১১. পরীবানুর ডাকনাম পরী

পরীবানুর ডাকনাম পরী।

তার জন্মের রাতে পরীবানুর দাদি স্বপ্নে দেখেন, একটা পরী তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। পরীর পাখার খোঁচায় তিনি খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি পরীকে বললেন, মা গো, তোমার পাখা দুইটা খুঁইল্যা ঘুমাও। পরী মেয়েটা দুঃখিত গলায় বলল, দাদি, আমার পাখা খোলার নিয়ম নাই। তখনি তাঁর ঘুম ভািঙল। তিনি বিছানায় উঠে বসে শুনলেন— বাড়িতে নানান হৈচৈ। তার ছেলের বউয়ের প্রসববেদনা উঠেছে। ধাই এসেছে। তিনি তার ছেলেকে ডেকে বললেন, তোর কন্যা-সন্তান হবে। কন্যা-সন্তানের নাম আমি দিলাম। পরীবানু। এই নামের ইতিহাস আছে। ইতিহাস আমি পরে বলব।

পরীবানু নামের ইতিহাস এই বৃদ্ধ যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনই বলে গেছেন। বাড়িতে ভিক্ষার জন্যে ভিনগায়ের ভিক্ষুক এলে তাকেও বলেছেন। পরীবানুকে তিনি যে আদর করেছেন তারও কোনো তুলনা নেই। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই মেয়েকে মারা তো দূরের কথা, কেউ কোনোদিন ধমকও দিতে পারবে না। যদি দেখেন কোনো কারণে এই মেয়ের চোখে পানি এসেছে, তাহলে তিনি বাড়িঘর ছেলে চলে যাবেন।

সত্যিকার ভালোবাসা দুদিকেই প্রবাহিত হয়। পরীবানুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তার জগৎ ছিল দাদিময়। ঘরে কোনো ভালো জিনিস রান্না হলে দাদি মুখে না দেয়া পর্যন্ত সে মুখে দেবে না। ঈদের সময় সবার আগে তার দাদির জন্যে নতুন শাড়ি কিনতে হবে।

দাদির মৃত্যুর সময় পরীবানুর বয়স ছয় বছর। সে তার দাদির মৃত্যু সহজভাবেই নিল। খুব সম্ভবত মৃত্যুবিষয়ক ধারণা তার দাদি আগেভাগে তাকে দিয়ে রেখেছিলেন। তবে তার পরিবর্তন যেটা হলো তা হচ্ছে–যখন-তখন দাদির কবরের কাছে চলে যাওয়া। কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলা—

আইজ কী ঘটনা ঘটেছে জানো দাদি? হাসির ঘটনা। ঘটনা শুনলে হাসতে হাসতে তোমার পেট-বেদনা হবে। হিহিহি…

পরীবানুর বয়স এখন পনেরো।

সে খুবই বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। শুধু দাদির বিষয়ে তার বুদ্ধি কাজ করে না। এখনো সে দাদির কবরের কাছে যায়। মাথা নিচু করে মৃত দাদির সঙ্গে একতরফা গল্প করে।

বউ হিসেবে বড় বাড়িতে রওনা হবার ঠিক আগে আগে সে গিয়েছে দাদির কবরের কাছে। বাঁধানো কবরের গায়ে হাত রেখে চাপা গলায় বলেছে–দাদি গো, খা বাড়িতে যাইতেছি। আর কোনোদিন এইখানে আসতে পারব বইল্যা মনে হয় না। এই পর্যন্ত বলেই সে প্রতিজ্ঞা ভুলে অনেকক্ষণ কাঁদল। দাদির সঙ্গে সে প্ৰতিজ্ঞা করেছিল যত দুঃখ-কষ্টই হোক সে কোনোদিন কান্দবে না। বেশির ভাগ প্রতিজ্ঞাই মানুষ রাখতে পারে না।

নতুন বউ স্বামীর বাড়িতে কাঁদতে কাঁদতে যায়। পরীবানু কান্দল না। পালকি থেকে নামল। যখন জলচৌকিতে উঠে দাড়াতে বলল, সে দাঁড়াল। একজন মহিলা তার পায়ে দুধ ঢেলে দিল। এই মহিলা তার শাশুড়ি। মহিলার মাথার ঠিক নেই। তাকে নাকি সবসময় ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। পরীবানু খুব আগ্রহ করে মহিলাকে দেখল। তাকে মোটেই অস্বাভাবিক বলে মনে হলো না। সে তার শ্বশুরকে কোথাও দেখল না। নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে এসে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সালাম করবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে শ্বশুরের সঙ্গে তার দেখা হবে না— এটা সে ধরেই নিয়েছিল। তার পরেও ক্ষীণ আশা ছিল— হয়তো এ– বাড়ির সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে কোনো সমস্যারই সমাধান হয় নি। সব সমস্যার সমাধান তাকে করতে হবে। কেউ কি তাকে সাহায্য করবে? লীলা নামের মেয়েটা হয়তো করবে। তবে মেয়েটা তার খুব কাছে আসছে না। দূরে দূরে থাকছে।

মাগরিবের নামাজের পর লীলার সঙ্গে তার প্রথম কথা হলো। সে বড় একটা ঘরের পালঙ্কের উপর একা বসেছিল। শ্বশুরবাড়িতে পা দেবার পর কোনো মেয়েই সন্ধ্যারাতে একা বসে থাকে না। তাকে রাজ্যের মানুষ ঘিরে থাকে। অথচ সে বসে আছে একা। একসময় যখন তার মনে হলো, তাকে এই পালঙ্কে একা বসে থাকতে হবে কেউ তার পাশে আসবে না, তখন লীলা হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢুকল। তার পাশে বসতে বসতে বলল, এটা চিনির শরবত না, লবণের শরবত। লেবু, কাঁচামরিচ। আর লবণ দিয়ে বানানো শরবত। আমার ধারণা আজ সারাদিন তোমার উপর দিয়ে অনেক চাপ গিয়েছে। শরবতটা খাও, দেখবে ভালো লাগবে।

নতুন বউয়ের অনেক নিয়মকানুন আছে। শরবত খাও বললেই কোনো নতুন বউ হাত থেকে টান দিয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে ঢাকচক করে খেয়ে ফেলে না। নতুন বাউদের সাধ্যসাধনা করে খাওয়াতে হয়। পরী সহজভাবেই হাতে গ্লাস নিল। লেবুর শরবতটা খেতে তার ভালো লাগল।

লীলা বলল, তোমার কি মাথাব্যথা করছে?

পরীবানু বলল, না।

তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় তোমার মাথাব্যথা।

পরীবানু বলল, হ্যাঁ, আমার মাথাব্যথা।

লীলা বলল, আমার কাছে কিছু গোপন করবে না। আমার কাছে কেউ কিছু গোপন করলে আমার ভালো লাগে না।

পরী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

লীলা বলল, তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?

পরী সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি।

লীলা বলল, রান্না হয়ে গেছে। আমরা দুজন একসঙ্গে খেয়ে নেব। ক্ষুধার কারণে অনেক সময় মাথা ধরে।

পরী বলল, আমি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দুটা কথা বলব।

মাসুদের সঙ্গে কথা বলতে চাও?

জি।

ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তুমি তো জানোই বাবা কেমন রাগী মানুষ, উনি মাসুদকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন। বাবার রাগ কমার সময় দিতে হবে।

উনার রাগ কমবে?

নিজ থেকে কমবে না। কমাবার চেষ্টা করতে হবে। আমি চেষ্টা করব। তুমিও চেষ্টা করবে।

আমি কীভাবে চেষ্টা করব?

সেটা ভেবে ঠিক করা হবে।

লীলা পরীবানুর সঙ্গে কথা বলে অবাক হয়েছে। মেয়েটা গ্রামের মেয়েদের মতো কথা বলছে না। মোটামুটি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করছে। মেয়েটিকে লীলার বুদ্ধিমতী বলেও মনে হচ্ছে। মেয়েটা এই বাড়ির ব্যাপারগুলি বোঝার চেষ্টা করছে। যে-পরিস্থিতিতে মেয়েটা এসেছে সেই পরিস্থিতিতে পড়লে সব মেয়েই হাল ছেড়ে দেবে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে। কোনোকিছু বোঝার চেষ্টা করবে লীলা বলল, তুমি কি শহরে কিছুদিন ছিলে?

পরী বলল, জি। আমি ময়মনসিংহে থাকি। বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়ি। ছুটিতে বাড়িতে আসি।

কোন ক্লাসে পড়ো?

এবার ম্যাট্রিক দিব।

তোমার সঙ্গে মাসুদের পরিচয় কোথায় হয়েছে? ময়মনসিংহে?

জি না। আমাদের বাড়িতে। উনি বাবার কাছে গান শুনতে আসতেন।

তুমি গান জানো?

জি না।

লীলা বলল, তুমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো। রান্না হয়ে গেলেই আমি তোমাকে নিয়ে খেতে বসব।

পরী কিছু বলল না। তবে লীলার কথামতো কুণ্ডলি পাকিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে নতুন বউ ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখল তার দাদিকে। দাদি খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ হাসি-হাসি। তিনি বললেন, তোর শ্বশুরবাড়ি দেখতে আসছি। খুশি হয়েছি। এদের বিরাট শান-শওকত। তবে মানুষজন নাই। ঘরবাড়ি জিনিসপত্র দিয়া শান-শওকত হয় না। শান-শওকত হয় মানুষজন দিয়া। তুই একলা শুয়ে আছিস। তোর জামাই কই?

পরী হাসতে হাসতে বলল, তারে তালাবদ্ধ করে রেখেছে।

কী জন্যে?

জানি না।

তালাবদ্ধ কে করছে?

আমার শ্বশুর সাহেব করেছেন।

এই লোকের দেখি স্বভাব ভালো না! সবেরে তালাবদ্ধ করে রাখে। নিজের স্ত্রীকেও শুনেছি তালাবন্ধ করে রেখেছে।

বেশিক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকবা না দাদি। শেষে তোমারেও তালাবন্ধ করবে।

আমারে তালাবন্ধ করে করুক, তোর জামাইরে কেন করবে? যা তারে ছুটিয়ে নিয়ে আয়।

কীভাবে ছুটায়ে আনব? আমার কাছে চাবি নাই।

চাবি আমি নিয়া আসছি। এই নে।

বৃদ্ধ বড় একটা পিতলের চাবি পরীর হাতে দিলেন। পরী সেই চাবি সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলল। তখনি তার ঘুম ভাঙল। স্বপ্নটা এত বাস্তব ছিল যে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে পরী শাড়ির আঁচল ঘুরেফিরে দেখল। রাত কত হয়েছে পরা বুঝতে পারছে না। কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই। মনে হচ্ছে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িটাও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের নিজেদের বাড়ির অবস্থা অন্যরকম। সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন আসতে থাকে। রাত একটু বাড়ার পর ঢোলের বাড়ি পড়তে শুরু করে। মাঝরাতে শুরু হয়। গানের আসার। বন্দনা দিয়ে শুরু হয়–

পশ্চিমে বন্দনা করি সোনার মদিনা
ঝলমল ঝলমল ঝলমল ঝলমল
সোনার মদিনা…

লীলা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পরীকে চমকে গিয়ে বলল, ঘুম ভেঙেছে?

পরী বলল, জি।

রান্না হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ঘুম ভাঙাই নি। এসো খেতে বসি। মাথা ধরা এখনো আছে?

না।

বাবা-মা, ভাই-বোনদের জন্য মনখারাপ লাগছে?

না।

মনখারাপ লাগছে না কেন?

জানি না।

খাওয়ার আয়োজন ভেতরের বারান্দায়। পোলাও-কোরমা, মাছভাজি–অনেক আয়োজন। পরী কিছুই খেতে পারছে না। হাত দিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে। লীলা বলল, খেতে পারছ না?

পরী বলল, না। আপনি খান। আমি বসে থাকি।

লীলা কিছুক্ষণ পরীর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, পরী, তোমার কি সন্তান হবে?

পরী বলল, হ্যাঁ।

বিয়েটা কি এইজন্যই তাড়াহুড়া করে গোপনে করে ফেলেছ?

পরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

লীলা বলল, কয় মাস কী, এইসব হিসাব কি তোমার আছে?

পরী বলল, হিসাব আছে। তিন মাস।

লীলা বলল, তোমরা দু’জন যে বিরাট একটা অন্যায় করেছ, এটা কি জানো?

আমি কোনো অন্যায় করি নাই। আপনি কাউকে বলেন, শুকনা মরিচের ভর্তা বানিয়ে আমাকে দিতে। মরিচভর্তা ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে আমি ভাত খেতে পারি না।

লীলা পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরী বসে আছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তাকিয়ে আছে লীলার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো অস্বস্তি নেই।

 

রাতের খাবারের পরপরই সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। লোকমান হুক্কার নল তার হাতে ধরিয়ে দিল। তিনি ঘুমের ঘোরে। দুটা টান দিলেন। তার মনে হলো নল-হাতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়বেন। এই লক্ষণ ভালো না। এই লক্ষণ বার্ধক্য এবং স্থবিরতার লক্ষণ। স্থবির মানুষরাই মুখভর্তি পান নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হুঙ্কার নল হাতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সিদ্দিকুর রহমান ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করলেন। ঘুমটা যাচ্ছে না। আবারো যেন চেপে আসছে। জটিল কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করলে কিংবা কারো সঙ্গে জটিল আলোচনা করলে ঘুমটা হয়তো কাটবে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, লোকমান!

লোকমান তার ইজিচেয়ারের পেছনে বসেছিল। সেখান থেকে জবাব দিল— জি চাচাজি?

মাস্টারের খবর কী?

উনি ভালো আছেন। আজ সারাদিনে জ্বর আসে নাই।

উনারে ডেকে নিয়ে আসো।

জি আচ্ছা। সিদ্দিকুর রহমান ঘুমিয়ে পড়তে চান না। এখন ঘুমিয়ে পড়া মানে রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা। খাটে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা। সাপে-কাটা রোগীকে কিছুতেই ঘুমাতে দেয়া হয় না। তিনি কল্পনা করছেন চার-পাঁচ হাত লম্বা কালো একটা চন্দ্ৰবোড়া সাপ তার পায়ে ছোবল দিয়েছে। ওঝা এসে বিষ ঝাড়বে। বিষ না নামানো পর্যন্ত তাকে জেগে থাকতে হবে।

 

আমাকে ডেকেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, জলচৌকিটার উপর বসো।

আনিস বসল। সিদ্দিকুর রহমান হঠাৎ লক্ষ করলেন, তার ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। তিনি সামান্যতম আলস্যও বোধ করছেন না। তার শরীর ঝনঝন করছে।

মাস্টার, কেমন আছ?

জি ভালো।

তুমি তো আমাদের মোটামুটি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। ভালো কথা, তুমি গায়ে সেন্ট মেখেছ না-কি? সেন্টের গন্ধ পাচ্ছি।

আনিস লজ্জিত গলায় বলল, পাঞ্জাবির পকেটে কয়েকটা আমের মুকুল রেখেছি। আমের মুকুলের গন্ধ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছ? ফুল যতক্ষণ গাছে থাকে তখন তার একরকম গন্ধ, যেই তুমি ফুল ছিড়ে হাতে নিবে তখনি তার অন্যরকম গন্ধ।

ব্যাপারটা আমি লক্ষ করি নাই।

লক্ষ করে দেখবে। কিছু-কিছু ফুলগাছ আছে যাদের শেকড়ের গন্ধও ফুলের গন্ধের মতো।

আমি আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। আগে কোনোদিন শুনি নাই।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এমন অনেক কথাই তোমাকে বলতে পারি যেটা তুমি আগে কখনো শোনো নাই। বলার মতো মানুষ পাই না বলে বলি না। সব কথা সবাইকে বলা ঠিক না। মাস্টার, খাওয়াদাওয়া করেছ?

জি করেছি।

আজ আমার বাড়িতে ছেলের বউ প্রথম এসেছে। খাওয়াদাওয়ার বিরাট আয়োজন করা উচিত ছিল। আয়োজন করা হয় নাই। মনে রাগ নিয়া উৎসবের আয়োজন করা যায় না।

রাগটা কী জন্যে? আপনাকে না জানিয়ে ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে এই জন্যে? এটা রাগ করার মতো কোনো কারণ না।

সিদ্দিকুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, এটা রাগ করার মতো কারণ না?

আনিস বলল, জি-না। কোনো কারণ না। বিয়েটা সম্পূর্ণ আপনার ছেলের নিজের ব্যাপার। সে তার নিজের সংসার করবে। সেই সংসারে আপনি কে?

আমি কেউ না?

জি না। আপনি কেউ না। মাসুদের সংসার মাসুদের। আপনারটা আপনার।

আনিস জলচৌকিতে বসতে বসতে বলল, আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন মাসুদের বিষয়ে দুএকটা কথা বলব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অনুমতি দিলাম না।

সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নলে টান দিতে লাগলেন। আগুন নিভে গেছে, নলে টান দিলে গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হয়। শব্দটা শুনতে ভালো লাগে। মনে হয় তিনি কোনো–একটা কাজের মধ্যে আছেন।

মাস্টার!

জি?

তোমার একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি। তুমি কোনো-না-কোনোভাবে আমার সঙ্গে তর্ক বাঁধায়ে দিতে চাও। কোনো-একটা বিষয়ে তুমি আমার সঙ্গে একমত হয়েছ এরকম মনে হয় না।

আনিস নিচু গলায় বলল, তার কারণ হয়তো এই যে, আপনি যে-মতের জগতে বাস করেন আমি সেই জগতে বাস করি না। আজ আপনার বাড়িতে ছেলের বউ এসেছে। এই উপলক্ষে সবাই নতুন কাপড় পেয়েছে। আমিও একটা পাঞ্জাবি পেয়েছি। অথচ এই আনন্দের দিনে আপনি আপনার ছেলেটাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন।

এই ছেলে তোমার হলে তুমি তাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে?

তা করতাম না। কিন্তু তাকে তালাবন্ধ করেও রাখতাম না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি আমার ছেলের বিষয়ে পরামর্শ করার জন্যে তোমাকে ডাকি নাই। যে-কারণে ডেকেছি সেটা মন দিয়ে শোনো।

আনিস কৌতূহলী হয়ে বলল, কী কারণে ডেকেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি একটা আশ্রম বানাতে চাই।

আনিস বলল, আপনি কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। কী বানাতে চান?

আশ্রম বানাতে চাই।

আশ্রম বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন? অর্থটা পরিষ্কার হচ্ছে না। যেখানে আশ্রয় আছে সেটাই আশ্রম। আশ্রয় তো আপনার আছে।

সিদ্দিকুর রহমান আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন, লোকমান টিক্কায় আগুন ধরিয়ে নতুন তামাক দিয়েছে। এই আম্বরী তামাকের বিশেষত্ব হলো— প্রথম কিছুক্ষণ খুব সুন্দর গন্ধ থাকে। তারপর হঠাৎ গন্ধটা মরে যায়। তিনি তামাক টানেন গন্ধ মরে না যাওয়া পর্যন্ত। এখন তামাকে টান দিলেন না। মাস্টারের দিকে তাকিয়ে খানিকটা লজ্জিত গলায় বললেন, আশ্রম বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছি সেটা আমিও জানি না।

আপনার কল্পনায় কী আছে?

আমার কল্পনায় আছে খুব সুন্দর একটা জায়গা। চারদিকে গাছ। চেনা অচেনা গাছ। পানির ঝরনা। অতি নির্জন। কোনো লোকজন নাই। চারদিকে শান্তি।

এরকম একটা জায়গার কথা আপনার মাথায় কী জন্যে এসেছে সেটা কি জানেন?

একটা বইয়ে এরকম পড়েছিলাম। পড়াটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে।

বইটার নাম কী? লেখকের নাম কী?

কিছুই মনে নাই। বইটার ঘটনাও মনে নাই। যেটা মনে আছে সেটা হলো— একটা মানুষ আশ্রমে থাকে। মহাশান্তির মধ্যে বাস করে। পাহাড়ি একটা ঝরনা আছে। ঝরনার পানি টলটলা নীল। ঝরনা যেখানে পড়েছে সেখানে পানি জমেছে। মানুষটা নগ্ন হয়ে সেই পানিতে সাঁতার কাটে। এইটুকু মনে আছে। আর কিছু মনে নাই।

আনিস বলল, আপনি আশ্রম কী জন্যে বানাতে চান, নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটার জন্যে?

কথাটা বলেই আনিসের মনে হলো, সে খুবই অসৌজন্যমূলক কথা মানুষটাকে বলেছে। তার কথার মধ্যে ঠাট্টার ভাব প্রবল। এমন একজন বুদ্ধিমান মানুষ ঠাট্টা বুঝবেন না তা হয় না। কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে এবং তিনি তা সহ্য করে যাবেন তা কখনো হবে না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করেছ। রসিকতাটা আমি গায়ে মাখলাম না। কারণ ঐ বইটার মানুষটা শুধু যে সাঁতারের সময় নগ্ন থাকতেন তা না। সারাক্ষণই নগ্ন থাকতেন। কে তাকে নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কারণ তিনি বাস করতেন সম্পূর্ণ তার নিজের অঞ্চলে। কেউ সেখানে ঢুকতে পারত না।

আপনি এরকম একটা জায়গা বানাতে চান?

হ্যাঁ। আমি অনেকখানি জমি কিনেছি। এই বিষয়ে তোমার মতামত কী?

আনিস বলল, আমি কোনো মতামত দিতে পারছি না। কারণ আপনি কী বলার চেষ্টা করছেন আমি বুঝতে পারছি না। ভাসাভাসা ঘটনা শুনে ভাসাভাসা মত দেয়া যায়।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার ভাসাভাসা মতটা কী?

আনিস বলল, আমার ভাসাভাসা মতটা হলো, আপনার শরীরটা ভালো না। আপনি অসুস্থ। আপনার ভেতর মৃত্যুচিন্তা ঢুকে গেছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মাস্টার, আমার মৃত্যুচিন্তা আছে। ভয় নাই। জীবনে একবার বিরাট ভয় পেয়েছিলাম। সেই ভয় আরো একবার পাব। এর বাইরে ভয় পাব না।

কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

সেটা তোমাকে বলব না। আচ্ছা তুমি এখন যাও। এখন আর কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না।

কথা বলার দরকার নাই। দুজন চুপচাপ বসে থাকি।

আচ্ছা থাকো বসে।

কুঁজা মাস্টার বসে আছে। সিদ্দিকুর রহমান হঠাৎ ব্যাপারটায় মজা পেয়ে গেলেন। দেখা যাক মাস্টার কতক্ষণ বসে থাকতে পারে। একটা ধৈর্যের খেলা হয়ে যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *