১১. দ্বিতীয় বিজয়

১১. দ্বিতীয় বিজয়

‘যেমন কাজ তেমন ফল’ কথাটা বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলেও ১৯৮২ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বসুর মনে হয়েছিল এই ঘষা পয়সার মত পুরোনো কথাটা যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। তখন বসু বুঝেছিলেন কথাটার কতটা ওজন—কারণ প্রথম অকংগ্রেসী সরকার প্রথম পাঁচ বছরে যেমন কাজ করেছে একমাত্র তার ওপরই নির্ভর করেছিল রাজ্য বামফ্রন্টে দ্বিতীয়বার ফিরে আসা। আগের থেকে ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তখন বেশ ‘সংশয়’ আর ‘প্রশ্ন’ নিয়েই জনগণের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আশার কথা, রাজ্যের মানুষ বামফ্রন্টকে নিরাশ করেনি। ২৯৪টি আসনের মধ্যে সি. পি. আই. (এম) একাই পেয়েছিল মোট ১৭৪টি আসন এবং তাদের বামফ্রন্ট জোট সব মিলিয়ে পেয়েছিল ২৩৮টি আসন। এবারে সি. পি. আই. ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল। কংগ্রেসের অবস্থা আগের তুলনায় একটু ভাল হয়েছিল বটে কিন্তু মাত্র ৪৯টি আসন নিয়ে ঠিক ধর্তব্য হতে পারেনি। জনতা দল মুছে গিয়েছিল ফলে কংগ্রেস আর বামফ্রন্টে মেরুকরণ একেবারে সম্পূর্ণ হয়েছিল।

বামফ্রন্টের দ্বিতীয় বিজয়ের পর বসুর মনে হয়েছিল তাঁর দায়িত্ব যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। এদিকে প্রমোদ দাশগুপ্ত মারা যাওয়াতে তাঁর অন্যান্য কাজকর্মও বেড়ে গিয়েছিল। জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত—এই দুজনের চিন্তাভাবনার ফারাক থাকা সত্ত্বেও এবং ‘কট্টরবাদী’ ও ‘বাস্তববাদী’ এই দুই শিবিরের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য একটা থাকলেও দুই নেতার মধ্যে যেন কাজ চালানোর জন্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া ছিল। প্রমোদবাবু বেশ বুঝতেন ‘জ্যোতিবাবু’ হলেন জনগণের এমন এক নেতা যিনি জনগণকে পার্টির দিকে টানতে পারেন এবং যিনি ব্যক্তিগত স্বার্থকে কখনই কোনও মূল্য দেন না। আর জ্যোতিবাবুও ভালই বুঝতেন যদি প্রমোদবাবু পার্টির সংগঠন এইরকম দক্ষভাবে চালিয়ে যান তো সরকারও মসৃণভাবে চলবে। প্রমোদবাবু কোনওদিন নিজে মন্ত্রী হতে চান নি, বরং মন্ত্রী তৈরী করেছেন।

বসুর অভ্যাস ছিল নিজের কোয়ালিশন ক্যাবিনেটের সদস্যদের প্রত্যেকের মতামত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কোনও সদস্য তাঁকে কোনও বিশেষ পরামর্শ বা অভিমত জানালে তিনি সেটা বিবেচনা করে তবে নিজের মত দিতেন। সরকারের প্রথম কয়েকটা বছর খুব একটা ঘটনাবহুল ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থার পর তাঁর পরাজয় থেকে খানিকটা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী শিবিরের সঙ্গে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে তিনি আদানপ্রদান করতেন। তাই সরকার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা তিনি আর করেন নি। বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বসুর পরামর্শও চাইতেন। তবে সব কথা শুনতেন তা নয়, যেমন, বসু বললেন, “পাঞ্জাবের সমস্যার কথাটা ও তেমনভাবে ভাবেনি, তড়িঘড়ি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।” যাই হোক ইন্দিরা গান্ধীর মনে হয়েছিল, যে কোনও কারণেই হোক, বসু এমন এক বিরল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একজন যিনি ব্যক্তিগত এবং তুচ্ছ রাজনৈতিক চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্মত পরামর্শ দিতে পারেন। রাজ্য চালানোর কাজ, পার্টি অফিসে নিয়মিত সভাসমিতি, দিল্লী যাওয়া—এইভাবেই কমবেশী বাঁধা রুটিনেই বসু চলছিলেন। এরই মধ্যে কখন অজান্তে ধকলটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল। নিজেও সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি। ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সারাদিন কাকদ্বীপে পার্টির একটা মিটিং করেছিলেন, মাঝে মাঝে চুমুক দিয়েছিলেন ছোট ভাঁড়ের চায়ে। সঙ্গে ছিলেন ছোট শ্যালিকা মঞ্জুলা রায় আর লীডস্ থেকে এসেছিলেন ছোট শ্যালক মুকুল (সুধাময়) আর পার্টি কমরেডরা তো ছিলেনই। “বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন জামাইবাবু”, বললেন মঞ্জুলা রায়, “ফিরলেন আমার বাড়ীতে, তখন আমার বাড়ীতে লিফ্‌ট ছিল না, হেঁটেই তিনতলায় উঠলেন, তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই গেলাম চন্দনের বাড়ি কুইনস্ ম্যানসনে, সেখানে আমাদের সকলের রাতের খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। সবাই খেতে বসলেন, দিদি জামাইবাবু, জয়ন্ত, চিংকু, ডলি, আমার দুই দাদা, মাও ছিলেন, হঠাৎ জামাইবাবু খানিকটা খেয়েই উঠে পড়লেন। উঠেই এগোতে যাবেন এমন সময় টলে পড়ে গেলেন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ডাঃ রাজীব শীল, উনি চট্ করে জামাইবাবুকে ধরে ফেললেন, জামাইবাবুও চোখ মেলে তাকালেন, তখন সবাই হতভম্ব—জামাইবাবুকে তো কখনও অসুস্থ হতে আমরা দেখিনি। সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্ত চিংকু সবাই ওঁকে নিয়ে গেল এস. এস. কে. এম. হাসপাতালে। চিংকু তো কান্নাকটি শুরু করে দিয়েছে।” বসু নিজের এই অসুখ প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, “হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর একটা বেশ মজার ব্যাপার হয়েছিল। জয়ন্ত আমার ভায়রাভাই এমারজেন্সিতে গিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে একজনকে বলল, ‘দাদা একটু এদিকে আসবেন, চীফ মিনিস্টার একটু অসুস্থ’–সে বলল, ‘যা বলার ওখান থেকেই বলুন, চীফ মিনিস্টার তো কি হয়েছে?

“যাই হোক, আর এক ডাক্তার, তাঁর স্ত্রী তখন এইটি পার্সেন্ট বার্নট কেসে ওখানে ভর্তি ছিলেন, তিনি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করলেন, ডাঃ মাইতি, ডাঃ ছেত্রী, ওদের সব খবর দেওয়া হল।” বসুর অন্যান্য কোনও সমস্যা ছিল না। আসলে অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই এটা হয়েছিল। বিমান বসু পরে অত্যন্ত সহৃদয়ভাবে বলেছিলেন “আমাদের এত বড় একজন নেতা, আমাদেরই ভাল করে যত্ন নেওয়া উচিত ছিল।”

অসুখের পর বসুকে বলা হল সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে। বসু কিছুদিন ছেলের বাড়িতে রইলেন। কাজের চাপও খানিকটা কমালেন। নিজে হাতে নিজের কাজ করার অভ্যাসটাও ছাড়তে হল। “জেলে থেকে আর বিদেশে থেকে আমার নিজের কাজ করার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল,” বসু বললেন। অসুস্থতার কারণে তাঁর হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে লিফ্‌ট বসানো হল, আগের মত পার্টির কালো ফিয়াট গাড়িতেই যাতায়াত করতে লাগলেন। বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে যাতে ধকল না পোহাতে হয় এবং সময়ও নষ্ট না হয়, এই সব কারণে বসু বাসা পাল্টালেন। এবার তিনি থাকতে গেলেন রাজভবনের ক্যাম্পাসের মধ্যে একটা সাধারণ দোতলা বাড়িতে। বাড়িটা তেমন আলো-হাওয়াযুক্ত খোলামেলা নয়, কিন্তু রাইটার্স বিল্ডিংস্ থেকে খুবই কাছে। রাজ্যের প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ দুজনেই এই বাড়িতে আগে বসবাস করেছেন। এই সময়টা বসুকে রাজ্যের বাইরে যাওয়াটা কমিয়ে দিতে হয়েছিল, অনেক সময় পার্টির সভাও তাঁর বাড়িতে হত। ডঃ অশোক মিত্র অর্থদপ্তরের দায়িত্ব নিলেন। বসু বিশেষ জোর দিলেন কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের ওপর। বসুর মতে “রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা আর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মধ্যে একটা নিবিড় যোগ রয়েছে।” কয়েক মাস বিশ্রাম নেওয়ার পর বসু রাজ্যের নানা সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য দিল্লী গেলেন। ইতিমধ্যে তিনি ধীরে ধীরে জাতীয় স্তরের নেতা হয়ে উঠছেন। বসু বললেন, “সেই সময় ভারতীয় রাজনীতির চেহারা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল, ইন্দিরা বুঝতে পারছিল যে কংগ্রেসের একাধিপত্য আর থাকছে না, অনেক প্রাদেশিক দল, এমনকি কমিউনিস্ট দলও সামনের সারিতে চলে আসছে। অতএব সময়ের সঙ্গে তাল রেখে ইন্দিরাও তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছিল। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের যে নতুন করে মূল্যায়ন হওয়া উচিত এ বিষয়ে সে একমতও হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাস্তবে কিন্তু কেন্দ্র রাজ্যগুলির ক্ষমতা খর্বই করত এবং এই কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক যেন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল তার—কেন যে এক রকম মুখে বলা হত আর কাজে করা হত আর এক রকম তা কে জানে!”

১৯৮৪ সালের ১৬ই জুলাই থেকে ১০ই আগষ্ট বসু ছিলেন বিদেশে। এই সময় বসু গিয়েছিলেন ইংল্যাণ্ড, কানাডা এবং আমেরিকা। বিদেশে থাকার সময় দেশের সমস্যা নিয়ে জর্জরিত থাকাটা বসুর পছন্দ নয়। রোজই কলকাতা থেকে ফোনে খবরাখবর যেত, উনি নানা পরামর্শ দিতেন, শুনে নিতেন কিন্তু বেশিক্ষণ মাথাঘামাতে তাঁর খুব একটা ভাল লাগত না। “দেশ থেকে দূরে গিয়ে দেশের সমস্যা নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও মানে হয় না, কারণ অতদূর থেকে তো সমস্যাটা সমাধান করা যায় না, বড় জোর কয়েকটা সমাধানসূত্র দেওয়া যায় এই পর্যন্ত। তার থেকে যেখানে আছি সেখানে মনঃসংযোগ করাটাই ভাল”—বসু মন্তব্য করেন। তবে প্রয়োজন হলে তাঁকে মাথা ঘামাতে হয়েছে বৈকি। ঐ বিদেশ সফরের সময়ই তাঁকে ভারতের জাতীয় রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে হয়েছে। বিভিন্ন সভায় সাক্ষাৎকারে উনি পাঞ্জাব আর কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টারের বিপক্ষে কথা বলেছেন, বিরোধিতা করেছেন কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লার সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘটনার।

“ইন্দিরা অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে ঐ অপারেশন চালানোর পরে আমায় ফোন করেছিল। আমি তখন রাজভবনের ঐ বাড়িতে। সকালবেলায় ব্রেকফাস্টের পর বসার ঘরে খবরের কাগজ পড়ছি, এমন সময় দিল্লী থেকে ইন্দিরার ফোন এল। আমায় ফোনে বলল, ‘আমি এই কাজ করেছি। আপনি দিল্লী আসুন।’ আমি বললাম, কাজটা তো ঠিক হয়নি, এখন তো ব্যাপারটা হয়ে গেছে, এখন আর কি হবে, যাই হোক, আমি দিল্লী গেলাম।” বসু বললেন, “ঐ র‍্যাশ্ সিদ্ধান্তের ফল বড় ট্র্যাজিক হয়েছিল।” ৩১শে অক্টোবর বসু ছিলেন মাদ্রাজে। সেখানেই খবর পান ইন্দিরা দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। বসু খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন এই ঘটনায়। সঙ্গে সঙ্গে দিল্লী উড়ে গিয়েছিলেন, বুলেটবিদ্ধ ইন্দিরাকে দেখে তাঁর মন আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। “সারাভারতে এই মর্মান্তিক ঘটনার হিংস্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়”, বসু বললেন, “মাত্র দু’দিনে কেবল দিল্লীতেই তিন হাজার শিখ মারা পড়ে, কলকাতায় পরিস্থিতি কিন্তু আয়ত্তের মধ্যে ছিল।” প্রকৃতপক্ষে সারা রাজ্য এবং কলকাতা শহরেও অবস্থা শান্তিপূর্ণ ছিল। কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য সর্বধর্মীয় এক বিশাল মিছিলও বেরিয়েছিল। গোড়ার দিকে বহু শিখ পরিবার আতঙ্কিত হয়ে স্থানীয় গুরুদ্বোয়ারায় আশ্রয় নেয় কিন্তু অবিলম্বে তারা নিজেদের বাড়ীতে ফিরেও আসে। কোন সংঘর্ষ হয়নি, কেউ হতাহতও হয়নি। “১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর সারা ভারতের কাছে পশ্চিমবঙ্গ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল” বসু ঈষৎ গর্বিতভাবে বললেন।

কেন্দ্রের ছবি আবার বদলে গেল। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন। “রাজীব ছিল একবারে ‘নভিস’, ওর বন্ধুদের পরামর্শেই চলত”—বসু মন্তব্য করেন। রাজীব গান্ধী আর বসুর মধ্যে সম্পর্কটা একটা বিচিত্র মোড় নিয়েছিল। প্রথম প্রথম রাজীব অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বসুকে আক্রমণ করতেন কিন্তু শেষের দিকে বসুর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বসুরও বেশ অসুবিধা হত রাজীব গান্ধীর সঙ্গে কাজ চালাতে গিয়ে, দুজনের স্তরের মধ্যে এতই ফারাক ছিল তা বলার নয়। বসু বললেন,

“ইন্দিরা অনেক ছোট বয়স থেকে রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপারগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছিল, কিন্তু এই অল্পবয়সী ছেলেটি তো রাজনীতিতে একেবারেই আনকোরা।” ভারতের এই নব্য প্রধানমন্ত্রীর অপরিণত রাজনীতির সমালোচনা বসু বিদেশেও করেছিলেন। ১৯৮৫ সালের ২৫শে জুলাই লন্ডনে বি. বি. সি-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বসু এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্তব্য করেন। তাছাড়া তিনি জরুরী অবস্থা সমর্থন করার জন্য রাজীবের সমালোচনা করেন, কলকাতাকে ‘মৃতনগরী’ বলার জন্যও আক্রমণ করতে ছাড়েন না। এই সময়েই তিনি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের উপর একটি সাক্ষাৎকারও দেন। সাক্ষাৎকারটি বসু ১৬ই জুলাই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ক’দিনের জন্য ঘুরে এলেন কর্নওয়ালে। তখন স্ট্রবেরীর সময়, গ্রীষ্মকাল, প্রাণভরে স্ট্রবেরী ক্ষেত থেকে স্ট্রবেরী তুললেন, কয়েকটা মুখেও দিলেন, মগ্ন রইলেন সাধারণ নাগরিকের স্বাধীনতার আমেজে। কয়েকটা দিন মাত্র। দেশে ফিরেই বিচ্ছিন্নতাবাদের মুখোমুখি। একেবারে নিজের রাজ্যে। আগেই আভাস ছিল, এখন দেখলেন ব্যাপারটা বিরাট আকার ধারণ করেছে। শুরু হল সুবাস ঘিসিং-এর গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলন। গোর্খা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্ট, অন্দোলনের শুরুতেই নাগরিকত্বের স্বাতন্ত্র্যের দাবি নিয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছিল ইউনাইটেড নেশনস্ এবং অন্যান্য সংস্থাকে। বসু এই কাজটা ‘জাতীয়তা- বিরোধী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। “তাছাড়া আর কি বলব? নিজেদের দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশের সমর্থন কি চাওয়া উচিত?” বসু বললেন, “আমার ঠিক পুরো এক বছর লেগেছিল রাজীব গান্ধীকে বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে।” শেষ পর্যন্ত রাজীব গান্ধীকে বসু বোঝাতে পেরেছিলেন কিন্তু জি. এন. এল. এফ. তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতেই থাকে। পুলিশকর্মী আক্রমণ, পার্টিকর্মীদের নিগ্রহ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ইত্যাদি চলতে থাকে। দার্জিলিং-এ ট্যুরিস্টদের ভিড় কমে যায়, রাজ্যের রাজস্ব লোকসান হয়। “আড়াই বছর ধরে আমরা কেন্দ্রের দু’মুখো আর ভ্রান্ত নীতির জন্য গোর্খাল্যান্ড সমস্যা নিয়ে যুদ্ধ করেছি”, বসু বলেন। প্রায়ই কখনও কলকাতায় কখনও দিল্লীতে বসু নিজে উদ্যোগ নিয়ে ঘিসিং-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে শেষ পর্যন্ত সুবাস ঘিসিং পাহাড়ী এলাকার উন্নয়নের জন্য দার্জিলিং গোরখা হিল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হন। ঠিক হয় নেপালী সংখ্যাগরিষ্ঠ অধ্যুষিত দার্জিলিং, কার্সিয়াং এবং কালিম্পং এই তিনটি সাব-ডিভিশন দার্জিলিং গোরখা হিল কাউন্সিলের আওতায় পড়বে। কথাবার্তা চলার সময় দিল্লীতে একটা বৈঠকের আগে হঠাৎ বসুর পিঠে স্পনডিলাইটিসের পুরোনো ব্যথা চাগাড় দেয়। ডাক্তার বসুকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেয়, রে’ চিকিৎসাও চলতে থাকে। ১৯৮৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর হিল কাউন্সিলের নির্বাচন হয়। কিন্তু কাউন্সিল গঠিত হবার কিছুদিন পর থেকেই ঘিসিং আবার অর্থাভাবের অভিযোগ করতে থাকেন। বসু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “আমি চেয়েছিলাম হিল কাউন্সিল দার্জিলিঙের লোকেদের স্বার্থ দেখাশোনা করবে, কিন্তু দেখছি হিল কাউন্সিল হয়ে যাওয়ার পরেও আমাদের পার্টিকর্মীরা ভীষণভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।” হিল কাউন্সিলের সমস্যার সমাধান এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। বেশ কিছুদিন সুপ্ত থাকার পর ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে এই আন্দোলন আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবার দাবী আরও বেশি, আরও বেশি এলাকা চাই, আরও ক্ষমতা চাই, আরও অর্থ চাই। প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া উত্তরাখণ্ডের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মন্ত্রব্য করার পরে ঘিসিং-এর আশা বেড়ে যায়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লী গিয়ে দেখাও করেন, কিন্তু বসু আবার দক্ষভাবে বিষয়টির মধ্যস্থতা করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *