দীনদাস স্বগৃহে এসেছেন। তারপর পক্ষকাল গত। ইতোমধ্যে তিনি উজুবটেও গিয়েছিলেন। ভস্মীভূত ক্ষেত্রকর পল্লীটিতে এখন আর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় না। বাতাস এবং বৃষ্টি ভস্ম ও অঙ্গারগুলি মৃত্তিকার সঙ্গে মিশ্রিত করে দিয়েছে। তদুপরি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরুলতার আবির্ভাবে এমন হয়েছে স্থানটি, যে ঈষদুচ্চ গৃহ–পীঠগুলি না থাকলে অনুমানই করা যেতো না যে একদা এই স্থানে একটি সমৃদ্ধ পল্লী ছিলো।
শুনেছিলেন কোনো কোনো পল্লীবাসী ফিরে এসে পুনরায় গৃহ নির্মাণ করেছে। কিন্তু দেখলেন, কথাটি জনরব মাত্র। দুএকখানি গৃহ অবশ্য উঠেছে কিন্তু ঐ স্থানে নয় কিঞ্চিৎ দূরবর্তী স্থানে, ব্রাহ্মণপল্লীর একেবারে প্রান্তসীমায় সংলগ্ন। বোঝা যায়, ব্রাহ্মণরাই ব্যবস্থাটি করেছেন। দাস ভৃত্য না হলে তাঁদের চলবে কীভাবে?
তিনি বহু সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। যেমন মহাসামন্ত হরিসেন রাজধানীতে ছিলেন মাসাধিককাল। সেখান থেকে এসে তার প্রতাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রক্ষা এই যে, এখনও নতুন কোনো ঘটনা ঘটাননি। কেবল তাঁর চরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেত্রকরদের নিশ্চিহ্ন পল্লীটির উপর এখনও তাঁর ক্রোধ। তাঁর নাকি অনুমান ঐ পল্লীর লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো যুগপৎ যবন ও সদ্ধর্মীদের। তাদেরই ষড়যন্ত্রের কারণে যবনেরা হরিসেনের বাহিনীকে আঘাত করে। ঘটনাটির কথা যতোবার স্মরণ হয় ততোবারই নাকি তাঁর ক্রোধ উদ্দীপ্ত হয়। ঐ পল্লীর শিশু বৃদ্ধ রমণী কাউকেই তিনি জীবিত রাখতে চান না। শোনা যায়, একটি কিশোর বালককে বন্দী করা হয়েছিলো সেই বালকটিকে সন্ধান করে আর কেউ পায়নি। কাজটি নাকি অভিমন্যুদাসের। এই লোকটি এখন হরিসেনের দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠেছে। যাবতীয় দুষ্কর্ম এখন অভিমন্যুদাসই সম্পাদন করে। সে উজুবটের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে চর নিয়োগ করে রেখেছে–ভিক্ষু অথবা যোগী বলে কোনো লোককে সন্দেহ হলেই তারা যেন সংবাদ দেয়। সে যোগী এবং ভিক্ষুদের লাঞ্ছনা করতে অত্যধিক আগ্রহী। ঐ কাজে সে যারপরনাই আনন্দ পায়। এও শোনা যায় যে হরকান্ত ও তার কন্যাটির সে সন্ধান করছে। হরকান্তের গৃহে একটি যোগী এসেছিলেন, সেই যোগীটিকেও নাকি তার বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নাকি আরও একটি কুম্ভকার যুবকের সন্ধান করছে সে। দীনদাসের অনুমান, এই কুম্ভকার যুবক শ্যামাঙ্গ ব্যতীত আর কেউ নয়। শ্যামাঙ্গের যে কী অপরাধ তিনি ভেবে পান না।
দীনদাস এতো সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন এই জন্য যে, এই সকল সংবাদের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বগ্রামে শুকদেবের প্রত্যাবর্তন সমীচীন কিনা। যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে অন্য কোথাও গৃহ নির্মাণ করতে হবে–তা সে যে স্থানেই হোক। দূরদেশে অন্যের আশ্রয়ে কতোদিন থাকবেন। সর্বোপরি জামাতা বসন্তদাস সম্পর্কে হরিসেনের অনুচরদের কি মনোভাব সেইটি জানা অধিক প্রয়োজন। কেননা বসন্তদাসের সঙ্গে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সংস্রবের সংবাদটি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত। এবং হরিসেনের অনুচরেরা যে উজুবটের ক্ষেত্রকর পল্লীটি আক্রমণ করে, তাও কিন্তু বসন্তদাসকে বন্দী করার জন্যই। এমতাবস্থায় বসন্তদাসের প্রতি হরিসেন ও তার অনুচরদের মনোভাবের। পরিবর্তন যদি না ঘটে, তাহলে শুকদেবের উজুবট গ্রাম তো দূর স্থান, এতদঞ্চলেই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
অথচ ওদিকে ভগিনী যোগমায়া ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। মায়াবতী চিন্তায় চিন্তায় শীর্ণকায়া, শুকদেব তো প্রায় সর্বক্ষণই নীরব ও নির্জীব থাকেন। তবে সৌভাগ্য যে, জামাতা বসন্তদাসের সংবাদ পাওয়া গেছে, সে জীবিত এবং সুস্থ। দীনদাস জানেন, এই সংবাদটি শ্রবণ করলেই শুকদেব পুনরায় সচল ও সজীব হয়ে উঠবেন, যোগমায়ার মুখে হাসি ফুটবে এবং মায়াবতী হয়ে উঠবে চঞ্চলা হরিণীটির মতো–যেমন সে পূর্বে ছিলো।
যবনদের আগমন সংক্রান্ত সংবাদ তাকে কেউ-ই দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলে, তারা পশ্চিমে তঙ্গন নদীর পরপারে অবস্থান করছে, কেউ আবার বলে, তারা দক্ষিণ–পশ্চিমে মহানন্দার তীরে শিবির স্থাপন করে আছে–প্রকৃত সংবাদ কেউ জানে না। তবে স্বস্তির কথা এই যে, তাদের নতুন কোনো কার্যকলাপ দেখা যায়নি। কিন্তু একটি চিন্তার বিষয়ও আছে। শোনা যাচ্ছে যে, সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা নাকি সত্য সত্যই যবনদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
দীনদাসের বহু কাজ–প্রথমত মদনপুর গ্রামে শুকদেবের সুহৃদ প্রফুল্লদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। তারপর সন্ধান করতে হবে বসন্তদাসের। যদি সাক্ষাৎ হয় উত্তম, না হলে প্রফুল্লদাসের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করতে হবে, শুকদেব আর তাঁর স্ত্রী কন্যাকে কোথায় আনা যায়–নিজ গ্রামে উদয়পুরে, না প্রফুল্লদাসের গৃহ মদনপুরে।
শুকদেব উজুবটের ব্রাহ্মণপল্লীতেও যেতে বলেছেন। সোমজিৎ উপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অভিমতটি যেন সংগ্রহ করেন দীনদাস।
সোমজিৎ উপাধ্যায় বহির্বাটিতেই ছিলেন। দীনদাস প্রণাম করে সম্মুখে দাঁড়ালে জানতে চাইলেন, কে তুমি? তোমাকে তো পরিচিত মনে হচ্ছে না?
আজ্ঞে আমি উদয়পুরের লোক, এই গ্রামের ক্ষেত্রকর শুকদেব আমার ভগিনীপতি।
শুকদেবের নাম শুনে সোমজিৎ আগ্রহী হলেন। বললেন, শুকদেব কোথায়? তার কি সংবাদ, কুশলে আছে তো?
দীনদাস সত্য গোপন করলেন। বললেন, তিনি আমার গৃহে আছেন। শরীর অসুস্থ, বৃদ্ধ হয়েছেন তো–তিনি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। আপনার পরামর্শ চান শুকদেব, তিনি কি উজুবটে ফিরে আসবেন? আপনি বললেই তিনি আসবেন।
সোমজিৎ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন একটি। কী বলবেন? এই অপরিচিত ক্ষেত্ৰকরটির কাছে কি বলা যায়, রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে তিনি কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন? বলবেন কি, যে মহাসামন্ত হরিসেনের স্বেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ নেই। তিনি আপন মনে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, শুকদেব পরমকুটুম্বের গৃহে গেছে, সেখানে থাক কিছুদিন, এতো শীঘ প্রত্যাবর্তনের কি প্রয়োজন? নাকি শ্যালক শ্যালক–পত্নী যথেষ্ট সমাদর করছেন না।
ঈষৎ কৌতুকে হাস্য করলেন কথাটি বলে। শেষে জানালেন, শুকদেবকে আগমনের পরামর্শ আমি দেবো না, কারণ আমি বৃদ্ধ হয়েছি, দেহবল মনোবল উভয়ই আমার গত প্রায়। তবে যদি আগমন করতেই হয়, তাহলে তাকে বলল সে যেন আমার গৃহের নিকটে কুটির নির্মাণ করে থাকে। ঐ যে ব্রাহ্মণপল্লীর সীমানা দেখছো, সোমজিৎ হাত তুলে দেখালেন। বললেন, তারপরই আমার দুই কূলব্যাপ ভূমি–ঐ স্থানে আরও দুটি পরিবার গৃহ নির্মাণ করে আছে–শুকদেব এলে ওখানেই তাকে গৃহ নির্মাণ করতে হবে, তার নিজের পল্লীতে বসবাস এখনও বিপজ্জনক।
উপাধ্যায় মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে একটি লোক তার সম্মুখে দাঁড়ালো। তারপর আপাদমস্তক দৃষ্টিপাত করে বললো, মহাশয়কে নতুন দেখছি মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, আমি উদয়পুরের লোক, আপনি?
আমি এই গ্রামেরই লোক, একজন দীন অভাজন বলতে পারেন।
দীনদাস লক্ষ্য করলেন লোকটির দৃষ্টি অদ্ভুত। বিনয়ে মুখখানি নত। কিন্তু যখন দৃষ্টি তোলে তখন চক্ষু দুটির বহুদূর ভেতরে কপিশবর্ণের আলোকরেখা দেখা যায় একটি। যেন বিষধর সর্পের দৃষ্টি।
তা মহাশয় বুঝি উপাধ্যায় মহাশয়ের ক্ষেত্রকর? লোকটি জানতে চায়।
না, আমি নই, আমার ভগ্নীপতি তার ক্ষেত্রকর।
ও, তাই হবে, আপনি তাঁর ক্ষেত্রকর হলে তো নিশ্চয়ই আপনাকে পূর্বে দেখতাম। আমি নির্বোধ, জানেন, সকলেই আমাকে উন্মাদ বলে। কখন কোন কথা বলি কিছুরই স্থিরতা নেই–তা মহাশয়ের ভগ্নীপতিটির পরিচয় তো জানা হলো না?
দীনদাস দেখলেন, লোকটি সুবিধার নয়। বললেন, আমার ভগ্নীপতির নাম শুকদেব, এবার পথ ছাড়ুন, আমি যাবো।
কি যে বলেন, হেঁ হেঁ কি যে বলেন–শুকদেব আমার শ্বশুর স্থানীয় ব্যক্তি। তার আত্মীয় হলে তো আপনি আমারও আত্মীয়–আপনাকে এভাবে পথ থেকেই যেতে দিই কীভাবে–হেঁ হেঁ–আপনি গুরুজন, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন, শুকদেব কোথায় আছেন? কেমন আছেন? তার জন্য আমরা এতো উদ্বিগ্ন যে বলার কথা নয়। তার কন্যা মায়াবতী কোথায়? তার জামাতা বসন্তদাস কোথায়?
দীনদাস বুঝলেন, সমস্তই লোকটির অভিনয়, নিশ্চয় সে হরিসেনের অনুচর। তিনি সাবধান হলেন। বললেন, আমি মদনপুরে প্রফুল্লদাসের কাছে যাচ্ছি, এখানে উপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সমাপ্ত হয়নি–সন্ধ্যাকালে আবার হবে–রাত্রি আমি তার গৃহেই যাপন করবো, আর বিলম্ব করাবেন না–যেতে দিন।
অবশ্যই যাবেন, হেঁ হেঁ, বিলম্ব করা আদৌ উচিত নয়, ঐ যে আমার কুটির, বড় অভাজন আমি, যদি পদধূলি দিতেন একবার, এ দীন অভাজন ধন্য হতো।
সোমজিৎ দূর থেকে দেখছিলেন ব্যাপারটি। তিনি সম্মুখে এলেন। জানতে চাইলেন, কি হয়েছে অভিমন্যুদাস? এঁকে তুমি যেতে দিচ্ছো না কেন?
অভিমন্যুদাস তাহলে এই লোক, দীনদাস লোকটিকে দেখে নিলেন উত্তমরূপে।
সে তখনও বলে চলেছে–হেঁ হেঁ গুরুদেব, আমি কে? আমি তো নিমিত্ত মাত্র সবই ভবিতব্য বলতে হবে। ইনি আত্মীয়জন, শুকদেবের শ্যালক, কি প্রকারে যেতে দিই বলুন–হেঁ হেঁ হেঁ–আপনিই বলুন শুকদেবের সংবাদ নিতে হবে না? তার জামাতাটির জন্য কতো ব্যাকুল আমরা।
অভিমন্যুদাস, সোমজিৎ বুঝিয়ে বললেন, দেখো, তুমি অহেতুক এঁর উপর উপদ্রব সৃষ্টি করেছো–এঁকে যেতে দাও–আমি উত্তম মতো জানি, এ কোনো প্রকার দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়।
কিন্তু অভিমন্যুদাসের দন্তবিকাশের শেষ নেই। অনবরত হেঁ হেঁ রবে হেসে যাচ্ছে। শেষে জানালো, আমার প্রভু হরিসেন কিন্তু আপনার উপরও দৃষ্টি রাখতে বলেছেন, হেঁ হেঁ গুরুদেব। আপনার ভাবগতিকও নাকি সুবিধার নয়। কী যে বলেন, রাজপুরুষেরা, তাই না গুরুদেব? হেঁ হেঁ, কিছুই বোধগম্য হয় না, তাই না? আসুন আপনি, আমার সঙ্গে আসুন।
সোমজিৎ কিছুই বলতে পারলেন না। দীনদাস তাঁর মুখের দিকে চাইলে তিনি শুধু বললেন, তুমি আমার কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করো না–আমি বৃদ্ধ।
দীনদাস ততক্ষণে বুঝে নিয়েছেন, তাঁর সমূহ বিপদ। তিনি মহাসামন্ত হরিসেনের এক উন্মাদপ্রায় বিকৃত–বুদ্ধি লোকের হাতে পড়েছেন, তার আর আশা নেই। তিনি ইতি কর্তব্য স্থির করে নিলেন। অভিমদাসের খর্বাকৃতি দেহাবয়বটি আপাদমস্তক দেখলেন, দূরে যে গৃহের দিকে অভিমন্যু তাকে নিয়ে যেতে চায় সেই গৃহখানি দেখলেন, তারপর মনে মনে বললেন, দীনদাস, এবার তোমার ইষ্ট নাম জপ করার সময় হয়েছে–যদি কিছু করতে চাও, তো এখনই করো।
সোমজিৎকে বললেন, গুরুদেব চলুন, আপনার গৃহে জলপান করি প্রথমে, তারপর অভিমন্যুদাসের গৃহে যাবো–দেখি কী প্রকার সমাদর করে সে।
অভিমন্যু দন্ত বিকাশ করে হাসে শুধু।
সোমজিতের গৃহের বহির্দ্বারে গৃহ সংস্কারের নানাবিধ উপকরণাদি সংগ্রহ করে রাখা ছিলো। দীনদাস বহির্দ্বারের নিকটে এসে অভাবিত এবং দুঃসাহসী কাজটি করলেন। কারও কিছু বোধগম্য হবার পূর্বেই তিনি একখানি বংশখণ্ড হাতে তুলে নিলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে আঘাত করলেন। কি হলো বুঝতে পারেননি সোমজিৎ। যখন বুঝলেন, তখন দেখেন, অভিমন্যুদাস ভূমিতে পপাত এবং দীনদাস অনতিদূরে ধাবমান।
ঐ ঘটনার পর দীনদাসের ঐ অঞ্চলে থাকবার কথা নয়–এবং তিনি ছিলেনও না। কিন্তু অভিমন্যুদাস নিজ সঙ্গীদের নিয়ে উদয়পুর পর্যন্ত যেতে বিলম্ব করেনি। সেখানে কি হতো বলা যায় না। কেননা দীনদাসকে না পেয়ে অভিমন্যুর লোকেরা তার গৃহে অগ্নিসংযোগ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলো। ওদিকে আবার প্রস্তুত হয়েছিলো গ্রামবাসীরাও। অভিমন্যুদাস অবস্থা দেখে নিজ সঙ্গীদের নিবৃত্ত করে এবং উদয়পুর গ্রাম থেকে চলে আসে।
তার নানান গুণ। আচরণে সে অত্যধিক ভদ্র এবং বিনয়ী। প্রথম আলাপে তাকে নির্বোধও মনে হতে পারে। কেউ কেউ বলে, সে নাকি নপুংসক। কিন্তু যে পরিচিতি, সে জানে কি প্রকার চতুর এবং কৌশলী সে। অমন নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা সচরাচর দেখা যায় না। হরিসেনের বিশ্বাসভাজন হয়েছে সে এই গুণটির জন্য। তার মস্তিষ্ক কখনই তপ্ত হয় না। সে এক উদ্দেশ্য নিয়ে বৎসরের পর বৎসর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে।
দীনদাসের জন্যও অপেক্ষা করতে পারবে, মনে মনে সে সিদ্ধান্তগ্রহণ করে। তার এক অপেক্ষা সেই অপরিচিত কুম্ভকার যুবকটির জন্য, উজুবটে অগ্নিসংযোগের রাত্রে যাকে সে লীলাবতীর সঙ্গে পলায়ন করতে দেখেছিলো, আর দ্বিতীয় অপেক্ষা, এই দীনদাসের জন্য। তার নিশ্চিত ধারণা, লীলাবতী একদিন না একদিন উজুবট গ্রামে আসবে। সে না আসুক, ঐ যুবকটি আসবে আর দীনদাসকে তো উদয়পুর আসতেই হবে। কেননা ঐ গ্রামে তার গৃহ-সংসার।
দীন অভাজন ব্যক্তি সে, মস্তকাবনত করে যতোদিন প্রয়োজন, সে অপেক্ষা করে থাকবে।
অপেক্ষা করার প্রয়োজন হতো না। মহাসামন্তের শস্ত্রধারী সুশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে ঐ লগুড়ধারী গ্রামবাসীদের তুলনা? সে চিন্তা করে দেখেছে। ও তো মাত্রই এক রাত্রির ব্যাপার, গ্রামখানির চিহ্ন পর্যন্ত থাকতো না। তবে সময় এখন অন্যরূপ। বলা যায় না, কখন যবন অশ্বারোহীদের উপদ্রব এসে উপস্থিত হয়। কেমন করে যে তারা সংবাদ পায় ভগবান, জানেন। কোন স্থান থেকে আসে, কোথায় যায়–কিছুই বলতে পারে না কেউ। না হলে লীলাবতী কি যুবাপুরুষটির হাত ধরে সেদিন ঐভাবে পলায়ন করতে পারে? যদি পশ্চাতে অশ্বারোহীটি ছুটে না আসতো, তাহলে একটি বর্শাঘাতের অপেক্ষামাত্র ছিলো। তারপর দেখা যেতো, লীলাবতীর অহঙ্কারখানি কত উচ্চ হয়েছে।
কিন্তু দেখা যায়নি শেষ পর্যন্ত। লীলাবতীর মাতুল সেই যোগী পুরুষটিকেও সে দেখতে চায়। আর শুকদেবের জামাতাটি, তাকেও তার প্রয়োজন। সুতরাং সে অপেক্ষা করবে।
কিন্তু কেন এই অপেক্ষা? কেউ–ই জানে না কিসের অপেক্ষায় দিন গণনা করছে। বরেন্দ্র–বঙ্গ–সমতটের জনপদগুলি। লোভ হিংসা প্রতিহিংসা প্রতারণা যুদ্ধ ধ্বংস প্রেম সমস্ত কিছু একাকার হয়ে অপেক্ষায় আছে সেই অনাগত প্রহরটির জন্য।
রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে গোবর্ধন আচার্য ও হলায়ুধ মিশ্রের মতো লোকেরা অপেক্ষায় আছেন–অপেক্ষায় আছেন উজুবট গ্রামের সোমজিৎ উপাধ্যায়–হরিসেনও সম্ভবত অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা বসন্তদাসের, লীলাবতীর, শ্যামাঙ্গের, ছায়াবতীর, শুকদেবের, মিত্রানন্দের। কার অপেক্ষা নয়? সকলেই উপলব্ধি করে, যে জীবনযাপিত হচ্ছে, সে জীবন থাকবে না–এই অস্থিরতার অবশ্যই অবসান হবে। কিন্তু সেই অবসান কিসে? মৃত্যুর হতাশায়? না নবীন জীবনের উন্মেষে? কেউ-ই বলতে পারে না।
দীনদাস সুনন্দপুরে এসে শুকদেবকে ঐ অপেক্ষা করার কথাই বলেন। জানান, ভ্রাতঃ, উপায় নেই এখন অপেক্ষা করা ব্যতীত, উজুবটে প্রত্যাগমন এখন অসম্ভব।
শুকদেব কিঞ্চিৎ সুস্থ এখন। তাঁর বিষণ্ণ নির্জীব ভাবটি আর নেই। যোগমায়ার মুখেও হাসি দেখা যায়–আর মায়াবতী হয়ে উঠেছে পূর্বের মতোই। এই পরিবর্তনের কারণ একটিই আর তা হলো বসন্তদাসের আগমন। বসন্তদাস সুনন্দপুরে আসে দীনদাসের আগমনের সপ্তাহকাল পূর্বে। তার আগমনে, বলাই বাহুল্য, নির্জীব এবং হতাশ এই উদ্বাস্তু পরিবারে স্বস্তি আনন্দ এবং উল্লাস একইসঙ্গে জেগে ওঠে। বসন্তদাস উজুবট ও নিকটবর্তী গ্রামগুলির অবস্থা জানিয়েছে শুকদেবকে। শুধু গ্রামের কথা নয়, রাজধানীর সংবাদও। যবনদের সংবাদ, ভিক্ষুদের সংবাদ, সমস্তই জানিয়েছে। এবং শেষ কথা বলেছে, আপাতত কিছুই করণীয় নেই, এ স্থানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সমস্ত কিছু শোনার পর শুকদেবের মনে হয়েছে ঐ একই কথা। এখন সত্যই কিছু করণীয় নেই–অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু যোগমায়ার কষ্ট হচ্ছে। দান ঋণ এবং স্বল্প সঞ্চয়ে তার সংসার আর কতোদিন চলে? প্রতিবেশীরা করুণা করে, নানান মন্তব্য করে একেকজন, তাতে তার অসহ্য বোধ হয়। নিজ গৃহে তাঁর কোনো অভাব ছিলো না–কিন্তু এখানে অভাব বোধ করছেন প্রতি পদে। তাঁর আশা হয়েছিলো, দীনদাস শুভ সংবাদ নিয়ে আসবেন এবং তারপরই তিনি স্বামী সংসার নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যাবেন। কিন্তু এ কোন কথা শুনছেন? আরও নাকি অপেক্ষা করতে হবে? কতদিন? স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন। শুকদেব দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলেন, জানি না।
কিন্তু মায়াবতী ঐ কথা শুনবে না। অভিমানে ওষ্ঠ স্কুরিত হয়, চোখে অশ্রু উদ্বেল হতে দেখা যায়। আর বলে, না আমি আর একদণ্ডও থাকবে না এ স্থানে। স্বামীকে কাছে পেয়ে তার অভিমান হয়েছে আরও অধিক। বসন্তদাসের সঙ্গে সে কলহে প্রবৃত্ত হয়। বসন্তদাস স্ত্রীর অভিমান এবং ক্রোধের কারণ বোঝে, কিন্তু কোনো পথ যে সত্যই নেই, সে কথাটি সে স্ত্রীকে বোঝাতে পারে না।
অবকাশও স্বল্প। কারণ একটি কুটিরে বাস–কুটিরের ভিতরে শয়ন করেন শুকদেব স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আর দীনদাস এবং বসন্তদাসকে বাইরে রাত্রিযাপন করতে হয়। ফলে স্বামী–স্ত্রীর একান্ত হবার সুযোগ প্রায় একেবারেই নেই। মায়াবতীর অস্থিরতার এক কারণ সে অন্তঃসত্ত্বা। তার স্বামীসঙ্গ প্রয়োজন। একেকদিন নির্লজ্জ রমণীর মতো দ্বিপ্রহরে স্বামীকে সে কুটিরের ভিতরে ডাকে। দুবাহুতে স্বামীকে কণ্ঠলগ্ন করে বলে, তুমি আমাকে নিয়ে চলোতোমাকে আমি সর্বক্ষণ পাই না–এখানে থাকলে কখনই পাবো না–আমি এখানে থাকবো না।
বসন্তদাস নির্বোধের মতো আচরণ করে। অস্থির আবেগময়ী স্ত্রীকে সে শান্ত করতে পারে না। একেক সময় বহুক্ষণ রোদন করতে থাকলে বিরক্তি, ক্রোধ, ক্ষোভ ইত্যাকার মানসিক প্রতিক্রিয়া যে হয় না তা নয়–কিন্তু তথাপি সে সংযত থাকে। এখন কোনো প্রকার অস্থিরতাকে সে প্রশ্রয় দেবে না।
ইতোমধ্যে একটি সংবাদ পাওয়া যায় যে, পুনর্ভবা তীরের মদনপুর গ্রামখানি যবনদের দ্বারা উপদ্রুত হয়েছে। তাতে শুকদেব চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার শক্তি নেই যে একাকী অতদূর যান। জামাতাকে বলেন, বসন্ত, দেখো, যদি প্ৰফুল্লের কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারো, ওর কন্যাটির জন্য আমার বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
বসন্তদাস কোনোদিন পান্থশালায় যায়, কোনোদিন হাটে যায় আর চারিদিকের অবস্থা দেখে। তার অস্পষ্ট মনে হয়–সময় ঘনিয়ে আসছে। আর বোধ হয় কিছু করতে পারলো না কেউ।
একদিন সুনন্দপুরের হাটেই সংবাদ পাওয়া গেলো যে মহাসামন্ত সুধীমিত্র বিল্বগ্রামে নেই। কোথায় গেছেন, কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে যে তিনি তীর্থে গেছেন, অন্য জনরব আবার এই যে, যবনাক্রমণ আসন্ন দেখে তিনি দক্ষিণ দেশে পলায়ন করেছেন।
মিত্রানন্দ ইতোমধ্যে একদিন কদম্বঘাটে ছায়াবতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছে। সেখানেও নতুন সংবাদ এই যে, নদীপথে দক্ষিণগামী বৃহৎ নৌকার সংখ্যা অধিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামন্তপতিরাই শুধু নয় তাদের অনুচরদের পরিবারও দক্ষিণে এবং পূর্বে চলে যাচ্ছে। ঐ ঘাটেই সাক্ষাৎ হলো এক বৃদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে। তিনি দেখে এসেছেন পশ্চিমের গ্রামগুলি থেকেও লোক পলায়ন করছে। প্রত্যেকের মুখেই যবনাক্রমণের সংবাদ। হ্যাঁ, তিনিও শুনেছেন মদনপুর গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে। তবে আক্রমণকারীরা গ্রামখানি ধ্বংস করে দেয়নি। দুতিনটি যুবতী রমণী এবং কয়েকটি গাভী ও ছাগল নিয়ে গেছে। না, কেউ নিহত হয়নি। তবে যাবার সময় মন্দিরটি অপবিত্র করে গেছে। মন্দির প্রাঙ্গণে গো–হত্যা করে সেই গো–মাংস দগ্ধ করে ভক্ষণ করেছে–এবং ঐ মন্দিরেই নাকি রমণীদের বলাকার করা হয়েছে। তিনি স্বচক্ষে দেখে এসেছেন দুই আত্মঘাতিনী রমণীর মৃতদেহ। তৃতীয়টি নাকি পূর্ব থেকেই উন্মাদিনী ছিলোসে এখন পথে পথে ঘুরছে।
মিত্রানন্দ অস্থির হয়ে উঠেছেন মনে মনে। তাঁর ধারণা, এখনও কিছু করা সম্ভব। যবনেরা বহিরাগত, স্থানীয় লোকের সহায়তা না পেলে তাদের পক্ষে এদেশে অধিককাল থাকা সম্ভব হবে না। সে সুযোগের অপেক্ষায় রইলো।
মায়াবতী যেন অনুভব করে তার স্বামী উন্মন। উজুবটে যেমন মনে হতো–এ তার চাইতেও অধিক। সর্বক্ষণ যেন কী চিন্তা করে। একদিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ বললো, তুমি কি আবার চলে যাবে?
না, কোথায় যাবো? তুমি অহেতুক চিন্তা করো না–আমি তোমাকে ত্যাগ করে কোথাও যাবো না। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বসন্তদাস।
না, আমার মন বলছে, তুমি চলে যাবে, বলল, তুমি কী ভাবছো?
বসন্তদাস স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে দেখে বারেক। ভাবে, সরলা এই গৃহবধূর কাছে সে নিজ চিন্তা–ভাবনার কথা বলবে কি বলবে না। তারপর সে বলে, আমি কি চিন্তা করি শুনবে? শোনো তাহলে, আমি তোমার আমার মতো মানুষের কথা ভাবি। দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে–এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতোদিন এভাবে চলবে? গ্রামপতি, সামন্তপতিরা যথেচ্ছ অত্যাচার করে যাবে, কেউ কিছু বলতে পারবে না–ওদিকে আবার যবনরা ধেয়ে আসছে, তাদের তরবারির নীচে কত মানুষের শির ছিন্ন। হবে তাও কেউ বলতে পারে না। আমি চিন্তা করি এই অবস্থার পরিবর্তনের কথা।
কিন্তু তুমি কী করবে, যুদ্ধ করবে? মায়াবতীর স্বরে আতঙ্ক ফোটে। বলে, তুমি একাকী কেমন করে যুদ্ধ করবে–যুদ্ধ করলে তো মানুষের মৃত্যু হয়।
মায়াবতী স্বামীকে দুবাহুতে বেষ্টন করে ধরে।
বসন্তদাস স্ত্রীর কথায় হাসে। বলে, না আমি কেন যুদ্ধ করবো, যারা যুদ্ধ করতে চায়, আমি তাদের বলবো যে যুদ্ধ করো না, যুদ্ধ করলে মানুষ ধ্বংস হয়।
না, সে কথা বলার তুমি কে? এ সকল কথা ভয়ানক–তুমি সামন্তপতিদের সঙ্গে কথা বলতে যাবে না–তাদের ভারী ক্রোধ–দেখোনি, তুমি ভিক্ষুদের সঙ্গে মিত্রতা করেছিলে বলে কতো কাণ্ড ঘটলো?
বসন্তদাস বিমূঢ় বোধ করে। কোন্ ভাষায় সে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বোঝাবে। তথাপি বলে, এ একজনের ব্যাপার নয় মায়া–এ হচ্ছে সকল মানুষের ব্যাপার। আমি যদি ঐ সকল কথা নাও বলি, তাহলেও আমরা রক্ষা পাবো না। যদি বিলম্ব হয়ে যায় যুদ্ধকারীদের বোঝানো না যায়–তাহলে সর্বত্র যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাবে। কেউ রক্ষা পাবে
না, আমরাও না। এ অবস্থার কিছু একটা করা প্রয়োজন।
মায়াবতীর কিছুই বোধগম্য হয় না। তার এক কথা, তুমি ঐ সকল ভয়ঙ্কর ব্যাপারে যাবে না। গেলে আমি আত্মঘাতিনী হবো।
কিন্তু এভাবে কতদিন? একেবারে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা আর চরম সর্বনাশের জন্য অপেক্ষা করা? তার মনে হয়, এভাবে দিনযাপন একেবারেই অর্থহীন। সমূহ সর্বনাশ আসন্ন অথচ সে কিছুই করছে না, কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই তার। ধিক বসন্তদাস, ধিক তোমার এই জীবনে! সে একাকী কেবলি নিজেকে ধিক্কার দেয়। ভিক্ষু মিত্রানন্দ জীবন বিপন্ন করে কোন স্থান থেকে কোন স্থানে চলে যাচ্ছে–বিভাবতী কৃষ্ণা শুক্লার মতো রমণীরা আত্মাহুতি দিচ্ছে আর তুমি গৃহসুখ উপভোগ করছো? অল্প কদিনের মধ্যেই সে ক্লান্ত হয়ে উঠলো। এবং একদা হঠাৎ জানালো, আমি নিজ গৃহে যাবো, পিতা–মাতাকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়েছে।
এই কথার পর কারও কিছু বলার থাকে না। যোগমায়া মৃদু আপত্তি করেন, কিন্তু সেই আপত্তি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অবশেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়াবতী স্বামীকে বিদায় দেয়। বিদায়কালে বলে, শীঘ্র ফিরে এসো, বিলম্ব হলে আর আমাকে জীবিত দেখবে না।
স্বগৃহে যাওয়া তার প্রয়োজন বটে, কিন্তু সে যাত্রা করে বিপরীত দিকে, পুন্ড্রনগরীর উদ্দেশে।
সেখানে গিয়ে দেখে, মিত্রান ফিরে এসেছে। এবং সে অত্যধিক ব্যস্ত। কেন ব্যস্ত, কিসে ব্যস্ত, কিছুই বলে না সে। নগরপ্রান্তে প্রকাণ্ড একটি বিহার–যেমন প্রাচীন, তেমনই তার ভগ্নদশা। সে অবাকই হলো এক প্রকার। এতে ভিক্ষু একত্রে সে জীবনে দেখেনি। বাহির থেকে দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এতো অধিক সংখ্যক ভিক্ষু এ স্থানে বসবাস করে।
মিত্রানন্দ অবশ্য জানিয়েছে যে ভিক্ষুদের সকলেই এই স্থানের নয়। বহুসংখ্যক ভিক্ষু বহিরাগত। কিন্তু তথাপি এতো অধিকসংখ্যক ভিক্ষুর একত্র সমাবেশ তার কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়েছে। মিত্রানন্দকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করলে বলে, অপেক্ষা করো, অচিরেই সমস্ত কিছু জানতে পারবে। সম্ভবত আমরা শীঘ্রই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছি।
আবার সেই অপেক্ষার কথা।
অবশেষে দেখলো, ঐটিই হলো মূল কথা–অপেক্ষা করা হবে, কি হবে না। তরুণ ভিক্ষু নিরঞ্জন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ঐ অপেক্ষার কথা শুনে।
বসন্তদাস লক্ষ্য করে দেখলো, অত্যন্ত তেজস্বী এই তরুণ ভিক্ষুটি। লক্ষ্য করে দেখার আরও একটি কারণ ছিলো। ছায়াবতীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা এই নিরঞ্জন।
ভিক্ষুসভায় তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নিরঞ্জন। বলে, আর কতোকাল আমরা অপেক্ষা করবো, বলুন? বহুকাল অপেক্ষায় অতিবাহিত হয়েছে, আমাদের ধর্ম নিঃশেষ প্রায়, জ্ঞান আচ্ছন্ন, বুদ্ধি অবসাদগ্রস্ত–এরপরও কি অপেক্ষা করতে হবে? এ অপেক্ষার অপর নাম তাহলে মরণ। এভাবে আমরা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে চাই না। আপনারা মহাভিক্ষুদের নির্দেশ নিয়ে আসুন।
অপরাহ্নের রৌদ্র এসে পড়েছিলো তার মুখে–এবং ঐ রৌদ্রে তার কাষায় বস্ত্র, গৌরবোজ্জ্বল মুখ, মুণ্ডিত মস্তক–সমস্ত একত্রে অগ্নিশিখার মতো জ্বলছিলো।
একজন বয়স্ক ভিক্ষু তাকে নিবৃত্ত করার জন্য বললেন, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, বলতে পারো, আমাদের ক্ষমতা কতোখানি? তোমার পরিকল্পনা কী, আমাদের কাছে বলবে?
নিরঞ্জনের ঐ কথায় যেন সম্বিত হয়, ঈষৎ লজ্জায় মাথা নত করে। তবে সে দমিত হয় না। বলে, মহাভিক্ষুরা সমবেত হয়ে বিচার করুন, এবং শীঘ সিদ্ধান্ত নিন, এইটিই আমাদের কথা।
না, ঐভাবে বললে হবে না, আমরা আপনার কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব চাই–দূর থেকে একটি তরুণ ভিক্ষু চিৎকার করে বলে।
সুস্পষ্ট প্রস্তাব আমি অবশ্যই আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো বলে আশা করি। কিন্তু তার পূর্বে আমাদের বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে হবে, নিরঞ্জন বলতে থাকে, আমি পশ্চিমের গ্রামগুলি ভ্রমণ করে এসেছি। দেখেছি মানুষের জীবন অতিষ্ঠ এবং অসহ্য। সর্বত্রই দেখেছি উচ্চশ্রেণীর লোকদের হাতে নিম্নশ্রেণীর লোকদের নিপীড়ন হবেই–প্রত্যক্ষে হোক আর পরোক্ষে হোক। লুণ্ঠন, হত্যা, দস্যুবৃত্তি–এগুলি প্রায় নিত্যসঙ্গী মানুষের জীবনে। রাজপাদোপজীবী যারা, তারা কিছুই করেন না–সম্ভোগ ও ব্যসনে তাঁদের আসক্তি সীমাহীন। প্রজারা তাঁদের কাছে যেন পীড়নের পাত্র–পালনের নয়। ছিন্নমূল ক্ষুদ্রতরুর মতোই তাদের অবস্থা। ফলে যখনই দেখি যবনেরা আসে, তখনই তারা হয় পলায়ন করে, নতুবা বশ্যতা স্বীকার করে–কখনই যুদ্ধ করে না। যবন শক্তি ভিন্নদেশীয়। তারা আজ আছে কাল নেই–এমতাবস্থায় এই–ই মাহেন্দ্রক্ষণ, রাষ্ট্রশক্তি একেবারে শতধা বিচ্ছিন্ন–এই ক্ষয়িত রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করলেই ধসে পড়বে।
আঘাত কে করবে, আমরা? আমাদের কি তাহলে যুদ্ধ করতে হবে? কোন শাস্ত্রে আছে যে ভিক্ষুরা যুদ্ধ করে? সেন রাজার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কতো জানো? অশ্বারোহী কতো বলো? যুদ্ধহস্তির সংখ্যাটি বলতে পারো?
শ্রোতারা একের পর এক প্রশ্ন করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সন্দেহের কথা জানায়।
কেন, আমরা কি যুদ্ধ করতে পারি না? নিরঞ্জন প্রত্যুত্তরে বলতে আরম্ভ করে, আমি আপনাদের দীপঙ্কর অতীশের কথা স্মরণ করিয়ে দিই–তিনি তিব্বতে বলেছেন, ধর্মকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্রশক্তি যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সংঘকে সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, সংঘই হবে সমস্ত কিছুর নির্ধারক। প্রয়োজনবোধে সে–ই রাষ্ট্রশক্তির পরিবর্তন ঘটাবে।
কিন্তু এ কথা তো তিব্বতী ভিক্ষুদের উদ্দেশে বলেছিলেন দীপঙ্কর, এদেশ তো তিব্বত নয়।
নিরঞ্জন গ্রীবা ঈষৎ বঙ্কিম করে। মন্তব্যকারীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে একবার, তারপর বলে, ভ্রাতঃ এ তর্ক অর্থহীন। মহাপণ্ডিতের বাণী কেবল এক দেশের সমস্যা সমাধান করবে, অন্য দেশের সমস্যা সমাধানে তা ব্যবহার করা যাবে না–এমন কি হতে পারে? আপনারা জানেন, হতে পারে না, তথাগত বাণীর কথা চিন্তা করুন, বোধিসত্ত্বের কথা চিন্তা করুন। আমার বিশ্বাস, মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের বাণী সকল দেশের সদ্ধর্মীদের জন্য অবশ্যই পালনীয়–বিশেষত এই দেশে–কারণ এদেশ তাঁর জন্মভূমি।
মিত্ৰানন্দ জানতো না এই প্রকার একটি নির্দেশ মহাপণ্ডিত দান করেছেন। দীপঙ্করের তিব্বতে পরিনির্বাণ হয়েছে সে আজ প্রায় শতাব্দকালের কথা। তার গ্রন্থগুলির কয়েকখানি, শোনা যায়, জগদ্দলে আনা হয়েছে। অতঃপর সেগুলির কি হলো, সন্ধান নেই। নিরঞ্জন কোথায় শুনেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সংঘের করণীয় বিষয়ের নির্দেশটি সেই জানে। তবে মনে হচ্ছে, নিরঞ্জন অধিক আবেগপ্রবণ, সে আবেগ নিয়ে একটি সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই সে বাধা দিলো। বললো, না এখনও সময় হয়নি, ভ্রাতঃ নিরঞ্জন; তোমার বক্তব্যের প্রথম অংশ আমি সমর্থন করি–তোমার বিশ্লেষণও চমৎকার এবং যুক্তিযুক্ত–কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করতে পারি না–আমার বিশ্বাস, এ সিদ্ধান্ত হঠকারী যে, বহিরাগত যবনদের সঙ্গে সহযোগিতা করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তোমার বক্তব্যের ঐ অংশ যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি যে, সত্যই সংঘকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণও করতে হবে। রাষ্ট্রের শাসন যদি ধর্মবিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে সেই শাসনকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমার অনুমান, অতীশ সদ্ধর্মীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কথা বলেছেন। শঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের যে পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন, তা সম্ভব হতো না, যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় সদ্ধর্মীরা মনোযোগী হতেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘ কি যথেষ্ট শক্তিশালী এখন? ভিক্ষুরা পলায়নপর, শাসকরা মারমুখী। এক্ষেত্রে ব্রাত্য এবং অন্ত্যজ ক্ষেত্রকরেরা দ্রোহের পতাকা উত্তোলন করলেই কি সাফল্য আসবে? কয়েকটি স্থানের সংবাদ আমরা জানি, ডোম এবং চণ্ডালেরা ক্রুদ্ধ হয়ে শাসকদের আক্রমণ করেছে, কিন্তু সফল হয়নি শেষ পর্যন্ত। শাসকদের আক্রমণে নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; ক্ষেত্রকরেরা কেউ সক্রিয় সহযোগিতা দান করেনি। যদি ধরেও নিই যে দ্রোহ সফল হয়েছে, তাহলে তারপরে কে নেবে রাজদণ্ড? সামন্ত মহাসামন্তদের স্থানে কারা আসবে? আমার ধারণায় আসে না সমগ্র ব্যাপারটি।
মিত্রানন্দ পুনরায় জানায়, না ভ্রাতঃ নিরঞ্জন, এখনও সময় হয়নি, আরও আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
নিরঞ্জনের ঋজুদেহ অধিকতর ঋজু হয়। দুই চক্ষুতে বিদ্যুৎ চমকিত হয়–সে দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করে উপস্থিত ভিক্ষুমণ্ডলীকে দেখে নেয়। তারপর মিত্রানন্দের উদ্দেশে বলে, না ভ্রাতঃ মিত্রানন্দ, আমাদের অপেক্ষার আর সময় নেই। মগধ এখন যবন সেনাদলের অধিকারে। ওদন্তপুরী বিহার তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। গৌড় পর্যন্ত আগমন এখন তাদের ইচ্ছার ব্যাপার মাত্র–চলে এলেই হয়।
এই যদি প্রকৃত অবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে আর আমাদের ভূমিকা কোথায়? অন্য এক ভিক্ষু প্রশ্নটি করে। বলে, আমরা দ্রোহ করলাম, রাজাকে বিতাড়ন করলাম, আর রাজ্যের অধিকারী হয়ে গেলো যবন রাজা–এ কেমন ব্যবস্থা হবে, চিন্তা করেছেন?
হ্যাঁ, চিন্তা করেছি, নিরঞ্জন জানায়। বলে, যবনরা বহিরাগত, এসেছে, ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে চলে যাবে। তারপর আর কে? তারপর তো আমরা, প্রকৃতিপুঞ্জ। আমাদেরই মনোমতো নির্বাচিত রাজা আমাদের শাসন করবেন, যেমন একদা করেছিলেন গোপালদেব।
নিরঞ্জনের অদ্ভুত শাণিত যুক্তি–এবং অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত তার বক্তব্য–কিন্তু তথাপি মনে হয় না যে তার কথায় কারও মনে আস্থার ভাব সঞ্চারিত হচ্ছে। বসন্তদাসের নিজেরও মনে হয় সমস্ত পরিকল্পনাটিই মিথ্যা ও সুযোগ সন্ধানের উপর নির্মিত। যেন আর এক কৌটিল্যের প্রস্তাবনা। আর সেই সঙ্গে বাস্তব সম্পর্ক বর্জিত অহেতুক উচ্চাশা।
বসন্তদাস দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমস্তই দেখছিলো এবং শুনছিলো। তার নিকটেই কয়েকজন শ্ৰমণও দাঁড়িয়ে ছিলো। লক্ষ্য করলো শ্রমণরা স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য করছে। তাদের মধ্যে তীব্র ক্রোধ এবং আক্রোশ–তারা চিষ্কার করে নিরঞ্জনকে সমর্থন জানাচ্ছে।
কিন্তু সে নিজে নিরঞ্জনের বক্তব্যকে যুক্তিসহ বলে গ্রহণ করতে পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো, এরা অর্থহীন একটা উচ্চাশা নিয়ে বসে আছে। মাত্র জনা কয় ভিক্ষু গ্রাম গ্রামান্তরে চণ্ডাল ব্রাত্যদের বলবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ জেগে উঠবে? বিদ্রোহ কি অতোই সহজ? তার অনুমান, এরা প্রকৃত অবস্থা কিছুই জানে না–গ্রামে ব্রাত্য আর কয়জন? অধিকাংশই তো ক্ষেত্রকর। ক্ষেত্রকরেরা সদ্ধর্মীদের কথা শুনবেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ঐ সময় একজন ভিক্ষুর বক্তব্য তার শ্রবণে আসে। খর্বকায় প্রৌঢ় ভিক্ষুটি গম্ভীর স্বরে কথা বলছিলেন, বসন্তদাস শুনলো।
ভ্রাতা নিরঞ্জন উচিত কথা বলেছেন, তার কথা আমি সমর্থন করি। তবে তাঁর মূল প্রস্তাবটির বিচার হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলছেন, সংঘকেই সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র ব্যাপারেও সংঘের ভূমিকা আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, সংঘের কথা কেউ চিন্তা করেছেন? আমার তো মনে হয় না, কোনো লোক আমাদের ধর্ম অনুসরণ করতে আসবে। আমাদের মধ্যে কতো বিভাগ, চিন্তা করে দেখুন। সিদ্ধাচার্যরা কতো প্রকার সাধনরীতির কথা বলেন। সংসারত্যাগী সাধকদের ঐ সাধনাচার কি সকলের জন্য গ্রহণীয়? আপনারাই বলুন? আর যদি সাধারণ মানুষ আমাদের সহজভাবে গ্রহণ না করতে পারে, তাহলে আমাদের স্থান কোথায়? আপনারা চিন্তা করুন, আমাদের প্রকৃত শক্তি কতখানি। পক্ষান্তরে দেখুন, একজন গ্রামপতি কিরূপ শক্তিমান। দুই চারিজন সামন্তানুচরই একখানি সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে দিতে পারে। গ্রামবাসীরা জানে না প্রতিবাদ কাকে বলে, সমস্তই তারা ললাটলিপি বলে গ্রহণ করে।
তাহলে কি আমরা একেবারেই নিশ্চেষ্ট থাকবো? নিরঞ্জনের স্বরে তীব্র বিদ্রূপ।
না, তা কেন, জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরা সমস্বরে বলতে লাগলেন, আমাদের প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন–সংঘকে শক্তিশালী করা, জনগণকে সত্যধর্মে দীক্ষা দেওয়া, এই সকল কাজ আমাদের অবশ্যই করে যেতে হবে। অপেক্ষা ব্যতীত এখন আর আমাদের পথ নেই।
শুধু অপেক্ষাই নয়, আমার মনে হয়, আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত সমাজের সকল শ্ৰেণীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টি করা।
বসন্তদাস দেখলো, দূরে প্রায়ান্ধকার ছায়ায় একজন ভিক্ষু উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে দেখে মৃদু কোলাহল আরম্ভ হয়ে গেলো। কোলাহল শান্ত করার জন্য মিত্রানন্দ চিৎকার করে বললো, বলুন শিবানন্দ, আপনার বক্তব্য বলুন।
সদ্ধর্মী ভিক্ষুটির নাম শিবানন্দ, অদ্ভুত কাণ্ড বলতে হবে, বসন্ত অবাক হয়। পার্শ্ববর্তী শ্ৰমণটি জানালো, লোকটির মস্তিষ্কে দোষ আছে–উনি সর্বধর্মের সমন্বয় চান–তার ধারণা, শিব বোধিসত্ত্ব ছিলেন।
শুনুন, ভিক্ষু শিবানন্দের কথা শুনুন।
যা বলছিলাম, সদ্ভাবের কথা, শিবানন্দ বলতে লাগলেন, আমাদের সদ্ভাব ও মিত্রতা করতে হবে, রাজশক্তির সঙ্গে। তাদের বোঝাতে হবে প্রকৃত পরিস্থিতিটি কি
ভিক্ষু শিবানন্দ কি শৃগাল সমীপে মিনতি করতে বলেন, কুম্ভীর শাবকদের যেন সে ভক্ষণ না করে? একজন তরুণ শ্ৰমণ প্রশ্নটি করে।
না, তা নয়, ব্যাঘ্রকে করজোড়ে অনুরোধ করতে হবে, প্রভু আপনি তৃণ ভোজন করুন! সহাস্যে মন্তব্য করে অন্য আর এক তরুণ ভিক্ষু।
নিরঞ্জন পুনরায় উঠে দাঁড়ায়। বলে, ভিক্ষু শিবানন্দ, আপনার প্রস্তাব উত্তম। অবশ্যই আমরা সদ্ভাব ও প্রীতির হস্ত প্রসারণ করবো। কিন্তু প্রশ্ন, সদ্ভাব ও প্রীতি কিসে উপজাত হয়? নিশ্চয়ই বিশ্বাসে, আন্তরিকতায়, উদারতায়–কিন্তু তার চিহ্ন কি কোথাও দেখেছেন সেন রাষ্ট্রব্যবস্থায়?
সে ত্রুটি তো উভয় পক্ষেই নিরঞ্জন, শিবানন্দ ক্ষুব্ধ স্বরে জানান, সদ্ধর্মীরাও তো উদার হতে পারছে না!
এ আপনি কি বলছেন ভিক্ষু শিবানন্দ? সদ্ধর্মীরা যদি উদার না হয় তো উদার কে? নিরঞ্জন বলতে থাকে, মহারাজ শশাঙ্ক এই পুন্ড্রবর্ধনের কতিপয় সদ্ধর্মীর বিসদৃশ আচরণের কারণে কয়েক সহস্র সদ্ধর্মীকে হত্যা করেছিলেন, সে কথা স্মরণ করুন–স্মরণ করুন, সোমপুর বিহারের কথা–মহারাজ জাতবর্মণের সৈন্যদল বিহার ধ্বংস করে প্রধান ভিক্ষুকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলো। একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানও কি সামান্যতম রাজানুকূল্য পেয়েছে সমগ্র সেন শাসনকালে? বলুন, দেখাতে পারবেন কোনো প্রমাণ? আপনি উদারতার কথা বলছেন, সেন রাজাদের মতো যদি হতেন পাল রাজারা, তাহলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এ অঞ্চলে থাকতে পারতো? ও কথা বলবেন না–রাজপুরুষদের সঙ্গে মিত্রতা সম্ভব নয়, অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই। আসুন, আমরা ভিক্ষুমণ্ডলীর এই সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করি যে, সেন রাজশক্তি লুণ্ঠক, অপহারক ঘাতক এবং নারী হরণকারী, এই রাজশক্তি প্রকৃতিপুঞ্জের সকল বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে–তাই আমরা এই রাজশক্তির অপসারণ চাই।
অসম্ভব, মিত্রানন্দ তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে। চিৎকার করে জানায়, ভিক্ষুসভায় এ প্রস্তাব গ্রহণ সম্ভব নয়–এ প্রস্তাব ঈর্ষা ও ক্রোধ প্রসূত, হঠকারী এবং একদেশদর্শী। আমরা মনে করি, এ প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে যবনদের আগমনের পথ সুগম হবে–সে ব্যবস্থা আমাদের অভিপ্রেত নয়। আমরা অবশ্যই মানব মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবো, প্রয়োজন হলে শতাব্দকাল পর্যন্ত আমাদের সগ্রাম চলবে–কিন্তু বহিঃশক্তির এ দেশে আগমন সহ্য করবো না, আমাদের সংগ্রাম আমাদেরই করতে হবে। আমরা যবন আহ্বানের বিপক্ষেই অভিমত জ্ঞাপন করি। আসুন, সেইমর্মে প্রস্তাব গৃহীত হোক।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, না–না, এই প্রকার কোলাহল উঠলো। ভিক্ষুরা একে একে সভাস্থল থেকে বাহিরে চলে যেতে আরম্ভ করলো। এবং এক সময় দেখা গেলো, সভাস্থলে কেউ নেই, সকলেই বাহিরে।
নিরঞ্জনকে দেখলো বসন্তদাস। অতিশয় ক্ষুব্ধ মুখভাব, বাহিরে এসে চীবরের প্রান্তখানি স্কন্ধে তুলে অগ্রসর হচ্ছিলো। বসন্তদাস ডাকলো, ভিক্ষু নিরঞ্জন, আপনার সঙ্গে দুটি কথা আছে আমার।
নিরঞ্জন দাঁড়ায়, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বসন্তদাসের মুখে। তারপর জানতে চায়, আপনি কে?
আমার নাম বসন্তদাস, আমি সদ্ধর্মী নই, তবে বলতে পারেন আপনাদের একপ্রকার সহগামী।
মুহূর্তে নিরঞ্জনের মুখভাব শান্ত এবং ধীর হয়, নমস্কার করে বলে, বলুন আপনার কী কথা আছে?
আপনি ছায়াবতীর কোনো সংবাদ জানেন?
নিরঞ্জনের ভ্রূরেখা ঈষৎ কুঞ্চিত হয়। বলে, হ্যাঁ, ছায়াবতী আমার ভগিনী, তার কোনো সংবাদ আছে?
হ্যাঁ, তিনি আপনার কুশল জানতে চেয়েছেন–আপনি কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন?
নিরঞ্জন হাসে। বলে, নারীদের নিয়ে সমস্যা কি জানেন, তাঁরা চিরন্তন মাতা এবং ভগিনী। তিনি জানেন, আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি–গৃহীর মানসিকতা আমার নেই, তথাপি তিনি আমাকে কাছে পেতে চান–আমার কি সময় আছে, আপনিই বলুন? তাঁকে। বুঝিয়ে বলবেন, আমি অবশ্যই কদম্বঘাটে যাবো, তবে বিলম্ব হবে। জানাবেন, আমি সুস্থ আছি, ভগবান তথাগতের কৃপায় সুখী আছি।
সবিনয়ে নমস্কার করে অতঃপর নিরঞ্জন আবার সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়।
বসন্তদাস দেখলো, দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে চলেছে তরুণ ভিক্ষুটি। মস্তক উন্নত, গম্ভীর এবং ধীর। মনে মনে সে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলো না। এ তরুণ সাধারণ ভিক্ষু নয়, সে বুঝলল, এ সম্মুখে বহুদূর পর্যন্ত পথ অতিক্রম করতে পারবে।
মিত্রানন্দ হতাশ। সভায় সিদ্ধান্ত কিছুই হলো না। মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ সাধারণ ভিক্ষুদের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন–তা আর জানানো সম্ভব নয়। বসন্তদাসকে ডেকে বললো, বসন্ত তুমি কি এবার যাবে?
মিত্রানন্দ আর কী করবে–তার কোনোই কাজ নেই। সেও একপ্রকার হতাশ। আশা ছিলো, সদ্ধর্মীরা মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ঐক্যভাব সৃষ্টির চেষ্টা করবে। তাতে অন্যকিছু না হোক, অন্তত সামন্ত মহাসামন্তরা কিছুকালের জন্য দমিত থাকতো। কিন্তু দেখছে, সে পথ একেবারেই বন্ধ–সদ্ধর্মীরা রাজশক্তির মিত্র হতে চায় না। কী যে তারা চায়, কিছুই অনুমান করা গেলো না। একপক্ষ যা চায়, অন্যপক্ষ চায় তার বিপরীত। সুতরাং আর পুন্ড্রনগরীতে অবস্থান কেন? এবার সে যাবে। বললো, মিত্রানন্দ, আমার আর বিলম্ব করে কোনো লাভ আছে, বলো?
না, আর কি লাভ বিলম্ব করে, মিত্রানন্দ জানায়, আমিও এ স্থানে থাকবো না, তবে একটি কাজ এখনও বাকি আছে–আর একটি সংবাদ জানা প্রয়োজন, সেটি হলে আমিও যাবো–তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?
তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিক্ষুরা উপাসনার আয়োজন করছিলো। মিত্রানন্দের এক সহচর এসে জানালো, আসুন উপাসনার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে।
মিত্রানন্দ বললো, তুমি যাও, আমি আসছি।
লোকটি চলে গেলে সে আবার বললো, বসন্ত, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
কোথায়, উপাসনায়?
না, আমি যেখানে যাবার কথা বলছিলাম।
অধিক দূরে কি?
না, দূরে নয়, নিকটেই, নগরীর পশ্চিমপ্রান্তে।
চলো যাই।
তাহলে তুমি কিছুক্ষণ দাঁড়াও, উপাসনা আরম্ভ হলেই আমি চলে আসছি–বিলম্ব হবে না।
সত্যই অধিক বিলম্ব হলো না। অল্পক্ষণ পরই ফিরে এলো বসন্ত। বললো, এবার চলো।
সন্ধ্যা গত হয়েছে, তথাপি পশ্চিম আকাশে পাটল মেঘগুলির প্রান্তভাগ রক্তিম ভাব। সেদিকে ইঙ্গিত করে মিত্রানন্দ বললো, দেখেছো, আকাশে কেমন রঙ?
হ্যাঁ, যেন সিন্দুর বর্ণ।
না বসন্ত, আমার মনে হয়, বর্ণটি রক্তের মতোই, সন্ধ্যারম্ভে তুমি দেখোনি, দেখলে বুঝতে। বৃদ্ধরা বলে, আকাশে ঐরূপ রক্ত বর্ণের মেঘ রক্তপাতের ইঙ্গিত বহন করে।
ওসব কুসংস্কার মাত্র, লোকের কল্পনা।
কয়েক পদ অগ্রসর হয়েছে, ঐ সময়ই আবার অদূরে একটি পথকুক্কুর কেঁদে উঠলো।
শুনছো বসন্ত?
হ্যাঁ, পথকুক্কুর কাঁদছে–পথকুক্কুর কাঁদলে মন্বন্তর হয়, এই প্রকার লোকপ্রবাদ আছে।
তুমি বিশ্বাস করো?
না, মিত্রানন্দ। এসব আমার বিশ্বাস হয় না–জ্যেষ্ঠী, শূন্যকুম্ভ, শৃগাল, গোধিকা এসব দেখলে নাকি বহুকিছু হয়, সবই অমঙ্গল–চিহ্ন, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।
আমারও হয় না, মিত্রানন্দও জানায়। তারপর বলে, কিন্তু মধ্যরাত্রে গভীর নিঃশব্দতার মধ্যে যখন কুকুরের ঐ প্রকার কান্না ওঠে, তখন সত্যই ভয়াবহ কিছু ঘটবে বলে আশঙ্কা হয়। আজ কদিন ধরেই সন্ধ্যাকাশে রক্তিমাভা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস করি না, তথাপি মনের মধ্যে কেমন আশঙ্কার ছায়া দোলে।
যে স্থানে মিত্রানন্দ নিয়ে এলো সেটি একটি যবন কেন্দ্র। দ্বারদেশে বহু লোক। সকলেই বলছে, দরবেশ দর্শন চাই, দরবেশ দর্শন চাই।
বসন্তদাস শুনে অবাক। জানতে চাইলো, দরবেশ কি বস্তু? এ কি কারও নাম?
হ্যাঁ, যবনদের এ স্থানীয় প্রধানকে এরা দরবেশ বলে থাকে–শব্দটি যাবনী ভাষায়–এর অর্থ নাকি সংসার ত্যাগী সাধুপুরুষ।
বিচিত্র স্থান, দ্বারদেশে নারী পুরুষের কোলাহল, কিন্তু অভ্যন্তর একেবারেই নীরব। প্রলম্বিত শ্বেতবস্ত্রধারী, দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ, ধীর পদে যবনেরা গমনাগমন করছে। তাদের দেখিয়ে মিত্ৰানন্দ বললো, এরা এই কেন্দ্রের অধিকারীটির শিষ্য–প্রত্যেকেই ধর্মপ্রাণ।
বসন্তদাসের মনে পড়লো দেবীকোট মেলার সেই যবন বৃদ্ধটির কথা। বললো, এরা তো দেখছি শান্ত এবং ভদ্র–কিন্তু জনরব যে শুনি, যবন জাতি নাকি নিষ্ঠুর এবং দুর্ধর্ষ? এরা কি সত্যই এক জাতি?
আমি বলতে পারবো না। পরিচিত মুখ দেখে মিত্রানন্দ ডাকলো, এই যে মহাশয়, শুনছেন?
এক যবন পুরুষ সম্মুখে এগিয়ে এলো। মুখে স্মিত হাস্য। বললো, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, কি সংবাদ? বহুদিন পরে এলেন মনে হচ্ছে?
মহাত্মা আহমদের সঙ্গে কি সাক্ষাৎ হবে? মিত্ৰানন্দ জানালো, বলবেন, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি।
নিশ্চয় সাক্ষাৎ হবে, আসুন।
লোকটি নিজ ভাষায় অপর একজন সহচরকে কিছু বললে সহচরটি দ্রুত প্রস্থান করে। অতঃপর এক কুটিরের সম্মুখ প্রাঙ্গণে একটি বেদী দেখিয়ে লোকটি বলে, এখানে বসুন, আমি প্রভুকে আপনার আগমন সংবাদ দিয়ে আসি।
কুটিরের সম্মুখে কয়েকজন লোক অপেক্ষমাণ। দেশীয় লোক তারা, কেন অপেক্ষা করছে, কিছুই অনুমান করতে পারে না বসন্তদাস।
ক্ষণকাল অতিবাহিত না হতেই দেখা গেলো, একটি লোক ক্ষুদ্র একটি কলস এবং পানপাত্র এনে সম্মুখে রাখছে। লোকটি নিজ ভাষায় কিছু বলে ইঙ্গিত করলো। বোঝা গেলো, ঐ পানীয় পান করতে হবে। বসন্তদাস অনুমান করে, নিশ্চয়ই কোনো প্রকার আসব। সে উৎফুল্ল বোধ করলো, যাক, বহুদিন পর আসব পানের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু পান করে দেখলো নিতান্তই মিষ্ট জল–তবে সুগন্ধী এবং তৃপ্তিদায়ক।
পান শেষ হবার পূর্বেই প্রথম লোকটি ফিরে এসে জানালো, বন্ধু মিত্রানন্দ, আসুন, এখনই তিনি আপনাদের সাক্ষাৎ দান করবেন।
কুটিরের ভিতরটি শুভ্র বস্ত্রাচ্ছাদিত। এক প্রান্তে কৃষ্ণাম্বরধারী শক্তিমান এক প্রৌঢ় বসে আছেন। নিকটেই কোথাও ধূপজাতীয় কিছু দগ্ধ হচ্ছে, সুগন্ধে কক্ষটি আমোদিত। প্রৌঢ়ের সম্মুখে একটি উপাধান, সেই উপাধানের উপর একখানি পুঁথি। মনে হলো, কিছুক্ষণ আগেও পুঁথি পাঠ হচ্ছিলো।
দুজনে সম্মুখে বসে প্রথমে প্রণাম জানালো। সাধুপুরুষ বললেন, ঈশ্বরের শান্তি বর্ষিত হোক তোমাদের উপর। তারপর জানতে চাইলেন, মিত্রানন্দ, তোমাদের সমস্ত কুশল তো, মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দ কি ফিরেছেন?
আজ্ঞে না।
না ফেরাই মঙ্গল। ইনি কে? বসন্তদাসের মুখপানে দৃষ্টিপাত করলেন সাধুপুরুষ।
ইনি আমার মিত্র, এবং সহগামী।
উত্তম, বলো, কী সংবাদ?
অর্হৎ জ্ঞানানন্দ আপনার অভিমত জানতে চেয়েছেন–যবন সেনাদলের সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে আমাদের? মিত্রতার, না অসহযোগের?
সাধুপুরুষ স্মিত হাসলেন। বললেন, যারা আসছে তারা ভাগ্যান্বেষী সৈনিক, অসহযোগিতা করে কী লাভ বলো? আমি তো মনে করি, মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রথম সম্পর্কই হওয়া উচিত মিত্রতার।
কিন্তু একটি বিষয় চিন্তা করার আছে, এই পর্যন্ত বলে সাধুপুরুষটি বিরত হলেন। নিজ ভাষায় মৃদুকণ্ঠে মন্ত্রজাতীয় কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, চিন্তার বিষয়টি হচ্ছে, কার সঙ্গে মিত্ৰতা করবে? তারা কি মিত্রতার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিয়েছে তোমাদের দিকে? যারা তরবারি উত্তোলন করেছে আঘাত করার জন্য, তোমার হস্ত সম্প্রসারণ করে দিলে তাদেরই দিকে, তাতে ফল কী হবে? তোমাদের হাতগুলি অহেতুক ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং কার সঙ্গে মিত্রতা, সেইটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। জ্ঞানানন্দকে বলো আমি সংবাদ পেয়েছি যে সদ্ধর্মীদের কেউ কেউ সামন্তপতিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যবন বাহিনীকে পথ দেখিয়ে আনতে চান–সাবধান, ঐ কাজ যেন কেউ না করে–এই যবনেরা তুর্কি, এরা বর্বর, জ্ঞান বিদ্যা ধর্ম কোনো কিছুতেই এদের শ্রদ্ধা নেই। এদের ডেকে আনা আর আত্মঘাতী হওয়া একই ব্যাপার।
প্রভু, আপনি কি মনে করেন, যবন সেনারা এদেশে আসবে? বসন্তদাস প্রশ্নটি না করে পারে না।
অবশ্যই আসবে–দস্যু যদি জানতে পারে যে দস্যুবৃত্তি করলে কেউ বাধা দেবার। নেই, তাহলে সে কি করে, বলো?
তাহলে এদেশের মানুষের উপায়?
উপায় তো আমি দেখি না, পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা ব্যতীত। তবে মনে হয় না, তারা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারবে, কারণ তাদের সংখ্যা অধিক নয়।
আর একটা কথা বলি তোমাদের, মহাত্মা আহমদ জানান, যারা বহিরাগত, তারা যদি মনে প্রাণে বহিরাগতই থেকে যায়, তাহলে এদেশে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু যদি তারা মৃত্তিকালগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে, প্রকৃতিপুঞ্জের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়, তবে কিন্তু তাদের এদেশ থেকে বিতাড়ন করা অসম্ভব হবে।
ঐ পর্যন্তই কথা। দুজনে উঠে আসছিলো। সাধুপুরুষটি বললেন, তোমরা সাবধানে নগরীতে থাকবে–আমি সংকেত পেয়েছি, যবনেরা রাজধানী আক্রমণ যে কোনোদিন করতে পারে। যদি আগামীকালই শুনতে পাই যে এই নগরীও আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে আমি অবাক হবো না।
এই পর্যন্ত বলে তিনি হাসলেন। বললেন, জ্ঞানানন্দকে বলো তো, তিনি আমাদের ধর্মগ্রহণ করবেন কি না? তোমাদের ধর্মের সঙ্গে আমাদের ধর্মের তো বহু সাদৃশ্য আছে, সেটি জানো তো?
ঐ কথার পর হাসতে হাসতে বিদায়।
বাইরে এসে মিত্রানন্দ বললো, দেখলে তো? যবন সেনাদল সম্পর্কে যবন সাধুপুরুষটির কী ধারণা? নিরঞ্জন হঠকারী ব্যতীত অন্য কিছু নয়।
বহির্দ্বারের নিকটে এসে হঠাৎ বসন্তদাস দাঁড়ালো, আশ্চর্য, এ কে? উজুবটের লীলাবতী?
তরুণীটিকে দেখলো মিত্রানন্দও। বললো, তুমি ওকে চেনো?
হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর বাল্যসখী, ও এখানে কেন?
নিকটবর্তী হতেই লীলাবতীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ভ্রাতঃ আপনি?
হ্যাঁ, তুমি এখানে কেন?
তারপর লীলাবতী কাঁদলো হাসলো ক্রমান্বয়ে কয়েকবার এবং ঐ হাসি কান্নার মধ্যেই নিজ দুর্ভাগ্যের কথা বর্ণনা করলো। শেষে জানতে চাইলো, মায়াবতী কেমন আছে, তার বিপদ হয়নি তো?
অল্প সময়, কতোটুকুই বা বলা যায়। কখনও এ কথা মনে হয়, কখনও ও কথা মনে হয়। বসন্তদাস লক্ষ্য করলো, লীলাবতীর কথায় সংলগ্নতা নেই।
অদূরে মিত্ৰানন্দ অপেক্ষা করছিলো। সে বললো, এখন যাই লীলা, পরে সাক্ষাৎ হবে।
মিত্রানন্দকে আর কিছু জিজ্ঞাসার নেই। সবই তো জানা হয়ে গেছে। কি অসম্ভব দুরাশা মিত্রানন্দের। কতো স্বপ্ন, মানুষের মুক্তি হবে দাসত্ব থেকে, যুগযুগ ধরে লাঞ্ছিত মানুষ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত হবে, মানুষের সৃজন ক্ষমতা শত স্রোতোধারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ কী হতে যাচ্ছে, মিত্রানন্দ?
মিত্রানন্দ নীরব। কতো দীর্ঘ পথ তাকে পরিক্রমা করতে হয়েছে। কোথায় পট্টিকেরা রাজ্য আর কোথায় জগদ্দল মহাবিহার। সমগ্র ভূ-ভাগের ধূলিকণা তার দুই পায়ে লেগে আছে–সমস্তই কি বৃথা? কৃষ্ণা শুক্লা বিভাবতীর লাঞ্ছনা, সেও কি বৃথা? তার মন স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু স্বীকার না করেও উপায় নেই। সে বসন্তদাসের হাত ধরলো। বললো, মিত্র বসন্ত, আমাদের স্বপ্ন রচনা কি স্বপ্নই থেকে যাবে? এতো শ্রম, এতো স্বেদ, এতো আত্মদান–সমস্তই বৃথা? বলো, তোমারও কি মনে হয় সমস্তই বৃথা যাবে?
বসন্তদাস রাত্রির আকাশে নক্ষত্রমালা দেখে। কোন তারকাটির নাম সে কৃষ্ণা রেখেছিলো, এখন সন্ধান করে পায় না। বলে, না মিত্ৰানন্দ, ও কথা আমার কাছে জানতে চেয়ো না–আমি বলতে পারবো না। কারণ, আমি জানি না।
তাহলে কে জানে? মিত্ৰানন্দ বিভ্রান্ত বোধ করে। একদিকে হতাশা আর অন্যদিকে বেদনা। কিছুই কি করণীয় নেই? পথক্ৰমণকালে তার মনে নানান চিন্তা আলোড়িত হয়। জগৎ কি বস্তুপুঞ্জ মাত্র। জীব কি তাহলে বস্তুতেই জাত হয় এবং বস্তুতেই হয় বিলীন? অনন্ত তার বন্দীদশা–বস্তুকে অতিক্রম করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই? যদি থাকতো, তাহলো জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব অবশ্যই প্রত্যক্ষ করা যেতো–বিচ্ছিন্ন মানুষ ঐকমত্যে উপনীত হতে পারতো। কিন্তু তা তো হলো না। অথচ তার বিশ্বাস ছিলো একটি ঐকমত্য হবে। কারণ জ্ঞানানন্দ বলেছিলেন, চিন্তা করো না মিত্রানন্দ, বস্তুময় জগৎ পরুষ, কঠোর এবং ক্ষেত্রবিশেষে নির্মমও বটে, কিন্তু এও আবার সত্য যে ঐ বস্তুময় জগতে অবগাহন করেই জীবসত্তা জ্ঞানের অধিকারী হয়। সুতরাং সাময়িক বিপর্যয় দেখে ভীত হবার কারণ নেই–দেখবে, ঘাতসংঘাতের মধ্য দিয়ে যথাসময়েই জ্ঞান এবং করুণার আবির্ভাব হচ্ছে, আর তা হলেই তখন আর চিন্তার কিছু থাকবে না।
জ্ঞানানন্দের ঐ স্থির বিশ্বাসের এখন কি হবে? সে ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপারটি ঘটেছে। নিরঞ্জনের মতো নিষ্ঠাবান ভিক্ষুও হিংসাকে প্রতিরোধ করতে চায় প্রতিহিংসা দিয়ে–অত্যাচারী ভ্রাতাকে বিতাড়ন করার জন্য বহিরাগত দস্যুকে আহ্বান করতে দ্বিধা নেই তার। সুতরাং সকল উদ্দেশ্যই তার বিফলে গেলো। এ অবস্থায় জীবের রক্ষা এখন কীভাবে সম্ভব? সে চিন্তা করে কূল পায় না।
ত্রিশরণ মন্ত্রটি সে এখন প্রায় সর্বক্ষণই মনে মনে জপ করে, কিন্তু তথাপি স্বস্তি বোধ হয় না। চক্ষু মুদিত করলে দিব্যচক্রটি আর সে দেখে না–দেখে লেলিহান অগ্নিশিখা এবং রক্তস্রোত। মনে হয়, বহুদূরে কোথায় যেন অসংখ্য আর্ত মানুষ হাহাকার করে যাচ্ছে। ফলে সে প্রায় নীরবেই পথ চলে।
বসন্তদাস জিজ্ঞাসা করে, সখা, তুমি কী ভাবো, বলো তো?
মিত্রানন্দ ম্লান হাসে। বলে, নতুন কিছু নয় বসন্ত, পুরাতন কথাই ভাবি–চিন্তা হয়, ভবিষ্যতে কী হবে।
বসন্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে–আর ভবিষ্যৎ! ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কি আর লাভ আছে কিছু! বরং এখন কী করবে সেইটি চিন্তা করো।
আমার তো করণীয় কিছু নেই এখন, মিত্রানন্দ জানায়। তারপর বলে, তুমি কি কিছু করবে বলে ভাবছো?
নাহ্, আমি আর কী করবো–ভাবছি সত্বর গৃহে ফিরবো–তুমি?
আমি, মিত্রানন্দ দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলে, হ্যাঁ, আমাকেও ফিরতে হবে মহাভিক্ষু জ্ঞানানন্দের সন্ধান করে তার কাছে যাবো।
তারপর?
তারপর আর জানি না। বসন্তদাসের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়–যদি জানাই না থাকে তোমাদের, তাহলে কেন এতো আয়োজন করতে নেমেছিলে? যারা তোমাদের ভরসায় নবীন আশায় উজ্জীবিত হয়েছিলো, তাদের কী হবে? প্রশ্নটা জাগে বসন্তদাসের মনে, কিন্তু প্রকাশ করে না সে। মিত্রানন্দ নিজেই যে অসম্ভব মনোকষ্টে পীড়িত হচ্ছে সেটা তো তার অগোচর নয়। সুতরাং কিছু বলতে পারে না সে। একত্রে পথ ভ্রমণ তাদের–কিন্তু দুজনের মধ্যে বিপুল একটা দূরত্ব থেকে যায়।