ছোটদা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর বাড়িতে আবদার করলেন আনন্দ মোহন কলেজে বেবি নাম, নেত্রকোণা বাড়ি, তাঁর এক সহপাঠী মেয়েকে এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া হোক, যেহেতু বেবির থাকার জন্য কোনও ভাল জায়গা নেই। ছোটদার আবদার মঞ্জুর হল। বেবি সুটকেস নিয়ে উঠল অবকাশে, আমার বিছানায় শোবার জায়গা হল তার। টেবিল চেয়ার দেওয়া হল তাকে পড়াশুনা করার। বেবি, দেখতে লম্বা, শ্যামলা, চমৎকার মায়াবি চোখ, দু’দিনেই খাতির জমিয়ে ফেলল বাড়ির সবার সঙ্গে। আত্মীয় স্বজনের বাইরে কারও মুখ দেখে ঘুমোতে যাওয়ার, বা ঘুম থেকে ওঠার আমার সুযোগ ঘটেনি এর আগে। বাইরের জগত থেকে আমাদের সংসারে একটি জলজ্যান্ত মানুষের প্রবেশ ঢেউ তোলে আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে। বেবি যখন গল্প করে তার বোন মঞ্জুরি কী করে গাছের মগডাল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল, সে ই বা কী করে একা একা নেত্রকোণা থেকে চলে এল ময়মনসিংহে লেখাপড়া করতে, কী করে তার পাগল এক ভাই কংসের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকত সারাদিন, একদিন তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি–কংস হয়ে দাঁড়ায় আমারই নদী, ব্রহ্মপুত্র যেমন। মঞ্জুরিকে মনে হয় আমার জন্ম জন্ম চেনা। মা’র সঙ্গে চুলোর পাড়ে বসে বেবি গল্প করে কী করে তার পাগল ভাইটিকে আর খুঁজে না পাওয়ার পর মা তার নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পড়ল, শুকিয়ে পাতাকাঠির মত হয়ে বেবিকে বলল তাকে পুকুরে নিয়ে স্নান করিয়ে আনতে, বেবি তাই করল, পুকুর থেকে নেয়ে এসে শাদা একটি শাড়ি পরে বেবির মা শুল, সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। মা গল্প শুনে আহা আহা করে বলেন তুমি হইলা আমার মেয়ে। আমার এখন তিন মেয়ে।
বাবা বাড়ি ফিরে বেবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, পড়াশুনা কেমন চলছে? ফার্স্ট ডিভিশন পাইবা ত!
বেবি মাথা নুয়ে বলে–জী খালুজান, আশা রাখি।
সাড়ে তিন মাস পর বেবিকে অবশ্য পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হল। কারণ মা হঠাৎ এক দুপুরে আবিষ্কার করেছিলেন ছোটদা বিছানায় শুয়ে আছেন, খাটের কিনারে বসে ছোটদার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেবি। মা ফেটে পড়লেন বেবি, এত শয়তানি তুমার মনে মনে ছিল! আমারে বুঝাইছ তুমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক। দুধ কলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি আমি। আমার ছেলের সাথে ফস্টি নস্টি করার উদ্দেশ্য তুমার! এত বড় সাহস!
বেবি কেঁদে পড়ল মা’র পায়ে। ছোটদার মাথা ধরেছিল বলে বেবি কেবল স্পর্শ করেছিল কপালে, এই যা। আর কোনওদিন এমন ভুল হবে না বলে সে জোড় হাতে ক্ষমা চাইল। মা ক্ষমা করার মানুষ নন। বলে দেন, মন যখন ভাঙে মা’র, একেবারেই ভাঙে। বেবির চলে যাওয়াতে বাড়িতে সবচেয়ে যে মানুষটি নির্বিকার ছিলেন, তিনি ছোটদা।
ছোটদার পরীক্ষা সামনে, আইএসসি, যে পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হবেন তিনি মেডিকেল কলেজে। বাবার অনেকদিনের স্বপ্ন, তাঁর একটি ছেলে ডাক্তার হবে। সেই ছোটদা হঠাৎ বাড়ি ফেরেন না। একদিন দু’দিন, সপ্তাহ চলে যায়, তাঁর টিকিটি নেই। বাবা উন্মাদ হয়ে সারা শহরে খোঁজ করেন। বাবা তখন টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন, ভোররাতে বাসে করে টাঙ্গাইল যান চাকরি করতে, অবশ্য যত না চাকরি করতে চাকরি বাঁচাতেই বেশি, রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। আপিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলে তিনি ছেলের খোঁজ করেন। ময়মনসিংহ ছোট শহর, ছেলে মেলে, তবে ছেলে আর সেই আগের ছেলে নেই। ছেলে বিবাহিত। কি ঘটনা, ক্লাসের এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তাকে বিয়ে অবদি করে ফেলেছেন গোপনে, এক বন্ধুকে উকিল বাপ বানিয়ে। এখন বউ নিয়ে সেই বন্ধুর বাড়িতে আছেন।
বাবা কপালের শিরা চেপে বলেন–সব্বনাশ হইয়া গেছে। আমার সব আশা ভরসা শেষ। ছেলে আমার এ কি কান্ড করল! কে তারে এইসব করতে বুদ্ধি দিল। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস আছে। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়বে। ছেলে আমার মানুষের মত মানুষ হবে। ছেলে এ কি পাগলামি করল! ওর ভবিষ্যত নষ্ট হইয়া গেল! কত কইছি বন্ধুদের সাথে মিশবি না। মিশছে। কত বুঝাইছি লেখাপড়া কইরা মানুষ হইতে!
বাবার মাথায় লোটা লোটা ঠান্ডা পানি ঢালেন মা। বাবার রক্তচাপ বাড়ছে। মা টের পান না, বাবার হৃদপিন্ডের ওপর কালো এক থাবা বসিয়ে যায় ফুঁসে ওঠা রক্তচাপ।
মা ফুঁপিয়ে কাদেন আর বলেন – আমার হীরার টুকরা ছেলে। কই আছে, কী খায় কেডা জানে! বদমাইশেরা ওরে নিশ্চয় তাবিজ করছে! এইডা কি তার বিয়ার বয়স হইল যে বিয়া করে। আল্লাহগো আমার ছেলেরে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।
চোখের পানি মুছে বাবার ঝিম ধরে থাকাকে ঠেলে ভাঙেন মা, নাকি গুজব?
বাবা ডানে বামে মাথা নাড়েন।
গুজব নয়। ঘটনা সত্য। মেয়ের নাম গীতা মিত্র। হিন্দু।
চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না। শুয়ে থেকে থেকে সারাদিন কড়িকাঠ গুনি। দাদা ঢাকা চলে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। আমার বড় একা লাগে। দাদা নেই, ছোটদাও যদি আর এ বাড়িতে না থাকেন, বাড়িটি বিষম খাঁ খাঁ করবে। মণি ঝিমোয় বারান্দায়, রোদ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিচে, উঠোনে। রোদের গায়ে কারও পা পড়ে না। রোদে দাঁড় করিয়ে মা তাঁর ছেলেমেয়েদের গা মেজে গোসল করিয়ে সারা গায়ে মেখে দিতেন সর্ষের তেল, মেখে দু’কানের ছিদ্রে দু’ফোঁটা করে তেল আর নাভির ছিদ্রে একফোঁটা। বড় হয়ে যাওয়া ছোটদাকেও তাই করতেন। ছোটদা কপালের ওপর ঢেউ করে চুল আঁচড়াতেন, চোখা জুতো পরতেন, পাশের বাড়ির ডলি পালের দিকে চেয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসতেন আর বাড়ির ভেতর ঢুকেই তিনি মা’র তোতলা শিশু, মুখে লোকমা তুলে খাওয়াতেন তাঁকে মা।
বাবার শিয়রের কাছে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–একটা হিন্দু মেয়েরে, কী কইরা একটা হিন্দু মেয়েরে বিয়া করল কামাল! মেয়েটা কয়দিন আইছে এই বাড়িতে। ওর আচার ব্যবহার আমার ভালা লাগে নাই। আইসা নোমানরে সিনেমায় লইয়া যাইতে চায়। নোমান না যাইতে চাইলে কামালরে সাধে। ছেড়াগোর পিছে পিছে ঘুরার স্বভাব। বড় চতুর মেয়ে, আমার শাদাসিধা ছেলেটারে পটাইছে। কামালের কয়দিন ধইরা দেখতাছিলাম বড় উড়া উড়া মন। ওই মেয়ের পাল্লায় পড়ছে এইটা যদি জানতাম আগে! তাইলে ওরে আমি সাবধান কইরা দিতাম।
খাটের রেলিংএ কুনই রেখে গালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেন–আল্লাহই পারেন ছেলের মন ফিরাইতে। আল্লাগো ছেলেরে আমার ফিরাইয়া আনো। হিন্দু বাড়িত বিয়া হইত ক্যা আমার ছেলের! আমার হীরার টুকরা ছেলের লাইগা কত বড় বড় ঘরের মেয়ের বাপেরা ভিড় করত অইলে! কত জাঁক জমক কইরা বউ ঘরে আনতাম! লেখাপড়া শেষ কইরা চাকরি বাকরি করতে থাকব, তারপরে না বিয়া! মন ঠিকই ফিরব আমার ছেলের, ফিইরা আইব। ভুল ত মাইনষেই করে!
গীতা মিত্র বিদ্যাময়ীতে পড়ত, মুখখানা গোল, তেঁতুলের গুলির মত, মায়া মায়া কালো মুখে হরিণের চোখ। ইস্কুলে নানা পরবে অনুষ্ঠানে নাচত মেয়ে। ছোটদার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আনন্দ মোহন কলেজে পড়তে গিয়ে। আবার তাঁর খোঁড়া মাসির কারণে, খোঁড়া মাসি পড়াত আমাদের, সে সূত্রে এ বাড়িতেও ক’দিন এসেছে সে, এসে আমাদের দু’বোনের সঙ্গে রসিয়ে গল্প করেছে, বলেছে আমাদের সে লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে যাবে, নাচ শেখাবে, গাছ থেকে আতাফল পাড়তে গিয়ে তরতর করে গাছের মগডালে গিয়ে বসেছে, অমন এক দস্যি মেয়ে দেখে আমরা তখন খুশিতে বাঁচি না। বেবি ছিল অন্যরকম, সেলাই জানা রান্না জানা ঘরকুনো মেয়ে। বেবির দাপিয়ে বেড়ানোর স্বভাব ছিল না, গীতার যেমন। দস্যি মেয়েটি খুব অল্পতেই আমাদের হৃদয় দখল করে ফেলে। অবশ্য হৃদয়ের কপাট তখন এমন খোলা যে কেউ পা রাখলেই দখল হয়ে যায়। ঈদের জামা বানাতে শাদা সার্টিনের জামার কাপড় কিনে আনা হল, গীতা বাড়ি এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কাপড়, বলল আমি খুব ভাল শিলাই জানি, আমি শিলাইয়া দিব। ব্যস, বাড়িতে দিনে দু’বার করে আসতে লাগল গজফিতায় গায়ের মাপ নিতে আমাদের। তিন দিনে সেলাই হবে বলেছিল, লাগিয়েছে তের দিন। তাও জামা জোটে ঈদের সকালে। পরতে গিয়ে দেখি বুক এমন আঁটো যে প্রায় ফেটে যায়, ঝুল এত বড় যে মনে হয় পীরবাড়ির আলখাল্লা। এমন অদ্ভুত জামা এর আগে কখনও পরিনি। ঈদটিও গিয়েছিল মাঠে মারা। ঈদের সকালে বাড়ি এসে জামা পরিয়ে দিয়ে সে হাততালি দিয়ে ইঁদুর-দেতো হাসি দিয়ে বলল–ইস কি যে সুন্দর লাগতাছে তুমারে! দারুন! দারুন।
বলল–চল তুমারে দারুন এক জায়গায় নিয়া যাব বেড়াইতে।
দারুন এক জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার তর সয় না। রিক্সা করে গীতার সঙ্গে দিব্যি রওনা হয়ে গেলাম। উঠলাম গিয়ে সাহেব কোয়ার্টারে জজের বাড়িতে। বড়লোকের বাড়ি। রুহি নামের এক মেয়ে গীতার বান্ধবী, তাকে নিয়ে তার বেরোতে হবে কোথাও। রুহি, চ্যাপ্টা দেখতে মেয়ে, বেজায় ফর্সা, তার মা’কে পটাতে লাগল বাইরে বেরোবে বলে। মা’র পটতে যত দেরি হয় গীতা আর রুহি তত ফিসফিস কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আর আমি বসে থাকি খেলনার মত সোফায়। ঘন্টা দুই পর রুহির মা পটল, রুহি মুখে লাল পাউডারের আস্তর মেখে চোখে কাজল ফাজল লাগিয়ে বের হল, তিনজন এক রিক্সায় বসে রওনা হলাম সেই দারুন জায়গায়। আমার তখন দারুন জায়গাটি ঠিক কোথায়, জানা হয়নি। ওরা রিক্সায় বসে খিলখিল হাসে, আর আমি কাঠের ঘোড়ার মত বসে থাকি গীতার কোলে। গুলকিবাড়ির এক বাড়িতে রিক্সা থামে, বাড়ির এক শিয়াল-মুখো লোক আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে দেয়। লোকটিকে আমি কখনও দেখিনি এর আগে। নিঝুম একটি বাড়ি, বড় মাঠঅলা। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি সারা বাড়িতে আর কোনও লোক নেই, শিয়াল-মুখো ছাড়া। দুটো ঘর পাশাপাশি। ভেতরে শোবার ঘরে রুহি ঢুকে যায় লোকটির সঙ্গে। পাশের ঘরের সোফায় খেলনার মত নাকি কাঠের ঘোড়ার মত নাকি জানি না, বসে আমি দেখতে থাকি লোকটি রুহির সঙ্গে ঘন হয়ে বিছানায় বসল। এত ঘন হয়ে যে আমার পলক পড়ে না। শিয়াল-মুখো শুয়ে পড়ল বিছানায় রুহিকে বুকের ওপর টেনে। হঠাৎই এক লাফে রুহিকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে লোকটি আমাদের হাতে ফানটার বোতল ধরিয়ে দিয়ে গীতা যাও, লনে বস গিয়া বলে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
মাঠে গিয়ে আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি–লোকটা কে?
মিটিমিটি হেসে গীতা বলল–খুররম ভাই। অনেক বড়লোক। গাড়ি আছে।
— রুহিরে নিয়া যে লোকটা দরজা বন্ধ কইরা দিল। ঢোঁক গিলে বলি, এহন কি হইব। আমার ডর লাগতাছে। চল যাইগা।
গীতা তার কালো মুখে শাদা হাসি ফুটিয়ে বলে, আরে বস, এহনি যাইয়া কি করবা!
দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল চল যাইগা চল যাইগা করে করে। আমি ছটফট করি, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আমার অস্বস্তিতে। শিয়াল-মুখো ঘন্টায় ঘন্টায় ফানটার বোতল দিয়ে যায় এদিকে। ফানটা খেয়ে তখন আর আমার পোষাচ্ছে না। ক্ষিধেয় চিনচিন করছে পেট। গেটের কাছে গিয়ে কান্না-গলায় বলি–গেট খুইলা দেও। আমি যাইগা। আমার আর ভাল লাগতাছে না।
গীতার মুখও শুকনো হয়ে ছিল। শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল–ও খুররম ভাই। ও থাকতে চাইতাছে না। আমরা না হয় যাই গা।
বেরিয়ে এল শেয়াল-মুখো, পাকানো মোচ পুরু ঠোঁটের ওপর, আঙুলে সিগারেট, খালি গা, খালি পা।
— গীতা, ফটো তুইলা দেও তো কিছু। আসো। বলে লোকটি গীতাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়।
রুহি মাথা নিচু করে বিছানার মধ্যিখানে বসেছিল। বাঁধা ছিল চুল ঘোড়ার লেজের মত, এখন খোলা, এলোমেলো। ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল, নেই। চোখের কাজল ছতড়ে গেছে। বড় মায়া হতে থাকে রুহির জন্য। লোকটি কি ওকে ন্যাংটো করেছিল! ও কি চেয়েছিল ন্যাংটো হতে নাকি চায়নি! লোকটি কি ভয় দেখিয়ে, জোর করে রুহিকে আটকে রেখেছে ঘরে! কিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। গীতার হাতে ক্যামেরা দিয়ে লোকটি রুহিকে দু’হাতে জাপটে ধরল, গীতা মিটিমিটি হেসে টিপ দিল বোতামে। লোকটি শুয়ে পড়ল রুহির কোলে। গীতা টিপল আবার। রুহির গালে গাল লাগাল লোকটি, গীতা টিপল।
আমাদের ছাড়া পেতে পেতে সন্ধে পার হয়ে গিয়েছিল। গীতা প্রথম রুহিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পরে আমাকে দিল, বলল কাউরে কইবা না কই গেছিলা। সারাদিনের নিখোঁজ কন্যার জন্য দুশ্চিন্তায় বাবা মা’র ঈদ মাটি হয়েছে। আমি পাংশু মুখে বাবা মা’র রক্তচোখের সামনে দাঁড়িয়ে পিঠ পেতে বরণ করেছি যা আমার প্রাপ্য ছিল। সেই রহস্যে মোড়া গীতা, যে আমাকে একটি দারুন দিন উপহার দিয়েছিল, সে এখন ছোটদার বউ! শহরের নামকরা গিটার বাজিয়ে ছোটদা, কলেজে তাঁর গিটারের সুরের সঙ্গে ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা নেচেই গীতা মিত্রের মাথা ঠেকানো শুরু হয়েছিল ছোটদার কাঁধে, বুকে। সেই গীতা মিত্র! বেবি বলত, ও একটা জঘন্য মেয়ে। ওর সাথে মিশবা না। গীতাও বলত বেবি খারাপ। দেইখ ও যেন আর তুমাদের বাসায় না আসে।
গলা ফাটে বাবার,–অরে আমি ত্যাজ্যা পুত্র করাম। আমার খাইয়া আমার পইরা আমাকে গলায় ছুরি বসাইল।
ফোঁপানো বন্ধ হয়ে এবার গলা চড়ছে মা’র–
শেষ পর্যন্ত একটা চাড়ালনিরে বিয়া করল!
খড়িউলার ঝিয়েরে বিয়া করল!
ওই হিন্দু খড়িউলা হইব এম বি বি এস ডাক্তারের বেয়াই!
অর মা মাসিরা রাস্তার কলপারো গিয়া গোসল করে। ছুটোলুকের জাত। কাউট্যা খাউরা জাত। মালাউনের জাত।
সমাজে মুখ দেহানো আর গেল না! মান ইজ্জত সব গেছে!
গুষ্ঠির মুহে চুনকালি দিল ছেলে!
একটা নর্তকীরে বিয়া করল, ছি ছি ছি।
এমন ছেলেরে ক্যান আমি জন্ম দিছিলাম!
মা’র বিলাপ ক্লান্তি হীন ঢেউ, সংসার সমুদ্রে। এমন বিপর্যয় এ সংসারে ঘটেনি আর। নানি নানা রুনু খালা হাশেম মামাকে ডেকে পাঠান বাবা। ঢাকা থেকে বড় মামা আসেন, ঝুনু খালা আসেন, দাদা আসেন। সকলে বিষম উদ্বিগ্ন, ঘরে মূল্যবান বৈঠক চলছে, ওতে ছোটদের, আমার আর ইয়াসমিনের উঁকি দেওয়া মানা। মধ্যরাত অবদি কথাবার্তা চলে, স্বর এত নিচে নামিয়ে কথা বলেন ওঁরা যে আমি কান পেতে থেকেও কিছু বুঝে উঠতে পারি না। শিমুল তুলোর মত ওড়ে দু’একটি শব্দ, ঠিক অনুমান করতে পারি না, হাওয়া কোন দিকে বইছে।
বৈঠকের পরদিন এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। ছোটদাকে ধরে এনে বৈঠকঘরে মোটা শেকলে বাঁধেন বাবা আর হাশেম মামা। পায়ে শেকল, হাতে শেকলে, শেকলে তালা। চাবি বাবার বুক পকেটে। বাবার গর্জনে বাড়ি কাঁপে, গাছপালা কাঁপে। জানালার ফাঁকে চোখ রেখে দৃশ্য দেখে গা ঘামতে থাকে আমার। ইয়াসমিন বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ রেখে কাঁদতে থাকে। মা বারান্দায় অস্থির হাঁটেন, বিড় বিড় করতে করতে দ্রুত সরাতে থাকেন তসবিহর গোটা।
— গীতারে ছাড়বি কি না ক! না ছাড়লে তরে আমি ত্যাজ্য পুত্র করাম। থেকে থেকে বাবার গর্জন।
ছোটদা বলেন নিরুত্তাপ কণ্ঠে–ত্যাজ্য পুত্র করেন, আমি গীতারে ছাড়তাম না। বাবার চোখ বেরিয়ে আসতে থাকে কোটর থেকে, শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। কোমরে দু’হাত রেখে হাঁপাতে থাকেন, রক্তচাপ বাড়ছে বাবার।
— তুই বাড়ি থেইকা কুথাও যাইতে পারবি না। কুথাও না। কলেজে পড়বি। পরীক্ষা দিবি।
ছোটদা চড়া গলায় বলেন–আমি এই বাড়িতে আইতে চাই নাই। মিছা কথা কইয়া আমারে আপনেরা নিয়া আইছেন। আমি গীতারে বিয়া করছি। আমারে ছাইড়া দেন। আমি গীতার কাছে যাইয়াম। আপনাগোর কাছে আমি কিচ্ছু চাই না। আমারে ছাইড়া দেন।
— গীতারে ছাড়। নাইলে তর মরন আমার হাতে। আমি তরে চাবকাইয়া একেবারে মাইরা ফালাব। বাবার দু’চোখ থেকে আগুন ঝরে।
ছোটদাকে বাবা দু’ঘন্টা সময় দিয়েছেন ভাবার, ওই দুঘন্টা সময় জুড়ে ছোটদা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থেকেছেন। আর দফায় দফায় গিয়ে নানি, রুনু খালা, মা বলেছেন– বাবারে তুমি ভাল ছেলে। তুমার বাবা যা কয় মাইনা লও। এই বয়সে ছেলেরা অনেক ভুল করে, তুমার বাবা তুমারে মাপ কইরা দিব যদি বাড়িত ফিইরা আইসা লেখাপড়া কর, পরীক্ষা দেও। তুমি ডাক্তারি পইড়া বড় ডাক্তার হইবা। হ বিয়া করছ করছ। মেয়েও তার বাবার বাড়ি ফিইরা যাক। লেখাপড়া শেষ কর দুইজনেই। পরে তুমার বাবা বড় অনুষ্ঠান কইরা মানুষরে জানাইয়া এই মেয়েরেই ঘরে তুলব তুমার বউ কইরা। তুমি ছাত্র মানুষ, এই যে বিয়া কইরা বাড়ি ছাইড়া গেলা গা, খাইবা কি, বউরে খাওয়াইবা কি? যেটুক লেহাপড়া করছ এটুক দিয়া ত কুনো চাকরিই পাওয়া যাইত না। তুমি কি কুলিগিরি করবার চাও? তুমি কি রিক্সা চালাইবা? তুমার বাবা বড় ডাক্তার, শহরে তারে এক নামে সবাই চিনে। বাপের কথা মাইনা লও। ত্যাজ্য পুত্র করলে তুমি বাপের সম্পত্তির কানাকড়িও পাইবা না। বাবা, তুমার ত বুদ্ধি আছে, মেয়েরে গিয়া কও তার বাড়িত ফিইরা যাইতে। তুমার বাপ কথা দিছে বিয়া করার সময় অইলে যারেই তুমি বিয়া করতে চাও, তুমার বাপ তারে দিয়াই বিয়া করাইব।
ছোটদার চোয়াল শক্তই থাকে। তাঁর একটিই কথা, শেকল খুলে দেওয়া হোক। শক্ত চোয়ালকে বাবা পরোয়া করেন না, গরু পিটিয়ে মানুষ করার খ্যাতি আছে তাঁর। জীবন নিয়ে জুয়ো খেলছে ছেলে, এ তিনি বাবা হয়ে সহ্য করতে পারেন না। চোখের সামনে ছেলে তাঁর আগুনে ঝাপ দিচ্ছে, কেন তিনি তা হতে দেবেন! এ তাঁর নিজের ছেলে, এ ছেলের শরীরে তাঁর রক্ত, ছেলের মুখে তাঁর মুখের আদল। ছেলেকে মানুষ করতে তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করেছেন, খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছেন, ছেলে তাঁর বংশের বাতি, ছেলে তাঁর, ছেলেকে তিনি যে করেই হোক ফেরাবেনই। দু’ঘন্টা পর বাবা আসেন বৈঠক ঘরে শক্ত শেকলে বাঁধা চোয়াল শক্ত ছেলের সামনে। হাতে তাঁর চাবুক।
— কি তর সিদ্ধান্ত কি? আমার কথা মত চলবি কি চলবি না। বাবা না নরম না গরম কণ্ঠে বলেন।
ছোটদার চোয়াল আরও শক্ত হয়। বলেন–আমারে ছাইড়া দেন।
— হ তরে ত ছাড়বই। আমার কথা ছাড়া কুথাও এক পাও লড়বি না। গীতার কাছে যাওয়া তর চলবে না।
দাঁতে দাঁত চেপে ছোটদা বলেন–আমার কথা একটাই, এর কুনো নড়চড় নাই। আমি এই বাড়িতে থাকতাম না। আমি গীতার কাছে যাইয়ামই।
— গীতারে খাওয়াইবি কি, নিজে খাইবি কি? চাবুক নাড়তে নাড়তে বলেন বাবা।
— সেইডা কারও চিন্তা করার দরকার নাই। চোয়াল তখনও শক্ত ছোটদার, দাঁতে দাঁত।
ছোটদার জায়গায় আমি হলে, সব শর্ত সম্ভবত মেনে নিতাম। বাঘের থাবায় এসে বাঘের সঙ্গে রাগ দেখানো বোকামো ছাড়া আর কী!
চোয়াল এবার শক্ত হয় বাবার। চোখ হয় করমচার মত লাল।
চাবুক চালান ছোটদার ওপর, ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে এতদিনে আস্ত হরিণ। চাবুক যেন আমার পিঠে পড়ছে। আমারই সারা গা থেকে রক্ত ঝরছে। চামড়া কেটে মাংস বেরিয়ে গেছে পিঠের, মাংস কেটে হাড়। চোখ বুজে থাকি। চোখ বুজে অপেক্ষা করি চাবুক থামার। চাবুক থামে না। বৈঠক ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসেন মা, নানি, বড় মামা, রুনু খালা। কেউ বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে থাকেন জানেন না কিছু দেখছেন কিনা সামনে, কেউ ধীরে হাঁটতে থাকে, জানেন না হাঁটছেন কি না, কেউ নিজের চুল খামচে ধরে থাকেন, জানেন না তাঁর চুলে তিনি হাত দিয়েছেন কি না। একেকজন যেন মৃত মানুষ, কবর থেকে উঠে এসে হাঁটছেন গন্তব্যহীন, তাঁরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না, সামনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, অন্ধকারে শুয়ে আছে অরণ্য আর অরণ্য থেকে একটি কেবল শব্দ আসছে, সে চাবুকের।
মা দৌড়ে যান বৈঠক ঘরে, গিয়ে চাবুকের আর মা মা চিৎকারের তলে যেন না হারায় তাঁর নিজের শব্দ, চিৎকার করে বলেন–ছেলেটা ত মইরা যাইব। মাইরা ফেলতে চাও নাকি! আমার ছেলেরে তুমি মাইরা ফেলতে চাও!
চাবুকে ছোটদাকে রক্তাক্ত করতে করতে বাবা বলেন–এরে আমি মাইরাই ফেলব আজ। এরম ছেলের বাইচা থাইকা কুনো দরকার নাই।
–ছাইড়া দেও যাকগা যেহানে যাইতে চায়। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, এরে মাইরা কুনো লাভ নাই। এর রগ ছুডোবেলা থেইকা ত্যাড়া । আইজকা বাপ মা ভাই বোনের চেয়ে তার কাছে বড় হইয়া গেছে এক মালাউনের ছেড়ি। যাক, ও সেহানেই যাক। ওরে ছাইড়া দেও।
ছোটদাকে ছাড়া হয় না। বন্দি করা হয় ওঁর নিজের ঘরে। ঘরের দরজায় নতুন তালা পড়ে, তালার চাবি বাবার বুক পকেটে। বাড়িতে ঘোষণা করে দেন বাবা, ছোটদাকে কোনওরকম খাবার দেওয়া চলবে না। পায়খানা পেশাব তিনি ওঘরেই করবেন, যতদিনে না তাঁর সুমতি হয়। আটকা পড়ে ছোটদা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন, জানলা ভাঙার। কোনওটিই ভাঙে না। ভাঙবে কেন, লোহা গলিয়ে কাঠ বানানো হয় যদি! দৈর্ঘে নফুট, প্রস্থে পাঁচ।
সারারাত গোঙরান তিনি। অনেকগুলো প্রাণী প্রাচীন কোনও প্রেত পুরীর মত বাড়িটির বালিশে মাথা রেখে গোপনে জেগে থাকে। আমিও জেগে থাকি। অনেক রাতে, সে কত জানি না, ইয়াসমিন ভাঙা গলায় বলে–বুবু, আমার ঘুম আয়ে না। আমি পাশ ফিরে বলি–আমারও না।
দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে ছড়াতে ঘরে কুয়াশা-মত জমে, চোখে ঝাপসা লাগে সব। ঝাপসা হয়ে আসে দরজা জানালা বারান্দার আলো পড়া ঘরের আসবাব, সব। অন্ধকার আমার চুলে এসে বসে, চোখে, চিবুকে।
ছোটদা চারদিন উপোস থাকার পর মা জানালার লোহার শিকের ফাঁক গলে লুকিয়ে খাবার চালান করেন। ছোটদাকে খাইয়ে চারদিন পর নিজে তিনি খাবার মুখে তোলেন। বাবা ঘরে বসে কান পেতে থাকেন বন্ধ ঘর থেকে কোনও সমর্পনের শব্দ আসে কি না, কষ্ট পেতে পেতে, ক্ষিধের বন্দিত্বের। শব্দ আসে না। বাড়ির চুলোয় যেন আগুন ধরানো না হয়, বাবার কড়া হুকুম।
কি করে বাঁচবে তবে বাড়ির বাকি মানুষ!
মুড়ি চিবিয়ে পানি গিলবে, ব্যস।
আর ও ঘরে কেউ কোনও খাবার পাচার চেষ্টা করলে তাঁকেও চাবকানো হবে। তবু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু না কিছু জানলা গলে ও ঘরে যায়ই। আমার স্পষ্ট ধারণা হয় বাবা টের পান যে ছোটদাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে এবং তিনি ঘটনাটি না জানার ভান করছেন। বাবা তাঁর ছুটি আবার বাড়িয়ে বাড়িতে বসে থাকেন আর অপেক্ষা করেন ছোটদার আত্মসমর্পনের। এদিকে শুকিয়ে ছোটদার হাড় বেরিয়ে আসে বুকের, গলার, গালের। আস্ত একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে গোঙরায় জানালার শিক ধরে।
বাঘে বাঘে লড়াই চলছে, আমরা অসহায় দর্শক মাত্র। লড়াই শেষ হয় পনেরোদিন পার হলে ‘পর।
লড়াইয়ে হেরে যান বাবা। ছোটদাকে শেষ অবদি ছেড়ে দিতে হয়।
ছোটদা চলে যাওয়ার পর বাবা আমাদের দু’বোনকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। এত শক্ত করে যে মনে হয় বুকের হাড় সব ঢুকে যাবে মাংসের ভেতর। জড়িয়ে বাবা বলেন, তুমরা আমারে কথা দেও পড়ালেখা কইরা মানুষ হবা তুমরা, কও!
আমরা মাথা নাড়ি হব।
— দুইটা মেয়েই এখন আমার স্বপ্ন। কও, তুমরা কেও তুমরার ভাইয়ের মত হইবা না। কও! বাবা বলেন।
আমরা মাথা নাড়ি হব না।
— ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য আমি সব করছিলাম। আমার কত স্বপ্ন ছিল কামালরে নিয়া। ও কী অসভব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল, মেট্রিকে স্টার পাওয়া ছাত্র। ও আমার কত গর্ব ছিল। আমার সব গর্ব, সব স্বপ্ন এখন শ্যাষ। তুমরা আমার শ্যাষ ভরসা। তুমাদের মুখের দিকে চাইয়া এখন আমার বাঁচতে হইব। কও আমারে বাঁচতে দিবা! লেখাপড়া করবা, কও! বলতে বলতে বাবার গলা বুজে আসে।
আমরা মাথা নেড়ে বলি করব।
— আমি আমার ছেলেরে মারতে চাই নাই। আমার কি কম কষ্ট হইছে ছেলেরে মারতে! না খাওয়াইয়া রাখতে! শেষ চেষ্টা করছি ছেলের মত যেন পাল্টায়। আদর কইরা বুঝাইছি, শুনে নাই। মাইরা কইছি, তাও শুনে নাই। তুমরা শুনবা আমার কথা, কও! আমরা মাথা নেড়ে বলি শুনব।
বাবার চোখের পানি আমাদের জামা ভিজিয়ে ফেলে। বাবাকে এই প্রথম আমরা কাঁদতে দেখি।
কিন্তু আমরা মাথা নেড়ে কথা দিয়ে দিলাম আর বাবাও তা মেনে নিয়ে মনে সুখ পাবেন, বাবা আমার এমন ধাঁচের নয়। তিনি মা’কে বলেন–পরিবেশ নষ্ট হইয়া গেছে বাড়ির। এই এত বড় বাড়ি আমি কিনছিলাম, আমার ছেলেমেয়েদের জন্য,যেন তারা একটা ভাল পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারে। সবার জন্য আলাদা ঘর, ক্যাচর ম্যাচর নাই, গণ্ডগোল নাই। পাড়ার কারও সাথে মিশতে দেই নাই ছেলেমেয়েদের। নিরিবিলি থাইকা যেন লেখাপড়ায় মন দেয়। হইল না। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীরখানা বিছানায় এলিয়ে বলেন–এই বাড়ি দিয়া আমি এখন করব কি! আমি বাড়ি বেইচা দিব। আমার চোখ ফাঁকি দিয়া নুমানে বন্ধু বান্ধব লইয়া আড্ডা দিয়া পরীক্ষায় খারাপ করছে, কামালে চইলা গেল এক ছেড়ির লাইগা নিজের জীবনটা নষ্ট করতে। এই বাড়িতে থাকলে মেয়েদুইটাও মানুষ হইব না।
মা নীরবে দেখেন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাওয়া মানুষের কাতরানো। নামাজ শেষে মা প্রতিদিন প্রার্থনা করেছেন ছেলের মন যেন ফেরে বিধর্মী মেয়ে থেকে। ছেলে যেন তওবা করে নামাজ শুরু করে। ছেলে যেন ঈমান আনে। মা’র প্রার্থনায় কাজ হয়নি। ছোটদা চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফেরেননি।
ছোটদা চলে যাওয়ার দু’দিনের মাথায় বাবা দুটো সুটকেসে বইখাতা কাপড় চোপড় ভরে আমাকে রেখে আসেন মডেল ইস্কুলের ছাত্রীনিবাসে, আর ইয়াসমিনেকে মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসএ। রুখে দাঁড়ানোর সাহস আমাদের কারও ছিল না। কালো ফটকের সামনে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন মা। টোকা দিলে বুড়ো গোলাপের পাপড়ির মত ঝরে পড়ত পাথর, জানি।
তের বছরে তখনও আমি পা দিইনি। মা’কে ছেড়ে কখনও কোথাও থাকার অভ্যেস নেই আমার। মা চুল বেঁধে দেন, মুখে তুলে খাইয়ে দেন, জ্বর হলে মাথার কাছে বসে থেকে রাত জেগে জলপট্টি দেন কপালে, গাছের বড় পেয়ারা, বড় আম, বড় ডাব, বড় আতা, বড় মেয়ের জন্য তোলা থাকে। ফুল তোলা ঘটি হাতা জামা বানিয়ে দেন নিজে হাতে। রাতে ঘুম না আসলে পিঠে তাল দিতে দিতে গান ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নাই পালঙ্ক নাই, রাজুর চোখে বসো। মা আমাকে মাঝে মধ্যে আদর করে রাজু বলে ডাকেন। সেই মা’কে ছেড়ে, নিজের বিছানা বালিশ ছেড়ে, এক্কা দোক্কার উঠোন আর গোল্লাছুটের মাঠ ছেড়ে এক তক্তপোশে আমাকে বসে থাকতে হয়, যেহেতু এখানে আমাকে ফেলে রেখে গেছেন বাবা। ছাত্রীনিবাসের মেয়েরা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলে– তুমি হোস্টেলে এসছো কেন? তোমাদের বাড়ি তো এ শহরেই!
কোনও উত্তর নেই ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকা ছাড়া। যেন চিড়িয়াখানায় আজব এক প্রাণী এসেছে, তার পায়ে শিং, পেটে শিং দেখতে এসে মেয়েরা ঠোঁট চেপে হাসে। আমার কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না আমার ছোটদা, ঈশ্বরগঞ্জে, ইয়াসমিন যে বাড়িতে জন্মেছিল, সে বাড়ির দেয়ালে পিঁপড়ের পেছনে পিঁপড়ে হাঁটত কালো আর লাল, লাল গুলোকে আঙুলে টিপে মারতেন আর বলতেন–লাল পিঁপড়া হিন্দু।
আমি একটি কালো পিঁপড়ে মেরেছিলাম বলে সে কি রাগ ছোটদার! পিঠে দুমাদুম কিলিয়ে বলেছিলেন–কালা পিঁপড়া মারছ ক্যা? কালা পিঁপড়া ত মুসলমান। লালগুলারে বাইছা বাইছা মারবি।
হ্যাঁ সেই ছোটদাই, হিন্দু পিঁপড়ে মারা ছোটদা এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়লেন। লেখাপড়া ছাড়লেন। বাবা মা ভাই বোন ছাড়লেন। ছত্রখান হয়ে গেল সংসার।
দিন সাত পর মা এলেন হোস্টেলে। হোস্টেলের সুপারের কাছে দরখাস্ত করলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। মা’র দরখাস্ত মঞ্জুর হয়নি, যেহেতু আমার অভিভাবক হিসেবে খাতায় নাম আছে কেবল বাবার। মা কাঁদতে কাঁদতে বিদেয় হলেন। ইস্কুলের প্রিন্সিপাল ওবায়দা সাদ থাকেন ওপর তলায়, নিচ তলায় হাতে গোনা কজন মেয়ে নিয়ে নামকাওয়াস্তে ছাত্রীনিবাস সাজানো হয়েছে।
প্রায় বিকেলেই বাবা আসেন আমাকে দেখতে, বিস্কুট, চানাচুর, মালাইকারি, মন্ডা নিয়ে। ওগুলো হাতে দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন–লেখাপড়া কেমন করতাছ মা?
চোখ মাটিতে। মাথা নেড়ে বলি ভাল।
বাবা মোলায়েম স্বরে বলেন–হোস্টেলে ত আরও মেয়েরা থাকে, তোমার বয়সী মেয়েরা, থাকে না?
মাথা নেড়ে বলি থাকে।
— এইখানে থাইকা ক্লাস করবা, আর ছুটির পরে হোস্টেলে ফিইরা গোসল কইরা খাইয়া দাইয়া পড়তে বসবা। আর ত কোনও কাজ নাই। হোস্টেলে তুমারে দিছি তুমার ভালর জন্য। এহন না বুঝলেও তুমি যহন বড় হইবা, বুঝবা। বাবা সবসময় ছেলেমেয়ের ভাল চায় মা। চায় না?
মাথা নেড়ে বলি হ চায়।
চোখ ফেটে জল আসে আমার। চোখের জল আড়াল করতে আকাশের তীব্র লাল আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন বাবা ভাবেন সূর্য্যর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালে জ্বালা করে চোখ জল কিছু আসে, এ কান্না নয়।
বাড়ি ফেরার জন্য কতটা অস্থির হয়ে আছি, বাবাকে বুঝতে দিই না। বাবা ছাড়া আর কোনও অতিথি আসা নিষেধ আমার কাছে। এমনকি মা এলেও মা’র সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ইচ্ছে করে দৌড়ে পালাই। কিন্তু মোচঅলা তাগড়া দারোয়ান বসে থাকে গেটে, গেট পার হয়ে কারও বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই। ডাক্তার রেবেকা চলে গেছেন মেডিকেল কলেজের টিচার্স কোয়ার্টারে, রুনিকেও তাই চলে যেতে হয়েছে। ওকে পেলে হয়ত যন্ত্রণা কিছু উপসম হত। আসলে হত কী! আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
বিকেলে ইস্কুল ছুটির পর খেয়ে ঘুমিয়ে জিরিয়ে কিছু মেয়ে নামে ব্যাডমিন্টন খেলতে, কিছু মেয়ে আড্ডায় বসে মাস্টারদের কার স্বামী আছে কার স্ত্রী, কার তালাক হয়েছে, কে একা থাকে, কার সঙ্গে কার প্রেম চলছে এসব। আমি আধেক বুঝি, আধেক বুঝি না। আমি ঠিক বুঝে পাই না ওরা কি করে মাস্টারদের ঘরের খবর, মনের খবর রাখে। আমি পারি না। ব্যাডমিন্টনের দর্শক আর আড্ডার শ্রোতা হয়ে আমার সময় কাটে। সন্ধেবেলা বই সামনে নিয়ে বসে থাকতে হয়, সুপার ঘুরে ঘুরে দেখেন মেয়েরা পড়ছে কি না। বইয়ের পাতায় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে আমার। অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে, প্রতিরাতে। প্রতিরাতে আমাকে বিছানায় শুতে হয় একা, কোনও ঘুম পাড়ানি মাসি বা পিসি এসে বসে না আমার চেখে।
কী দোষ করেছিলাম, যে আমাকে ঘরবাড়ি ফেলে নির্বাসনে জীবন কাটাতে হচ্ছে! প্রেম করলেন ছোটদা, প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে আমাকে। আমার কোনও দ্বিধা হয় না ভাবতে যে বাবা অন্যায় করছেন।
প্রেম দাদাকেও করতে দেখেছি, নীরবে। অবকাশে আসার তিনদিনের মাথায় পাড়ার অনিতা নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দীঘল ঘন চুলের এক উজ্জ্বল মেয়েকে দেখলেন ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস প্রেমে পড়ে গেলেন। অনিতারা মাস ছয় পর চলে যায় কলকাতা। দাদা চোখের জল ফেলতে ফেলতে কবিতা লেখা ধরলেন। শীলাকে দেখার পর কবিতা লেখায় অবশ্য ভাঁটা পড়ে। ফরহাদ নামে দু’জন বন্ধু ছিল দাদার। একজনকে ডাকা হত মুডা ফরহাদ, আরেকজনকে চিকন ফরহাদ। চিকন ফরহাদের বোনই হচ্ছে শীলা। লম্বা মেয়ে, পানপাতার মত মুখ। দাদা বলতেন শীলা দেখতে অবিকল অলিভিয়ার মত, অলিভিয়া ছিল ফিল্মের নায়িকা। সিনেমা পত্রিকা থেকে অলিভিয়ার ছবি কেটে কেটে দাদা ঘর ভরে ফেললেন। বইয়ের ভেতর, খাতার ভেতর, টেবিলক্লথের নিচে, বালিশের নিচে, তোষকের তলায় কেবল অলিভিয়া। আমি আর ইয়াসমিন কোথাও অলিভিয়ার কোনও ছবি দেখলে এনে দাদার হাতে দিতাম। ওসব ছবির দিকে দাদাকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে, তাকিয়ে থেকে বলতে শীলার থুতনিটা ঠিক এইরকম, নাকটা এক্কেবারে শীলার, চোখ দুইটা ত মনে হয় ওরগুলাই বসাইয়া দিছে। হাসলে শীলারও বাম গালে টোল পড়ে।
পুরোনো খাতা ফেলে নতুন খাতা ভরে দাদা নতুন উদ্যমে কবিতা লিখতে শুরু করেন আবার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রেমের গান শোনেন একা একা। কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়া আর টিফিনের পয়সা জমিয়ে বেহালা কেনেন, যামিনী রায়ের কাছে বেহালা বাজানো শিখে এসে শীলাকে ভেবে বেহালায় করুণ সূর তোলেন। শীলা তখনও প্রেমে পড়েনি দাদার, দাদাই একা। দাদার বেহালা শুনে মন গলবে না শীলার, গলবে কোনও এক দিন, কবিতায়। বলদের ডাগর চোখে চোখ রেখে হরিণী বলবে, কবিতা লেখা শিখলেন কোত্থেইকা? ভালই লেখেন।
বলদ লাজুক হাসবে।
হরিণী বলবে–আপনে আমার দিকে এত তাকায়ে থাকেন কেন।
বলদ লাজুক হাসবে।
হরিণী বলবে–আপনে যে এত ঘন ঘন সামনের রাস্তা দিয়া হাঁটেন, আমার ভাই কিন্তু দেইখা বলে নোমান কাঁচিঝুলিতে এত আসে কেন!
বলদ লাজুক হাসবে।
হরিণী বলবে–আপনে আসেন তাতে কার কী, এই রাস্তা কি ফরহাদের কেনা!
আপনে হাঁটেন, আপনের আরও বন্ধু ত কাঁচিঝুলিতে থাকে, তাদের বাসায় যান।
বলদ লাজুক হাসবে।
হরিণী বলবে–আপনে না আপনের দুই বোনের জামা বানাইতে দিবেন, কই নিয়া আসেন একদিন, আমি জামা ভালই শিলাই করতে জানি।
বলদ মাথা নাড়বে।
হরিণী বলবে–ইস কী গরম পড়ছে, ছাদে গিয়া বসলে একটু বাতাস লাগবে।
আপনেরও নিশ্চয় গরম লাগতাছে?
বলদ মাথা নাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের এম এ ক্লাসের ছাত্র দাদা। তাঁর মন পড়ে থাকবে ময়মনসিংহ শহরের কাঁচিঝুলিতে। আর বিজ্ঞান ঝুলে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের অশ্বত্থ গাছে, বাঁদরের অথবা বাদুরের মত। দাদা ছুটির নামে ঘন ঘন বাড়ি ফিরবেন। বিষন্ন হরিণীর সঙ্গে দেখা হবে কাঁচিঝুলির শিমুলতলায়।
হরিণী বলবে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করতেছে।
বলদ বলবে, কার সাথে?
হরিণী বলবে, যার সাথেই হোক, তুমার সাথে না।
বলদ বলবে,ও।
হরিণী বলবে, বাবার অসুখ, ভাবতেছেন মরে টরে যাবেন, মেয়ের বিয়ে দিলে নিশ্চিন্তে মরবেন।
বলদ বলবে, কী অসুখ?
হরিণী বলবে, যে অসুখই হোক, বিয়ে দিবেন আমার।
বলদ বলবে, ও।
হরিণী বলবে, তুমার বাবা যদি প্রস্তাব নিয়া আসে আমার বাবার কাছে, বাবা মনে হয় না করবেন না।
বলদ বলবে, ও।
হরিণী কাঁদবে।
বলদ বলবে, কাঁদো কেন?
হরিণী বলবে, কাঁদি কেন, তুমি বোঝ না!
বলদ মাথা নাড়বে, সে বোঝে না।
হরিণী বলবে, তুমি না মনোবিজ্ঞান পড়? অথচ মনের কিছুই বোঝ না!
বলদ বিব্রত, অপ্রতিভ।
দাদা বাড়িতে মা’কে প্রথম পাড়বেন কথাটি যে শীলা খুব লক্ষ্মী একটি মেয়ে, ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শিগরি, ওকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাবে, ও চমৎকার রান্না করতে জানে, চমৎকার শেলাই জানে, শীলা তাঁর শ্বশুর শাশুড়িদের খুব যত্ন করবে, ওর ফুটফুটে সব বাচ্চা হবে।
মা বলবেন, তর বন্ধুর একটা বইন সুন্দরী, সংসারি। ভাল খবর। তা আসল কথাটা কি, ক!
আসল কথাটি বলতে দাদা সময় নেবেন। এক কাঠি দু’কাঠি এগোতে এগোতে একদিন বলবেন শীলাকে তিনি বিয়ে করতে চান। বাবার কানে কথাটি মা মিছরির গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে ঢালবেন। মিছরির গুঁড়োর স্বাদও খুব তেতো লাগবে বাবার। এক কাঠি দু’কাঠি পেছোতে পেছোতে বাবা একদিন বলবেন ঠিক আছে মেয়েকে দেখতে চাই আমি।
বলদ বলবে, চল, আমাদের বাড়িতে তোমার দাওয়াত। তোমারে বাবা দেখতে চাইছেন।
হরিণী লাজুক হাসবে।
বলদ বলবে, আমার যে কি খুশি লাগতাছে। তুমি আমার বউ হবা।
হরিণী লাজুক হাসবে।
বলদ বলবে, তুমারে দেখার পর বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়া তুমাদের বাসায় আসবে।
হরিণী লাজুক হাসবে।
বলদ বলবে, তুমি চুড়ি পইও না আবার হাতে, কানের দুলও না। মুখে রঙ লাগাইও না। বাবা পছন্দ করে না। আর, কইবা মেট্রিকে ফাস্ট ডিভিশন পাইছ, স্টার আছে কইবা। থাক ধরা পইরা যাইতে পার, দরকার নাই। আই এ পড়, খুব পড়াশুনা করতাছ যাতে ফাস্ট ডিভিশন পাও আর বিয়ার পরও লেখাপড়া চালাইয়া যাইবা। এইম কি জিগাস করলে বলবা কলেজের টিচার হওয়া।
হরিণী লাজুক হাসবে।
শীলা আসবে বাড়িতে। বৈঠক ঘরে শীলার সামনে বসে থাকবেন বাবা, দাদা বসে থাকবেন নিজের ঘরে, দাদার পা নড়তে থাকবে দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মত, হাঁটুতে হাঁটুতে লেগে ঠক ঠক শব্দ হবে। বৈঠক ঘরে যেতে তাঁর লজ্জা হবে। মা দুধ শেমাই রান্না করে, ট্রেতে চা, বিস্কুট, মিষ্টি, শেমাই সাজিয়ে সোফার সামনের টেবিলে রাখবেন। খেতে খেতে শীলার সঙ্গে গল্প করবেন বাবা। বাবার ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দেবে।
শীলার যাওয়ার সময় হলে নিজে তিনি রিক্সা ডেকে ওকে তুলে দেবেন। কালো ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে হাত নাড়বেন হেসে।
নতুন শাড়ি পরা মা, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা মা, খুশির দোলনায় দোলা মা দৌড়ে যাবেন বাবার সামনে। বলবেন, দেখতে মধুবালার মত।
বাবা বলবেন, ঠিকই।
মা বলবেন, মেয়েটা খুব লক্ষ্মী।
বাবা বলবেন, তা ঠিক।
মা বলবেন, ছেলের বিয়ার বয়স হইছে। তাড়াতাড়িই বিয়াটা হইয়া যাওয়া ভাল।
শার্ট পরা, প্যান্ট পরা, টাই পরা, জুতো পরা, চশমা চোখের, কোঁকড়া চুলের বাবা বলবেন, এই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়া দিব না।
হাকিম নড়বে তো হুকুম নড়বে না।
দু’মাস পর তেইশ বছরের ফারাক নিয়ে এক ভুঁড়িঅলা, মোচঅলা, পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি লোকের সঙ্গে শীলার বিয়ে হয়ে যাবে।
হরিণী আটকা পড়বে খাঁচায়।
ঝুনু খালা কেঁদেছিলেন দাদার মত নিরালায় বসে নিঃশব্দে নয়। পাড়া কাঁপিয়ে। নাওয়া খাওয়া ছেড়েছিলেন। বাড়ির কাচের বাসন কোসন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভেঙেছিলেন। গলার ওড়না পেচিয়ে কড়িকাঠে ফাঁসি নিতে গিয়েও নেওয়া হয়নি, আগেই দরজা ভেঙে হাশেম মামা ঢুকে নামিয়ে আনেন। ঝুনু খালাকে কবিরাজ দেখানো হয়, মাথায় মাথা ঠান্ডা হওয়ার তেল মাখা হয়, মৌলবি ডেকে এনে ফুঁ দেওয়ানো হয় মুখে।
ঝুনু খালা তবু সারেননি, শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বড় মামার বাড়িতে, ঢাকায়।
রুনু ঝুনু পিঠাপিঠি বোন, দু’বোনের সখ্য পাড়ার লোকও জানে। চানাচুর অলাও বাড়ির সামনে গান ধরে ও আমার রুনু ভাই, ঝুনু ভাই কই গেলারে, গরম চানাচুর যায় খাইবা নাকি রে। হেই চানাচুর গরম। রুনু ঝুনু কাঁদেন একসঙ্গে, হাসেন একসঙ্গে। গান, নাচেন, বরই কুড়োন, শিউলি ফুল তোলেন, মালা গাঁথেন, সব এক সঙ্গে। ঝুনু তাঁর পেটের খবর রুনুকে বলেন, রুনু তাঁর পেটের খবর ঝুনুকে। দু’বোন পাশাপাশি শোন এক বিছানায়। লোকে বলে আহা যেন যমজ বইন। সেই রুনু হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে হাওয়া। হাওয়া তো হাওয়াই। নেই নেই, শহর জুড়ে নেই। খবর পাওয়া গেল, বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বিয়ে করেছেন রাসুকে, আছেন এখন রাসুর গ্রামের বাড়িতে, বেগুন বাড়ি। শুনে ঝুনু পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদেন। উঠোনের ধুলোয় গড়িয়ে কাঁদেন, বুক থাপড়ে কাঁদেন। কেন কাঁদেন! রাসু ছিলেন ঝুনুর গৃহশিক্ষক। রাসু রুনুর কেউ ছিলেন না। রাসুর সামনে বসে রাসুর চোখের ভাষা পড়েননি রুনু, বুকের ধুকপুক শব্দ শোনেনি। এক ঝুনু জানেন কি করে টেবিলের তলে ঝুনুর পায়ের ওপর এগিয়ে আসতো রাসুর পায়ের আঙুল। কি করে ঝুনুর আঙুল নিয়ে খেলত গোপন এক হাত। ঝুনু জানেন শিউলি ফুলের মালা তিনি কার জন্য গাঁথতেন। কার জন্য তিনি বিকেল হতেই আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেন বারবার। চোখে কাজল পরতেন কার জন্য! সকলে জানত, ঝুনুকে পড়াতে মাস্টার আসেন, কেউ জানে না কয় ভাগ পড়া আর কয় ভাগ অপড়ায় সময় কাটে ছাত্রী আর শিক্ষকের। ছাত্রী পড়ানোর সময় কারও ঘরে ঢোকা মানা, কারও গণ্ডগোল করা মানা, শিক্ষকের জন্য এক ফাঁকে চা বিস্কুট দিয়ে যেতেন রুনু, ওটুকুই ছিল কেবল পড়া বা অপড়ার মধ্যে সামান্য বিশৃঙ্খলা।
সেই ঝুনুর সঙ্গে যদি রাসুর বিয়ে না হয়ে রুনুর হয়, তবে অপমানে লজ্জায় ঝুনু মরতে চাইবেন না কেন!
পুরুষ হচ্ছে জানোয়ারের জাত, ঝুনু খালার ধারণা তাই।
পুরুষের কথায় মজছ কি মরছ, ঝুনু খালা ঘাটে বসে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বলছিলেন, মৌলবির ফুঁ এর দু’দিন পর।
শুয়োরের চেয়ে অধম এরা। এরা যারে পায় তারে চাখে। এগোর কুনো নীতি নাই।
তুমারে আইজ কইল ভালবাসে, পরদিন আরেকজনরে একই কথা কইব।
ঝুনু খালার পিঠ পেরিয়ে পাছায় নামা ঘন চুল, সে চুলে জট, কালি পড়া কাজল না পরা চোখ,.গায়ের কাঁচা হলুদ রঙ দেখায় মরা ঘাসের মত।
নানির চার মেয়ের মধ্যে ফজলি খালা একশতে আশি, ঝুনু খালা একশতে পঞ্চাশ, রুনু খালা তিরিশ, আর মা .. . .
দাদা ইস্কুলের মাস্টারের মত রূপের নম্বর এভাবে দিতেন, — আর মা কত?
দাদা চেয়ারে বসে দু’পা নেড়ে নেড়ে, দাঁতে পেনসিল কামড়ে বলতেন, মা হইল রসগোল্লা।
— বুঝলা গেঁতুর মা, তুমিও যেরম আমিও তেমন। তুমারে এক লোকে কষ্ট দিছে, আমারেও দিছে। উপরে যদি আল্লাহ থাকে, আল্লাহ এইটা সইব না। ওগোর বিচার আল্লাহই করব। ঝুনুখালা, পঞ্চাশ পাওয়া রূপসী, নতুন সন্যাসিনী বলেন।
— গেতুঁর মার সাথে এত কি ফুসুর ফুসুর আলাপ ঝুনুর! জানালায় দাঁড়িয়ে দুজনের ঘনিষ্ঠ বসে থাকা দেখে নানি অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন,–ঝুনু ত আবার পেডো কথা রাখতে পারে না, কী না কী কয় আবার!
গেঁতুর মা’র বুক কেঁপে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়–আল্লাহ আসলে বিচার করে না। আল্লাহ বড় একচোখ্যাপনা করে। গেতুঁর বাপ আমারে মাইরা পুড়াইয়া খেদাইয়া, বিয়া করছে আরেকটা। হে ত সুহেই আছে। সুহে নাই আমি, বাপ নাই যে বাপের কাছে যাই, ভাই আছে দুইডা, ভাইয়েরা আমারে উঠতে বইতে গাইল্লায়, কয় আমারই দুষে আমারে খেদাইছে গেঁতুর বাপ।
গেঁতুর মা’র পোড়া হাত ভেসে থাকে ঝুনুখালা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বলেন–এই দুনিয়ায় আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আবার ভাবি আমি মরতাম ক্যান একলা, ওই দুইটারে মাইরা নিজে মরবাম। আমি সুখে নাই, তরা সুখে থাকবি ক্যান!
এঁদো গলি থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে এসে অন্ধকার ঢুকে পড়ে নানির বাড়ির উঠোনে। পুকুরের জলে আধখানা চাঁদ কচুরিপানার কম্বল মুড়ে ঘুমোয়। গেঁতুর মা’র পোড়া হাতখানা ঘুমোয় ছেঁড়া আঁচলের তলে। ঝুনু খালার ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। ইচ্ছে করে পুকুর ঘাটে, বাঁকা খেজুর গাছের এই তলায় তিনি বসে থাকবেন সারারাত আর টুপ টুপ করে তাঁর জটা চুলে শিশির পড়বে। শিশির ভেজা ঘাস থেকে তিনি আর আঁচল ভরে ভোরবেলা শিউলি কুড়োবেন না। আর কারও জন্য মালা গাঁথার তাঁর দরকার নেই। আর কারও জন্য বিকেলে লাল ফিতেয় কলাবেণি করে চোখে কাজল পরে অপেক্ষা করার দরকার নেই।
ঝুনু খালার বড় খালি খালি লাগে। তিনি এক দৌড়ে ঘর থেকে এক ঝুড়ি কাগজ নিয়ে আসেন, রাসুর লেখা চিঠি, নেপথলিনের গন্ধ অলা চিঠি, টিনের ট্রাংকে কাপড় চোপড়ের ভেতর চিঠিগুলো রেখে ছিলেন তিনি, সযতনে। আধখানা চাঁদ যখন ঘুমোচ্ছে আর খেঁজুর গাছে বাদুরের মত ঝুলছে অন্ধকার, ঝুনু খালা আগুন ধরান চিঠিগুলোয়।
— চল গেঁতুর মা, আগুন তাপাই। শীত পড়তাছে।
আগুনে পোড়া চিঠির ছাই উড়ে এসে ঝুনুখালার জটা চুলে পড়ে।
গেঁতুর মার মুখখানা লাল হতে থাকে আগুনে, আগুন দেখলে তার ইচ্ছে করে ভাত ফুটোতে, হাঁড়ির কাছে মুখ নিয়ে বলক পাড়া ভাতের গন্ধ শুঁকতে ইচ্ছে করে খুব। গেঁতুর মার মাথার ওপর অন্ধকারের বাদুরখানা ঝপ করে পড়ে।
— এক বাত কাপড়ের লাইগা, গেঁতুর মা বলে, বেডাইনের লাত্থি গুতা খাইয়া পইড়া থাহি। আমগো পেডো ক্ষিদা, পেডো ক্ষিদা থাকলে মন পক্কীর লাহান উইড়া যায়। মন দেওয়া নেওয়া করি নাই কুনোদিন। হেইতা বড়লুকেরেই মানায়। মন নাই, আমগোর খালি জ্বলাউরা পেট আছে। যে ভাত দেয়, হেরেই ভাতার কই।
ঝুনুখালার ভাল লাগে না গেঁতুর মা’র ক্ষিধের গপ্প শুনতে। তাঁর কদিন ধরে ক্ষিদেই পায় না। মুখে ভাতের লোকমা তুললেই বমি-মত লাগে। বুকের মধ্যে মনে হয় বিরান এক চর পড়েছে। রাসুর সঙ্গে গাছের তলায়ও তিনি জীবন কাটাতে পারতেন, রাসুর চোখের দিকে তাকালে ঝুনুখালা ক্ষিধে তৃষ্ণা সব ভুলে যেতেন, রাসুর সঙ্গে জলে ডুবে মরলেও তাঁর সুখ হত।
শেষ চিঠিটি, আধেক পুড়ে আগুন নিবে যায়। ঝুনু খালা আধপোড়া চিঠি হাতে নিয়ে বসে থাকেন অন্ধকারে। তাঁর খুব পড়তে ইচ্ছে করে চিঠিটি। এটি সম্ভবত সেই চিঠি, তিনি ভাবেন, যে চিঠিতে রাসু লিখেছিরেন ঝুনুখালাকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। ঢাকা চলে যাওয়ার আগে আগে ঝুনু খালা, আমি আর ঝুনুখালাই কেবল জানি, জুবলিঘাটের হলুদ একটি দোতলা বাড়ির সামনে, বাড়ির গায়ে ডাক বাংলো লেখা, রিক্সা থেকে নেমেছিলেন, পেছন পেছন আমি। ডাক বাংলোর বারো নম্বর ঘরে যখন টোকা দিচ্ছিলেন, ঝুনুখালার নাকের ডগায় দেখেছিলাম ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক টিংটিঙে, চিবুক অবদি লম্বা মোচঅলা, দেখতে গেছো ভূত এর মত, নানির বাড়ির দু’বাড়ি পেছনের বাড়ির লোক, দু’একদিন দেখেছি, জাফর ইকবাল নাম। ঝুনুখালাকে ঘরটিতে ঢুকিয়ে দুয়োর এঁটেছিল সে লোক, আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়, ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে, আমার বিকেল পার হয় ব্রহ্মপুত্রের ঢেউ ভাঙা ঝিলমিল জল দেখতে দেখতে আর সে জলের ওপর দেখতে দেখতে ভাটিয়ালি গান গেয়ে গেয়ে মাঝিদের নৌকো বাওয়া। পশ্চিমের আকাশ লাল করে ডিমের কুসুমের মত সূর্য যখন ডুবছিল ব্রহ্মপুত্রের জলে, আমি সম্মোহিতের মত, ওখানেই, যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলেন ঝুনুখালা, ছিলাম।
সূর্য ডুবল আর ঝুনু খালা দুয়োর আঁটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার গালে হাতের তেলোয় আদর করে বললেন–শোন, কেউ যদি জিগায় কই গেছিলি, বলবি ঝুনুখালার এক বান্ধবীর বাসায়।
বাংলো থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠতে উঠতে ঝুনু খালা আবার বলেন–যদি জিগায় কী নাম সেই বান্ধবীটার, বাড়ি কোন জায়গায়?
ঝুনুখালার মুখের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করি। তিনি বলেন–কইবি ফাতেমা, থাকে হইতাছে কালিবাড়ি। না না কালিবাড়ি না, কইবি ব্রাহ্মপল্লী। ঠিক আছে?
ঠিক আছে কি ঠিক নেই কিছুই ঝুনুখালাকে আমি বলি না। সম্ভবত তিনি বুঝে নেন, তিনি বলুন আর না বলুন আমার মুখের কপাট সহজে যেহেতু খোলে না, খুলবে না।