১১. দুই ঈদের নামায

১১. দুই ঈদের নামায

ঈদের নামায মাঠে পড়তেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) দুই ঈদের নামাযই মাঠে পড়তেন। মদীনার পূর্ব প্রবেশ পথে একটি মাঠ ছিলো। সে মাঠেই তিন ঈদের নামায পড়তেন। আজকাল সেখানে হাজীদের যানবাহন রাখা হয়।

তিনি একবার একবার ছাড়া আর কখনো ঈদের নামায মসজিদের পড়েননি। সেই একবারও মসজিদে পড়েছিলেন বৃষ্টির কারণে। একথা বর্ণিত হয়েছে সুনানে আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহতে।

ঈদের দিন কি করতেন??

সবসময় ঈদগাতে নামায পড়াই ছিলো তাঁর রীতি।

ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বেরুবার সময় তিনি সাধ্যানুযায়ী সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। দুই ঈদ ও জুমার সময় পরার জন্যে তাঁর একটি হোল্লাহ (ঢিলা লম্বা গাউন বা আলখেল্লা) ছিলো।

একবার তিনি দুটি সবুজ চাদর পরে ঈদগাতে গিয়েছেন।

কেউ কেউ বলেছেন, একবার তিনি লাল চাদ পরে ঈদগাতে গিযেছেন। আসলে ওটা লাল চাদর ছিলোনা। পাড়ে লালচে কাজ করা ছিলো। এটা হতে পারেনা যে, তিনি লাল চাদর পরেছেন। কারণ, তিনি লাল ও গৈরিক (গেরুয়া) পোষাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। একবার তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমরে পরণে দুটি লাল বসন দেখে তাকে সেগুলো জ্বালিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। এমন অপছন্দ করা সত্ত্বেও তিনি নিজে তা পরেছেন, তা কী করে হতে পারে?- তাঁর নিষেধাজ্ঞা থেকে বুঝা যায়, লাল পোশাক (পুরুষের জন্যে) হয় হারাম, নয়তো কমপক্ষে মাকরূহ তাহরিমী।

ঈদুল ফিতরের দিন তিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বেরুবার আগে কয়েকটি খেজুর খেয়ে নিতেন। সেগুলোর সংখ্যা হতো বিজোড়।

ঈদুল আযহার দিন নামায থেকে ফিরে আসার পূর্বে কিছু খেতেন না। নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন।

তিনি দুই ঈদের দিন (ঈদগাহে যাবার আগে) গোসল করতেন। এটাই সহীহ হাদিস। কিন্তু এ প্রসংগে ভিন্ন রকম দুটি জয়ীফ হাদিস আছে।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. কড়াকড়ি ভাবে সুন্নাতের অনুসরণ করতেন। তাই দুই ঈদেই তিনি গোসল করে বের হতেন।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন।

ঈদগাহে যাবার কালে তাঁর সামনে সামনে নেযা বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। ঈদগাতে পৌছার পর নেযা খাড়া করে গোড়ে রাখা হতো, যাতে করে তিনি সেটাকে সামনে রেখে নামাযে দাঁড়াতে পারেন। কারণ, ঈদগাহে ছিলো খালি মাঠ। সম্মুখে কোনো প্রাচরি বা খুঁটি ছিলোনা। তাই এ অস্ত্রটিকে সুতরা হিসেবে ব্যবহার করতেন।

তিনি ঈদুল ফিতরের নামায দেরি করে পড়তেন।

তিনি ঈদুল আযহার নামায সকাল সকাল পড়তেন। এই সুন্নতটি কড়াকড়িভাবে পালন করার জন্যে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ঈদুল আযহার দনি সর্যোদয়ের পূর্বেই ঈদগাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতেন।

তিনি (ﷺ) ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর উচ্চারণ করতে থাকতেন।

ঈদের নামায কিভাবে পড়তেন?

রসুলুল্লাহ (ﷺ) ঈদগাহে পৌঁছেই নামায শুরু করে দিতেন। নামাযের আগে আযানও দোয়া হতোনা, ইকাতমও দেয়া হতোনা এবং নামায শরু হচ্ছে বলে ঘোষণাও দেয়া হতোনা। এর কিচুই তিনি করতেন না। এটাই সুন্নত।

তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ ঈদগাতে পৌঁছে এই দুই রাকাত নামাযের আগে বা পরে আর কোনো নামায পড়তেন না।

তিনি খুতবার আগেই নামায পড়তেন।

তিনি দুই রাকাত নামায পড়তেন।

প্রথম রাকাতে সাতবার তাকবীর বলতেন। তাকবীর তাহরীমার সাথে সাথেই সাতবার তাকবীর বলতেন। প্রতি দুই তাকবীরের মাঝে সামান্য থামতেন। দুই তাকবীরের মাঝে কোনো যিকর বা তাসবীহ পড়তেন বলে প্রমাণ নেই। তবে আবদুল্লা ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, তিনি হামদ সানা ও দরূদ পড়তেন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. রসূলুল্লাহ (ﷺ) –কে অনুসরণ করে প্রতি তাকবীরে ‘রাফে ইয়াদাইন’ করতেন।

তকবীর শেষ করে তিনি কিরাত শুরু করতেন। সূরা ফাতিহার পর এক রাকাতে ‘নূন ওয়াল কুরআনির মাজীদ’ সূরা পড়তেন এবং অপর রাকাতে ‘ইকতারাবাতিস সা’আতু ওয়ান শাককাল কামার’ সূরা পড়তেন। কখনো কখনো ‘সাব্বিহ ইসমি রাব্বিকাল আলা’ এবং ‘হাল আতাকা হাদিসুল গাশীয়া’ সূরা পড়তেন। এগুলোই সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য বর্ণনা সহীহ নয়।

কিরাত শেষ করার পর তাকবীর বলে রুকূ ও সাজদা করতেন।

প্রথম রাকাত শেষে সাজদা থেকে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় রাকাতের শুরুতে পরপর পাঁচবার তাকবীর বলতেন। তাকবীর শেষ করে কিরাত শুরু করতেন।

এভাবে প্রত্যেক রাকাত নি তাকবীর সমহ দ্বারা শুরু করতেন এবং কিরাত শেষ করেই রুকূতে যেতেন। [আবু দাউতে একজন তাবেয়ী থেকে চার চার তাকবীরের কথা বর্ণিত হযেছে। তিনি বলেছেন, তিনি সাহাবি আবু মূসা এবং হুযাইফা রা. –কে জিজ্ঞেস করে এ সংবাদ জানতে পেরেছেন। এ তাবেয়ীর নাম সায়ীদ ইবনুল আস।] (তাকবীর সংক্রান্ত এসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে তিরমিযি, ইবনে মাজাহ ও দারমিতে।)

কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম রাকাতে সূরা কিরাতের পূর্বে তাকবীর বলেছেন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কিরাতের পরে তাকবীর বলেছেন। কিন্তু এসব বর্ণনা প্রমাণিত নয়। এই বর্ণনাটির সূত্রে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াবিয়া নিশাপুরি নামে এক ব্যক্তি রয়েছে। বায়হাকি বলেছেন, এ ব্যক্তি যে মিথ্যার সাথে জড়িত, তা একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

ইমাম তিরমিযি কাসীর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আউফ থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছেন। কাসীর ইবনে আবদুল্লাহ তার পিতার ও দাদার সূত্রে শুনেছেন: রসূরুল্লাহ (ﷺ) দুই ইদরে নামাযেই প্রথশ রাকাতে কিরাতের পূর্বে সাতবার তাকবীর বলেছেন এবং দ্বিতীয় ররাকাতে কিরাতের পূর্বে পাঁচবার তাকবীর বলেছেন। তিরমিযি বলেন, আমি এ হাদিসটি সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল অর্থাৎ ইমাম বুখারিকে জিজ্ঞেস করেছি। ইমাম বুখারি বলেছেন ঈদের নামাযের তাকবীর সম্পর্কে এর চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো হাদিস নেই।

ইমাম তিরমিযি বলেন, এই হাদিসটি সম্পর্কে আমার ইমাম বুখারির একই মত।

তিনি নামাযের পরে ভাষণ (খুতবা) দিতেন

রসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায শেষ করে ঘুরে জনতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতেন। জনতা তাদরে নিজ নিজ সারিতেই বসা থাকতো। দাঁড়িয়ে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ (খুতবা) দিতেন। ভাষণে তিনি তাদেরকে উপদেশ পরামর্শ এবং আদেশ নিষেধ প্রদান করতেন।

কোথাও সৈন্য বাহিনী পাঠানোর থাকলে এখান থেকেই পাঠাতেন।

কোনো নির্দেশ জারি করার থাকলে এখান থেকেই জারি করতেন।

ভাষণ দেবার জন্যে সেখনে (ঈদগাহে) কোনো মিম্বর ছিলনা। তাছাড়া মদিনার মসজিদ থেকেও মিম্বর বের করে আনা হয়নি। তিনি ভূমিতে দাঁড়িয়েই ভাষণ দিতেন।

জাবির রা. বর্ণনা করেছেন, আমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে ঈদের নামাযে উপস্থিত ছিলাম। তিনি খুতবার আগেই আযান ও ইকামত ছাড়া নামায পড়েছেন। নামায শেষ করে বিলালের কাঁদে ভর দিয়ে খুতবা দিয়েছেন। খুতবায় তিন আল্লাহকে ভয় করার ও আল্লাহর আনুগত্য করার আদেশ দেন, লোকদের বিভিন্ন উপদেশ দেন ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করেন।

অতপর তিনি মহিলাদের সমাবেশে আসেন, তাদেরকেও উপদেশ দেন এবং নসীহত করেন। (বুখারি ও মুসলিম)

আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে একটি বর্ণনায জানা যায়, রসুলুল্লাহ (ﷺ) বাহনে চড়ে ভাষণ দিয়েছেন।

জাবির রা. থেকেও একটি বর্ননা রয়েছে, তাতে তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) ঈদগাহে এসে প্রথমে নামায পড়লেন। নামায শেষে কুতবা দিলেন খুতবা শেষ করে নেমে গেলেন এবং মহিলাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।

তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার মাধ্যমে খুতবা শুরু করতেন। তিনি তাকবীর বলে খুতবা শুরু করতেন বলে প্রমাণ নেই।

নবী করীম (ﷺ) এর মুয়াযযিন সাআদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) খুতবায় বেশি বেশি তাকবীর বলতেন এবং দুই ঈদের খুতবায় আরো অধিক তাকবীর বলতেন। তবে এ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়না যে, তিনি তাকবীর বলে খুতবা শুরু করতেন।

যারা ঈদের নামাযে উপস্থিত হতো রসূল (ﷺ) তাদেরকে খুতবা শোনার জন্য বসার এবং বলে যেতে চাইলে চলে যাবার রুখসত দিতেন। একবার জুমার দিন ঈদ হলে দিনিস তাদেরকে রুখসত দিয়েছিলেন।

ঈদগাহে যাওয়া আসার পথ পরিবর্তন করতেন।

রসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈদগাহে যাওয়া আসার পথ পরিবর্তন করতেন। তিনি ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যেতেন এবং ফিরে আসার সময় আরেক পথে ফিরে আসতেন। পথ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলেছেন।

কেউ বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো, দুই পথে অধিক সংখ্যক লোককে সালাম দেয়া।

কেউ কেউ বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো, উভয় অঞ্চলের লোককে ঈদের বরকত পৌঁছে দেয়া।

কেউ কেউ বলেছেন এর উদ্দেশ্য হলো, উভয় পথের অভাবী লোকদের সাহায্য করা।

কেউ কেউ বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো, সকল অলি-গলি ও পথে প্রান্তরে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটানো।

কেউ কেউ বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হলো, মুনাফিকদের ইসলামের শান শওকত ও দাপট প্রদর্শন করা।

কেউ কেউ বলেছেন, বেশি বেশি ভূমিকে মুসল্লিদের জন্যে সাক্ষ্য বানানো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *