পরিশিষ্ট
প্রাক আধুনিক রক্ষণশীল আমলে আমাদের পূর্বপুরুষের মতো আমরা ধার্মিক হতে পারব না, তখন ধর্মবিশ্বাসের মিথ ও আচার মানুষকে কৃষি ভিত্তিক সভ্যতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করেছে। এখন আমরা ভবিষ্যৎমুখী, এবং আমাদের ভেতর যারা আধুনিক বিশ্বের যুক্তিবাদে গড়ে উঠেছি তাদের পক্ষে আর প্রাচীন ধরনের আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা নিউটনের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নই, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণই বৈজ্ঞানিক চেতনায় পরিপূর্ণ পাশ্চাত্য বিশ্বের অন্যতম পথিকৃত। মিথলজি উপলব্ধি তাঁর কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে। আমরা প্রচলিত ধর্মকে আপন করে নেওয়ার যত চেষ্টাই করি না কেন, সত্যকে বাস্তব, ঐতিহাসিক এবং প্রয়োগযোগ্য হিসাবে দেখার স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে আমাদের। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্বের সাথে নিতে হলে এর মিথসমূহকে অবশ্যই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণযোগ্য হতে হবে ও আধুনিকতার প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বাস্তবক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করতে সক্ষম হতে হবে। বিশেষ করে ইউরোপে বিংশ শতাব্দীতে এমন ট্র্যাজিডি মোকাবিলাকারী বর্ধিত সংখ্যক মানুষ ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তিকে যারা সত্য প্রকাশ করার একমাত্র পথ হিসাবে দেখে, তাদের পক্ষে এটা নৈতিক ও সৎ অবস্থান। বিজ্ঞানীরা যেমন প্রথম জোরের সাথে বলবেন, যৌক্তিক লোগোস প্রায়োগিক অনুসন্ধানের অতীতে অবস্থানরত চরম অর্থ সংক্রান্ত কোনও জবাব দিতে পারে না। আমাদের শতকের গণহত্যামূলক আতঙ্কের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুক্তির কিছুই বলার থাকে না।
সুতরাং আধুনিক সংস্কৃতির কেন্দ্রে এক শূন্যতা বিরাজ করছে, পশ্চিমা মানুষ তাদের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের গোড়ার দিকে যাকে অনুভব করেছিল। মহাবিশ্বের শূন্যতা বুঝতে পেরে ভীতিতে কুকড়ে গেছেন পাসকাল; মানুষকে এই জড় মহাবিশ্বের একমাত্র অধিবাসী হিসাবে দেখেছেন দেকার্তে; হবস কল্পনা করেছেন ঈশ্বর মহাবিশ্ব থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন; নিৎশে ঈশ্বরের প্রয়াণ ঘোষণা করেছেন: মানবজাতি দিশা হারিয়েছে ও এক অসীম শূন্যতায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু অন্যরা ধর্মের বিদায়ে নিজেদের মুক্ত ভেবেছেন; ধর্মের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছেন। আধুনিক চেতনায় ঈশ্বর আকৃতির গহ্বরের অস্তিত্বের কথা স্বীকারকারী সার্ত্র যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমাদের মুক্তিকে নাকচকারী উপাস্যকে অস্বীকার করা এখনও আমাদের দায়িত্ব রয়ে গেছে। আলবার্তো কামু (১৯১৩-৬০) বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর প্রত্যাখ্যান নারী-পুরুষকে মানবজাতির প্রতি তাদের সকল মনোযোগ ও ভালোবাসা নিবদ্ধ করতে সক্ষম করে তুলবে। অন্যরা তাদের বিশ্বাসকে আলোকনের প্রতি নিবদ্ধ করেছেন, এমন ভবিষ্যতের কথা ভেবেছেন যেখানে মানবজাতি আরও যৌক্তিক ও সহিষ্ণু হয়ে উঠবে; এক দূরবর্তী কাল্পনিক ঈশ্বরের বদলে ব্যক্তির পবিত্র স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করবে। তাদের জন্যে অন্তর্দৃষ্টি, দুর্ভেয়তা আর পরমানন্দ নিয়ে আসা আধ্যাত্মিকতার সেক্যুলার ধরন গড়ে তুলেছেন তাঁরা, যা তাঁদের আত্মা ও মনের নিজস্ব শৃঙ্খলা গড়ে তুলেছে।
তাসত্ত্বেও এক বিশাল সংখ্যক মানুষ এখনও ধার্মিক হতে চায় ও বিশ্বাসের নতুন ধরন গড়ে তুলতে চেয়েছে তারা। মৌলবাদ ঠিক তেমনি আধুনিক ধর্মীয় পরীক্ষার অন্যতম নজীর। আমরা যেমন দেখেছি, এটা ধর্মকে আন্তর্জাতিক এজেন্ডার একেবারে কেন্দ্রে স্থাপন করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রার সাফল্য ভোগ করেছে। কিন্তু প্রায়শঃই তা কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসের বিশেষ কিছু পবিত্ৰ মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে। মৌলবাদীরা ডগমাসমূহকে বৈজ্ঞানিকভাবে সত্যি দাবি করে অথবা তাদের জটিল মিথলজিকে কঠোর আদর্শে পরিণত করে ধর্মের মিথোসকে লোগোসে পরিণত করেছে। এভাবে তারা জ্ঞানের দুটি পারস্পরিক সম্পূরক উৎস ও ধরনকে গুলিয়ে ফেলেছে, প্রাক আধুনিক মানুষ যাকে সাধারণত বিচ্ছিন্ন রাখাই শ্রেয়তর বলে স্থির করত। মৌলবাদী অভিজ্ঞতা এই রক্ষণশীল দর্শনের সত্যি তুলে ধরেছে। ক্রিশ্চানিটির সত্যিগুলো বাস্তব ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য বলে জোর দিয়ে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা ধর্ম ও বিজ্ঞানের এক ক্যারিকেচার সৃষ্টি করেছে। যেসব ইহুদি ও মুসলিম অন্য সেক্যুলার আদর্শের সাথে পাল্লা দিতে তাদের ধর্মকে যুক্তিভিত্তিক, পদ্ধতিগতভাবে উপস্থাপন করেছে তারাও তাদের ঐতিহ্যকে বিকৃত করেছে, নিষ্ঠুর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে একক বিন্দুতে এনে ঠেকিয়েছে। ফলে সবাই আরও সহিষ্ণু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহানুভূতিশীল শিক্ষাকে অবহেলা করেছে এবং ক্রোধ, অসন্তোষ ও প্রতিশোধের ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছে। ক্ষেত্র ভেদে এটা এমনকি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু হত্যাকে অনুমোদন দানের কাজে ধর্মকে ব্যবহার করে বিকৃতও করেছে। এমনকি এই ধরনের সন্ত্রাসের বিরোধিতাকারী মৌলবাদীদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকেও তাদের মতের সাথে যারা একমত পোষণ করে না তাদের বেলায় বর্জনবাদী ও নিন্দুক প্রবণ হতে দেখা যায়।
কিন্তু মৌলবাদী হিংস্রতা আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির মানুষের উপর চরম কঠিন চাহিদা আরোপ করার কথা মনে করিয়ে দেয়। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের ক্ষমতাবান করেছে, আমাদের দিগন্ত প্রসারিত করেছে এবং আমাদের অনেককেই আরও সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে সক্ষম করে তুলেছে। কিন্তু তারপরেও এটা প্রায়শঃই আমাদের আত্মঅহমকে ভোঁতা করে দিয়েছে। কিন্তু একই সময়ে আমাদের যৌক্তিক বিশ্বদৃষ্টি মানুষই সকল বস্তুর মানদণ্ড ঘোষণা করে একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপর অশোভন নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিলেও পাশাপাশি আমাদের নাজুকতা, আক্রম্যতা আর মর্যাদার ঘাটতিও তুলে ধরেছে। কোপার্নিকাস আমাদের মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত করে প্রান্তিক ভুমিকায় অবনত করেছিলেন। কান্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, আমাদের ধারণা আমাদের মাথার বাইরের বাস্তবতার সাথে মেলে কিনা সে ব্যাপারে আমরা কখনওই নিশ্চিত হতে পারব না। ডারউইন বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা পশুমাত্র; এবং ফ্রয়েড দেখিয়েছেন যে, সম্পূর্ণ যৌক্তিক প্রাণী হওয়া দূরে থাক, মানুষ আসলে অবেচতনের শক্তিশালী, অযৌক্তিক শক্তির করুণাধীনমাত্র, কেবল অনেক প্রয়াসের মাধ্যমেই যার নাগাল পাওয়া সম্ভব। প্রকৃতপক্ষেই এটা আধুনিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তির কাল্ট সত্ত্বেও আধুনিক ইতিহাস ডাইনী শিকার ও বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, এসব ছিল যুক্তিহীনতার বিস্ফোরণ। একসময় সেরা রক্ষণশীল ধর্মের প্রাচীন মিথ, লিটার্জি ও অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের যোগানো মননের গভীর কন্দরে পৌঁছানোর ক্ষমতা বাদে যুক্তি অনেক সময় আমাদের সাহসী নতুন বিশ্বে দিশা হারিয়ে ফেলে বলে মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষে মানবজাতির দিকে আগের চেয়ে বেশি আলোকিত ও সহিষ্ণু পর্যায়ে অগ্রসর হওয়ার উদার মিথ এই গ্রন্থে বিবেচিত অন্য যেকোনও মিলেনিয়াল মিথের চেয়ে ফ্যান্টাস্টিক মনে হচ্ছে। ‘উচ্চতর’ মিথিকাল সত্যির বন্ধন ছাড়া যুক্তি অনেক সময় দানবীয় হয়ে উঠতে পারে ও এমন সব অপরাধ সংগঠিত করতে পারে যেগুলো মৌলবাদীদের হাতে সংগঠিত যেকোনও নিষ্ঠুরতার চেয়ে বড় না হলেও কাছাকাছি।
আধুনিকতা সুবিধাজনক, উদার ও মানবিক ছিল, কিন্তু প্রায়শঃই এটা বিশেষ করে গোড়ার দিকে নিষ্ঠুর হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে। বিশেষ করে আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে আগ্রাসী, সাম্রাজ্যবাদী ও অচেনা মনে করা উন্নতশীল দেশে এটা বেশি সত্যি ছিল। আমাদের বিবেচিত মুসলিম দেশগুলোতে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া খুবই কষ্টকর ও ভিন্ন ছিল। পশ্চিমে এটা স্বাধীনতা ও উদ্ভাবনে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছে; মিশর ও ইরানে এর সাথে পরনির্ভরতা ও অনুকরণ জড়িত ছিল, মুসলিম সংস্কারক ও আদর্শবাদীগণ সূক্ষ্মভাবে এ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। এইসব দেশে তা আধুনিকতার সুর পল্টে দেবে। আপনি ভুল উপাদানে (টাটকা ডিমের বদলে শুকনো ডিম, ময়দার বদলে চাল) আর ভুল সরঞ্জাম দিয়ে কেক বানাতে গেলে পরিণতি রান্নার বইয়ের ফলের সাথে মিলবে না; সেটা মজাদার হতে পারে, কিন্তু আবার দারুণ নোংরাও হতে পারে। স্থানীয় জ্ঞান ও রান্নার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে হাতের কাছে প্রাপ্য উপাদান ও কৌশল ব্যবহার করে রীতির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করাই অনেক ভালো। আফগানি, আব্দুহ, শরিয়তি এবং খোমেনির মতো ইসলামিস্টগণ তাদের নিজস্ব ও ভিন্ন কেক বানাতে মুসলিম উপাদান ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিতে ভাবতে পারছিল না এমন কোনও কোনও পশ্চিমার পক্ষে বিশেষ করে সহিংস ও নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশকারী ধর্মের এই পুনর্জাগরণ উপলব্ধি কঠিন ছিল। আধুনিক সমাজ ঘনঘন ‘দুটি জাতিতে’ বিভক্ত হয়েছে: সেক্যুলারিস্ট ও ধার্মিক একই দেশে বাস করেও পরস্পরের ভাষায় কথা বলতে পারেনি বা একই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিস্থিতি দেখতে পারেনি। এক পক্ষের কাছে যাকে পবিত্র ও ইতিবাচক মনে হয়েছে অন্য পক্ষ তাকে দানবীয় ও পরিহাসের সাথে দেখেছে। সেক্যুলারিস্ট ও ধার্মিক, দুই পক্ষই পরস্পরের কারণে নিজেদের গভীরভাবে হুমকির মুখে মনে করেছে, এবং দুটি সম্পূর্ণ সমন্বয়ের অতীত বিশ্বদৃষ্টির সংঘাত লাগলে, সালমান রূশদির ক্ষেত্রে যেমন, বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে। এটা অস্বাস্থ্যকর ও সহজাতভাবে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। মৌলবাদ বিদায় নিচ্ছে না। কোনও কোনও স্থানে তা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে বা আরও চরম রূপ ধারণ করছে। উদার সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান সেতু তৈরি করার লক্ষ্যে ও ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়াতে কী করতে পারে?’
দমন ও নির্যাতন স্পষ্টতই জবাব নয়। তা অনিবার্যভাবে পাল্টা আক্রমণ ডেকে আনে। মৌলবাদী ও সম্ভাব্য মৌলবাদীদের আরও চরম করে তুলতে পারে। স্কোপস ট্রায়ালে অপদস্থ হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা আরও প্রতিক্রিয়াশীল, আপোসহীন ও আক্ষরবাদী হয়ে উঠেছিল। নাসেরের নির্যাতন শিবিরে সুন্নি মৌলবাদের চরমপন্থী ধরন আবির্ভূত হয়েছে এবং শাহর ক্র্যাকডাউন ইসলামি বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য করেছে। মৌলবাদ এক যুদ্ধংদেহী ধর্মবিশ্বাস; অত্যাসন্ন বিনাশ আশঙ্কা করে থাকে। এটা বিস্ময়কর নয় যে, ইহুদি মৌলবাদীরা, তা সে যায়নবাদী বা আল্ট্রা-অর্থডক্স, যাই হোক, এখনও হলোকাস্টের ভীতি ও অ্যান্টি-সেমিটিক বিপর্যয়ের ভীতিতে তাড়িত হয়। সেক্যুলারাইজেশনকে যারা আগ্রাসী হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে নির্যাতন তাদের আত্মায় গভীর দাগ ফেলেছে ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করেছে, একে এভাবে সহিংস ও অসহিষ্ণু করে তুলেছে। মৌলবাদীরা সর্বত্র ষড়যন্ত্র দেখে ও অনেক সময় এমন ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যাকে দানবীয় মনে হয়।
এবং এখনও সেক্যুলার, বাস্তব উদ্দেশ্যে মৌলবাদকে ব্যবহার করার প্রয়াসও উল্টো ফলদায়ী। সাদাত তাঁর শাসনকে বৈধতা দিতে মিশরের মুসলিমদের তোয়াজ — করেছেন, নিজের শাসনের ভিত্তি গড়ে তুলতে জামাত আল-ইসলামিয়াহর সমর্থন আদায়ের প্রয়াস পেয়েছেন। পিএলও-কে খাট করার প্রয়াসে ইসরায়েল প্রাথমিকভাবে হামাসকে সমর্থন দিয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস করুণ ও মারাত্মকভাবে সেক্যুলারিস্ট রাষ্ট্রের উপর পাল্টা আঘাত হেনেছে। এই ধর্মীয় আন্দোলনসমূহের আরও ন্যায্য ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে।
প্রথমত, এটা শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই ধর্মতত্ত্ব ও আদর্শগুলো ভীতিতে প্রোথিত। মতবাদ সংজ্ঞায়িত করার আকাঙ্ক্ষা, প্রতিবন্ধক সৃষ্টি, সীমানা স্থাপন, আইন কোঠরভাবে পালন করা যাবে এমন এক পবিত্র ছিটমহলে বিশ্বাসীদের বিচ্ছিন্ন করার বিষয়গুলো নিশ্চিহ্নতার ভীতি থেকে উদ্ভুত হয়, যা সকল মৌলবাদীকে এক সময় না এক সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে সেক্যুলারিস্টরা তাদের নিশ্চিহ্ন করতে ক্ষেপে উঠেছে। আধুনিক বিশ্ব, যাকে উদারপন্থীদের কাছে দারুণ উত্তেজনাকর ঠেকে, মৌলবাদীদের কাছে তাকেই ঈশ্বরবিহীন, সকল অর্থ হতে বঞ্চিত এবং এমনকি শয়তানিসুলভ মনে হয়। কোনও রোগী এই ধরনের প্যারানয়েড, ষড়যন্ত্রে ভরা ও প্রতিশোধ প্রবণ ফ্যান্টাসিসহ কোনও থেরাপিস্টের কাছে এলে নিঃসন্দেহে তিনি তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে শনাক্ত করবেন। আধুনিকতার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের চোখে দানবীয় প্রিমিলেনিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি গণহত্যামূলক স্বপ্ন লালন করে ও মানবজাতি এক ভয়ানক সমাপ্তির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে বলে কল্পনা করে, এটা বহু প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীর মনে আধুনিকতার সৃষ্ট ভীতি ও হতাশারই পরিষ্কার ইঙ্গিত বহন করে। আমরা মৌলবাদীদের কর্মসূচিকে প্রভাবিতকারী নিহিলিজম দেখেছি। এই ধরনের ভীতিকে যুক্তি দিয়ে বোঝা বা নির্যাতনমূলক পদ্ধতিতে দূর করা সম্ভব নয়। এমনকি একজন উদারপন্থী বা সেক্যুলারিস্ট এই ভীতি পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত না হলেও আরও কল্পনা নির্ভর সাড়া হবে এই বৈকল্যের গভীরতা উপলব্ধির করার প্রয়াস।
দ্বিতীয়ত, এইসব আন্দোলন যে কোনওভাবেই অতীতে প্রাচীনপন্থী পশ্চাদপসরণ নয় সেটা উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ; এগুলো আধুনিক, উদ্ভাবনী এবং আধুনিকায়নসুলভ। প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা বাইবেলকে প্ৰাক আধুনিক আধ্যাত্মিকতার অধিকতর অতীন্দ্রিয়, উপমাগত পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আক্ষরিক, যৌক্তিক উপায়ের পাঠ করে। খোমেনির বেলায়েত-ই ফাকিহ ছিল শত শত বছরের শিয়া ঐতিহ্যের খোলনালচে পাল্টানো। মুসলিম চিন্তাবিদগণ একটি স্বাধীনতার ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেছেন ও একটি সাম্যাজ্যবাদ বিরোধী আদর্শ সৃষ্টি করেছেন যা কিনা তাদের কালের অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনের অনুরূপ। এমনকি আল্ট্রা-অর্থডক্স ইহুদিরা পর্যন্ত, যাদের আধুনিক সমাজ থেকে দৃঢ়ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে মনে হয়েছিল, তারাও তাদের ইয়েশিভোতকে আবিশ্যিকভাবেই আধুনিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বলে আবিষ্কার করেছে। তোরাহ পরিপালনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের কঠোরতা গ্রহণ করেছিল তারা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে যাতে বিগত দুই সহস্ৰ বছরে ধার্মিক ইহুদিরা ভোগ করেনি এমন ক্ষমতা এনে দিয়েছিল।
আমরা আগাগোড়া দেখেছি যে ধর্ম প্রায়শঃই মানুষকে আধুনিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছে। শাব্বেতিয়বাদ, মেথডিজম ও ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের ব্যাপক পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত করেছে ও তাদের নতুন ধারণার প্রতি অগ্রসর হতে সক্ষম করে তুলতে একটা পরিপ্রেক্ষিত দিয়েছে। যেসব আমেরিকানের প্রজাতন্ত্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের ডেইজমের প্রতি কোনও ফুরসত ছিল না, তারা মহাজাগরণের মহান সংগ্রামে তৈরি হয়েছিল। মুসলিমরাও তাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিকতার গতিময়তা দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছিন্নতার মতো আদর্শের উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষেই, ইউরোপেও সেক্যুলারিজম ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে ধার্মিক হওয়ার নতুন উপায় হিসাবেই প্ৰথমে দেখা হয়েছিল। আমাদের বিবেচিত অতি সাম্প্রতিক বেশ কিছু আন্দোলনও আধুনিকায়নসুলভ ছিল। হাসান আল-বান্না, শরিয়তি, এবং এমনকি খোমেনিসহ প্রত্যেকে মুসলিমদের পশ্চিম থেকে আমদনি করা বিভিন্ন আদর্শ থেকে তাদের অনেক বেশি পরিচিত ইসলামিক প্রেক্ষিতে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। কেবল এভাবেই তারা ‘নিজেদের কাছে ফিরে যেতে পারত’ এবং যারা বাধ্য হয়ে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছিল তাদের গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও গণতান্ত্রিক শাসনের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহকে উপলব্ধিতে সাহায্য করতে পারত। এটা পবিত্র প্রেক্ষিতে আধুনিকতাকে নতুন করে স্থাপন করারও প্রয়াস ছিল। প্রাক আধুনিক ধর্ম সব সময়ই মিথোস ও লোগোসকে সম্পূরক হিসাবে দেখেছে। ইসলামি সংস্কারকগণ সরকারের বাস্তবভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় ও অতীন্দ্রিয়বাদী কাঠামোর ভেতর প্রত্যক্ষ করবেন।
এটা সেক্যুলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের বিদ্রোহেরও অংশ বটে। এটা ঈশ্বরকে ফের রাজনৈতিক বলয়ে ফিরিয়ে আনার একটা উপায় যেখানে থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্নভাবে মৌলবাদীরা আধুনিকতার বিচ্ছিন্নতা প্রত্যাখ্যান করেছে (চার্চ ও রাষ্ট্রের, সেক্যুলার ও জাগতিক) এবং নতুন করে হারানো সামগ্রিকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে। ধার্মিক যায়নবাদীরা ধর্ম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী সেক্যুলারিস্ট যায়নবাদীদের ‘বিদ্রোহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করেছিল। তারা ডায়াসপোরায় যতটা সম্ভব ছিল পবিত্র ভূমিতে তারচেয়ে আরও বেশি করে ঈশ্বর ও তোরাহ পেতে চেয়েছে। খোমেনি ও শরিয়তি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, রাজনীতি থেকে পবিত্রকে বাদ দেওয়া অসম্ভব; কুতব মিশরে জাহিলি হিসাবে আখ্যায়িত সেক্যুলারিস্ট শাসকগোষ্ঠীর খোদাহীনতার নিন্দা করেছেন। এখনও যারা আধুনিকতার সেক্যুলার যুক্তিবাদকে আলিঙ্গন করে উঠতে পারেনি তারা অস্তিত্বের অদৃশ্য মাত্রা সম্পর্কে সজাগ, এবং রাজনীতিতে তার প্রতিফলন দেখতে ইচ্ছুক। সেজন্যে তারা কম আধুনিক হবে কেন সেটা তারা বুঝতে পারে না, যদিও তারা আভাসে স্বীকার করে যে, এর মানে হবে প্রাক আধুনিক ধর্মের কিছু সংখ্যক রক্ষণশীল বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কচ্যুতি। ধর্মের মৌলবাদী সংস্কারের মানে দাঁড়ায় এমন এক অ্যাক্টিভিজম যাকে এতদিন অবধি অধর্মসুলভ মনে করা হলেও এখন তা গুরুত্বপূর্ণ। ধার্মিক যায়নবাদী এবং মৌলবাদী ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা সবাই গতিশীলতা ও বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছে যাতে আধুনিক সমাজের অগ্রযাত্রা ও বাস্তবভিত্তিক গতির সাথে তাল মেলানো যায়।
স্রষ্টার পক্ষে এই লড়াই বৈজ্ঞনিক যুক্তিবাদের কেন্দ্রে অবস্থান করা শূন্যতাকে ভরে তোলার একটি প্রয়াস। মৌলবাদীদের পরিহাস না করে সেক্যুলারিস্ট প্রতিষ্ঠান অনেক সময় তাদের প্রতি-সংস্কৃতির প্রতি তীক্ষ্ণ ও নিবিড় দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। শুকরি মুস্তাফার কমিউনসমূহ সাদাতের খোলা দুয়ার নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল; মুসলিম ব্রাদারদের প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সাম্রাজ্যসমূহ এবং জামাত আল-ইসলামিয়াহর সদস্যদের গৃহীত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ বর্তমান সরকারের ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিহীনতাকে তীক্ষ্ণভাবে তুলে ধরেছে। এই আন্দোলনগুলোর জনপ্রিয়তা ও শক্তি দেখায় যে, সেক্যুলারিস্ট প্রবণতা সত্ত্বেও মিশরের জনগণ এখনও ধার্মিক হতে চায়। ইরানের খোমেনির কাল্টও তাই: সরকারের সাথে বিরোধ জোরাল হয়ে ওঠার সাথে সাথে খোমেনি ক্রমেই আরও অধিকহারে ইমামদের বৈশিষ্ট্য ধারণ করছিলেন, শাহর স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্বের বিপরীতে নিজেকে বহু ইরানির কাছে স্পষ্টতই আকর্ষণীয় শিয়া বিকল্প হিসাবে তুলে ধরছিলেন। একইভাবে ইহুদি ইয়েশিভোত সেক্যুলারিস্ট শিক্ষার বাস্তববাদী প্রকৃতির বিপরীত রূপ ধারণ করেছে; ঈশ্বর ও তাঁর আইনকে বাতিল করে দিয়েছে বলে মনে হওয়া এক সমাজে ইয়েশিভা ছাত্ররা ঐশী সত্তার সাথে সাক্ষাৎ লাভের লক্ষ্যে পড়াশোনা করেছে, কেবল প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের জন্যে নয়, এবং তোরাহ পাঠকে আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে তাদের জীবনের মৌল বিষয়ে পরিণত করেছে। এইসব বিকল্প সমাজ গড়ে তোলার সময় মৌলবাদীরা তাদের এমন সংস্কৃতির প্রতি মোহমুক্তি দেখিয়েছে যা আর সহজে আধ্যাত্মিকতাকে স্থান দিতে পারছিল না।
যুদ্ধংদেহী বলেই সমাজকে আবার পবিত্র করে তোলার অভিযান আগ্রাসী ও বিকৃত হয়ে গেছে। ধর্মীয় জীবনে আবশ্যক বলে সকল ধর্মে জোর দেওয়া সহানুভূতির ঘাটতি রয়েছে এর, এবং নুমিনাসেরও কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তার বদলে এটা বর্জন, ঘৃণা এবং এমনকি সহিংসতার আদর্শ প্রচার করেছে। কিন্তু মৌলবাদীদের ক্রোধের উপর একচেটিয়া অধিকার নেই। তাদের আন্দোলনসমূহ প্রায়শঃই ধর্ম ও এর অনুসারীদের প্রতি সামান্যই সম্মান প্রদর্শনকারী এক আগ্রাসী সেক্যুলারিজমের সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিকশিত করে। সেক্যুলারিস্ট ও মৌলবাদীরা অনেক সময় বৈরিতা ও পাল্টা অভিযোগের ক্রমবর্ধমান ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে বলে মনে হয়। মৌলবাদীরা যদি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার স্বার্থে প্রতিপক্ষের আরও সহানুভূতিপূর্ণ মূল্যায়ন করে, সেক্যুলারিস্টদেরও অবশ্যই আধুনিক সংস্কৃতিকে এর সেরা অবস্থায় বৈশিষ্ট্যায়িতকারী উদারতা, সহিষ্ণুতা ও মানুষের প্রতি সম্মানের ক্ষেত্রে আরও বেশি বিশ্বস্ত থাকতে হবে এবং নিজেদের আরও সহানুভতির সাথে তাদের অসংখ্য মৌলবাদী প্রতিবেশীর অনভূত ভীতি, উদ্বেগ ও প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে, কোনও সমাজই যাকে নিরাপদে অগ্রাহ্য করতে পারে না।
শেষ