এগার
দু’চারটে বোম পড়লেই ঈশ্বরপুকুর লেনের তিন নম্বর আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ক্রাচ বগলে নিয়ে অবিনাশের ঝাঁপ সরিয়ে গলিতে নেমে অনিমেষ দেখল চারধার ফাঁকা। অবিনাশ অবশ্য তখনও তাকে বের হতে নিষেধ করেছিল কিন্তু অনিমেষের আর ওই বদ্ধ ঘরে বসতে ইচ্ছে করছিল না। খানিকটা মদ পেটে যাওয়ার পর ওদের কথাবার্তায় তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। গা ঘিনঘিন করছিল। জনার্দন এখন অবলীলাক্রমে অশ্লীল শব্দ বলে যাচ্ছে। ঝাঁপ সরাবার আগে অবিনাশ বলেছিল, ‘তাহলে কাজটা কাল থেকেই শুরু করে দিন। খাঁ সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নাও জনার্দন।’
অনিমেষ মাথা নেড়েছিল, ‘না। ছেড়ে দিন।’
জনার্দন তার লাল চোখ ছোট করেছিল, ‘একি কথা?’
‘পেন্সিলার হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে অনেক স্বস্তির। আপনারা আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করতে পারব না।’
অবিনাশ চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘ওসব বড় বড় বুলিতে পেট ভরবে?’
অনিমেষ বলেছিল, ‘এ আপনি বুঝবেন না।’
গলিতে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল অনিমেষ। কথাগুলো মাধবীলতাকে বলাও যাবে না। চমকে উঠে বলবে, ‘তুমি ওই কথা অতক্ষণ ধরে শুনলে?’ অবিনাশ অবশ্য তার ভালর জন্যেই নিজের গণ্ডীতে যা সহন তাই বলেছে। ওর কি দোষ!
অনিমেষ অন্ধকার ঘরগুলোর দিকে তাকাল। তারপর ঠুক ঠুক করে গলির মুখের দিকে এগোল। এখনও মাধবীলতা ফেরেনি। ইন্দ্র বিশ্বাস রোড এমন কিছু দূরে নয়। সেখান থেকে পড়িয়ে ফিরতে এত রাত হয় কেন? মেজাজ বিগড়ে ছিল, এখন বেশ রাগ হল। সে এই গলির বন্ধ ঘরে দিনের পর দিন পড়ে আছে আর মাধবীলতা কেমন ড্যাং ড্যাং করে বিশ্বচরাচরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কয়েক পা এগোতেই খ্যানখেনে গলাটা কানে এল, ‘কে যায়?’
অনিমেষ বাঁ দিকে তাকাল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘আমি।’
‘আমিটা কে? নাম রাখেনি নাকি বাপ মা?’
‘অনিমেষ।’
‘অনি অ। মাস্টারনির বর?’
প্রথম শব্দটি কানে যাওয়া মাত্র অনিমেষের সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুতের ছোঁওয়া লাগল। অনি। অনেক অনেকদিন বাদে এই ডাকটা শুনল সে। মুহূর্তেই মনের সব বিস্বাদ কিংবা জ্বালা মিলিয়ে গেল। ও নিচু গলায় জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’
‘তা এখানে কি করতে এয়েছ? তুমি নুলো মানুষ, চারপাশে গোলমাল হচ্ছে, আসা উচিত হয়নি।’ মোক্ষবুড়ি একই স্বরে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। অনিমেষ আবার সচেতন হল। নুলো মানুষ। শালা এই বুড়িও তাকে করুণা করছে! সে কথা না বলে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। মোক্ষবুড়ি সেটা বুঝতে পেরেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার নাতিটাকে চেন? কিলা গো, ওকে দেখলে পাঠিয়ে দিও। মাস্টারনির বর, শুনতে পাচ্ছ?’
অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল। তার পরিচয় এখন মাস্টারনির বর, নুলো। চমৎকার। সে ঈশ্বরপুকুর লেনটাকে দেখল। একদম ফাঁকা হয়ে রয়েছে রাস্তা। নিমুর চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। হাঙ্গামাটা বেশ জব্বর ধরনের মনে হচ্ছে। অনিমেষ আরও কয়েক পা এগোল। এ পর্যন্ত কখনই আসে না সে কিন্তু আজ তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। অবশ্য থাই-এর কাছে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা খুবই সামান্য। মিছিমিছি ভয় পেয়ে অ্যাদ্দিন ঘরে আটকে ছিল। অনিমেষ বুঝতে পারছিল না সে ট্রামবাসে উঠতে পারবে কিনা। কিন্তু বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে অনেকটা নিশ্চয়ই হাঁটতে পারবে।
একটা কাজ চাই। একটু আগে জনার্দনরা যে কাজের কথা বলল সেটা সে করতে পারবে না। কেন পারবে না? অনিমেষ নিজেকেই প্রশ্ন করল। নিশ্চয়ই শ’য়ে শ’য়ে লোক এই কাজ করে। তাহলে সে করতে পারবে না কেন? মাধবীলতা কি বলবে সেই সঙ্কোচে? নাকি সেই অনিমেষ যে এককালে অনেক বিরাট আদর্শের কথা মাথায় রাখত, এই দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে নিজেকে বিরাট বলে ভেবেছিল সেই কি ছি ছি করে উঠল। সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে যার, শুধু অসহায় চোখে চারধার দেখে যাওয়া ছাড়া যার অন্য কোন ভূমিকা নেই তার এত উঁচু নাক হবে কেন? ওসব আদর্শ রুচিফুচি মাথায় কেন যে পোকার মত কুটকুট করে? এই যে হাজার হাজার ছেলে বিপ্লবের আশায় প্রাণ দিল, তার মতন অগুনতি মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে রইল তাতে এই দেশের কোন পরিবর্তন হয়েছে? সাধারণ মানুষের মনে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা আসা দূরের কথা, সামান্য ঢেউ পর্যন্ত ওঠেনি। বরং আগের চেয়ে মানুষ এখন নিজের আখের গোছাতে বেশী ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেরেফ বোকামি, ওইসব আদর্শের নামে বাছবিচার করে নাক সিঁটকানো মানে আত্মহত্যা করা। কেউ তোমার মুখে খাবার তুলে দেবে না, যে দেবে সে করুণা দেখাবে। মনে মনে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও অনিমেষ বুঝতে পারছিল সে হেরে যাচ্ছে। ওই ছাঁচটাকে এই জীবনে ভাঙ্গা যাবে না। হয়তো এটা সুস্থ থাকার অহঙ্কার। সবই তো গেছে শুধু এটুকু আঁকড়ে যদি বাকি জীবনটা চলে যায় তো যাক।
ঠিক এইসময় মাধবীলতাকে দেখতে পেল অনিমেষ। খুব ত্রস্ত পায়ে ট্রাম রাস্তার দিক থেকে আসছে। দেখতে দেখতে অনিমেষের চোখে মুগ্ধতা নামল। বাঃ, এখনও তো ওকে বেশ মিষ্টি দেখায়। প্রতিদিন ওই ছোট্ট ঘরের সীমাবদ্ধতায় এই রূপ চোখেই পড়েনি। ক্লান্ত, বয়সের সামান্য আঁচড় সর্বাঙ্গে কিন্তু মাধবীলতার এমন কিছু এখনও অবশিষ্ট রয়েছে যা অনিমেষের নিজের নেই, এক ফোঁটাও নেই।
তাকে দেখা মাত্র মাধবীলতা যেন আঁতকে উঠল, ‘তুমি!’
অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, ‘এলাম।’
‘এতটা এসেছ কেন? এইজন্যে আবার ভুগতে হবে।’ মাধবীলতা সামনে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর এই ব্যস্ততা দেখে অনিমেষ ছোট চোখে তাকাল, ওকে কি সারাজীবন শুইয়ে রাখতে চায় মাধবীলতা? একটু আগের নরম ভাবটা চট করে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তাই সে বলল, ‘না, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ তো চলে এলাম।’
‘পায়ে লাগছে না?’
‘এমন কিছু না।’
‘কিন্তু তুমি খুব রিস্ক নিয়েছ!’
‘কেন ভাবছ এত! আমারটা আমি বুঝি না?’
কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতা চট করে মুখ তুলে অনিমেষকে দেখল। দেখে হাসল, ‘তাহলে তো ভালই।’
কথা ঘোরানোর জন্যে অনিমেষ বলল, ‘একটু আগে এখানে খুব গোলমাল হয়ে গেছে। বোম ফেটেছে।’
মাধবীলতা বলল, ‘রাস্তা দেখে তাই মনে হচ্ছে। খোকা পড়ছে?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, ‘এখনও ফেরেনি।’
‘সেকি! পাড়ায় ছিল গোলমালের সময়ে?’
‘জানি না।’
‘উফ্। আমি যে কি করি! আজ বাড়ি ফিরুক, একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়ব।’ মাধবীলতা গর্জে উঠল যেন।
‘সে তো রোজই করছ। এভাবে হবে না।’
‘কিভাবে হবে?’
‘সেটাই তো জানি না। তাছাড়া কি হওয়াতে চাও সেটা জানো?’
‘কি আবার? ও পড়াশুনা করুক, শিক্ষিত হয়ে নিজেরটা বুঝে নিক, এছাড়া আর কি চাইব আমি?’
‘তারপর? তারপর আর একটা ভেড়া হয়ে পালে ঢুকে যাক। পাশ করে বেকার হয়ে বসে থাকুক কিংবা সামান্য কেরানি হয়ে সন্তান উৎপাদন করে বংশ রাখুক—এই তো? ও যখন আমাকে এইসব প্রশ্ন করে আমি নিজেই জবাব দিতে পারি না। তুমি ওকে যে পথে নিয়ে যেতে চাও তার সুস্থ পরিণতি কি তা যখন জানো না তখন আর এই নিয়ে হেস্তনেস্ত করে কি লাভ। লতা, আমাকে একটু ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে?’
মাধবীলতা চমকে উঠল, ‘তুমি যেতে পারবে?’
‘চল না।’
মাধবীলতা ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেন রাজি হল। ফুটপাথ ধরে অনিমেষের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সে কথাগুলো ভাবছিল। অনিমেষ একটু আগে যা বলল তা সত্যি। কিন্তু কোন মা চাইবে তার সন্তান বকে যাক, একটা গুণ্ডা তৈরি হোক! সামনে কোন ভবিষ্যৎ নেই জেনে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রাজনীতির কথা একদম বলে না অনিমেষ। তার রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি মাধবীলতা। কিন্তু একটা কথা সে বোঝে, মরে যেতে তো একদিন হবেই তাই বলে আজকে আমি বেঁচে আছি এটা মিথ্যে? অসুখ করলে ওষুধ খাবে না?
ধর্মতলায় মাত্র কয়েকটা জায়গা চেনা অর্কর। ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে বেরিয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত মনে হয় ওটা নিজের এলাকা কিন্তু এখানে এলেই বেশ অস্বস্তি হয়। তার ওপর বিকেল বেলায় এত মানুষের ভিড় যে তাল রাখা মুশকিল। তাই রাস্তাটাকে খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল।
নিচে ঝকঝকে দোকান পাট, ফুটপাথ ঘেঁষে রিকশার লাইন, অর্ক সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারল এটাই নার্সিংহোম। ব্যাপারটা সত্যি জেনে একটু ভরসা হল এখন। কিন্তু ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক লোক রয়েছে; তাদের কি বলবে সে? হারখানার কথা তো চেঁচিয়ে বলা যাবে না। ওকে দেখে যদি না আসে? যদি ব্যস্ত আছে বলে কাটিয়ে দেয়? অর্ক অস্বস্তিতে পড়ল। তারপর মনে মনে কয়েকটা অজুহাত তৈরি করে নিয়ে সামনে পা বাড়াল। বড় চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসেই নার্সিংহোমের গেটটা দেখতে পেল সে। ওপরে লাল ক্রশের ভেতরে আলো জ্বলছে। অর্ক দরজায় আসতেই একটা দারোয়ান গোছের লোক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই?’
‘একজনকে ডেকে দিতে হবে।’ কথাটা বলেই অর্ক বুঝতে পারল কেমন হুকুমের সুর এসে গেল গলায়। ঈশ্বরপুকুর লেনে যেভাবে কথা বলে এখানে সেভাবে বলা চলবে না। লোকটার চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্টতই বিরক্তি। তবু জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে?’
‘ঝুমকি।’
‘ঝুমকি!’ একটু একটু করে রহস্যের হাসি হাসল লোকটা, ‘ওই নামে এখানে কেউ নেই। অন্য কোথাও যাও ভাই।’
এবার বেশ অসহায় হয়ে পড়ল অর্ক। ঝুমকি যদি এখানে না থাকে তাহলে হারখানা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। জায়গাটা মোটেই ভুল করেনি সে, ঝুমকি যদি বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে আসে তাহলে অবশ্য—।
এইসময় একজন নার্স খুব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তার সেন এসেছেন?’
দারোয়ান মাথা নাড়ল, না। মহিলা চলে যাচ্ছিল, দারোয়ান তাকে ঠাট্টার গলায় বলল, ‘ঝুমকি বলে কেউ আছে নাকি?’
মহিলা ঘুরে দাঁড়াল, ‘কে ঝুমকি?’
অর্ক এবার এগোল, ‘এখানে কাজ করে শুনেছি।’
‘কি কাজ? নার্স না আয়া?’
‘আয়া।’ কথাটা সেরেফ, অনুমানের ওপর বলে ফেলল অর্ক।
‘এই নামে তো কোন আয়া নেই ভাই। অন্তত এখানে নেই।’
‘ও।’ অর্ক হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। হয়তো তার মুখ দেখে মহিলার মনে কোন ছায়া পড়ল, ‘কোত্থেকে আসে বল তো?’
‘বেলগাছিয়া। বেশী বয়স নয়।’
‘বেলগাছিয়া? কি রকম দেখতে?’
ঝুমকিকে কি ভাবে বর্ণনা করবে অর্ক। কালো, রোগাটে তবে মুখখানা ভাল আর খুব দুর্নাম আছে, এই তো। যেটুকু পারল খুঁটিয়ে বলল সে। মহিলা সব শুনে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, এরকম একটা মেয়ে এখানে কাজ করছিল কিছুদিন। তবে তার নাম ঝুমকি নয়। কিন্তু তার সঙ্গে তোমার কি দরকার?’
এবার যেন একটু আলো দেখতে পেল অর্ক। চটপট সাজানো অজুহাত জানালো সে, ‘আমি ওদের পাশের ঘরে থাকি। আজ বিকেলে মাসীমা, মানে ঝুমকির মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঝুমকির বাবা এই ঠিকানায় আমাকে খবর দিতে পাঠালেন।’
‘ওমা, তাই?’
‘হ্যাঁ।’ মুখখানা যতটা সম্ভব বিমর্ষ করল অর্ক।
‘আচ্ছা, তুমি এসো আমার সঙ্গে।’ মহিলা তাকে ডেকে ভেতরে চলে যেতে অর্ক অনুসরণ করল। সেই হাসপাতাল-হাসপাতাল গন্ধ। আরো কয়েকজন নার্স ব্যস্ত হয়ে হাঁটাচলা করছে। মহিলাকে অনুসরণ করে অর্ক একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। তিনজন বিভিন্ন বয়সী আয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে গল্প করছে। মহিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘মালতীদি, বেলগাছিয়া থেকে একটা কালো মেয়ে এখানে কদিন ছিল তোমার মনে আছে?’
যাকে বলা হল তার বয়স হয়েছে। শরীর বেশ স্থূলা। চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তা আর মনে নেই। বন্ধ ঘড়ি পরে থাকত!’
মহিলার এবার মনে পড়ল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’
পৃথুলা বলল, ‘তা তাকে প্রয়োজন?’
মহিলা অর্ককে দেখাল, ‘এই ছেলেটি ওর পাশের ঘরে থাকে। বাড়িতে অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে। এখানে সে আর কাজ করে না তাও জানায়নি।’ পৃথুলা বলল, ‘কাজ করল আর কোথায়! কাজ জানে যে করবে? অ্যাকসিডেণ্ট কার হয়েছে?’ ‘মায়ের।’ অর্ক উত্তর দিল, ‘বেশীক্ষণ বাঁচবে না।’
‘অ।’ তারপর ইশারায় মহিলাকে কাছে ডাকল পৃথুলা। অর্ক বুঝল কিছু গোপনীয় কথাবার্তা হবে। একটু বাদে মহিলা বেরিয়ে এসে বলল, ‘শোন ভাই, তুমি যাকে খুঁজছ এ সে নাও হতে পারে। কারণ নামটা মিলছে না। বেলগাছিয়া থেকে এসে যে এখানে ছিল তার নাম লতিকা দাস। কুমকির পদবী কি দাস?’
জানে না অর্ক, তবু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
‘এ লাইনে অনেকে নাম পাল্টায়। তাই সঠিক হবে কি না জানি না। আমি খুব কম দেখেছি। মালতীদির কাছে শুনলাম সে নাকি আর আয়ার কাজ করছে না। নাচ শিখছে।’ মহিলা ঠোঁট টিপে হাসল।
‘নাচ?’ অর্ক হতভম্ব।
‘হ্যাঁ। সত্যি কি না তুমি একবার গিয়ে দেখতে পার। অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে যখন তখন খবর দেবার চেষ্টা করো।’ মহিলা ওকে ঠিকানাটা বলে দিল। চৌরঙ্গী লেন। অর্ক কখনও ওদিকে যায়নি।
রাস্তায় নেমে অর্ক বুঝতে পারছিল না কি করবে। চারধারে এখন ঝকঝকে আলো। সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত নেমেছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরলে ভাল হত। মায়ের সঙ্গে দুপুরে কথাবার্তার পর এটুকু সে করবে ঠিক করেছিল। কিন্তু হারের সন্ধান না পেলে ফিরবে কি করে? যা হয় হোক, আর একদিন না হয় বাড়িতে ঝামেলা হবে কিন্তু হারখানার জন্যে শেষ চেষ্টা করবে সে।
কিন্তু ঝুমকি কি করে লতিকা দাস হবে? তার ওপর নাচ, ভাবাই যায় না। অর্কর মনে হল পুরোটাই ভুল হয়ে যাচ্ছে। তিন নম্বরের মেয়ে চৌরঙ্গী লেনে নাচ শিখতে আসবে কেন? আর নাচ শিখলে কি টাকা পাওয়া যায়? খানিকক্ষণ দোনামনা করে অর্ক চৌরঙ্গী লেনের উদ্দেশে পা বাড়াল।
জিজ্ঞাসা করে করে গ্লোব সিনেমার পেছনের রাস্তায় চলে এসে অর্কর মনে হল জায়গাটায় মানুষজন তেমন নেই। মাঝে মাঝে দু’একটা রিকশা কিংবা ট্যাক্সি ছুটে যাচ্ছে। বিচিত্র চেহারার দুজন সাহেব হই হই করতে করতে চলে গেল। আলো কম রাস্তায়। নম্বর মিলিয়ে অর্ক যখন হাঁটছে তখন একটা লোক অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল, ‘স্কুল গার্ল? ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ?’
অর্ক হতভম্ব। কোনরকমে বলল, ‘মানে?’
লোকটা বোধহয় ততক্ষণে অর্ককে বুঝতে পেরেছে। চোখ কুঁচকে আমজাদ খানের মতন মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই এখানে?’
ভঙ্গী দেখে অর্কর মেজাজ গরম হল। কিন্তু লোকটার চেহারা বিশাল এবং পাড়াটা তার সম্পূর্ণ অজানা। লোকটা আবার বলল, ‘আব্বে, কি চাই?’
এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেল অর্ক। কোনরকমে বলতে পারল ঘটনাটা। বাড়িতে অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে বলে সে খবর দিতে এসেছে। এপাড়ার কিছুই সে চেনে না। কোন বাড়ি তাও জানে না। বোধহয় দয়া হল লোকটার কারণ কোন কথা না বলে সে অর্ককে নিয়ে খানিকটা পথ এগিয়ে চিৎকার করল, ‘হ্যায় বিল্, বিল্।’
একটু বাদেই বিরাট চেহারার একটা কালো কুচকুচে লোক চুরুট মুখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। নিচের লোকটা বলল, ‘হেয়ার ইজ এ চিকেন ফর য়ু।’ বলে অর্ককে একটা দরজা দেখিয়ে দিল।
অর্ক বুঝতে পারছিল জায়গা মোটেই সুবিধের নয়। কিন্তু এখান থেকে ফেরার কোন উপায় নেই। শক্ত হবার চেষ্টা করতে করতে সে দরজা পেরিয়ে ডান দিকে একটা সিঁড়ি দেখতে পেল। সিঁড়িতে আলো নেই। ওপরে উঠতেই দরজা খুলে সেই কালো লোকটা চুরুট মুখে এসে দাঁড়াল ‘কি ব্যাপার?’
কাঁপা গলায় অর্ক আবার গল্পটা বলল।
‘লতিকা দাস?’ ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞাসা করল লোকটা। অর্ক শুনতে পাচ্ছিল ভেতর থেকে উদ্দাম বাজনা ভেসে আসছে। পুরুষ ও নারীকণ্ঠে তার তালে উল্লাস উঠছে।
‘ও এখানে আছে তা কে বলল?’
অর্ক তখন নার্সিংহোমের কথা জানাল।
‘খুব অসুস্থ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাকে চেনে ও?’
‘হ্যাঁ।’
‘কাম ইন।’ ইঙ্গিতে ভেতরে আসতে বলে লোটা চিৎকার করল, ‘ডরোথি, ডরোথি?’
একজন প্রৌঢ়া মেমসাহেব ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়াল, ‘হাই! কান্ট দে ওয়েট অ্যানাদার ফাইভ মিনিটস?’
লোকটা বলল, ‘না সে ব্যাপার নয়। মিস ডি-কে এখনই ডেকে দাও। খুব জরুরী দরকার, বাড়ি থেকে লোক এসেছে।’
মেমসাহেব বলল, ‘সেকি! ঠিকানা জানল কি করে?’
‘সেটা পরে হবে। পাঠিয়ে দাও।’
মেমসাহেব চলে যেতে লোকটা পাশের আর একটা ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর পাঁচমিনিট অপেক্ষা করুন স্যার, নাচের কোর্স শেষ হয়ে এসেছে। নাইট ইজ টু ইয়ং।’
পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফেরাতেই পাথর হয়ে গেল অর্ক। একি ঝুমকি? চকচকে একটা কালো প্যাণ্ট শরীর চেপে হাঁটুর এক ইঞ্চি নিচে শেষ হয়েছে। এক পিস কাপড়ের একটা কলার তোলা জামা নাভির অনেক ওপরে আচমকা থেমে গেছে। চুল চুড়ো করে বাঁধা। ঘরে ঢুকেছিল প্রায় নাচতে নাচতে, কিন্তু ঢুকেই চমকে উঠল। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
লোকটা কড়া গলায় বলল, ‘একে চেন?’
ঠোঁট বেঁকাল ঝুমকি। বোধহয় প্রথমে ভেবেছিল অস্বীকার করবে তারপর হয়তো মন পাল্টাল, মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
‘ও বলছে তোমার বাড়িতে অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে। আমি তোমাদের প্রত্যেককে বলে দিয়েছি যে প্রাইভেট প্রবলেম যেন এখানে না আসে। ও তোমার ঠিকানা পেল কি করে?’
‘আমি জানি না।’ ঝুমকির গলা কাঁপছিল।
লোকটা বিরক্তিতে কাঁধ নাচাল; ‘এরকম ঘটনা আর যেন না ঘটে।’ কথাটা বলে লোকটা ভেতরে চলে যেতেই ঝুমকি সাপের মত মাথা তুলল, ‘কেন এসেছ?’
‘তোমার মায়ের অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে। হাসপাতালে আছে।’ অম্লানবদনে কথাগুলি বলল অর্ক।
‘মা!’ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ঝুমকি, ‘কখন? কি হয়েছে?’
‘তুমি চলে আসার পরই। তোমার বাবা খবর দিতে নার্সিংহোমে পাঠিয়েছিলেন, সেখান থেকে এখানে। দেখতে চাও তো তাড়াতাড়ি চল।’
অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র ঝুমকি একছুটে ভেতরে চলে গেল। যাক, কাজ হয়েছে, অর্ক অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল। এখান থেকে বের না করে ঝুমকিকে কোন প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। সে পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল দেওয়াল জুড়ে বিরাট বিরাট ফটোগ্রাফ। খাটো পোশাক পরে নাচের ভঙ্গীতে কয়েকটা মেয়ে পাশাপাশি। তাদের শরীরের প্রায় সবটাই দেখা যাচ্ছে। তলায় লেখা আছে, মিস টি, মিস এন, মিস পি•••এইসব। ঝুমকির ছবি এখানে নেই। এটা কি তাহলে নাচের স্কুল? ঝুমকি এত পয়সা খরচ করে এখানে নাচ শিখতে আসে? কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না ব্যাপারটা। ঝুমকিকে লোকটা কি বলে সম্বোধন করল যেন, ও হ্যাঁ, মিস ডি। ঈশ্বর পুকুর লেনের ঝুমকি এখানে মিস ডি হয়ে গেল কি করে?
এইসময় ভেতরের ঘর থেকে একটা মেয়ে পরীর মত উড়তে উড়তে বেরিয়ে এসে পাশের ঘরে ঢুকে হেসে ভেঙ্গে পড়ল। চকচকে রঙিন পোশাক এক পলকের জন্যে অর্কর সামনে চলকে উঠেছিল। সে চট করে পেছনটা দেখে নিল, ছবির একজনই বোধহয় ওই ঘরে গেল যেখানে পুরুষ রয়েছে। তবে ছয়জনের কোন জন তা বুঝতে পারল না অর্ক। এইসময় ঝুমকি বেরিয়ে এল কমদামী প্রিন্টেড শাড়ি, লাল ব্লাউজ, তিন নম্বরে এই পোশাকে অনেকবার দেখেছে অর্ক।
সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ঝুমকি পরিষ্কার হিন্দিতে চেঁচিয়ে কাউকে রিকশার কথা বলল। অর্ক বলল, ‘চল। রিকশা কি হবে?’
ঝুমকি মাথা নাড়ল, ‘এ পাড়ায় হেঁটে যাওয়া নিষেধ আছে।’
অর্ক আবার ঝুমকিকে দেখল। মুখে চোখে এখন প্রসাধন একটুও নেই। অ্যাকসিডেণ্টের খবর পেয়ে খুব ঘাবড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে।
একটু বাদেই নিচ থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘রিকশা।’
ওরা নিচে নেমে এল। সামনেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। প্রথমে ঝুমকি উঠল, তারপর অর্ক। রিকশাওয়ালা সামনের পর্দা ফেলে দিয়ে হ্যাণ্ডেল তুলে নিল। ঠুন ঠুন করে রিকশাটা খানিক এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিল। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘এদিকে কোথায় যাচ্ছে?’
‘ঠিক যাচ্ছে। ও জানে। ট্রাম রাস্তা।’ তারপর সামান্য ঘুরে ঝুমকি অর্কর হাত চেপে ধরল, ‘তোমার পায়ে পড়ি পাড়ার কাউকে বলো না আমি এখানে আসি।’
অর্ক হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল, ‘কেন?’
‘না। এমনিতে লোকে নানান কথা বলে, আমি আর টিকতে পারব না। আর একটা বছর, তারপর আমি আর কাউকে কেয়ার করব না। তুমি কাউকে বলবে না, কথা দাও।’ ঝুমকি মিনতি করতে লাগল।
‘তুমি এখানে কি কর?’
‘নাচ শিখি। ক্যাবারে ড্যান্স।’
‘পয়সা লাগে না?’
‘লাগে। সে তুমি বুঝবে না।’
অর্ক তাকাল ঝুমকির মুখের দিকে। অন্ধকারে ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। তারপর ঘেন্নাজড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ওটা কি খানকিবাড়ি?’
কথাটা শোনামাত্র ঝুমকি চাবুক-খাওয়ার মত রাস্তার দিকে মুখ ঘোরাল। আর তারপরই অর্ক বুঝতে পারল ঝুমকি কাঁপছে। কাঁপুনিটা যে কান্না থেকে তা বুঝতে অসুবিধা হল না।
অনেকটা পথ আসার পর সেই অবস্থায় ঝুমকি বলল, ‘এখন তোমরা আমাকে যা ইচ্ছে বল, সামনের বছর থেকে আমি মিস ডি হয়ে যাব। তখন—তখন—।’
‘মিস ডি আবার কি নাম?’
জবাব দিল না কথাটার ঝুমকি। রিকশা যখন ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে গেছে তখন মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘অর্ক, তুমি তো পাড়ার অন্য ছেলেদের মত নও, তুমি কথা দাও কাউকে বলবে না।’
অর্ক বলল, ‘কেন, আমি কি আলাদা?’
‘হ্যাঁ আলাদা, তোমার চেহারা, তোমার মা বাবা, সব আলাদা। আমাকে বাঁচতেই হবে যেমন করেই হোক। একবার নাম হয়ে গেলে—। ওরা বলে আমি খুব ভাল নাচছি। কালো শরীরের খুব বাজার আছে বাইরে। তদ্দিন তদ্দিন—।’ ঝুমকি তাকাল, ভিক্ষে চাওয়ার মতন।
‘ঠিক আছে। কাউকে বলব না। কিন্তু একটা জিনিস চাই।’ অর্ক বলল।
‘কি-কি?’
‘হারখানা। যেটা আজ কলতলা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছ।’ কাটা কাটা গলায় কথাটা বলা মাত্র রিকশাওয়ালা ঠক্ করে রিকশা নামিয়ে রাখল।