১১. পাক-ভারত উপমহাদেশে ধর্মান্দোলন ও ধর্মসংস্কারচিন্তা

একাদশ অধ্যায় – পাক-ভারত উপমহাদেশে ধর্মান্দোলন ও ধর্মসংস্কারচিন্তা (Religious Movement and Reformation in Indo-Pak Sub-Continent )

গীতায় ধর্মসংস্কারচিন্তা

খ্রিষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশের উচ্চবর্গের সমাজপতিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে খ্রিষ্টধর্মের বাইবেল বা ইসলাম ধর্মের কোরান-এর মত হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোন একটি মৌলিক শাস্ত্রগ্রন্থ নেই। রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মাধ্যমে, আর আরব আক্রমণের ফলে, বাইবেল ও কোরান-এর গুরুত্ব সম্বন্ধে তাঁরা অবহিত হয়েছিলেন, আর হিন্দু ধর্মের সুরক্ষার জন্য এরকম একটি মৌলিক ধর্মগ্রন্থের অবশ্য প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করেছিলেন, যার মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল সামাজিক ও আধিবিদ্যক বক্তব্য ও অনুশাসনগুলি ঈশ্বরের বিধান হিসেবে সংক্ষেপে এক সঙ্গে পাওয়া যাবে। শংকরাচার্য (৭৮৮- ৮২০ খ্রি.) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গীতাশাস্ত্রই সেই ধর্মগ্রন্থ। বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিরোধেও ভগবদ্গীতা এক বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। গবেষকরা মনে করেন ভগবদ্গীতা শুধুমাত্র বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্য করেই রচিত হয়নি। স্লেচ্ছঅনার্য, ভূমিপুত্র অনার্য, এবং লোকায়তসহ সমস্ত বিধর্মী এবং নাস্তিকদের লক্ষ্য করেই রচিত হয়েছিল। তাছাড়া আর্যসমাজের অন্তর্গত শূদ্রদের বশে রাখাও ছিল গীতা রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য। এজন্য গীতায় শ্রীভগবানের মুখে অসুর প্রকৃতির সমস্ত মানুষের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করতে যে অগণিত অনার্য ও শূদ্র অসম্মত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ পরিণতির এবং নরকভোগের সতর্কবাণী বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে আত্মার অবিনশ্বরতা ও জন্মান্তর, যাগযজ্ঞের এবং নিত্যকর্মের অবশ্য প্রয়োজনীয়তা, চাতুবর্ণের দৈব উৎপত্তি, শূদ্র ও নারীর আর্থসামাজিক হীনস্থান, ঈশ্বরে ভক্তি ও আত্মসমার্পণ এবং নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের কতকগুলি মৌলিক তত্ত্ব উপাদানের জোরালো ঐশ্বরীয় সমর্থনও ভগবদ্গীতায় ব্যক্ত হয়েছে। পৃথিবীর দুষ্কৃতীদের বিনাশ এবং সাধুদের পরিত্রাণ করবার উদ্দেশ্যে শ্রীভগবান অবতাররূপে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের এই বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাসের কারণেই ভগবদ্গীতা হিন্দুদের ঘরে ঘরে সমাদৃত। গীতার জ্ঞানযোগ সংক্রান্ত চতুর্থ অধ্যায় শ্রীভগবানের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে সেই বিখ্যাত উক্তি :

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (গীতা ৪/৭-৮)

যখন যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, হে ভারত, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতীদের বিনাশ, এবং ধর্ম সংস্থাপন করবার উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। আঠার দিনব্যাপী সংঘটিত কৃরুক্ষেত্র (বর্তমান হরিয়ানা) যুদ্ধের প্রাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর সখা অর্জুনের মধ্যে যে সংলাপ হয়েছিল— সেই সংলাপের সমন্বিত রূপই শ্রীমদ্ভবদ্‌গীতা।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর এক গবেষণার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন, আদিতে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে কোন পার্থক্য ছিল না। এই দুই ধর্মের চিন্তা- চেতনাও এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তা’আলার দিকে প্রসারিত ছিল। এই দুই ধৰ্মই নিরাকার একেশ্বরবাদী এক স্রষ্টায় সমর্পিত। পরবর্তীকালে ইশ্বরোপসনায় যে- আকৃতি আরোপ করেছে তা স্বাতন্ত্র্য স্বার্থের সংযোজন মাত্র। বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি ইত্যাদি ধর্মেও তাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ হিন্দু ধর্মের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লিখিত বিখ্যাত শ্লোক ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত’– এর প্রক্ষিপ্ত অংশের উদ্দেশ্য এবং পরবর্তীকালে এর প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির পূর্বাপর তথ্যের ইতিবৃত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, শ্লোকটি মূলে একরূপ ছিল, পরবর্তী যুগে শাস্ত্রকারদের হাতে বিকৃত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, দশম শতকের বিখ্যাত পণ্ডিত অভিনব গুপ্ত তাঁর সম্পাদিত শ্রীমদ্ভগবদগীতা সংকলনে হিন্দু ধর্মে অবতারবাদের সমর্থনে শ্লোকটির বিকৃতি ঘটায়। পূর্বে শ্লোকটি ছিল :

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতে ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মংশং সৃজম্যহম্।।

পরবর্তীকালে এই শ্লোকটি পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় :

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।

এর ফলে শ্লোকটির অর্থ যেখানে ছিল— যখনি ধর্মে গ্লানি উপস্থিত হয় ধর্ম সংস্থাপনার্থে শ্রীভগবান স্বীয় আত্মার অংশে (সৃষ্ট) অবতার প্রেরণ করেন। পরিবর্তিত অর্থে সেখানে হয়েছে— যখনি ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয় ধর্ম সংস্থাপনার্থে শ্রীভগবান স্বয়ং অবতাররূপে অবতীর্ণ হন। ফলে স্রষ্টা সৃষ্টিকর্তার স্থান থেকে নেমে এসে সৃষ্টবস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। যা সকল ধর্ম মতের বিরোধী। প্রথম শ্লোকে (মূল শ্লোকে) ‘তদাত্মংশং’ থেকে ‘তদাত্মানং’-এ রূপান্তরের ফলে নিরাকার একেশ্বরের অনুভূতি পৌত্তলিকতায় রঞ্জিত হয়ে যায়। এভাবে মূল ‘তৌহিদবাদী’ হিন্দু ধর্মমতও পৌত্তলিক ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলে তা ছিল না। (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, “ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মিলন ভূমি’, উদ্বোধন, অগ্রহায়ণ, ১৩৪০/১৯৩৭ বঙ্গাব্দ)।

বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তক চৈতন্যদেব ও তাঁর ধর্মান্দোলন

বাঙালির ভাবাবেগকে ধর্মান্দোলনে রূপায়িত করে, বাঙালির জাতীয় চেতনার মর্মমূলে, যিনি অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছিলেন তিনি প্রেমের অবতার, ভক্তিবাদের প্রবক্তা, মহাপুরুষ চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রি.) চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম বিশ্বম্ভর। সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর তাঁর নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সংক্ষেপে চৈতন্য। এছাড়া নিমাই, গৌরাঙ্গ, গৌরহরি, মহাপ্রভু, গোরাচাঁদ, গোরা প্রভৃতি নামেও তিনি পরিচিত। চৈতন্যদেব ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফাল্গুন পূর্ণিমার দিন এক ব্রাহ্মণ পরিবারে নবদ্বীপ ধামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র, মাতার নাম শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্রের পিতা উপেন্দ্র মিশ্রের নিবাস ছিল সিলেট জেলায়। বিদ্যার্জনের জন্য জগন্নাথ মিশ্র সিলেট থেকে নবদ্বীপ ধামে আগমন করেন। এখানেই তিনি শচীদেবীকে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসতি গড়েন। চৈতন্যদের জন্মগ্রহণ করার পূর্বে তাঁর মাতা শচীদেবীর কয়েকটি সন্তান অকালে মৃত্যুবরণ করেন। বেঁচে থাকেন জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বরূপ ও কনিষ্ঠপুত্র চৈতন্য। চৈতন্যদেব যখন ছোট তখন বিশ্বরূপ টোলের পড়া শেষ করে সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করেন। বিশ্বরূপ সংসার ত্যাগী হলে চৈতন্যদেবের পিতা-মাতা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা মনে করেন চৈতন্যদেবও লেখাপড়া শিখলে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করবে। তাই তাঁরা চৈতন্যদেবকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু চৈতন্যদেবের লেখাপড়ার প্রতি ছিল দুর্নিবার আগ্রহ। শেষ পর্যন্ত জগন্নাথ মিশ্র চৈতন্যের জেদের কাছে হার মেনে চৈত্যদেবকে টোলে প্রেরণ করেন। চৈতন্য গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যাকরণ, কাব্য, দর্শন ও অলংকারশাস্ত্র অধ্যয়ন করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ শেষ করে বাড়িতে টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে চৈতন্যদেবের পিতা মৃতুবরণ করলে বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে চৈতন্যদেব বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে সংসার সুখ সাব্যস্ত হয়েছিল— ‘প্রেমধর্মে আপনার অধিকার’। ফলে সমগ্র দেশেই দেখা দিল এক অপূর্ব ভাব-বিপ্লব। যার মহানায়ক হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু।

জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল-এ আছে রথের সামনে নৃত্য করবার সময়ে চৈতন্যদেবের পায়ে ইটের টুকরো বিদ্ধ হয় এবং পরে তা বিষাক্ত ক্ষতে পরিণত হয়। এ ব্যাধিতেই মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন পুরীধামে ভবলীলা সংবরণ করেন।[২৬]

[২৬. কিন্তু সাম্প্রতিকালের অধিকাংশ গবেষকের অভিমত এই যে, শ্রীচৈতন্যকে পুরীর ধর্মীয় পাণ্ডারা খুন করে মন্দিরের মধ্যেই সমাহিত করে রাখে। অন্য একটি মতে, তাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়।]

বাঙালির মধ্যযুগের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেবই বাঙালির জাতীয় চরিত্রের বিশিষ্ট লক্ষণগুলো নির্দিষ্ট করে গিয়েছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালি ধর্ম-দর্শনে, ভাষা-সাহিত্যে, সংগীত-ভাস্কর্য-চিত্রকলায় এক মহৎ চেতনার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। চৈতনদেবই গৃহাঙ্গণের রুদ্ধদ্বার গোষ্ঠী-কীৰ্তনকে রাজপথের জন-সংকীর্তনে পরিবর্তিত করেছিলেন। উত্তর ভারতের ভক্তিবাদের মত জাতিভেদকে সরাসরি অস্বীকার না করলেও, ভক্তির সর্বাতিশায়ী গৌরবে তিনিই ঘোষণা করেছিলেন ‘চণ্ডালোঽপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণ। শাস্ত্র-পুরাণ ঐতিহ্যে পুষ্ট ভক্তিবাদীর এই ঘোষণার তাৎপর্য সেদিনকার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক। ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ভেদ, ধনী-দরিদ্রের ভেদ, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদ— সমাজের ধর্মীয়, আর্থিক, সাংস্কৃতিক অসাম্য ও বিভেদের সামগ্রিক কাঠামোকেই ভক্তির অস্ত্রে প্রবল আঘাত করেছিলেন নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের তরুণ নায়ক চৈতন্য। গড়ে তুলেছিলেন বৈষ্ণবদের স্বতন্ত্র সংগঠন ও সমাজ। চৈতন্যের এই ধর্মান্দোলন সমকালীন স্মার্ত সমাজের চোখে চৈতন্য ও তাঁর বৈষ্ণবগোষ্ঠী ‘একঘরে’ হয়ে পড়েছিলেন, ভক্তি-আন্দোলন উপহাসের বস্তু হয়ে উঠেছিল। নবদ্বীপের বৈষ্ণবগোষ্ঠীর এবং সামগ্রিকভাবে ভক্তি-আন্দোলনের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেরণাই ছিল চৈতন্যের সন্ন্যাসের মূলে। তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণ এক প্রচণ্ড নৈতিক সাহসের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। ‘সন্ন্যাসীরে সর্ব্বলোক করে নমস্কার।’ আন্দোলনের নায়ক চৈতন্য নিজে সন্ন্যাস নিয়ে সর্বলোকের নমস্কার যেমন পেয়েছিলেন, তেমনি তাঁর আন্দোলন, তাঁর অনুগামীরাও যে নমস্কৃত হয়েছিলেন ইতিহাসই তার সাক্ষ্য দেয়।

মধ্যযুগে ইসলামধর্মের প্রচার ও প্রসার রোধকল্পে শ্রীচৈতন্য দেব যেমন ‘বৈষ্ণব ধর্মমত’ প্রচার আরম্ভ করেন এবং জাত-পাতে বিভক্ত হিন্দু-সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য বলেন ‘মুচিও শুচি হয় যদি কৃষ্ণ ভজে’ অর্থাৎ‍ কৃষ্ণনাম ভজনা করলে নিম্নশ্রেণিও শুদ্ধতা ফিরে পায়। তেমনি ঊনবিংশ শতাব্দীতে খ্রিষ্টীয়, ব্রাহ্মধর্মসহ অন্যান্য আধুনিক চিন্তা-চেতনার গতি রোধ করবার জন্যই রামকৃষ্ণ বাধ্য হয়েছিলেন সকল ধর্মের সত্যতা স্বীকার করতে। এর মধ্যে দিয়ে তিনি হিন্দুধর্মকেই ত্রাণ করে গেছেন।

বৈষ্ণব আন্দোলনপ্রধান ‘ষড়গোস্বামী’র অবদান

মহাপ্রভু চৈতন্যদেব শিষ্যদের জন্য কোন বিধিবদ্ধ শাস্ত্র রেখে যাননি। চরিতকারগণ যেসব তত্ত্ব ও তথ্য তার মুখে উচ্চারিত বলে বর্ণনা করেছেন, সেগুলো প্রমাণসিদ্ধ নয় বরং বিতর্কিত বিষয়।

চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর গৌড়ীয় নববৈষ্ণবদের চর্চা ও আচার-আচরণ বিধির শৃঙ্খলিত রূপের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিধি-নিষেদের শাস্ত্র যেমন আবশ্যিক তেমনি বিশ্বাস ও মতকে অবিকৃত রাখার জন্যে উপলব্ধ তত্ত্বের ও গৃহীত তথ্যের একটা দার্শনিক ভিত্তিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই দুঃসাধ্য কাজ যারা অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সুসম্পন্ন করলেন তারাই বৈষ্ণবসমাজে ‘ষড়গোস্বামী’ নামে প্রাতঃস্মরণীয় ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। ষড়গোস্বামী গোষ্ঠীর শাস্ত্রকার ও দার্শনিকদের মধ্যে তিনজনই ছিলেন একই পরিবারের সদস্য। এঁরা হলেন— রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী নামক দুই ভাই ও তাদের অপর ভ্রাতা অনুপমের পুত্র জীব গোস্বামী। অন্য তিনজন হলেন— গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট ও রঘুনাথ দাস। রূপ ও সনাতন গোস্বামী চৈতন্যদেবের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। চৈতন্যের জীবৎকালেই তাঁর নির্দেশে রূপ ও সনাতন চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় নববৈষ্ণব মতবাদ প্রচার ও প্রসারের জন্যে এবং বৈষ্ণবদের পবিত্র তীর্থভূমি রূপে বৃন্দাবনকে গড়ে তুলতে বৃন্দাবনে বাস করতে থাকেন। নিম্নে ষড়গোস্বামীর সংক্ষিপ্ত স্বতন্ত্র পরিচয় উদ্ধৃত হল :

১. সনাতন গোস্বামী কর্ণাটী ব্রাহ্মণ এবং জমিদারবংশীয় ছিলেন। এঁরা প্রথমে নৈহাটিতে (নবহট্টে) পরে চন্দ্রদ্বীপে (বাকলায়-বরিশালে) এবং চৈতন্যদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার প্রাক্কালে যশোরে বসতি স্থাপন করেন। চার সহোদর সনাতন, রূপ, অনুপম এবং তাদের অজ্ঞাত নামা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হোসেন শাহর উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন।

২. রূপ গোস্বামী বৈষ্ণবদের মূলধারার শাস্ত্রকারদের মধ্যে অন্যতম। তিনি অসামান্য তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ছিলেন। বৈষ্ণব মতবাদকে সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনন্য ভূমিকা পালন করেন রূপ গোস্বামী। অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে— ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রূপ গোস্বামী জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দের আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। রূপ গোস্বামী রচিত গ্রন্থাবলি বৈষ্ণব সমাজে আজও গুরুত্ব সহকারে পাঠ করা হয়। বিশেষ করে তাঁর উজ্জ্বলনীলমণি ও ভক্তিরসামৃতসিন্ধু শাস্ত্রগ্রন্থের মর্যাদা সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত।

৩. জীব গোস্বামী সনাতনের ভাই অনুপমের পুত্র। অনুপম গৌড়ের সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহের টাঁকশালের অধ্যক্ষ ছিলেন। অনুপম পালিয়ে প্রয়াগে চৈতন্যদেবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কিছুকাল পরে তাঁর মৃত্যু হয়। কাশীতে জীব তাঁর শিক্ষাগুরু মধুসূদন বাচস্পতির কাছে ব্যাকরণ, স্মৃতি ও বেদান্ত পাঠ করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

৪. রঘুনাথ ভট্ট চৈতন্যদেবের প্রথম শিষ্য ছিলেন। ইনি ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় তপন মিশ্রর পুত্র। তপন মিশ্র সপরিবারে কাশীবাসী হয়েছিলেন ।

৫. রঘুনাথ দাস সপ্তগ্রামের জমিদার গোবর্ধন মজুমদারের পুত্র ছিলেন। তাঁর ঐশ্বর্য ছিল অতুল, ঘরে ছিল রূপসী স্ত্রী। তবু ঐশ্বর্যের মোহ আর রূপসী স্ত্রীর আকর্ষণ তাকে গৃহে বন্দি করে রাখতে পারেনি। কিশোর বয়সেই তিনি চৈতন্যদেবকে দেখবার জন্য (১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে) শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের গৃহে গিয়েছিলেন।

৬. গোপাল ভট্ট দাক্ষিণাত্যের শ্রীরঙ্গমবাসী ত্রিমল্লভট্টের পুত্র ছিলেন। ত্রিমল্লভট্টের বাসগৃহ চৈতন্যদেবের চরণধূলিধন্য ছিল। গোপাল ভট্ট শ্রীনিবাস আচার্যের দীক্ষাগুরু ছিলেন।

বৈষ্ণবধর্ম ও ধর্মান্দোলনের স্মরণীয় ইতিহাস প্রণেতা

বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাসতত্ত্বে আরো একটি ধারা ক্রমশ বিকশিত হয়। তা হল, এই ধর্মের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে আলোচনার ধারা। লক্ষণীয়, এটিরও সূত্রপাত করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বিষয়টি সম্পর্কে তথ্য ও প্রমাণ সহ আলোচনা করেন ভাণ্ডারকর, রমাপ্রসাদ চন্দ, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিমানবিহারী মজুমদার, জীতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নেদারল্যাণ্ডস-এর ভারততত্ত্ববিদ জান্ গোণ্ডা।

কিন্তু চৈতন্যের ধর্মান্দোলন সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা ইতিহাসের ছাত্রপাঠ্য পুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল। এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কোন কোন পণ্ডিত সচেতনও ছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত তথ্য জানার ও নির্ধারণের প্রয়োজনে মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ লিখলেন সুশীলকুমার দে, রাধাগোবিন্দ নাথ, গিরীন্দ্রনারায়ণ মল্লিক, বিমানবিহারী মজুমদার এবং হরিদাস দাস। এই পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিচারপদ্ধতি বিভিন্ন এবং এরাই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাসকে লক্ষণীয় ভাবে সম্প্রসারিত করেছেন।

বহু তথ্যে সমৃদ্ধ, অসাধারণ পাণ্ডিত্যে মহিমান্বিত সুশীলকুমার দের গ্রন্থে চৈতন্যের জীবনীসহ বৃন্দাবনের গোস্বামীবর্গসৃষ্ট বৈষ্ণবশাস্ত্রের এবং সংস্কৃত সাহিত্যের বিশ্লেষণ আছে। পরিশেষে আছে একটি নঞর্থক মূল্যায়ন। তবে এই গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে কোন তথ্য উপস্থাপন করেন নি; যদিও তাঁর গ্রন্থের নাম Vaisnava Faith and Movement in Bengal ।

ইতিহাস সন্ধিৎসায় দেখা যায়, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও সাহিত্য, তার ইতিহাস ও ভূগোল, তার সন্ততত্ত্ব, তার সামগ্রিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে হরিদাস দাসের বিভিন্ন গ্রন্থের উৎকর্ষ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও, সম্ভবত জীবনব্যাপী এই সারস্বত সাধনাই তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। তাঁর সযত্নে সম্পাদিত বহু গ্রন্থে, বিশেষ করে তাঁর অতুলনীয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান-এর দুটি খণ্ডে, যে বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ-প্ৰয়োগ, যে অসামান্য গভীরতা, যে অবিশ্বাস্য রকমের নিরপেক্ষ বিচারপদ্ধতি দেখা যায়, যে বিপুল প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় তা অন্যত্র সুলভ নয়। আরও বড় কথা, হরিদাস দাসের ধর্মভাবনা তাঁর ঐতিহাসিক চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। প্রায় একই ধরনের গবেষণায় ব্রতী হয়েছিলেন সুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন বিখ্যাত। কিন্তু হরিদাস দাসের ঔদার্য তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সনাতন ধর্মানুসারিদের মধ্যে ধর্মচেতনায় সর্বাধিক আলোড়িত ঘটনা মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলন। সমাজ ও সাহিত্যে এর প্রভাবও অপরিসীম। এ সময় গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলাদেশে সহজিয়া সাধনার ধারণাটিও প্রবাহিত ছিল। মনীন্দ্রমোহন বসু, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, এড্‌ওয়ার্ড ডিমক, পরিতোষ দাস প্রমুখ এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) এবং নিশিকান্ত সান্যাল প্রণীত The Life of Srikrishna Chaitanya গ্রন্থদ্বয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিচারসিদ্ধ আলোচনা আছে। গিরিজাশংকর রায়চৌধুরী প্রণীত বাংলা চরিত গ্রন্থে শ্রীচৈতন্য গবেষণায় ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম চৈতন্যের জীবন ও তাঁর ধর্মান্দোলনের প্রকৃতি নির্ণয়ের অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। যদিও পেশাদার ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের গ্রন্থও এই স্মরণ তালিকায় অগ্রগণ্য তবুও এসময়ের আরেক পেশাদার ঐতিহাসিক অমূল্যচন্দ্র সেন প্রণীত ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য গ্রন্থটিও এই প্রেক্ষাপটে অগ্রগণ্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও ধর্মান্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত চৈতন্যের পরিকর, বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী, রূপ গোস্বামী সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ বিচারমুখী বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ মাইতী, নরেশ চন্দ্র জানা, শুকদেব সিংহ প্রমুখ স্মরণীয় হয়ে আছেন।

বৈষ্ণবধর্মের সামগ্রিক ইতিহাসের আরেক সন্ধিৎসু গবেষক রমাকান্ত চক্রবর্তীর Vaishanvism in Bengal গ্রন্থটি সংশ্লিষ্ট গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পেশাদার ঐতিহাসিকের বস্তুনিষ্ঠ বিচারবুদ্ধি ও বিপুল তথ্যপ্রমাণের যুক্তিনিষ্ঠ প্রয়োগে তাঁর গ্রন্থটি সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে মূল্যবান গবেষণা।

বাংলাদেশের চৈতন্যপ্রভাবিত বৈষ্ণবধর্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মধ্যযুগে সমকালীন অন্যান্য ধর্মান্দোলনের সঙ্গে চৈতন্যদেবের ধর্মান্দোলন নিজস্বতার স্বাতন্ত্র্যে ও গৌরবে সর্বাধিক সমুজ্জ্বল। এ সম্পর্কে বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, জয়ানন্দ, লোচন দাস, ঈশান নাগর, চূড়ামণিদাস, গোপীজনবল্লভ দাস, হরিচরণ দাস, নরহরি চক্রবর্তী, সারদাচরণ মিত্র প্রমুখ রচিত চৈতন্যজীবনী গ্রন্থসমূহ পাঠ করলেই বাংলাদেশে বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের পূর্বাপর ইতিহাস অনুধাবন সম্ভব। কেননা এগুলোই বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ইতিহাসের উপাদান। তবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই বহুল পঠিত ইতিহাসের উৎসমুখে স্থানীয় ইতিহাস প্রণেতা তথা আঞ্চলিকতাবাদী গবেষণার ধারার সূত্রপাত করেছিলেন শ্রীহট্টের অচ্যুতচরণ চৌধুরী ও পদ্মনাথ ভট্টাচার্য। বহু রচনায় তাঁরা এটাই প্ৰতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন যে, যেহেতু চৈতন্য এবং তাঁর প্রধান কয়েকজন পরিকরের আদি বাসস্থান ছিল শ্রীহট্টে, তাই শ্রীহট্টেই চৈতন্যের ভক্তি-আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। পরে এই ধারার বাহক হন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। এইসাথে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই আন্দোলনের আলোচনায় অনেক বিদেশীও যুক্ত হন। এঁদের মধ্যে হোরেস হেম্যান উইলসন, রেভা. জেমস্ লঙ্, উইলিয়াম হান্টার, জেমস ওয়াইজ, রেভা. রিজলি, ম্যাকস বেবর বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাঙালিদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্ত, যোগীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, যদুনাথ সরকার, রমাপ্রসাদ চন্দ, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিমানবিহারী মজুমদার, সুশীলকুমার দে, রমাকান্ত, চক্রবর্তী প্রমুখ বৈষ্ণব ধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের সামগ্রিক ইতিহাস উপস্থাপনে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ব্রাহ্ম আন্দোলন ও রামমোহনের ধর্মসংস্কারচিন্তা

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎ পাই তাঁদের প্রায় সকলেই কোন না কোন ধর্মের প্রতি অনুগত ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪- ১৮৭৩), কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫), কেশবচন্দ্র -সেন (১৮৩৮- ১৮৮৪), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৪) প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এঁদের অনেকেই ‘জন্মসূত্ৰে প্ৰাপ্ত ধর্ম’ পরিত্যাগ করলেও অন্য ধর্মের দিকে ঝুঁকেছেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। যিনি এদেশের বিধবাবিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধ, স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেসব ইতিহাস মোটামুটি সবার জানা। তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্য ও পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘দয়ার সাগর’, বিদ্যাসাগর’ উপাধিতেও ভূষিত।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও প্রসার তৎকালীন সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। আরেকজন ব্যক্তি সেই সময়ে ধর্মীয় জগতে এক নতুন ভাবোন্মাদনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন— তিনি হচ্ছেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (১৮৩৬-১৮৮৬)। যিনি বলেছিলেন— ‘যত মত তত পথ”, ‘ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু’। অর্থাৎ ধর্মীয় উদারতার পাশাপাশি তিনি যে ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন তা বেদান্ত দর্শনেরই আধুনিক সংস্করণ। স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) রামকৃষ্ণ সম্পর্কে বলেছেন— জ্ঞান, যোগ, ভক্তি ও কর্মের পরাকাষ্ঠা সমষ্টিস্বরূপ এরূপ অপূর্ব মহাপুরুষ আর মানবজাতির মধ্যে কখনই সমুদিত হন নাই।’ তাঁর ভক্তগণ রামকৃষ্ণকে ‘মনুষ্য শরীরধারী সাক্ষাৎ ভগবান’ হিসেবে স্বীকার করে থাকেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্যদেব বলেছিলেন— ‘শ্রীভগবান এখনও রামকৃষ্ণের শরীর ত্যাগ করেন নাই। কেহ কেহ এখনও তাঁহাকে সেই শরীরে দেখিয়া থাকেন।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘পুরাকালে সে-প্রকার একমাত্র গীতা-বক্তা ভগবানই… সকল আপাত বিবদমান উক্তি সকলের মধ্যে কিঞ্চিৎ সামঞ্জস্য বিধান করিয়াছিলেন, কালে অতীব বিশালতাপ্রাপ্ত সেই বিবাদ নিঃশেষে ভঞ্জন করিবার জন্যই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণরূপে আর্বিভূত হইয়াছেন।’ শুধু তাই নয়, রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্যগণ পরমহংসের ‘পটপূজা’ আরম্ভ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই পূজা সমর্থন করে লেখেন… ‘যদি খ্রীস্ট, কৃষ্ণ কিংবা বুদ্ধকে পূজা করিলে কোন ক্ষতি না হয়, তাহলে যে পুরুষপ্রবর জীবনে ও চিন্তায় বা কর্মে লেশমাত্র অপবিত্র কিছু করেন নাই, যাঁহার অন্তর্দৃষ্টিপ্রসূত তীক্ষ্ণবুদ্ধি অন্যসকল ধর্মগুরু অপেক্ষা ঊর্ধ্বতর স্তর বিদ্যমান— তাঁহাকে পূজা করিলে কী ক্ষতি হইতে পারে? দর্শন, বিজ্ঞান বা অপর কোনও বিদ্যার সহায়তা না লইয়া এই পুরুষই জগতের ইতিহাসের এই তত্ত্ব প্রচার করিলেন যে, সকল ধর্মেই সত্য নিহিত আছে— ইহা বলিলেই চলিবে না- প্ৰত্যুত সকল ধর্মই সত্য।’

সব ধর্মই সত্য? এ প্রশ্নের মীমাংসায় রামমোহন বলেছিলেন— বিভিন্ন ধর্মের ভিতরে পরস্পরবিরোধী অনেক নিত্যবিধি বর্তমান, তাই সব ধর্মই সত্য এ-কথা মানা যায় না, তবে সব ধর্মের ভিতরেই সত্য আছে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের এই মীমাংসা মেনে চলেছিলেন বলতে পারা যায় যদিও উপনিষদের দিকে তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের ভক্তি-প্রধান প্রকৃতির কাছে রাজার এ মীমাংসা ব্যর্থ হল। তিনি বললেন— Our position is not that there are truths in all religions, but that all established religions of the world are true। এই কথাই রামকৃষ্ণ আরো সোজা করে বললেন— যত মত তত পথ। –যত মত যত পথ তো নিশ্চয়ই; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— সে-সব পথ একই গন্তব্য স্থানে নিয়ে যায় কিনা। রামকৃষ্ণ বললেন- হাঁ তাই যায়, তিনি সাধনা করে দেখেছেন শাক্ত-বৈষ্ণব-বেদান্ত-সূফি-খ্রিষ্টান ইত্যাদি সব পথই এই অখণ্ড সচ্চিদানন্দের অনুভূতিতে নিয়ে যায়। এ-সব কথার সামনে তর্ক বৃথা। তবে এই একটি কথা বলা যেতে পারে যে মানুষ অনেক সময়ে বেশি করে যা ভাবে চোখেও সে তাই দেখে। যেমন সংগীতসাধক ও কালীভক্ত রামপ্রসাদ কাজে-কর্মে শয়নে স্বপনে সবসময়েই কালীর উপস্থিতি অনুভব করতেন।

বিদ্যাসাগর ও রামকৃষ্ণ : ধর্মসংস্কারচিন্তায় সাদৃশ্য ও স্বাতন্ত্র্য

হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করবার ‘অপরাধে’ শিবনাথ শাস্ত্রী পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজে ব্রাহ্মধর্ম, খ্রিষ্টীয়ধর্ম ও ইউরোপীয় আধুনিক দার্শনিকদের দর্শনচিন্তা এ দেশীয় শিক্ষিত ব্যক্তিদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। কাজেই ‘হিন্দুধর্ম’ রক্ষার্থে ‘ সমন্বয় ও শান্তি’ ব্যতীত রামকৃষ্ণ ও তাঁর অনুসারীদের কোন গত্যন্তর ছিল না। তাদের ভাবটা ছিল এরকম : তোমাদের ধর্ম, চিন্তা, দর্শনও ভালো, আমাদেরটাও ভালো। এসো, মিলে মিশে থাকি। আমাদের অনুসারীদের নিয়ে অযথা টানাটানি করো না। সাকারও ভালো, নিরাকারও ভালো। যিশুও ভালো, কৃষ্ণও ভালো। খারাপ শুধু নতুন চিন্তা নতুন দর্শন, ইহজাগতিকতা, আত্মজাগরণ আর সামনের পথে এগিয়ে চলা!

রামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগরের আলাপচারিতার ভিতর দিয়ে আমরা বিদ্যাসাগরের ধর্মভাবনার স্বরূপ অনেকটা উপলব্ধি করতে পারি। শ্রী মহেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত (ওরফে ‘শ্রীম’) বিদ্যাসাগরের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেজন্য তিনি বিদ্যাসাগরকে চিনতেন, জানতেন। শ্রীমকে রামকৃষ্ণ একদিন অনুরোধ করেন– ‘আমাকে বিদ্যাসাগরের কাছে নিয়ে যাবে? আমার দেখবার বড় সাধ।’ শ্রীম-র ভাষ্যানুযায়ী ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট বিদ্যাসাগরের বাড়িতে দুজনের সাক্ষাৎ হয়। তাঁদের মধ্যে যেসব কথোপকথন হয় তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি :

‘শ্রীরামকৃষ্ণ। আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হ্রদ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি।

বিদ্যাসাগর (সহাস্যে)।। তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান।

শ্রীরামকৃষ্ণ।। না গো! নোনাজল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! তুমি ক্ষীর সমুদ্র’।

রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরকে ‘সিদ্ধ পুরুষ’ বলেও অভিহিত করেছিলেন! বিদ্যাসাগরকে তিনি বলেছিলেন— ‘তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্যে যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে— কিন্তু এ রজোগুণ— সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নেই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন, ঈশ্বরবিষয় শিক্ষা দেবার জন্যে। তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্যে, কেউ পুণ্যের জন্যে, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই।’

এই উক্তির শেষাংশ (‘কেউ করে নামের জন্যে….’) বিদ্যাসাগরকেই লক্ষ্য করে বলা। কারণ শ্রীম-কে বিদ্যাসাগর একবার বলেছিলেন, ঈশ্বরকে ‘জানবার যেমন নেই।’ তেমনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পরমহংসও স্বীকার করেছিলেন- ‘ব্রহ্ম যে কী, মুখে বলা যায় না।’

‘শ্রীরামকৃষ্ণ। দেখ না, এই জগৎ কী চমৎকার। কত রকম জিনিস— চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র। কত রকম জীব। বড়, ছোট, ভাল মন্দ, কারও বেশি শক্তি, কারও কম শক্তি।

বিদ্যাসাগর।। “তিনি কি কাউকে বেশি শক্তি, কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন’? (রামকৃষ্ণ কথামৃত)।

এই প্রশ্নের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর ঈশ্বরের ‘অসাম্য নীতি’কেই যেন প্রকটিত করতে চেয়েছেন। রামকৃষ্ণ এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে পারেন নি। একটু এড়িয়ে গিয়ে বলছেন— ‘তিনি বিভূরূপে সর্বভূতে আছেন। পিঁপড়েতে পর্যন্ত। কিন্তু শক্তিবিশেষ। তা না হলে একজন লোক দশজনকে হারিয়ে দেয়, আবার কেউ একজনের কাছ থেকে পালায়। আর তা না হলে তোমাকেই বা সবাই মানে কেন? তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? তোমার দয়া আছে, বিদ্যা আছে, অন্যের চেয়ে তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে। তুমি একথা মানো কি না?’ পরমহংসের এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বিদ্যাসাগর শুধু মৃদু হেসেছিলেন। বোধহয় এই কারণে, যে দয়ার কথা, বিদ্যার কথা রামকৃষ্ণ বলেছেন সেগুলো ‘ঈশ্বর’ তাঁকে এমনি এমনি প্রদান করেন নি, তার জন্য তাঁকে কষ্টসাধ্য পরিশ্রম করতে হয়েছে, ‘সাধনা’ করতে হয়েছে। তিনি একদিনে বিদ্যাসাগর বা দয়ার সাগর হন নি।

বিপ্লববাদী আন্দোলনে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকা

‘সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ও মানব কল্যাণ কাজে নিবেদিত থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানটির সাথে রাজনীতির কোন সংস্রব থাকবে না’— এই অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়ে মিশনটি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তার কর্ম পরিচালনা শুরু করে। মিশনটি বিধিবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় এর উদ্দেশ্য এবং আদর্শ সম্পর্কে যে নির্দেশনামা রচনা করা হয়েছিল সেখানে কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতির কথা উল্লেখ করা হয় নি। উপরন্তু মিশনের সদস্যপদ লাভ করার জন্য যে-প্রবেশপত্র পূরণ করতে হত তার মধ্যে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে একটি নতুন শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়। এই শর্ত অনুযায়ী আবেদনকারী ব্যক্তিকে এই মর্মে ঘোষণা করতে হত যে, তাঁর সাথে কোন ধরনের রাজনীতি বা গোপন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিন্দুমাত্র কোন সংশ্রব নেই। কিন্তু মিশনের এই অঙ্গীকার ও তার বিধিবদ্ধ বিধান থেকে ক্রমশ সরে যেতে দেখা যায়। মিশনটি ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলন ও বিপ্লববাদী চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে রামকৃষ্ণের নামে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আশ্রমগুলির সাথে পরবর্তীকালে বিপ্লববাদী কর্মীদের গোপন যোগাযোগের কথা যখন জানাজানি হয়ে যায় সেই সময় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে মিশনের তদানীন্তন সেক্রেটারি স্বামী সারদানন্দ পুলিশ কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন যে ‘এই সব তথাকথিত আশ্রমগুলির সাথে মিশনের কোন সম্পর্ক নেই।’ পরবর্তীকালেও বিভিন্ন তরফ থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে প্রত্যক্ষ রাজনীতির যোগাযোগের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে বিবেকানন্দ স্বয়ং রাজনৈতিক ব্যাপারে কোন রকম মতামত দেওয়া সম্ভব পক্ষে এড়িয়ে যেতেন। ব্রিটিশশাসনের কুফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন অভিমত প্রকাশ করে তিনি নিজেকে ঝামেলায় জড়াতে চাননি, কেননা তার ফলে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যকর্মটিই ব্যাহত হতে পারে। (Biman Behari Majumdar, Militant Nationalism in India, 1966, p. 37)। ভগিনী নিবেদিতা সম্পর্কেও একই ধরনের মন্তব্য কখনো কখনো প্রকাশ করা হয়েছে। শ্রী অরবিন্দ নিবেদিতাকে নিঃসংশয়ে বাংলাদেশের বিপ্লববাদী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আরো অনেকে এদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে নিবেদিতার সম্পর্ক শুধু এক ধরনের বুদ্ধিজীবীর সহানুভূতি (Intellectual Sympathy ) হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন।

ভারতবর্ষের মুক্তির আন্দোলনের রাজনীতিতে এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রভাব সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নেতা উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি কোন এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, যেহেতু এদেশের বিরাট এক শ্রেণির মানুষকে কেবলমাত্র ধর্মের কারণেই কোন গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব সেই কারণে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনেও এদেশের সাধু সমাজের সাহায্য ভিক্ষা করেছিলেন। (Report of the Sedition Committee; 1918, p. 2০)। বিশিষ্ট বিপ্লববাদী কর্মী শ্রীনলিনী কিশোর গুহ তাঁর বাংলায় বিপ্লববাদ গ্রন্থে একাধিক বিপ্লবীর সন্ন্যাস গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরাও যে কোন-না কোনভাবে বিপ্লব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকবেন সে ব্যাপারে কিছু অস্বাভাবিকতা নেই। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে সিডিশন কমিটি ভারতবর্ষের সন্ত্রাস আন্দোলন সম্পর্কে যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করে, সেখানে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের কথা খুবই গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্তবাদ’ সমগ্র জাতির মনে সুরা পানের সমতুল্য এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল এবং তাঁর মৃত্যুর মাত্র তিন বছর পরেই বঙ্গ-ভঙ্গকে কেন্দ্র করে সমগ্র দেশে অভূতপূর্ণ জাতীয় জাগরণে পরিণত করে। (Romain Rolland, Prophets of the New India, 5০1 )।

ধর্মীয় সংগঠন আনন্দমার্গ-এর কর্মকাণ্ড নিয়েও উত্থাপিত হয়েছিল এরকম অনেক অভিযোগ। আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমূর্ত্তিজীর (প্রকৃত নাম : প্ৰভাত রঞ্জন সরকার) নেতৃত্বে পরিচালিত এই সংগঠনের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের অভিযোগে ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা CBI আনন্দমূর্ত্তিজীকে খুনের অভিযোগে জড়িয়ে জেলে পাঠায়। অবশ্য জেল জীবনেই তিনি এই সংগঠনের শাখা বিশ্বের ১৮০টি দেশে সম্প্রসারণে সক্ষম হন।

শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর-এর মতুয়া ধর্মান্দোলন

ইতিহাসের জটিল বিন্যাসে না ঢুকে সহজ কথায় বললে বলতে হয় গৌতমবুদ্ধ (৫৬৬-৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্ব) থেকে শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) দেবের ঐতিহ্য- ঋদ্ধ এক বিপ্লবী ধর্ম আন্দোলন তথা সমাজ আন্দোলনের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মেছিলেন পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার সাফলিডাঙা গ্রামে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ। বেঁচে ছিলেন ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ পর্যন্ত। তাঁর সুপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। তার প্রয়াণ তারিখ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ তাঁদের ধর্ম সাধনার গোটা সময়টাই (১৮১২ থেকে ১৯২৭) পরাধীন দেশে, অবিভক্ত বাংলায়। তাঁদের প্রবর্তিত ধর্মমতের নাম ‘মতুয়া ধর্ম’।[২৭ তাঁদের ধর্ম অবিভক্ত বাংলায়। তাঁদের ধর্ম আন্দোলন, সমাজ বিপ্লব, জীবনসাধনা বিষয়ে তাঁদের লেখা কোনও গ্ৰন্থ নেই। যেমন ছিল না চৈতন্যদেবের। হরিচাঁদ সামান্য শিক্ষিত ছিলেন, দলিল ইত্যাদি পাঠ করতে পারতেন। তাঁর পুত্রকে বর্ণ হিন্দুদের স্কুলে পড়ার সুযোগ ছিল না বলে মক্তবে ভর্তি করেন। এখানে পড়াশুনা করার পরে অন্যত্রও পড়াশুনা করেন। তবে তাঁদের জীবনলীলা বা কর্মসাধনা দর্শন মনন ও নির্দেশ বিধৃত আছে দুটি মহাগ্রন্থে। মতুয়া ধর্মের মানুষের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র সে দুটি। হরিচাঁদের জীবন কেন্দ্রে রচিত মহাকবি তারক সরকারের শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত এবং গুরুচাঁদের জীবন ও সংগ্রামের কথা লেখা আছে আচার্য মহানন্দ হালদারের শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত্র গ্রন্থে। দুটি গ্রন্থই ছন্দে বিধৃত। ভক্তদের অভিমতে যেন এ যুগের চৈতন্য চরিতামৃত।

[২৭. মতুয়া ধর্ম নাম কেন?— কেউ বলেন হরি নামে মাতোয়ারা। কেউ বলেন ওদের তন্ত্র- মন্ত্র বাছ-বিচার নেই, হিন্দুরীতি মানে না। জাত-পাতহীন এ ধর্মমত; যেমন বিধর্মীর মতো। তাই মতুয়া ধর্ম। কুসংস্কার মুক্ত এক সূক্ষ্ম-সনাতন ধর্ম। যাদের মূল আশ্রয় এ জীবন, পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা-স্ত্রী-আত্মীয়সহ এ গৃহ, গার্হস্থ্য-ধর্ম তাদের।]

আরমা জানি পৃথিবীর ইতিহাসে বহু যুগে বহু দেশে ধর্ম আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক মহামনীষী করেছেন সমাজ সংস্কার এমনি সমাজ বিপ্লব। হরিচাঁদ তাঁর মতুয়া ধর্মকে বলেছিলেন, ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’। যেন সেই আদিম সাম্যবাদী যুগের মত কথা। মনু-পূর্ব ভারতে বর্ণবিভাজন ছিল কর্মভিত্তিক। জন্মভিত্তিক-গোষ্ঠীতন্ত্রবাদী ব্রাহ্মণ্য শোষণের বর্ণাশ্রম নয়। জানি না হরিচাঁদ তেমনি কোনও বিভেদ মুক্ত সনাতন ধর্মের কথা বলেছিলেন কিনা। সে যাইহোক পূর্ব বাংলার গ্রামে বসে শহরের সংযোগহীন একজন মানুষ বর্ণবাদকে অস্বীকার করলেন। তাঁর ধর্ম আন্দোলনে এল চার্বাক-বৃহস্পতি-বুদুর-উত্তরাধিকার, বস্তুবাদী চিন্তার আলোকে।

তার আগের মহাপুরুষেরা বলেছেন স্বর্গলাভ, পরকাল, পরজন্ম, মোক্ষ নির্বাণের কথা। তিনি বললেন, ‘এসব স্বর্গলোভ, পাপভয় দেখিয়ে মানুষের মানসিক শক্তিকে আচ্ছাদন করা হয়’। এ প্রসঙ্গে গুরুচাঁদ বলেন, ‘অনন্ত শক্তির কেন্দ্র মানবের মন। পাপভয়ে স্বৰ্গলোভে করে আচ্ছাদন।’ ভারতের অন্য কোনও সাধু সন্তরা স্বর্গকে লোভের বস্তু হিসেবে ঘোষণা করেছেন কিনা—আমরা জানিনা। এই ধর্মমত তাই আমাদের ভাষায় একটি বস্তুবাদী বিপ্লবী ধর্মমত। যা অনেক ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’ বলতে আমাদের যেসব পুরনো ধর্মীয় ধারণা আছে তাকে অতিক্রম করে যায়।

হরিচাঁদ-এর সমাজ সংস্কার

চৈতন্যদেব এই বাংলায় ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মানুষের মধ্যে সকল প্রকার ভেদাভেদ দূর করে সকলকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য তিনি প্রবর্তন করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্ম। রাজা রামমোহন রায় (জন্ম ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ, প্রয়াণ ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) মানবের কল্যাণ সাধনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল হিন্দু সমাজের লজ্জা, চরম মানবতাবিরোধী প্রথা সতীদাহ প্রথা বিলোপ সাধন। তাঁরই অদম্য প্রচেষ্টায় এই কু-প্রথা বন্ধ করে আইন বিধিবদ্ধ হয় ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (জন্ম ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ এবং প্রয়াণ ২৯শে জুলাই ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে) হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। গোড়া হিন্দুরা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাঁর এই মহতী প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে উদ্ধার করেছিলেন পরাশর সংহিতার শ্লোক-

‘নষ্টে-মৃতে-প্রবর্জিতে-ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চ শাপং সু নারী নাং পতিরান্য বিধিয়তে।’

(অর্থাৎ স্বামী যদি নষ্ট হয়ে যায়, মৃত হয়, বিদেশে চলে যায়, ক্লীব হয় অথবা পতিতে পতন হয়, তা হলে নারী অন্য পতি গ্রহণ করতে পারে)। অবশেষে বিধবা বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয় ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের ঐ ভূমিকার পক্ষে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজের সার্বিক কল্যাণে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য প্রবর্তন করেছিলেন ‘মতুয়া ধর্ম’। হিন্দু ধর্মের মধ্যে নিচু জাতি বলে চিহ্নিত যারা, তাদের মধ্যে নমশূদ্র সম্প্রদায়কে চণ্ডাল বলে অভিহিত করা হত। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে বাংলায় কয়েকটি এলাকায় চণ্ডাল রাজত্ব ছিল। বল্লাল সেন তা দখল করার পর হিন্দু সমাজের মধ্যে বৰ্ণ- বৈষম্যকে তীব্র করা— বিশেষ করে চণ্ডালদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য যা করার তার সব কিছু তিনি করেছিলেন।

ভারতে প্রথম জনগণনা হয় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে। সেখানে নমশূদ্রের কোন উল্লেখ ছিল না, ছিল চণ্ডাল। ১৮৯১-এর জনগণনায় বলা হয় ‘নমশূদ্র অথবা চণ্ডাল’। ১৯০১-এর জনগণনায় ‘নমশূদ্র (চণ্ডাল)’ বলে উল্লেখ থাকে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের দৃঢ় ভূমিকায় এবং অস্ট্রেলিয়া নিবাসী খ্রিষ্টধর্মীয় যাজক মিড সাহেবের সহায়তায় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনায় ‘নমশূদ্র’ উল্লেখ করা হয়। জনগণনার তথ্যে ‘চণ্ডাল’ শব্দের অপসারণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের অস্পৃশ্যতা ঘোচেনি, সেজন্য রবীন্দ্রনাথকে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চণ্ডালিকা নৃত্য নাটক রচনা করে সমাজকে সচেতন করতে হয়েছে। ভারতের অনেক মানবতাবাদী মনীষী, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা হিন্দু ধর্মের দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত বর্ণ-বৈষম্যবাদ, অস্পৃশ্যতা দূর করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর ঐ একই ব্রতে ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁরা সারা জীবন ধরে চেষ্টা করে গেছেন হিন্দু ধর্ম থেকে ঐ মানবতাবিরোধী মানসিকতা বিদূরিত করতে।

ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদসহ দেশের বহু মনীষীকে দেশের এই ধর্মীয় কুসংস্কারে অবিভক্ত ভারতের এক-তৃতীয়াংশ জনতার মর্যাদা ও অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছিল— সেই সংগ্রাম এখনও চলছে।

বৌদ্ধধর্ম সংস্কারে সম্রাট অশোকের ভূমিকা

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৭ গৌতম বুদ্ধের[২৮] উপদেশ সম্বন্ধে মতভেদের মীমাংসার জন্য বৈশালী নগরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বিতীয় সঙ্গীতি বা মহাধর্মসভার অধিবেশন হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৪২ অব্দে সম্রাট অশোকের আহ্বান পাটলিপুত্র (পাটনা) নগরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তৃতীয় মহাধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সংগৃহীত হয়ে পালি ভাষা লিপিবদ্ধ হয়। অশোক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য স্বরাজ্যে এবং বিভিন্ন দেশে বহু প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। নিজ পুত্র মহেন্দ্ৰ ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রাকে পাঠান সিংহলে (খ্রি. পূ. ২৪৪)। বর্তমান শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্মের এদের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও কীর্তিত হচ্ছে। অশোক প্রজাদের মনে ধর্মভাব জাগরুক রাখার জন্য রাজ্যের স্থানে স্থানে পর্বত গাত্রে স্তম্ভ নির্মাণ করে সেই স্তম্ভে বহু ধর্ম উপদেশ সহজ ভাষায় উৎকীর্ণ করে রেখেছিলেন। এসব উপদেশ মালার সারমর্ম এরকম : ‘পিতা মাতা ও অন্যান্য গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে; ব্রাহ্মণ ও শ্রমণের প্রতি ভক্তিমান হইবে; সত্যবাদী হইবে; সকল মানুষ ও জীবজন্তুর প্রতি সদয় ব্যবহার করিবে; পর ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন করিবে না; দয়া, পবিত্রতা, কৃতজ্ঞতা প্রভৃতি গুণের অনুশীলন করিবে।’

[২৮. বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ আশি বৎসর বয়সে খ্রি. পৃ. ৪৮০ (মতান্তরে ৪৭৭) বর্তমান গোরক্ষপুর জেলার অন্তর্গত কুশী নগরের (আধুনিক কসিয় নামক স্থান) এক বটবৃক্ষ তলে দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই (বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শিষ্যবৃন্দ) পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা) শহরে সমবেত হয়ে বুদ্ধের উপদেশসমূহ সংগৃহীত ও সেকালে প্রচলিত পালি ভাষায় তা লিবিপদ্ধ করেন। এটাই বৌদ্ধদের প্রথম সঙ্গীতি বা মহাধর্মসভা। তবে বুদ্ধের মৃত্যু সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবেদ আছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। (Historian’s History of the World; vol-11, p. 479)। উল্লেখ্য যে, গৌতমবুদ্ধের কোন সমাধি চিহ্ন কুশীনগরে বিদ্যমান নাই। কারণ, তাঁর শবদেহ অতি পবিত্র বিবেচনায় তাঁর দেহের অস্থি, দন্ত, নখ, চুল ইত্যাদি শিষ্যরা ভাগ করে নিয়ে যায়। কালক্রমে বুদ্ধের ওই দেহাবশেষের উপর ভারত, ব্রহ্ম, সিংহল, চীন, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বহু স্তূপ, পেগোডা, মন্দির ইত্যাদি নির্মিত হয়। ওইসব স্থাপন আজও বুদ্ধের স্মৃতি জাগরণে বৌদ্ধ ধর্মানুসারিসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আকৃষ্ট করে রেখেছে।]

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে কুশান সম্রাট কনিষ্কের আহ্বানে কাশ্মীরে (মতান্তরে পাঞ্জাবে জলান্ধর নামক স্থানে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের চতুর্থ ও শেষ বৌদ্ধ-সঙ্গীতি বা ধর্ম-মহাসভার অধিবেশন হয়। এর ফলে বৌদ্ধরা হীনযান (আদি বৌদ্ধ ধর্ম) ও মহাযান (সংস্কৃত বৌদ্ধ ধর্ম) এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়। হীনযান সম্প্রদায় ব্যক্তিগণ জীবনে নির্বাণ লাভই বৌদ্ধ ধর্মের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। মহাযান সম্প্রদায় সমগ্র জীব জগতের কল্যাণ সাধনাই ধর্মের মূলনীতি বলে মনে করে, এবং তাঁরা গৌতম বুদ্ধের মূর্তিপূজা সমর্থন করে। (মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমি ঐতিহাসিক অভিধান, প্র. প্র. ১৯৬৭। Vide – Imperial Gagetteer of India, vol. 1. p. 411 )।

আম্বেদকরের হরিজন আন্দোলন

এই প্রসঙ্গে গান্ধীজীর ‘হরিজন আন্দোলন’ এবং ডক্টর আম্বেদকরের আন্দোলন স্মরণ করতে হয়। ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী গান্ধীজী বুঝেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুই নয়, দলিত, নিপীড়িত তথাকথিত ‘অন্ত্যজ’ জনসমাজকেও যুক্ত করা দরকার। কিন্তু এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, যা মূলত সামাজিক আন্দালনের বিষয়বস্তু তাকে রাজনৈতিক দৃষ্টি নিরিখে বিচার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করতে গেলে তার ব্যর্থতা অনিবার্য। অপরপক্ষে ড. বি, আর, আম্বেদকর (ভীমরাও রামজী আম্বেদকর) ছিলেন মহারাষ্ট্রের ‘মাহার’ নামে এক ‘অস্পৃশ্য’ সম্প্রদায়ের ঘরের সন্তান। হিন্দু হয়েও জন্মসূত্রে যারা অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ছাপ নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে উচ্চবর্ণের, বিশেষত ব্রাহ্মণবর্ণের নিকট থেকে যে অপমান, লাঞ্ছনা আর ঘৃণা পেয়ে এসেছে তাদের মর্মবেদনার গভীরতা একজন অস্পৃশ্য পিতামাতার সন্তানের পক্ষে উপলব্ধি করা যতখানি সহজ এবং স্বাভাবিক, সেই উপলব্ধির গভীরতা কি গুজরাতের এক সচ্ছল বেনিয়া পরিবারের সন্তানের পক্ষে কোনদিনই সম্ভব? সম্ভব হয়নি।

স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু আইন এবং সংবিধান সম্বন্ধে অসাধারণ বিশেষজ্ঞ ড. আম্বেদকরকে আইনমন্ত্রী রূপে মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছিলেন এবং ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার মুখ্য দায়িত্ব তাঁরই ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে নিজের পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি পেলেও কংগ্রেস দল এবং গান্ধীজীর নেতৃত্বে আম্বেদকরের অস্পৃশ্যতা-বিরোধী আন্দোলন সামান্যমাত্র সাফল্যও লাভ করতে পারেনি।

অবশেষে পথ নির্ধারণ করে নিলেন ড. আম্বেদকর। তিনি বিশ্বাস করতেন- যে ধর্মই নীতিবোধক যথার্থভাবে গঠন করতে পারে এবং সেই নীতিবোধভিত্তিক ধর্মই শক্তিশালী জাতি গঠনে সমর্থ। তিনি স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করলেন যে হিন্দুধর্মের এই উচ্চ-নীচ বিভেদভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সেই শক্তিশালী জাতিগঠনের পক্ষে সহায়ক নয়। তারপরই তিনি দৃপ্ত প্রত্যয়ে ঘোষণা করলেন যে, জাতিবর্ণ বিচারবিহনী বৌদ্ধধর্মই এ বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। এই বিশ্বাসই ড. আম্বেদকরের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের কারণ। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাঁর নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে কুড়ি লক্ষেরও বেশি ‘অস্পৃশ্য’ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করে মানুষের মর্যাদা লাভ করেন।

খ্রিষ্টধর্ম সংস্কারে সম্রাট কন্সটান্টাইনের ভূমিকা

৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে রোম সম্রাট কন্সটান্টাইনের আহ্বানে ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের নিসিয়া (Nicea বা Nice) নগরে খ্রিষ্টধর্মযাজকদের এক মহাসভার অধিবেশন হয়।

এই সভায় আঠার জন্য বিশপ ও দুই হাজার পাদরী (Clergy) বহু বাদানুবাদ ও তর্কবিতর্কের পর যিশু খ্রিষ্টকে ঈশ্বরের একমাত্র জাত পুত্র বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় রোমের সেন্ট পিটার গির্জা থেকে আনীত বেদীর উপর বহু উঁচু থেকে খ্রিষ্টান সমাজে প্রচলিত প্রায় তিন হাজার বাইবেল (Gospel ) নিক্ষেপ করা হয়। যে বাইবেলগুলি বেদীর উপর স্থির থাকল, সেগুলিই অভ্রান্ত বলে ঘোষিত হয়। উল্লেখ্য এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে এই খ্রিষ্টসমাজ স্রষ্টার/আল্লাহ একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এই সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ এথানাসিয়ান (Athanasian) ত্রিত্ববাদ অর্থাৎ ‘God the Father, God the Son and God the holy Ghost ie. three in one in three’ মতবাদ প্রচার করেন। কথিত আছে, রোম সম্রাট কন্সটাইন্টাইন (Constantine the Great, মু. ৩৩৭ খ্রি.) ছিলেন অত্যাচারী শাসক। যিশু তার জীবনের অর্জিত পাপের বোঝা বহন করবেন এই বিশ্বাস থেকে তিনি শেষ জীবনে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁরই চেষ্টায় ইউরোপে খ্রিষ্টধর্মের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে।

ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবাড়িতে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত অপর এক ধর্মসভায় নির্ধারিত বিশেষজ্ঞ কমিটি ১২ বৎসরকাল পরিশ্রমের পর বাইবেলের নতুন সংস্করণ (Revised Verson) প্রকাশ করেন। ইতঃপূর্বে খ্রিষ্টধর্মানুসারিদের বাইবেলে বহু সংখ্যক কৃত্রিম ‘সুসমাচার’ পুস্তক সন্নিবেশিত ও প্রচলিত ছিল। অতঃপর উক্তধর্মসভার গৃহীত সিদ্ধান্তের পর পূর্ব প্রচলিত বাইবেল পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

তৌরাত-এ উল্লেখিত খতনার নির্দেশনা

‘খতনাহ্’ একটি আরবি শব্দ। ‘খতনাহ্’র (Circumcision) শাব্দিক অর্থ— লিঙ্গমুখের ত্বকছেদ; সুন্নত; মুসলমানি। হজরত মূসা (আ.)[২৯] এর উপর নাজিলকৃত আসমানি কিতাব তৌরাত শরীফ-এর প্রথম খণ্ড ‘পয়দায়েশ’ এ খতনা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহ কেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে এবং তাঁর পরিবারে অন্তর্ভুক্ত সকলকে খতনা করার নির্দেশ দান করেছিলেন তাঁর একটি ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান। তৌরাতে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ.) কে বলেছেন— ‘আমি (আল্লাহ) তোমার (ইব্রাহিম) বংশ অনেক বাড়াইয়া দিব। তোমার মধ্য হইতে অনেক বাদশাহর জন্ম হইবে। এই ব্যবস্থার সম্বন্ধ যে কেবল তোমার আর আমার মধ্যে চলিবে তাহা নয়, তাহা চলিবে তোমার সন্তানদের ও আমার মধ্যে বংশের পর বংশ ধরিয়া। ইহা হইবে একটি চিরকালের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় আমি তোমার এবং তোমার পরে তোমার বংশের লোকদেরও আল্লাহ হইলাম। যে কেনান দেশে [মহাবন্যার পরে হজরত নূহ (আ.) এর নাতি কেনানের বংশধরেরা যে প্রদেশে বসবাস করিয়া ছিল উহাই ছিল কেনান দেশ (পয়দায়েশ ১০:১৫- ১৯)। ইহাই ছিল হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর নিকটে আল্লাহর ওয়াদা করা দেশ (পয়দায়েশ ১৭:৮)। [হজরত ঈসা মসীহের সময়ে সেই দেশটির নাম ছিল প্যালেন্টাইন। বর্তমানে দেশটির নাম ইসরাইল।] তুমি এখন বিদেশি হইয়া বাস করিতেছ তাহার সম্পূর্ণটাই চিরকালের সম্পত্তি হিসেবে আমি তোমাকে ও তোমার বংশকে দিলাম। আমি তাদের সকলেরই আল্লাহ হইলাম।’

[২৯. হজরত মূসা (আ.) ইসরাইল জাতির নেতা এবং নবী ছিলেন। মূসা (আ.) এর পিতার নাম ছিল ইমরান। ইমরান ১৩৭ বছর জীবিত ছিলেন। ইমরানের পিতার নাম ছিল কহাৎ। কহাৎ অর্থাৎ মূসা (আ.) এর দাদা (পিতামহ) ১৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। ইমরান তাঁর ফুফু ইউখাবেজকে বিবাহ করেছিলেন এবং ইউখাবেজের গর্ভেই হজরত হারুন (আ.) ও মূসা (আ.) এর জন্ম হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আ.) ফেরাউনের হাত থেকে বনি-ইসরাইলদের রক্ষা করে মিশর দেশ হতে বের করে এনেছিলেন এবং আল্লাহর দেওয়া শরিয়ত ও তৌরাত কিতাব তাদের দিয়েছিলেন। ফেরাউনের সঙ্গে কথা বলার সময় মূসার বয়স ছিল ৮০ আর হারুনের বয়স ৮৩ বছর। ঐতিহাসিকদের মতে, মূসা (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব ১৫২০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন।]

আল্লাহ ইব্রাহিমকে আরও বললেন— ‘এই ব্যবস্থায় তোমার যাহা করিবার রহিয়াছে তাহা এই— তুমি ও তোমার সমস্ত সন্তান বংশের পর বংশ ধরিয়া এই ব্যবস্থা মানিয়া চলিবে। আমার এই যে ব্যবস্থা, যাহার নিশানা হিসাবে তোমাদের প্রত্যেকটি পুরুষের খতনা করাইতে হইবে, তাহা তোমার ও তোমার বংশের লোকদের মানিয়া চলিতে হইবে। তোমাদের প্রত্যেকের পুরুষাঙ্গের সামনের চামড়া কাটিয়া ফেলিতে হইবে। তোমার ও আমার মধ্যে এই যে, ব্যবস্থা স্থির হইল, ইহাই হইবে তাহার নিশানা। বংশের পর বংশ ধরিয়া তোমাদের প্রত্যেকটি পুরুষ সন্তানের জন্মের আট দিনের দিন এই খতনা করাইতে হইবে।’

তৌরাত-এ আরও বলা হয়েছে— ‘ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলা শেষ করিয়া আল্লাহ তাঁহার নিকট হইতে উপরের দিকে উঠিয়া গেলেন। আল্লাহর কথা মত ইব্রাহিম সেই দিনই ইসমাইলের খতনা করাইলেন। সেই সঙ্গে তিনি তাঁহার কেনা কিংবা ঘরে জন্মিয়াছে এমন সমস্ত গোলামের অর্থাৎ তাঁহার বাড়ির প্রত্যেকটি পুরুষের খতনা করাইলেন। ইব্রাহিমের নিজের যখন খতনা করানো হইল তখন তাঁহার বয়স ছিল ৯৯ বৎসর, আর তাঁহার ছেলে ইসমাইলের বয়স ছিল ১৩ বৎসর। একই দিনে ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁহার ছেলে ইসমাইলের খতনা করানো হইয়াছিল।’

ইসলামে ফরায়েজী আন্দোলন ও তার প্রভাব

ফরায়েজী আন্দোলনের রূপকার হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০খ্রি.)। হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে প্রকৃত ইসলামে ফিরে যাওয়া এবং অন্যদিকে মুসলিম সমাজকে পরিশুদ্ধ করা। ৩৮ বছর বয়সে তিনি এই ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করেন। এরপর থেকেই তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করেন। ফরায়েজী আন্দোলন সম্পর্কিত উপাদান থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি যে, তাহির সোম্বল মক্কায় একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ শিক্ষাগুরু তাহির সোম্বলের কাছে ১৪ বছর সময় ধরে ধর্মীয় বিজ্ঞান শিক্ষা করেন। পরবর্তীকালে হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন দ্বিতীয়বার মক্কা ভ্রমণ করেন তখন তাহির সোম্বলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং বাংলায় বিশুদ্ধ ইসলাম প্রচারের অনুমতি গ্রহণ করেন। সুতরাং ১৮০১ থেকে কমপক্ষে ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে তাহির সোম্বল তাঁর খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেছিলেন। তাহির সোম্বল সম্পর্কে ফরায়েজী পুঁথিসমূহে সর্বপ্রথম উল্লেখিত হয়েছে। পুঁথিতে তাঁকে সাধারণভাবে ‘তাহির সোম্বল বা মোহাম্মদ তাহির সোম্বল’ বলা হয়েছে। এই বিষয়টি ফরায়েজীদের মধ্যে প্রচলিত ঐতিহ্যগত বিবরণ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। উপরন্তু পুঁথিতে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘সোম্বল’ হল পদবী যা ফরায়েজীগণ তাকে রোহিলাখণ্ডের গঙ্গাতীরে অবস্থিত।

মক্কায় ধর্মীয় বিজ্ঞানে শিক্ষা শেষ করার পর শরীয়তুল্লাহ ইসলামী আদর্শের সংশ্লিষ্ট বিষয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য আল আজহারে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কায়রো গমন করেন এবং বছর এই স্থানে অবস্থান করেন। প্রচলিত বিবরণে দেখা যায় যে, হাজী শরীয়তুল্লাহ যখন ‘দর্শন শাস্ত্র’ শিক্ষা করার জন্য কায়রো যাওয়ার অনুমতি চান তখন তাহির সোম্বল নিবিঘ্নে অনুমতি দেন। শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী আন্দোলনের ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের মুসলিম জনসংখ্যা এক ষষ্ঠাংশ ফরায়েজী মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়। ১৮৫৬-৬২ খ্রিষ্টাব্দে জে,ই, গ্যাসট্রেল ফরিদপুর, যশোর এবং বাকেরগঞ্জ জেলার জরীপ কার্যপরিচালনা করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, ফরিদপুর ও নিকটস্থ জেলাসমূহের মুসলিম সমাজে ফরায়েজীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। একইভাবে হাজীর জীবদ্দশায়ই ত্রিপুরা জেলায় (বৃহত্তর কুমিল্লা) ফরায়েজী আন্দোলন প্রসার লাভ করে। উল্লেখ্য যে, শরীয়তুল্লাহর মত অন্য কেউই কৃষকদের নিকট দৃঢ়ভাবে আবেদন করতে পারেনি। তার ছিল নির্দোষ এবং অনুকরণীয় জীবন। হাজী শরীয়তুল্লাহর নিজের উত্থানের চেয়ে বাংলার মুসলমানদেরই জাগিয়ে তোলা ছিল ‘অধিক আশ্চর্যজনক’। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের নিচু এলাকায় প্রথম প্রচারক যিনি ইসলামের শুদ্ধবাদী মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন।

ফরায়েজী সম্প্রদায়ের নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত একজন ব্যক্তিকে ‘তওবার মুসলিম’ বা মুমিন বলা হয়। সে অন্যান্য ফরায়েজীদের মতই সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ‘তওবা মতবাদটি ফরায়েজী সংস্কারের প্রধান ফটক বলা যায় যা উদ্ধৃত শপথে প্রতিফলিত হয়েছে। তওবা করার পদ্ধতিকে ফরায়েজীগণ ‘ইস্তিগফার’ বা সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা বলে। এটাকে ‘ইকরারী বাইয়াতও’ বলা হয়। যাঁর অর্থ উস্তাদ এবং শাগরেদ পরস্পরকে স্পর্শ না করে শপথ নেয়া। ঐতিহ্য অনুযায়ী পীরদের শপথের চেয়ে ফরায়েজীদের শপথ এই ক্ষেত্রে পৃথক। পীরগণ সাধারণত শাগরেদের হাতে নিজের হাত রেখে ‘বাইয়াত’ পরিচালনা করে থাকেন। এই ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে পীরের আশীর্বাদ মুরিদের কাছে পৌঁছানো হয় বলে বিশ্বাস প্রচলিত। ফরায়েজীগণ এই ধরনের ‘বাইয়াত’কে বেদাত হিসেবে পরিত্যাগ করে এবং এই প্রক্রিয়াকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। এটাকে ‘দাস্তি বাইয়া’ বলে আখ্যায়িত করে। কোরআন অথবা সুন্নাহতে নেই বলে ফরায়েজীগণ তা মনে করে। অন্যদিকে ফরায়েজীগণ ‘ইকরারি বাইয়াত’ নবীজীর কার্যপদ্ধতি অনুযায়ী পরিচালিত হয় বলে দাবি করেন।

ফরায়েজীগণ নিজেদেকে ‘হানাফী’ হিসাবে দাবি করে থাকে। মতাদর্শিক এবং আইনী উভয় ক্ষেত্রেই ফরায়েজীগণ ‘হানাফী’ মযহাবের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। তওহীদ বা আল্লাহর একত্ব ইসলামী পুনরুজ্জীবনের প্রবক্তা হিসাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ কোরআন ভিত্তিক তওহীদ বা আল্লাহর একত্বের ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন। এই ধারণাটি তওবার পদ্ধতির মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ’র একত্ব বিষয়ক মতবাদটি ফরায়েজী সমাজে কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং তওহীদ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন সব বিষয়কে বিলোপ করা হয়। আল্লাহ’র একত্ব সম্পর্কে ফরায়েজী মতবাদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এই মতবাদ শুধু ‘ফরায়েজী’দেরকে আলাদা সম্প্রদায় হিসেবেই চিহ্নিত করেনি এবং সনাতন সমাজের সঙ্গে এর সরাসরি সংঘাত সৃষ্টি করে, যা মতবাদের ব্যাখ্যা এবং অনুসরণের মধ্যে প্রতিভাত হয়। হাজী শরীয়তুল্লাহ্ তাঁর স্ব-ধর্মের লোকদের মধ্যে তওহীদের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করানোর জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তওবার বিভিন্ন ফর্মুলার মধ্যে তা স্পষ্ট হয়। তওহীদ সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যায় তিনি সসন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ এই ব্যাখ্যায় শুধু আল্লাহ’র একত্ব সম্পর্কে ধারণা ছিল। তিনি ‘ঈমান’ অথবা ধর্ম বিশ্বাসকে দুটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করেন যথা ক. আল্লাহর’ একত্বে বিশ্বাস করা এবং তার উপর দৃঢ়ভাবে আমল করা খ. অন্য কিছুর সঙ্গে আল্লাহর অংশীদারিত্ব সংযোগে বিরত থাকা। সুতরাং তাঁর মতে তওহীদ শুধু একটি মতবাদ নয় বরং তার উপর বাস্তবে আমল করতে হবে। যে কোন বিশ্বাস এবং কাজের সঙ্গে যদি নাস্তিকতা, শিরক অথবা বেদাতের সামান্যতমও সংশ্রব থাকে তাহলে তা হবে তওহীদ বিরোধী। এছাড়া হিন্দুদের আচার উৎসবে চাঁদা দেয়া, পীরদের প্রতি অস্বাভাবিক ভক্তি, ফাতিহা অনুষ্ঠান এবং এমন ধরনের অন্যান্য কর্মকাণ্ডকেও তিনি তওহীদ বিরোধী মনে করেন। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কেরামত আলী বলেন যে, ‘খারিজী’ এবং ‘ফরায়েজীগণ’ ‘আমল’কে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করে থাকে।

ফরায়েজী আন্দোলনকে শুদ্ধিবাদী পুনর্জাগরণ আন্দোলন হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এই আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত মুসলিম কৃষক শ্রেণির মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসা অনৈসলামিক আচার ও বিশ্বাসকে শুদ্ধ করা এবং দ্বিতীয়ত তাদের সংস্কার করা ধর্মমতকে কায়েমি স্বার্থান্বেষী জমিদার ও নীলকরদের থেকে সুরক্ষা। ফরায়েজীগণ নিজেদেরকে ‘হানাফী’ হিসেবে দাবি করে থাকে। মতাদর্শিক এবং আইনী উভয় ক্ষেত্রেই ফরায়েজীগণ ‘হানাফী’ মাজহাবের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। ফরায়েজী আন্দোলন ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম সংগঠিত ইসলামি আন্দোলন। ব্রিটিশরা ভারতে আসার ফলে মুসলিম শাসন অবসান ঘটলে দিল্লির প্রখ্যাত আলেম শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রা.) এর পুত্র শাহ্ আবদুল আজিজ ঘোষণা করেন যে ভারত একটি ‘দারুল হরব’ (বা শত্রু রাষ্ট্র)। হাজী শরীয়তুল্লাহ এ ঘোষণার শুধু পুনরাবৃত্তি করে ক্ষান্ত হননি। বরং অগ্রসর হয়ে বললেন : ‘ইন্ডিয়া একটি শত্রু কবলিত দেশ এখানে মুসলিম শাসক না থাকার কারণে জুমআ ও ঈদের নামাজ— যা মুসলিম শাসনের অধীন খলিফা কিংবা তাঁর প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে জায়েজ নয়।’ হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য শিষ্য পীর মুহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলনকে আরো সম্প্রসারিত ও বেগবান করেন।

ইসলামে ‘ওহ্‌হাবী আন্দোলন ও তার প্রভাব

ইসলামে ‘ওহ্‌হাবী’ মতবাদের সূত্রপাত ঘটে হজরত মুহম্মদ (স.) এর মৃত্যুর পর মাত্র আশি (৬৩২-৭১২খ্রি.) বছরের মধ্যে। তবে ইসলামে শরীয়ত বিরুদ্ধ অনাচার অনুপ্রবেশ বিদূরিত করার প্রথম আন্দোলনের উৎস ও সাবধান বাণী ঝংকৃত হয়েছিল তের-চৌদ্দ শতকে সিরিয়ার আইন বিজ্ঞানী ও সংস্কারক ইবনে তাইমিয়ার (১২৬৩-১৩২৮খ্রি.) কণ্ঠে। ইসলামি অনুশাসনে ইজমার প্রয়োগ নিষেধ করে তিনি প্রচার করেন যে, কুরআনের বিধি-ব্যবস্থা আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং তার বাধ্য করতে হলে কুরআনেরই আশ্রয় নিতে হবে। হাম্বলী মাজহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী ইবনে তাইমিয়া যাবতীয় বেদাতের বিরুদ্ধে ফতোয়া দান করেন এবং পীরবাদ ও তার আনুষঙ্গিক সব অনুষ্ঠানকে নিছক পৌত্তলিকতা বলে ঘোষণা করেন। ইসলামে ‘পিউরিটানিক’ বা অতিনৈতিক মতবাদের গোড়াপত্তন হয় আহমদ বিন তাইমিয়া ওরফে ইবনে তাইমিয়ার শিক্ষা থেকেই। আর এর উৎসস্থল আরবের মক্কার অধিবাসী মহম্মদ ইবনে আবদুল ওহ্হাব (১৭০৩-১৭৯৮খ্রি.) প্রণীত ইসলামের বিশুদ্ধ মতবাদ ভিত্তিক গ্রন্থ কিতাব আল-তওহীদ-এ বিধৃত অনুশাসন থেকে। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এই আন্দোলনের শুরু হলেও সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১খ্রি.)-এর নেতৃত্বে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে এই আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ওহ্হাবী আন্দোলন এক পর্যায়ে ফরায়েজী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।

‘ওহ্হাবী’ শব্দে প্রথমে যথার্থভাবে একদল আরব মুসলমানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর শব্দটার উৎপত্তি হচ্ছে সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার নাম শেখ আবদুল ওহাব থেকে। তিনি গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব দেশের নজদ্ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। বসরার মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে ভ্রাম্যমাণ সওদাগর হিসেবে দাম, পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী মশহুর শহরগুলোতে এবং পারস্যেও সফর করেন। বহু বছর সফরের পর তিনি আরবে প্রত্যাগমন করেন এবং নিজ প্রদেশের রাজধানী দারিয়ায় বসবাস কায়েম করেন। সেখানে তিনি সংস্কার কাজ শুরু করেন এবং নিজের বিশেষ মতবাদও প্রচার করতে থাকেন। তিনি শিক্ষা দেন যে, মুসলমানদের উচিত হজরতের জীবদ্দশায় ও তাঁর পরের খেলাফতের আমলে ইসলামের যে রূপ ছিল, তারই অনুসারী হওয়া; প্রত্যেক মুসলমানের উচিত একমাত্র আল্লাহর উপর এবং তাঁরই উপর অকুণ্ঠ নির্ভর করা, হজরত মুহম্মদ কিংবা কোনও ওলী-দরবেশের পর থেকে যে-সব অনুষ্ঠান, উৎসব ও নিয়ম উদ্ভূত হয়েছে যে-সব একেবারে পরিহার করা এবং সর্বোপরি ইসলামের শৈশাবস্থায় ইসলাম যেমন তরবারির মুখে প্রচারিত হয়েছিল, তেমনইভাবে ইসলাম জারী করা।

আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের ওয়াহাবী আন্দোলনকে বা বাংলার ফরায়েজী আন্দোলনকে ধর্মবিশ্লেষকরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূল্যায়ন করেছেন। উপনিবেশবিরোধী উপাদানের তারতম্যহেতু এই বিশ্লেষণও বহুমাত্রিক এবং স্বস্বার্থমুখী। যেমন সুফি ইতিহাস দৃষ্টিতে এর কোন গুরুত্বই নেই। তবে নির্মোহী ঐতিহাসিকেরা এই সিদ্ধান্তে একমত যে, পূর্বোক্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনেরই একটা প্রধান দিক হল ইসলাম থেকে ইসলাম-বহির্ভূত সকল বেদাত বিষয়কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ইসলামকে তার ‘মৌল বিশুদ্ধতায়’ জারি রাখার চেষ্টা। এ সময়ের উপমহাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওয়াহাবীদের এই ‘মৌল বিশুদ্ধতা রক্ষা’ আন্দোলন এক পর্যায়ে অসহিষ্ণু মৌলবাদী চেহারায় রূপ নেয়। আমরা জানি ইসলাম ধর্মে আরবের মুসলমান এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। হিন্দু সমাজে দরিদ্র ও শূদ্রদের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোন বিদ্রোহ দেখা যায়নি, তার কারণ হল জন্মান্তরবাদ। হিন্দু শাস্ত্র সমূহে বলা হয়েছে, এ জন্মে নির্বিবাদে ব্রাহ্মাণের সেবা ও তাদের নির্দেশ পালন করলে— পর জন্মে তারা উচ্চতর বর্ণে জন্মগ্রহণ করে সুখ ও স্বাচ্ছন্দের জীবন যাপন করতে পারবে।

বর্তমান শতকের প্রথম ভাগে ওহাবী মতবাদ আরব প্রত্যাগত বহু হাজীর দ্বারা ভারতে আমদানী করা হয়েছে। আর এটা সুনিশ্চিত যে, ফরিদপুরের বাসিন্দা ও মশহুর দুদু মিয়ার পিতা হাজী শরীয়তউল্লাহ্ কর্তৃক এই ধরনের মতবাদ নিম্নবঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় ফারাজী। কিন্তু শরীয়তউল্লাহ্র শিক্ষার ফল এই দাঁড়ায় যে, লোকে হিন্দুস্থানের বাসিন্দা সৈয়দ আহমদের মতবাদ গ্রহণ করাবার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে একটি সর্ববাদিসম্মত কাহিনী চলিত আছে যে, মুহম্মদের মৃত্যুর পর থেকে রোজ-কেয়ামত পর্যন্ত বারো জন খলিফা ইসলামের শাসক হবেন। কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়ে গেছে, এ পর্যন্ত কতজন খলিফা উদিত হয়েছেন। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, এগারো জন ইমাম গত হয়েছেন এবং দ্বাদশ ইমাম মুহম্মদ আবু কাসিম ২৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। শিয়ারা বিশ্বাস করে না যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে; বরং তাদের ধারণা যে, তিনি কোনও গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে আছেন এবং উপযুক্ত সময় উপস্থিত হলেই তিনি পুনরায় উদিত হবেন ও মুসলমানদিগকে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করবেন।

ইসলামে ধর্মীয় আচার পদ্ধতিতে ‘মাজহাব’-এর উৎপত্তি ও তার প্রভাব

‘মাজহাব’ আরবি শব্দ। এর অর্থ-ই লাম ধর্মীয় চর্চাপদ্ধতি; বিশেষ মত ও পদ অবলম্বী দল; সম্প্রদায়; সঙ্ঘ ইতাদি। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এর তিরোধানের পরেও কোরআন ও হাদিসে যেসব সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত, সেগুলো নিয়ে বড় রকমের কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের পরে ইসলামের সঙ্গে যখন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির সংযোগ ঘটতে শুরু করে তখন ভিনদেশি আচার অনুশীলন ও নিয়ম-কানুনকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে দেখতে হয়। এবং কোন বিশেষ বিষয়টি ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আর কোনটি ইসলামের পরিপন্থি তা-ও স্থির করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় স্বভাবতই মুসলমানরা পড়ল বিপাকে। তখনই দেখা দিল মতদ্বৈধ, তখনই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াল বাধ্যতামুলক বিস্মৃত আইন-কানুনের। এভাবে আইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে চিন্তাভাবনার এক সুস্পষ্ট পর্ব সূচিত হয় খ্রিষ্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকের দিকে। ওই সময়েই ইরাক, হেজাজ, সিরিয়া ও বিভিন্ন স্থানে বিকশিত হয় আইনবিষয়ক কিছু সুনির্দিষ্ট মত এবং এগুলোর ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে চারটি সুন্নি মাজহাব। এই মাজহাব চারটির প্রতিষ্ঠাতাদের প্রত্যেকেই অর্জন করেছিলেন জনগণের ব্যাপক স্বীকৃতি ও সম্মান। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন প্রণালির সঙ্গে এদের রায় বিবেচিত হত প্রায় অবশ্য পালনীয় বলে। তাঁদের অনুসৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগবুদ্ধির ব্যবহার (ইজতেহাদ) মুসলিম জাতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আজও পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান তাঁদের কোন-না কোন একজনের নির্দেশিত পথের অনুসারী। মূলনীতির দিক থেকে এ চারটি মাজহাবের মধ্যে বিশেষ কোন মৌলিক পার্থক্য নেই বটে; কিন্তু আইনের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যায় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই স্বতন্ত্র। চারটি মাজহাব হল—

ক. হানাফি মাজহাব, খ. মালেকি মাজহাব, গ. শাফি মাজহাব ও ঘ. হাম্বলি মাজহাব।

ক. হানাফি মাজহাব : প্রথম মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফার (৬৯৯- ৭৬৭ খ্রি.) নামানুসারে হানাফি মাজহাব পরিচিতি লাভ করে। আবু হানিফার আবির্ভাব ঘটে ইরাকে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের আমলে কিন্তু তাঁর কার্যকলাপ বিস্তৃত ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের আঠারো বছর অবধি। তিনি দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেন আইন বিজ্ঞান অধ্যয়নে এবং স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হিসেবে। আইন বিশ্লেষণে আবু হানিফা যে প্রগাঢ় নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন তা সব মহলে স্বীকৃত। আইনতত্ত্বের সূত্র ও নীতি প্রণয়নে তিনি ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন বলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত হানাফি মাজহাবকে অভিমতবাদী (আহলুল রায়) বলে অভিহিত করা হয়। আবু হানিফার আগে কিয়াস প্রচলিত থাকলেও তিনিই এ নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন মুসলিম আইনের উৎস হিসেবে। তাঁর প্রবর্তিত আইনের নীতিমালা ইসতিহসান নামে পরিচিত। বাস্তবতার সঙ্গে আইনের সাযুজ্য অনুসন্ধানই ছিল এ নীতির মূলকথা। হানাফি মাজহাবকে আরও প্রণালিবদ্ধ ও সংহত করেন আবু হানিফার দুই বিশিষ্ট শিষ্য আবু ইউসুফ (মৃ. ৭৯৭) এবং মোহাম্মদ আলি সায়বানি (মৃ. ৮০৫)। স্বাধীন মতবাদ প্রয়োগের জন্য বিখ্যাত এ মাজহাবটিকে আব্বাসীয় খলিফারা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। কিন্তু এই স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের কারণেই তাঁরা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন অষ্টম ও নবম শতকের দিকে স্বাধীন মতবাদ বিরোধী আহলে হাদিস সম্প্রদায় দ্বারা। বর্তমানে তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা এ মাজহাবের অন্তর্গত।

খ. মালেকি মাজহাব : মালেক ইবনে আনাস (৭১৩-৭৯৫ খ্রি.) মদিনায় প্রতিষ্ঠা করেন মালেকি মাজহাব। তিনি তাঁর সম সাময়িক কালের হাদিস শাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত। আইনতত্ত্বে তাঁর প্রধানগ্রন্থ আলমুবাত্তা। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় মালেকি মাজহাবের বিকাশ। মালেক ইবনে আনাসের সঙ্গে আবু হানিফার মতের তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবে তিনি ব্যক্তির অভিমতের চেয়ে হাদিসের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়া মদিনায় প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকেও তিনি আইনের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে তিনি এগুলোর সমর্থনের প্রয়োজন মনে করতেন প্রামাণিক হাদিস দ্বারা। তিনি যেসব আইনবিষয়ক রীতি সংগ্রহ করেন এবং যেগুলোকে মদিনার প্রচলিত আচারের আলোকে পরীক্ষা করেন সেগুলোর সমন্বয়েই রচনা করেছিলেন আলমুবাত্তা। বর্তমানে মক্কা, মদিনা, পশ্চিম আফ্রিকা, উত্তর মিশরের অধিকাংশ অঞ্চলে এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম অঞ্চলের বেশির ভাগ মুসলমান মালেকি মাজহাবে বিশ্বাসী।

গ. শাফি মাজহাব : মুসলিম আইন সম্প্রদায়ের তৃতীয় প্রভাবশালী সম্প্রদায় হল শাফি মাজহাব। এই মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইসলামি আইনের প্রথম ধ্রুপদী ব্যাখ্যাতা বলে পরিচিত মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আস-শাফি (৭৬৭-৮১৯ খ্রি.)। তিনি ছিলেন ইমাম মালেকের ছাত্র। তবে আইন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর গুরুকে ছাড়িয়ে যান। ইসলামি আইনের বিকাশে তাঁর প্রভাব অপরিমেয়। তাঁর প্রধানগ্রন্থ রিসালা আইনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের দিকে হাদিসের বহু সংস্করণ লক্ষ্য করা যায় এবং এগুলোর প্রামাণিকতা পরীক্ষারও প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা সমাধানে কোরআন ও হাদিসের উপর নির্ভরশীলতার পরিমাণ, কোরআন ও হাদিসে যেসব সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান নেই, সেগুলোর সমাধানে কী করণীয়, প্রামাণিক ও অপ্রামাণিক কোরআনীয় বাণী কিংবা হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করা যায় কীভাবে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যখন উত্তপ্ত আলোচনা ও অস্বস্তিকর বিতর্ক চলছিল, তখনই এগিয়ে এসেছিলেন আস-শাফি।

তাঁর মতে আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরআন ইসলামি আইনের অকাট্য ভিত্তি, আর হাদিস ও সুন্নাহ এর পরিপূরক। কোরআন ও হাদিসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। থাকতেও পারে না। দুটি হাদিস পরস্পরবিরোধী হতে পারে একথাও তিনি সহজে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। এমন কি যেসব ক্ষেত্রে বিরোধটা খুবই স্পষ্ট বলে চিহ্নিত হত সেখানেও তিনি সংশ্লিষ্ট হাদিসের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেন, যার ফলে একটি হাদিসকে আর অপরটির বিরোধী বলে মনে হত না। সব ক্ষেত্রেই যে এধরনের সমন্বয় ভাষ্য সম্ভব তা দেখাবার উদ্দেশ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর কিতাব ইখতেলাফ আল-হাদিস নামক গ্রন্থটি।

শাফির মতে, মহানবীর হাদিস ও খলিফাদের অনুসৃত রীতির মধ্যে কোনও বিরোধ দেখা দিলে হাদিসকে গ্রহণ এবং সেসব রীতিকে বাতিল করতে হবে। ধর্মপ্রাণ খলিফাদের রীতি চূড়ান্ত বলে গ্রাহ্য হবে শুধু সেসব ক্ষেত্রে যেখানে কোরআন কিংবা হাদিসে কোন নির্দেশনা নেই। তবে তিনি একথা জোর দিয়ে বলেন যে, মহানবীর প্রত্যেকটি হাদিসকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের ধারাবাহিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। শাফির মতে, ইসলামি আইনের উৎস চারটি : প্রথমত কোরআন, দ্বিতীয় হাদিসে বিধৃত মহানবীর সুন্নাহ, তৃতীয়ত সমাজের আলেমদের ইজমা (ঐকমত্য) এবং চতুর্থত কিয়াসের মাধ্যমে ব্যবহৃত আলেমদের মৌলিক চিন্তার প্রয়োগ (ইজতেহাদ)। আইনের দিক থেকে শাফির মতবাদ হাদিসবিজ্ঞান বিকাশের পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য প্রেরণা হিসেবে বিবেচিত। মুসলিম আইনের সব ক্লাসিক্যাল মতবাদের উৎস বলেও তা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বর্তমানে মিশর, সিরিয়া, দক্ষিণ আরব, পশ্চিম আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ায় শাফির অনেক অনুসারী রয়েছে।

ঘ. হাম্বলি মাজহাব : আহমদ ইবনে হাম্বলের (৭৮০-৮৫৫ খ্রি.) নেতৃত্বে নবম শতকে একটি নতুন সম্প্রদায় শাফি মাজহাব থেকে বেরিয়ে আসে। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, হাদিসে সুপণ্ডিত ও রক্ষণশীলপন্থি চিন্তাবিদ আহমদ ইবনে হাম্বলের নামানুসারে এই মাজহাবের নাম হয় হাম্বলি মাজহাব। হাদিসের সর্বাত্মক ও সঠিক অনুসরণই তাঁর প্রবর্তিত আইনের মূলসূত্র। হাম্বলের শিক্ষাকে সুসংহত করেছিলেন তাঁর শিষ্যেরা। চৌদ্দ শতক পর্যন্ত এর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এরপর তাঁদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে কেবল আরবে এর কিছু সমর্থক আছে। আঠারো শতকে ওহাবিরা তাঁদের মতবাদের উৎস ও প্রেরণা লাভ করেছিলেন হাম্বলিদের কাছ থেকে।

মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এর বাণী ও রীতির অনুশীলনকে হাম্বলিরা ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ বলে মনে করেন। বিশেষত হাম্বলি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইবনে হাম্বল হাদিস ব্যাখ্যায় অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। তিনি ইজমা বা কিয়াসের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না এবং তাঁর মতে, ব্যাখ্যার মাধ্যমে হাদিসের প্রসারণ কিংবা সংকোচন অনুমোদনযোগ্য নয়। তিনি ছিলেন শাফির অনুসারী। ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে যেন কোন প্রগাঢ় আলোচনা করা না হয় সেজন্য তিনি এক নতুন ধরনের যুক্তির অবতারণা করেন। তাঁর মতে, মহানবী আলোচনা করেননি এমন যেকোন বিষয়ের আলোচনা ভ্রান্তিজনক এবং সেজন্যই অবাঞ্চনীয়।

হাম্বল ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান নিরাপদ হাদিসপন্থি ধর্মতাত্ত্বিক। তাঁর মতে, বিনা আলোচনায় ও বিনা প্রশ্নে হাদিসকে গ্রহণ করতেই হবে। কোরআন ও মহানবীর সুন্নাহর অধ্যয়নে বুদ্ধির প্রয়োগকে তিনি কঠোরভাবে নিন্দা করেন। তাঁর এ নির্বিচার বিশ্বাসের প্রতি অনেক শিষ্য আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে সংখ্যাগুরু হানাফি মাজহাব অনুসৃত মুসলিমদের সঙ্গে এই হাম্বলি মাজহাবের অনুসারীদের বহু বিষয়ে তথা ‘শরা-বেশরা’র বিরোধ বিদ্যমান।

ইসলামে মুতাজিলা মতবাদ : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ওয়াসিল বিন আতা ও আমর বিন ওবায়েদ নামক দুজন মুক্তবুদ্ধি মানুষের আবির্ভাব ঘটে ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। এঁরা দুজনেই ছিলেন হাসান আল-বসরির শিষ্য। হাসান আল-বসরির নির্দেশেই তাঁরা বসরা নগরীর প্রধান মসজিদে নিয়মিত ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দিতেন। এই দুজন অসামান্য পণ্ডিতের নামের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে মুতাজিলা মতবাদের জন্ম ইতিহাস।

একদিন হাসান আল-বসরি যখন তাঁর ভক্তদের সঙ্গে কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন তখন উপস্থিত ভক্তদের একজন মুরজিয়া ও ওয়াইদিয়াদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সম্পর্কে একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করেন। মুরজিয়া শব্দের অর্থ হল স্থগিত রাখা। মুরজিয়া মতে, আল্লাহই চূড়ান্ত বিচারের মালিক। এবং এজন্য অন্যান্য মুসলমানদের সম্পর্কে যেকোন রায় শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত স্থগিত রাখা উচিত। মুরজিয়াদের মতে, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমান পাপ করলেও মুসলমান থেকে যায়। কোন ব্যক্তি পাপ করে যদি অনুশোচনা করে তা হলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন। খারিজিয়া যখন ঘোষণা করে যে, পাপের পরিণতি দোজখের আগুন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে মুরজিয়ারা এগিয়ে আসেন তাঁদের উদার নৈতিক মত নিয়ে। ধর্মীয় ব্যাপারে মুরজিয়ারা ছিলেন উদার ও সহনশীল। তাঁরা অপরের পাপকে দেখতেন উদার দৃষ্টিতে এবং মনে করতেন যে, একমাত্র বহু ঈশ্বর বিশ্বাসই অমার্জনীয় পাপ।

হাসান আল-বসরির জনৈক শিষ্য হাসানের কাছে জানতে চান— মুরজিয়ারা মনে করে যেকোনো বড় পাপ করার পরে মুসলমান মুসলমানই থাকে, তাকে অবিশ্বাসী বলা যায় না। কারণ, তার ভাগ্য নির্ভর করে আল্লাহর বিবেচনার উপর। অপর দিকে ওয়াইদিয়ারা মনে করেন— কোরআনের নির্দেশ অনুসারে বড় পাপ সংঘটনকারী সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত, এবং সে কারণেই তাকে আর বিশ্বাসী বলা চলে না। এর আসল জবাব কী হবে? হাসান আল-বসরি এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই ওয়াসিল অথবা আমর তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন এবং বলেন যে, আলোচ্য পাপী ব্যক্তিকে মুসলমান যেমন বলা যাবে না, তেমনি তাকে অমুসলমান বলাও ঠিক হবে না। তাঁর এই আচরণে হাসান বিরক্তি বোধ করেন এবং বলেন : ‘সে (ওয়াসিল/আমর) আমাদের ত্যাগ করেছে (ইয়াযালা আনা)।’ ঠিক তখনই ওয়াসির ও আমর তাঁদের গুরুর সঙ্গ ত্যাগ করেন এবং মসজিদের অন্য এক অংশে গিয়ে তাঁদের নিজ নিজ মত প্রচার শুরু করেন।

মুতাজিলাবাদের অগ্রগতির মূলে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে ওয়াসিল বিন আতা ও আমর বিন ওবায়েদ ছিলেন বিখ্যাত। খলিফা ইয়াজিদ ইবনে ওয়ালিদ মুতাজিলা মত প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর শাসনকালে এ মত অন্য সব মতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়াদের পতনের পর মুতাজিলারা আব্বাসীয়দের কাছ থেকে উদার সমর্থন লাভ করে। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ছিলেন আমর বিন ওবায়েদের বন্ধু। তিনি আমরের ধর্মানুরাগ ও পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেন। শুধু তা-ই নয়, আমরের মৃত্যুতে তিনি একটি শোকগাথা রচনা করেছিলেন। একজন পণ্ডিতব্যক্তির মৃত্যুতে কোন শাসকের পক্ষে শোকগাথা রচনা মুসলমানদের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম। তাঁর শাসনামলে মুতাজিলারা চিন্তার ক্ষেত্রে অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি পায় এবং স্বাধীন চিন্তাভাবনার সুযোগ পায়।

খলিফা মনসুরের আমলে ইহুদি, খ্রিষ্টান, পারসিক প্রভৃতি জাতির ধর্মীয় বিধি- বিধান ও যাগযজ্ঞের দার্শনিক বিশ্লেষণ এমন কি সমালোচনাও শুরু হয়। এসব স্বাধীন আলোচনাকে মনসুর উৎসাহিত করেন। রক্ষণশীল মুসলমানরা তাদের ধর্মের সমর্থনে মুসলমানদের সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু অমুসলমানদের যুক্তিকে তারা নিছক বিশ্বাসের অস্ত্র দ্বারা খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়। এসময় মুতাজিলারা এগিয়ে আসেন ইসলামকে যৌক্তিকভাবে সমর্থনের দাবি নিয়ে। দ্বান্দ্বিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তারা অমুসলমানদের যুক্তি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন। এর ফলে ইসলামের ভাবমূর্তি সমুন্নত ও সুদৃঢ় হয়। পরবর্তীকালে মুতাজিলারা খলিফা আল মামুনের কাছ থেকে আরও সমর্থন লাভ করেন।

মুতাজিলা মতবাদ ছিল শাস্ত্রীয় বিধান ও বাণী যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা করার একটি শক্তিশালী আন্দোলন। মুতাজিলারা ছিলেন প্রধানত স্বাধীন চিন্তাবিদ এবং এ কারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রশ্নে তাঁরা পোষণ করতেন নিজস্ব স্বতন্ত্র মত।

মুতাজিলারা যৌক্তিক বিশ্লেষণের আলোকে দেখাবার চেষ্টা করেন যে, কোরআনের ব্যাখ্যায় উদ্ধৃত অনেকগুলো হাদিসই বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার পরিপন্থি এবং এ কারণেই এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে কেউ যদি যুক্তিযুক্ত কারণে হাদিসকে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে তার অমুসলমান হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। তাঁরা মনে করেন, হাদিস কখনো কখনো কোরআন ব্যাখ্যার ভিত্তি কিংবা কোরআনের সমপর্যায় ভুক্ত হতে পারে না। মহানবীর যেসব হাদিসের প্রামাণিকতা বহুসূত্রে সমর্থিত এবং ব্যাপকভাবে গৃহীত নয় সেগুলোর উপর তাঁরা নির্ভর করতে নারাজ। জ্ঞানের উৎস হিসেবে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাকে গ্রহণ করার কারণেই তাঁরা কোরআন ব্যাখ্যায়, ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণে এবং আইন প্রণয়নে সংগতি রক্ষার দাবি জানান।

খলিফা আল-মামুন, আল-মুতাসিন ও আল-ওয়াতিকের শাসনামলে বাগদাদের রাজদরবারে বিভিন্ন ধর্মের মতবাদ নিয়ে আলোচনার জন্য সভা- সম্মেলন অনুষ্ঠিত হত। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য পৃথিবীর বহুদেশের পণ্ডিতব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতেন। কেউ কেউ এর জন্য মুতাজিলাদের প্রভাবকে দায়ী করেন। যার ফলে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে মুতাজিলাদের দুর্দশা শুরু হয়ে যায়। এসময় মুতাজিলারা নতুন খলিফার চোখে ধর্মবিরোধী বলে চিহ্নিত হন এবং তাদের গ্রন্থাবলিকে ভস্মীভূত করা হয়। তবে সব রকম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও খ্রিষ্টীয় দশম শতক অবধি মুতাজিলাদের কিছু কিছু কর্মতৎপরতা অক্ষুণ্ণ ছিল। ইসলামে ধর্মান্দোলনের ইতিহাসে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের আন্দোলন এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

ইসলামে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় : উদ্ভব ও বিকাশ

মুসলিম উম্মাহ দুটি বড় দলে বিভক্ত। একটি হল শিয়া সম্প্রদায়, অপরটি হল সুন্নি সম্প্রদায়। যদিও শিয়া ও সুন্নি উভয়েই খিলাফতের বিষয়ে এবং কিছু মাসলা- মাসায়েলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন, তথাপি এরা উভয়েই একই কিবলার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। এই উভয় সম্প্রদায়ই সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল-কোরআনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের ভেদ রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় প্রকট ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদান নিয়ে যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়— সেখান থেকেই এই দুই সম্প্রদায়ের সূচনা ও বিভাজন শুরু হয়।

রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর তাঁর স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত বা সুন্নি সম্প্রদায়ের মতামত কি? এমন প্রশ্নের জবাবে আহলে সুন্নাত বা সুন্নি সম্প্রদায়ের উত্তর হল— আহলে সুন্নাত বা সুন্নি সম্প্রদায় হজরত আবু বকর (রা.) কে রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত বলে মনে করে এবং বিশ্বাস করে যে, রাসূল (সা.) নিজের পরে কাউকেই উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করে যাননি। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য মুসলমানদের একজন নেতার প্রয়োজন ছিল। যিনি হবেন রাসূল (সা.)-এর স্থরাভিষিক্ত। তাই রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর কিছু সংখ্যক মুসলমান ‘সাকিফা’ নামক স্থানে জমায়েত হন এবং হজরত আবু বকরকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করে তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

প্রশ্ন হল এত এত মানুষ থাকতে হজরত আবু বকর (রা.)কে রাসূল (সা.) এর খলিফা হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল কেন? এর জবাবে আহলে সুন্নাত বা সুন্নি সম্প্রদায় বলেন, হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রগামীদের একজন। তিনি ছিলেন মুহাজির। ‘সাওর’ গুহায় তিনি রাসূল (সা.) এর সঙ্গী ছিলেন এবং রাসূল (সা.)-এর অসুস্থাবস্থায় তিনি রাসূল (সা.)-এর স্থলে মসজিদে নববীতে নামাজের ইমামতি করেছিলেন।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত (সুন্নি সম্প্রদায়) বিশ্বাস করে যে, হজরত আবু বকর (রা.) সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিজের মৃত্যুর পুর্বে একজন উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেন এবং হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) কে খলিফা নিযুক্ত করেন। হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)ও মৃত্যুর পূর্বে তার উত্তরাধিকারী নিয়োগের জন্য ছয়জনের একটি শুরা বা কমিটি নিযুক্ত করেন। যাতে এর এই ছয়জন নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা নির্বাচন করতে পারে। এই কমিটির মাধ্যমে হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) তৃতীয় খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। হজরত ওসমান (রা.)-এর মৃত্যুর পর সাহাবীরা ও সাধারণ জনগণ অনেক অনুরোধ করে হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

মুসলমানদের যে দলটি উপরিউক্ত এরূপ মতাদর্শের অধিকারী ছিল, পরবর্তীকালে তারা আহলে সুন্নাত বা সুন্নি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

রাসূল (সা.)-এর স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে শিয়াদের বিশ্বাস বা মতামত কি?

মুসলমানদের এ দলটি বিশ্বাস করে যে, পয়গম্বর (সা.) তাঁর উম্মতকে কখনো পথপ্রদর্শক বা নেতাহীন অবস্থায় ফেলে রাখতে পারেন না। তারা এটিও বিশ্বাস করে যে, রাসূল (সা.)-এর খিলাফত বা মুসলমানদের নেতৃত্ব এমন সাধারণ কোন কোন বিষয় নয়, যেখানে সাধারণ মানুষও হস্তক্ষেপ করতে পারে। বরং এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ, সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয় যা একমাত্র রাসূল (সা.)- এর পক্ষে থেকেই নির্ধারিত হবে এবং সাধারণ মানুষ তাঁর আদেশের অনুসরণ করবে।

শিয়া সম্প্রদায়টি এরূপ বিশ্বাস করে যে, রাসুল (সা.) তাঁর ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়েই হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.) কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচন করেন এবং সকলের মধ্যে প্রচার করেন যে, তাঁর পর হজরত আলী ইবনে আবূ তালিব (আ.) আমাদের সকলের ইমাম ও নেতা। তিনি তাঁর নিকটস্থ আত্মীয়দের দাওয়াতে, ‘গাদিরে খোম’ গোদির জলাশয় নামক স্থানে এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে হজরত আলী (আ.) এর জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, তাকওয়া, ন্যায়পরায়ণতা ও ঐশী মর্যাদার কথা মানুষের মাঝে প্রচার করেন।

যে দলটি দ্বীন, আল্লাহ ও নবীকে মানার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে হজরত আলী (আ.) এর অনুসারী মনে করে, তারা বিশ্বাস করে যে, ইমামতও নবুওতের ন্যায় ঐশী মর্যাদা সম্পন্ন। যেহেতু নবীর পর ইমামই আল্লাহর হুকুম-আহকামের রক্ষক ও প্রচারক, তাই তাঁকে অবশ্যই আল্লাহর হুকুম আহকামের ব্যাপারে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে।

ইমাম যেহেতু আল্লাহর আইন-কানুন অনুযায়ী জনগণের নেতৃত্ব ও পথ প্রদর্শন করবেন তাই তাকে অবশ্যই রাসূল (সা.) তরফ থেকে এই পদের জন্য নির্বাচিত ও নিযুক্ত হতে হবে। যাতে করে তিনি জনগণের নেতা ও আল্লাহর হুকুম-আহকামের সংরক্ষক হতে পারেন এবং জনগণও যেন পুর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তাকে অনুসরণ করতে পারেন। শিয়ারা বিশ্বাস করেন মহানবী (সা.) আল্লাহর সহযোগিতায় এরূপ ব্যক্তিকে চিনতেন। তাই তিনি আল্লাহর আদেশে তাঁকে জনগণের ইমাম ও নিজ উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীতও করে গেছেন।

হজরত আলী ইবনে আবূ তালিব (আ.) নবী (সা.) এর আদেশে ইমাম হাসান (আ.) কে নিজের পর ইমাম হিসেবে মনোনীত করেন। ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসানই (আ.)-কে আল্লাহর ও নবীর আদেশে ইমাম হিসেবে মনোনীত করেন।

ইমাম হোসেইন (আ.) ও আল্লাহর আদেশ ও নবী (সা.)-এর পরামর্শে নিজপুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আ.)কে ইমাম হিসেবে মনোনীত করেন এবং এভাবে প্রত্যেক ইমাম স্বস্থানে তাদের পরবর্তী ইমামকে নির্বাচন করতেন এবং তা ১২তম ইমাম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শিয়াদের মধ্যে যারা এরূপ ইমামতে বিশ্বাসী তাদেরকে ‘দ্বাদশ ইমামপন্থি শিয়া’ বা ‘ইমামিয়া’ বলা হয়।

আমরা দেখেছি যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে, তখনই স্বধর্ম সংস্কার তথা ধর্মকে গ্লানিমুক্ত করে তাকে পুনরায় মানবিক পর্যায়ে প্রত্যাবর্তন করানোর প্রয়োজনে এই ধরাধামে স্রষ্টা সংস্কারক প্রেরণ করেন। গীতা ভাষ্যে এঁরা সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন করার জন্যই আবির্ভূত হন। দেখা যায়, প্রত্যেক ধর্মেই তার ক্রান্তিকালে এরকম পরিত্রাণকারীর আবির্ভাব ঘটে। সমাজ বিজ্ঞানের অভিধায় আমরা এঁদের সবাইকে ধর্ম সংস্কারক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও সমাজ সংস্কারক হিসেবে বেশি স্বীকৃতি দেই। যেহেতু কাল পরিক্রায় হারানো ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য ফিরে পেতে এই সকল ধর্ম সংস্কারকদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন হিন্দুধর্ম সংস্কারে শংকরাচার্য, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, শ্রীচৈতন্য দেব, শঙ্কর দেব, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ প্রমুখ সংস্কারকদের যেমন স্মরণ করতে হয়— তেমনি বৌদ্ধধর্ম সংস্কারে সম্রাট অশোক, সম্রাট কনিষ্ক, অনাগারিক ধর্মপাল, আম্বেদকর প্রমুখ সংস্কারকদেরও স্মরণ করতে হয়। খ্রিষ্টধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন সম্রাট কনস্টাইন, মার্টিন লুথার, সেন্ট অগাস্টাস প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এমনিভাবে ইসলাম ধর্ম সংস্কারে শেখ আবদুল ওয়াহাব, সম্রাট আকবর, বাহাউল্লাহ, মোজাদ্দেদে আলফে সানী, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী, মাওলানা মওদুদী, হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রমুখ অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। এঁদের অনেকেই স্ব স্ব ধর্মের শাস্ত্র নির্দেশিত স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে আন্দোলন করেছেন। কেউ বা সংস্কারের প্রয়োজনে আন্দোলন করেছেন। যেমন আরবের শেখ আবদুল ওয়াহাব-এর ‘ওয়াহাবী’ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ইসলামের ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষার জন্য। ইসলাম যে-জনপদেই পৌছুক তাকে এই ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষা করতে হবে, মানতে হবে সমকালীন আরবীয় অনুশাসন, কোন কিছুই পরিবর্তন করা যাবে না; মূল কথা আরবীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা পাক-ভারত উপমহাদেশে সম্প্রসারিত করেছিলেন মওলানা মওদুদী। তবে সুফিদের প্রচারিত সম্প্রীতির ইসলামের কাছে এই অসহিষ্ণু আন্দোলন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ধর্মসংস্কার শুধু ধর্মের শাস্ত্রাজ্ঞা পুনরুদ্ধার নয়, তা কখনো প্রচলিত সমাজ বিধানের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হতে দেখা যায়। যেমন রামমোহনের ব্রাহ্ম আন্দোলন ও সতীদাহ নিবারণ কিংবা বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রচলন। তবে ইতিহাসের সকল সংস্কার আন্দোলনই যে-সমাজের অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে কিংবা মানবিকী চেতনায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তা নয়, এই অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকেই আজ সোচ্চার কণ্ঠে বলেন : ‘ধর্ম-সংস্কার চেতনায় কোন কা-পুরুষ বাঙালির আদর্শ হতে পারে না। বাঙালি আজ চায়, স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলা রাম নয়, স্ত্রীকে সহীদাহ থেকে রক্ষাকর্তা রাজা রামমোহন হোক বাঙালির আদর্শ।’

যে-আদর্শ অনুসৃত হলে বাঙালির ধর্মচেতনা বিশ্বমানবিকতায় পৌঁছতে পারে। যদি বাঙালির ধর্মান্দোলনগুলি সবই প্রত্যাশিত মানবিকবোধে বিকশিত হত— তাহলে কতই-না মহত্তম হত! এতদ্‌সত্ত্বেও স্ব স্ব আদর্শে উজ্জীবিত এসব অতৃপ্ত ধর্মান্দোলনে যে-টুকু মানবিকবোধ সঞ্চারিত হয়েছে- তারও বৈশ্বিক গৌরব

বাঙালির ধর্মচিন্তা ৪০৮

কম নয়। বাঙালির ধর্মান্দোলনের এই গৌরবের অংশকেই ধারণ করে নজরুলের গানে গানে বাঙালি আরও কতকাল হয়ত গাইবে-

‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।’

হ্যাঁ, ধর্মান্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বকে যদি জ্ঞাতি অর্থাৎ আত্মীয়-আপনজন করা যায়, বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে (Universal Btotherhood) আবদ্ধ করা যায়, সর্বমানবিক মঙ্গলার্থে সেই ধর্মান্দোলনের সংগ্রামী সাধকদের সকলেই স্বাগত জানাবে। কিন্তু স্বতন্ত্র ধর্মাবিশ্বাসতাড়িত আপনপক্ষে অপরকে আহ্বান যতই সুভাষিত হোক, শান্তিপূর্ণ হোক— তা দিয়ে কি সর্বমানবিক মঞ্চ স্থাপন সম্ভব? সেটা ‘স্ব-জাতির সেবা’ হতে পারে বিশ্বকে জ্ঞাতি হিসেবে গণ্য করে একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী (Faith Sharer) হওয়া কি সম্ভব?

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি

H.W. Turner, Religions Movements in Africa; Boston, 1979 Diane Choqette, New Religious in the United States and Canada; Westport, 1985

George Chryssides, New Religious Movements, London, 1995 Eileen Barker, New Religious Movements; London, 1995

J.A. Backford, New Religious Movements and Rapid Social Change; Paris, 1995

J.A. Backford, New Religious Movements in Western Europe, Levasseur, 1995

B.M. Walsh, New Religious Movements: A Challenge of the Church, London, 1995

Bryan Wilson, New Religious Movements: Challenge and Response; London, 1999

Christopher Partridge (edited), J. Gordon Melton (forwarded), Encyclopedia New Religions New Religious Movements Sects and Alternative Spiritualities: Lion Publishing Plc, Oxford, England, first Published, 2004

Hafez Munir Uddin Ahmed, Dr. Khadiza Rezai, Bangladesh Islamic Directory; Al Quaran Academy London & Bangladesh Islamic Directory & Data Information Ltd, Dhaka – London, 2005

শ্রীনাথ চন্দ, ব্রাহ্মসমাজ চল্লিশ বৎসর; সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, ময়মনসিংহ, প্ৰ. প্ৰ. ১৯১৩

প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, আত্মীয়-সভার কথা; সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, কলিকাতা, ১৯৭৫ স্বা

মী অনুভবানন্দ, আর্য সমাজ পরিচয় (শঙ্করনাথ পণ্ডিত কর্তৃক হিন্দি থেকে অনুদিত, দয়ানন্দ সরস্বতীর সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ); কলিকাতা, ১৯২৬

বিহারীলাল সরকার, তিতুমীর বা নারকেল বেড়িয়ার লড়াই, কালিকা যন্ত্র, কলিকাতা, ১৮৯৭

আবদুল মওদুদ, ওহাবী আন্দোলন; আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, চ. সং. ১৯৯৬

আবুবকর সিদ্দিকী, খেলাফত আন্দোলনের পদ্ধতি, বরিশাল ১৯২১

রজনীকান্ত গুপ্ত, আর্য্য-কীর্তি; বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরি, কলিকাতা, ১৮৮৩

ধনঞ্জন রায়, উত্তরবঙ্গের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন; নর্থ-ইস্ট পাবলিকেশন, কলিকাতা, ১৯৮৯

মধুসূদন তত্ত্ববাচস্পতি, গৌড়ীয়-বৈষ্ণব-ইতিহাস, বৈষ্ণব-বিবৃতি, ভক্তিপ্ৰভা কার্যালয়, শ্রীরামপুর, হুগলী, ১৯২৬

ক্ষিতীন্দ্র নাথ ঠাকুর, ব্রাহ্ম-সমাজের ইতিবৃত্ত; উপকরণ, কলিকাতা, ১৯৩০

ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর সংস্কার আন্দোলন; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৭

সেলিম আহমেদ, হজরত খান জাহান আলী (র.); ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৭

সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ), তারিখে দাওয়াত ঔর আযীমত (সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, ৫ খণ্ড), দারুল উলূম নওদাতুল ওলামা, লখনৌ, ভারত, ১৯৯২।

ড. মঈন উদ-দীন আহমদ খান, ফরায়েজী আন্দোলনের ইতিহাস; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০০

হাফেয মুহাম্মদ আইয়ুব, আহলে হাদীসদের পরিচয় ও ইতিহাস; আহলে হাদীস রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা, ২০০০

এ.এম.এম. আবদুল আযীম ও সিদ্দিক আহমদ খান, হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র.) জীবন ও কর্ম; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০১

অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশোক ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), চৈতন্য: ইতিহাস ও অবদান; সারস্বত লাইব্রেরী, কলকতা, দ্বি. মু., ২০০২

সদর উদ্দিন আহমদ চিন্তী, মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ; র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৩

ইমামুদ্দীন মুহাম্মদ তোয়াহা বিন্ হাবীব, এ হলো ইসলাম এ ছিলেন মুহাম্মদ (সা.); মুহাম্মাদ ইবন্ ইমামুদ্দীন, ঢাকা, ২০০৩

দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, হযরত শাহজালাল (র.); ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৪

জুলফিকার আহমদ কিসমতী, দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) ও তাঁর চিন্তাধারা; ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০8

বাশীর বিন মুহাম্মদ আল-মা’সূমী, প্রচলিত ভুল; আদ-দারুত তা’লীমীয়্যা; মাক্কাতুল মুকাররামা, স’য়ূদী আরব, ২০১২

এম.এ.হক. জেহাদ দর্শন; র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১৩

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি : প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট; আনন্দ পাবলিশার্স প্রা.লি. কলকাতা, চ.মু. ২০১৫

পারভেজ আলম, মুসলিম জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই; আদর্শ, ঢাকা, প্র.প্র. ২০১৫

পারভেজ আলম, মুসলিম দুনিয়ার ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস; আদর্শ, ঢাকা, প্র.প্র. ২০১৬

সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ও ইসলাম; জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬

মুস্তফা নূরউল ইসলাম, বাঙালির আত্মপরিচয়; বর্ণায়ন, ঢাকা, ২০১৬

মাওলানা হোসেন আলী, বাঙালি মুসলমান : আত্মপরিচয়ের সন্ধানে; জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬

মুনতাসির মামুন, উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্ম আন্দোলন; অনন্যা, ঢাকা ২০১৭

আ.ন.ম আবদুস সোহবান, উপমহাদেশের ইতিহাস, ধর্ম ও রাজনীতি; মুক্তচিন্তা, ঢাকা, ২০১৭

মুফতী রফিকুল ইসলাম আল মাদানী, মাযহাব মানি কেন; ঐতিহ্য, ঢাকা ২০১৭

আকবর আলী খান, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ; প্রথমা ২০১৮

আজগর আলী ইঞ্জিনিয়ার, ইসলাম ও আধুনিকতা; অঙ্কুর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৮

ড. স্বরোচিষ সরকার, বাংলা সাহিত্যে সংস্কারচেতনা মুসলমান সমাজ; শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *