১১. প্রতিশোধ
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হলো আমি যদি জহিরকে খুন করে ফেলতে পারতাম তাহলে একটু শান্তি পেতাম। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো আর একটা মানুষকে খুন করে ফেলা যায় না তাই খুন করার কাছাকাছি কী করা যায় আমি সেটা চিন্তা করতে লাগলাম।
বড়োদের কাছে শুনেছি তারা যখন ছোটো ছিল তখন নাকি রূপকথা নামে একধরনের বই পড়ত। সেই বইয়ে রাক্ষস, দৈত্য, দানব এইসব থাকত এবং তাদের প্রাণ লুকানো থাকত একটা ভোমরার মাঝে। সেই ভোমরার একটা ঠ্যাং ছিঁড়ে ফেললে রাক্ষস কিংবা দৈত্য দানবের ঠ্যাং ছিঁড়ে যেত। মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেললে রাক্ষসের মুণ্ডু ছিঁড়ে রাক্ষস মারা পড়ত! (কী আজব!) কিন্তু আজকে মনে হলো জহিরের সেই রকম প্রাণ লুকিয়ে আছে তার মাথার চুলের মাঝে। সে যেভাবে প্রত্যেক মিনিটে তার চুলের যত্ন করে, হাত দিয়ে আদর করে তার অর্থ এই চুলকে যদি আমি উপড়ে ফেলতে পারি তাহলে তাকে খুন করার কাছাকাছি একটা কাজ হবে। কাজেই আমাকে তার চুলকে মাথা থেকে খিমচে খিমচে তুলতে হবে। কাজটা কীভাবে করা যায় আমি সেটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলাম। কোনো ভালো কিংবা মহান চিন্তায় আমি বেশীদূর এগুতে পারি না, কিন্তু এরকম চিন্তায় আমি যথেষ্ট ভালো।
একটু পরে মামী শুতে এলেন। বিছানায় উঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “টুলু ঘুমিয়ে গেছিস?” মামীর গলা বেশ নরম।
আমাদেরকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করার পর থেকে মামীর সাথে আমার কথাবার্তা বেশী হয় নাই। দুজনের কেউই কথা বলছি না। এই প্রথম মামী কথা বললেন। আমি বললাম, “না।”
“আজকে তোদের একটু বেশী বলা হয়ে গেছে।” কথাটা প্রশ্ন হতেও পারে নাও হতে পারে তাই আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
মামী বললেন, “ঠিক কী হয়েছিল তুই বলতে চাইছিলি। এখন বলতে চাস?”
আমি বললাম, “নাহ্।”
“কেন? বল, শুনি।”
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, “না মামী। তুমি ঠিকই বলেছিলে একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার পর সেটা কেন ঘটেছে শুনে কোনো লাভ নাই। অঘটনটা না ঘটলে লাভ আছে।”
“তাহলে তুই বলবি না?”
“নাহ্ মামী। তুমি না শুনলে।”
মামী নরম গলায় বললেন, “তুই আমার ওপর রাগ করেছিস?”
আমি বললাম, “না মামী। রাগ করি নাই। কিন্তু এটা আমি নিজেই শেষ করতে চাই।”
“কোনটা?”
“এইতো যেটা হয়েছে।”
“তার মানে এখনো শেষ হয় নাই?”
“উঁহু। আমার কাজটা বাকী আছে।”
“ঠিক আছে।” মামী একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলেন।
.
পরদিন ভোরে যাদের সাথেই দেখা হলো সবাই আমাকে আর মিতিকে হাই ফাইভ দিতে লাগল, বলতে লাগল, “তোমরা একটা কোরাল রিফ আবিষ্কার করেছ! কী অসাধারণ! ফ্যান্টাসটিক!” তারপরেই অবশ্য বলতে লাগল, “কিন্তু তোমাদের নিয়ে যা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। বঙ্গোপসাগরে দুজন বাচ্চা হারিয়ে গেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! চিন্তা করতে পারো?” ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো বেইজ্জতি ব্যাপার।
যখন কেউ আশেপাশে নাই তখন জহির আমাদের কাছে এসেছে, মুখে এমন একটা ভাব যেন সে কিছুই জানে না। মুখটা বাঁকা করে বলল, “তোরা নাকি কী একটা জিনিস আবিষ্কার করেছিস?”
আমি তার কথার উত্তর দিলাম না। আমার বিখ্যাত বিষাক্ত দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকালাম। জহির সেটা না দেখার ভান করে বলল, “মনে রাখিস, আসল ক্রেডিট কিন্তু আমার।”
আমি কোনো কথা না বলে মিতিকে নিয়ে সরে গেলাম। তার সাথে কথা বলা মানেই তাকে লাই দেওয়া। যেহেতু তার প্রাণ ভোমরা ছেচে ফেলার প্ল্যান করছি তাই এখন তার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নাই।
মিতি সারাদিন বসে বসে ছবি আঁকল। ছবির বিষয়বস্তু কোরাল রিফ, তার মাঝে রং বেরঙয়ের মাছ। মাঝে মাঝে মাছের সাথে আমি আর সে। এই মেয়েটা অসাধারণ ছবি আঁকে।
আমি বসে বসে চোখ বন্ধ করে কীভাবে জহিরকে সাইজ করা যায় সেটা চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। চুলের ওপর আক্রমণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে চিউয়িংগাম। ভালো করে চিবিয়ে নরম করে কারো চুলের ওপর লাগিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যায়। আমি অনেকবার অনেকের মাথায় চেষ্টা করেছি, প্রত্যেকবার নির্ভুলভাবে কাজ করেছে। প্রথম দিকে ছোটো একটা জায়গায় থাকে, কিন্তু যতই পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয় সেটা ততই ছড়িয়ে যেতে থাকে। সবশেষে মাথার এক খাবলা চুল কেটে সেটা পরিষ্কার করতে হয়।
কিন্তু এই অসাধারণ টেকনিকটা এখানে কাজ করানো যাবে না। আমার কাছে চিউয়িংগাম নাই (মামী দুই চোখে এটা দেখতে পারেন না, কী কারণ কে জানে!) এই জাহাজে কোনোখানে চিউয়িংগাম পাওয়া যাবে না। চিউয়িংগামের বদলে কী ব্যবহার করা যায় যখন সেটা চিন্তা করছি তখন হঠাৎ করে বাবুর্চি চাচার ইঁদুর ধরার আঠার কথা মনে পড়ল। এই আঠার মাঝে যদি ইঁদুরের মতো মহা ধুরন্ধর প্রাণী আটকা পড়ে তাহলে চুল থেকে সরানো নিশ্চয়ই অসম্ভব ব্যাপার হবে। এটা চিউয়িংগাম থেকে অনেক ভালো কারণ চিউয়িংগাম হয় ছোটো, অল্প জায়গায় লাগানো যায়। ইঁদুর ধরার আঠা দরকার হলে সারা মাথায় লাগানো যাবে। চিউয়িংগাম আঠা না, এটা মুখে দিয়ে চাবায়, ইঁদুর ধরার আঠা সরাসরি আঠা, এর কাজই কোনোকিছু আটকে ফেলা।
এত ভালো একটা আইডিয়া মাথায় আসার জন্য আমি খুশী হয়ে উঠলাম। নিচে কিচেনে গিয়ে বাবুর্চি চাচার কাছে গিয়ে কোনো একটা গল্প বলে খানিকটা আঠা নিয়ে আসলেই হবে। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জহিরের চুলে ভালো মতন সেটা লেপে দেওয়া। এমনভাবে কাজটা করতে হবে যেন সে ভুলেও আমাকে সন্দেহ না করে। কীভাবে সেটা করা যায় আমি তখন সেটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। অনেকগুলো আইডিয়া মাথায় এলো কিন্তু কোনোটাই সেরকম কাজের মনে হলো না। তখন বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আমার হাওয়াই মিঠাই রঙের ক্যাপটার কথা মনে পড়ল। আমি যতবার এটা মাথায় পরেছি ততবার জহির সেটা আমার মাথা থেকে খুলে নিয়ে নিজের মাথায় পরেছে। তারপর কায়দা করে সেলফি তুলেছে।
এই ক্যাপটার ভেতরে যদি আমি ইঁদুর ধরার আঠাটা লাগিয়ে রাখি তাহলেই কাজ হয়ে যাবে। ক্যাপটা এমন জায়গায় রাখব যেন সে দেখতে পায়, তাহলেই এসে এটা তুলে মাথায় পরে ফেলবে। মাথায় পরার সময় যদি ভেতরে তাকিয়ে পরীক্ষা করে তাহলে বিপদ কিন্তু তার চান্স খুবই কম।
টুপিটা মাথায় পরার পর সে যখন আবিষ্কার করবে ভয়ংকর আঠায় সেটা তার মাথায় আটকে গেছে তখন কেন আমি টুপির ভেতরে আঠা লাগিয়েছি সেটার একটা গল্প বানাতে হবে। কী গল্প হতে পারে সেটাও আমি ঠিক করে রাখলাম।
এখন আমার প্রথম কাজ হচ্ছে নিচের কিচেনে গিয়ে বাবুর্চি চাচার কাছ থেকে ইঁদুর ধরার আঠা নিয়ে আসা। আমি সাথে সাথে নিচে রওনা দিলাম।
বাবুর্চি চাচা কিছুতেই আমার হাতে ইঁদুরের আঠা দিতে রাজী হলো না, চোখ কপালে তুলে বলল, “সব্বোনাশ! এইটা বাচ্চা পুলাপান ধরার কথা না।”
আমি একটা লম্বা গল্প ফাঁদলাম, ঘরের মাঝে উঁদুর, আমার বই কেটে ফেলছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। বাবুর্চি চাচা বলল, “কত নম্বর কেবিন বলো? আমি রাত্রে বিছানার নিচে রেখে আসব।”
আমি রাজী হলাম না ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। হাজার রকম কিরা কসম কেটে বললাম খুবই সাবধান থাকব ইত্যাদি ইত্যাদি, শেষ পর্যন্ত একটা ছোটো কাঠের টুকরার ওপর একটু আঠা লাগিয়ে দিল। আমি আবার কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে পরিমাণটা বাড়িয়ে নিলাম। ব্যস কাজ হয়ে গেছে।
মিতিকে ষড়যন্ত্রে নিব কিনা চিন্তা করলাম। সে শান্তশিষ্ট চুপচাপ নরম একটা মেয়ে, তাকে এরকম বদমাইশি কাজকর্মে নেওয়া ঠিক হবে না, কিন্তু সে যদি কিছু না জানে তাহলে বিপদ হতে পারে। না বুঝে মিতি নিজেই হয়ত আমার ক্যাপটা মাথায় দিয়ে বসে থাকবে, তখন একটা মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
কাজেই মিতিকে আমার পুরো প্ল্যানটা বলতে হলো। ইঁদুর ধরার আঠা দেখিয়ে বললাম, “এটা দেখেছ?”
মিতি আমার হাতে এই বিপজ্জনক জিনিস দেখে যথেষ্ট অবাক হলো। মাথা নেড়ে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল এটা দিয়ে আমি কী করব।
আমি বললাম, “জহিরকে টাইট করব।” তারপর হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গী করলাম।
মিতি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখন এদিক সেদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম জহির আশেপাশে নাই। তারপর আমার হাওয়াই মিঠাই ক্যাপের ভেতরে উঁদুর ধরার আঠাটা লাগাতে লাগলাম। মিতি প্রথমে চমকে উঠল তারপর হঠাৎ করে বুঝে গেল আমি কী করতে চাইছি। তার মুখে প্রথমে ভয়, তারপর অবিশ্বাস এবং সবশেষে হাসি ফুটে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে সে চোখ বড়ো বড়ো করে মাথা নাড়তে লাগল।
আঠা লাগানোর পর আমি ক্যাপটা ডেক চেয়ারের পাশে রাখা ছোটো টেবিলটার ওপরে সোজা করে রাখলাম। পাশে মিতির একটা বই রাখলাম। আঠা লাগানো শেষ হওয়ার পর যে কাঠের টুকরাটা রয়েছে সেটাও টেবিলের এক কোনায় রেখে দিলাম।
ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে এখন শিকারের জন্য অপেক্ষা করা।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের শিকার এসে হাজির হলো। আমি আর মিতি রেলিং ধরে দূরে তাকিয়ে আছি। চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম জহির খুবই বেসুরোভাবে শিস দিতে দিতে আসছে। আমাদেরকে দেখল কিন্তু আমরা যেহেতু তার সাথে বেশী কথাবার্তা বলছি না সে হেঁটে একটু সরে গেল। এবং বুঝতে পারলাম সে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল এবং টুপিটা হাতে নিয়ে একটু নাড়াল তারপর মাথায় দিল! কাজ হয়ে গেছে!
আমি কয়েক সেকেন্ড সময় দিলাম তারপর জহিরের দিকে তাকালাম। তারপর চোখে মুখে ভয়াবহ আতঙ্কের একটা ভঙ্গী করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “সর্বনাশ! তুমি কী করেছ?”
জহিরও একটু ভয় পেল, বলল, “কী করেছি?”
আমি বললাম, “তুমি নড়বে না। ক্যাপটা ধরবে না। খবরদার।”
জহির ভয়ে ভয়ে বলল, “কেন? কী হবে ধরলে?”
“তুমি এই ডেক চেয়ারটায় বসো।”
জহির ডেক চেয়ারটায় বসল। অবাক হয়ে আমার দিকে ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কাছে গেলাম, তার মাথায় ক্যাপটা ধরলাম, তারপর বললাম, “এই ক্যাপটার মাঝে আঠা, তোমার মাথায় আঠা লেগে যাবে। তুমি নড়বে না। আমি সাবধানে খুলে দিই।”
জহির নড়ল না। আমি ক্যাপটা খুলে নেওয়ার একটা বাড়াবাড়ি অভিনয় করলাম কিন্তু আসলে ক্যাপটা চাপ দিয়ে তার মাথার মাঝে আচ্ছা করে ডলে দিলাম। তারপর হতাশ একটা ভঙ্গী করে বললাম, “নাহ্! খুলতে পারছি না। লেগে গেছে।”
জহির আর্তনাদ করে বলল, “খুলতে পারছিস না মানে?”
সে তখন নিজেই ক্যাপটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু আমি খোলার ভান করে এমন আচ্ছা মতন ডলে দিয়েছি যে জহির সত্যিই সত্যিই ক্যাপটা খুলতে পারল না, আউ আউ করে চিৎকার করতে লাগল। বুঝতে পারলাম চাঁদির কিছু চুল না ছিঁড়ে সে এটা খুলতে পারবে না।
আমি সাহায্য করলাম এবং হ্যাঁচকা টান দিয়ে কিছু চুল ছিঁড়ে ক্যাপটা খুলে আনলাম, ক্যাপটা হাতে নিয়ে বললাম, “ইশ! আমার এত সুন্দর ক্যাপটার কী অবস্থা হয়েছে দেখো।”
আমি খুব মন খারাপের ভঙ্গী করে আমার ক্যাপটার দিকে তাকিয়ে আহা উহ করতে লাগলাম, যেন আমার ক্যাপটা নষ্ট হয়েছে সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথা, জহিরের চুল নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নাই!
জহির হাত দিয়ে তার চুল ধরার চেষ্টা করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “চুল, আমার চুল!”
আমি বললাম, “হাত দিয়ে ছুঁয়ো না, তাহলে হাতে আঠা লেগে যাবে।” জহির চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই তোর টুপির মাঝে আঠা লাগিয়ে রেখেছিস কেন?”
আমি আরও গরম হয়ে বললাম, “ইচ্ছা করে লাগিয়েছি নাকি? আমার এত সুন্দর ক্যাপটা আমি আঠা লাগিয়ে নষ্ট করব? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?”
“তাহলে তাহলে–?”
আমি উদাস গলায় বললাম, “মিতির দোষ।”
“মিতি? মিতি কী করেছে?”
“আমি ইন্দুর ধরার আঠা এনেছিলাম আমার কেবিনের ইন্দুর ধরার জন্য। সেটা টুপি দিয়ে ঢেকে রেখেছি। মিতি না বুঝে ধপাস করে তার মোটা একটা বই ওপরে রেখে দিয়েছে। ব্যস টুপির ভেতরে আঠা দিয়ে মাখামাখি”
করল তারপর পকেট থেকে তার স্মার্টফোন দিয়ে নিজের চুল দেখতে লাগল। তার মুখটা একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। বলল, “এখন–এখন–এই আঠা কী করে পরিষ্কার করব?”
আমি বিরক্ত হওয়ার ভান করলাম, “আমি কী জানি! জানলে তো আমার ক্যাপটাই পরিষ্কার করে ফেলতাম।”
জহির তখন নিজের বুদ্ধি দিয়ে আঠা পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। প্রথমে টিস্যু দিয়ে মোছার চেষ্টা করল, তার ফল হলো ভয়ানক। আঠা তো মোছা গেলই না বরং টিস্যু ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার চুলের সাথে লেগে গেল। তখন জহিরের চেহারাটা হলো দেখার মতো। জহির হাত দিয়ে খিমচে খিমচে টিস্যুর টুকরাগুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, যে আঠা থেকে উঁদুর পর্যন্ত ছুটে বের হয়ে আসতে পারে না সেই আঠা থেকে নরম টিস্যু আলাদা করা তো সোজা কথা না। লাভের মাঝে লাভ হলো তার হাতের সব আঙুল আঠা দিয়ে মাখামাখি হয়ে গেল। হাতের আঙুল দিয়ে সবকিছু ধরতে হয় তাই প্রথমে তার স্মার্টফোন তারপরে তার বিখ্যাত ব্র্যান্ডের শার্ট সেই আঠায় আঠালো হয়ে গেল। জহির প্রথমে কাঁদো কাঁদো ছিল এখন মনে হলো সত্যি সত্যি তার চোখ থেকে পানি বের হতে শুরু করেছে।
সহজ কোনো উপায়ে আঠা পরিষ্কার করতে না পেরে জহির শ্যাম্পু সাবান দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলার জন্য বাথরুমে ঢুকল। জাহাজের বাথরুমগুলো ছোটো, সমুদ্রের ওপরে পানির টানাটানি তাই সব কাজকর্ম অল্প পানি দিয়ে করার কথা তাই জহির খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বের হয়ে এলো। আঠা পরিষ্কার হয়নি বরং সেটা এখন অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, ঘাড় দিয়ে পিঠে গিয়েছে, কপাল এবং গাল এখন চটচটে হয়ে আছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মোছার সময় মনে হয় ভোয়ালে চুলে আটকে গিয়েছিল, কিছু চুল ছিঁড়ে সেটা ছোটাতে হয়েছে।
জহির আরও নানাভাবে চেষ্টা করল। যখন জাহাজে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল তখন অন্যদের কাছ থেকে আরও নানা ধরনের আইডিয়া আসতে থাকে। কেরোসিন দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেলা, অ্যালকোহল দিয়ে পরিষ্কার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। জহিরের বড়ো ভাই যখন ব্যাপারটা জানতে পারলেন তখন জহিরের ঘাড় ধরে তাকে নিচে নিয়ে গেলেন এবং একজন খালাসি তার মাথাটা ন্যাড়া করে দিল।
যে মানুষের চেহারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার চুল সে যখন ন্যাড়া হয়ে যায় তখন তাকে এত অদ্ভুত দেখায় যে সেটা বলার মতো নয়। আমি জানতাম মানুষের মাথা মোটামুটি গোল কিন্তু জহিরের ন্যাড়া মাথা দেখে আমি আবিষ্কার করলাম সেটা সত্যি নয়, তার মাথার এদিকে সেদিক রীতিমতো উঁচু নিচু এবং ঢেউ ঢেউ আছে। কী আজব!
.
রাত্রে শোয়ার সময় মামী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের কেবিনে ইঁদুর আছে, সেই ইঁদুর তোর বই কেটে ফেলছে সেজন্য ইঁদুর ধরার আঠার দরকার এই গল্পগুলো তুই আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস?”
আমি বললাম, “নাহ্।”
“জহির ছেলেটাকে তুই এভাবে নাজেহাল করেছিস?”
আমি চুপ করে রইলাম। মামী বললেন, “কাজটা বাড়াবাড়ি হলো না?”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “ওর জন্য আমি আর মিতি ছোটো বোটে সমুদ্রে ভেসে গিয়েছিলাম, বোটটা কোনোভাবে উলটে গেলে আমরা মরে যেতে পারতাম।”
“সেজন্য ওকে শাস্তি দিয়েছিস?”
আমি চুপ করে রইলাম। মামী জিজ্ঞেস করলেন, “শাস্তি শেষ হয়েছে?”
আমি এবারও চুপ করে রইলাম। তাকে আরও একটা শাস্তি দেওয়ার বুদ্ধি মাথায় এসেছে। এটা আগে কখনো চেষ্টা করে দেখি নাই কিন্তু মনে হয় কাজ করবে। তার সিগারেটের একটু তামাক বের করে ম্যাচের কাঠির বারুদ রেখে আবার তামাকটুকু ভরে দেওয়া। সিগারেটের আগুন বারুদ পর্যন্ত পৌঁছালে ফট করে জ্বলে উঠে একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটতে পারে।
মামী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “শাস্তি শেষ নাকি বাকী আছে?”
আমি কিছু বলার আগে মামী বললেন, “যা হওয়ার হয়েছে। এখন পুরো ব্যাপারটা এখানেই শেষ। বুঝেছিস?”
আমি মামীর দিকে তাকালাম বললাম, “ঠিক আছে।”
মামী তার বিছানায় শুতে শুতে বললেন, “তুই এত ডেঞ্জারাস আমি। জানতাম না।”
কথাটা গালি হিসেবে নেব নাকি প্রশংসা হিসেবে নেব বুঝতে পারলাম না। আমি মামীর দিকে তাকালাম। কেবিনের অল্প আলোতে মনে হলো মামীর মুখে খুবই হালকা একটা হাসি।
আমিও মুখে একটা হাসি নিয়ে শুয়ে পড়লাম।