১১. পলায়ন
বসে বসে সবাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করল। অন্ধকার হওয়া মাত্র তারা ছয়জন ঘর থেকে বের হবে। এক সাথে বের না হয়ে সবাই আলাদা আলাদাভাবে। হোস্টেলের গেট রাত আটটার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় কাজেই ঠিক সন্ধ্যার দিকে বের হলে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ঘর থেকে বের হয়ে হোস্টেলের পিছন দিকে চলে যাবে, সেখানে দেয়াল বেয়ে উঠে দেয়াল টপকে স্কুল থেকে বের হয়ে যাবে। বিছানার একটা চাদর পাকিয়ে দড়ির মতো তৈরি করা হবে, প্রথমে যে পার হবে সে সেটা দেয়ালের অন্যপাশে ধরে রাখবে যেন অনারা সেটা ধরে তাড়াতাড়ি ওঠে পার হতে পারে। ওরা একজুন একজন করে পালাবে। তাই যদি কেউ ধরা পড়ে যায় কখনোই অন্যদের কথা বলবে না। যদি কোনো কারণে ওরা আলাদা হয়ে যায় তাহলে স্কুলের বাইরে যে রাস্তা আছে সেই রাস্তার শেষ মাথায় যে বাস স্টেশন রয়েছে সেখানে অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করবে। যেহেতু পুরো ব্যাপারটা একটা সত্যিকারের এডভেঞ্চার তাই সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে বের হবে। তাদের পায়ে থাকবে টেনিস সু এবং পরনে থাকবে প্যান্ট এবং টী সার্ট। সবার সাথে একটা করে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাগ থাকবে, সেই ব্যাগের মাঝে থাকবে আরো এক সেট কাপড়, একটা চাদর, কাগজপত্র, কিছু শুকনো খাবার, ছুরি চাকু বা কোনো এক ধরনের অস্ত্র। যার কাছে যে পরিমাণ টাকা পয়সা আছে সেটা নিয়ে নেয়া হবে, কখন কী প্রয়োজন হতে পারে সেটা কেউ জানে না। অনেক আলোচনা করে ঠিক করা হল প্রথমে বের হবে মিতুল। মিতুলের পর রুনু। রুনুর পর ঝুনু। ঝুনুর পর নিতু, নিতুর পর রেবেকা এবং সবার শেষে তানিয়া। নিতুর ব্যাগের মাঝে থাকবে ফাইলটা—-কাজেই সে যেন ঠিক ভাবে পালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যাপারটা সবাই আলাদা করে লক্ষ্য রাখবে।
বাকি দিনটুকু উত্তেজনার মাঝে কেটে গেল। শান্তা আপা আসার আগে ছুটির দিনগুলি ছিল আনন্দে ভরপুর, প্রতিদিন কিছু না কিছু হত। কোনোদিন স্কুলের মাঠে বনভোজন কোনোদিন মজার কোনো বই পড়া কোনোদিন নাটকের রিহার্সাল। অথচ আজকে সবাইকে দিয়ে বাথরুম আর টয়লেট পরিষ্কার করিয়ে ঘরের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে নোটিশ এসেছে যে সবাইকে চার পৃষ্ঠা ইংরেজি ট্রান্সলেশান করে কুড়িটা অংক করতে হবে। সবাই ঘরে বসে বসে সেগুলি করছে, নিতু এবং তার বন্ধুরা ছাড়া। যখন এই কাজগুলি জমা দেয়ার কথা তার অনেক আগেই তাদের স্কুল থেকে পালিয়ে যাবার কথা। যদি পালাতে না পারে আর খোরাসানী ম্যাডামের হাতে ধরা পড়ে যায় তাহলে ম্যাডাম এমনিতেই খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলবে, কাজেই এই চার পৃষ্ঠা ট্রান্সলেশান আর কুড়িটা অংক না করার জন্যে আলাদা করে শাস্তি পেতে হবে না।
ঠিক সন্ধেবেলা মিতুল তার ব্যাগ কাধে নিয়ে রেডি হল! চাদর পাকিয়ে যে দড়িটা তৈরি করা হয়েছে সেটা হাতে নিয়ে সে কেমন যেন ভীত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ভয় করছে।
সবারই ভিতরে ভিতরে ভয় করছিল কিন্তু মিতুল মুখে সেটা উচ্চারণ করে ফেলার পর হঠাৎ করে সবাই যেন সেটা প্রথমবার টের পেলো। নিতু সাহস দেয়ার জন্যে বল্ল, ভয়ের কী আছে? একবার চিন্তা করে দেখ, ফাইলটা আমার যদি কোনোভাবে বাইরে নিয়ে শান্তা আপার হাতে দিতে পারি তাহলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে?
হুঁ। রুনু বলল, আর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। যেটা করতে ভালো লাগে সেটা করতে পারব।
মিতুল ফিস ফিস করে বলল, তবু ভয় লাগে।
রেবেকা বলল, ভয়ের কিছু নেই। আয় কাছে আয়, তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে তার বুকে ফুঁ দিয়ে দিই, তাহলে কোনো বিপদ তোকে ছুঁতে পারবে না।
মিতুল রেবেকার কাছে এগিয়ে গেল, তখন রোবক চোখ বন্ধ করে খুব গম্ভীর মুখে তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে মিতুলের বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, যা আর কোনো ভয় নাই। আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যখন পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করতে যেতেন সব সময় তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে যেতেন। তাই কোনোদিন কোনো গুলি লাগে নাই।
রেবেকার কথা শুনে মিতুল মনে হয় একটু সাহস পেলো। সে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি গেলাম। দোয়া করিস। একটু থেমে যোগ করল, বেঁচে থাকলে দেখা হবে।
কেউ কোনো কথা বলল না এবং মিতুল দরজা খুলে বের হয়ে গেল। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যায় সে হোস্টেলের পিছনে পৌঁছে গেছে। অন্ধকারে ঝােপঝাড় ভেঙ্গে মিতুল ছুটে যেতে থাকে এবং দেখতে দেখতে সে হোস্টেলের পিছনে দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল দেয়ালের কয়েকটা জায়গা পরীক্ষা করে একটা জায়গা বেছে নিয়েছে, অন্ধকারে অনেকদূর থেকে ঠিক স্পষ্ট দেখা গেল না, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যে দেওয়াল বেয়ে ওঠে পড়তে পারল, সেটা বোঝা গেল। দেওয়ালের ওপর বসে গুড়ি মেরে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিতুল একটা জায়গা পছন্দ করে টুপ করে নেমে পড়ল এবং সাথে সাথে ঘরের ভিতরে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিতু বলল, দেখলি কত সহজ?
রেবেকা বলল, এবারে রুনু।
নিতু মাথা নাড়ল, বলল, তোর জন্যে কাজটা আরো সহজ। মিতুল চাদরটা ধরে রেখেছে তুই শুধু বেয়ে উঠে যাবি।
রেবেকা বলল, যা রওনা দে। দেরি করিস না।
ঝুনু বলল, আমি আর রুনু এক সাথে যাই?
রুনু সায় দিল, যা যাই? তাহলে এক সাথে দুইজন চলে যাব।
দুই বোন সবসময় এক সাথে থাকে তাই এবারেও কেউ আপত্তি করল না। নিতু বলল, যা, রওনা দে।
রুনু আর ঝুনু দু জনের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাবধানে দরজা খুলে মাথা বের করে এদিকে সেদিক তাকিয়ে বের হতে গিয়ে আবার ফিরে এসে রেবেকাকে বলল, আমাদের ফুঁ দিবি না?
রেবেকা বলল, আয়, কাছে আয়।
দুজনে কাছে এগিয়ে এল তখন রেবেকা আবার চোখ বন্ধ করে কুলহু আল্লাহ পড়ে দুজনের বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। রুনু ঝুনু আবার ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয় তারপর সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে যায়। ঘরের ভেতরে বসে পিছনের জানালা দিয়ে বাকি তিনজন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে। মিতুল যে রকম প্রায় সাথে সাথেই হোস্টেলের পিছনে চলে এসেছিল রুনু ঝুনুর বেলায় সেটা সত্যি হল না অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু তবু তার পিছনে এল না। রেবেকা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! কোনো বিপদ হল না তো?
কী বিপদ?
ধরা পড়ে গেল না তো?
ধরা পড়ে গেলে চেচামেচি হৈ চৈ হতো না। কোনো রকম হৈ চৈ তো হচ্ছে না।
নিতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে বাইরে বিশাল হল্লা শোনা গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে তাদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে তার মাঝেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুনু আর ঝুনু প্রাণ নিয়ে দেওয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর তাদের পিছু পিছু চিৎকার করতে করতে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম। রুনু আর ঝুনু হালকা পাতলা কাজেই তারা ছুটছে একেবারে তীরের মতো, পিছু পিছু খোরাসানী ম্যাডামকে মনে হচ্ছে একটা চলন্ত ট্রাক, গাছ পালা ঝােপ ঝাড় ভেঙ্গে একেবারে কামানের গোলার মতো ছুটে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে হোস্টেলে সবাই পিছনের জানালায় চলে এসেছে সবাই হতবাক হয়ে দেখছে রুনু ঝুনু পাই পাই করে ছুটছে আর তাদেরকে ধরার জন্যে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম।
হোস্টেলের পিছনে অনেকটা জায়গা, খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল শরীর নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠেছে। তা ছাড়া দেখতে পাচ্ছে সামনে দেওয়াল, সেখানে পৌঁছালে তো আর যাবার জায়গা নেই তখন তো এমনিতেই ধরা পড়ে যাবে ভেবে খোরাসানী ম্যাডাম তার দৌড়ে একটু রাস টেনেছে, সেই সুর্যোগ দুইবোন দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল চাদর ঝুলিয়ে রেখেছে দুই বোন সেই চাদর ধরে একেবারে বানরের বাচ্চার মতো উপরে উঠতে শুরু করল। খোরাসানী ম্যাড়ম যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারল দুইজন দেওয়াল টপকে পালিয়ে যাচ্ছে তখন আঁ আঁ আঁ করে আবার চিৎকার করতে করতে একেবারে রেলগাড়ির মতো ছুটে আসতে লাগল, এত বড় একটা মানুষ যে এত জোরে ছুটতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। আর একটু হলে খোরাসানী ম্যাডাম দুইজনের একজনকে ধরে ফেলত, কিন্তু তারা ঠিক সময় মতো তার বিশাল থাবা ফসকে কোনো মতে পার হয়ে ঝুপ ঝুপ করে দেওয়ালের অন্যপাশে লাফিয়ে পড়ল। খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল ছুটন্ত দেহকে সামলাতে না পেরে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরেকটু হলে পুরো দেওয়ালটাকেই ধ্বসিয়ে দিত, কিন্তু তা না করে বিশাল শব্দে সে নিজেই নিচে আছড়ে পড়ল। গা গা গাঁ শব্দ করে সেই অবস্থাতে লাফিয়ে উঠে সে চাদরটা ধরে ঝুলে পড়ল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, এই বিশাল দেহটিকে অন্য পাশ থেকে মিতুল একা নিশ্চয়ই ধরে রাখতে পারবে না–তাই তারা যেটা ভাবছিল ঠিক সেটাই ঘটল হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ধপাস করে নিচে আচড়ে পড়ল এবং এই প্রথম বার সবাই তার একটা কাতর আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই বেকায়দা ভাবে ব্যথা পেয়েছে কারণ দেখা গেল খুব সহজে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। জমিলার মা এবং আরো দুয়েকজন তার দিকে ছুটে যাচ্ছে টেনে তোলার জন্যে।
নিতু এবারে রেবেকা আর তানিয়ার দিকে তাকাল, তারপর উত্তেজিত গলায় বলল, আমরা ধরা পড়ে গেছি। এখনই পালাতে হবে।
রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, কোথায় পালাব?
জানি না, এক্ষুনি ঘর থেকে বের হ। ম্যাডাম এক্ষুনি আমাদের খোঁজ করতে আসবে।
কিন্তু —।
কোনো কিন্তু নাই, ঘর থেকে বের হ। তাড়াতাড়ি।
তাদের ব্যাগ আগে থেকে প্রস্তুত করা ছিল, হাতে নিয়ে তিনজন চোখের পলকে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হৈ হল্লা এবং চেঁচামেচি শুনে সবাই জানালার কাছে চলে গেছে বলে তিনজন সবার চোখ এড়িয়ে সহজেই হোস্টেল থেকে বের হয়ে এল। হোস্টেল থেকে দূরে সরে গিয়ে স্কুল ঘরের সিঁড়ির পিছনে তিনজনই লুকিয়ে গেল।
নিতু যে রকম সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই ঘটল, কয়েক মিনিটের মাঝে খোরাসানী ম্যাডাম তার দল বল নিয়ে হোস্টেলে তাদের ঘরে হাজির হল। তারা এতদূর থেকে শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলছে, খুঁজে বের কর সবগুলিকে। সব বদমাসি পাজী হতছাড়া শয়তানের বাচ্চাদের। এক্ষুনি খুঁজে বের কর। না হলে সবগুলিকে আমি কাল সকালের মাঝে তাড়িয়ে দেব। আস্ত রাখব না একটাকেও।
কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল খোরাসানী ম্যাডামের চেলারা তাদের খোজাখুজি শুরু করে দিয়েছে। ওরা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম চিল্কার করে বলছে, টর্চ লাইট নিয়ে বাইরে যেতে, সবাই নিশ্চয়ই পালাতে পারে নাই, একটা দুইটা নিশ্চয়ই সীমানার ভিতরেই আছে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতেই হবে।
রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেল।
হ্যাঁ নিতু ফিস ফিস করে বলল, টর্চ লাইট নিয়ে খুঁজতে শুরু করলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে।
আমাদেরকে পেয়ে গেলে কী হবে চিন্তা করেছিস?
তানিয়া বলল, আমি চিন্তা করতে চাই না।
আমিও চিন্তা করতে চাই না।
কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।
তা ঠিক। নিতু চিন্তিত মুখে বাইরে ইতি উতি তাকাতে থাকে, ভালো করে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজতে থাকে কিন্তু সে রকম কোনো জায়গাই খুঁজে পায় না। এক পাশে হোস্টেল, অন্য পাশে দূরে খোরাসানী ম্যাডামের বাসা এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল, বলল, পেয়েছি।
কী পেয়েছিস?
লুকানোর জায়গা।
কোথায়।
খোরাসানী ম্যাডামের বাসা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আয়।
রেবেকা আর তানিয়া মুখ হা করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারা এখনো বুঝতে পারছে না নিতু ফাজলেমি করছে কী না। কিন্তু এখন আর যাই করা যাক না কেন ফাজলেমি করার সময় নয়। তানিয়া চাপা গলায় বলল, কী বলছিস তুই?
নিতু অধৈর্য হয়ে বলল, বুঝতে পারছিস না? আমাদেরকে এই স্কুলের সীমানার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় খুঁজবে শুধু একটি জায়গা ছাড়া। সেটা হচ্ছে খোরাসানী মডামের বাসা। আয় সেই বাসার ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি, যখন খোজা বন্ধ করবে তখন বের হয়ে যাবো। আয়, দেরি করিস না।
তানিয়া মাখা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছিস।
রেবেকা এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিল না কিন্তু তিনজনের মাঝে দুজন রাজি হয়ে যাওয়ার তার আর কিছু করার ছিল না।
কিছুক্ষণের মাঝে তিনজন খোরাসানী ম্যাডামের বাসায় হাজির হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে অনেক জায়গা। খোরাসানী ম্যাডাম খুব ভাল করে জানে কেউ কখনো তার বাসায় নিজে থেকে ঢুকাবে না তাই দরজা হাট করে খোলা। নিতু রেবেকা আর তানিয়া চুপি চুপি ভিতরে ঢুকে যায়। লুকানোর জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা পেলো একটা বড় খাটের তলা, সামনে নানারকম বস্তা, প্যাকেট হাড়ি কুড়ি রাখা, পিছনে তিন জনের লুকিয়ে থাকার প্রচুর জায়গা। খোঁজাখুঁজির উত্তেজনাটা পার হয়ে গেলে তারা বের হয়ে আসবে। আর যদি বের হতে নাও পারে রুনু ঝুনু আর মিতুল শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তাদেরকে উদ্ধার করার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে।
তিনজন গুটি শুটি মেরে খাটের নিচে শুয়ে রইল এবং বাইরে হৈ চৈ চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল খোরাসানী ম্যাডাম আর তার চেলা চামুণ্ডা মিলে তাদেরকে খুঁজছে। খানিকক্ষণ পর রেবেকাকেও স্বীকার করতে হল এখানে এসে না লুকালে আজকে তাদের আর জানে বেঁচে থাকার কোন উপায় ছিল না!
খোরাসানী ম্যাডামের বিশাল খাটের নিচে প্রচুর জায়গা এবং মনে হচ্ছে বেশ নিরাপদেই সেখানে শুয়ে থাকা যাচ্ছে কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তারা খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়ল। বিশেষ করে রেবেকার অবস্থা হল খুব খারাপ, সে মাকড়শাকে খুব ভয় পায় আর তার মনে হতে থাকে বড় বড় গোবদা মাকড়শা খাটের নিচে ঘোরা ফেরা করছে আর যে কোনো মুহূর্তে তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ভয় পেলে যদি গলা ফাটিয়ে চিল্কার করা যায় তাহলে একটু আরাম হয়, কিন্তু তারা এমন জায়গায় লুকিয়ে আছে যে তারা যত ভয়ই পাক না কেন এতটুকু শব্দ করতে পারবে না, সেটাই হয়েছে মুশকিল। তা ছাড়া কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে সেটাও আন্দাজ করতে পারছে না। সন্ধে হয়ে গেছে, একটু পরে রাত হয়ে যাবে। রাত্রি বেলা তাদের মতো ছোট ছোট মেয়েরা বাইরে ঘুরোঘুরি করবে কেমন করে?
তাদের সমস্যার সমাধান অবিশ্যি নিজের থেকেই হয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই তারা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে আসছে। খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটলে গুম গুম করে একটা শব্দ হয়, কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে এখন শব্দটা হচ্ছে গুম ক্যাঁৎ গুম কঁাৎ….। কারণটা তারা একটু পইে টের পেল। রুনু বুনুকে তাড়া করে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে এবং মিতুলের ঝুলিয়ে রাখা চাদর বেয়ে উঠতে গিয়ে আছাড় খেয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা পায়ে ভালো রকম ব্যথা পেয়েছে, সেই পাটা ফেলতে হচ্ছে খুব সাবধানে। তার বিশাল শরীরের ওজন সেই পায়ের ওপর ভর করতে গিয়ে কোথা থেকে জানি কাত করে শব্দ হচ্ছে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া খাটের তলায় বসে থেকে দেখতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে এই ঘরে এসে হাজির হয়েছে এবং যন্ত্রণার একরকম শব্দ করে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। সাথে সাথে পুরো বিছানাটি নিয়ে নেমে এল, নিতু রেবেকা আর তানিয়ার মনে হল বুঝি খাটটা ভেঙ্গে তাদের খাটের নিচে পিষে ফেলবে তারা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল কিন্তু খাটটা ভেঙ্গে পড়ল না।
খোরাসানী ম্যাডাম বিছানায় একটু আরাম করে বসে একটা হুংকার দিয়ে বলল, তারার মা–আমার হুক্কা টা—
খাটের নিচে বসে তিন জন চমকে উঠে, হুক্কা? হুক্কা মানে নিশ্চয়ই হুকো, কোনো মহিলা কী কখনো ইকো খেতে পারে? তাদের সন্দেহ একটু পরেই দূর হয়ে গেল, সত্যি সত্যি তারার মা নামে একজন বুড়ি একটা হুকোর ওপর কলকেতে জ্বলন্ত অংগারে ফুঁ দিতে দিতে নিয়ে আসে। সেটা বিছানার পাশে রেখে বলল, খাবার দিব?
দে।
আমার একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার ছিল— কথা শেষ হওয়ার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম তারার মাকে সুশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ শুরু করে, সেই গালি গালাজের ভাষা এত খারাপ যে খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে নিতু রেবেকা আর তানিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। খোরাসানী ম্যাডাম এত খারাপ গালগাল দিতে পারে অথচ সে তুলনায় তাদেরকে যে গালি গালাজ করে সেটা রীতিমতো ভদ্র ভাষা, ব্যাপারটা চিন্তা করে এই প্রথমবার খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে তাদের ভিতর একটু কৃতজ্ঞতার জন্ম নেয়। গালাগালি শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম মনে হল শুয়ে থেকেই তারার মাকে একটা লাথি মারার চেষ্টা করল। তারার মা নিশ্চয়ই এরকম আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত, এতকিছু ঘটে যাবার পরও শান্ত গলায় বলল, টেবিলে খাবার ঢেকে রাখব আফা, আপনি খেয়ে নিবেন কথা শেষ হবার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম, যা হারামজাদি, যা ভাগ, তোর চাকরি শেষ- বলে তাকে দূর করে দিল।
তারার মা ঘর ছেড়ে যাবার সাথে সাথে খোরাসানী ম্যাডাম গুড় গুড়ক করে হুকো টানতে থাকে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে হাটে নিচে শুয়ে থাকে, খোরাসানী ম্যাডাম কী মানুষ না অন্য গ্রহের একটা ভয়ংকর প্রাণী সেটা নিয়ে তাদের সন্দেহ হতে থাকে। খানিকক্ষণ ঘরে হুকোর গুড়ক গুড়ুক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একসময় হঠাৎ মনে হল খোয়াসানী ম্যাডাম কিছু একটা টেনে নিল, জিনিসটা কী একটু পরেই বোঝা গেল, একটি টেলিফোন। কোনো এক জায়গায় ডায়াল করে কথা বলতে শুরু করে খোরাসানী ম্যাডাম।
কালু, খবর কী, বল?
টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে কী খবর দেওয়া হল ওরা শুনতে পেল না কিন্তু খবরটা যে গুরুতর সেটা খোরাসানী ম্যাডামের কথা শুনে বোঝা গেল, ম্যাডাম প্রায় চিৎকার করে বলল, কী বললি? আবাগীর বেটি গেছে নয়নপুর? জোহরা কামাল নিয়ে খোঁজ নিতে?
খাটের নিচে নিতু রেবেকা আর তানিয়া একসাথে চমকে উঠল। তাদের কাছে বেগম জোহরা কামালের দলিল পত্র, তিনি থাকতেন নয়নপুরে! আবাগীর বেটি বলাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে তাদের শান্তা আপাকে! তার মানে শান্তা আপা নিজে নিজেই বেগম জোহরা কামাল সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছেন?
কী বললি? দলিলগুলি খোঁজ করছে? সর্বনাশ! যদি কোনোভাবে পেয়ে যায় আমাদের কী অবস্থা হবে টের পাচ্ছিস? খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, স্কুলের জমি যা দখল নিয়েছি সব যাবে! মনে হয় জেল টেলও হয়ে যাবে।
গুড়ুক গুড়ুক করে হুকো খাওয়ার শব্দ হতে লাগল এবং খোরাসানী ম্যাডাম টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা শুনতে লাগল, যার সাথে কথা বলছে সে নিশ্চয়ই খুব ঘনিষ্ঠ, মহিলা হয়ে সে যে হুকো টানছে সেটা নিয়ে তার কোনো লজ্জা নাই।
খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানা বন্ধ করে বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক। জোহরা কামালের বাক্স খুঁজে পাওয়া গেলে এতদিনে পাওয়া যেতো! এই স্কুলের মাঝেই তো থাকবে, আমি ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুজেছি। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) আর এই বাক্সে যদি খুঁজে না পায় তাহলে আমাদের কিছু করতে পারবে না। জাল দলিল যেটা তৈরি হয়েছে সেইটা আসল দলিলের বাপ। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) তবে আবাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী মহা ঝামেলা তৈরি করেছে। সেইদিনের ছেমড়ী কিন্তু শালীর বুদ্ধি কী সাংঘাতিক! অফিসের দুইটা কাগজ দেখেই সন্দেহ করে ফেলল। (গুড়ুক গুড়ুক)। বুঝলি কালু, আবাগীর বেটির কোনো ভয় ডর নাই, পুরা স্কুলটাকে ওলট পালট করে ফেলল।
খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানতে টতে আবার অন্য পাশে কী বলছে শুনতে থাকে, খানিকক্ষণ শুনে বলল, তাহলে তুই খবর পেয়েছিস আবাগীর বেটি ফিরে আসছে? আমি জানি কোথায় আসছে। (গুড়ুক গুড়ুক) আবাগীর বেটি ফিরে আসছে স্কুলে। তার পিয়ারের মেয়েদের দেখতে—তাদেরকে না বলে চলে গেছে তো, সেইজন্য মন টিকছে না। এসে নিশ্চয়ই তাদের বোঝ দিবে, সাহস দিবে। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) দাঁড়া আমি বোঝাচ্ছি ঠেলা। কয়টার দিকে পৌঁছাবে বল দেখি?
টেলিফোনের অন্য পাশে বলা হল কয়টার সময় শান্তা আপা স্কুলে পৌঁছাবেন কিন্তু নিতু রেবেকা আর তানিয়া সময়টা শুনতে পেল না, তারা শুনল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, ঠিক আছে তাহলে আমি বাকি ব্যবস্থা করি। ওই আবাগীর বেটিরে আমি সিধা করে ছেড়ে দিব। (গুড়ুক গুড়ক) কালু, তুই জানিস শান্তা ছেমড়ি কী অবস্থা করেছে? মেয়েদের এমন লাই দিয়েছে যে ছয় ছয়টা মেয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেছে! স্কুলের ভিতর ইঞ্চি ইঞ্চি করে খোঁজা হয়েছে কোথাও নাই। সেই রিপোর্ট ও দিতে হবে (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) কিছু আর ভালো লাগে না। বদমাইস গুলিরে ধরতে গিয়ে বেকায়দা পড়ে মাজাটায় যা ব্যথা পেয়েছি, ওহ! রেখে দেই কালু, অনেক কাজ বাকি।
খোরাসনী ম্যাডামের অনেক কাজ কী সেটা বোঝা গেল একটু পরে, ফোন করে কথা বলতে শুরু করল শহরের বড় কোন্ মাস্তানের সাথে। স্কুলের রাস্তার ঠিক কোন্ নির্জন জায়গায় রাত নয়টার দিকে রিক্সা করে শান্তা আপা আসবেন এবং সেখানে কী ভাবে তাকে আক্রমণ করে আচ্ছা মতন শিক্ষা দিতে হবে সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে থাকল। আচ্ছা মতন শিক্ষা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হল, জানে মারতে হবে না, হাত পা কিছু একটা ভেঙ্গে দিতে হবে। কোনো জয়েন্ট ভাঙ্গলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া যায়, সারতে খুব বেশি সময় নেয় এটা নিয়েও দীর্ঘ সময় আলোচনা করা হল। যে কাজটা ঠিক করে করতে হবে সেটা হচ্ছে ভয় দেখানো—এমন ভয় দেখাতে হবে যেন শান্তা চৌধুরী আর জীবনে এই এলাকায় না আসেন। যে মাস্তানের সাথে কথা হচ্ছে সে কীভাবে ভয় দেখাবে টেলিফোনে খোরাসানী ম্যাডামকে শোনাল এবং পদ্ধতিটা খোরাসানী ম্যাডামের খুব পছন্দ হল বলে মনে হল কারণ খোরাসানী ম্যাডাম দুলে দুলে হাসতে শুরু করল! বুতুরুন্নেসা স্কুলের কোনো মেয়ে কোনো দিন খোরাসানী ম্যাডামকে হাসতে দেখে নি, এখন হঠাৎ করে তার হাসি শুনে নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কেমন জানি শিউরে উঠে, তাদের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে, একজন মানুষের হাসি এরকম ভয়ংকর হতে পারে তারা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করতো না—হাসার সময় তার মুখটাও না জানি কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে!
শান্তা আপার উপর কী রকম আক্রমণ করা হবে ঠিক করার পর তার জন্যে মাস্তানদের কত টাকা দিতে হবে সেটা নিয়ে দরদাম করা শুরু হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল একেবারে মাছের বাজারে মানুষ যেভাবে দরদাম করে ঠিক সেই ভাবে দরদাম করা হল খোরাসানী মাঙামকে মনে হল এই লাইনে খুব অভিজ্ঞ, খুন করা জন্যে কত রেট, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে কত, রগ কেটে দেওয়ার জন্যে কত বা গাড়ি ভাংচুর করার জন্যে কত রেট সব তার একেবারে মুখস্ত। শুধু তাই না বছরের কোন সময় এবং কোন্ দলের কোন্ সরকার থাকলে সেই রেট কীভাবে বাড়ে কমে সেটাও খোরাসানী ম্যাডাম জানে। তাই মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে এক হাজার নগদ, দুই হাজার কাজ শেষ হবার পর) রাত নয়টার দিকে স্কুলের রাস্তার নির্জন অংশে শান্তা ম্যাডামকে আক্রমণ করে পায়ের হাটু ভেঙ্গে দেওয়ার একটা কন্ট্রাক্ট করে ফেলা হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিজের কানে না শুনলে এটা বিশ্বাস কত কী না সন্দেহ।
খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করেও কথা বলা যায় না তাই নিতু রেবেকা আর তনিয়ার অপেক্ষা করতে হল। খোরাসানী ম্যাডাম যখন টেলিফোনে হোস্টেলের চাউল সাপ্লয়ারের সাথে প্রতি কে জি চাউলের জন্যে তাকে কত টাকা ভাগ না দিলে সে অন্য সাপ্লায়ারের কাছে চলে যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে থাকল তখন তারা গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতে থাকে। নিতু বলল, শান্তা আপাকে বাঁচানোর জন্যে এক্ষুনি আমাদের যেতে হবে।
কীভাবে যাবি?
যখন টেলিফোনে কথা বলছে তখন বের হয়ে যাই।
কিন্তু–
কোনো কিন্তু নাই। তাড়াতাড়ি চল—
কিন্তু বের হতে হতে টেলিফোনে আলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা আবার খাটের নিচে আটকা পড়ে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম এবারে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, তার সমস্ত শরীরের ওজনে পুরো খাটটা মটমট করতে থাকে। নাড়া চাড়া করার সময় খোরাসানী ম্যাডাম মাঝে মাঝেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠেছিল এবং সাথে সাথে তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল, একজন মানুষ—বিশেষ করে মেয়ে মানুষ যে এরকম ভাষায় গালাগাল করতে পারে নিজের কানে না শুনলে ওরা বিশ্বাস করতে পারত না। খোরাসানী ম্যাডাম যদি জানত যারা তার এই দুরবস্থা করেছে তারা এই মুহূর্তে তার খাটের নিচে শুয়ে আছে তাহলে সে কী করত কে জানে!
এভাবে বেশ সময় কেটে গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া যখন খাটের নিচে আটকা পড়ে বের হতে না পেরে একেবারে অস্থির হয়ে গিয়েছে ঠিক তখন তারা পৃথিবীর মধুরতম শব্দটি শুনতে পেল, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে খোরাসানী ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়েছে, বাঁশির মতো তার নাক ডাকতে শুরু করেছে। মানুষের নাক ডাকার শব্দ যে এত ভালো লাগতে পারে সেটি তারা এর আগে কখনো কল্পনা করে নি।
তিনজন এবারে খুব সাবধানে খাটের নিচে থেকে বের হয়ে এল—যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া সম্ভব ছিল তাদের তার থেকে একটু বেশি সময় লাগল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। খাটের নিচে থেকে বের হওয়ার সময় তারা আবিষ্কার করল সেখানে যেসব জিনিস গাদাগাদি করে রাখা আছে তার মাঝে একটি হচ্ছে একটা বড় তেলের টিন। তারা সেটা খুলে পুরো তেলটুকু মেঝেতে ছড়িয়ে দিল। খোরাসানী ম্যাডাম যদি হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠে তাদের পিছু নিতে শুরু করে তাহলে তেলে পা পিছলে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরকে পালিয়ে যাবার জন্যে খানিকটা বাড়তি সময় দেবে? যদি পিছু নাও নেয় ঘুম থেকে উঠেও সে যদি খামোখা ধড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে হাত পা কিংবা মাথা ভেঙ্গে ফেলে তাদের কারো মনে এতটুকু দুঃখ হবে না।