পাগলা দাশু
মেঘ ফুঁড়ে প্লেন নামছে। পায়ের নীচে বিশাল সেই শহর। এত উঁচু থেকেও তার বুঝি শেষ দেখা যায় না। আমি স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো চেয়ে থাকি। ক্রমে শহরটা ছুটে চলে আসে আমাকে লক্ষ করে। তারপর আর দেখা যায়। না তাকে। খানিক বড় ঘাসের মাঠ জানালার বাইরে উলটোদিকে ছুটে যায়। ঝম করে দমদম এয়ারপোর্টের কংক্রিটে পা রাখল প্লেন। হু হু করে কলকাতা ঢুকে যাচ্ছে আমার মধ্যে। অত্যন্ত দ্রুত আমার মগজের মধ্যে জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। আমার প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়।
মনে পড়ে গেল। সব মনে পড়ে গেল! ভারী লজ্জা করছিল কলকাতার মুখোমুখি হতে। ভুলে গিয়ে অপরাধী হয়ে আছি। আড়ষ্ট লাগছে একটু। দীর্ঘ প্রবাসের পর ফেরার মতো।
.
সায়ন।
ডাক শুনে শ্যামলা রোগা, ছোটখাটো মেয়েটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা নিয়ন আলোর মতো জ্বলে উঠল না তো। তবে স্বাভাবিক খুশিই দেখাল ওকে।
বলল, তুমি! কত ভাবছিলাম তোমার কথা। কই চিঠিতে আসবে বলে লেখোনি তো!
হঠাং এলাম।
কেমন ছিলে? কেমন জায়গা?
সে অনেক কথা সায়ন। চলো, কলকাতাটা ঘুরে দেখি।
ঠিক আগের মতো আমরা ট্রামে, বাসে উঠে উঠে চলে যাই এখানে সেখানে। ময়দানে, পার্কে, গঙ্গার ধারে, রেস্টুরেন্টে, থিয়েটারে, সিনেমায়। কথা ফুরোতে চায় না। রাত্রে বিছানায় শুয়ে মনে পড়ে এ কথাটা ওকে বলা হল না। কাল বলব। পরদিন নতুন কথা মনে পড়ে।
আমাদের পুরনো ভাড়াটে বাড়িটার সেই শ্যাওলাধরা কলতলার আঁশটে গন্ধ বুক ভরে নিই। মায়ের আঁচলের গন্ধ নিয়ে রাখি। রাত জেগে আড্ডা দিই ভাইবোনেদের সঙ্গে।
চারদিনের দিন কাকভোরে জানালা দিয়ে সেই স্বর এল।
শুনছেন।
ফুলচোর। আমি মৃদু হেসে মুখ তুলি।
যাক, চিনতে পারলেন।
পারব না কেন?
চোখের আড়াল হলেই তো আপনি মানুষকে ভুলে যান। তবে এখন এই কলকাতায় কী করে মনে পড়ল আমাকে?
কী জানি। হয়তো আপনাকে ভুলতে চাই না।
কলকাতা কি ফিরে এল আপনার মনে?
এল।
সায়ন্তনী?
সেও।
তা হলে আমি বরং যাই।
শুনুন।
কী?
আমার আর একটা কথাও মনে পড়ছে যে।
কী কথা?
আপনাকে আমি আগে কোথায় দেখেছি।
পলকে মিলিয়ে গেল ফুলচোর।
ঘুম ভেঙে আমি হঠাৎ টানটান হয়ে বিছানায় উঠে বসি। মাথার ঘুমোনো কোনও বন্ধ ঘর থেকে ফুলচোরের জলজ্যান্ত স্মৃতি বেরিয়ে এসেছে। বেশি দিনের কথা তো নয়, মাত্র বছরখানেক।
পরদিনই শঙ্কুর সঙ্গে দেখা করি। সব শুনে শঙ্কু খুব অপরাধী-হাসি হেসে বলে, সে সময়টায় মাথার ঠিক ছিল না। তোকে বলেই বলছি। ওই শহরে যখন আছিস, তখন সবই তো জানতে পারবি। কাটু আমার আপন পিসতুতো বোন।
কাটু! আমি ছ্যাকা খেয়ে চমকে উঠি। লিচুর মুখে কাটুর কথা শুনেছি না! অমিতদার ভাবী বউ।
শঙ্কু বিষণ্ন গলায় বলে, দোষটা আমারই। ও রাজি ছিল না।
তারা হোটেলে রাত কাটিয়েছিলি না সেদিন?
কাটিয়েছিলাম। কিন্তু কাটু নরম হয়নি। হলে আজ আমাদের ফ্যামিলিতে একটা বিরাট গণ্ডগোল হয়ে যেত। প্লিজ, এ ব্যাপারটা কাউকে বলিস না।
আমি মাথা নাড়লাম। বলব না।
.
সায়ন, আমাকে তোমার একটা ফোটো দেবে? আমি নিয়ে যাব।
ফোটো!–সায়ন্তনী একটু অবাক হয়ে বলে, ফোটো তো নেই। তোলানো হয়নি।
আমার যে দরকার।
সায়ন হাসে, তুমি এমন নতুন প্রেমিকের মতো করছ! ফোটো চাই তো আগে বলোনি কেন? তা হলে তুলিয়ে রাখতাম।
আমি ওর হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলি, চলো আজই দু’জনে ছবি তুলিয়ে রাখি।
সায়ন্তনী বাধা দেয় না, তবে বলে, আজ ফোটো তোলালে কি কাল দিতে পারবে? তুমি তো কালই চলে যাচ্ছ।
আমি ওর কথায় কান দিই না।
স্টুডিয়োয় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সায়ন্তনী আমার কানে কানে বলল, আমার ছবি ভাল ওঠে না।
ভালর দরকার নেই।
কেন চাইছ ছবি? শীতকালেই তো বিয়ে। আর কটা মাস।
হোক সায়ন। এই ক’টা মাসই হয়তো বিপজ্জনক।
কীসের বিপদ?
ফোটোগ্রাফার দৃঢ় স্বরে বলল, আঃ! কথা বলবেন না। আর একটু ক্লোজ হয়ে দাঁড়ান দু’ জনে।…আর একটু…নড়বেন না…রেডি…
সায়ন্তনী খুক করে হেসে ফেলে। ক্যামেরার একটা প্লেট নষ্ট হয়। ফোটোগ্রাফার রেগে যায়। আবার তোলে।
বেরিয়ে এসে সায়ন্তনী বলে, বাব্বা! ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে যা বুক ঢিবঢিপ করে।
কেন বুক ঢিবঢিব করে সায়ন?
কী জানি বাবা! মনে হয় একচোখে যন্ত্রটা আমার কী না জানি দেখে নিচ্ছে।
কী দেখবে! ক্যামেরাকে আমরা যা দেখাই তাই দ্যাখে। তার বেশি দ্যাখার সাধ্যই ওর নেই।
তবু ভয় করে।
মানুষের চোখ ক্যামেরার চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পারে, মানুষের চোখকে ভয় পাও না?
তোমার সব উদ্ভট প্রশ্ন, জানি না যাও। শোনো, তুমি কেন বললে এই ক’টা মাসই বিপজ্জনক?
ও এমনি।
তা নয়। তুমি কিছু মিন করেছিলে।
আমি ওর হাত ধরে মৃদু ভাবে চেপে রাখি মুঠোয়। বলি, আমার সব কিছুই কেন অন্য রকম বলো তো।
কী রকম?
অন্য রকম। আমার জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায়। সে ভীষণ উঁচু পাহাড়, অদ্ভুত তার রং। যেখানে ভয়ংকর জোরে বৃষ্টি নামে। গাছপালা ভীষণ ঝাঁঝালো।
সায়নী সামান্য রুক্ষ স্বরে বলে, ও জায়গাটা তো আর রূপকথার দেশ নয়। ওরকমভাবে বলছ কেন?
তা ঠিক। তবু আমার যেন কী রকম হয়।
কী হয়, বলবে?
আমার কিছুতেই কলকাতার কথা মনে পড়ে না। তোমার কথাও না।
তাই ফোটো তুলে নিলে?
হ্যাঁ।
সায়ন্তনী ম্লান মুখে হেসে বলল, জানলা দিয়ে পাহাড় ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না তো?
আর কী?
কোনও মহিলাকে?
যাঃ, কী যে বলো।
লোকে এমনি-এমনি তো ভুলে যায় না! পাহাড়, প্রকৃতি, বৃষ্টি এগুলো কি ভুলে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
না, তা হয়তো নয়।
তবে কী?
আমি ক্লিষ্ট হেসে বলি, বোধ হয় মাথায় সেই চোট হওয়ার পর থেকে আমার ব্রেনটা একটু ডিফেকটিভ হয়ে আছে সায়ন।
সায়ন্তনী ভ্রু কোঁচকায়। বলে, তোমার ব্রেন খারাপ হলে আমি সবচেয়ে আগে টের পেতাম। তোমার মাথায় কোনও দিন কোনও গোলমাল হয়নি।
তবে ভুলে যাচ্ছি কেন?
একদিন তুমিই তা বলতে পারবে।
তুমি পারো না?
না। সায়ন্তনী মাথা নাড়ে, আমি তোমার কী-ই বা জানি বলো? ওখানে গিয়ে তোমার কী হল তা এতদূর থেকে বলব কী করে? তবে মনে হচ্ছে তুমি ফিরে গিয়ে আবার আমাকে ভুলে যাবে।
না না–বলে আমি ওর হাত চেপে ধরি! তারপর শিথিল অবশ গলায় বলি, আমি তো ভুলতে চাইনা।
বলেই মনে হয়, মিথ্যে বললাম নাকি?
পরদিনই আমি দার্জিলিং মেল ধরি। সঙ্গে সদ্যতোলা সায়ন্তনীর ছবি। বারবার নিজেকে আমি বোঝাই, ভুলব না। এবার ভুলব না।
বাংকে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত্রি ভেদ করে ট্রেন চলেছে। ভোর হবে এক আশ্চর্য সুন্দর অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকায়। শরৎকাল আসছে। ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ উপুড় করে দেবে তার বোদ। সে ভারী সুন্দর জায়গা। আমি সেখানে যাচ্ছি।
কে যেন গায়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে ডাকল, শুনছেন?
উ!
আপনার জলের ফ্লাস্কটা একটু নেব? আমাদেরটায় জল নেই।
নিন না। ওই তো রয়েছে।
বলে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। ঘুমচোখে অস্পষ্ট দেখতে পাই, আমার ফ্লাস্ক খুলে নীচের সিটে একটা বাচ্চা ছেলেকে চুকচুক করে জল খাওয়াচ্ছে তার মা, আর তার বাবা মুগ্ধ চোখে দৃশ্যটা দেখছে।
আহা, দৃশ্যটা বড় সুন্দর। দেখতে দেখতে আমি ঘুমে ঢলে পড়ি। কাল আমি আবার সেই মহান পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে পাব। অন্ধকারে হঠাৎ জাহাজের মতো ভেসে ওঠ ভোরের পাহাড়, ব্রোঞ্জের রং ধরে। ব্রোঞ্জ ক্রমে সোনা হয়।
কাকভোরে ফুলচোর আসবে ঠিক। ডাকবে, শুনছেন!
আপনার ঘড়িটা! ও মশাই!
আমি ঘুমের টিকিট আঁটা চোখ খুলে বলি, উ।
ঘড়িটা দিয়ে দিন।
আমি বাঁ হাতের ঘড়িটা খুলে লোকটার হাতে দিয়ে দিই। চোখ বুজেই দেখি, পাহাড়ের গায়ে সেই পাথরটায় বসে আছি। ঘন্টানাড়া একটা পাখি ডাকছে। ঝোরার শব্দ।
পেটে একটা খোঁচা লাগে। ককিয়ে উঠে আবার চোখ মেলি। প্রবল হাহাকারের শব্দ তুলে উন্মত্ত ট্রেন ছুটছে। প্রচণ্ড তার দুলুনি। মুখের সামনে আর একটা কাঠখোট্টা মুখ ঝুঁকে আছে।
আপনার মানিব্যাগটা?
হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা ঘুমন্ত হাতে বের করে দিয়ে দিই। তারপর ঘুমে তলিয়ে যাই আবার। ঘুমের মধ্যে লিচুদের হারমোনিয়ামটা প্যা-পোঁ করে বাজতে থাকে। বারবার বাজে। বেজে বেজে বলে, সখি ভালবাসা কারে কয়, সে কি শুধুই যাতনাময়…
কে যেন একটা লোক বিকট চেঁচিয়ে বলছে, শব্দ করলে জানে মেরে দেব! চোপ শালা! জানে মেরে দেব! কেউ শব্দ করবে না। জান নিয়ে নেব।
ফের আমাকে কে যেন ধাক্কা দেয়, আর কী আছে? ও মশাই আর কী আছে?
কে যেন কাকে একটা ঘুসি বা লাথি মারল পাশের কিউবিকলে। বাবা রে!’ বলে ককিয়ে উঠে। একটা লোক পড়ে যায়। তারপর ভয়ে বীভৎস রকমের বিকৃত গলায় বলে, মেরো না! মেরো না! দিচ্ছি।
আর একটা শব্দ করলে মাল ভরে দেব! চোপ শুয়োরের বাচ্চা।
একটা হাত আমার কোমর, পকেট, জামার নীচে হাতড়াচ্ছে। আমি চোখ মেলে চাইতেই মুখের সামনেকার হলুদ আলোটা কটকট করে চোখে লাগল।
কী চাই? আমি কাঠখোট্টা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম।
আর কী আছে?
আমি চোখ বুজে বলি, কিছু নেই।
হয়তো আবার ঘুমের ঝোঁক এসেছিল। আবার কে যেন ডাকল, শুনছেন?
ফুলচোর। আমি মাথা তুলে শিয়রের জানলাটা দেখতে চেষ্টা করি।
শুনছেন! শুনছেন।–খুব চাপা জরুরি গলায় আমাকে ডাকছে কেউ। নীচের সিটে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল।
শুনুন না। শুনছেন না কেন? বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন একজন মহিলা।
আমি চোখ চাই।
কী হয়েছে?
সেই বাচ্চার মা মুখ তুলে চেয়ে আছে আমার দিকে। মুখে আতঙ্ক, চোখে জল।
ওরা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। কী হবে?
কারা?– আমি বিরক্তির গলায় বলি।
ডাকাতরা। এতক্ষণ ধরে কী কাণ্ড করল টের পাননি? প্লিজ। কেউ কিছু বলছে না ওদের।
শুনতে শুনতেই আমি নেমে পড়তে থাকি বাংক থেকে।
আপনার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল কেন?
বাচ্চার হাত থেকে বালা নিতে চেয়েছিল, আমার হাজব্যান্ড নিতে দিচ্ছিল না। ওই শুনুন।
বাথরুমের দিক থেকে একটা কান ফাটানো আওয়াজ আসে। বোধ হয় চড়ের আওয়াজ।
কামরার সব লোক চোখ চেয়ে স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। নড়ছে না।
আমি বরাবর দেখেছি, আমি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই আমার শরীর তার কাজে নেমে পড়ে। এ দুইয়ের মধ্যে বোধ হয় একটা যোগাযোগের অভাব আছে।
বাথরুমের গলিতে অল্প আলোয় একটা লোককে গাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরে আছে চার মস্তান। হাতে ছোরা, রিভলভারও।
একবার দু’বার মার খাওয়ার পর আর মারের ভয় থাকে না। আমার ভয় অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল না। আমি বহুবার মার খেয়েছি। আমার মাথার একটা অংশ বোধ হয় আজও ফাঁকা।
আমি কিছু ভাবি না। পিছন থেকে চুল ধেরে দুটো লোককে সরিয়ে দিই তাঁচকা টান মেরে। রিভলবারওয়ালা ফিরে দাঁড়াতে না পাড়াতেই আমার লাথি জমে যায় তার পেটে।
কমিকসের বীরপুরুষরা একাই কত লোককে ঘায়েল করে দেয়। জেমস বন্ড আরও কত বিপজ্জনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সিনেমার হিয়োরা অবিরল ক্লান্তিহীন মারপিট করে যেতে পারে।
হায়! আমি তাদের মতো নই।
তবু প্রথম ঝটকায় ভারী চমৎকার কাজ হয়ে যায়। একটা লোক বসে কোঁকাচ্ছে, বাকি তিনটে ভ্যাবাচ্যাকা। কিন্তু সেটা পলকের জন্য মাত্র।
আমি আর একবার হাত তুলেছিলাম। সে হাত কোথাও পৌঁছোয় না। একজন চাপা ভয়ংকর গলায় বলল, ছেড়ে দে। আমি দেখছি।
পিঠের দিক থেকে একটা ধাক্কা খাই। একবার, দু’বার।
ধাক্কাগুলো সাধারণ নয়। কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। পেটটা গুলিয়ে ওঠে। মাথাটা চক্কর মারতে থাকে।
কে যেন বলল, আর একটু ওপরে আর একবার চালা!
চালাল। তৃতীয়বার ছড়াৎ করে খানিকটা রক্ত ছিটকে আসে সামনের দিকে।
আমি মুখ তুলি। দেয়ালে ঠেস দেওয়া বাচ্চার বাবা আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছে।
আমি তাকেই জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে আমার?
লোকটা হতভম্বের মতো মাথা নেড়ে জানাল, না।
আমি অবাক হই। কিছু হয়নি? তবে আমার দুটো হাতের আঙুল কেন কুঁকড়ে আসে? কেন উঠতে পারছি না? পায়ের কাছে কেন এক পুকুর রক্ত জমা হচ্ছে?
চারটে লোক সরে যায় দু’দিকে দরজার কাছে। উপুড় হয়ে আমি বসে আছি। কিন্তু বসে থাকতে পারছি না। বড় ঘুম। বমি পাচ্ছে। শরীরটা চমকে চমকে উঠছে।
পিছন থেকে বাচ্চার মা ডাকছে, চলে এসো! কী বোকার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ ওখানে?
বাচ্চার বাবা চমকে ওঠে। তারপর সাবধানে রক্তের পুকুরটা ডিঙিয়ে বাচ্চার মায়ের কাছে যায়। তারপর তারা বোধ হয় ফিরে গেল তাদের বাচ্চাটার কাছে। যাবেই তো! বাচ্চাটা ভীষণ কাঁদছে।
ট্রেন হুইসিল দিচ্ছে বার বার। কুক বুক কু-উ। কুক কুক কুউ! থেমে আসছে গাড়ি। দু’ দিকের দরজা খুলে যায়। চারটে লোক নেমে গেল।
আমার গলা দিয়ে ঘরর ঘরর করে একটা শব্দ হয়। জিভে সামান্য ফেনা। ধোঁয়াটে চোখেও আমি দেখতে পাই, মুখের ফেনার রং লাল।
হঠাৎ কামরায় তুমুল হট্টরোল ফেটে পড়ল। কারা চেঁচাচ্ছে, খুন! খুন! ডাকাত! বাঁচাও! খুবই ক্ষীণ শোনায় সেই শব্দ। আমার কানে ঝি ঝি ডাকছে। ঘন, তীব্র, একটানা।
কয়েকজন আমাকে তুলছে মেঝে থেকে। চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। লাভ নেই।
সায়ন!
তুমি আমার কেউ না।
আঃ সায়ন!
আমি তোমাকে ভুলে গেছি।
উঃ সায়ন।
ছবিটা ফেরত দেবে? আমাদের জোড়া ছবি কারও হাতে পড়লে কী ভাববে বলো তো! তুমি বেঁচে থাকলে এক কথা ছিল। তা যখন হচ্ছে না তখন কেন ওটা রাখবে? দাও নষ্ট করে ফেলি।
আমি ওর কথার যুক্তিযুক্ততা বুঝতে পারি। ছবিটা বের করে ওর হাতে দিই। ও বসে বসে ছিঁড়তে থাকে।
লিচু।
ওঃ দারুণ মজা! দারুণ মজা!
কেন লিচু?
দেখুন, কত বার হাতবদল হয়ে আমাদের হারমোনিয়াম আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে।
খুশি ত লিচু?
ভীষণ। হারমোনিয়াম থাকলে আর কিছু চাই না। ঘর না, বর না, টাকা পয়সা না।
একদিন জ্যোৎস্নারাতে তুমি কিন্তু আমাকে চেয়েছিলে লিচু!
উঃ!–লিচু লজ্জায় মুখ ঢাকে। বলে, তা ঠিক। তবে গরিবরা সব সময়ই এটা চায়, ওটা চায়। না পেলেও দুঃখ হয় না আমাদের। আপনি কিছু ভাববেন না। হারমোনিয়াম আমাকে সব ভুলিয়ে দেবে।
শিয়রের জানালায় ফুলচোর ডাক দেয়, শুনছেন!
ফুলচোর!
কলকাতায় কী হল?
সে অনেক কথা।
ম্লান মুখে বিষণ্ণ গলায় ফুলচোর বলল, আমাকে চিনতে পারলেন শেষমেষ?
না, ফুলচোর।
বললেন যে সেদিন।
ওটা মিথ্যে কথা। আপনি তো কোনওদিন কলকাতায় যাননি।
ফুলচোর জানালার গ্রিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে, আপনি সব জানেন, আপনি সব জানেন। এখন আমার কী হবে?
কিছু হবে না। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, আমি কাউকে বলিনি। কোনওদিন বলব না। ভুলে যাব। দেখবেন।
ফুলচোর চোখের জল মুছে হাসে, আমি জানতাম, আপনি কখনও অত নিষ্ঠুর হতে পারেন না। আপনার মন বড় সুন্দর। লিচুদের হারমোনিয়ামটা নইলে আপনি কিনতেন না।
পশুপতিকে বলবেন লিচুদের হারমোনিয়ামটা যেন দিয়ে দেয়।
বলব।
এই জানলাটা এখন কি খুব ফাঁকা লাগবে আপনার?
ওমা! লাগবেনা? আমি তো রোজ আসি। যখন আপনি ছিলেন না তখনও। ফাঁকা জানলায় একা একা কত কথা কয়ে যাই।
ফাজিল।
ফুলচোর তাকায়। চোখে করুণ দৃষ্টি।
কোনওদিন বোঝেননি আপনি বলতে বলতে ফুলচোরের সুন্দর ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে।
কী বুঝব?
আমি বুঝি শুধু আপনার সেই আমাকে মনে পড়ার ভয়ে আসতাম?
তবে?
আমি আসতাম ফুল তুলতে। স্বাচ্ছন্নের মতো বলে ফুলচোর।
আমি চেয়ে থাকি। বুকের মধ্যে ডুগডুগির শব্দ।
ফুলচোর অকপটে চেয়ে থেকে বলে, একটা সাদা ফুল। ছোট্ট, সুন্দর।
ফাজিল।
দেবেন সেই ফুলটা আজ? দিন না!
ফুলচোর হাত বাড়ায়। গভীর গাঢ় স্বরে বলে, সাদা সুন্দর ফুলের মতো ওই হৃদয়। দেবেন?
আমি চোখ মেলি। হাসপাতালের ঘর নয়? তাই হবে। উপুড় করা রক্তের বোতল থেকে শিরায় ড্রিপ নেমে আসছে। নাকে নল।
একটা কালো ঢেউ আসে।
কে যেন চেঁচিয়ে বলছে, গাড়ি বদল! গাড়ি বদল!
মাঝরাতে অন্ধকার এক জংশনে গাড়ি থেকে নামি। ঘোর অন্ধকার প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ওপাশে এক অন্ধকার ট্রেনের কামরায় গিয়ে উঠি। একা।
জানলার ধারে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে থাকি।
ট্রেন ছাড়ে। দুলে দুলে চলে। কোথায় যাচ্ছি তা প্রশ্ন করতে নেই। কেউ জবাব দেবে না।
তা ছাড়া কোথায় যাচ্ছি তা তো আমি জানি।
কিন্তু জানালায় তবু ফুলচোরের মুখ ভেসে আসে। করুণ, তীব্র এক স্বরে সে বলে, পৃথিবী আর সুন্দর থাকবে না যে। ফুল ফুটবে না আর! ভোর আসবে না। আপনি যাবেন না, আমাকে দয়া করুন।
আপনাকে দয়া, ফুলচোর? হাসালেন!
কেন যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? আমাদের কাছে থাকতে আপনার একটুও ইচ্ছে করে না?
আমি একটু হাসবার চেষ্টা করি। বলি, বড় মারে এরা। বড় ভুল বোঝে। প্রত্যাখ্যান করে। তার চেয়ে এই লম্বা ঘুমই ভাল। অনেক দিন ধরে আমি এই রকম ঘুমিয়ে পড়তে চাইছি ফুলচোর।
আমি যে রোজ একটা ফুলই তুলতে আসতাম তা কি জানেন?
জানি।
আজও সেই ফুল ভোলা হল না আমার। পৃথিবীতে তো সেই ফুল আর ফুটবে না কোনও দিন। প্লিজ!!
আমি ক্লান্ত বোধ করি। বলি, আপনি বাগদত্তা, ফুলচোর।
খুব জানেন। বোকা কোথাকার।
নন?
নই।
আর সায়ন?
পৃথিবীতে আর কেউ আমার মতো অপেক্ষা করছে না আপনার জন্য। শুধু আমি। শুধু একা আমি।
কেন ফুলচোর?
ওই সুন্দর সাদা ছোট্ট ফুল, ওটা আমার চাই।
আস্তে আস্তে গাড়ি থামে। পিছু হটে। আবার জংশন। আবার গাড়িবদল।
চোখের পাতায় হিমালয়ের ভার। তবু আমি আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাই।