী : ওকে দেখেই ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলার মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল সোমনাথের। “আমাদের দেশে তাকেই বলে সুন্দর যার বর্ণ গৌর। কিন্তু যে আকাশ আলো দেয় সে নীল।”
আঙুল দিয়ে খামটা এবার খুলে ফেললো সোমনাথ। তপতী লিখেছে : “একেবারেই ভুলে গেলে নাকি? এমন তো কথা ছিল না। গতকাল ইউ-জি-সি স্কলারশিপের খবরটা এসেছে। এর অর্থ—সরকারী প্রশ্রয়ে ডি-ফিল করার স্বাধীনতা। ভাবলাম, খবরটা তোমারই প্রথম পাওয়া উচিত। কেমন আছো? ইতি তপতী।”
ইতি এবং তপতীর মধ্যে একটা কথা লেখা ছিল। কিন্তু লেখার পরে কোনো কারণে যত্ন করে কাটা হয়েছে। কথাটা কী হতে পারে? সোমনাথ আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। চিঠিটা আলোর সামনে ধরে কাটা কথাটা পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করলো সোমনাথ। মনে হচ্ছে লেখা ছিল ‘তোমারই’। যদি সোমনাথের আন্দাজ ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কথাটা তপতী কেন কাটতে গেলো? ‘তোমারই তপতী’ লিখতে তপতী কী আজকাল দ্বিধা করছে? নিজের চিঠি থেকে যে-কোনো অক্ষর কেটে দেবার অধিকার অবশ্যই তপতীর আছে। কিন্তু তাহলে চিঠি লেখার কী প্রয়োজন ছিল? তার ইউ-জি-সি স্কলারশিপের খবর প্রথম সোমনাথকেই দেওয়ার কথা ওঠে কেন?
এদিকে বাবা নিশ্চয় সোমনাথের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভাবছেন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সমস্ত ঘটনার পখানপঙখ বর্ণনা সোমনাথের কাছ থেকে শোনা যাবে। কত লোক লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল? কতক্ষণ সময় লাগলো? অফিসার ডেকে কোনো কথা বললেন কি না? অথবা কেরানিরাই কার্ড রিনিউ করে দিলো।
ও বিষয়ে ছেলের কিন্তু বিরক্তি ধরেছে। এক্সচেঞ্জ অফিসের সামনে সাড়ে-পাঁচ ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অপমানকর অভিজ্ঞতা সে ভুলতে চায়। সমবয়সিনী এক বালিকার মিষ্টি চিঠি বুকে নিয়ে সে শুয়ে থাকতে চাইছে। তপতীর সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ করেনি সোমনাথ। ওর সঙ্গে দেখা করবার ইচ্ছে হয়েছে অনেকবার। ভবানীপুরের রাখাল মুখার্জি রোড তো বেশি দূরে নয়। কিন্তু দ্বিধা ও সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারেনি সোমনাথ।
যাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, তার চিঠিই আজকে তাকে কাছে নিয়ে আসছে। চিঠিটা আরেকবার পড়তে বেশ ভালো লাগলো। অথচ ছোট্ট চিঠি। যা ভালো লাগছে তা এই চিঠির না-লেখা অংশগুলো—যেমন শূন্যস্থান একমাত্র সোমনাথের পক্ষেই পরণ করা সম্ভব। যেমন তপতীর চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই। এখানে অনেক কিছুই বসিয়ে নৈওয়া যায় সবিনয় নিবেদন—খোকন—সোমনাথ—সোমনাথবাব-প্রীতিভাজনেষ-প্রিয়বরেষ…। আরও একটা শব্দ তপতীর মুখে শুনতে ইচ্ছে করে, হাতের লেখায় দেখতে প্রবল লোভ হয়। শব্দটার প্রতিচ্ছবি তপতীর শ্যামলী মুখে সোমনাথ অনেকবার দেখেছে। কিন্তু বড় গম্ভীর এবং কিছুটা চাপা স্বভাবের মেয়ে। কেউ কেউ আছে যা অনুভব করে তার ডবল প্রকাশ করে ফেলে। তপতী যা অনুভব করে তার থেকে অনেক কম জানতে দেয়। তবু কাল্পনিক সেই কথাটা সোমনাথ চিঠির ওপরেই আন্দাজ করে নিলো। তপতীর অনভ্যস্ত বাংলা হাতের লেখায় প্রিয়তমের কথাটা কী রকম আকার নেবে তা কল্পনা করতে সোমনাথের কোনোরকম অসুবিধে হচ্ছে না।
তারপর তপতী লিখেছে : একেবারেই ভুলে গেলে নাকি? তপতীর ছোট্ট নরম গোল গোল হাত দুটো দেখতে পাচ্ছে সোমনাথ। লেখার সময় বাঁ হাত দিয়ে এই চিঠির কাগজটা তপতী নিশ্চয়ই চেপে ধরেছিল। এই হাতে সুন্দর একগাছি সোনার কাঁকন পরে তপতী অনেকটা বউদির কাঁকনে যে-রকম ডিজাইন আছে।
তপতীর ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলের নখটা বেশ বড় আকারের। এই নখটা নিয়ে ছাত্রজীবনে সোমনাথ একবার রসিকতা করেছিল। “মেয়েরা শখ করে নখ রাখে কেন?” তপতী প্রথমে লজ্জা পেয়েছিল—ওর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিটি খুঁটিনাটি কেউ অডিট করছে এই বোধটাই ওর অস্বস্তির কারণ। তপতীর সঙ্গে সেদিন বান্ধবী শ্রীময়ী রায় ছিল। ভারি সপ্রতিভ মেয়ে। শ্রীময়ী বলেছিল, “অনেক দুঃখে মেয়েরা আজকাল নখ রাখছে, সোমনাথবাব। মেয়ে হয়ে ট্রামে-বাসে যদি কলেজে আসতেন তাহলে বুঝতেন। কিছু লোক যা ব্যবহার করে–সভ্য মানুষ না জঙ্গলের জানোয়ার বোঝা যায় না।”
শ্রীময়ীর কথার ভঙ্গীতে তপতী ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। বন্ধুকে থামাবার চেষ্টা করেছিল। “এই চুপ কর। ওদের ওসব বলে লাভ নেই, ওরা কী করবে।”
জন-অরণ্য কথাটা সোমনাথের মনে তখনই এসেছিল। কবিতা লেখার উৎসাহে তখনও ভাঁটা পড়েনি। কলেজের লাইব্রেরীতে বসে সোমনাথ একটা কবিতা লিখে ফেলেছিল। বিশাল এই কলকাতা শহরকে এক শ্বাপদসঙ্কুল গহন অরণ্যের সঙ্গে তুলনা করেছিল সোমনাথ—যেখানে অরণ্যের আইনই ভদ্রতার কোট পরে চালু রয়েছে। কেউ এখানে নিরাপদ নয়। সতরাং অরণ্যের আদিম পদ্ধতিতেই আত্মরক্ষা করতে হবে। প্রকৃতিও তাই চায়–না হলে সুদেহিনী সুন্দরীর কোমল অঙ্গেও কেন তীক্ষ্ণ নখ গজায়। দন্ত কৌমুদীতেও কেন আদিম যুগের শাণিত ক্ষুরধারের সহ অবস্থান?
কবিতার প্রথম কয়েকটা লাইন এখনও সোমনাথের মনে পড়ছে : “এও এক আদিম অরণ্য শহর কলকাতা/অগণিত জীব পোশাক-আশাকে মানুষের দাবিদার/প্রকৃতি তালিকায় জন্তু মাত্র—।” কবিতার নাম দিয়েছিল : জন-অরণ্য।
কোনো নকল না-রেখেই কবিতাটা খাতার পাতা থেকে ছিঁড়ে তপতীর হাতে দিয়েছিল সোমনাথ। সেই ছেড়া পাতাটা তপতী যত্ন করে রেখে দিয়েছিল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কাড়-হোল্ডার সোমনাথ হাসলো। কলেজের সেই সবুজ দিনগুলোতে তপতী প্রত্যাশা করেছিল সোমনাথ মস্ত কবি হবে। জন-অরণ্য সে মুখস্থ করে ফেলেছিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তপতী বলেছিল, “একটা কবিতা শুনুন। এও এক আদিম অরণ্য শহর কলকাতা…।” সমস্ত কবিতাটা সে আবত্তি করে ফেললো। তপতীর মুখে কী সুন্দর শোনাচ্ছিল কবিতাটা।
শ্রীময়ী রায় কাছেই দাঁড়িয়েছিল। তপতীর মুখে কবিতা শুনে সে অবাক হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, “তোর আবার কবিতায় আগ্রহ হলো কবে? আমি তো জানতাম হিসট্রি ছাড়া কোনো বিষয়ে তোর হস নেই।”
তপতী লজ্জা পেয়েছিল। শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করেছিল, “কবিতাটা কার লেখা?” তপতী ও সোমনাথ দুজনেই উত্তরটা চেপে গেলো। তপতী বলেছিল, “কবিতা ভালো লাগলে পড়ি। কবির নাম-টাম আমার মনে থাকে না।”
শ্রীময়ী অন্য বাসে রিজেন্ট পার্কে চলে গিয়েছিল। দু নম্বর বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তপতী বলেছিল, “আপনার কবিতা ভালো হয়েছে—কিন্তু নেগেটিভ। বিরক্ত হয়ে আপনি আঘাত করেছেন, কিন্তু সমাজের মধ্যে আশার কিছু লক্ষ্য করেননি।”
কবি সোমনাথ মনে মনে ধন্য হলেও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। লাবণ্যময়ী তপতীর ঝলমলে দেহটার ওপর চোখ বুলিয়ে মৃদু হেসে বলেছিল, “দাঁত, নখ এগুলো তো আঘাতেরই হাতিয়ার।”
ওর স্বরের গাঢ়তা তপতী উপভোগ করেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, “মেয়েদের আপনি কিছুই বোঝেননি। নখ কি কেবল আঁচড়ে দেবার জন্যে? মেয়েরা নখে তাহলে রং লাগায় কেন?”
উত্তরটা খুব ভালো লেগেছিল সোমনাথের। তপতীর বুদ্ধির দীপ্তি অকস্মাৎ ওর মসণ কোমল দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল। মদ্ধ সোমনাথ বলেছিল, “এখন বুঝতে পারছি, লম্বা সর এবং ধারালো নখ দিয়ে কোনো কবির কলমও হতে পারে।”
এমন কিছু, নিবিড় পরিচয় ছিল না দুজনের মধ্যে। ফস করে এই ধরনের কথা বলে …ফেলে সোমনাথ একটু বিব্রত হলো। হঠাৎ দ-নম্বর বাস আসছে দেখে তপতী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিবহনের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো—সে বিরক্ত হলো কিনা সোমনাথ বুঝতে পারলো না।
পরের দিন কলেজের প্রথম পিরিয়ডে তপতী সাইড বেঞ্চির প্রথম সারিতে বসেছিল। দর থেকে ওর গম্ভীর মুখ দেখে সোমনাথের চিন্তা আরও একটু বেড়েছিল—ফলে অধ্যাপকের লেকচার কানেই ঢুকলো না সোমনাথের। প্রায় পনেরো মিনিট নজর রাখার পর দুজনের চোখাচোখি হলো। দৃষ্টিতে বিশেষ কোনো বিরক্তির চিহ্ন ধরা না পড়ায় নিশ্চিত হলো সোমনাথ। তপতীর সর্দি হয়েছে। মাঝে মাঝে রমাল বার করে নিজেকে সামলাচ্ছে।
দুপুরবেলায় দুজনে আবার দেখা হয়েছিল। ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে যাবার পথে তপতী দুত ওর হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট গুজে দিয়ে উধাও হয়েছিল। বন্ধুদের সতর্ক দটি ফাঁকি দিয়ে কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে প্যাকেট খুলেছিল সোমনাথ। একটা পাইলট পেন—সঙ্গে ছোট্ট চিরকুট। কোনো সম্বোধনই নেই-লেখিকার নামও নেই। শুধু লেখা। “নখকে কলম করা নিতান্তই কবির কপনা। কবিতা লিখতে হয় কলম দিয়ে।”
সবুজ রংয়ের সেই কলম আজও সোমনাথের হাতের কাছে রয়েছে। তপতীর সেই প্রত্যাশার সম্মান রাখতে পারেনি সোমনাথ। কবিতা না লিখে, বস্তা বস্তা আবেদনপত্র বোঝাই করে করে কলমকে ভোঁতা করে ফেলেছে সোমনাথ। অসখ কলমটা মাঝে মাঝে বমি করে হঠাৎ বিনা কারণে ভকভক করে কালি বেরিয়ে আসে। সোমনাথ ব্যানার্জির এই পরিণতি হবে জানলে, তপতী নিশ্চয় তাকে কলম উপহার দিতো না। কলম দিয়ে তপতীর চিঠির ওপর হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে নানা অর্থহীন চিন্তার জালে সোমনাথ জড়িয়ে পড়লো।