জীবনে এই প্রথম পার্টিতে আসা। ক্লাবের গেটে দরোয়ান প্রথমেই তাকে বাধা দেবে কি না ভাবছিল। নিমন্ত্রিতদের হলে, সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তাতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও সে সকলের দিকেই তাকিয়ে, অমায়িক ভাবে হাসতে লাগল। মহিলারা তাকে দেখে কানাকানি করছিল। হাসাহাসি করছিল। সকলেই তার অচেনা। বীরেন্দ্রনারায়ণ এসে তাকে দেখেই রেগে বারুদ। কিন্তু কিছু করবার ছিল না। শিবেনকে বললেন, এ অবস্থায় একে না আনাই উচিত ছিল, তাতে ওর আসার যতই ইচ্ছে থাকুক। তবু তিনি কারুর কারুর সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। ওর বাবার নাম, অতীন্দ্রনাথ মিত্রের নামটা অনেকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। কুবের সিং, অরূপ দত্তদের সঙ্গে আলাপ হল, এবং আলাপ হওয়ামাত্রই সুজিত বলল, আপনাদের নাম শুনেছি। তারা অবাক হয়ে যখন জানতে চাইল, কোথায় শুনেছে, তখন সে বলল, সুনীতার বন্ধু তো আপনারা, সেই সূত্রেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তারা হাসিতে ফেটে পড়ল। তাকে নানান রকমের প্রশ্ন করে, সুজিতের জবাব ও তার ভাব-ভঙ্গি দেখে, একটা রীতিমতো হই-হুঁল্লোড় লাগিয়ে দিল। বেয়ারা ঘুরছিল ট্রেতে করে ককটেলের পাত্র নিয়ে। সুজিত দেখল, সবাই একটি একটি করে গ্লাস নিয়েছে। সে জানতে চাইল, এটা মদ কি না। তাই নিয়ে আবার হাসির ফোয়ারা ছুটল। এবং তাকে পান করবার জন্যে অনেকেই উৎসাহিত করতে লাগল। সে বলল, মদ সে কখনও খায়নি, এবং দীপু তাকে বারণ করেছে। আবার হাসির রোল পড়ল।
ঠিক এসময়েই, সমস্ত হলটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, সবাই প্রবেশদরজার দিকে ফিরে তাকাল। সুজিত দেখল, সুনীতা ঢুকছে, তার সঙ্গে দু-একটি মেয়ে। অদ্ভুত তাদের সাজ-সজ্জা। বিচিত্র তাদের চুল বিন্যাসের ভঙ্গি। অধিকাংশ উপস্থিত মহিলাদের পোশাক-আশাক অদ্ভুত দেখতে হয়েছিল। তবে রূপের মধ্যে সুনীতাই যেন সুন্দরীশ্রেষ্ঠা। একজন স্কুল টাকমাথা লোক সুনীতাকে অভ্যর্থনা করল। কুবের সিং, অরূপ দত্ত আর শিবেন, সবাই সুনীতার কাছাকাছি চলে গেল। এতক্ষণ সুজিতকে নিয়ে যারা মজা করছিল, সুজিত তাদের কাউকেই আর তার পাশে দেখতে পেল না। এবং একটা আশ্চর্য ব্যাপার সে লক্ষ করল, মহিলারা কেউ গিয়ে সুনীতাকে অভ্যর্থনা করল না, অথচ অন্যান্য মহিলাদের, মহিলারা সকলেই অভ্যর্থনা করে, কাছে ডেকে কথাবার্তা বলেছিলেন। এখন অধিকাংশ মহিলারই ঠোঁট বেঁকে গেল, কপালে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল, কেউ কেউ বিদ্রূপ করে জোরে হেসে উঠলেন। অনেক ভদ্রলোককেও দেখা গেল, তাঁরা সুনীতার ত্রিসীমানা থেকে সরে গেলেন। দু-একজন সুজিতের আশেপাশেই গুনগুন করে বলতে লাগল, সুনীতা নাগ নয়, নাগিনী। কেউ বলল, নাগরী। কেউ ভলাপচুয়াস। কথাটার মানে মোটামুটি জানা ছিল সুজিতের, স্বেচ্ছাচারিণী। আরও এমন সব আলোচনা করতে লাগল, সুজিতের শুনতে কষ্ট হচ্ছিল। সুনীতার জন্যে মনটা তার বিষণ্ণ হয়ে উঠল, করুণ হয়ে উঠল, এবং শেষপর্যন্ত পাশ থেকে একজন রুচিহীন ইঙ্গিত করায় সে হেসে বলল, না, আপনি যা বলছেন, ও তা নয়। ও প্রিয়নাথ দাশকে ব্ল্যাকমেল করছে না, প্রিয়নাথ দাশই বরং ওকে একদিক থেকে ব্ল্যাকমেল করেছে।
এ নিয়ে দু-একটা কথাকাটাকাটি হতেই, ব্যাপারটা হাসিতে পর্যবসিত হল। সুজিত সহসা চোখ তুলে দেখল, সুনীতা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হতেই, সুনীতা কাছে এল, এবং সুজিতকে আপাদমস্তক দেখে বলে উঠল, একী, এ সব কী পরে এসেছ তুমি?
সুজিত বলল, শিবেনবাবুরটা পরে এসেছি।
সুনীতা হাসি সামলাতে পারল না। তার সঙ্গে বাকিরাও হেসে উঠল। শিবেন বলে উঠল সুনীতাকে, এ হাসির আনন্দটুকুর জন্যে ধন্যবাদ কিন্তু আমারই প্রাপ্য সুনীতা।
সুনীতা বলল, তাই নাকি? তার ঠোঁট বেঁকে উঠল। সে সুজিতকে বলল, তোমার যা পোশাক ছিল, তাই পরে এলে না কেন?
সুজিত বলল, সেগুলো সব ময়লা। কিন্তু আমার কিছু মনে হচ্ছে না।
আবার সবাই হেসে উঠল। সুনীতা হাসল না। সে সুজিতের চোখের দিকে তাকাল। তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্বোধন ও কথাবার্তায় অনেকেই অবাক হয়েছিল। শিবেন যতই হাসুক, তার চোখে বিক্ষোভ ও ঈর্ষার রক্তাভা। কুবের সিং, অরূপ দত্ত এবং আরও অনেকেরই সেই অবস্থা। বিস্ময় এবং ঈর্ষা তাদের চোখে। কে একজন বলে উঠল, উদ্ধবটি কে? সুনীতা নাগের নিউ পিকআপ নাকি?
সুনীতার মুখ লাল হল, সাপিনীর মতো ফণা তুলে সে ঘাড় ফেরাল। আরও কয়েকজন তার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকাল। সুনীতা বলে উঠল, ঠিক তাই, ও আমার লাস্ট পিকআপ, কারণ ও জানোয়ার নয়, মানুষ।
একটা অস্বস্তিদায়ক স্তব্ধতা নেমে এল এই গুচ্ছটিকে ঘিরে। বীরেন্দ্র এসে কথাবার্তা বলে আবহাওয়াটা সহজ করে দিলেন, ইতিমধ্যে বেয়ারা কটেলের ট্রে নিয়ে সুনীতার সামনে এগিয়ে এল। সুনীতা চকিতে এক বার সুজিতের দিকে তাকাল। তারপর হাত নেড়ে দিল প্রত্যাখ্যান করে।…হঠাৎ এক সময়ে সুজিত আবিষ্কার করল, তার পাশেই রঞ্জনও রয়েছে। রঞ্জনের সেই ভাবলেশহীন কঠিন মুখ, কিন্তু তার দু চোখ ভরা বিস্ময়। এক হাতে মদের পাত্র। সুজিত খুশি হয়ে তার একটি হাত ধরে বলল, তুমি কখন এলে?
রঞ্জন বলল, অনেকক্ষণ।
বলেও সে সহসা চোখ নামাল না। এবং সুজিতের হাত ধরার মধ্যে তার কোনও আবেগ প্রকাশ পেল না। নিচু গম্ভীর স্বরে সে বলল, তোমার সঙ্গে সুনীতার এত ভাব, তা তো তুমি বলনি!
সুজিত হেসে বলল, হ্যাঁ, তারপরে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে, আমার খুবই ভাব হয়ে গেছে।
রঞ্জন বিস্মিত তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সুজিতের দিকে। বলল, ভাব হয়ে গেছে?
সুজিত,অম্লান হেসে বলল, হ্যাঁ, আমরা বোধ হয় পরস্পরকে বুঝি।
কী বোঝ?
–ও একটি দুঃখী মেয়ে, একটু শান্তি আর ভালবাসার প্রয়োজন ওর।
–আর তাই কি তুমি ওকে দিতে চাও?
–আমি ওকে তা দিতে পারব কি না বুঝি না, ও নিতে চায় কি না, তাও জানি না। আমি দেখলাম, ও খুব অসম্মানিতা। ওকে সবাই ঘৃণা করে। আমার কষ্ট হচ্ছে ওকে দেখে।
রঞ্জন বলল, কিন্তু ওকে আমি এ সব কিছু থেকেই সরিয়ে নিয়ে যাব।
দৃঢ়তার সঙ্গে এই কথা বলেই, হঠাৎ রঞ্জন ক্ষিপ্ত বাইসনের মতো অন্যদিকে মুখ ফেরাল, এবং শিবেনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমি শুনেছি তোমার কথা। তুমি আমাকে হুডলাম বলো আর ব্রুট বলো, সুনীতার ওপর থেকে তোমার হাত সরিয়ে নিতে হবে।
আবার একটা স্তব্ধতা নেমে এল, এবং সকলেই এইদিকে ফিরে তাকাল। সুজিত দেখল, সুনীতাও। বিস্ময়ে এবং অপমানে লাল হয়ে উঠেছে। শিবেন বলে উঠল, যুগটা সভ্য, আর এখানে কেউ ডুয়েল লড়তে আসেনি।
রঞ্জন বলে উঠল, ডুয়েল নিশ্চয়ই, অন্য কায়দায়, এই যা। কিন্তু তুমি যে তখন থেকে আমার সম্পর্কে যা তা বলে যাচ্ছ, আমি সবই শুনেছি।
শিবেন বলে উঠল, সেদিন তুমি অত্যন্ত জঘন্যভাবে আমাদের বাড়ি গেছলে, আমি সেই কথাই বলেছি।
–কিন্তু কেন গেছলাম, সে কথা বলিনি। এক লক্ষ টাকা পাবার জন্যেই তো তোমার যত লোভ, সেটা সবাইকে জানিয়ে দাও।
সুনীতা বসে ছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়াল! বলে উঠল, এ সবের মানে কী?
শিবেন ক্রুদ্ধ ঘৃণায় বলে উঠল, আমি টাকার লোভ করছি, তাতে তোমার কী?
–তাতে সুনীতার ক্ষতি, এবং আমারও ক্ষতি।
সুনীতা তাকিয়ে ছিল সুজিতের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে হেসে উঠল। সে হাসি, মূৰ্হাগ্রস্তের মতো অস্বাভাবিক উন্মত্ত হাসি। সুজিতকে বলল, তুমি যেন কী বলছিলে সেদিন সব ভাল ভাল কথা? এখানে দেখ, কী রকম বেচা-কেনা হচ্ছে।
বীরেন্দ্র রঞ্জনকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ও যদি এক লক্ষ টাকা পায়, সেটা ক্ষতি কী? টাকার কি মূল্য কম?
রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, কিছুমাত্র না। একমাত্র প্রিয়নাথ দাশের টাকা বলেই ক্ষতি, কারণ এ বিয়েটাও একটা ব্যভিচার।
সুনীতা বলে উঠল, বাঃ বাঃ, কিন্তু আমি দেখতে চাই ডুয়েল ওরা দুজনেই লডুক।
সবাই থমকে গেল। রঞ্জন তাকাল তীক্ষ্ণ চোখে। শিবেন রাগের মধ্যেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রঞ্জন হঠাৎ হেসে উঠল, বলল, ডুয়েল লড়ব, কিন্তু টাকা দিয়ে। কত টাকা চাই তোমার শিবেন বলো? এক লক্ষের জায়গায় দেড় লাখ? দু লাখ? তিন লাখ?
শিবেনের মুখ ক্রমে সাদা হয়ে উঠতে লাগল। রঞ্জন বলল, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। তুমি যাদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা নিয়ে এই বিয়ে করতে যাচ্ছ, আমি তোমাকে সেখানে তিন লাখ টাকা দেব। ভিক্ষে করে, লুঠ করে, যেখান থেকে পারি, ক্যাশ তিন লাখ টাকা। চেক নয়, দলিল নয়, করকরে নোট, তিন লক্ষ; রাজি? বলো, রাজি আছ?
সুনীতা বলে উঠল, ভিক্ষে করে আনবে তুমি, লুঠ করে আনবে তিন লাখ টাকা! আমি রাজি আছি, আটাশে মার্চে তুমি টাকা নিয়ে এসো আমার বাড়িতে। না আনতে পারলে আমি শিবেনকেই বিয়ে করব।
বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, দ্যাটস্ রিয়্যাল স্পোর্টস।
চারদিক থেকেই হাততালি পড়ল। আর সুনীতার সেই ভয়ংকর হাসি হলের মধ্যে বাজছে। বাজনার শব্দ ছাপিয়ে তা শোনা যাচ্ছে। হাসতে হাসতে সুনীতা আবার চিৎকার করে উঠল, এই নিলামে যদি কেউ চার লাখ দিতে পারে তবে আমি তার। কে কিনবে আমাকে?…
কথা শেষ হবার আগেই সুজিতের দিকে তার চোখ পড়ল। সুনীতার হাসিটা সহসা যেন একটু থমকে গেল। আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিল, সুজিতের অপলক চোখের দিকে তাকিয়ে, আবার থমকে গেল সে। সুজিত বলে উঠল, বাড়ি যাও সুনীতা।
সুনীতা সহসা মাথা নামাল, এবং ক্লান্তভাবে ওর সঙ্গের সেই দুটি মেয়ের একজনের কাঁধে হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আশেপাশের সবাই সুজিতের দিকে ফিরে তাকাল। শিবেন, রঞ্জনদের চোখে বিস্ময়ের অবধি নেই। সুজিত করুণভাবে হাসল সকলের দিকে তাকিয়ে। কে একজন বলে উঠল, কিছুই বোঝা গেল না। আর একজন বলল, ভভাজবাজি। বীরেন্দ্রনারায়ণ সুজিতকে একপাশে ডেকে বললেন, ব্যাপারটা কী বলো তো? ও তোমার কথা অমন করে শুনল কেন?
–ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল, আপনারা বুঝতে পারছিলেন না বোধ হয়, তাই ওকে আমি বাড়ি চলে যেতে বললাম।
–তুমি বললে, আর তাতেই চলে গেল?
–তাই তো দেখছি।
–কিন্তু কেন? তুমি–মানে–তোমার ব্যাপারটা কী?
–আজ্ঞে, তা কী জানি।
বীরেন্দ্রনারায়ণ ভ্রুকুটি বিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন, তুমি একটা, কী বলব, ইমপসিবল, ইম্পসিবল!
.
আটাশে মার্চ, বিকেল। সন্ধ্যা যতই আসন্ন হয়ে আসছে ততই সুজিতের বুকের ভিতরটা কী রকম করছে। এই কদিন সুনীতার কোনও খবর সে পায়নি। দীপু বার বার গিয়েছে, ফিরে এসে জানিয়েছে, সুনীতাদি বাড়ি নেই। দীপুর বিশ্বাস, সুনীতাদি বাড়িতেই আছে, দেখা করছে না, বোধ হয় খালি মদ খেয়ে পড়ে থাকছে। এই প্রথম সুজিতের মনে হচ্ছে, জীবনটা তার ঠিক পথে যাচ্ছে না। সম্ভবত সত্যি, সে ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছয়নি। জীবন নিয়ে, স্নেহ ও প্রেমের অধিকার নিয়ে, এই আশ্চর্য বীভৎসতা সে চিন্তা করতে পারে না। ডক্টর ঘোষের কথা বারবার মনে হয়, মানুষ ঈশ্বর আর ভালবাসা, এই দুই বিষয়েই অত্যন্ত অনবহিত। সুনীতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে সৎ বলিষ্ঠ জীবনযাপনের চিন্তা করবার সাহসও লয় পেয়েছে। প্রিয়নাথের অপমানের শোধ তুলতে গিয়ে, নিজেকে সে এমন জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে, সেই নরকের বাইরে আসার পথ সে আজ আর খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ বাইরে আসারই আকুতি ওর চোখে।
দীপুর সঙ্গে তার যাবার কথা সুনীতার বাড়িতে। ইতিমধ্যে দোলা তাকে টেলিফোন করেনি, বীরেন্দ্রনারায়ণও তাকে যাবার কথা বলেননি। উনি একদিন এসেছিলেন শিবেনের সঙ্গে। তাদের কথাবার্তা থেকে এইটুকু সংবাদ পেয়েছে, রঞ্জন তার অসুস্থ বাবার কাছে টাকা দাবি করেছিল, ওর বাবা দেননি শুধু নয়, বাড়িতে নাকি পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছেন। যদিও রঞ্জন ওর বাবার একমাত্র ছেলে। ওর বাবার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখন রঞ্জন নাকি হুণ্ডি কাটার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই ওর নিজের গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। কসবা না কোথায় একটা বাড়ি তার মাতামহের সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছিল, সেটাও বিক্রি করে দিয়েছে। বাকি টাকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কারণ এক লক্ষ টাকাও সংগ্রহ করতে পারেনি। এ সব কথা বীরেন্দ্র খুব উত্তেজিত উল্লাসেই বলেছেন। শিবেনের চোখ দুটিও জ্বলজ্বল করে উঠেছে।
ভুজঙ্গভূষণও সংবাদটা জানেন। তিনি এই নিয়ে সুজিতের সঙ্গে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছেন। সুজিতকে বলেছেন, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, লড়াইটা জমেছে ভাল। আচ্ছা ধরা যাক, বাঘ যদি রঞ্জন হয়, কুমিরটি তবে কে, তুমি বলতে পার?
সুজিত বলেছে, হ্যাঁ, শিবেনবাবু।
তুমি একটি উন্মুক।
আজ্ঞে?
–গর্দভ তুমি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। তবে শোনো, তোমাকে আমার জীবনের একটা অভিজ্ঞতা
সুজিত তাড়াতাড়ি বলেছে, কুমিরটা তবে কে, ওইটেই আগে বলুন।
–ও, তুমি ভাবছ, আমি মিথ্যে কথা বলতে যাচ্ছিলাম। যাক শোনো, এ ক্ষেত্রে কুমির হচ্ছে প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ টাকাটা কেন দিচ্ছে ওই মেয়েটাকে? না, যাতে সে জীবনে সেট করতে পারে। মেয়েদের সেট করা মানে কী? একটা বিয়ে, গুছিয়ে গাছিয়ে সংসার করা। এই তো? তা ছাড়া, প্রিয়নাথ বিশ্বম্ভর রায়ের মেয়েকে বিয়ে করবে, তাতে যেন মেয়েটা বাগড়া না দেয়, অথচ প্রিয়নাথেরা চায়, এমন একটা লোকের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে হোক, যাতে ও ওদের দখলে থাকে।
সুজিত জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা, এ দখলে রাখার মানেটা কী, বলতে পারেন?
-তুমি একটি বুন্ধু। বড়লোকেরা এই রকমই চায়, যা কিছু সুন্দর আর ভাল, তা তাদের দখলে থাক। ওই মেয়েটা রূপসী, যা শুনছি, সবদিকেই বেশ পোক্ত, এরকম একটা মেয়েকে নিজেদের দখলে রাখতে পারলে, বুঝতে পারছ না ব্যাপারটা? কিন্তু কী হবে তোমাকে বুঝিয়ে? টাকা তো নেই।
আজ্ঞে আছে, টাকা পাঁচেক আছে।
–তবে দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি, খবরদার দীপু বা নয়নকে বোলো না যেন।
সুজিত ওর শেষ সম্বল যা ছিল, দিয়ে দিয়েছে। তারপরে ভেবেছে, ভুজঙ্গ ভুল বলেননি। হয়তো বাঘ কুমির ছাড়াও সিংহ-নেকড়েও অনেক আছে। তবু শেষপর্যন্ত এদের হিংস্র শিকার একমাত্র সুনীতা।