১১. পুষ্পকে নতুন শাড়ি কিনে দেয়া হয়েছে

পুষ্পকে নতুন শাড়ি কিনে দেয়া হয়েছে। সবুজ রঙের শাড়ি। কালো শরীরে সবুজ শাড়ি এত সুন্দর মানিয়েছে! নীতুর একটু মন খারাপ লাগছে–কেন তার গায়ের রং এত ফর্সা হল! গায়ের রঙ পুষ্পের মত কুচকুচে কালো হলে সেও অবশ্যি একটা সবুজ শাড়ি কিনত। পুষ্প আজ তার বিছানা-বালিশ নিয়ে এসেছে। এখন থেকে রাতেও এই বাড়িতে থাকবে। বিছানা-বালিশ বলতে একটা মাদুর আর একটা বালিশ। বালিশটা খুব বাহারী–ফুল লতা পাতা আঁকা। সরু সূতায় পুষ্পের নাম লেখা।

নীতু এখন শাহানার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে না। তার জন্য আলাদা ঘর। সে এবং পুষ্প এই ঘরে শোয়। ঘরটা নীতুর খুব পছন্দ হয়েছে। এই ঘর থেকে হাওড় দেখা যায়। তবে এই ঘরের সমস্যা একটাই ভোরবেলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো একেবারে মুখের উপর এসে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায়। ছুটিছাটার দিনে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমুতে ইচ্ছা করে। এই ঘরে থাকলে সে উপায় নেই।

সন্ধ্যা সাতটা। ইরতাজুদ্দিন কিছুক্ষণ আগে নীতুকে খামবন্ধ চিঠি দিয়েছেন। নীতুর বাবার চিঠি। তিনি হাতে হাতেই নীতুর চিঠির উত্তর পাঠিয়েছেন। সেই চিঠি পড়ে নীতুর মন খারাপ হল। কারণ চিঠি পড়ে পরিষ্কার বোঝা যায়, নীতুর বাবা নীতুর। চিঠি না পড়েই জবাব দিয়েছেন। অতি বোকা মেয়েও সেটা বুঝবে। নীতু বোকা মেয়ে না। তিনি লিখেছেন

মা নীতু,

তোমার চিঠি পড়ে খুব ভাল লাগল। দাদার বাড়িতে তোমরা খুব আনন্দ করছ জেনে খুশি হয়েছি। (এই লাইন পড়েই নীতু বঝেছে বাবা চিঠি না পড়েই জবাব দিচ্ছেন। কারণ নীতু তার চিঠিতে কোথাও লেখেনি তারা খুব আনন্দ করছে।

ন তারিখে তোমার মা সিঙ্গাপুর যেতে চাচ্ছে—সে শাহানার বিয়ের কিছু কেনাকাটা করবে। মনে হচ্ছে আমাকেও সঙ্গে যেতে হতে পারে। কাজেই ইচ্ছা করলে তোমরা দাদার বাড়িতে কয়েকদিন বেশি কাটিয়ে আসতে পার।

(নীতু পরিষ্কার বুঝছে চিঠির এই প্যারাটি আপার জন্যে লেখা। বাবা জানেন আপা এই চিঠি পড়বে। পড়ে জানবে যৈতার বিয়ের কেনাকাটার জন্যে তাঁরা সিংগাপুর যাচ্ছেন। এই কথাগুলি আপাকে আলাদা করে চিঠি লিখে জানালেও হত। তা তিনি জানাবেন না।)

পানির দেশে গিয়েছ–সাবধানে থাকবে। হুটহাট করে পানিতে নামার দরকার নেই। তোমার মা ঠিক করেছে এবার ঢাকায় এলেই তোমাকে সাঁতার শেখানো হবে। তোমরা ভাল থেকো। তোমার জন্যে গল্পের বই পাঠালাম। ইতি তোমার বাবা…

চিঠিতে কোথাও নীতুর বান্ধবীর জন্মদিনের কথার উল্লেখ নেই। চিঠি পড়লে তবে তো উল্লেখ থাকবে। তবে নীতু জানে, তার বান্ধবী যথাসময়ে টেলিফোন পাবে। বাবা তার চিঠিটা তার সেক্রেটারীকে দেবেন। সেক্রেটারী চাচা সেই চিঠি ফাইলবন্দী করবেন–চিঠিতে জরুরি কোন ব্যাপার থাকলে সেই মত ব্যবস্থা করবেন।

নীতু বাবার চিঠি হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। বইয়ের প্যাকেট খুলে দেখতে ইচ্ছা করছে না। রাগ লাগছে। সে চিঠি নিয়ে উঠে গেল–আপাকে পড়তে দিতে হবে। তার নিজের চিঠি–অন্যকে পড়তে দিতেও ভাল লাগে না। চিঠি তো আর গল্পের বই না যে সবাই মিলেমিশে পড়বে।

শাহানা তার ঘরে বাতি নিভিয়ে শুয়েছিল। মাত্র সাতটা বাজে। এই সময় কেউ বিছানায় শুয়ে থাকে? নীতু দরজার বাইরে থেকেই ডাকল–আপা আসব?

শাহানা বলল, আয়।

ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি কেন?

এম্নি শুয়ে আছি।

মাথাব্যথা নেই তো?

না।

মন খারাপ?

হুঁ। মন একটু খারাপ।

কেন?

শাহানা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, জানি না কেন। যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোকে জানাতেম।

বাবা আমাকে চিঠি লিখেছেন–পড়বে?

উহুঁ।

চিঠিতে তোমার একটা খবর আছে।

কি খবর?

নীতু এসে খাটে পা দুলিয়ে বসল। পা নাচাতে নাচাতে বলল, তোমার তো খুব বুদ্ধি, দেখি আন্দাজ কর তো কি খবর।

ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারলে আমাকে কি দিবি?

যা চাইবে তাই দেব।

শাহানা তরল গলায় বলল, আমার বিয়ে সংক্রান্ত কোন খবর আছে। হয়ত ডেট ফাইন্যাল হয়েছে কিংবা মা বিয়ের কেনাকাটার জন্যে কোলকাতা বা ব্যাংকক যাচ্ছেন। ঠিক হয়েছে?

হুঁ।

নীতু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। আপার বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে তার এত বিস্ময়বোধ হয়! সব মানুষের বুদ্ধি যদি আপর মত হত তাহলে পৃথিবীতে বাস করাই কঠিন হত। ভাগ্যিস সবার বুদ্ধি আপার মত না।

আপা।

উঁ।

পুষ্প মেয়েটাকে তোমার কাছে কেমন লাগছে?

ভাল তো। সারাক্ষণ তোর পেছনে ঘুর ঘুর করছে। মেরী হ্যাড এ লিটল ল্যাম্বের মত অবস্থা।

খুব মিথ্যা কথা বলে আপা–বানিয়ে বানিয়ে সারাক্ষণ মিথ্যা গল্প।

গল্প তো বানিয়ে বানিয়েই বলতে হবে–টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি এঁরা তো বানিয়ে বানিয়েই গল্প লেখেন।

আচ্ছা আপা, তুমি কি খুব বড় ডাক্তার?

হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?

সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে তুমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তার।

কে ছড়াল? পুষ্প?

খোদেজার মা নামের একজন ধাই আছে–সে ছড়াচ্ছে আর পুষ্প ছড়াচ্ছে–কথা ছড়ানোয় এই মেয়ে ওস্তাদ। কোথাও কিছু শুনলেই দশ জায়গায় ছড়াবে।

এই গ্রামে কোথায় কি হচ্ছে তুই তাহলে সব জানিস?

হুঁ জানি। মতি মিয়া নামে যে গায়ক আছে সে নাকি যেখানে যত কঠিন রোগ আছে তাদের সবাইকে শুক্রবার তাঁর বাসায় যেতে বলেছে।

রোগিদের নিয়ে মিছিল করবে?

উহুঁ–শুক্রবারে তিনি তোমাকে দাওয়াত করে নিয়ে যাবেন। তুমি বিনাপয়সায় সব রোগি দেখে দেবে। পুষ্পের এক বড় বোন আছে, যার নাম–কুসুম। সেও তোমাকে দেখাবে।

কুসুমের কি অসুখ?

কি অসুখ পুষ্প জানে না। পুষ্পের ধারণা, কুসুমের কোন অসুখ নেই–তোমাকে দেখতে চায় এই জন্যে অসুখের ভান করছে। সে নাকি খুব ভান করতে পারে। কুসুমের সঙ্গে জ্বীন থাকে। তোমাকে আেগেই বলেছি।

বললেও ভুলে গেছি। কুসুমের সঙ্গে তাহলে দ্বীন থাকে!

তার চুল খুব লম্বা, একেবারে পায়ের পাতা পর্যন্ত। লম্বা চুলের মেয়েদের খুব জ্বীনে ধরে। এই জন্যে সে ঠিক করে ফেলেছে চুল কেটে তোমার মত ছোট করে ফেলবে।

আমাকে তো সে দেখেনি–বুঝল কি করে আমার চুল ছোট?

তোমাকে দেখেছে। তুমি একবার সাপের আড্ডাখানায় উপস্থিত হয়েছিলে, তখন দেখেছে।

শাহানা আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত গলায় বলল–একটু আগে তোর সঙ্গে আমার একটা বাজি হল না? বাজির শর্ত ছিল–আমি বাজিতে জিতলে যা চাইব তাই তুই আমাকে দিবি।

হুঁ। আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে দেব। কি চাও তুমি?

আমি চাচ্ছি–তুই এখন চলে যা। কথা বলতে আর ভাল লাগছে না।

নীতু আহত গলায় বলল, তুমি এম্নি বললেও তো আমি চলে যেতাম–শুধু শুধু, বাজির কথা তুললে কেন? আমার কথা শুনে তুমি বিরক্ত হচ্ছ এটা প্রথমে বললেই হত।

চট করে উঠে দাঁড়াল। তার কান্না পেয়ে গেছে। কেঁদে ফেলার আগেই তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সে ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে মাথা ফুলিয়ে ফেলল।

 

নীতুর খুব একা একা লাগছে। মনে হচ্ছে সারা বাড়িতে সে একা। পুষ্প থাকলে এতটা একা লাগত না। পুষ্প গেছে তার মার কাছে। নতুন শাড়ি সে তার মাকে দেখাতে গেছে। রাতে মনে হয় আর ফিরবে না। দাদাজান বাংলোঘরে। প্রতি রাতেই তিনি একা একা দীর্ঘ সময় বাংলোঘরে বাতি জ্বালিয়ে বসে থাকেন। এই সময় কেউ আশেপাশে গেলেই তিনি বিরক্ত হন। সবাইকে মনে হয় চিনতেও পারেন না। গত রাত্রে নীতুর কিছু করার ছিল না–বাংলোঘরের দিকে গেছে। জানালা দিয়ে বুকে, দেখতে পেয়ে দাদাজান ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?

নীতু বলল, আমি।

দাদাজান ভুরু কুঁচকে তাকিয়েই রইলেন। মনে হল চিনতে পারছেন না। নীতু প্রায় পালিয়ে চলে এল।

আচ্ছা এখন সে কি করবে? আপার কাছে যাওয়া যাবে না। দাজানের কাছে যাওয়া যাবে না, সে করবে কি? গল্পের বই পড়বে? গল্পের বই পড়তে তার কখনই খারাপ লাগে না–কিন্তু এখন পড়তে ইচ্ছা করছে না। এই বাড়িতে রাতে গল্পের বই পড়ার অনেক অসুবিধা। আলো কম। কিছুক্ষণ বই পড়লেই তার মাথা ধরে যায়।

নীতু রান্নাঘরের দিকে গেল। রমিজার মা রান্নাঘরে আছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যায়। এই মহিলাটাও খুব ভাল শুধু হাসে। নীতু বলেছিল, আপনি এত হাসেন কেন? সে বলেছে–মনের দুঃখে হাসি। মনে দুঃখ বেশি তো, এই জন্যে হাসিও বেশি। দার্শনিক ধরনের উত্তর। নীতুর ধারণা, গ্রামের মানুষরা সহজ সরল হলেও সহজভাবে তারা কথা বলতে পারে না। সব কথাতেই শেষ দিকে তারা ছোট একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। এদের কথা বলার ধরনই বোধহয় এ রকম।

নীতু রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কি করছেন?

রানতেছি গো ময়না। খিদা লাগছে?

উহুঁ।

দেরি হইব না, তরকারি নামালেই ভাত দিয়া দিমু।

আপনারে তো বলেছি–আমার খিদে লাগেনি।

কোন দুপুরে ভাত খাইছ–খিদা তো লাগনেরই কথা।

বলেছি তো খিদে হয়নি।

নীতু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। গ্রামের মানুষের এই আরেক সমস্যা–তারা নিজে কি ভাবছে সেটাই বড়। অন্যে কি ভাবছে কি ভাবছে না সেটা জরুরি না। নীতু রান্নাঘর থেকে বের হল। ছাদে উঠলে কেমন হয়? কাঠের সিড়ি তো আছেই–চুপি চুপি উঠে গেলেই হয়। ছাদে উঠে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা। এর মধ্যে যদি আপা তাকে খুঁজতে শুরু করে এবং খুঁজে না পায় তাহলে বেশ ভাল হয়। তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার শাস্তি হয়।

ছাদের সিঁড়িটা নড়বড়ে। নিচ থেকে একজনকে ধরতে হয়, তবু খুব সাবধানে উঠলে হয়ত ওঠা যাবে। নীতু সাবধানী মেয়ে। সে সাবধানে উঠবে। হঠাৎ করে বৃষ্টি না নামলেই হয়। আর নামলেও ক্ষতি কি সে ভিজবে। একটু ভিজলেই তার ঠাণ্ডা লাগবে জ্বর হবে নিওমোনিয়া হবে অনেক চিকিৎসা করেও তাকে বাঁচানো যাবে না।

 

শাহানা অনেকক্ষণ হল ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ত যে শুয়ে আছে। ঠিক আলসেমির জন্যে যে শুয়ে আছে তা না–ভাল লাগছে না। মানুষের স্বভাব খানিকটা বোধহয় শামুকের মত। নিজের শক্ত খোলসের ভেতর মাঝে মাঝেই তাকে ঢুকে যেতে হয়। অতি প্রিয়জনের সঙ্গও সে সময় অসহ্যবোধ হয়।

শুয়ে শুয়ে শাহানা ভাবছে, অতি প্রিয়জন বলে তার কি কেউ আছে? মা-বাবাকে প্রিয়-অপ্রিয় কোন দলেই ফেলা যায় না। মা-বাবা শরীরের অংশের মত। কারোর হাত বা পা যেমন প্রিয়-অপ্রিয় কোনটাই হতে পারে মা, মা-বাবাও পারে না। ভাই বোন শরীরের অংশের মত নয়। প্রিয়-অপ্রিয় ব্যাপারটা তাদের ক্ষেত্রে হয়ত আসে… নীতু তার খুবই প্রিয়। কিন্তু নীতুর বছরের বড় মিতু তার তেমন প্রিয় নয়। মিতুর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে লাগে না। মিতুর কথা দীর্ঘ সময় শুনতেও ভাল লাগে না। অথচ মিতু চমৎকার একটা মেয়ে। তাহলে সে তার প্রিয় নয় কেন? রহস্যটা কোথায়?

শাহানা সুখানপুকুর আসবে শুনে সবচে বেশি লাফালাফি শুরু করেছিল মিতু। শাহানা বলল, দল বেঁধে সবাই চলে গেলে মার সঙ্গে কে থাকবে? মার শরীর ভাল না। মার সঙ্গে তো একজন কারও থাকা দরকার। মিতু কয়েক মুহূর্ত শাহানার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আচ্ছা আমি থাকব। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার মধ্যে মিতু চোখে চোখে অনেক কথা বলে ফেলল। সেই কথাগুলি হচ্ছে—তুমি আমাকে নিতে চাচ্ছ না কেন আপা? আমি কি করেছি? কিছুদিন পরে তুমি বাইরে চলে যাচ্ছ, আবার কবে আসবে না আসবে কে জানে! এই কিছুদিন তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চাই। তুমি তাতে রাজি হচ্ছ না কেন? আমি যে তোমাকে কি প্রচণ্ড ভালবাসি তুমি জান না?

মিতুর প্রতি কি শাহানার গোপন কোন ঈর্ষা আছে? হয়ত আছে। ঈর্ষা করার মত কিছু কি তার আছে? মিতু সহজ সরল ধরনের মেয়ে। তার পড়তে ভাল লাগে না। বইয়ের ধারে কাছেও সে যায় না।

পরীক্ষার আগে আগে বই নিয়ে বসে আর প্রতি দশ মিনিট পর পর বলে–সর্বনাশ হয়েছে, এইবার ধরা খাব।

মা কঠিন গলায় বলেন–ধরা খাব আবার কি রকম কথা? ধরা খাব মানে কি?

ধরা খাব মানে হচ্ছে গোল্লা খাব।

কথাবার্তাগুলি আরেকটু সুন্দর কর মা।

আচ্ছা যাও–এখন থেকে সুন্দর করে কথা বলব–শান্তিনিকেতনী ঢং-এ অর্ধেক কথা বলব নাকে–হি হি হি।

মিতু কোন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারেনি–সব পরীক্ষায় টেনে টুনে সেকেন্ড ডিভিশন মার্ক। এতেই সে খুশি। সে সব কিছুতেই খুশি। তাকে কেউ বকলেও সে খুশি। যেন এই পৃথিবীতে সে বকা খেয়ে খুশি হবার জন্যে এসেছে। মিতুকে কি শাহানা তার এই খুশি হবার অস্বাভাবিক গুণের জন্যে ঈর্ষা করে? করতে পারে।

শাহানার বিয়ে ঠিকঠাক করার পর তার মন খুব খারাপ হল নিতান্তই অপরিচিত একটি ছেলে। কয়েকদিন মাত্র দেখা হয়েছে। দুবার রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা খেয়েছে। একবার গাড়িতে করে মেঘনা ব্রীজ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছে। ছেলেটি কেমন সে কিছুই জানে না। তার সঙ্গে জীবনের বাকি অংশটা কাটাতে হবে। কি রকম হবে সে জীবন? গভীর রাতে যদি তার হঠাৎ প্রিয় কোন বইয়ের কয়েকটা পাতা পড়তে ইচ্ছা করে তাহলে সে কি বলবে—রাত তিনটায় বাতি জ্বালিয়েছ কেন? বাতি নেভাও। চোখে আলো লাগছে। কিংবা মাঝে মাঝে যখন মানুষের শামুকের মত তার নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে তখন সে বিরক্ত হয়ে বলবে না তো–কি হয়েছে তোমার, দরজা বন্ধ করে বসে আছ কেন? সমস্যাটা কি? সে তো সমস্যাটা কি বলতে পারবে না। তখন কি হবে? বিয়ের কিছুদিন পর ছেলেটিকে যদি অসহ্যবোধ হয়–তখন? বুক ভর্তি ঘৃণা নিয়ে সে প্রতি রাতে তার সঙ্গে ঘুমুতে যাবে? মাঝে মাঝে সে যখন জড়ানো গলায় বলবে–এই, কাছে আস। তখন তাকে কাছে এগিয়ে যেতে হবে? সমস্ত অন্তরাত্মা হাহাকার করে উঠলেও তাকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে হবে ঘামে ভেজা একটা শরীর। কোন মানে হয়?

এই অবস্থায় মিতু একদিন এসে বলল–আপা, তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। শুনবে?

শাহানা না বলার আগেই মিতু তার কথা বলা শুরু করল—বিয়ে ঠিকঠাক হবার পরে তুমি ভয়ে এমন অস্থির হয়ে পড়েছ কেন? একজন মানুষের ভেতর অনেক রহস্য থাকে, বুঝলে আপা, রহস্যের জট খুলতে খুলতে সাত-আট বছর লেগে যায়। এই সাত-আট বছরে সংসারে নতুন শিশু আসে–পারিবারিক বন্ধনে জড়িয়ে যেতে হয়। বিয়েটা মজার এবং আনন্দের একটা ব্যাপার। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার ফঁসির হুকুম হয়েছে। আর তুমি তো প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি তো তোমার স্বামীকে খুব সাবধানে নিজের মত করে তৈরি করে নিতে পারবে। তুমি যা চাও, দেখবে, আস্তে আস্তে অবস্থা এমন হবে যে ভদ্রলোকও তা-ই চাইবেন। মাঝরাতে বাতি জ্বালিয়ে গম্ভীর গলায় বলবেন–শাহানা, কিছু মনে কর না, হঠাৎ ঘুম ভাঙল। এখন আমার প্রিয় উপন্যাসের পাতা না পড়লে আর ঘুম আসবে না। অবস্থা এ রকম হতে বাধ্য। অসুবিধা হবে আমার বা আমার মত মেয়েদের।

কি অসুবিধা?

আমি তো আপা হাবা-টাইপ মেয়ে। আমি বিয়ের পর পর স্বামীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকব। আমার মনে হতে থাকবে, এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে স্বামী নামক মানুষটিকে খুশি করার জন্যে এবং সেই খুশি করতে গিয়ে এমন সুর ছেলে মানুষি করব যে আশেপাশের সবাই বলবে-ছিঃ ছিঃ!মেয়েটার কি লজ্জাশরম নেই?

তোর কি ধারণা তুই হাবা-টাইপ মেয়ে?

না, আমি আসলে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে, তবে চিন্তা-ভাবনা করি হাবার মত।

কেন?

এম্নি। আচ্ছা তুমি এমন মুখ শুকনো করে থেকো না। চল এক কাজ করি–তিনজনে মিলে কোথাও ঘুরে আসি–খুব হৈ চৈ করে আসি।

কোথায় যাবি?

সুখানপুকুর যাবে? চল দাদাজানকে দেখে আসি। ঐ বাড়িটাতে আমার খুব যেতে ইচ্ছা করে। চল না আমরা তিন বোন মিলে হুট করে এক রাতে উপস্থিত হয়ে দাদাজানকে চমকে দেই।

শাহানা শান্ত স্বরে বলেছিল, কাউকে চমকে দিয়ে আমি তোর মত আনন্দ পাই না। আমি ঢাকাতেই থাকব–কোথাও যাব না।

শহরের বাইরে কিছুদিন থাকলে তোমার কিন্তু খুব ভাল লাগবে আপা। ঠাণ্ডা মাথায় বিয়ে টিয়ে এইসব নিয়ে চিন্তা করতে পারবে। এক কাজ কর–আমাদের নেবার দরকার নেই–তুমি বরং মনসুর ভাইকে নিয়ে যাও। বিয়ের আগের ভালবাসাবাসি দাদাজানের রাজপ্রাসাদে হোক। আমি বলব মনসুর ভাইকে?

না।

একটা সেকেন্ড থট দাও আপা, প্লীজ।

কোন থটই দেব না।

শাহানা তার কথা রাখেনি। ঢাকার বাইরে তার থাকার ব্যাপার নিয়ে সে অনেক ভেবেছে। তারপর হঠাৎ ঠিক করেছে–সে যাবে সুখানপুকুর কিন্তু মিতুকে সঙ্গে নেবে না। মানুষের মন এত বিচিত্র কেন?

 

বৃষ্টি পড়ছে। কি সুন্দর ঝম ঝম শব্দ! শাহানা উঠে বসল। রমিজের মা হারিকেন ” হাতে ঘরে ঢুকে বলল–ছোট আফা কই? ছোট আফা?

ঘরেই আছে। কোথায় যাবে।

ঘরে নাই। আমার বুক ধড়াস ধড়াস করতাছে আফা।

বুক ধড়াস ধড়াস করার কিছু নেই–ও ছাদে উঠে ভিজছে।

কি কন আফা! কি সর্বনাশের কথা!

কোন সর্বনাশের কথা না–চল যাই, আমি নামিয়ে আনছি।

বৃষ্টিতে ভিজে ছাদ পিচ্ছিল হয়ে আছে। রেলিং-নেই ছাদের এক কোণায় উবু হয়ে নীতু বসে আছে। শাহানা বলল, কি হয়েছে নীতু?

নীতু জবাব দিল না।

তুই কি আমার উপর রাগ করে ছাদে এসে বসে আছিস?

হুঁ।

আয় নিচে যাই। সাবধানে পা ফেলবি। যা পিছল ছাদ! আমার হাত ধর।

নীতু বলল, আমার কারো হাত ধরার দরকার নেই।

সময় হোক তখন দেখা যাবে, কারোর না কাঠের হাত ধরার জন্যে পাগল হয়ে গেছিস।

রমিজার মা নিচে কাঠের সিড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রমিজার মার পাশে ইরতাজুদ্দিন সাহেব। একজন কামলা ইরতাজুদ্দিন সাহেবের মাথায় ছাতা ধরে আছে। ইরতাজুদ্দিন সাহেব বিস্মিত হয়ে ভাবছেন–মেয়ে দুটির মাথা কি পুরোপুরি খারাপ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *