দানবের আবেদন
নিজের কাহিনি শেষ করে দৈত্য আমার পানে তাকিয়ে রইল মৌনমুখে।
আমিও নিরুত্তর হয়ে রইলুম। তার দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আমাকে এতখানি অভিভূত করেছিল যে আমি জবাব দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলুম না।
দৈত্য বলল, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ মনুষ্য-সমাজের মধ্যে। কিন্তু কোনও মানুষই আমার সঙ্গী হতে রাজি নয়। তাই দুনিয়ায় আমি একা। তোমাকে এই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে।
জানতে চাইলুম, কেমন করে?
আমারই মতন ভয়াবহ এক নারী সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের মতন সে আমাকে কখনওই ঘৃণা করবে না–আমার বউ হতে রাজি হবে। তাহলেই একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তিলাভ করব।
তার এই প্রস্তাব শুনে আবার জেগে উঠল আমার ক্রোধ। বললুম, অসম্ভব! আমি সৃষ্টি করব তোর মতন আবার এক দানবী, আর তারপর তোরা দুজনে মিলে করবি মানুষের ওপর অত্যাচার? না, তা হবে না! দূর হ!
দৈত্য অবিচলিত কণ্ঠে বললে, প্রভু, তুমি ভুল বুঝেছ। আমার ওপরে সবাই অত্যাচার করে বলেই আজ আমি হিংসুক হয়েছি। এমনকি তুমি পর্যন্ত আমার প্রতি বিমুখ—অথচ আমি হচ্ছি তোমারই সৃষ্টি! আমার কথা যদি না শোনো, তোমার সর্বনাশ করব! শোনো, আমি চাই আমারই মতন কুৎসিত দেখতে একটি স্ত্রী। তাহলে আমরা দুজনেই সুখের জীবন যাপন করতে পারব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, স্ত্রীকে নিয়ে মানুষের বসতি ছেড়ে চলে যাব পৃথিবীর কোনও সুদূর নির্জন প্রান্তে। মানুষের চোখ আর আমাদের দেখতে পাবে না।
যদি ফের ফিরে আসো?
কখনও না, কখনও না! শত্রুর কাছে ফিরে আসব কীসের মোহে?
কে জানে এই অনুরোধ তোমার ছলনা নয়? মানুষকে তুমি ঘৃণা করো। কে জানে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করবার জন্যেই তুমি আবার আমার কাছে এসেছ কি না?
প্রভু, আবার তুমি ভুল বুঝছ। আমি যদি আর-একজনের সহানুভূতি পাই তাহলে আবার আমার প্রকৃতি শান্ত হবে। জীব কখনও একলা থাকতে পারে? পশুও যে দোসর চায়!
নীরবে ভাবতে লাগলুম। দৈত্য যে সত্যকথাই বলছে তাতে আর সন্দেহ নেই। প্রথমে এর স্বভাব ছিল মিষ্টি, এর প্রাণ ছিল প্রেম ও উদারতায় ভরা। কিন্তু উপকার করতে গিয়ে এ সয়েছে অত্যাচার, ভালোবাসতে গিয়ে পেয়েছে খালি ঘৃণা। তার ওপরে এর শাসানিও তুচ্ছ ভেবে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। চেহারায় আর ক্ষমতায় এর তুলনা নেই। এ বুদ্ধি পেয়েছে। মানবের আর শক্তি পেয়েছে দানবের। একে তুষ্ট না করলে এ যদি মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে বাধা দেওয়ায় মতন মানুষ গোটা পৃথিবী খুঁজলে পাওয়া যাবে না।
বললুম, দানব, আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হলুম। তোমার বউয়ের মূর্তি গড়ব। কিন্তু তারপর তুমি মানুষের বসতির ত্রিসীমানায় থাকতে পারবে না।
দৈত্য বিপুল আনন্দে বললে, ওই প্রদীপ্ত সূর্য, ওই অনন্ত নীলাকাশ আমার সাক্ষী, একজন সঙ্গী পেলে আমি তাকে নিয়ে চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাব।
বেশ, তাহলে এখন বিদায় হও।
প্রভু, তুমি তবে সৃষ্টি-কার্য শুরু করো। কতখানি উৎকণ্ঠা নিয়ে আমি যে তোমার কাজ লক্ষ করব তা কেবল আমিই জানি। যেদিন তুমি সফল হবে সেইদিনই আবার আমার দেখা পাবে! এখন বিদায়! বলেই সে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি চলে গেল—যদি হঠাৎ আবার আমি মত পরিবর্তন করি, বোধহয় সেই ভয়েই! আশ্চর্য ক্ষিপ্র তার দুই পদ, উঁচু-নিচু পাহাড় পার হয়ে সে অদৃশ্য হল হরিণের চেয়ে দ্রুতগতিতে!
সন্ধ্যার সময়ে বাংলোর বারান্দায় বসে আছি—মনের ভেতর দিয়ে ছুটছে ভাবনার বন্যা!
আবার আমাকে নতুন সৃষ্টি করতে হবে! কিন্তু প্রথম বারের মত এবারে সৃষ্টির সম্ভাবনায় মন আমার আগ্রহে অধীর হয়ে উঠল না-এ সৃষ্টির সঙ্গে আর আমার প্রাণের যোগ নেই…
পরদিন সকালে বাবার এক পত্ৰ পেলুম। বাবা লিখেছেন—
স্নেহাস্পদেষু,
অজয়, আশা করি বায়ু পরিবর্তনের ফলে তোমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। আমার সমস্ত চিন্তাই এখন তোমাকে নিয়ে, কারণ আজ এ পৃথিবীতে আমার আত্মজ বলতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই তোমার ভালোমন্দের ওপরে নির্ভর করছে আমার সুখ-দুঃখ।
তুমি জানো, সংসারের হিসাবের খাতা মোড়বার বয়স আমার হয়েছে। একে বার্ধক্যের ভার হয়ে উঠেছে অসহনীয়, তার ওপরে অশোকের শোচনীয় মৃত্যু। আমার দেহের আর মনের শেষ শক্তিটুকু হরণ করে নিয়েছে। আমি দিনের পর দিন গুনছি জীবন্ত শবের মতো—এখন যেকোনও মুহূর্তে আসতে পারে পরকালের ডাক!
কিন্তু ইহলোক ত্যাগ করবার আগে আমার একটি শেষ কর্তব্য আছে। তা পালন না করলে আমার আত্মা পরলোকে গিয়েও শান্তিলাভ করবে না। আমার বন্ধুকন্যা মমতার ভার রয়েছে আমার ওপরে। মৃত্যুর আগে তার একটা ব্যবস্থা করে যেতে চাই।
সে ব্যবস্থা কী, তুমি জাননা। মমতাকে এতদিন আমি রক্ষা করেছি কেবল তোমার জন্যেই, একথা কারুর অবিদিত নেই। মমতাকে কেবল লালন-পালন নয়, আমার পুত্রবধূ করব, বন্ধুর মৃত্যুশয্যায় এমন প্রতিজ্ঞাও আমি করেছি। আর মমতা যে সবদিক দিয়েই তোমার যোগ্য, একথাও বলা বাহুল্য।
বাবা অজয়, এর চেয়ে বেশি আর কী বলব? মমতা তোমার জীবনযাত্রার পথ মধুময় করে তুলুক, এই আমার একমাত্র কামনা।
আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তোমার উত্তর পেলেই শুভ-বিবাহের দিন স্থির করে ফেলব। ইতি—
উত্তরে সম্মতি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ মমতা যে আমার স্ত্রী হবে, একথা বহুদিন হতেই শুনে আসছি।
কিন্তু আমার সামনে রয়েছে একটা মস্ত-বড়ো কর্তব্য। হ্যা, ঘৃণ্য কর্তব্য! বিবাহের পরে এ কাজ আরম্ভ করা অসম্ভব। এ কাজ শেষ করতে গেলে আমাকে থাকতে হবে কেবল আত্মীয় স্বজন নয় যে কোনও মানুষেরই চোখের আড়ালে!
একজন সঙ্গী না পেলে এই সাংঘাতিক দানবও আমাকে মুক্তি বা শান্তি কিছুই দেবে না। সে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াবে ছায়ার মতো—সর্বদাই মনে করিয়ে দেবে আমার প্রতিজ্ঞা আর তার দাবির কথা। পাছে তার কথা আর কেউ জানতে পারে সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাকেও থাকতে হবে ভয়ে ভয়ে। এখন আমি আর তার প্রভু নই—সেই-ই আমার আসল প্রভু। নিজের হাতে শনি সৃষ্টি করে আমি হয়েছি শনিগ্রস্ত।
কিন্তু সঙ্গী পেলে দানব আমার জগৎ থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করবে, আমিও আস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচব। তারপর আবার আমি লাভ করব স্বাধীন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক সুযোগ।
পত্রোত্তরে বাবাকে লিখলুম,
শ্রীচরণেষু,
আপনার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু এখনও আমি পূর্ণ স্বাস্থ্য ফিরে পাইনি, এখান থেকে এরই মধ্যে দেশে ফিরলে হয়তো আবার শয্যাগত হয়ে আপনাদের সকলকে বিপদগ্রস্ত করব।
এতদিন যখন অপেক্ষা করেছেন, তখন আর দুই মাস মাত্র অপেক্ষা করলে বোধহয় আপনার বিশেষ কোনও অসুবিধা হবে না। এ সম্বন্ধে আপনার মত জানতে পারলে সুখী হব। ইতি—
উত্তরে বাবা জানালেন,
তোমার কথামতোই কাজ করা হবে। দুই মাস পরে প্রথম লগ্নেই হবে মমতার সঙ্গে তোমার শুভবিবাহ। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। ইতি—
মাত্র দুই মাস সময়। এর মধ্যেই করতে হবে আমাকে একটি দানব-মূর্তি সৃষ্টি। সুকঠিন কর্তব্য, কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ এবারে আমাকে আর অন্ধের মতো অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে না। পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলেই এবারে আমি খুব তাড়াতাড়ি জাক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে পারব!