১১. পারুল বরের কাছে যাবার সময়

পারুল বরের কাছে যাবার সময় বলে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি, স্রেফ একটা মাটির পুতুলকে হৃদয় দান করে বসে আছিস তুই! না বুঝে তোর ভাল করতে গিয়ে শুধু ছোটই করলাম তোকে!

বকুল বলেছিল,  ‘ছোট হলাম না’ ভাবলে আর কে ছোট করতে পারে সেজদি?

পারুল বললো, ওটা তত্ত্বকথা। ও দিয়ে শুধু মনকে চোখ ঠারা যায়। ভেবে দুঃখ হচ্ছে, এমন ছাই প্রেম করলি যে একটা মাটির গণেশকে তার জেঠির আঁচলতলা থেকে টেনে বার করে আনতে পারলি না!

বকুল বলেছিল, থাম সেজদি! বাবার মতই বলি, জিবনটা নাটক নভেল নয়!

কিন্তু কথাটা কি বকুল সত্যি প্ৰাণ থেকে বলেছিল? বকুলের সেই অপাত্রে দান করে বসা হৃদয়টা কি নাটক-নভেলের নায়িকাদের মতই বেদনায় নীল হয়ে যায়নি? যায়নি যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে?

গভীর রাত্রিতে সারা বাড়ি যখন ঘুমিয়ে অভেতন হয়ে যেত, তখন বকুল জেগে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করতো না কি ও-বাড়ির তিনতলার ঘরটায় এখনো আলো জ্বলছে, না অন্ধকার?

না, ওই আলো-অন্ধকারের মধ্যে কোনো লাভ-লোকসান ছিল না বকুলের, তবু বকুলের ওই আলোটা ভালো লাগতো। বকুলের ভাবতে ভালো লাগতো, ওই তিনতলার মানুষটাও ঘুমোতে পারছে না, ও জেগে জেগে বকুলের কথা ভাবছে। এ ভাবনাটা নভেলের নায়িকাদের মতই নয় কি?

এ ছাড়াও অনেক সব অবাস্তব কল্পনা করতো বকুল।

যেমন হঠাৎ একদিন বিনা অসুখে মারা গেল বকুল, বাড়িতে কান্নাকাটি শোরগোল। ওবাড়ি এই আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে নিষেধবাণী ভুলে ছুটে চলে এলো এ-বাড়িতে, এসে শুনলো ডাক্তার বলেছে মানসিক আঘাতে হার্ট দুর্বল হয়ে গিয়ে হার্তফেল করেছে–

সেই কথা শুনে মাটির পুতুলের মধ্যে উঠতো দুরন্ত প্ৰাণের চেতনা, শূন্যে মাথা ঠুকে ঠুকে ভাবতো সে, কী মূর্খ আমি, কী মূঢ়!

হ্যাঁ, বিনিদ্র রাত্রির দুর্বলতায় এই রকম এক-একটা নেহাৎ কাঁচা লেখকের লেখা গল্পের মত গল্প রচনা করতো বকুল, কিন্তু বেশী দিন নয়, খুব তাড়াতাড়ির মধ্যেই ও-বাড়িতে অনেক আলো জ্বললো একদিন-ওই তিনতলার ঘরটায় সারারাত্রি ধরে অনেক আলো ঝলসালো, সেই আলোয় আত্মস্থ হয়ে গেল বকুল।

আর —আর ওই কাঁচা গল্পগুলো দেখে নিজেরই দারুণ হাসি পেলো তার। ভাবলো ভাগ্যিস মনে মনে লেখা গল্পের খবর কেউ জানতে পারে না!

কিন্তু বকুল কি ওই আলোটা শুধু নিজের ঘরে বসেই দেখলো? বকুল ওই আলোর নদীতে একবার ঘট ডোবাতে গেল না? তা তাও গেল বৈকি! বকুল তো নাটক-নভেলের নায়িকা নয়!

নির্মলের বাবা নিজে এসেছিলেন লাল চিঠি হাতে করে। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন বকুলের বাবার কাছে, আমার এই প্রথম কাজ দাদা, সবাইকে যেতে হবে, দাঁড়িয়ে থেকে তদ্বির করে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। না না, শরীর খারাপ বলে এড়াতে চাইলে চলবে না। কোনো ওজর-আপত্তি শুনবো না। বৌমাদের ডেকে আমার হয়ে বলুন, ও-বাড়ির কাকা বলে যাচ্ছেন, গায়েহলুদের দিন আর বৌভাতের দিন, এই দুটি দিন এ বাড়িতে উনুন জ্বলবে না। ছেলেপুলে সবাই ও-বাড়িতেই চা-জলখাবার, খাওয়াদাওয়া–

বকুলের বাবা বলেছিলেন, যাবে যাবে, ছেলেরা বৌমারা যাবে।

শুধু ছেলেরা বৌমারা নয় দাদা, নির্মলের বাবা নিৰ্বেদ সহকারে বলেছিলেন, নাতিনাতনী সবাইকে নিয়ে আপনাকেও যেতে হবে। আর নির্মলের মা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। বকুল যেন নিশ্চয় যায়। তার ওপর তিনি অনেক কাজের ভরসা রাখেন।

হয়তো বকুলের যাওয়া সম্পর্কে ওঁদের একটা সন্দেহ ছিল, তাই এভাবে বিশেষ করে বলেছিলেন বকুলকে।

বকুলের বাবা প্ৰবোধবাবু এই সময় তাঁর বাতের ব্যথা ভুলে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন, বৌমাকে বোলো ভাই, বকুলের কথা আমি বলতে পারছি না, বয়স্থ কুমারী মেয়ে, বুঝতেই পারছে পাঁচজনের সামনে একটা লজ্জা,–

তা বকুলদের আমলে বান্তবিকই ওতে লজ্জা ছিল। বয়স্থা কুমায়ী মেয়েকে চোরের অধিক লুকিয়ে থাকতে হত। প্ৰবোধবাবু বাহুল্য কিছু বলেননি। কিন্তু নির্মলের বাবা সেটা উড়িয়ে দিলেন। হয়তো মেয়েটাকে তাঁরা বিশেষ একটু স্নেহদৃষ্টিতে দেখতেন বলেই মমতার বশে সঙ্গেকার সম্পর্কটা সহজ করে নিতে চাইলেন। বললেন, এ তো একই বাড়ি দাদা, বাড়িতে বিয়ে হলে কী করতো বলুন!

বকুলের বাবা অনিচ্ছের গলায় বললেন, আচ্ছা বলবো।

নির্মলের বাবা বললেন, তাছাড়া ওর খুড়ির আর একটি আবদার আছে, সেটিও বলে যাবো। ওর খুড়ি কাজকর্মে বেরতে পারছে না, পরে আসবে, তবে সময় থাকতে বলে রাখতে বলেছে। ডাকুন না একবার বকুলকে। অনেকদিন দেখাটেখা হয়নি, নইলে আরো আগেই বলতেন। তা ছাড়া-বিয়েটা তো হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল!

বকুলের বাবা এতো আত্মীয়তাতেও খুব বেশী বিগলিত হলেন না, প্ৰায় অনমনীয় গলায় বললেন, বাড়ির মধ্যে কাজকর্মে আছে বোধ হয়, ব্যাপারটা কী?

ব্যাপারটা তখন খুলে বললেন নির্মলের বাবা।

নির্মলের মা বকুলের কাছে আবেদন জানিয়েছে, বকুল যেন তাঁর ছেলের বিয়েতে তাঁর নামে একটি প্রীতি উপহার লিখে দেয়।

বকুলের বাবার কপাল কুঁচকে গিয়ে আর সোজা হতে চায় না, কী লিখে দেবো?

প্রীতি উপহার, মানে আর কি পদ্য! বিয়েতে পদার্টদ্য ছাপায় না? সেই আর কি।

বকুলের বাবা ভুরু কুঁচকে বিস্ময়-বিরস কণ্ঠে বলেন, বকুল আবার পদ্য লিখতে শিখলো কবে?

নির্মলের বাবা বিগলিত হাস্যে বলেন, কবে। ছেলেবেলা থেকেই তো লেখে। কেন, ওর পদ্য তো ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছে, দেখেননি। আপনি? লজ্জা করে দেখায়নি বোধ হয়। ওর ওবাড়ির খুড়ি দেখেছে। বলে তো খুব ভালো। তা সেই জন্যেই একটি প্রীতি উপহারের অর্ডার দিতে আসা। ডাকুন একবার, নিজে মুখে বলে যাই।

ওষুধ-গেলা মুখে মেয়েকে ডেকে পাঠান প্ৰবোধচন্দ্ৰ। বলেন, তুমি নাকি পদ্য লেখো?

বকুল শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়।

ও-বাড়ির কাকাই বা এ-বাড়িতে কেন, আর তার সামনে এ কথাই বা কেন?

তা কেন যে সেটা টের পেতে দেরি হল না। নির্মলের বাবা তড়বড় করে তার বক্তব্য পেশ করলেন।

বকুল নভেলের নায়িকা নয়, তবু বকুলের পায়ের তলার মাটি সরে যায়নি কি? বকুলের কি মনে হয়নি, কাকীমা কি সত্যিই অবোধ, না নিতান্তই নিষ্ঠুর? বকুলের সমন্ত সত্তা কি একবার বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়নি এই নির্মম চক্রান্তের বিরুদ্ধে?

কেন? কেন? কেন তাকে যেতে হবে নির্মলের বিয়ে দেখতে? কেন তাকে নির্মলের বিয়ের পদ্য লিখতে হবে? উপন্যাসের নায়িকা না হলেও, একথা কি ভাবেনি বকুল? মানুষের এই নিষ্ঠুরতায় বকুল কি ফেটে পড়তে চায়নি?

হয়তো সবই হয়েছিল, তবু বকুল অস্ফুটে বললে, আচ্ছা।

আপনার বকুলের মত মেয়ে এ যুগে হয় না দাদা, নির্মলের বাবা হৃষ্টচিত্তে বলেন, ওর খুড়ি তো সুখ্যাতি করতে করতে-

বকুলের ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে বলে ওঠে, আপনি থামবেন?

কিন্তু বকুলের শরীরের ভিতরটা থরথর করা ছাড়া আর কিছু হল না।

নির্মলের বাবা হৃষ্টচিত্তে চলে গেলেন আরো একবার সবাই মিলে নেমন্তন্ন খাবার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে। হয়তো ওই মানুষটা সত্যিই অজ্ঞ অবোধ। কারণ নির্মলের মা পারুলের প্রস্তাবের কথাটুকু ছাড়া আর কিছুই বলেননি তাঁকে। কী-ই বা বলবেন? বকুল আর নির্মলের ভালবাসার কথা? তাই কি বলা যায়?

চলে যাবার পর ফেটে পড়েছিলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ। বলেছিলেন, অমনি বলে দিলি আচ্ছা! লজ্জা করলো না তোর হারামজাদি?

বকুল বলেছিল, ওঁদের যদি চাইতে লজ্জা না করে থাকে, আমার কেন দিতে লজ্জা করবে বাবা?

এই সেদিন অত বড় অপমানটা করলো ওরা—

অপমান মনে করলেই অপমান–, বকুল সে-যুগের মেয়ে হলেও বাপের সঙ্গে খোলাখুলি কথা কয়েছিল, বিয়ের মত মেয়ে-ছেলে থাকলেই লোকে সম্বন্ধ করতে চেষ্টা করে, করলেই কি সব জায়গায় হয়? তা বলে সেটা না হলে তারা শত্রু হয়ে যাবে?

প্ৰবোধচন্দ্র এই রকম উন্মুক্ত কথায় থতমত খেয়ে বলেছিলেন, তুমি পারলেই হল! পারুলবালা তো অনেক রকম কথা বলে গেলেন কিনা–।

সেজদির কথা বাদ দিন। বলে সব কথায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল বকুল।

হাঁ, তারপর স্নেহের সুনির্মলের শুভ বিবাহে স্নেহ উপহার লিখে দিয়েছিল বকুল নির্মলের মার নাম দিয়ে। সে পদ্য পড়ে ধন্যি ধন্যি করেছিল সবাই। নির্মলের মা বলেছিলেন, আমি তো তোকে কিছু বলে দিইনি। বাছা, তবু আমার মনের কথাগুলি সব কি করে বুঝে নিলি মা? কি করেই বা অমন মনের মত লিখলি?

বকুল শুধু হেসেছিল।

নির্মলের মার চোখ দিয়ে হঠাৎ জল পড়েছিল, তিনি অন্য দিকে চোথা ফিরিয়ে বলেছিলেন, ভগবানের কাছে তোর জন্যে প্রার্থনা করি মা, তোরা যেন রাজা বর হয়।

শুনে বকুল আর একটু হেসেছিল।

সেই হাসিটাকে স্মরণ করে অনামিকা দেবীও এতোদিন পরে একটু হাসলেন। নির্মলের মারা সেই আশীর্বাদটা স্রেফ অকেজো হয়ে পড়ে থেকেছে।

নির্মলের মা ছলছল চোখে আবারও বলেছিলেন, তোর জন্য ভগবান অনেক ভাল রেখেছেন, অনেক ভাল।

তা এ ভবিষ্যদ্বাণীটি হয়ত ভুল হয়নি তাঁর। বকুল হয়তো অনেক ভালোই পেয়েছে, অনেক ভালো-, ভাবলেন অনামিকা দেবী।

বকুল বৌ দেখতে তিনতলায় উঠে গিয়েছিল। বকুল আর সেদিন জেঠাইমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে গ্রাহ্য করেনি। বকুল বৌ দেখেছিল, নেমন্তন্ন খেয়েছিল, মেয়েদের দিকে পরিবেশনও করেছিল। আবার পরদিন নির্মলের মার কাছে বসে বউয়ের মুখ-দেখানি গহনা টাকা জিনিসপত্রের হিসাব লিখে দিয়েছিল।

সেই সূত্রে অদ্ভুত একটা হৃদ্যতা হয়ে গেল নির্মলের বৌয়ের সঙ্গে। ব্যাপারটা অদ্ভুত বৈকি। এমন ঘটে না! তবু কিছু কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে জগতে মাঝে মাঝে।

হিসেব মেলানোর কাজ হচ্ছিল, বৌ অদূরে ঘোমটা ঢাকা হয়ে বসে বসে ঘামছিল, শাশুড়ীর উপস্থিতিতে কোন কথা বলেনি। কি একটা কাজে তিনি উঠে যেতে, ঘোমটা নামিয়ে মৃদু অথচ পরিষ্কার গলায় বলে উঠলো, নেমন্তন্ন খেতে এসে এতো খাটছো কেন?

বকুল এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই একটু চমকালো। ভাবলো–বৌ আমায় চিনলে কি করে? তারপর আবার ভাবলো, এ প্রশ্নের অর্থ কি? বড় জেঠির কাছে তালিম নিয়ে যুদ্ধে নামলো নাকি বকুলের সঙ্গে?

হ্যাঁ, এই ধরনের একটা সন্দেহ মুহূর্তে কঠিন করে তুলেছিল বকুলকে। বকুল তাই নিজেও যুদ্ধে নামতে চাইল। স্থির আর শক্ত গলায় বললো, আমার সঙ্গে যে শুধু নেমন্তন্ন খাওয়ারই সম্পর্ক এ কথা আপনাকে কে বললো?

বৌ চোখ তুলে তাকিয়েছিল।

দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত গভীর কালো দুটি চোখ।

নির্মলের বৌ খুব সুন্দরী হচ্ছে এ কথা আগে থেকেই শুনেছিল বকুল। বৌ আসার পর দেখে বুঝেও ছিল। ধন্যি-ধন্যিটাও কানে এসেছিল, তবু ঠিক ওই মুহূর্তটার আগে বুঝি অনুধাবন করতে পারেনি সেই সৌন্দর্যটি কী মোহময়! ওই গভীর চোখের ব্যঞ্জনাময় চাহনির মধ্যে যেন অনেক কিছু লুকানো ছিল, ছিল অনেকখানি হৃদয়। যে দিকটায় কথা এ পর্যন্ত আদৌ চিন্তা করেনি বকুল।

নির্মলের বৌ শব্দটাকে বকুল যেন অবজ্ঞা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই বসেছিল। চেতনে না হোক। অবচেতনে।

কিন্তু বৌ বকুলের দিকে ভালবাসার ভর্ৎসনায় ভরা দুটি চোখ তুলে ধরলো। বকুল প্ৰতিজ্ঞার জোরটা যেন হারাতে বসলো।

বৌ মাধুরী সেই চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে বললো, আমি তো তোমায় তুমি করে বললাম ভাই, তুমি কেন আপনি করছো?

খুড়িমা ঘরে নেই, মুখোমুখি শুধু তারা দুজনে-বকুল লজ্জা ত্যাগ করলো। বললো, তা করবো না? বাবা! আমি হলাম তুচ্ছ একটা পাড়ার মেয়ে, আর আপনি হচ্ছেন একজন মান্যগণ্য মহিলা! এ বাড়ির বড় বৌ!

বকুলের কণ্ঠস্বরে কি ক্ষোভ ছিল?

অথবা তিক্ততা?

হয়তো ছিল।

কিন্তু বৌ তার পাল্ট জবাব দিল না। সে এ কথার উত্তরে হাত বাড়িয়ে বকুলের একটা হাত চেপে ধরে ভালবাসার গলায় বলে উঠলো, যতই চেষ্টা কর না কেন, তুমি আমায় দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না ভাই। আমি জানি তুমি খুব কাছের মানুষ, খুব নিকটজন!

বকুল একটু অবাক হয়েছিল বৈকি।

এটা তো ঠিক জেঠিমার তালিম বলে মনে হচ্ছে না? তবে কী এটা?

বকুলের গলার স্বর থেকে বোধ করি তার অজ্ঞাতসারেই ক্ষোভ আর তিক্ততাটা ঝরে পড়ে গিয়েছিল। বকুল যেন ঈষৎ কৌতুকের গলায় বলেছিল, বেশনা হয় তুমিই বললাম, কিন্তু আমি খুব নিকটজন, এমন অদ্ভুত খবরটি তোমায় দিল কে?

মাধুরী-বৌ খুব মিষ্টি একটা হেসে বলেছিল, যে দেবার সে-ই দিয়েছে। সব কথাই বলেছে কাল আমায়।

মুহূর্তে আবার কঠিন হয়ে উঠেছিল বকুল রাগে, আপাদমন্তক জ্বলে গিয়েছিল তার।

ওঃ, ফুলশয্যার রাত্রেই বৌয়ের কাছে হৃদয় উজাড় করা হয়েছে! না জানি নিজের গা বাঁচিয়ে আর বকুলকে অপমানের সমুদ্রে ড়ুবিয়ে কতো কৌশলেই করা হয়েছে সেটি!

নির্মল এমন!

নির্মল এতো নীচ, অসার, ক্ষুদ্র! অথবা তা নয়, একেবারে নির্বোধ মুখ্যু!

ভেবেছে কানাঘুষোয় কিছু যদি শুনে ফেলে বৌ, আগে থেকে সাফাই হয়ে থাকি। সেটা যে হয় না, সে জ্ঞান পর্যন্ত নেই।

বকুল অতএব কঠিন হয়েছিল।

রুক্ষ গলায় বলেছিল, সব কথাই বলেছে? এক রাত্তিরেই এতো ভাব? তা কি কি বলেছে? আমি তোমার বরের প্রেমে হাবুড়ুবু খেয়ে মরে পড়ে আছি? তার জন্যে আমার জীবন ব্যর্থ পৃথিবী অর্থহীন? এই সব? তাই করুণা করছো?

বলেছিল।

আশ্চর্য! বকুলের মুখ থেকেও এমন কুশ্রী কথাগুলো বেরিয়েছিল সেদিন। বকুলের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল যেন।

কিন্তু মাধুরী-বৌ এই রুক্ষতার, এই কটুক্তির উচিত জবাব দিল না। সে শুধু তার সেই বড় বড় চোখ দুটিতে গভীরতা ভরে উত্তর দিল, না, তা বলবে কেন? সে নিজেই ভালবাসায় মরে আছে, সেই কথাই বলেছে।

বা চমৎকার! বকুল কড়া গলায় হেসে উঠেছিল, সত্যসন্ধ যুধিষ্ঠির! তা যাক, তুমি সেই মরা মানুষটাকে বাঁচাবার প্রতিজ্ঞা নিয়েছ অবিশ্যি? অতএব নিশ্চিন্দি!

কথাগুলো কে বলেছিল?

বকুল, না বকুলের ঘাড়ে হঠাৎ ভর-করা কোনো ভূত? হয়তো তাই। নইলে জীবনে আর কবে বকুল অমন অসভ্য কথা বলেছে? তার আগে? তার পরে?

মাধুরী-বৌ তবুও শান্ত গলায় বলেছিল, আমি তো পাগল নই যে তেমন প্ৰতিজ্ঞা নেবো। তোমাকে ও কখনো ভুলতে পারবে না।

বৌয়ের মুখে এমন একটা নিশ্চিত প্রত্যয়ের আভা ছিল যে, তাকে ব্যঙ্গ করা যায় না।

বকুল অবাক হয়েছিল।

মেয়েটা কি?

অবোধ? না শিশু?

ন্যাকা ভাবপ্রবণ বরের ওই গদগদ স্বীকারোক্তি হজম করে এমন অমলিন মুখে আলোচনা করছে সেই প্রসঙ্গ? তবে কি সাংঘাতিক ধড়িবাজ? কথা ফেলে কথা আদায় করতে চায়? এই সরলতা সেই কথার রুই টেনে তোলবার চার?

ঠিক এই ভাষাভঙ্গীতে না হলেও, এই ভাবের কিছু একটা ভেবেছিল বকুল সেদিন প্রথমটায়।

কিন্তু তারপর বকুল সেই দেবীর মত মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখেছিল, তাকিয়ে দেখেছিল সেই দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত কালো কালো বড় বড় চোখের দিকে, আর দেখো যেন লজ্জায় মরে গিয়েছিল। বকুল বুঝেছিল, এ এক অন্য জাতের মেয়ে, সংসারের ধারণ মাপকাঠিতে মাপা যাবে না একে।

বকুলের ভিতর একটা বোবা দাহ বকুলকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিচ্ছিল, বাইরে ভদ্রতা আর অহঙ্কার বজায় রাখতে রাখতে বকুল কষ্টে মরে যাচ্ছিল, কিন্তু মাধুরী-বৌয়ের ওই জ্বালাহীন ঈর্ষাহীন পবিত্র সরলতার ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বকুল নিজের চিত্তদৈন্যে মরমে মরলো।

বকুলের সেই দাহটাও বুঝি কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল। বকুল সহজ কৌতুকের গলায় বললো, তুমি তো আচ্ছা বোকা মেয়ে! তোমার বর এমন একখানা পরমা সুন্দরী বৌকে ঘরে এনে পাড়ার একটা কালো-কোলো মেয়েকে হৃদয়ে চিরস্মরণীয় করে দেবে, আর তুমি সে ঘটনা সহ্য করবে?

কালো-কোলো? বৌ একটু হাসে, তোমার খুব বিনয়!। তারপর হাসিমুখেই বলে, বাইরের রূপটাই তো সব নয়!

বকুলই এবার হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরে। যাকে বলে করপল্লব। যেমন কোমল তেমনি মসৃণ; নির্মলটা জিতেছে সন্দেহ নেই। এ মেয়েকে দেখে বকুলই মুগ্ধ হচ্ছে।

বকুল সেই ধরা হাতটায় একটা গভীর চাপ দিয়ে বলে, তোমার বাইরের রূপও অতুলনীয়, ভেতরের রূপও অতুলনীয়।

মাধুরী-বৌ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে বলে, প্রথম ভালবাসার কাছে কোনো কিছুই লাগে না।

বকুলের বুকটা কেঁপে ওঠে, বকুলের মাথাটা যেন ঝিমঝিম করে আসে, নিজের সম্বন্ধে ভালবাসা শব্দটা অপরের মুখে এমন স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে এর আগে কি কোনোদিন শোনেনি বকুল? পারুল তো বলেছে কতো!

কিন্তু এ যেন অন্য কিছু, আর কিছু।

নির্মলের বিয়ের ব্যাপারের গোড়া থেকে নিজেকে কেবলই অপমানিত মনে হয়েছে বকুলের, এখন হঠাৎ নিজেকে যেন অপরাধী মনে হলো। যেন বকুল নির্লজ্জের মত কারো ন্যায্য প্ৰাপ্যে ভাগ বসিয়ে রেখেছে। এখন বকুল নিজেকে সেই দাবিদারের থেকে অনেক তুচ্ছ ভাবছে।

ওই মেয়েটার কাছে বকুল শুধু রূপেই তুচ্ছ নয়, মহিমাতেও অনেক খাটো।

বকুল নিজেকে সেই তুচ্ছর দরেই দেখতে চেষ্টা করলো।

মাধুরী-বৌয়ের কথায় হেসে উঠে বললো, ওরে বাস! খুব লম্বা-চওড়া কথা বলে নির্মলদা তো দেখছি তোমার কাছে নিজের দর বাড়িয়ে ফেলেছে! ওসব হচ্ছে স্রেফ কল্পিত কল্পনার ব্যাপার, বুঝলে?

এটা তুমি লজ্জা করে বলছো—, মাধুরী-বৌ মৃদু হেসে বলে, মেয়েরা তো সহজে হার মানে না। পুরুষমানুষ মনের ব্যাপারে অতো শক্ত হতে পারে না। তা ছাড়া ও তো একেবারে–

মাধুরী-বৌ নিজেই বোধ করি লজ্জায় চুপ করে গিয়েছিল।

বকুল সেই পরম সুন্দর মুখটার দিকে যেন মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে রইল। এই ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছে নির্মল নামের ছেলেটা?

বকুল কি নির্মলকে হিংসে করবে?

এ-যুগের কাছে কী হাস্যকরই ছিল সেকালের সেই জোলো-জোলো প্ৰেম ভালবাসা!

অনামিকা দেবী সেই বহু যুগের ওপর থেকে ভেসে আসা আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় হেসে উঠলেন।

এখনকার মেয়েরা যদি বকুলের কাহিনী শোনে, স্রেফ বলবে, শ্ৰীমতী বকুলমালা, তোমাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা উচিত!

তুমি কিনা তোমার প্ৰেমপাত্তরের প্রিয়ার রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে বসলে?

তার সেই রূপসী প্রিয়া যখন বললো, তোমার ওপর ঈর্ষা কেন হবে ভাই? ও তোমায় এতো ভালবাসে বলেই তো আমারও তোমাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে আমি বন্ধু পাতালাম আজ থেকে।

তুমি তখন একেবারে বিগলিত হয়ে বন্ধুত্বের শপথ নিয়ে বসলে! নির্মল নামের সেই ভাবপ্রবণ ছেলেটা না হয় প্রথম ঝোঁকে নতুন বৌয়ের কাছে অনেস্ট হয়েছে, প্রথম ভালবাসার বড়াই করে কাব্যি করেছে, কিন্তু তুমি সেই ফাঁদে ধরা দিলে কী বলে?

বেশ তো বলছিলে, বেশী গল্প উপন্যাস পড়েই এই ঢং হয়েছে নির্মলদার, দেবদাস হতে ইচ্ছে হচ্ছে, শেখর হতে ইচ্ছে হচ্ছে, তিলকে তাল করে তোমার কাছে হীরো হয়েছে!

বেশ তো বলছিলে, এই সব আজেবাজে কতকগুলো কথা তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে নির্মালদার কী ইষ্টসিদ্ধি হল জানিনে বাবা! বাজে কথায় কান দিও না।

বলেছিলে, সংসার জায়গাটা স্রেফ বাস্তব, বুঝলে বৌঠাকরুণ! ওসব কাব্যিটাব্যি চলে না। বিশেষ করে যেটা প্রবল প্ৰতাপ শ্ৰীমতী জেঠিমার সংসার।–

তারপর-হঠাৎ তবে ওই মেয়েটার কোমল করপল্লবখানা হাতে ধরে স্তন্ধ হয়ে বসে রইলে কেন অনেকখানি সময়? কেন তারপর আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বললে, আচ্ছা, বন্ধুত্বই পাতালাম।

তার মানে তোমার সব গর্ব ধূলিসাৎ হল, তুমি ধরা দিলে!

একটি সরল পবিত্রতা, একটি ভালবাসার হৃদয়, একটি হিংসাশূন্য, অহঙ্কারশূন্য, নির্মল মন অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে বৈকি। সকল গর্ব চুৰ্ণ করে দিয়ে একেবারে জয় করে নিতে পারে সে।

বকুলও বিজিত হল।

মাধুরী নামের মেয়েটার ওই অদ্ভুত জীবনদর্শন বকুলকে আকৃষ্ট করলো, আবিষ্ট করলো।

তোমার আর আমার দুজনেরই ভালবাসার পাত্র যখন একই লোক, তখন আমাদের মতো আপনজন আর কে আছে বল ভাই? তুমিও ওর মঙ্গল চাইবে, আমিও ওর মঙ্গল চাইবো, বিরোধ তবে আসবে কোনখান দিয়ে?

এই হচ্ছে মাধুরী-বৌয়ের জীবনদর্শন!

ষোল আনা অধিকারের দাবি নিয়ে রাজরাজেশ্বরী হয়ে এসে ঢুকেছিল সে, তবু বলেছিল, তোমার কাছে যে ভাই আমার অপরাধের শেষ নেই। সর্বদাই মনে হবে-বিনা দাবিতে জোর করে দখল করে বসে আছি আমি।

বকুল হেসেছিল।

বলেছিল, তোমার মতন এরকম ধর্মনিষ্ঠ মহামানবী সংসারে দুচারটে থাকলে–সংসার স্বৰ্গ হয়ে যেতো ভাই বৌঠকরুণ। নেই, তাই মর্ত্যভূমি হয়ে পড়ে আছে!

অবশ্য ঠিক সেই দিনই এত কথা হয়নি। সেদিন শুধু স্তব্ধতার পালা ছিল।

দিনে দিনে কথা উঠেছে জমে।

তুচ্ছতার গ্লানি, বঞ্চনার দাহ, সব দূর হয়ে গিয়ে মন উঠেছে অন্য এক অনুভূতিতে কানায় কানায় ভরে! আর সেই ভরা মনে নির্মল নামের মেরুদণ্ডহীন ছেলেটার উপর আর রাগবিরক্তি পুষে রাখতে পারেনি। খাড়া রাখতে পারেনি নিজের মধ্যেকার সেই ঔদাসীন্যের বোবা দেওয়ালটাকে, যেটাকে বকুল নির্মলের সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে গেঁথেছিল। পারেনি, বরং মগ্নতাই জমা হয়েছে তার জন্যে।

তবে সেদিন নয়।

যেদিন সেই মাধুরী-বৌয়ের হাতে হাত বেথে বন্ধুত্বের সংকল্প নিচ্ছিল, সেদিন দেওয়ালটাকে বরং বেশী মজবুত করার চেষ্টা করেছিল।

কাকীমা কোথায় যেন কোন কাজে ভেসে গিয়েছিলেন, একটু পরে নির্মল এসে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। নিজে থেকে আসবার সাহস হত না নির্মলের, কারণ এ ঘরে তার দু-দুটা অপরাধের বোঝাঁ। অথবা দু-দুটো আতঙ্কের বস্তু। তাই ঘরে ঢুকতে ইতস্তত করছিল।

বকুল যদি দেখে নির্মল বৌয়ের ধারে-কাছে ঘুরঘুর করছে, নিশ্চয় বকুল ঘৃণায় ধিক্কারে ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠবে। আর জেঠাইমা যদি দেখেন-হতভাগা গাধাটা বিয়ের পরও ওই পাজি মেয়েটোর আনাচে-কানাচে ঘুরছে, রসাতল করে ছাড়বেন।

বৌয়ের কাছে?

না, বৌয়ের জন্যে ভয় নেই নির্মলের! বৌয়ের কাছে তো নিজেকে উদঘাটিত করেছে সে।

বলেছে তার কাছে আবাল্যের ব্যাকুলতার ইতিহাস।

বলেছে, ওকে ভুলতে আমার সময় লাগবে, তুমি আমায় ক্ষমা কোরো।

বৌ তখন অদ্ভুত আশ্চর্য একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, তুমি যদি ওকে ভুলে যাও, তাহলেই বরং তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। মনে করবো তুমি একটা অসার মানুষ।

তুমি আমার দুঃখ বুঝতে পারছে মাধুরী?

চোখ দিয়ে জল পড়েছিল ওর।

মাধুরী বলেছিল, মানুষের প্রাণ থাকলেই মানুষের দুঃখ বোঝা যায়। তা আমাকে কি তোমার সেই রকম মনপ্রাণহীন পাষাণী মনে হচ্ছে?

তারপর নির্মল কি বলেছিল, সে কথা অবশ্য বকুল জানে না।

কিন্তু এতো কথাই বা জানলো কি করে বকুল? বকুল কি আড়ি পাততে গিয়েছিল নির্মলের ঘরে? না, তেমন অসম্ভব ঘটনা ঘটেনি।

বলেছিল নির্মলই স্নান বিষণ্ণ মুখে। নির্মলের মুখে তখন চাঁদের আলোর মত একটা স্নিগ্ধ আলোর আভাস ফুটে উঠেছিল। নির্মল তার ওই দেবীর মত মেয়ে বৌয়ের মহিমান্বিত হৃদয়ের পরিচয়ে বিমুগ্ধ হতে শুরু করেছে, নির্মল আস্তে আস্তে তার প্রেমে পড়তে শুরু করেছে তখন। আর নির্মল যেন তাই ব্যাকুল হয়ে বকুলকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে নির্মল কতো নিরুপায়!

এর থেকে যদি খুব দুষ্ট পাজি ঝগড়াটে একটা মেয়ে আমার বৌ হত!

নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল নির্মল।

বকুল হেসে ফেলেছিল।

বকুল যেন তখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল নির্মলের চেয়ে।

নির্মলের বিয়েটাকে ঘিরে যতো সব ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনাগুলো যেন বকুলকে ঠেলে হঠাৎ একদিনে একটা দশক পার করে দিয়েছিল।

বকুলের বৌদিরা বলেছিল, ঢের বেহায়া মেয়ে দেখেছি বাবা, ছোট ঠাকুর ঝির মত এমনটি আর দেখলাম না! নইলে ওই বিয়েতে নেমন্তন্ন যায়, পদ্য লিখে দেয়!

বকুলের বাবা বলেছিলেন, যেতেই হবে? এতো কিসের চক্ষুলজা? বলি এতো কিসের চক্ষুলজ্জা? বেশ তাই যদি হয়, অসুখ করেছে বলে বাড়িতে থাকলেই হত? অসুখের তো কথা নেই!

বকুলের দাদারা বলেছিল, কি করবো, ও-বাড়ির কাকা নিজে এলেন তাই, তা নয়তো এক প্ৰাণীও যেতাম না। তবে ধারণা করিনি বকুল যাবে!

বকুলের ভালবাসার ইতিহাস আন্দাজে অনুমানে সকলেই জানতো এবং রাগে ফুলতো, আর কেবলমাত্র বড় হওয়ার অজুহাতটাকেই বড় করে তুলে ধরে তাকে শাসন করতো, কিন্তু উদঘাটন করেনি কেউ। খোলাখুলি বলেনি কেউ। পারুলের ব্যর্থ চেষ্টাই সব উদঘাটিত করে বসলো। পারুলের ব্যর্থতার পর সে চলে গেলে জেঠাইমা একদিন এ বাড়িতে এসে মিষ্ট মধুর বচনে অনেক যাচ্ছেতাই করে গেলেন, এবং বৌদের ওপর ভার দিয়ে গেলেন পরিবারের সুনাম রক্ষার।

বলে গেলেন, শাশুড়ী নেই, তোমাদেরই দায়। যতোদিন না বিয়ে দিতে পারছ, ননদকে চোখে চোখে রাখবার দায়িত্ব তোমাদেরই, আর স্বামী-শ্বশুরকে বলে বলে বিয়েটা দিয়ে ফেল চটপট! বয়সের তো গাছপাথর নেই আর!

সে-কথা বকুলের কানো যায়নি তা নয়।

সেই কথার পর যে আবার কোনো মেয়ে সে বাড়িতে যায়, এ বৌদিরা ভাবতেই পারেনি।

অথচ বকুল গিয়েছিল।

হয়তো বকুল ওই জেঠাইমাকে ওদের বাড়ির প্রকৃত মালিক মনে করতো না অথবা বকুল না গিয়ে থাকতে পারেনি।

বিয়ে করে ফিরে নির্মলের মুখটা কেমন দেখায় দেখতে বড় বেশী বাসনা হয়েছিল। কিন্তু বকুল উদাসীন থেকেছিল, বকুল নিষ্ঠুর হয়েছিল।

নির্মল যখন সেই ভোজবাড়ির গোলমালে একবার বকুলের নিতান্ত নিকটে এসে বদ্ধগম্ভীর গলায় ডেকেছিল, বকুল!

বকুল তখন ব্যন্ত হয়ে বলেছিল, ওমা তুমি এখানে? দেখা গে তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এসে গেছে বোধ হয়। যাও যাও।

নির্মল আরো সন্নিকটে এসে বলেছিল, বকুল, তুমি আমায় কী ভাবছো জানি না—

বকুল কথা শেষ করতে দেয়নি।

বলে উঠেছিল, হঠাৎ আমি তোমায় কী ভাবছি, এ নিয়ে মাথা ঘামাতে বসছো কেন? আর তোমার কথা নিয়ে আমিই বা ভাবতে বসবো কেন?

বকুল—

সব কিছুরই একটা সীমা আছে নির্মলদা। বলে চলে গিয়েছিল বকুল।

আর তারপর থেকে যতোবারই নির্মল নিকটে আসবার চেষ্টা করেছে, বকুল সরে গেছে।

কিন্তু সেদিন ঘরে নতুন বৌ ছিল।

নির্মল ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যেন দেয়ালকে উদ্দেশ করে বলেছিল, মা বললেন, মা এখন আর আসতে পারবেন না, সব কিছু দেরাজে তুলে রাখতে।

বকুল হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে বলেছিলো, শুনলে তো বৌ হুকুম? তা হলে রাখো তুলে, বরের একটু সাহায্য নিও বরং। বলে নির্মলের পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল।

বকুলের সেই নিষ্ঠুরতা ভেবে আশ্চর্য লাগে অনামিকা দেবীর। অতো নির্মম হয়েছিল কি করে সেদিন বকুল? কোন পদগৌরবেই বা? নির্মলের বৌ তো বকুলের থেকে দশগুণ বেশী সুন্দরী, তার ওপর আবার অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে!

আর বকুল? কিছু না। বকুল তো শুধু নির্মলের দেওয়া মৰ্যাদাতেই এতোখানি মূল্যবান। অথচ বকুল—

.

কিন্তু তারপর বদলে গেল বকুল।

নির্মলের বিয়ের পর জেঠাইমা বোধ করি নিশ্চিন্ত হয়েই কেদারবদরী গেলেন কিছু বান্ধবী জুটিয়ে। সেই পরম সুযোগে নির্মলের মা আর বৌ এ-বাড়ি ও-বাড়ি এক করে তুললো। মাধুরী-বৌয়ের তো এই বাড়িটাই একটা বেড়াতে আসার জায়গা হল। নির্মলের মাও যেন একটা ভারী জাঁতার তলা থেকে বেরিয়ে এসে বেঁচেছিলেন দুদিনের জন্যে।

এই মুক্তির মধ্যে মাধুরী-বৌ যেন বকুলকে এক নিবিড় বন্ধনে বেঁধে ফেললো। আর সেই সূত্রে নির্মলের সঙ্গে সম্পর্কটা হঠাৎ আশ্চর্য রকমের সহজ হয়ে গেল।

বকুল যেন মাধুরীরই বেশী আপন হয়ে উঠলো। বকুল যেন নির্মলের সঙ্গে ব্যবহারে শ্যালিকার ভূমিকা নিলো। প্রখর কৌতুকময়ী মুখরা শ্যালিকা।

হ্যাঁ, ওই সময়টা থেকেই একেবারে বদলে গিয়েছিল বকুল। এই কিছুদিন আগেও কী ভীরু আর লাজুক ছিল সে। সেই ভীরু কুণ্ঠিত লাজুক কিশোরীর খোলস ভেঙে যেন আর একজন বেরিয়ে এসেছে। প্রখরা পূর্ণযৌবনা, অসমসাহসিকা।

নির্মল তার অসমসাহসিক কথাবার্তায় ভয় পেতো, অবাক হত আর বোধ করি আরও বেশী আকৃষ্ট হত। বকুল তখন ওকে ব্যঙ্গ-কৌতুকের ছুরিতে বিধতো। মাধুরী-বৌ সেই কৌতুকে হাসতো, কৌতুক বোধ করতো।

কেদার-বদরী ঘুরে এসে জেঠাইমা দেখলেন সংসারের যে জায়গাটি থেকে তিনি সরে গিয়েছিলেন, সে জায়গাটি যেন আর নেই। যেন কে কখন তার শূন্য সিংহাসনটা কোন দিকে ঠেলে সরিয়ে রেখে নিজেদের আসর বসিয়েছে। হয়তো এমনই হয় সংসারে।

কোনো শূন্য স্থানই শূন্য থাকে না।

সেখানে অন্য কিছু এসে দখল করে।

নির্মলের বৌ যেন জেঠশাশুড়ীর থেকে নিজের শাশুড়ীকেই প্রাধান্য দেয় বেশী, পুরনো ঝি চাকারগুলো পর্যন্ত যেন আর বড়মার ভয়ে তটস্থ হয় না। কেবলমাত্র নির্মলই ছিল আগের মূর্তিতে।

বড়মা এ দৃশ্য দর্শনে কোমর বেঁধে আবার নতুন করে লাগছিলেন, দুবাড়ির শ্ৰীক্ষেত্র ভাবটা দূর করতে চেষ্টিত হচ্ছিলেন, এই সময় মোতিহারিতে বদলি হয়ে গেল নির্মল।

মাধুরী-বৌ চলে গেল বরের সঙ্গে।

হয়তো সেটাই বকুলের প্রতি তার বিধাতার আশীর্বাদ। জেঠাইমা আবার নতুন করে কি কলঙ্ক তুলতেন বকুলের নামে কে জানে! কারণ একদিন বাড়ি বয়ে এসে ঝগড়া করে গেলেন তিনি। বললেন, এ যুগে আর জাত যায় না বলে কি মেয়ের বিয়ে দেবে না ঠাকুরপো? মেয়েকে বসিয়ে রাখবো?

প্ৰবোধচন্দ্র মাথা নীচু করে ছিলেন।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ কিছু বলতে পারেননি। তারপর উনি চলে যাওয়ার পর সব ঝাল ঝেড়েছিলেন বকুলের উপর।

যাক ওসব কথা।

এখন আর ও নিয়ে ভাববার কিছু নেই। নির্মল তারপর অনেক দূরে চলে গেল।

মোতিহারীর মতো নয়, অনেক অনেক দূরে।

কিন্তু সে কবে?

বকুল তখন কোথায়?

তখন কি তার ওই বকুল নামের খোলসটার মধ্যেই আবৃত ছিল সে?

না, তখন আর বকুল নামের পরিচয়টুকুর মধ্যেই নিমগ্ন ছিল না সে। ছড়িয়ে পড়েছিল আর এক নতুন নামের স্বাক্ষরে। সেই নতুন নামটার ভেলায় চড়ে বেরিয়ে এসেছিল নালা থেকে নদীতে, ডোবা থেকে সমুদ্রে।

.

ক্রমশঃ সেই নতুন নামটাই পুরনো হয়ে গেছে, পরিচয়ের উপর শক্ত খোলসের মত এটে বসেছে। কিন্তু তখনো ততোটা বসেনি। তখন ওই নতুন নামটার ভেলাখানা যেন নিঃশব্দে ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। ও যে বকুল নামের নেহাত তুচ্ছ প্ৰাণীটাকে নাম খ্যাতি পরিচিতির ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দিয়ে যাবে, এমন কোনো প্ৰতিশ্রুতিও বহন করে আনেনি। বরং বেশ কিছু অপ্রীতিকর অথচ কৌতুকাবহ ঘটনাই ঘটিয়েছিল।

তার মধ্যে সর্বপ্ৰথম ঘটনা হচ্ছে সেই নামে একটা খামের চিঠি আসা।

চিঠিখানা পড়েছিল প্ৰবোধচন্দ্রের হাতে। কারণ প্ৰবোধচন্দ্র সর্বদাই বাইরের দিকের ঘরে সমাসীন থাকেন, রাত্রে ছাড়া দোতলায় ওঠেন না। সিড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। পথে বেরোনোও তো প্রায় বন্ধ।

রোগী সেজে-সেজেও আরো নিজের পথে নিজে কাঁটা দিয়ে রেখেছেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ। ছেলেমেয়েয়া যদি কোনো সময় বলেছে, বাবা, সর্বদা আপনি এই একতলার চাপা ঘরখানায় বসে থাকেন, একটুখানি বাইরে বেড়িয়ে আসতেও তো পারেন–

প্ৰবোধচন্দ্ৰ ক্ষুব্ধ ভর্ৎসনায় তাদের ধিকৃত করেছেন, বেড়িয়ে? বেড়িয়ে আসবার ক্ষমতা থাকলে আমি সর্বদা এই কুয়োর ব্যাঙের মত এখানে পড়ে থাকতাম? …তোমরা বলবে তবে বেরবো এই অপেক্ষায়? আমার প্রাণ হাঁপায় না?…কী করবো, ভগবান যে সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে! তোমরা বিশ্বাস না করো, ভগবান জানছে আমার দেহের মধ্যে কী হচ্ছে! হাত-পা তুলতে কাঁপে, চোখে অন্ধকার দেখি,ইত্যাদি ইত্যাদি…

অতএব প্ৰবোধচন্দ্র ওই কুয়োর ব্যাঙের মতই মলিন শতরঞ্চি পাতা একখানা চৌকিতেই দেহভার অর্পণ করে বসে বসে হিসেব রাখেন, কে কখন বেরোয়, কে কখন ফেরে, গোয়ালা কতটা দুধ দিয়ে যায়, ধোবা ককুড়ি কাপড়ের মোটের লেনদেন করে, পিয়ন কার কার নামে কখানা চিঠি আনে।

চিঠিগুলি অবশ্য সব থেকে আকর্ষণীয়।

পিয়নের হাত থেকে সাগ্রহে প্রায় টেনে নিয়ে প্ৰবোধচন্দ্র সেগুলি বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিজের কাছেই রাখেন, চাটু করে যার জিনিস তাকে ডেকে দিয়ে দেন না। এমন কি সে ব্যক্তি কোনো কারণে ঘরে এসে পড়লেও, তখনকার মত চাটু করে বালিশের তলায় গুঁজে রেখে দেন।

কেন?

তা প্ৰবোধচন্দ্র নিজেও বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। হয়তো তার সৃষ্টিকর্তা বললেও বলতে পারেন। তবে প্ৰবোধচন্দ্ৰ জানেন যে, চিঠি যার নামেই আসুক, পোস্টকার্ডগুলি পড়ে ফেলা তার কর্তব্য, এবং খামের চিঠির নাম ঠিকানার অংশটুকু বার বার পড়ে পড়ে আন্দাজ করে নেওয়া কার কাছ থেকে এসেছে। এটা তিনি রীতিমত দরকার মনে করে থাকেন।

বেশীর ভাগ চিঠিই অবশ্য বৌমাদের বাপের বাড়ি থেকে আসে, হাতের লেখাটা অনুমান করতে ভুরু কুঁচকে কুঁচকে বার বার দেখতে থাকেন প্ৰবোধচন্দ্র, এবং স্মরণ করতে থাকেন এই হস্তাক্ষরের চিঠি শেষ কবে এসেছিল।

তাড়াতাড়ির মধ্যে হলে মুখটা একটু বাঁকান, মনে মনে বলেন, উঃ, মেয়ের জন্যে মনকেমন উথলে উঠছে একেবারে! নিত্য চিঠি!–আর আমার আপনার লোকেরা? মেয়েরা? জামাইরা? পুত্তুরটি? দিল্লী দরবারে (ওই ব্যাখ্যাই করেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ) অধিষ্ঠিত যিনি? কই বুড়ো বাপ বলে মাসে একখানা পোস্টকার্ড দিয়েও তো উদ্দিশ করেন না। তাঁরা? দুটো পয়সার তো মকদ্দমা!

এই চিঠিগুলো যেন ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় প্রবোধের।

তবু পোস্টকার্ডগুলোর একটু মাদকতা আছে, পড়ে ফেলে তার অজানিত অনেক কিছু খবর জানা হয়ে যায়। প্রবাহিত সংসারের কোনো ঘটনা-তরঙ্গই তো কেউ প্ৰবোধচন্দ্রের কাছে এসে পৌঁছে দিয়ে যায় না। প্ৰবোধচন্দ্ৰ নিজেই হেঁই হেঁই করে জিজ্ঞেস করে করে যেটুকু সংগ্ৰহ করতে পারেন। এ তবু

না, পরের চিঠি পড়াকে কিছুমাত্র গৰ্হিত বলে মনে করেন না প্ৰবোধচন্দ্র। বাড়ির কর্তা হিসাবে ওটুকু তার ন্যায্য দাবি বলেই মনে করেন। তবু খামের চিঠি খুলতে সাহসে কুলোয় না। বার বার নেড়েচেড়ে, অনেকক্ষণ নিজের কাছে রেখে দিয়ে, অবশেষে যেন নাপায্যিমানেই দিয়ে দেন, কেউ ঘরে এলে তার হাত দিয়ে।

এই চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিন্তু প্ৰবোধচন্দ্রের চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে গেল। এ আবার কার নামের চিঠি।

খামের চিঠি, এ বাড়িরই ঠিকানা, অথচ মালিকের নামটা সম্পূর্ণ অজানা। তাছাড়া চিঠিটা প্ৰবোধচন্দ্রের কেয়ারে আসেনি। চিঠি যার জন্যেই আসুক-ঠিকানার জায়গায় জ্বলজ্বল অক্ষরে কেয়ার অব প্ৰবোধচন্দ্র মুখোঁপাধ্যায় তো লেখা থাকবেই।

যা রীতি!

যা সভ্যনীতি!

অথচ এ চিঠিতে সেই সুরীতি সুনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। কর্তা প্ৰবোধচন্দ্রের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে।

অন্য বাড়ির চিঠি?

ভুলক্রমে এসেছে?

তাই বা বলা যায় কি করে?

এই তো স্পষ্ট পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে, তেরোর দুই রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীট

তেরোর একটা হচ্ছে নির্মলদের, তেরোর দুইটা হচ্ছে প্ৰবোধচন্দ্ৰদের।

তাহলে? কে এই চিঠির অধিকারিণী? তবে কি বৌমাদের কারো পোশাকী নাম এটা? নাকি বড়বৌমার ওই যে বোনঝিটা কদিন এসে রয়েছে তারই?

কিন্তু সেই একটা বছর দশ-বারোর নোলোক-পরা মেয়ের নামে এমন খামেমোড়া চিঠি কে পাঠাবো?

দুর্দমনীয় কৌতূহলে খামের মুখটায় এক ফোঁটা জল দিয়ে টেবিলে রাখলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ, যাতে আঠটা ভিজে খুলে যায়।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে ঠিক সেই মুহূর্তেই বকুল এসে ঘরে ঢুকলো বাপের দুধের গ্লাস হাতে।

থতমত খেয়ে চিঠিটা সরাতে ভুলে গেলেন প্ৰবোধচন্দ্র। আর এমনি কপালের ফের তার, তদণ্ডেই কিনা তার ওপর চোখ পড়লো ওই ধিঙ্গী মেয়ের! যাকে নাকি প্ৰবোধচন্দ্ৰ মনে মনে রীতিমত ভয় করে থাকেন! ভয় করার কারণ-টারণ স্পষ্ট নয়, তবু করেন ভয়! আর সেই ভয়ের বশেই-বকুল যখন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, চিঠিটায় জল পড়লো কি করে বাবা? বলে বসেছিলেন প্ৰবোধচন্দ্ৰ, জল নয়, ইয়ে ঘাম। টপ করে চিঠিটার ওপরই পড়লো, তাই হাওয়ায়—

ঘাম!

বকুল হতবাক দৃষ্টিতে বাপের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর শীতের অগ্রদূত হেমন্তকালের ঝাপসা-ঝাপসা আকাশের দিকে তাকিয়েছিল, আর তারপর বকুলের মুখে ফুটে উঠেছিল একটুখানি অতি সূক্ষ্ম হাসি। যে হাসিটার বদলে এক ঘা বেত খেলেও যেন ভাল ছিল প্ৰবোধচন্দ্রের।

ওই, ওই জন্যেই ভয় ঢুকেছে।

আগে এই হাসিটি ছিল না হারামজাদির। কিছুদিন থেকে হয়েছে। দেখলে গা সিরসির করে ওঠে। মনে হয় যেন সামনের লোকের একেবারে মনের ভিতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।

বকুল কিন্তু আর কিছু কথা বলেনি, শুধু বলেছিল, ঘাম!

তারপর হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তুলে নিতে গিয়েছিল।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ যেন একটা সুযোগ পেলেন, হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, থাক থাক, পরের বাড়ির চিঠি, পিয়নব্যাটা ভুল করে দিয়ে গেছে।

কিন্তু ততক্ষণে তো তুলে নেওয়া হয়ে গেছে এবং উল্টে দেখাও হয়ে গেছে।

খামের উপর লেখা নামটার উপর চোখ দুটো স্থির হয়ে গিয়েছিল বকুলের, তারপর বলেছিল, ভুল করে নয়, এ বাড়িরই।

এ বাড়িরই!

প্ৰবোধ সেই সূক্ষ্ম হাসির ঝাল ঝাড়েন, বাড়িতে তাহলে আজকাল আমার অজানিতে বাড়তি লোকও বাস করছে?

বাড়তি কেউ নেই বাবা!

নেই! নেই তো এই শ্ৰীমতী অনামিকা দেবীটি কে শুনি?

বকুল মৃদু হেসে বলেছিল, আসলে কেউই নয়।

আসলে কেউই নয়! অথচ তার নামে চিঠি আসে! চমৎকার! তোমরা কি এবারে বাড়িতে রহস্যলহরী সিরিজ খুলছে? রাখো চিঠি! আমি জানতে চাই কে এই অনামিকা দেবী?

চিঠি অবশ্য রাখেনি বকুল।

আরো একবার মৃদু হাসির সঙ্গে বলেছিল, বললাম তো, আসলে কেউই নয়, ওটা একটা বানানো নাম

বানানো নাম! বানানো নাম মানে? প্ৰবোধচন্দ্ৰ যথারীতি হাঁপানির টান ভুলে টানটান হয়ে উঠে বলেছিলেন, বানানো নামে চিঠি আসে কী করে? তাহলে—প্রেমপত্র পাঠাবার ষড়যন্ত্র?

তা তাই মনে হয়েছিল তখন প্ৰবোধচন্দ্রের; কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন ওই বানানো নামটার সঙ্গে বকুল নামের মেয়েটার কোনো যোগসূত্র আছে। সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গে মোতিহারীর যোগসূত্র আবিষ্কার করে বসেছিলেন তিনি।

লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে তাহলে এই কল ফেঁদেছে? বানানো নামে চিঠি আসবে, কেউ ধরতে পারবে না?…নির্ঘাত ওই চিঠির সন্ধানেই এসেছিল, দুধ আনাটা ছল!

রাগে ব্ৰহ্মাণ্ড জ্বলে গিয়েছিল প্ৰবোধচন্দ্রের। উঃ, সেই মিটমিটে পাজী চরিত্রহীন শয়তানটা এখনো আমার মেয়েটার মাথা খাচ্ছে! বিয়ে করেছিস, বিদেশ চলে গেছিস, তবু দুষ্প্রবৃত্তি যাচ্ছে না?…এনভেলাপে চিঠি লিখছিস? এতো আসপদ্দা যে, কেয়ার অবটা পর্যন্ত দেবার সৌজন্য নেই!

প্রবোধচন্দ্রের অভিভাবক-সত্তা গৃহকর্তা-সত্তা, দুটো একসঞগে চাড়া দিয়ে উঠেছিল।

প্ৰবোধচন্দ্ৰ ধমকে উঠেছিলেন, খোলো চিঠি, দেখতে চাই আমি।

দেখতে চান সে তো দেখতেই পাচ্ছি—, বকুল খামখানা আবার বাপের টেবিলেই ফেলে দিয়ে বলেছিল, জলে ভিজিয়ে আড়ালে খোলবার চেষ্টা না করে এই অনামিকা দেবীর চিঠি এলে আপনি খুলেই দেখবেন বাবা।

তারপর চলে গিয়েছিল ঘর থেকে।

বাপের অবস্থার দিকে আর তাকিয়ে দেখে যায়নি।

অথচ এই কিছুদিন আগেও বকুল বাপের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারতো না। হঠাৎ এই সাহসটা তাকে দিল কে? এই অনামিকা দেবী? যার নামে কোনো এক কাগজের সম্পাদক চিঠি পাঠিয়েছে, আপনার গল্পটি আমাদের মনোনীত হয়েছে। আগামী সংখ্যার জন্য আর একটি গল্প পাঠালে বাধিত হবো।

নাকি নির্মলের বিয়ে উপলক্ষ করে যে-বকুল উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল, সেই বকুল স্থির করেছিল পায়ের তলার মাটিটা কোথায় সেটা খুঁজে দেখতে হবে। হয়তো সেটা খুঁজেও পেয়েছিল বকুল। তাই বকুল তার খাতার একটা কোণায় কবে যেন লিখে রেখেছিল, ভয় করতে করতে এমন অদ্ভূত অভ্যাস হয়ে যায় যে, মনেই পড়ে না ভয় করার কোনো কারণ নেই। অভ্যাসটা ছাড়া দরকার।

আর মনের মধ্যে কোনখানে যে লিখেছিল, নির্মলকে সেজদি ধিক্কার দেয়, কিন্তু আমি ওকে ধন্যবাদই দিই। ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ও আমার নৌকোখানাকে দাঁড় বেয়ে খেয়া পার করে দিতে পারেনি বলেই না সেটা স্রোতের টানে সাগরে এসে পড়েছে।

তা এই সাগরটি উপমা মাত্র হলেও প্ৰবোধচন্দ্রের অনামিকা দেবী একটা বিস্ময়ের ঘটনা, বৈকি।

অনামিকা দেবীর নামের সেই চিঠিখানা প্ৰেমপত্র না হলেও, সেটা নিয়ে বাড়িতে কথা উঠেছিল কিছু। বকুলের বড়দা সেই না-দেখা সম্পাদকের উদ্দেশে মুচকি হেসে বলেছিল, শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর!

বকুলের ছোড়দা যার ডাকনাম মানু-বকুল পারুল ওকেই ছোড়দা বলে। সুবল ছিল শুধু সুবল! সে তো এখন শুধু একটা নাম, দেয়ালের একটা ছবি। সে থাকলে হয়তো ইতিহাস একটু অন্যরকম হতো। তা সেই ছোড়দা হেসে বলেছিল, মেয়ে বলেই তাই লেখা ছেপে দিয়েছে!..শুনতে পাস না ইউনিভাসিটিতে পর্যন্ত গোবর মাথা মেয়েগুলোকে কি রকম পাস করিয়ে দিচ্ছে? ওই লেখা একটা বেটা ছেলের নাম দিয়ে পাঠালে, দেখতে স্রেফ ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে চলে গেছে!

আর বকুলের বড়বৌদি অবাক-অবাক গলায় বলেছিল, নামডাক হবার জন্যেই তো লোকে বই লেখে বাবা, ইচ্ছে করে নাম বদলে লেখে, এ তো কখনো শুনিনি! লেখাটা যে তোমারই তা প্রমাণ হবে কী করে ভাই? এই আমিই যদি এখন বলি, আমিই অনামিকা দেবী?

বলো না, আপত্তি কি? বলে হেসে চলে গিয়েছিল বকুল।

বৌদি যে রীতিমত অবিশ্বাস করছে তা বকুল বুঝতে পেরেছিল।

ইতিপূর্বেও তার লেখা ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সে খবরটা নিতান্তই বকুলের নিজের আর নির্মলের বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এ বাড়িতে ধাক্কা দেয়নি।

এবার ধাক্কা দিল বলেই ধাক্কা উঠলো।

আরও একটা ধাক্কার খবর পাঠিয়েছিল সেজদি পারুল।

লিখেছিল.এদিকে তো দিব্যি এক কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিস। তোর গল্প নিয়ে তো এখানে পুরুষমহলে বেজায় সাড়া উঠেছে। নবীন ভারত পত্রিকাখানা এখানে খুব চালু কিনা।…তা ওনারা বলেছেন, নিরুপমা দেবী, অনুরূপ দেবী, প্রভাবতী দেবী এসব তো জানি, এই নতুন দেবীটি আবার কে? এ নির্ঘাত কোনো মহিলার ছদ্মনামে পুরুষ।…লেখার ধরন যে রকম বলিষ্ঠ—…অর্থাৎ বলিষ্ঠ হওয়াটা পুরুষেরই একচেটে!

তোর বুদ্ধিমান ভগ্নীপতিটি অবশ্য লেখিকার আসল পরিচয়টা কারো কাছে ফাস করে বসেননি, কিন্তু নিজে তো জানেন। তিনি বিষম অপমানের জ্বালায় জ্বলছেন। কেন জানিস? তিনি নাকি ওই গল্পের ভিলেন নায়কের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

যত বোঝাচ্ছি, গল্পটার নাম যখন আয়না, তখন ওর মুখোমুখি হলে তো নিজের ছায়া দেখা যাবেই, কিন্তু নিজেকে কেন তুমি–তা কে শোনে এসব সুযুক্তির কথা। বলছেন, ওনার শালী নাকী ওনাকে অপমান করতেই এমন একখানা মর্মান্তিক চরিত্র সৃষ্টি করেছে। তখন হেসে বলতেই হলো, শালী তাহলে শালীর মতই ব্যবহার করেছে। দেখ, তোদের অমলবাবুর সামনে গ্ৰাম্য ভাষা ব্যবহার করেছি বলে ছিছি করিস নে। বাংলা ভাষা মেয়েদের সম্পর্কে যে কত উদাসীন তা প্রতি পদেই টের পাবি। মানে লিখতে যখন বসেছিস, লক্ষ্য পড়বেই…শালার সম্পর্কে সম্বন্ধী বড় কুটুম্ব দুএকটা কথা তবু আছে, কিন্তু শালী? বড় জোর শ্যালিকা! ছিঃ! কোনো গুণবাচক শব্দ খোঁজ, নেই, মেয়েদের জন্যে কিছু নেই। অতএব বলতে হবে মহিলা কবি মহিলা সাহিত্যিক, মহিলা ডাক্তার ইত্যাদি ইত্যাদি, দেখিস মিলিয়ে মিলিয়ে। কাজে কাজেই শালী ছাড়া উপায় কি? তা লোকটা বলে কিনা ঠিক বলেছি, যা সম্পর্ক তেমনি ব্যবহার করেছে তোমার বোন!

এ কথাও বললাম, তোমার ছায়াই বা দেখছো কেন? তুমি কি অত নিষ্ঠুর?

সে সাত্ত্বনায় কিছু হচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *