১১. দেবদর্শন উদগ্রীব হয়ে আমার সঙ্গে আসছেন

দেবদর্শন উদগ্রীব হয়ে আমার সঙ্গে আসছেন, যদিও আমি নিজেই জানি না ঠিক কী দেখাতে তাঁকে নিয়ে চলেছি। তবে আমি দেখেছি কোনো অলৌকিক প্রত্যক্ষণ বিষয়ে আমার পূর্বানুভূতি সচরাচর নির্ভুল হয়।

বিশালাক্ষী মন্দির পর্যন্ত মাটির সঁড়ি পথটায় দেখার মতো কোনো কিছু নেই, তারপর থেকেই পথ ভাগ হয়ে একটা চলে গেল নদীর দিকে। আর একটা পুজোর মণ্ডপের দিকে। এই দুই পথের সংযোগস্থলেই বিশালাক্ষী মন্দির। ভাগ হওয়ার জায়গাটা থেকে মন্দিরের দিকে এগোতেই চোখ পড়ল সারি সারি পায়ের ছাপ, সাদা রঙের কিছুতে পা ডুবিয়ে হাঁটলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। বাড়ির মেয়েরা চালবাটা কিম্বা খড়িমাটি গুলে যেমন মা লক্ষ্মীর পা আঁকে, অনেকটা সেরকম। পার্থক্য এই—পুজোর জন্য আলপনা হিসেবে আঁকা পায়ের ছাপ জোড়া জোড়া, মানে পাশাপাশি হয়। দেখলে মনে হয় যেন কেউ কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম করার জন্য দাঁড়িয়েছিল। আর এই যা ছাপ দেখছি, এ নকল ছাপ নয়। এ হল সত্যিকারের কোনো হেঁটে যাওয়া মানুষের পা। দু’জনে নিঃশব্দে মন্দির পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে দেখলাম কেবল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকবার দরজার সামনে পায়ের ছাপ এক জোড়া। অর্থাৎ যাঁর তিনি এইখানে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করেছিলেন।

সিঁড়ি বেয়ে আমরা দুজন মন্দিরের চাতালে উঠেছিলাম। শেষ জোড়া পায়ের ছাপের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার দিকে মুখ তুললেন দেবদর্শন। তার চোখে জল। বললেন—ঠাকুরমশাই, আমি যা ভাবছি তাই কি সত্যি?

—ঠিক তাই মুখুজ্জেমশাই। শুধু আপনার নয়, আমার জীবনও ধন্য।

পশ্চিমদিগন্তে হেলে পড়েছে চাঁদ। এবার রাত ফুরিয়ে আসছে। হেমন্তের শেষরাত্তিরে আকাশবাতাস আর পৃথিবী যেন কেমন এক রূপকথার দেশে পরিণত হয়। বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে আসা রাত্রিশেষের জ্যোৎস্না ঈষৎ শীতের ছোঁয়া আর পুজোমণ্ডপ থেকে দেবীবাড়ি ফেরা লোকজনের গলার মৃদু গুঞ্জন পরিবেশকে অবাস্তব আর অপার্থিব করে তুলেছে। এখন প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম আর বলবৎ নয়, এখন সবকিছুই ঘটতে পারে।

মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন দেবদর্শন। বললাম—সব মানুষ ভাগ্যবান নয়, কোন কোন মানুষ ভাগ্যবান। ক্ষমতা, টাকাপয়সা এসব অনেকেরই থাকে, কিন্তু আপনার জীবনে আজ যা ঘটল তা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই ঘটে। যাঁকে আজ দেখেছেন তিনি আপনার স্ত্রী নন। তিনি–

আমি চুপ করতে দেবদর্শন বললেন—কে তিনি? বলুন ঠাকুরমশাই–

—তিনি স্বয়ং দেবী। আপনি আজ দেবীর আশীর্বাদ পেয়েছেন।

দেবদর্শন বললেন—এখান দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছেন। এই তাঁর পদচিহ্ন! আমার স্ত্রীর রূপে তিনি দেখা দিলেন কেন? তবে, তবে কি–

এর আর কী উত্তর দেব? বললাম—মায়েরা সকলেই দেবী।

হাতের হালকা ছোঁয়ায় দেবদর্শন মন্দিরের দরজা খুললেন।

মাটির পিলসুজের ওপর মাটির তৈরি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে মন্দিরের ভেতর। অন্যদিন ছছাটমাপের রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলে, সেটিও পাশেই রাখা আছে। সন্ধ্যেবেলা নিত্যপূজার পর জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। এখনো তা জ্বলছে। সেই স্নিগ্ধ আলোয় দেবীর প্রস্তরময়ী প্রতিমা যেন মুখে সত্যিকারের হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। এবং–

এবং দেবীর মূর্তির ডানহাতে একটি উঁটিওয়ালা তাজা পদ্ম।

এরপরে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। আমি এবং দেবদর্শন করজোড়ে দেবীকে প্রণাম জানালাম।

দু’হাতে কড়া ধরে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিলেন দেবদর্শন। তারপর পেছন ফিরেই বললেন—এ কি!

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মন্দিরের চাতালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাদা সেই পদচিহ্ন আর নেই। শুধু চাতালেই নয়, সিঁড়ির ধাপে ধাপে এবং সঁড়িপথে শ্বেতসঙ্কেতে আঁকা সেই দেবীর পায়ের ছাপ আর কোথাও নেই। দেবী আমাকে এবং গৃহস্বামীকে জানিয়ে দিতে এসেছিলেন যে, তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল।

না ঘুমিয়েই রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে নদী থেকে স্নান করে এসে বৈঠকখানায় বসলাম। একটু পরে দেবদর্শনও ভেতরবাড়ি থেকে এসে বসলেন। তারও স্নান হয়ে গিয়েছে। রঘু এসে তামাক দিয়ে গেল। দেবদর্শনের মুখেচোখে দিব্যানুভূতির উদ্ভাস, ইনি যেন আর ঠিক কালকের সেই মানুষ নন। আজ যেন তিনি অনেক বেশি সৌম্য, অনেক বেশি গভীর।

বললাম-এবার যে আমাকে যেতে হবে মুখুজ্জেমশাই। অনেকদিন হয়ে গেল, আবার। পথ ডাকছে–

দেবদর্শন চমকে উঠে বললেন—সে কী! চলে যাবেন। কেন?

হেসে বললাম—পরিব্রাজকের এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে নেই, তাতে আসক্তি জন্মায়। এই যে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়, বন্ধুত্ব—এই পর্যন্তই ভাল। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে তা বন্ধন হয়ে পায়ে জড়িয়ে যাবে।

দেবদর্শন চুপ করে তামাক খেতে লাগলেন।

বললাম—কথাগুলো একটু নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে, না?

দেবদর্শন কিছু বললেন না।

-রাগ করবেন না। জীবনে কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা রূঢ় হলেও সত্য। এক জায়গায় থেকে জীবন কাটাবো এমন ইচ্ছে থাকলে তো বাড়িতেই থাকতাম, মাকে কাঁদিয়ে গৃহত্যাগ করতাম না। ভালবাসা, বন্ধুত্ব, প্রীতির সম্পর্ক—এসব খুব ভাল জিনিস, কিন্তু যে মোহ আবরণ মহত্তর সত্য থেকে আমাদের আড়াল করে রেখেছে তার থেকে মুক্তি পেতে হলে যতই কষ্ট হোক পথে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি আপনাদের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ছি। এবার যেতে হবে–

দেবদর্শন তামাক খেয়ে যেতে লাগলেন।

খোলা দরজা দিয়ে সকালের আলোয় উজ্জ্বল আমবাগান-বাঁশবাগান দেখতে পাচ্ছি। সঁড়িপথটা দিয়ে জাল কঁাধে গান গাইতে গাইতে একজন জেলে এবং তার পরে-পরেই একজন রাখাল কয়েকটা গরু নিয়ে মাঠের দিকে গেল। আজকালকার ছেলেদের ইস্কুলের পড়ার বইতে যেমন পাড়াগাঁর বর্ণনার সঙ্গে কবিতা থাকে—রাখাল গরুর পাল লয়ে যায়। মাঠে’—ঠিক তেমনি। আজকাল ছাত্রদের ছবি এঁকে আর কবিতা লিখে বোঝাতে হয় গ্রাম কেমন ছিল, বাঁশঝাড় কাকে বলে না, হেসো নাসত্যিই তাই। কলকাতা শহরে মোটরগাড়ি চেপে মানুষ হয়েছে এমন বড়লোকের ছেলেপুলেরা কেউই গ্রাম দেখেনি। মজার কথা কী জানো, এদের অনেকেরই আদি বাড়ি কিন্তু গ্রামে। এক বা দুই পুরুষ আগে এদের বংশের কেউ একজন হয়তো বেশি উপার্জনের লোভে বা অন্য কোন সুবিধের জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিল শহরে বাস করতে। তার দেখাদেখি আরো অনেকে। এদের গ্রামের প্রাচীন ভদ্রাসন ভেঙে পড়ছে, কার্নিসে বট-অশ্বথের চারা আর উঠোনে আগাছা জন্মাচ্ছে, কবজা থেকে দরজা ভেঙে ঝুলছে—কিন্তু দরজার কড়ায় তালা এখন আটকানো। এসব বংশের ছেলেপুলেরা এখন বড়বড় চাকরি করে, কেউ বালিগঞ্জে কেউ ভবানীপুরে বাড়ি করেছে। মজা ডোবা আর ম্যালেরিয়ায় ভরা গ্রামে তারা আর কেউ বাস করতে ফিরে যাবে না।

কিশোরী বলল—আমি কিন্তু একটি পরিবারকে জানি যারা প্রতিবছর নিয়ম করে অন্তত একবার গ্রামের বাড়ি যায়—

তারানাথ হেসে বলল—ওরকম দু’একটা উদাহরণ দিলে তো সত্য বদলাবে না। আমিও জানি কেউ কেউ আছে যারা সাধারণত দুর্গাপুজোর আগে গ্রামের বাড়িতে বছরে একবার করে ফিরে যায়, তোক লাগিয়ে আগাছা বা বনজঙ্গল পরিষ্কার করায়। সম্ভব হলে একবার হালকা চুনকাম করায়। তারপর ধূমধামে দুর্গাপুজো করে দেওয়ালির পর আবার কলকাতায় ফিরে আসে।

এবার আমি বললাম-সে তো ভালো কথাই, এতে নিন্দের কী আছে? বছরে অন্তত একবার হলেও তো তারা দেশের বাড়ির টানে ফিরে আসে।

তারানাথ বলল—জিনিসটা অত হালকাভাবে দেখো না। এরা সবাই যে জন্মভূমির টানে ফিরে যায় এমন নয়। কেউ কেউ গরিব গ্রামবাসী আর শরিকদের কাছে নিজের ঐশ্বর্য আর বৈভব দেখাতে যায়।

একটু থেমে একটা পাসিং শো ধরালো তারানাথ। মৃদুমন্দ টান দিয়ে সিগারেটের একচতুর্থাংশ শেষ কবে নারকেলের মালায়, ছাই ঝেড়ে সে বলল—আগে মানুষ অনেক বেশি ধর্মভীরু ছিল। শত দুঃখকষ্টেও ভদ্রাসন ছেড়ে যেতে চাইতো না। এখন আর ওসব। আবেগকে কেউ প্রশ্রয় দেয় না। উপার্জনের লোভে কোথাকার মানুষ কোথায় চলে যাচ্ছে কারো কোনো শেকড় নেই। সমাজ দিনে দিনে শিথিল হয়ে পড়ছে।

কিশোরী বলল—কিন্তু সামাজিক মানুষের এসব চলাচল না হলে পৃথিবীর উন্নতি হবে কী করে? সভ্যতা এগুবে কী করে? ভেবে দেখুন–

তারানাথ হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল—দাঁড়াও হে, ওসব যুক্তি আমি অনেক শুনেছি। যন্ত্রপাতি কলকারখানা রেলগাড়ি—এসব দরকার মানুষের উন্নতির জন্য। এখন তো শুনছি এরোপ্লেন না হলেও সভ্যতা অচল। ভবিষ্যতে আরও কত কী হবে কে জানে! আমি সে-সব দেখেও যেতে পারবো না। কিন্তু কথাটা হচ্ছে—এসবে কী মানুষের শান্তি বাড়ছে? হৃদয়ের নরম অনুভূতির যে-সমস্ত প্রকাশকে আমরা সভ্যতা বলি। তার কি কোন উন্নতি হচ্ছে? পকেটে অনেক টাকা। কিন্তু মনে শান্তি নেই, এমন অবস্থা কি কেউ চায়? এর চেয়ে কি সেই পাখিডাকা ফুলফোটা পাড়াগাঁই ভালো ছিল না? যাক, আসল গল্প ছেড়ে বড্ড বেশি তত্ত্বকথায় ঢুকে পড়েছি। গল্পটা শোন।

তারানাথ আবার শুরু করল।

আলবোলার নল মুখ থেকে সরিয়ে দেবদর্শন জিজ্ঞাসা করলেন—কবে যাবেন ঠিক করেছেন?

—দেখি, কাল তো আর হবে না, পরশু নাগাদ রওনা দেব। আজ একটু বাদে থেকেই কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ পড়বে। কোথাও যাওয়ার পক্ষে এটা ভাল তিথি নয়। দ্বিতীয়া পড়তে পড়তে কাল দুপুর গড়িয়ে যাবে। বিকেলের দিকে আর কোথায় যাব? দু’মাইল হাঁটতে না হাঁটতে অন্ধকার নেমে আসবে। হেমন্তকালের ছোট দিন।

দেবদর্শন একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—যাক, কালকের দিনটা তো অন্তত

আছে। ক জিজ্ঞাসা করলাম-ভূষণ রায়ের কথামতো লটারির টাকাটা বোধহয় মাসখানেকের মধ্যেই হাতে পেয়ে যাবেন। টাকা দিয়ে কী করবেন কিছু ঠিক করলেন?

—এখনো পাকাপাকি ভাবে কিছু ঠিক করিনি। তবে প্রথমে তো বাড়িটা মেরামত করব। বাড়ির মায়া বড় মায়া। পিতৃপুরুষের এতবড় বাড়ি, সবটা ভালোভাবে সারাতে পারবো না। পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকায় যতটা হয়—একটু হালকা মেরামত আর কী—যাতে আবার দেড়-দু’ পুরুষ অন্তত চলে যায়। তারপর উত্তরাধিকারীদের ভাবনা তারাই ভাববে। হাজার তিরিশেক টাকা জমা রাখব আমার স্ত্রীর নামে, তার সুদ জমতে থাকবে। আমার অবর্তমান ঘটলে তার কোনো অসুবিধে হবে না। তিনিও গত হলে ছেলেরা সে টাকা নিয়ে যেমন বুঝবে করবে। ভূষণ রায়কে দেব পাঁচ হাজার। বাকি টাকা সম্বন্ধে এখনো কিছু ভাবিনি, আগে হাতে তো আসুক। তবে কয়েক জায়গায় আমি সাহায্য করব বলে প্রতিশ্রুত, কী করে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব তাই ভাবছিলাম। যারা চেয়েছে তারাও খুব অসহায়। বিশ্বাস করুন, ঠাকুরমশাই, টাকা পেয়ে এইটেই আমার সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হয়েছে। ঈশ্বর আমার মুখ রক্ষা করলেন

—ছেলেদের কিছু দেবেন না?

—না ঠাকুরমশাই, সেভাবে কিছু দেব না। আমার সংসারে ওদের কোনো অভাব নেই, আর আমি না থাকলে সবই ওদের দুজনের। তবে দুজনকেই আমি নবদ্বীপে রেখে আচার্য স্তর পর্যন্ত ন্যায়-কাব্য-ব্যাকরণ পড়িয়েছি। শীগগিরই হয়তো ওরাই বাড়িতে টোল খুলবে। অর্থের গৌরব নিম্নমানের এবং ক্ষণস্থায়ী, আমি চাই ওদের পাণ্ডিত্যের গৌরব হোক

পরের দিন দুপুরে খাওয়ার সময় আমাদের দুজনকে পরিবেশন করলেন স্বয়ং দেবদর্শনের স্ত্রী। সেই পরাতের মত বিশাল কাঁসার থালায় ভুরভুরে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের গন্ধওয়ালা পোলাও, ঘন মুগের ডাল আর বেগুন ভাজা। তার সঙ্গে চাররকমের মাছের পদ।

বললাম—করেছেন কী মুখুজ্জেমশাই! এত কি খাওয়া যায়? আতিথেয়তারও তো সীমা আছে

দেবদর্শন বললেন—কিছু নয় ঠাকুরমশাই—আবার কবে আসবেন তার তত ঠিক নেই—বাড়ির এঁরা আপনার জন্য আজ যত্ন করে করেছেন, খেয়ে নিন–

মুখুজ্জেগিন্নীকে এর আগে ভাল করে কখনও দেখিনি। আমি স্বাভাবিক সঙ্কোচের জন্য সরাসরি কখনও তাকাইনি, তিনিও বাঁহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাথার কাপড় একটু টেনে ধরে রাখতেন। আজ খেতে খেতে কেন যেন মুখ তুলে হঠাৎ তার দিকে একবার তাকালাম। তাকিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। পদ্মপলাশাক্ষী কথাটা সংস্কৃতে দেবীদের স্তবে প্রচলিত আছে, বাঙলার অখ্যাত এক পাড়াগাঁর পড়ন্ত জমিদারবধূর যে এমন দেবীর মত আয়ত পদ্মপলাশ লোচন হবে তা কে জানত! অতসী ফুলের মত গায়ের রং, কোঁকড়া চুল, সূর্যের গোলকের মত উজ্জ্বল সিঁদুরের টিপ, আর তার নীচে গভীর মাতৃত্বেপরিপূর্ণ ঐ দুটি টানাটানা বিশাল চোখ! হ্যাঁ, জগদ্ধাত্রীর মত রূপ বটে! তিনিও ক্ষণিকের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে বাৎসল্যের মৃদুহাসি হাসলেন।

পরক্ষণেই আমি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।

একটু দেরি করে হলেও সেদিন চাঁদ উঠল ভারি চমৎকার। নদীর ধারে বেড়িয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের খোলা দরজা দিয়ে একবার দেবীকে প্রণাম করে মুখুজ্জে বাড়িতে এলাম। বৈঠকখানায় বসে তামাক খাচ্ছেন দেবদর্শন। আমাকে দেখে বললেন—আসুন ঠাকুরমশাই, বসুন। ওরে রঘু, ঠাকুরমশাইকে তামাক দিয়ে যা–

তামাক এল। টান দিতে দিতে বললাম—আগামীকাল এই সময় কোথায় আছি কে জানে। সত্যি, মায়া পড়ে যাবার আগেই আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল।

দেবদর্শন বললেন—যাবেন তো কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে, তার এখন একটা রাত আর একটা বেলা বাকি। এখন বলুন রাত্তিরে কী খাবেন? মাংস চলবে?

হেসে বললাম–ওকথাও এখন থাক। দুপুরে যা ঠেসে খেয়েছি, রাত্তিরে আর খেতে পিরবো মনে হয় না। রান্নাও হয়েছিল চমৎকার। সবই বুঝি বউঠাকরুণের রান্না?

দেবদর্শন একটা স্মিত হাসি হেসে বললেন-হা, আজ প্রায় সব রান্নাই অতিথির জন্য বিশেষ করে আমার স্ত্রী বেঁধেছেন—

বললাম—সবচেয়ে ভাল হয়েছিল পোলাওটা। গাওয়া ঘি আর মশলা সব দোকানেই পাওয়া যায়, যে কেউ কিনে আনতে পারে। কিন্তু সবাই কী এমন সুন্দর পোলাও রাঁধতে পারে?

দেবদর্শনের আলবোলা টানার শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

আমার দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে বললেন—পোলাও! কিন্তু আজ দুপুরে তো পোলাও রান্না হয়নি। কী বলছেন আপনি! আমি তো আপনার পাশেই বসে খেলাম–

—আপনি কী খেলেন?

দেবদর্শন বললেন—কেন, সাদা ভাত! চালটা অবশ্য খুবই ভাল ছিল, রামচন্দ্রপুর থেকে আনানো এক নম্বর বাসমতী—কিন্তু তা সে যত ভাল চালই হোক, পোলাও তো কোনোমতেই নয়—

—আপনি কী খেয়েছেন? সাদা ভাত?

—অবশ্যই-কারণ সাদা ভাত ছাড়া কিছু রান্নাই হয়নি।

হেসে বললাম-এবার পুজোর সময়টা ভালই কাটল মুখুজ্জেমশাই, বলুন? শুধু টাকার কথা বলছি না। লটারিতে অর্থাগম প্রতিবছরই কারো না কারো হয়। কিন্তু এবার আপনি গড়ের তোপ শুনলেন, স্বয়ং দেবীকে পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে যেতে দেখলেন। আর আজকের এই পোলাও-এর ব্যাপারটা–

দেবদর্শন মুখ থেকে নল সরিয়ে বললেন—আর অমরজীবনের ব্যাপারটা? তার তো কোন ব্যাখ্যা হল না। কোথা থেকে এসেছিল সে, কোথায়ই বা গেল, কীই-বা তার পরিচয়? আপনি কী কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন ঠাকুরমশাই?

-আন্দাজ করতে হয়তো পেরেছি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।

–কী আন্দাজ করেছেন?

—ঠিক বোঝাতে পারব না মুখুজ্জেমশাই। এই সৃষ্টির রহস্য বড় বিচিত্র, সেই বৈচিত্র্যেরই একটা অংশ অমরজীবন। কেন এই পৃথিবী আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল, সে কেউ কি জানে? তেমনিই অমরজীবনের পরিচয়—একটা আকস্মিক আবর্তের মত হঠাৎ সে সৃষ্টির ভেতর জেগে উঠেছে, তার কোনো কারণ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে এটুকু বুঝেছি—তার অস্তিত্ব একটা বড় মাপের শুভশক্তির প্রকাশ

দেবদর্শন বললেন—কী রকম?

বললাম–সৃষ্টির মুহূর্তেই শুভ আর অশুভ দুরকম শক্তি তৈরি হয়েছিল, এ কথার সমর্থন পৃথিবীর সব ধর্মশাস্ত্র আর দর্শনে পাবেন। যেমন আলো আর অন্ধকার, মহত্ত্ব আর নীচতা। এও প্রকৃতির একটা সঠিক আইন, আসল বস্তু না থাকলে পরিপূরক এবং বৈপরীত্যের ধারণা আসবে কী করে? শাসকের অত্যাচার, ধর্মান্ধতা, ধনীদের দম্ভ, নিষ্ঠুরতা—এসবের ভেতর দিয়ে অশুভ শক্তি নিজেকে প্রকট করে। আর উলটো দিকে শুভ আর মহৎ বিশ্বশক্তি নিজেকে স্পষ্ট করে তোলে মহাপুরুষের বাণী, দেশপ্রেমীর আত্মোৎসর্গ, বৈজ্ঞানিকের নিঃস্বার্থ কর্ম—এর মাধ্যমে।

দেবদর্শন বললেন—তার কী প্রয়োজন ছিল? এত জটিল ঝামেলায় না গিয়ে ঈশ্বর তো অবিমিশ্র ভালোও সৃষ্টি করতে পারতেন?

বললাম-এর উত্তর আমি দিতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস দুনিয়ায় অকারণে কিছুই ঘটে না। কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু আমার সঙ্গে পরামর্শ করে জগৎ সৃষ্টি করেন নি, তাই সব রহস্যের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত। তবে একটা কথা বলি, যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, ঈশ্বরে মতি স্থির রাখবেন। যে যাই বলুন, তিনি আছেনই।

 

পরের দিন সকালবেলা জলখাবার খাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের প্রান্ত অবধি এগিয়ে দিতে এলেন দেবদর্শন। আমি বারণ করেছিলাম, তিনি শুনলেন না। গ্রামের একেবারে শেষ সীমায়, একটা মহানিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাকে বললাম—আর নয়, এবার ফিরে যান। আবার দেখা হবে–

ব্যগ্রভাবে আমার হাতদুটো ধরে দেবদর্শন বললেন–দেখা হবে বলছেন?

একটু ইতস্তত করে বললাম দেখা হবে। আর যদি কোন কারণে আমাকে খুব প্রয়োজন হয় তাহলে–

—কী তাহলে?

—তাহলে নির্জনে কোথাও দাঁড়িয়ে মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে একান্তভাবে আমার দেখা পেতে চাইবেন। যেখানেই থাকি না কেন, আমি ঠিক জানতে পারব।

—ব্যস, এতেই হবে? মধুসুন্দরী দেবী কে?

বললাম—এতেই হবে। মধুসুন্দরী দেবী আমার আরাধ্যা। কী করে আপনার ডাক শুনতে পাবো আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, কারণ আমিও তার উত্তর জানি না।

আর পেছনে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

গল্প থামিয়ে তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—আজ এই পর্যন্ত থাক। সামনে যেদিন আসবে সেদিন আবার কিছুটা বলা যাবে।

কিশোরী বলল—গল্প শুনতে তো খুবই ভাল লাগে। কিন্তু চট করে ফুরিয়ে যাবে না তো?

তারানাথ হেসে বলল-ফুরিয়ে যাবে কী হে! এই তো সবে পানিফলের ঝকে টান দিয়েছি। পুরো ঝাক এক জায়গায় হতে এখনো দেরি আছে। আচ্ছা, সামনের দিন বলা যাবে বাকিটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *