১১. পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত গল্প

পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত গল্প নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামার দুঃসংবাদ যিনি এনেছিলেন, সেই আমাদের বিশুদা, অর্থাৎ বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা কিঞ্চিৎ এখানে না বললে বৈঠকের পরিচয়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কালীঘাট পাড়ার সদানন্দ রোডের দোতলায় একখানি ঘরে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন, কিন্তু সেই ঘরখানির স্থানমাহাত্ম কালীঘাটের মন্দিরের চেয়েও কিছু কম নয়। কালীঘাটের ট্রাম ডিপোর উল্টো দিকের গলি দিয়ে ঢুকে সদানন্দ রোডে পড়েই আপনি হাঁক দিন—বিশুদা বাড়ি আছেন?

সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন দোতলার বারান্দায় হাস্যোম্ভাসিত একটি মুখ সাদর আহ্বান জানিয়ে বলছেন-চলে আসুন, ওপরে চলে আসুন।

রেলিং-বিহীন সংকীর্ণ সিঁড়ি সন্তর্পণে অতিক্রম করে দোতলার ঘরে ঢুকেই দেখবেন মেঝেতে ঘর-জোড়া ফরাশ পাতা, সেখানে আমারই মত আধ ডজন সাহিত্যোৎসাহী বন্ধু শুয়ে বসে আছেন। আপনিও একটা বালিশকে তাকিয়ার মত বগলদাবা করে শুয়ে পড়ে ডান পায়ের উপর বা তুলে নিশ্চিন্ত হয়ে নাচাতে থাকুন আর সাহিত্যের রাজা উজির মারুন, কেউ কিছু মনে করবে না। চা আর তেল-মুড়ি হাত বাড়ালেই হাজির।

কালীঘাটের এই পাণ্ডাটির কাছে সকলকেই আসতে হয়, বিশেষ করে লেখকদের।

কোথাও কোন আঘাত পেয়ে মন মুষড়ে আছে, চল বিশুদার কাছে। এক লেখকের সঙ্গে অপর লেখকের মনোমালিন্য হয়েছে, বিশুদার মিশন যে করেই হোক ঝগড়াটা মিটিয়ে ফেলতেই হবে। দারিদ্র্যের সঙ্গে নিত্যসংগ্রামে বিশুদা বিধ্বস্ত, কিন্তু পরাজিত উনি হবেন না। তাই কোন লেখক বিরূপ সমালোচনায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লে বিশুদা উত্তেজিত কণ্ঠে তাকে এই বলে তিরস্কার করবেন-তা বলে কি হার মানতে হবে? বাধা যত আসবে তাকে দ্বিগুন জোরে ফেরাতে হবে আরও লিখে। তবে লেখাটা যেন সিনসিয়র হয়।

বিশুদার এক কথায় মনের গ্লানি দূর হয়ে গেল। এক মুহূর্ত আগে যে লেখক ভেবেছিল লেখা ছেড়েই দেবে, এখন সে দ্বিগুণ উৎসাহে বিশুদার সঙ্গে শুরু করে দিল নতুন উপন্যাসের প্লট নিয়ে আলোচনা।

বিশুদা আমাদের বয়সী হলে কি হবে, প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যিক মহলে ঘোরা-ফেরা, মেলামেশার ব্যাপারে উনি আমাদের সকলের অগ্রণী। আমরা সেই সুবাদে ওঁকে সবাই দাদা বলে ডাকি। শরৎচন্দ্রের রসচক্র নামে যে সাহিত্যিক আচ্ছা ছিল, যার গল্প আমরা দূর থেকেই শুধু শুনে এসেছি, সেই বিখ্যাত রসচক্রের বিশুদা ছিলেন একজন নিয়মিত চক্রী। সেই আমল থেকে হালফিলের তরুণতম লেখকদের বিশুদা হচ্ছেন ফ্রেণ্ড, ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড। বিশুদা সাহেব কোম্পানীর ব্যাঙ্কে দশটাপাঁচটা টাকা আনা পাই হিসেব করেন, অবসর সময়ে করেন সাহিত্য চর্চা। অর্থাৎ লেখক বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া। বন্ধুরা কে কোথায় লিখল, সে লেখা সম্বন্ধে বিশুদার মতামত না পাওয়া পর্যন্ত লেখকদের মনেও শান্তি নেই। কোন সাময়িক পত্রে কোন সাহিত্যিক বন্ধুর লেখা বেয়োনট মাত্র বিশুদার তা পড়া চাই এবং লেখকদের বাড়ি গিয়ে তাকে প্রচুর উৎসাহ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই।

বিপত্নীক হবার পর বিশুদা কিছুদিন মনমরা হয়ে গেলেন। বৈঠকে আসেন, চুপচাপ বসে থাকেন, আবার এক সময়ে কাজের অছিলায় উঠে চলে যান।

বিশুদাকে চেপে ধরলাম, গল্প লিখতে হবে।

শুনে বিশুদা বললে–আমিও তাই ভাবছি। জানেন বাড়িতে ফিরে গেলে মন টেকে না। একটা কিছু নেশায় মনটাকে ডুবিয়ে রাখতে চাই। বড় নেশায় আসক্তি নেই, উপায়ও নেই। সুতরাং লেখার নেশায় ডুবে থাকলে কেমন হয়? আমি বললাম-সে তত উত্তম প্রস্তাব। আপনি এত ভাল গল্প বলেন, অথচ লেখেন না। একি কম দুঃখের কথা।

সেই ঝোঁকেই বিশুদা পর পর দুটো অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত কেরানী জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতা নিয়ে। অন্তরের গভীর অনুভূতি দিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা দুটি গল্পই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেই খানেই ইতি, আর কলম ধরলেন না। জিজ্ঞেস করলে বলেন-বেশ তত আছি। আপনার পত্রিকায় লেখকের ভিড় বাড়িয়ে আপনাকে দেশত্যাগ করতে চাইনে।

বিশুদা কথা রেখেছিলেন, কলম আর ধরেন নি। কিন্তু সাহিত্যিকদের যেকোন অনুষ্ঠানে বিশুদার স্থান সর্বাগ্রে। আমরা তাই ঠাট্টা করে আজও ওকে বলে থাকি-না লিখে সাহিত্যিক।

রসচক্রের আজ্ঞায় তাবড় সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে বিশুদা প্রায়ই আমাদের বৈঠকে রসিয়ে গল্প জমাতেন, যেন এইমাত্র সেই আড্ডা থেকে উঠে এসেছেন। বিশুদা বললেন–

এক রবিবার ঠিক হল রসচক্রর তরফ থেকে কবি গিরিজাকুমার বসুকে মানপত্র দেওয়া হবে।

বৈঠকে একজন বললে—এ কি সেই বিখ্যাত ল্যাবেস কবি গিরিজা কুমার?

বিশুদা খেঁকিয়ে উঠলেন—হ্যাঁ গো হ্যাঁ, তিনিই। প্রস্তাবটা উত্থাপন করলেন শরৎবাবু নিজেই। আমরা কয়েকজন আপত্তি জানিয়ে বললাম—তা হয় না শরৎদা। কালীদা, যতীনদা, নরেনদা থাকতে আগেই গিরিজাদাকে দেওয়াটা একটু দৃষ্টিকটু হয় না কি?

আমাদের আপত্তি শরৎদা কানেই তুললেন না। শুধু বললেন–ওরা মানপত্রের জন্য ব্যস্ত নয়। তাছাড়া ওদের মানপত্র দেবে দেশবাসী। কিন্তু গিরিজার কথা স্বতন্ত্র। বেচারী সারাজীবন ধরে ওর বউকে উপলক্ষ্য করে কয়েক হাজার প্রেমের কবিতা লিখল, অথচ তোমরা কেউ ওকে আমলই দিলে না। তাই ওর মনে একটা ক্ষোভ আছে।

একথার পর আর আপত্তি চলে না, সবাই মেনে নিলুম। বিশ্বপতি চৌধুরী মানপত্র দেবেন, পরামর্শ টা শরৎবাবুই দিলেন।

বিশুদার গল্পে বাধা দিয়ে বৈঠকের সব্যসাচী লেখক টিপ্পনী কেটে বললেন—এটা কি রকম হল বিশুদা? শরৎবাবু, কালিদাস রায়, যতীন বাগচী, নরেন্দ্র দেব এরা আপনার গল্পের তোড়ে দাদা হয়ে গেলেন?

বিশুদা রেগে বললেন–ওই তো আপনাদের দোষ। কিছুই না জেনে মন্তব্য করবেন। রসচক্রের বৈঠকে বসবার কল্কে তত পেলেন না। পেলে বুঝতেন রসচক্রের ওইটিই ছিল রীতি। বয়োজ্যষ্ঠরা ওখানে সবাই দাদা, সমবয়সী আর কনিষ্ঠদের সঙ্গে তাদের তুই-তোকারি সম্পর্ক।

তাই বলুন। সব্যসাচী লেখক টেবিলে টোকা মেরে, তবলার বোল তুলতে তুলতে বললেন—কোন দিন শুনব রসচক্রের সভ্যদের মুখে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, মায় বিদ্যাসাগর পর্যন্ত দাদা বনে গেছেন। শুধু কাঁধে হাত দেওয়াটাই বাকি।

আমাদের এই সব্যসাচী লেখকের খোঁচা-দেওয়া স্বভাবটা আর বদলাতে পারলাম না। জমে-ওঠা গল্পকে কঁচিয়ে দিয়ে মজা দেখা। আমরা সবাই বিশুদাকে তাতিয়ে দিয়ে বললাম—চালিয়ে যান বিশুদা। ওর কথায় কান দেবেন না।

এক গাল হেসে বিশুদা বললেন–ওর কথায় কোন দিন কান দিই নাকি! যতোসব—ও, কি যেন বলছিলুম? সেই মানপত্রের কথা। ঠিক হল যতীনদা, তোমাদের যতীন বাগচী গো, তাঁর বাড়িতেই পরবর্তী রবিবার সকালে মানপত্র দেওয়া হবে।

পরের রবিবার বেলা নয়টার মধ্যে রসচক্রের সভ্যরা একে একে যতীন বাগচীর বাড়িতে জমায়ত হয়েছেন, শরৎদাও যথাসময়ে উপস্থিত। কিন্তু মানপত্র আনার ভার যার উপরে দেওয়া হয়েছিল সেই বিশ্বপতি চৌধুরীর দেখা নেই।

এদিকে গিলে-হাতা আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধাক্কা-দেওয়া শান্তিপুরী কোচানো ধুতি পরে ষাট বছরের যুবা কবি গিরিজাকুমার বসু ঘর আলো করে বসে আছেন।

শরৎদা বললেন, মানপত্র যখন আসতে দেরি হচ্ছে ততক্ষণে মালা-চন্দন ওকে পরিয়ে দাও।

দুটি মেয়ে এসে গোড়ে মালা আর শ্বেতচন্দন পরিয়ে দিতেই শরৎঙ্গা বললেন–হ্যাঁ, এতক্ষণে গিরিজাকে বরবর দেখাচ্ছে।

বিশুদার কথায় আবার বাধা দিয়ে সব্যসাচী লেখক বলে উঠলেন—শরৎবাবু গিরিজাবাবুকে বর্বর বলে গাল দিলেন আর গিরিজাবাবু তা বিনা প্রতিবাদে হজম করলেন?

বিশুদা বললেন—রসচক্রের সভ্যরা রসিকতা বুঝতেন। আপনার মত তারা বেরসিক ছিলেন না। যাক, যে-কথা বলছিলাম। এদিকে বেলা বাড়ছে, বিশ্বপতিবাবুর দেখা নেই। সবাই ব্যস্ত আর উদগ্রীব, কখন বিশ্বপতিবাবু আসবেন। শরৎদা কিন্তু নির্বিকার। শুধু বললেন, বিশ্বপতির জন্য ব্যস্ত হবার কিছু নেই। ওর আসতে একটু দেরি হবেই।

বিশুদা থামলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললেন–এবার এক রাউণ্ড চা হয়ে যাক। বকর বকর করে গলাটা শুকিয়ে গেছে।

ঘরের এক কোণে অমর এক মনে কতকগুলি লেখার পাণ্ডুলিপি ফাইলে গুছিয়ে রাখছিল। বোঝা গেল কান সে খাড়া রেখেছিল গল্পের দিকে। বিশুদার মুখ থেকে চায়ের কথা বেয়োতে না বেরোতেই হন্তদন্ত হয়ে টপট নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। যেখানে এসে বিশুদা চায়ের জন্য গল্প থামিয়েছেন, সেখানে অধিক বিরতি বোধ হয় ওরও মনঃপূত নয়।

বৈঠকের তরুণ কবি আর ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে বললেন—তারপর কী হল বিশুদা?

বিশুদা বললেন–কি আর হবে। বিশ্বপতিবাবু না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বুঝলাম বেচারী অমরকে বিশুদা বঞ্চিত করতে চান না। শুধু বললেন–আপনারা তমাললতা বসুর কবিতা পড়েছেন?

বৈঠকের তরুণ কবি বললেন—পড়েছি কিছু কিশোর বয়সে। কিন্তু কি পড়েছি আজ জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না। তবু এটুকু মনে পড়ে প্রেমের কবিতাই লিখতেন বেশী, যা ওই বয়সে মন্দ লাগত না।

বিশুদা বললেন–এই দম্পতি সারা জীবন ধরে প্রেমালাপ করেছেন কবিতায় এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সেই প্রেমালাপ শেষে প্রলাপ হয়ে উঠেছিল।

বিশুদার এই কথায় আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম-যাই বলুন, তরুণ বয়সে এই কবি-দম্পতির কবিতা কিন্তু আমার ভালই লাগত। যে-বয়সটায় একটুকু কথা আর একটুকু ছোঁয়া নিয়ে মনে মনে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যার কল্পনা করতে ভাল লাগত সে-বয়সে ওঁদের লেখা মিষ্টি প্রেমের কবিতার একটা মোহ ছিল বইকি!

ওই জন্যেই তো বলা হয় ল্যাবেঞ্চুস কবি।

অমর বিশুদার সামনে চায়ের কাপটা রাখতেই চুমুক মেরে আবার বললেন–যাক, বিশ্বপতিবাবু এসে গেছেন। ট্যাক্সি থেকে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে নামলেন, হাতে খবরের কাগজে রোল করা একটা বিরাট জিনিস, অনুমান করলাম মানপত্ৰই হবে।

শরৎজা বললেন—কি হে বিশ্বপতি, এত দেরি করলে যে?

বিশ্বপতিবাবু বললেন–আপনি যে-ধরনের মানপত্রের কথা বলেছিলেন কলকাতায় কোথাও খুঁজে পাই না। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনারা সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, তাও বুঝতে পারছি। শেষকালে খালি হাতে ফিরব? তাই মরিয়া হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম ধাপার মাঠে। তাই দেরি হয়ে গেল।

আমরা সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি একটা মানপত্রর সঙ্গে ধাপার মাঠ পর্যন্ত ছোটার কি সম্পর্ক।

শরৎদা বললেন–তাহলে আর অপেক্ষা করা নয়, বেলা অনেক হল। ফটোগ্রাফারও সেই ন-টা থেকে বসে আছে ফটো তুলবার জন্যে। বিশ্বপতি, মানপত্রটা তুমিই গিরিজার হাতে তুলে দাও।

বিশ্বপতিবাবু একটু কিন্তু কিন্তু করে বললেন–আপনি উপস্থিত থাকতে আমি দেব?

শরৎদা বললেন—একই কথা। তাছাড়া রসচক্রর তরফ থেকে তোমাকেই তো এভার দেওয়া হয়েছে।

গিরিজাকুমার বসু গলায় মালা দিয়ে বসে আছেন আর প্রবল উত্তেজনায় শীতকালেই কপালে কালোকালে ঘাম দেখা দিয়েছে। বিশ্বপতিবাবু গিরিজাবাবুর সামনে জোড়হস্তে নিবেদনের ভঙ্গিতে খবরের কাগজে মোড়া সুতো দিয়ে বাঁধা মানপত্রটি রাখলেন।

শরৎদা বললেন—ওহে বিশ্বপতি, কাগজের মোড়কটা খুলে মানপত্রটা ওর হাতে তুলে দাও।

একটু ইতস্তত করে বিশ্বপতিবাবু কাগজের মোড়কটা খুলে ফেললেন, বেরিয়ে পড়ল দুহাত মাপের একটা মানকচুর পাতা।

গিরিজাবাবু এক লাফে আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। গলার মালা ফেললেন ছিড়ে। শরৎবাবুর দিকে বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি হেনে বললেন–বুঝতে পেরেছি শরৎজা। আমাকে নিয়ে এই যে ধ্যাষ্টামোটা হল তার মূলে রয়েছেন আপনি।

শরৎদা চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব এনে বললেন–আমি কি করে জানব। বিশ্বপতির উপর ভার ছিল মানপত্র আনবার, কথাটা ও রেখেছে।

আপনার সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। আমি চললুম।

শরৎদা বললেন–তার আগে তোমার সঙ্গে অন্তত ফটোগ্রাফটা তুলে রাখা যাক। ফটোগ্রাফারকে তাই সকাল থেকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

শরৎদার এই কথায় কাজ হল। শরৎবাবুর ওপর যতই রাগ হোক না কেন। ওঁর সঙ্গে একটা ছবি তুলে রাখার লোভ কার না আছে। গিরিজাবাবু রাজী হতেই ওঁকে মাঝখানে রেখে সবাই মিলে ছবি তোলা হল। গিরিজাবাবুর মাথার পিছনে অতি সন্তর্পণে যে মানকচুর পাতাটা তুলে ধরা হয়েছিল গিরিজাবাবু তা জানতে পেরেও না জানার ভান করেছিলেন।

বিশুদা এবার থামলেন। আমরা সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম সেই ফটোগ্রাফটা কিভাবে সংগ্রহ করা যায়।

বিশুদা বললেন—দুঃখের কথা আর বলেন কেন। সেই ফটোগ্রাফ সংগ্রহের চেষ্টা আমরা কি কম করেছি। কবি-পত্নী তমাললতা বা গিরিজাবাবুর কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে হুকুম দিলেন—যতটাকা লাগে এক্ষুনি গিয়ে ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে নেগেটিভটা কিনে আনতে। এবং গিরিজবাবু তা করেও ছিলেন। পরে সে নেগেটিভের আর কোন পাত্তা পাওয়া গেল না।

প্রশ্ন দেখা দিল শরৎচন্দ্র গিরিজাবাবুকে নিয়ে এরকম রসিকতা করলেন cal

বিশুদা বললেন—আমরা শরৎদাকে এই প্রশ্নই করেছিলাম। শরৎদা বললেন–গিরিজা রোজ সকালে তাড়া তাড়া কবিতা এনে আমাকে শোনাতে লাগল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সারা সকালটাই মাটি।

অমৃত সমান সচক্রের কথা থামতেই আমি বললাম—বিশুদা এবার আরেক দফা চামৃত হয়ে যাক্। অনেকক্ষণ তো গাঁজাখুরী গল্প চালালেন।

বিশুদা ফোঁস করে উঠলেন। বললেন–আপনারা বড়ই বেরসিক। আজকাল ভেজালের যুগে কোন জিনিসটা খাঁটি? গল্পে কিছু ভেজাল যদি এসেই থাকে দোষ কি।

দোষ নেই। তবে গিরিজাবাবুকে নিয়ে শরৎবাবু এরকম নির্মম রসিকতা কেন করলেন সেইটাই বুঝতে পারছি না।

বিশুদা বললেন–কী করে বুঝবেন। গিরিজাবাবুর পাল্লায় কোনোদিন তো পড়েন নি। তাছাড়া এ আর কি শুনলেন? শরৎদা রবীন্দ্রনাথকে একবার কী রকম জব্দ করেছিলেন সে ঘটনাটা বলি।

পথের দাবী বই বাজেয়াপ্ত হবার পর বন্ধুদের পরামর্শে শরৎদা রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন যে সাহিত্যের উপর ইংরাজ সরকারের এই অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দিতে। রবীন্দ্রনাথ শরৎদার এই অনুরোধ রক্ষা করতে পারেন নি এবং কেন পারেন নি তা এক দীর্ঘপত্রে রবীন্দ্রনাথ শরৎদাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পণ্ডিচেরীর দিলীপকুমার রায় যখন লোকমুখে শুনলেন যে রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের অনুরোধ রাখেন নি, ছুটে চলে এলেন শরৎদার কাছে। শরৎদাকে একটু উস্কে দেবার বাসনায় সান্ত্বনার সুরে বললেন—কবি আপনার অনুবোধ উপেক্ষা করে আপনার খুবই ক্ষতি করলেন।

শরৎদা মুচকি হেসে বললেন—ওহে মণ্টু, কবি আমার আর কী এমন ক্ষতি করলেন। আমি ওঁর যা ক্ষতি করেছি জীবনে তা উনি ভুলতে পারবেন না। গিরিজাকুমার বসুর সঙ্গে কবির আলাপ করিয়ে দিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *