পুঞ্জপুঞ্জ মেঘে-ছাওয়া সকালের আকাশ। পুর্ব থেকে পশ্চিমের দিগন্তে পাড়ি জমানো মেঘ পলকে পলকে রূপ বদল করছে। চলার শেষ নেই। কখনো দল বেঁধে গায়ে গায়ে, কখনও টকুরো টুকরো মেঘ যেন আজ আচমকা পশ্চিম দিগন্তের ডাকে সাড়া দিয়ে মহাসমারোহে চলেছে ছুটে। দল যখন জমাট বেঁধে ওঠে মনে হয় গতিরুদ্ধ মেঘ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করছে। তারপরেই আবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো। বন্দি বিহঙ্গ খোলা পেয়েছে আজ পিঞ্জরের দ্বার, মুক্ত অবাধ বিশৃঙ্খল তার গতি।
এবছর আশানুরূপ বৃষ্টি হয়নি। সকলেই বৃষ্টির জন্য প্রতীক্ষা করছিল। তা ছাড়া, কয়েক বছর ধরে চাষের কাজে জলের রীতিমতো অভাব দেখা দিয়েছে। রেললাইনের উঁচু জমি দিগন্তবিস্তৃত চাষের মাঠকে দু ভাগ করে প্রাচীর-অবরোধ খাড়া করেছে। বাধা পড়েছে জল চলাচলে। নয়ানজুলিগুলি বেশিরভাগ সময় শুকিয়েই থাকে। বৃষ্টি না হলে তো কথাই নেই। গঙ্গার জল আসার যেসমস্ত সুদীর্ঘ নালাগুলি রয়েছে সেগুলি বহুদিন কাটার অভাবে বুজে আসছে ক্রমাগত। একধারে জল যদিও বা আসে, অন্যদিকে যাওয়ার পথ রেললাইন বন্ধ করে দিয়েছে। মুক্তাপুরের খাল এমনিতেই ব্যাহত হয়েছে রেললাইনের জন্য। তা ছাড়া, বহুদিনের সংস্কারহীনতার জন্য খাল ক্রমাগত সংকীর্ণ ও অগভীর হয়ে আসছে। আশঙ্কা হয়, অদূর ভবিষ্যতে এ খাল মাঠের বুকে শুকনো নয়ানজুলির মতো একটি ক্ষীণ রেখায় পর্যবসিত হবে।
রান্নাঘরে কাজ করতে করতে কালীবউ আপনমনেই বলে উঠল, পোড়ামেঘের দিনক্ষণ ঠিক নেই বাপু। আজ কোথায় ঝোলন পুন্নিমে, তা না আজকেই মেঘের ছড়াছড়ি।
লখাই গোয়ালের কাছে বসে বিচুলি কাটছিল। সে একবার আকাশের দিকে দেখে আবার বিচুলি কাটায় মন দিল। শ্যাম বাড়ি নেই। মধুকে সঙ্গে নিয়ে সে ফরাসডাঙার গঞ্জে গিয়েছে বাজার করতে।
কালী আরও খানিকক্ষণ মেঘ ঝুলন এবং অতীতের ঝুলন উৎসবের গল্প আপন মনে বকবক করে জিজ্ঞেস করল লখাইকে, তুমি গাঁয়ে যাবে তো গো?
লখাই জবাব দিল,, একবার যাব।
কালী ঘর থেকে বেরিয়ে একমুহূর্ত ঠোঁট টিপে লখাইকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, অমন টেনে বলছ যে?
লখাই নীরবে একটু হাসল মাত্র।
কালী বলল, মোরলি বাবাজির নেমন্তন্নে একবার যাবে কেন, মন-পান তো তোমার সব সময় গিয়েই আছে।
মুরলী নিমন্ত্রণ করেছে লখাইকে আজ ঝুলনপুর্ণিমার। একা নয়, কাঞ্চনসহ যুগলে।
লখাই বলল, সত্যি, মোরলিদাদার মতো মানুষ হয় না।
ফিরে যেতে যেতে, কালী আবার একটু তাকিয়ে থেকে বলল, তা অত যার সেবাদাসী, সে মন্দ হবে কেন! তবে তুমি একটু সাবধান থেকো বাপু।
ঠাট্টাই হোক, আর আশঙ্কাই হোক, কালীর একথা পুরনো। লখাই হাসল।
কালী ঘরে ঢুকে বলল, তা যাবে তো ওঠো, আর দেরি কেন?কাঞ্চী তো নেয়ে এল বলে।
হাঁ, যাই। বলে সে বিচুলিকাটা শেষ করে সব গুছিয়ে রেখে উঠল।
কাঞ্চনকে নিয়ে লখাই যখন মুরলীর আখড়ায় এল, বেলা তখন অনেকখানি। মেবে হয়েছে, তত টের পাওয়া যায়নি।
মুরলীর আজ বিচিত্র সজ্জা। নীল শাড়ি একখানি পরেছে দুভাঁজ করে কাছা না দিয়ে। গায়ে বাসন্তী বর্ণের ওড়না গলার দুপাশ দিয়ে মাটি স্পর্শ করেছে। সর্বাঙ্গে কৃষ্ণনামের ছাপ, কুঞ্চিত আধপাকা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। নতুন তুলসীর মালা গলায়। চোখে কাজল টেনেছে। গোঁফদাড়ির চিহ্ন মাত্র নেই সারা মুখে। মুখে তার মিষ্টি হাসি।
আখড়ারও আজ রূপ খুলেছে। লতায় পাতায় ফুলে চারদিক সাজানো। সব যেন তেল দিয়ে লেপাপোঁছা হয়েছে। এত ফুলে সাজানো হয়েছে অথচ আখড়ার কোনও গাছের একটি ফুলও ভোলা হয়নি। কপূরমিশ্রিত পায়েসের গন্ধে ভরে উঠেছে আখড়া। মুগডালের খিচুড়ির মধ্যে সম্বরা, বিশেষ আদার মিশ্রিত গন্ধটি, বড় অপূর্ব।
দুরাগত অপরিচিত কয়েকজন বাবাজিও এসেছে। মন্দিরের দাওয়ায় বসে তারা নিম্ন বিলম্বিত শব্দে শুরু করেছে নামগান।
কাঞ্চন লখাই এসে দাঁড়াতেই মুরলী দুখানি মালা নিয়ে তাড়াতাড়ি উভয়ের গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, মন্দিরের যুগলকে মালা দিয়েছি বহুক্ষণ, এ যুগল বাকি ছিল। এত দেরি হল যে?
মালা পরে লখাইয়ের লজ্জা হল। সে বন্দুকধারী প্রহরী, জীবন তার দুর্ধর্ষ, তার উপর বাগদীঘরের সে আজ উদ্ধত পুরুষ। কিন্তু এখানে এলে সে যেন কেমন শান্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুরলীর সামনে।
কাঞ্চন কিন্তু তেমনি উদ্ধত, বলিষ্ঠ, বঙ্কিম হাসিতে ধারালো কাস্তের মতো শাণিত। আর তার শাণিত চোখের দৃষ্টি আখড়ার প্রতিটি কোণে দরজায় চক্রাকারে একবার ঘুরে এল যেন কার সন্ধানে। তারপর সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার দেখল লখাইয়ের মুখ। দেখে মুরলীকে বলল, বেলা ঠাওর পাইনি। তায় আবার তোমার কান্ত যা কুঁড়ে, বাবা গো। সে কোন্ সকালে স্কুিলি কাটতে বসেছে। ওঠার আর নাম নেই।
মুরলী বলল অপাঙ্গে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে, কান্তার মুখ চিন্তা করলে এটু দেরি লাগবেই তো।
কান্তা কেন, রাইকিশোরী না? চোখের কোণে উদ্দাম কটাক্ষ করে কাঞ্চন বলল।
মুরলী তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে বলল, ভুল মানি রাইকিশোরী, কৃষ্ণরানী, আমার কালো, পানকাত্তর পানহারিণী! এসসা, বসবে এসো। সকলে হেসে উঠল সশব্দে। তার মাঝে কাঞ্চনের হাসি বেজে উঠল বেলোয়ারি কাচের চুড়ির রিনিরিনি শব্দে। সকলেই দক্ষিণ ভিটার বারান্দায় গিয়ে বসল।
এমন সময় আখড়ার মেয়ে সরি অর্থে সারদা, একগোছ ফুলের মালা কলাপাতায় মুড়ে মন্দিরে ঢুকতে গিয়ে কাঞ্চন-লখাইকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
লখাই সেদিকেই তাকিয়েছিল। আলোয় ভরে উঠল সারদার শ্যাম শান্ত মুখ। একহারা ছিপছিপে শ্যামল লাউডগার মতো নরম নিটোল সারদা। প্রতিমুহূর্তে যেন কীসের লজ্জায় হাসি ও ত্রাসে চঞ্চল। কীসের দুরন্ত বেগে যেন সে সবসময়েই অমানুষিক পরিশ্রম করে আর দুরন্ত হাসিতে মাঝে মাঝে আখড়ার ভাবগাম্ভীর্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
কাঞ্চনের বঙ্কিম চোখ দপ করে জ্বলে উঠে আরও বেঁকে উঠল। দ্রুত নিশ্বাসে বুক দুলে উঠল, ফুলে উঠল নাকের পাটা। ঠোঁটের দুই পাশে এক নিষ্ঠুর অভিসন্ধি থেকে থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠল। লখাইয়ের মুগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সারা মুখে তার রক্তের বান ডাকল।
পিঠের উপর খোলাচুলে ঝাঁকানি দিয়ে মুখ ঢেকে সারদা মন্দিরে ঢুকে গেল।
কাঞ্চন চকিতে বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল আখড়ার বাইরে।
মুরলীদাস ঘর থেকে বেরিয়ে কাঞ্চনকে চলে যেতে দেখে বলল, রাইকিশোরী কোথায় যায় গো!
লখাই ফিরে দেখল কাঞ্চন চলে গেছে। বলল, কোথায়?
মুরলী বলল, বাইরে চলে গেল যে!
ধক করে উঠল লখাইয়ের বুকের মধ্যে। সে তাড়াতাড়ি নেমে বাইরে ছুটে গেল। মনে তার ঠিকই লেগেছে কাঞ্চনের ব্যাপার। তাই সে উৎকণ্ঠিত হয়ে পেছন-ধাওয়া করতে গিয়ে দেখল, পরিত্যক্ত জংলাঘাসে ভরা নীলখেতের উপর দিয়ে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য কাঞ্চন চলেছে।
সে তাড়াতাড়ি পেছন থেকে কাঞ্চনের কাপড় ধরে ফেলে ডাকল, কাঞ্চীবউ।
না ফিরেই কাঞ্চন কাপড় টেনে বলে উঠল, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, মিসে। নইলে তোরই একদিন কি আমার একদিন।
লখাই তাকে ধরে মুখের সামনে এসে বলল, কী হয়েছে কাঞ্চীবউ, বল।
কাঞ্চন দু হাতে প্রায় থাপ্পড় মারার মতো সজোরে লখাইয়ের মুখ চাপা দিয়ে খিঁচিয়ে উঠল, না না, আমি তোর কাঞ্চীবউ লই, লই। আমি তোর শত্রুর।
কেন কাঞ্চীবউ?
কেন? সাপিনীর মতো উদ্যত ফণা তুলে কাঞ্চন দুহাতে চোখের জল মুছে বলল, বেইমান, তুই বেইমান।
কাঞ্চীবউয়ের মিসে হয়ে সরি বোষ্টমীর সঙ্গে পিরিত করি। মোনর ছেলে সাপ, তোকে বিশ্বাস নেই।
লখাইয়ের সারা মুখ নিশ্চিন্ত নিস্পাপ, কিছুটা বা বিব্রত। সে শক্ত হাতে কাঞ্চনকে ধরে বলল, মিছে কথা কাঞ্চী, পিরিত লয়, সরি বোষ্টমীকে দেখে কেমন ধন্দ লাগল।
সর্বোনেশে মিসে, ওই ধন্দ কী, তা কি আমি জানিনে? অমনি করেই পিরিত হয়।
না। পিরিত লয়। তুমি থাকতে এ মনে আর কারওর ঠাঁই নেই।
তবে আমি যে দেখলাম।
ওটা পিরিত লয়। মুরলীদাদার সঙ্গে কীসের পিরিত আছে।
ছি, মরণ নেই আমার।
তবে? সরি বোষ্টমীও তাই, আমাদের বন্ধু।
, মেয়েমানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বে দরকার নেই।
বেশ, চল আখড়ায়। তোর কথাই থাকল।
কাঞ্চন হঠাৎ কেঁদে উঠে বলল, তুমি মিসে কাঁদাবে আমাকে?
লখাই তাকে বাহুবেষ্টনে রেখে বলল, ও তোমার ধন্দ কাঞ্চীবউ। বয়সও কি আমার কম হল?
বেলা গড়িয়ে গেল। আকাশে মেঘের ভার কিছুটা কমে এসেছে। বৃষ্টি আসার লক্ষণ নেই।
ঝুলনের আয়োজনে সবাই ব্যস্ত। কাঞ্চন লখাইয়ের দ্বারা যেটা সম্ভব, সে কাজগুলো তারা করছে। ওদিকে নামগান চলছে বিরামহীন।
এমন সময় দুটি গোরা সাহেব তেলেনিপাড়ার জমিদার বাঁড়ুজ্যেবাবুদের এক আমলার সঙ্গে জুতো পায়ে একেবারে সরাসরি মন্দিরের কাছে এসে দাঁড়াল।
নামগান স্তব্ধ হয়ে গেল। মুরলী এবং মেয়েরা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কেবল লখাই এক মুহূর্ত স্থির থেকে এই স্পর্ধিত অনাচার দেখে ক্রুদ্ধ সিংহের মতো ছুটে গেল সেদিকে।
গোরা দুজন হঠাৎ সেই ধাবিত বিভীষণ মূর্তি দেখে দু পা সরে গেল সন্ত্রস্তভাবে।
মুরলী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল লখাইকে। থাম থাম কান্ত লখাই, ঠাকুর সকলেই দেখতে পারে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে গোরাদের দিকে তাকিয়ে বলল লখাই, তা বলে ওই ফিরিঙ্গিরা? কার হুকুমে ওরা আখড়ায় ঢুকেছে? গোরা সাহেবের দুটি মুখ লাল হয়ে উঠল, তারা আমলার দিকে প্রশ্নসূচক ও ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল।
মুরলী শান্ত গলায় বলল, আসুক কান্ত, সবাই তাঁর জীব। শোনননি আনি মহাজন বলেছেন :
খিরিষ্টে আর বিষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই।
রক্তে ইংরেজবিদ্বেষ। জীবনের প্রতিটি দুর্ঘটনাতে বিপদে সে প্রতি মুহূর্তেই গ্রাসোদ্যত ইংরেজকে দেখতে পায়।
কিন্তু লখাই বলল, তোমার আন্টুনি মহাজন কি এমন জুতা পায়েই ভেতরে আসত? যাই বলল মুরলীদাদা, এ ফিরিঙ্গিরা মানুষ নয়, ওদের আস্পদ্দারও শেষ নাই। ওরা আমাদের শর, অজাতের দল।
আমলাও এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথায় শুধু বিস্মিত নয়, ঘাবড়েও গেছেন খানিকটা।
সাহেব দুটি ইংরিজিতে কী যেন বলল। আমলা জিজ্ঞেস করলেন, এ কে মুরলীদাস?
মুরলীদাস বিপদের গন্ধ পেয়ে ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য বলল, কাছেপিঠেই থাকে। কী মনে করে আমলামশাই?
আমলা তার অপমানিত মুখ ফিরিয়ে বললেন, কিছু নয়, এমনি সাহেবরা এদিকটা ঘুরে দেখতে এসেছেন, নীলকুঠির স্যাম সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলবেন। তারপর একটু চুপ থেকে আবার বললেন, তোমার আখড়ার আওতায় সব মিলিয়ে কতখানি জমি পড়েছে মুরলীদাস?
মুরলীদাস চমকে উঠে বলল, তা পেরায় এগারো বারো বিঘে হবে।
সাহেব দুটিও তখন লখাইয়ের দিক থেকে মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে আখড়ার চারপাশটা দেখে নিচ্ছে। কাঞ্চনও তখন লখাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লখাইয়ের উত্তেজনা কমেনি মোটেই এবং আমলার কথাবাতার ধরন দেখে সে বলে উঠল, এ ফিরিঙ্গিদের যদি কোনও কুমতলব না থাকে তো আমার নেই। এ শালার জাত সব করতে পারে।
আমলা একটু চুপ থেকে বললেন, সাহেবরা বাবুদের কাছ থেকে এখানকার সব জমি নেবেন, চটকল উঠবে এখানে।
লখাইয়ের ক্রুদ্ধ মুখ তিক্ত হাসিতে আরও জ্বর হয়ে উঠল। বলল, পানভরে শুনো মুরলীদাদা, তোমার আখড়া ভেঙে চটকল উঠবে। ওরা যে আমাদের মড়ার পরে ওদের মেমরানীকে বসিয়েছে।
বলতে বলতে দারুণ ক্রোধে দাঁতে দাঁত ঘষে দুই হাতের একটা সাংঘাতিক ভঙ্গি করে সে বলে উঠল, শালার জাতের মাথাগুলো ধরে ঘাড় থেকে তুলে ফেলতে হয়।
একটি সাহেব হঠাৎ আর সইতে না পেরে তার অপরিসীম অধ্যবসায়ের ফল বাংলাতে বলল, টুমি বাট কেন করে?
লখাই রুখে উঠে বলল, বাত আমি করব না তো তুই করবি, সাদা ঢ্যামনা। কামান থাকলে তোর মাথা উড়িয়ে দিতাম। কাঞ্চন লখাইকে ধরে হ্যাচকা টান মেরে সরিয়ে নিয়ে এল। মোনসার গোঁ বুঝি, ঘরে চলো তুমি।
সাহেব দুটি বিস্ময়ে রাগে লালমুখ আরও লাল করে স্তম্ভিত কালোমুখ আমলার সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল।
আখড়ার সমস্ত উৎসব আনন্দ নিরানন্দ হয়ে উঠল। কারও মুখে হাসি নেই। নামকীর্তনওয়ালারা বিমর্ষ। তাদের ভক্তি-গদগদ মুখে দুশ্চিন্তা।
কিন্তু আতঙ্কে মুরলীদাসের মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে। সে তাড়াতাড়ি সারদাকে বলল, সরি, বাইরের দরজা বন্ধ করে দে।
তারপর লখাইকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ কী করলে তুমি কাণ্ড লখাই, এ কী সব্বেনাশ করলে?
লখাই বুঝতে পেরেছিল রাগ সামলাতে না পেরে সে কী করেছে। সে মুরলীদাসের দুই হাত ধরে বলল, পারলুম না মুরলীদাদা, এ নিমকহারামের জাতকে আমি কিছুতেই সইতে পারিনে।
সন্ত্রস্ত কাঞ্চন বারবার বলতে লাগল, কেন কেন গো, এমন মতিগতি কেন তোমার? এখন যদি কোনও বিপদ হয়?
যদি হয়, হবেই। মুরলীদাস বলল দারুণ উল্কণ্ঠায়, তোমাকে পালাতে হবে কান্ত, নইলে ওরা তোমাকে ধরে লাঞ্ছনা করবে, কোতল করবে।
পালাব? হঠাৎ যেন কেমন বিহ্বল হয়ে গেল লখাই পালানোর কথা শুনে। বাইরের রুদ্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে সে ফিসফিস করে বলল, আবার, আবার পালাব? কোথায় পালাব, মুরলীদাদা?
পেছনের বেড়া ডিঙিয়ে বড় সড়ক ধরে বাড়ি চলে যাও তুমি।
তোমাকে এসে ওরা যখন জিজ্ঞেস করবে?
মুরলীদাস রুদ্ধ গলায় বলল, আমার বাপপিতামোর আখড়া যদি ভেঙে যায়, তা হলে আমার সবই গেল। তোমার জন্য দুটো মিছে কথা আর বলতে পারব না?
না। লখাই বলল, ওরা তোমাকে সাজা দেবে।
দিক। তবু কান্ত, তুমি যাও।
কিন্তু তার দরকার হল না। দরজায় করাঘাত হল। সকলের মুখ মুহূর্তে পাংশু হয়ে উঠল। এক দারুণ অঘটনের জন্য সকলেই আতঙ্কে শিউরে উঠল।
কাঞ্চন লখাইকে দুহাতে টেনে নিয়ে যেতে চাইল পেছন দিকে। চলো, চলো মিনসে, পায়ে মাথা কুটি তোমার, চলো। সারদাও তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলে ফেলল, যাও, যাও কান্ত লখাই।
দরজায় আবার করাঘাত হলো।
লখাই হঠাৎ গর্জন করে উঠল, যাব না, না, আর পালাব না। সব শেষ হয় তো হোক।বলে সবাইকে রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কের সাগরে ড়ুবিয়ে ছুটে গিয়ে সে নিজেই দরজা খুলে দিল।
আমলা একলা দাঁড়িয়ে আছে। লখাইকে দেখে বলল, মুরলীদাসকে ডাকো তো।
মুরলীদাস পেছনে পেছনেই ছুটে এসেছিল। লখাইকে আড়াল করে বলল, কী বলছেন, আমলা মশাই?
আমলা বললে, আজকে ঝুলন, কালকেও বোধ হয় পারবে না, পরশুদিন তোমার কাগজপত্র নিয়ে একবার কত্তার সঙ্গে দেখা করো। লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সাহেবরা তোমার সাহসের তারিফ করেছে হে খুব। চটকলে মজুর শাসন করবার জন্য নাকি তোমার মতো লোকের দরকার। তবে একটু সভ্য হতে শেখো, বুঝলে?
যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি এমনি একটা ভাব করে যাবার মুখে মুরলীদাসকে বললেন, বিপদের ভয় করো না, তোমার ওই কান্ত লখাই না কী নাম, ওর নাম-পরিচয়টা সাহেব চেয়েছে। পরশুদিন সেটা বলল। বলে তিনি চলে গেলেন।
ইতিমধ্যে মেয়েরাও দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমলা চলে গেলেও কেউ একটি কথা বলতে পারল না। এমনকী, লখাইও না। সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইল।
কেবল দমকা হাওয়ায় যুগলমূর্তি স্থাপন করার পূর্বেই মন্দিরের ঝুলনের দোলনা আপনি দোল খেয়ে দুলে দুলে উঠল।