১১. নাসিরুদ্দিন প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারেনি

নাসিরুদ্দিন প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারেনি। জলের মধ্যে আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকিয়েছিল, তারপর বিবর্ণ মুখে চেঁচিয়ে উঠল, বাবু!

নিশানাথ স্থিরচোখে তাকিয়ে আছেন জলের দিকে। তাঁর ছেলে প্রথমে জলের মধ্যে প্রবল তোলপাড় তুলে ডুবে গেল একেবারে। এবং কয়েক মুহূর্ত বাদেই আবার ভেসে উঠল। তার কালো চুলভরা মাথাটা দেখা যেতেই নাসিরুদ্দিন হালটা নামিয়ে রেখে লাফাবার জন্য তৈরি হল।

নিশানাথ হাত তুলে তাকে বাধা দিয়ে বললেন, মাঝি, তুমি থাকো।

নিশানাথ ঝট করে জামাটা খুলে লাফিয়ে পড়লেন জলে। পায়ের প্রচন্ড ধাক্কায় নৌকোটা প্রায় উলটে যাচ্ছিল। বুড়ো মাঝি কোনোরকমে সামলাল।

নিশানাথ লম্বা লম্বা হাতে জল কেটে এগিয়ে যেতে লাগলেন। স্রোতের খুব টান, সুব্রত ভেসে গেছে অনেকটা। নিশানাথ কাছে এসে সুব্রতর চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। সেই স্পর্শেই সুব্রত হাঁকুপাঁকু করে দু-হাতে জড়িয়ে ধরতে এল বাবার গলা। নিশানাথ নিজেকে সরিয়ে নিয়ে খুব জোরে একটা চড় মারলেন ছেলেকে।

সুব্রতর নাকটা আছে জলের মধ্যে। মাথাটা কিছুতেই তুলতে পারছে না। নিশানাথের হাতের ঝাঁকুনিতে একবার মাথাটা জল থেকে সামান্য উঁচু হতেই সে আঁহ আহ শব্দ করে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইল। অর্ধস্ফুট গলায় বলল, বাবাঃ–

নিশানাথ তার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা আরও দু-একবার উঁচুতে তুলে ঝাঁকাতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, দেখ মরা কাকে বলে! দেখ!

সুব্রত কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার চিন্তা করারও শক্তি নেই। সে শুধু কোনো একটা জিনিস ধরতে চায়। জলকে ধরা যায় না। হাতের কাছে একটা কাঠ পেলেও সে চেপে ধরত প্রাণপণে। তার বদলে একজন মানুষকে পেয়েছে, তার বাবা।

সে বার বার ধরতে যাচ্ছে। নিশানাথ তাকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। জলে ডোবা মানুষের মুষ্টি কী সাংঘাতিক হয় তিনি জানেন। কোনোরকমে ছেলেটাকে উলটে ফেলা দরকার। কিন্তু সুব্রত হাঁকুপাঁকু করছে ভীষণভাবে। এক-একবার মুখ তুলছে আর চিৎকার করছে সেইভাবে। এত স্রোতের মধ্যে এইভাবে ধরে রাখা যায় না। ওকে অজ্ঞান করে ফেলা দরকার।

কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে সুব্রতর গায়ে একটু জোর ফিরে এসেছে। সে আবার দু-হাত বাড়িয়ে দিল বাবার দিকে। এবার ধরতে পেরেছে। সাঁড়াশির মতন আঙুল দিয়ে সে নিশানাথের টুঁটি আঁকড়ে ধরল।

নিশানাথ প্রচন্ড শক্তিতে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন। সুব্রতর গায়ে এখন যেন। অসুরের শক্তি এসে গেছে। সে আর কিছুতেই ছাড়বে না।

নিশানাথের দম আটকে এসেছিল, তিনি নিজেকে ছাড়াবার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা করতে লাগলেন। পারছেন না। একটা অক্টোপাসের অনেকগুলো হাত যেন তাঁকে চেপে ধরেছে, একবার ডুবে গিয়ে তিনি অনেকখানি জল খেলেন—কোনোক্রমে আবার মুখ তুলে বললেন, ছাড়, ছাড়—

সুব্রত ছাড়ল না। সে আর কিছুতেই ছাড়বে না, সে বাঁচতে চাইছে। নিশানাথ কোনোক্রমে মাথা তুলে সুব্রতর পেটে এক লাথি মারলেন। সেই ধাক্কায় সুব্রত ছিটকে বেরিয়ে গেল। আবার ডুবেই যাচ্ছিল, নিশানাথ দ্রুত এগিয়ে এসে সুব্রতর জামাটা ধরে ফেললেন। হাতটা যতখানি লম্বা করা যায়, ততখানি দূরে ওকে সরিয়ে রাখলেন। তারপর স্রোতের সঙ্গে দু জনেরই শরীরটা ভাসিয়ে রেখে অন্য হাতে সমস্ত জোর দিয়ে ঠাস ঠাস করে মারতে লাগলেন সুব্রতর ঘাড়ে।

সুব্রত মার খেয়ে আঁক আঁক শব্দ করতে লাগল, একটু দম পেতেই বলতে লাগল, বাবা, আর করব না, বাঁচিয়ে দিন, আপনার পায়ে ধরছি…

–মরতে চেয়েছিলি না? দেখ মরা কাকে বলে?

সুব্রত ঘোলাটে চোখে বাবাকে দেখবার চেষ্টা করল। নিশানাথ তখনও তাকে কাছে আনলেন না। বললেন, একদম নড়াচড়া করবি না। একটু নড়লেই মার খাবি—

সুব্রতর চোখের জল মিশছে নদীতে, নিশানাথ একটু থামতেই সে ফোঁপাতে লাগল, আমি মরে যাব। আমি মরে যাব। নিশানাথ আর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামিয়ে দিলেন তাকে।

তিনি সুব্রতর দেহটা উলটে চিত করে দিলেন। নিজেও চিত হয়ে সুব্রতর মাথাটা টেনে এনে নিজের বুকের ওপর রাখলেন।

ওপরে আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা এসে পড়ছে মুখে। যেন জলের একটা অতিকায় প্রাণী বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তার সন্তানকে। হাঁটতে শেখার পর আর সন্তানের মাথার স্পর্শ নিশানাথের বুকে লাগেনি। তিনি বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

নাসিরুদ্দিন নৌকোটা কাছে নিয়ে এসেছে। বইঠাটা বাড়িয়ে দিল নিশানাথের দিকে। নিশানাথ সেটা ধরে ফেলে নৌকোর সঙ্গে শরীরটাকে সমান্তরাল করে ফেললেন, তারপর বললেন, তুমি একে আগে উঠিয়ে নাও।

সুব্রতর তখনও অজ্ঞানের মতন ঘোরলাগা অবস্থা। নিজে থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। নিশানাথ তার কোমরটা ঠেলে উঁচু করে তুললেন। বুড়ো মাঝি তার মাথাটা তুলে দিল গলুইয়ের ওপর। তারপর যেমনভাবে বড়ো মাছ ওঠানো হয়, সেইভাবে তোলা হল সুব্রতকে।

তারপরও নিশানাথ নৌকোর গা ধরে ভাসতে লাগলেন। তিনি উঠতে ভরসা পাচ্ছেন না। তার এত বড়ো শরীরটা তোলার সময়কার ঝাঁকুনিতে নৌকোটা উলটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

তিনি মাঝিকে বললেন, তুমি যদি নৌকোটা একা চালিয়ে নিয়ে যেত পার, তাহলে আমি পাশে পাশে সাঁতরে চলে যাব।

নাসিরুদ্দিনের মুখখানা অপ্রসন্ন, সে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, এই সময়ডার পানিতে খুব কামঠ লাগে।

নিশানাথ নদীর দিকে আর একবার তাকালেন। ছোটো জাতের কুমিরগুলো সাধারণত এত গভীর জলে আসে না, তবু বলাও যায় না, মাঝিরাই ভালো জানবে।

কিন্তু নৌকোটা যদি সবসুদ্ধ উলটে যায়?

নাসিরুদ্দিন বলল, যাবে না, আপনি ওঠেন তো।

নাসিরুদ্দিন সুব্রতকে ঠেলে নিয়ে গেল একদিকে। নিজেও সে সেইদিকে কাত হয়ে রইল। নিশানাথ নৌকোর ধারটায় যত দূর সম্ভব কম চাপ দিয়ে প্রায় যেন লাফিয়েই উঠে এলেন জল থেকে। তাঁর অত বড়ো শরীরের চাপে দু-টি পাটাতন ভেঙে গেল মচাং করে। এবং অন্য একটিতে তাঁর থুতনি ঠুকে গেল বেশ জোরে। কেটে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত পড়তে লাগল। দরদরিয়ে।

নাসিরুদ্দিন বলল, বাবু, আপনে কি আমারেও মারতে চান? নিশানাথের খুব জোর লেগেছে। চোখ বুজে মুখটা কুঁচকে রেখে তিনি ব্যথাটা সামলাবার চেষ্টা করছেন। একটু বাদে তিনি চোখ খুলে বললেন, তুমি আমাকে মাপ করে দাও।

আমার ঘরে বালবাচ্চা নেই, জরুর নেই, আমি একলা মানুষ আমি আপনাদের রীত পৃকিতি কিছু বুঝি না। তবু আপনি আমারে আজ এতবড়ো ভয়ডা দেহালেন।

তুমি একটু বেশি ভয় পেয়েছিলে মাঝি। আমি জানতাম, কিছু হবে না।

নিশানাথের রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তাঁর বুকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। রক্ত কখনো সোজা যায় না। এঁকেবেঁকে নিজস্ব একটা পথ তৈরি করে নেয়। নিশানাথ হাত দিয়ে থুতনিটা চেপে ধরে রইলেন।

সুব্রত স্থির হয়ে শুয়ে আছে। সে-দিকে চোখ পড়তেই তিনি বললেন, নাসিরুদ্দিন দেখো তো ছেলেটার পেটে জল ঢুকেছে কিনা! নাসিরুদ্দিন কোনো উত্তর না দিয়ে সুব্রতর কাছে এসে পড়ল। তারপর তার পিঠের দু-দিকে হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগল। ওই শীর্ণ হাতেও বেশ শক্তি আছে, কারণ চাপ লাগতেই সুব্রত একটা শব্দ করে উঠল। কিন্তু তার পেটে জল ঢোকেনি, কিছুই বেরোলো না। শুধু সে দুর্বল বোধ করছে।

নিশানাথ কাছে এসে সুব্রতর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, ঠিক হয়ে যাবে, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে!

বাবার হাতের সেবা পাওয়ার অভ্যেস নেই সুব্রতর। মাথাটা একটু পরিষ্কার হতেই সে বেশ অস্বস্তি বোধ করল। উঠে বসল আস্তে আস্তে। দেখল বাবার থুতনি ও বুক রক্তে মাখামাখি। সে কিছুই বলল না। কী বলবে?

নিশানাথ বার বার হাতের তেলো দিয়ে রক্ত মুছছেন। ফিরে গেলেন গলুইয়ের কাছে।

সুব্রত উবু হয়ে বসে রইল নৌকোর খোলের মধ্যে। ফাঁকা ফাঁকা দৃষ্টি। মাঝে মাঝে সে যেন বেশি শীত লাগার মতন কেঁপে উঠছে। কাছেই জলে আলোড়ন তুলে একটা প্রাণী মাথা তুলেই আবার ডুব মারল। নিশানাথ সুব্রতকে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ওটা শুশুক, ভয়ের কিছু নেই।

নিশানাথ এখনও বইঠা ধরেননি বলে নৌকোটা স্রোতের সঙ্গে সঙ্গেই ভাসছে। বাতাসের বেগ একটুও কমেনি। আকাশের চেহারা একইরকম খারাপ। বুড়ো মাঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আজ বুঝি গালাম!

নিশানাথ বইঠাটা তুলে নিয়ে বললেন, কিছু হবে না, ঠিক পৌঁছে যাব।

ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই ছইয়ের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়।

সুব্রত নড়ল না।

নিশানাথ এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টেনে বললেন, ওঠ। শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজে কী হবে!

সুব্রতকে তিনি নিয়ে গেলেন ভেতরে। ছইয়ের সঙ্গে ঝুলছে মাঝির ছেড়া গামছা। সেটাই তুলে নিয়ে বললেন, এটা দিয়ে মাথাটা অন্তত মুছে নে।

তারপর তিনি গলুইয়ে ফিরে গিয়ে বইঠা নিলেন। একবার ডান দিকে, একবার বাঁ-দিকে জল টেনে টেনে নৌকোটা সোজা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তবু নৌকোটা ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে ওদিকে তাকিয়ে দেখলেন, বৃদ্ধ মাঝি হাল থেকে হাত তুলে নিয়েছে।

সে বলল, আমার আর শক্তি নাই, বাবু।

একেই বলে হাল ছেড়ে দেওয়া। নিশানাথ ভাবলেন, নাসিরুদ্দিন তাঁকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। তিনি একটু হেসে বললেন, আরে মিঞা, আর একটুখানি ধরো। এ-রকম করলে নৌকো যাবে কী করে?

যেখানে যায় যাক।

আরে তুমি কি পাগল হলে নাকি? যা বলছি শোনো!

বাবু, দুনিয়ায় আমার কেউ নাই, আমি কার বান্দা?

নাসিরুদ্দিন, হালটা ধরো শিগগির, নৌকো ঘুরছে।

আর পারি না। শক্তি নাই! পেটের মধ্যে সেই ব্যথাটা…

কথার অবাধ্য হলে মাথাটা ফাটিয়ে দেব তোমার।

মাঝি হা-হা করে হেসে উঠল।

মধ্যনদীতে ঝড়-জলের মধ্যে এই কৌতুক নিশানাথের পছন্দ হল না। এ-রকমভাবে নৌকো সামলানো যাবে না। তিনি তো একাই হাল আর দাঁড় দুটোই নিতে পারেন না। লোকটা কী সত্যিই পাগল হয়ে গেল নাকি? কিন্তু যে-লোক সারাজীবন নৌকো চালাতে চালাতে বুড়ো হয়ে গেল, সে একদিনের ঝড়-বৃষ্টিতে ভয় পাবে কেন? যতই পেটের ব্যথা হোক, এখন হাল ধরে নৌকো না সামলালে যে ভরাডুবি হবে!

নিশানাথকে আবার বইঠা তুলে রেখে এদিকে আসতে হল। মাঝির মুখের কাছে ঝুঁকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার?

হালটার ওপর মাথা রেখে নাসিরুদ্দিন বলল, এ যাত্তারায় আর বুঝি ফেরা হল নি! আমার তাগৎ সব গেছে।

নিশানাথ ওর গা ছুঁয়ে দেখলেন, ওর গায়ে দারুণ জ্বর। চোখ দু-টি ঘোলাটে হয়ে আসছে।

এই প্রথম নিশানাথ অসহায় বোধ করলেন।

জলে ভেজার জন্য কোনো মাঝির কখনো জ্বর হয়েছে বলে তিনি শোনেননি। তাহলে তো মাছেদেরও জ্বর হওয়ার কথা। কিন্তু এই লোকটা সত্যিই অসুস্থ।

সুব্রত জুলজুলে চোখে সব কিছু দেখছে। যেন একটা রোমহর্ষক নাটক। এর শেষ পরিণতি জানার জন্য সে উদগ্রীব। বোধ হয় নৌকোটা ভাসতে ভাসতে সমুদ্রে চলে যাবে। কিংবা উলটে যাবে যেকোনো সময়। আর কোনোদিন সে মাকে কিংবা শিখাকে দেখতে পাবে না।

তুই হালটা ধরতে পারবি?

সুব্রত চমকে উঠে ফ্যাকাশে গলায় বলল, আমি? আমি তো জানি না কী করে—

আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।

সাঁতার না-জানা যে-মানুষ হঠাৎ জলে পড়ে যায়, সে মানসিক ধাক্কায় শারীরিকভাবেই অনেকক্ষণ অবসন্ন হয়ে থাকে। সুব্রতর হাত-পায়ে একটুও জোর নেই এখন। বুকের ধড়ফড়ানিটা এখন কমলেও ভেতরটা যেন একেবারে খালি। তবু উঠে বাইরে বেরিয়ে এল।

নিশানাথ বললেন, মাঝি তুমি ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।

নাসিরুদ্দিন মাথা নেড়ে বলল, এ খোকাবাবুডা পারবে না। ই কি কেউ একদিনে শেখে?

তবু কিছু একটা করতে হবে তো!

এ যাত্তারা আর ফেরা হলনি। ছেড়ে দেন।

নিশানাথ হালের ডগাটা শক্ত করে ধরে আছেন। কড়া গলায় বললেন, সরো।

এইসব লোকের কথাবার্তা তিনি একদম বোঝেন না। এরা যখন-তখন হার স্বীকার করতে চায়। এটা কী মানুষের ধর্ম? নদীর ওপরে একটা নৌকো স্রোতে ভাসছে—এটা যদি-বা যতক্ষণ উলটে না যায়, ততক্ষণ এটাকে পাড়ে পৌঁছোবার শেষ চেষ্টা করতে হবে না?

মাঝি একটু সরে যেতেই নিশানাথ সুব্রতকে সেই জায়গায় বসালেন। তারপর বললেন, দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধর।

নির্দেশমতন সুব্রত দু-হাত দিয়ে হালটাকে চেপে ধরল। নাসিরুদ্দিন ক্লান্তভাবে হেসে বলল, ও পারবে না।

সে-কথা অগ্রাহ্য করে নিশানাথ ছেলেকে বললেন, তুই হাল চালাতে পারবি না ঠিকই, কিন্তু শক্ত করে ধরে থাকবি

একটা বড় ঢেউতে নৌকো খুব জোরে দুলে উঠল। নিশানাথ দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোক্রমে সুব্রতর পিঠটা ধরে সামলালেন। তারপর বললেন, মনে রাখবি, সবসময় খুব শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। একটু আলগা দিলেই ছিটকে ফেলে দিতে পারে। আমি ওদিক থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলব, সামনে বললে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়বি, আর পেছনে বললে, পেছন দিকে টানবি-কোনোক্রমে মুঠো যেন আলগা না হয়। যখন ছেড়ে দিতে হবে, তখনও আমি বলব।

নিশানাথ সুব্রতর কাঁধে হাত রেখে খুব কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, পারবি না?

সুব্রত অস্ফুটভাবে বলল, পারব।

নিশানাথ ফিরে গেলেন নিজের জায়গায়। আবার বইঠা ধরলেন এবং বহুকালের দক্ষ মাঝির মতন চালাতে লাগলেন। ফুলে উঠেছে হাত ও পিঠের পেশি। ছেলের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, এই তো ঠিক আছে, আর একটু সামনে সামনে, আর একটু—

ছই-এর মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে নাসিরুদ্দিন। সুব্রতকে দেখছে আর বিড়বিড় করে বলছে পারবে না, পারবে না, লৌকোড়া কয় হাত আগুলো? কয় হাত?

বুড়ো মাঝির নিরাশা-বাক্যে সুব্রতর আরও জেদ বেড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে জলের মধ্যে যেরকম কঠিন আঙুল দিয়ে সে বাবার গলা চেপে ধরেছিল, এখন সেইরকম আঙুলেই ধরে রইল হালটা। এক-এক সময় অসম্ভব জোর লাগছে, বড়ো বড়ো ঢেউয়ের সময় মনে হচ্ছে যেন হাত ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, তবু সুব্রত প্রাণপণ আঁকড়ে রইল। তার গাঁটগুলো টনটন করছে। যেকোনো মুহূর্তে চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরোবে মনে হয়, তবু সে ছাড়ল না।

নিশানাথ চেঁচিয়ে বললেন, ঠিক আছে, এই তো ঠিক আছে, এবার পেছনে–

তবু সুব্রতর দু-একবার ভুল হয়ে যাচ্ছে। একবার একটা বড়ো ভুলে নৌকোটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নাসিরুদ্দিন উঠে বসে বলল, দ্যান, আমারে দ্যান, আপনার কম্মো না–

সুব্রত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, না, আপনি শুয়ে থাকুন। আমি পারব।

নিশানাথ ছেলের ভুলের জন্য বকলেন না। বললেন, তুমি শুয়ে থাকো মাঝি, ও পারবে। দু-একবার তো ভুল হবেই–

ঝড়ের বেগ কমে এসে বৃষ্টির তোেড় বেড়েছে। নিশানাথ অক্লান্তভাবে বেয়ে চললেন। এক সময় আর থাকতে না পেরে নাসিরুদ্দিন আর একখানা বইঠা নিয়ে আর একপাশে বসল। আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে নৌকো ওপারে এসে ভিড়ল। কাছাকাছি কোনো ঘাট নেই, বাড়ি-ঘর নেই, ধু-ধু করছে মাঠ।

কাদার মধ্যে নেমে লগি পুঁতে নৌকো বাঁধলেন নিশানাথ। তারপর বললেন, এ কোথায় এলাম? জায়গাটা চেন নাকি মাঝি? নাসিরুদ্দিন বললেন, বেশি দূরে আসেন নাই। ওই দ্যাখেন না–

দূরে একটা অস্পষ্ট উঁচু স্তম্ভের মতন জিনিসের দিকে আঙুল তুলে সে বলল, ওই দেখেন না আন্দাজগড়।

নিশানাথ স্বস্তির সঙ্গে বললেন, ও তাহলে তো বারশিঙা গ্রাম খুব বেশি দূরে নয়।

–এই কোনাকুনি যেতি হবে। ক্রোশ খানেক।

–চলো, তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে।

—আমি? আপনেরা যান, পথ চিনতে ভুল হবে না।

—পথ চেনাবার জন্য নিতে চাইছি না। তুমি এমনিই আমাদের সঙ্গে যাবে।

–তাও বুইঝলাম না।

-বুঝলে না? তুমি হঠাৎ হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের বিপদে ফেলেছিলে, তার ফল পেতে হবে না? এমনি এমনি ছেড়ে দেব?

–আমারে শাস্তি দেবেন? আমারে মারবেন?

হ্যাঁ, তোমাকে মারব। তোমাকে মেরে কেটেকুটে তোমার মাংস রান্না করে খাব। চলো–।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *