১১. ফরিদের মামলা কোর্টে উঠেছে

ফরিদের মামলা কোর্টে উঠেছে। পুলিশ চার্জশিট আগেই দিয়েছিল। ফরিদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন উকিল মুসলেম উদ্দিন। হাবীব খানের জুনিয়র। রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছে খুন হয়েছে। মুসলেম উদ্দিন বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটেছে।

মামলা সাজানোর পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আছে। ফরিদকে দেখানো হচ্ছে হাজি রহমত সাহেবের কেয়ারটেকার হিসাবে। বন্দুকের লাইসেন্স হাজি সাহেবের নামে। তাঁর কেয়ারটেকারের পক্ষেই বন্দুক পরিষ্কার করা যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া হাসানকে কোনো কিছুতেই রাখা হচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের সময় সে অকুস্থলেই ছিল না। ময়মনসিংহে এসেছিল সিনেমা দেখতে। দুই রাত হোটেলে ছিল। হোটেলের রেজিস্ট্রারে ব্যাকডেটে তার নাম তোলা হয়েছে।

হাজি সাহেবের সাক্ষ্য ভালোমতো হয়েছে। তিনি কোনো ভুল করেননি। বেফাস কথা বলেন নি। যা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তা-ই বলেছেন। বিশ্বাসযোগ্যভাবে সুন্দর করে বলেছেন।

আপনি এই বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করেন? (বন্দুক দেখানো হলো)

জি।

রোজ শিকার করেন?

হঠাৎ হঠাৎ করি, রোজ না।

কী পাখি? বক, হরিয়াল, ঘুঘু। জুররা গুলি ব্যবহার করেন? জি। তাহলে বন্দুকের ভেতর ছররা গুলি থাকার কথা। বুলেট ছিল কেন?

একটা বাঘডাশা খুব উপদ্রপ করছিল। হাঁসমুরগি নিয়ে যায়। একটা ছাগলও নিয়ে গিয়েছিল। বাঘডাশা মারার জন্য বুলেট ভরেছিলাম।

বাঘডাশা মরিতে পেরেছিলেন?

জি জনাব। দু’নলা বন্দুকের একটা গুলি খরচ হয়েছে। আরেকটা হয় নাই। বন্দুকে একটা গুলি আছে, ফরিদ বুঝতে পারে নাই। বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এখানে তার যতটা দোষ, আমারও ততটাই দোষ। বুলেট আমি কেন সরায়ে রাখি নাই? আপনারা শাস্তি দিতে চাইলে আমাকে দিবেন। আমারই শাস্তি হওয়া উচিত।

হাজি সাহেব শেষের কথাগুলি জজ সাহেবের দিকে হাতজোড় করে বললেন। বলার সময় তাঁর গলা ভেঙে গেল। তার কাঁধে রাখা চাদরে চোখ মুছলেন।

ডিসট্রিক জজ বললেন, ঠিক আছে আপনি যান। অন্য কোনো সাক্ষী থাকলে আসুক।

পরের সাক্ষীর নাম আমেনা বেগম। সে প্রত্যক্ষদর্শী। হাবীব জেরা করার জন্যে তার জুনিয়রকে উঠতে দিলেন না। নিজেই উঠলেন।

হাবীব : আপনার নাম আমেনা বেগম?

আমেনা : জি।

হাবীব : আপনি কী করেন?

আমেনা : আমি কইতরবাড়িতে পাকশাকের কাম করি।

হাবীব : ফরিদকে আপনি চেনেন?

আমেনা : জে। হে আমারে খালা ডাকে।

হাবীব : ফরিদ ছেলে কেমন?

আমেনা : হে ফেরেশতার মতো। আমি তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখি নাই।

হাবীব : ওইদিনের ঘটনা আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?

আমেনা : জি।

হাবীব : কী দেখেছেন বলুন।

আমেনা : ফরিদ সকালবেলা আমারে কইল, খালাজি, আমারে এককাপ চা দেন। চা খায়া বন্দুক সাফ করব।

আমি বললাম, কাইল একবার বন্দুক সাফ করলি, আইজ আবার?

সে বলল, গতকাইল বাঘডাশা মারা হইছে—নলে ময়লা জমেছে। বড়সাব যদি পক্ষী শিকারে যাইতে চান।

আমি বললাম, তুই যা বন্দুক সাফা কর, আমি চা নিয়া আসতেছি।

সে বলল, মামার জন্যেও এক কাপ চা আনা। মামা নামাজে দাঁড়াইছেন। নামাজ শেষ কইরা চায়ে চুমুক দিলে ভালো লাগত।

হাবীব : মামা কে?

আমেনা : যিনি খুন হইছেন তারে ফরিদ মামা ডাকত। উনারে ফরিদ অত্যধিক সম্মান করত। মামা মামা ডাইকা পিছনে ঘুরত।

হাবীব : আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নাই।

আমেনা : স্যার, ঘটনা ক্যামনে ঘটছে সেইটা জিগান। বৰ্ণনা করি। আরেকটু হইলে আমি গুলি খায়া মরতাম। ভাইগ্নার হাতে খালার মৃত্যু। বন্দুকের নল ছিল আমার দিকে। ইয়া মাবুদে এলাহি।

হাবীব নিজের জায়গায় এসে বসলেন। প্রণব চাপা গলায় বলল, সাক্ষী কেমন জোগাড় হয়েছে দেখেছেন স্যার! সব ঠোটস্থ। প্রশ্নের আগে উত্তর।

হাবিব বললেন, বেশি মুখস্থ হওয়াও ভালো না। বেশি মুখস্থের স্বাক্ষী সন্দেহজনক। কেউ বিশ্বাস করে না।

প্রণব গলা আরও নামিয়ে বলল, গতকালের ময়মনসিংহ বার্তা পড়েছেন স্যার?

ময়মনসিংহ বার্তা আমি পড়ি না।

প্রণব বলল, আমিও পড়ি না। একজন আমার হাতে দিয়ে গেছে। নেন পড়েন। পড়া প্রয়োজন। শেষ পৃষ্ঠা।

হাবীব ময়মনসিংহ বার্তর শেষ পৃষ্ঠা পড়লেন। সেখানে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ নামে একটা খবর ছাপা হয়েছে। খবরের বিষয়বস্তু হলো—খুন করেছে একজন, বিচার হচ্ছে আরেকজনের। ফরিদের মামলার পুরো বিবরণ সেখানে লেখা। মূল খুনি কে এই নাম শুধু বাদ।

হাবীব বললেন, পত্রিকার সম্পাদককে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।

কবে দেখা করবে?

আজ রাত আটটার পর। ওসি সাহেবকেও বলবে।

রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট থেকে জিনিস আনায়ে রাখব?

অবশ্যই। হেকিমের দোকানের পরোটা মাংস যেন থাকে। ওসি সাহেব পছন্দ করেন।

নাদিয়া আম্মা আজ ঢাকা যাবে না?

না। এই গণ্ডগোলে তারে ঘরের বাইরে পাঠাব না। প্রয়োজনে এক বৎসর মিস দিবে, পরের বৎসর পড়বে।

আম্মা কি রাজি হবেন?

তার রাজি হওয়া না-হওয়ার কিছু নাই।

বৌদি স্বীকার পেয়েছেন?

তারও স্বীকার পাওয়া অস্বীকার পাওয়ার কিছু নাই। সংসার একটা গাড়ির মতো। সেই গাড়ির চালক একজন। দুইজনে একসঙ্গে গাড়ি চালায় এমন কথা কেউ শুনে নাই।

হাবীবের অতি কঠিন সিদ্ধান্তের কারণ গত বৃহস্পতিবার রাতে, ফজরের আজানের আগে আগে দেখা একটা স্বপ্ন। অতি পরিষ্কার স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, রোকেয়া হল থেকে মিছিল বের হয়েছে। আয়ুববিরোধী মিছিল। অনেকের হাতে প্লাকার্ড। প্লাকার্ডে সাধারণ যে সব কথাবার্তা থাকে সেই সবই লেখা। শুধু নাদিয়ার প্লাকার্ডে লাল কালি দিয়ে লেখা–

রক্ত খাই।
আয়ুব খানের রক্ত খাই।

স্বপ্নের মধ্যেই তার মনে হলো, এটা কী! আয়ুব খানের ফাঁসি চাই’ লেখা থাকতে পারে, কিন্তু তার রক্ত পাবে কেন?

মিছিল পাবলিক লাইব্রেরির কাছে আসতেই পুলিশ গুলি করল। কারও গায়ে গুলি লাগল না। শুধু নাদিয়ার পেটে গুলি লাগল। রাস্তায় কোনো লোকজন নাই, পুলিশও নাই। নাদিয়া চিৎকার করছে, পানি! পানি! তখন বিদ্যুত কান্তি ছুটে এল। সে পানি খাওয়ানোর বদলে নাদিয়ার শাড়ি-ব্লাউজ টেনে খুলতে শুরু করল। এই পর্যায়ে হাবীবের ঘুম ভেঙে গেল।

এমন এক স্বপ্ন দেখার পর মেয়েকে ঢাকা পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। স্বপ্নের দোষ কাটানোর জন্যে তিনি একটা মোরগ ছদকা দিয়েছেন, দশটা কবুতর আজাদ করেছেন। তিনজন এতিম খাইয়েছেন। শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেবের কাছে লোক পাঠিয়েছেন। তিনি চিল্লায় বসে বিশেষ দোয়া করবেন।

হাবীব মেয়েকে স্বপ্নের কথা বলেছেন। বিদ্যুত নামে শিক্ষকের অংশটি বলেননি। নিজের মেয়েকে এই বিষয় বলা যায় না। নাদিয়া বলেছে, দেশজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে, এই কারণেই এমন স্বপ্ন। এই স্বপ্ন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নাই।

হাবীব বললেন, আমি তোমার মতো জ্ঞানী না। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই। তোমার ঢাকা যাওয়া বন্ধ। দেশ যদি কোনোদিন শান্ত হয় চাকায় যাবে।

শান্ত না হলে যেতে পারব না?

না।

আমি এখানে থেকে কী করব?

যা করতে ইচ্ছা হয় করবে। আমি তোমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। তোমার দাদি মৃত্যুশয্যায়। তিনি নাতজামাইয়ের মুখ দেখতে চান।

বাবা, আমার খুব ইচ্ছা আমি পড়াশোনা শেষ করি। Ph.D করি। ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করি।

তোমার কপালে থাকলে যা চাও হবে। কপালে না থাকলে হবে না। শেখ মুজিব পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন করে তার প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিল–এখন সে ঝুলবে ফাঁসিতে, কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াড। ফায়ারিং স্কোয়াড হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মিলিটারিরা ফাঁসি পছন্দ করে না। তুমি কি আর কিছু বলতে চাও?

নাদিয়া বলল, না।

জানি তুমি রাগ করেছ। আমি তোমার রাগ নিয়ে থাকতে পারব। অনেকেরই আমার উপর রাগ আছে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

নাদিয়া বলল, সেটাই ভালো। বাবা আমি উঠলাম। দিঘির ঘাটে গিয়ে বসে থাকব। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবে না। আমি তোমার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি, কিন্তু যাব না।

সন্ধ্যাবেলা হাজেরা বিবি নাতনির জন্যে অস্থির হয়ে গেলেন। চিলের মতো চিৎকার, ও তেজল্লী! ও তোজল্লী! আমার তোজল্লী কই?

নাদিয়া দাদির কাছে ছুটে গেল। হাজেরা বিবি করুণ গলায় বললেন, এইটা কী খবর শুনলাম?

দাদি, কী শুনেছ?

পুলিশ নাকি তোর পেটে গুলি করেছে? তোর মৃত্যু হয়েছে?

নাদিয়া বলল, যার মৃত্যু হয় সে কি তোমার খাটে বসে গল্প করতে পারে?

হাজেরা বিবি বললেন, তোর মৃত্যু যদি না হয়ে থাকে তাইলে এমন কথা কেন রটল? সবাই জানে, যাহা রটে তাহা বটে।

নাদিয়া শান্ত গলায় বলল, দাদি। বাবা আমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। তুমি এই দুঃস্বপ্নের কথা শুনেছ। তুমি ভালোমতোই জানো আমি বেঁচে আছি, তারপরেও নাটক করার জন্যে কিছুক্ষণ হইচই করলে। তুমি প্রমাণ করতে চাও তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমার মাথা যে যোলআনা ঠিক আছে সেটা আর কেউ না জানুক আমি জানি।

হাজেরা বিবি বললেন, জানলে জানস। এখন আমারে বোতলের মিজিকটা আরেকবার দেখা।

বোতলের ম্যাজিক তোমাকে অনেকবার দেখিয়েছি। আর দেখাতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া আমার মনটা আজ খারাপ।

বাপ আটক দিছে এইজন্যে মন খারাপ?

দাদি তুমি তো সবই জানো। শুধু শুধু কেন জিজ্ঞেস করছ?

হাজেরা বিবির চোখ হঠাৎ চকচক করে উঠল। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, আমারে একবার আমার শ্বশুরআব্বা আটক দিয়েছিলেন। বাপের বাড়ি নাইয়র যাইতে দিবেন না। আমারে নাইয়র নিতে আমার বড় ভাইজান আসছে। বিরাট নাও নিয়া আসছে। শ্বশুরআব্বা তারারে ফিরত পাঠাইছেন। আমি খবর পাইয়া কী করলাম নবি?

শুনতে চাচ্ছি না, ভয়ঙ্কর কিছু তুমি করেছ বুঝতে পারছি।

হাজেরা বিবি হাসিমুখে বললেন, ওন না, শুনলে মজা পাবি। আমি শ্বশুরআব্বার মাথা কামানির ক্ষুর হাতে নিয়া তার কাছে গেলাম। তারে বললাম, আপনে যদি এক্ষণ আমারে বাপের বাড়ি না পাঠান এই ক্ষুর আমি নিজের গলায় বসায়ে দিব। কথা শেষ কইরা ক্ষুর বাইর কইরা গলার কাছে ধরলাম শ্বশুরআব্বা বললেন, হাত থাইকা ক্ষুর নামাও। আমি ব্যবস্থা নিতেছি।

নাদিয়া বলল, আমি কি বাবার একটা ক্ষুর নিজের গলার কাছে ধরব?

হাজেরা বিবি পান ছেচনি হাতে নিতে নিতে বললেন, সেইটা তোর বিবেচনা।

 

ময়মনসিংহ বার্তা পত্রিকার সম্পাদকের নাম নিবারণ চক্রবর্তী। সম্পাদকের রাত আটটায় আসার কথা। তিনি আটটা বাজার আগেই চলে এসেছেন। ছোটখাটো মানুষ। পুরুষ্ট গোঁফ আছে। ধুতির ওপর কালো কোট পরেছেন। ধূর্ততা মাখানো ছোট হেট, চোখ চিন্তিত মুখে হাবীবের চেম্বারে বসে আছেন। জরুরি তলবের কারণ ধরতে পারছেন না। হাবীব ঠিক আটটায় চেম্বারে ঢুকলেন।

নারায়ণ চক্রবর্তী হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার।

হাবীব বললেন, আদাব। ভালো?

জি ভালো।

পত্রিকা কেমন চলছে?

আমার পত্রিকা অপুষ্ট রুগ্নশি, কোনোমতে বেঁচে আছে। নিজের প্রেস থাকায় রক্ষা। প্রেস না থাকলে পত্রিকা কবেই উঠে যেত।

কত কপি ছাপেন?

দুইশ আড়াইশ কপি।

বিক্রি কত কপি হয়?

অল্প কিছু হয়। সবই চলে যায় সৌজন্যে। ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াই।

হাবীব বললেন, আপনি সাহসী মানুষ। আপনার সাহসের তারিফ করি।

সাহসের কী দেখেছেন?

হিন্দুরা ধুতি ছেড়ে দিয়েছে। আপনি পরছেন। সাহসী কর্মকাণ্ড। মাঝে মাঝে এমন কিছু খবর ছাপেন যা অন্য কেউ ছাপবে না। সাহসের অভাবেই ছাপবে না। আপনার সাহস আছে, আপনি ছাপেন।

কোন খবরের কথা বলছেন?

উদোর পিণ্ডি নিয়ে একটা খবর পড়লাম।

না জেনে ছাপাই নাই। জেনে ছাপায়েছি।

তাই তো করা উচিত। কেউ আপনাকে বলল, চিলে আপনার কান নিয়ে গেছে। আপনি কানে হাত না দিয়েই ময়মনসিংহ বার্তায় লিখলেন, একটা বড় চিল, ময়মনসিংহ বার্তার সম্পাদকের কান নিয়া আকাশে উড়িয়া গেছে। সেটা কি ঠিক?

নারায়ণ চক্রবর্তী অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তার চোখ পিটপিট করছে। তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন, আমাকে একজন এই খবরটা দিয়েছে।

একজনটা কে?

সম্পাদকের নীতিমালায় খবরের সোর্স বলা যায় না।

আপনি যে বিরাট নীতিবাগিশ লোক সেটা জানা ছিল না। দেশ থেকে নীতি উঠে গেছে। আপনার মধ্যে আছে। অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। আচ্ছা আপনি যান। আপনার সঙ্গে কথা শেষ।

নারায়ণ চক্রবর্তী বললেন, আমাকে কী জন্যে ডেকেছেন তা পরিষ্কার বুঝলাম না।

যথাসময়ে বুঝবেন। যে হাজি সাহেবের মামলা নিয়ে সংবাদ ছেপেছেন তিনি যখন কুড়ি লাখ টাকার মানহানির মামলা করবেন তখন বুঝবেন। টাকাপয়সা কি আছে?

আমি দরিদ্র মানুষ।

একটা প্রেস আছে, দরিদ্র হবেন কেন? প্রেস বেচে দিবেন। ইন্ডিয়াতেও নিশ্চয়ই বিষয়সম্পত্তি করেছেন। বসতবাটি আছে না?

জল খাব।

অবশ্যই জল খাবেন। মুসলমান বাড়িতে এসেছেন বলে আপনাকে পানি খাওয়ায়ে দিব তা না। প্রণব, উনাকে কাঁসার গ্লাসে জল দাও।

নারায়ণ চক্রবর্তী ভীত গলায় বললেন, খবরটা যদি ভুল হয় বিজয়ের দিলে ছাপায়ে দিব।

হাবীব বললেন, জয়েন্ডার বিজয়ের কিছু কেউ দিবে না। গায়ের চামড়া রক্ষার জন্যে নিজেই যা করার করবেন। দেশরক্ষা আইনে যারা গ্রেফতার হচ্ছে তারা সবাই হিন্দু। এই বিষয়টাও খেয়াল রাখবেন। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ এই বাগধারা কি শুনেছেন?

শুনেছি।

‘ছেলে বোবা কালা, বাপ নাম রেখেছে তর্কবাগিশ’—এটা শুনেছেন?

না। আপনার পত্রিকা বোবা কালা, আপনি নাম রেখেছেন তর্কবাগিশ। কাজটা ঠিক হয় নাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে অনেক সময় নষ্ট করেছি, আর করব না। আপনি জল খেয়ে চলে যান। ওসি সাহেব আসবেন, তার সঙ্গে জরুরি আলোচনা। আপনার বিষয়েই আলোচনা।

আমার বিষয়ে কী আলোচনা?

পুলিশ একটা হত্যা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। মামলা শেষ পর্যায়ে, এখন আপনি উল্টাগীত গাইছেন। পুলিশ কি বিষয়টা সহজভাবে নিবে?

যে-কোনো ভুলেরই সংশোধন আছে।

সংশোধনের বিষয় নিয়ে চিন্তা করা শুরু করে দেন। হাতে সময় বেশি নাই।

 

ওসি সাহেব রাত নটায় এলেন। তার সঙ্গে দরজা বন্ধ করে হাবীব মিটিং করলেন। খাওয়াদাওয়া করে ওসি সাহেব সাড়ে দশটার দিকে চলে গেলেন। ভোর তিনটায় ময়মনসিংহ বার্তা সম্পাদক গ্রেফতার হলেন দেশরক্ষা আইনে। ময়মনসিংহ বার্তা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।

মফস্বল শহরের ছোট্ট একটা পত্রিকার বাজেয়াপ্তের খবর কোথাও উঠল না। নারায়ণ চক্রবর্তী জেলহাজতে বসেই খবর পেলেন, তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা নগদ টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর কিশোরী কন্যা সীতাকে নিয়ে গেছে। সীতার বয়স চৌদ্দ। সে এই বছরই এসএসসি পরীক্ষা দিবে।

সীতা অপহরণের খবর ইত্তেফাক পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছাপা হলো। মওলানা ভাসানী বগুড়ার এক জনসভায় সংখ্যালঘুদের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে সীতার অপহরণের প্রসঙ্গ তুললেন।

 

ফরিদের মামলা আবার কোর্টে উঠেছে। হাবীব কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দোতলা থেকে নামতেই প্রণব ছুটে হাবীবের হাত থেকে ব্রিফকেইস নিতে নিতে বলল, আপনার কাছে আমার একটা আবদার।

হাবীব বললেন, বলো কী আবদার?

আবদার রক্ষা করলে সারা জীবন আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।

হাবীব বললেন, কেনা গোলাম তো হয়েই আছ। নতুন কেনা গোলাম কীভাবে হবে।

প্রণব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, তাও ঠিক।

আবদারটা কী বলো।

নারায়ণ চক্রবর্তীর মেয়ে সীতাকে উদ্ধারের একটা ব্যবস্থা যদি আপনি করেন। মেয়েটাকে আমি দেখেছি। ফাংশানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। পরীর মতো মেয়ে, কিন্নর কণ্ঠ।

হাবীব বললেন, তোমার কথায় যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি। তোমার কি ধারণা ডাকাতি আমি করিয়েছি।

না না, ছিঃ ছিঃ কী বলেন!

তাহলে মেয়েটাকে উদ্ধার করব কীভাবে?

আপনি যদি একটু ওসি সাহেবকে বলে দেন। পুলিশের পক্ষে এটা কোনো বিষয়ই না। সব অপরাধীর সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ।

হাবীব বললেন, সুযোগমতো বলব।

প্রণব হঠাৎ হাবীবকে চমকে দিয়ে মেঝেতে বসে দু’হাতে তার পা চেপে ধরল। কাঁদো কাদো গলায় বলল, স্যার মেয়েটাকে উদ্ধার করে দিন। স্যার স্যার গো…

হাবীব বললেন, ভালো বিপদে পড়লাম তো।

প্রণব বললেন, আপনি স্বীকার না করা পর্যন্ত আপনার পা আমি ছাড়ব না। ভগবান সাক্ষী, আমি ছাড়ব না।

 

বিদ্যুত কান্তি দে’র বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার চাকরিটা চলে গেছে। বৈধভাবেই গিয়েছে। সে ছিল লিভ ভ্যাকেনসিতে। যার ছুটির কারণে বিদ্যুত চাকরি পেয়েছে। তিনি Ph.D করে চাকরিতে জয়েন করেছেন।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, বিদ্যুত, ভেরি সরি। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট একজন শিক্ষককে আমরা রাখতে পারছি না।

বিদ্যুত বলল, আমি হিন্দু এই কারণে রাখতে পারছেন না।

এই ধরনের কথা তোমার কাছ থেকে আশা করিনি। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকানুন জানো।

বিদ্যুত বলল, লিভ ভ্যাকেন্সিতে আমরা তিনজন ছিলাম। দু’জন মুসলমান একজন হিন্দু। চাকরি শুধু হিন্দুটার গেছে। যদিও সেই হিন্দু মালাউনের একাডেমিক কেরিয়ার সবচেয়ে ভালো। সে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে, আবার এমএসসিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছে।

বিদ্যুত, তুমি উদ্ধত ভঙ্গিতে কথা বলছ।

স্যার, আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন। আমার কণ্ঠস্বর এবং মাথা সবসময় নিচু রাখতে হবে।

তুমি আরও কিছু বলবে, নাকি কথা শেষ?

যাবার আগে আপনাকে প্রণাম করে একটা কথা শুধু বলব।

প্রণামের প্রয়োজন নাই—কী কথা বলতে চাও বলো।

বিদ্যুত প্রণাম করতে করতে বলল, আমরা প্রয়োজনের কাজের চেয়ে অপ্রয়োজনের কাজ বেশি করি। যাই হোক, কথাটা বলি। স্যার, পাথরে ঘুণ ধরে না।

তার মানে কী?

আপনি পচা কাঠ। পাথর না, তাই ঘুণ ধরেছে। আমি পাথর। ঘুণ আমাকে ধরবে না।

 

নরসিংদীর এক গ্রাম, নয়নাতলা।

বিদ্যুত মাথা নিচু করে তার বাড়ির উঠানে বসে আছেন। টিনের বাড়ি। নতুন টিন লাগানোয় ঝকঝক করছে। বাড়ির উত্তরে কুয়া কাটানো হয়েছে। কুয়ায় পানি ওঠেনি, তারপরের কুয়াতলা বাঁধানো। বাড়ির পেছনে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। টিউবওয়েলের পানি মিষ্টি।

সবই করেছে বিদ্যুত। বেতনের টাকার প্রায় সবটাই বাড়ির পেছনে চলে গেছে। এখন সে নিঃস্ব। বাড়িতে আসার খরচ জোগাড় করার জন্যে সে হাতঘড়ি এবং লেকচারস অব ফাইনম্যান বই বিক্রি করেছে।

সময় দুপুর। বিদ্যুৎ রোদে পিঠ মেলে বসে আছে। রোদে গা চিড়বিড় করছে, সে নড়ছে না। বিদ্যুতের মা সরলা দরজা ধরে দাঁড়ালেন। মানুষটা ছোটখাটো।চোখেরহারা দৃষ্টি। সরলা বলেন, বাবা তোর হাত কি খালি?

বিদ্যুৎ হ্যাঁ–সুচক মাথা নাড়ল।

বড় মাছের একটা টুকরা ভেজে দেই, খা।

মাছ কোথায় পেয়েছ?

সরলা জবাব দিলেন না। বিদ্যুৎ বলল, বাবার পুরানা অভ্যাস যায় নাই।

সরলা বললেন, না।

বাবা কই?

জানি না। মনে হয় সেতাবগঞ্জের হাটে গেছে। আজ হাটবার।

মা, ঘরে কি লেখার কাগজ-কলম আছে?

কলম আছে। কসজ নাই।

বিদ্যুৎ বলল, ঠিক আছে লাগবে না।

সরলা বললেন, আমার কাছে একটা সুর চেইন আছে নিয়া যা, স্বর্ণকারের দোকানে বেইচা দিয়া কাগজ কিন্যা আন।

কাগজ লাগবে না।

বাবা একটা কথা বলি, রাখবি?

ব্যাথার মত কথা গুম রাখব। অন্যায় কথা রাখব না।

অন্যায় কথা না বান্ধব কথা। চল ইন্ডিয়া চলে যাই।

নিজের দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

ইন্ডিয়ায় গেলে তুই সহজে চাকরি পাবি।

চাকরি আমি এখানেই পাব। দেশজুড়ে আন্দোলনের কারণে সব বন্ধ। আন্দোলন একটু কমুক। চাকরি না পেলেও চলবে।

কীভাবে চলবে?

মা, আমার অনেক বুদ্ধি। বুদ্ধি বেঁচে টাকা জোগাড় করব।

বুদ্ধি কার কাছে বেচবি?

যার বুদ্ধি নাই তার কাছে।

সরলা বললেন, আমার কাছে বেচ, আমার বুদ্ধি নাই।

বলতে বলতে সরলা হাসলেন, বিদ্যুৎ হামল।

 

বিদ্যুতের বাবা হরি সেতাবগঞ্জের হাটে একটা ছাগলের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরুষ্ট ছাগল, ভালো দাম পাওয়ার কথা। হরি অল্পদামেই ছাগল ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কুড়ি টাকা পেলেই তিনি ছেড়ে দিবেন।

ছাগলটা তাঁর না। হাঁটে আসার পথে এক বেগুনক্ষেত থেকে তিনি ধরেছেন। ছাগলের মালিকের এই হাটে আসার সম্ভাবনা আছে। তবে সে তার ছাগল দেখে চিনতে পারবে না। ছাগলের দাড়ি তিনি কাঁচি দিয়ে সুন্দর করে কেটে দিয়েছেন। ছাগলের মুখের কাছে সাদা রঙ কালো জুতার কালি ঘষে কালো করেছেন। এইসব সরঞ্জাম সবসময় তার সঙ্গেই থাকে।

মাছ ধরায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। গভীর রাতে জাল ফেলে অন্যের পুকুরের মাছ। বিষয়টাকে তিনি চুরি হিসেবে দেখেন না। অন্যের আছে তার নাই। যার আছে তার ধনের ওপর যার নাই তার কিছু অধিকার থাকবেই।

বিদ্যুত মাস্টারি পাওয়ার পর তিনি গুরুর কাছ থেকে মন্ত্র নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেছেন। ছেলে মানিঅর্ডারে ভালো টাকা পাঠাচ্ছে। মাছ চুরি, ছাগল চুরির প্রয়োজন কী? ঝিম ধরে বাড়ির উঠানের কাঁঠালগাছের নিচে বসে মন্ত্র জপ করা।

কিছুদিনের মধ্যেই মন্ত্রের ওপর তার ঘেন্না ধরে গেল। রাতে ঘুম হয় না। খাওয়াদাওয়ায় রুচি নাই।

তারপর এক মাঝরাতে বছির মাতবরের গোয়াল থেকে মাঝারি সাইজের এক বলদ নিয়ে হাঁটা দিলেন। সারা রাত হাঁটলেন। কী উত্তেজনার হাঁটা। বুকের ভেতর গুড়গুড় করছে। কেউ যদি দেখে ফেলে সে আতঙ্ক আছে, আবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার রোমাঞ্চও আছে। আতঙ্ক, রোমাঞ্চ, উত্তেজনা এর নামই তো জীবন।

তিনি ভোরবেলা নীলগঞ্জ বাজারে পৌঁছলেন। কসাইয়ের কাছে পঁচাত্তর টাকায় বলদটি বিক্রি করলেন।

 

ছাগল পনেরো টাকায় বিক্রি হয়ে গেল। হরি চাল-ডাল কিনলেন। ছেলে মাংস পছন্দ করে। এক পোয়া খাসির মাংস কিনলেন। ছেলেটা ঝামেলায় পড়েছে, চাকরি চলে গেছে। একবেলা আরাম করে খাক। তিনি পোলায়ের চাল এবং ঘি কিনলেন। আজ রাতে পোলাও-মাংস হোক। বাপ-বেটা আরাম করে খাবে।

সংসার আর কয়দিনের?

এই আসছি এই নাই
দুই দিনের খাই খাই।

 

বিদ্যুত উঠানে চক্রাকারে হাঁটছে। মাঝখানে হারিকেন জ্বলছে। সরলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কাণ্ড দেখছেন। তার ছেলেটা এরকম কেন?

সরলা বললেন, বাবা চা খাবি?

না।

বাবা এরকম করছিস কেন?

একটা ছোট্ট পরীক্ষা করলাম।

কী পরীক্ষা?

তুমি বুঝবে না।

বলে দেখ। বুঝতেও তো পারি।

আমি পরীক্ষা করে বের করলাম, যারা লেফট হ্যান্ডার তারা Anticlokvise দ্রুত ঘুরতে পারে। রাইট হ্যাভারা দ্রুত ঘুরে Clokwise। কিছু বুঝেছ?

সরলা হতাশ গলায় বললেন, বুঝেছি।

বিদ্যুত হো হো করে হাসছে। সরলা মুগ্ধ হয়ে ছেলের হাসি দেখছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *