দলের নেতার নাম হরকুমার। মানুষটি অসম্ভব রোগা, গলার অ্যাডমস অ্যাপেল বা কণ্ঠমণিটি অনেকখানি বেরিয়ে আছে, কঁধদুটো এমন বেখাপ্পা ধরনের উঁচু যে মনে হয়, হাতের বদলে দুটি ডানা লাগানো আছে। কিন্তু হরকুমারের চোখের দৃষ্টি তীব্র, বেশিক্ষণ চোখাচোখি করে থাকা যায় না। হরকুমার কঠোরভাষী নন, বরং কথা বলার মধ্যে একটা ক্লান্ত ভঙ্গি আছে। মাঝে মাঝেই কাশির দমক ওঠে, তখন জলের গেলাসে চুমুক না দিলে আর কথা বলতে পারেন না।
মেঝের ওপর ছেঁড়া শতরঞ্চি পাতা। হরকুমার সূর্যকে বললেন, বোসো ওখানে।
এই দলের আর চারজনের নাম পরেশনাথ, বিষণ সিং, ব্রজগোপাল এবং আলিমুদ্দিন। আলিমুদ্দিনকে সবাই মাস্টারসাহেব বলে ডাকে।
আলিমুদ্দিনসাহেব বললেন, হরদা, আপনার মনে আছে, এই রকম একটা ছোঁড়াই মজঃফরপুরে পুলিশের ইনফর্মার ছিল?
হরকুমার ক্লান্ত ভাবে বললেন, হু। এই যে ছেলে, তোমার নাম কী?
সূর্যকুমার ভাদুড়ী।
বাবার নাম কী? কী করেন তিনি? কোথায় থাকেন?
অনেকক্ষণ ধরে জেরা করা হল সূর্যকুমারকে। সূর্যকুমারের উত্তরগুলো শুনে ওঁরা খুব একটা সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না। এ-ছেলেটির ভাবভঙ্গিই একটু বিচিত্র। অনেক কথার উত্তর দেয়, অনেক কথার উত্তর দেয় না। সবকিছুই যেন তার পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করছে। এরকম একটা পরিবেশের মধ্যে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় শতরঞ্জির ওপর বসা পাঁচ জন অপরিচিত মানুষ–একজনের কোলের ওপর তখনও পিস্তল রাখা–কিন্তু সূর্যকুমার এতে ভয় পাবার বদলে আকৃষ্ট হয়েছিল বেশি। সে এক একবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সকলের মুখের দিকে দেখছিল।
হরকুমার বললেন, ছেলেটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। ও যখন পাদরিদের ইস্কুলে পড়ে, ওকে কেউ সন্দেহ করবে না। শোনো খোকা, ইংরেজের গোলামি করার জন্য তুমি জন্মাওনি। যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য তোমাকে প্রাণও দিতে হয়–তবুও জানবে তোমার জীবনটা ধন্য। দরকার হলে সে রকম প্রাণ দিতে পারবে?
সূর্যকুমার কোনও উত্তর দিল না।
ব্রজগোপাল জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দীনেশ গুপ্তের নাম শুনেছ? সূর্য সেনের নাম শুনেছ?
সূর্যকুমার ওসব নাম শোনেনি।
আলিমুদ্দিন মাস্টার বললেন, এ দেখছি সূর্য নামের কলঙ্ক। লোকনাথ বলের ছোটভাই ট্যাগরা তোতা তোমারই বয়সি ছিল। সে কী রকম ভাবে লড়াই করতে করতে জান দিয়েছিল জানো?
হরকুমার বললেন, মাস্টারসাহেব, ওকে একটু একটু তালিম দেবেন। এই রকম ভাবেই তো দেশের ছেলে তৈরি করতে হবে। বিষণ সিং, ছুরিটা দাও তো!
বিষণ সিংয়ের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে হরকুমার সেটা এগিয়ে দিলেন সূর্যকুমারের দিকে। তারপর বললেন, নিজের হাতে তোমার একটা আঙুল চিরে একটু রক্ত বার করো তো! পারবে না?
সূর্যকুমার ছুরিটা নিয়ে ধরে পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর হঠাৎ খ্যাচ করে বসিয়ে দিল বাঁ হাতের বুড়োআঙুলে। গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। দু-তিনজন চমকে হা হা করে উঠল, অত না, অত না!
হরকুমার শান্ত ভাবেই বললেন, ঠিক আছে, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। একটু রক্ত পড়লে কিছু যায় আসে না। তুমি ওই রক্তের ছাপ দাও নিজের কপালে, তারপর বলল, আমি দেশের জন্য সর্বস্ব পণ করিলাম। এ-শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত আমি ইংরাজের দাসত্ব কিংবা পরাধীনতার শৃঙ্খল সহ্য করিব না! বন্দেমাতরম!
হরকুমার তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, না হে মাস্টারসাহেব, ছেলেটার মুরোদ আছে। দিন, এবার ছেলেটার হাতটা একটু ব্যান্ডেজ করে দিন!
এখানে একটা কথা বলা দরকার। সূর্যকুমারের তখনও তেমন বাংলা ভাষার জ্ঞান ছিল না যাতে দেশমাতৃকা, দাসত্ব শৃঙ্খল, সর্বস্বপণ ইত্যাদি শব্দের ঠিক ঠিক মানে বুঝতে পারবে। তা ছাড়া, ওই সব শব্দের অন্তর্নিহিত ভাবও তার পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সহজ নয়–কারণ ছেলেবেলা থেকে সে সে রকম কোনও শিক্ষা পায়নি। মাতৃভূমির কোনও ভাবমূর্তি তার চোখে ছিল না। ওই সব আঙুল কেটে প্রতিজ্ঞা ঐতিজ্ঞার ব্যাপারগুলো সে করেছিল নিছক নতুনত্বের লোভে–তা ছাড়া নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক কাজ করার প্রতি তার সহজাত ঝোঁক ছিল। আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর সে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাকে ওই রিভলভার ছুঁড়তে দেবেন?
হরকুমার বলেছিলেন, হ্যাঁ দেব। বুকের মধ্যে যে-দিন শত্রুকে আঘাত হানার আগুন সত্যিকারের জ্বলে উঠবে–সে-দিন অস্ত্রও ঠিক পেয়ে যাবে।
একটু গালভারী ধরনের আদর্শবাদী বাক্য বলা স্বভাব হরকুমারের।
তারপর থেকে সূর্যকুমার সহপাঠীদের সঙ্গে জুয়ার আড্ডায় যাবার বদলে একা একা চলে আসত এই বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায়। ব্রজগোপালের কাছে সে কুস্তির প্যাঁচ শিখত। হরকুমার শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-বিষয়ক কবিতা। এ ছাড়া বিপ্লবীদের সম্পর্কে অসংখ্য গল্প। কার্ল মার্কস, ডি ভ্যালেরা, স্ট্যালিন সম্পর্কেও আলোচনা হত। একদিন হরকুমারের কাছে এমন একটা গল্প শুনল, তার আর তুলনা নেই।
হরকুমার প্রায়ই সূর্যকে দেখে বলতেন, ওই ছেলেটাকে দেখলেই আমার বৈকুণ্ঠ সুকুলের কথা মনে পড়ে। চেহারায় খুব মিল আছে। প্রথম দিন ওকে দেখেই সে কথা মনে পড়েছিল বলে ছেলেটার ওপর আমার মায়া পড়ে যায়।
সূর্যকুমার জানত না বৈকুণ্ঠ সুকুল কে। একদিন জানল।
ওই গোপন আস্তানায় প্রায়ই একজন পাগলা মতন লোক আসত। একজন মাঝবয়সি মুসলমান, মুখ-ভরতি দাড়ি, নোংরা ছেঁড়া খাকি জামা ও প্যান্ট। মাটিতে শুয়ে পড়ে সে হরকুমারের পা জড়িয়ে ধরত আর কাঁদত হাউহাউ করে। পাগল হলেও খুব নিরীহ পাগল। হরকুমার খুব স্নেহের সঙ্গে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তাকে জোর করে বসিয়ে খাবার খাওয়াতেন। তারপর দুজনে খুব নিকট আত্মীয়ের মতন কথা বলতেন কিছুক্ষণ।
একদিন সূর্যকুমার জিজ্ঞেস করেছিল, হরদা, ওই পাগলটা তোমার কাছে আসে কেন?
হরকুমার বলে ছিলেন, শুনবি ওর কথা? পরেশ, তুমি বলে দাও তো ওর কাহিনীটা।
পরেশ বললেন, না, হরদা, আপনিই বলুন। আপনার মতন কেউ বলতে পারবে না।
হরকুমারের সে-দিন কাশি বেড়েছে। অনবরত কাশছেন আর মুখে রুমাল চাপা দিচ্ছেন। হরকুমারের শরীর যে ভাবে ভেঙে পড়ছে–আর কদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন তার ঠিক নেই। কিন্তু হরকুমার কিছুতেই চিকিৎসা করাবেন না, নিজস্ব টোট। ওষুধ খেয়েই থাকবেন।
একটু কাশি থামিয়ে হরকুমার বললেন, আমি যখন গয়া জেলে ছিলাম, তখন ওই যাকে এখন পাগলা দেখছিস, ও ছিল একজন হাবিলদার। ওর পুরো নাম আমি আজও জানি না, তবে সবাই ওকে বলত হাবিলদার রেজা। ইউ পির লোক, উর্দুতে কথা বলে। প্রথম মহাযুদ্ধে ও ভার্দুনে, মেসোপটেমিয়ায় লড়েছে। লেখাপড়া কিছু জানে না, কিন্তু ঘুরেছে অনেক দেশ। তারপর যুদ্ধ থেমে গেলে নানান ঘাটের জল খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত গয়া জেলে রক্ষীর কাজ পেয়েছিল। এটা বছর চারেক আগের কথা। হাবিলদার রেজাকে তখন ভালো করে চিনতাম না–চেনার দরকারও ছিল না। আমরা সব রাজবন্দি, ও একজন বিশাল চেহারার গার্ড, জুতো খটখটিয়ে সেলের বাইরে দিয়ে চলে যায়। ওকে চিনলাম এক রাত্তিরে।
তখন জেলখানা রাজবন্দিতে ভরতি। গান গেয়ে, হইচই করে আমরা সব ভুলে আছি। হঠাৎ একদিন শুনলাম, সাত ডিগ্রি কনডেন্ড সেলের একজন আসামির ফাঁসি হবে। আমরা তখন আছি পনেরো ডিগ্রিতে। কার ফাঁসি হবে, নাম জানতে পারলাম না– ভীষণ কৌতূহল জেগে রইল।
ফাঁসির আগের দিন আসামিকে পনেরো ডিগ্রির এক নম্বর সেলে আনা হল। সে-দিন বিকেলে আমাদের জেনারেল লক আপ হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। আমাদের সবাইকে এনে ঢোকানো হল যার যার নির্দিষ্ট ব্যারাকে আর সেলে। পাশাপাশি কয়েকটি সেলে আছি আমি, রঘুনাথ পাণ্ডে, ত্রিভুবন আজাদ আর বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত। লোহার গরাদ ধরে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে আছি, কখন আনা হবে ফাঁসির আসামিকে।
সন্ধ্যার সময় তাকে আনা হল। অনেকগুলো বুটের শব্দ, জেলার, ডেপুটি জেলার, বড় জমাদার, সেপাই সান্ত্রী সবাই মিলে নিয়ে আসছে একজনকে–কে এমন মহাপুরুষ? দেখলাম হাত-পায়ে শিকল বাঁধা ফুটফুটে চেহারার এক কিশোর। শিকল ঝনঝনিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে উৎফুল্ল মুখে, ঠিক যেন সিংহের বাচ্চা! ফাঁসির আগে এক নম্বর সেলে। ঢোকাবার সময় আসামির হাত-পায়ের শিকল বেড়ি খুলে দেওয়াই নিয়ম, হারামজাদারা ওর বেলায় তা-ও করেনি। পুলিশের চোখে ও নাকি ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল। অথচ কী বলব তোমাদের, কী সরল নিষ্পপ তার মুখ–এই আমাদের সূর্যর থেকে মাত্র দু-তিন বছরের বড় হবে–তাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, সে নাকি বিপজ্জনক আসামি!
আমাদের সেলগুলোর পাশ দিয়ে যখন সে যাচ্ছে, তখন বিভূতিদা হঠাৎ অস্ফুট ভাবে বলে উঠলেন, আরে, এ যে বৈকুণ্ঠ সুকুল।
আসামিও বিভূতিদাকে চিনতে পেরে মহা উল্লাসের সঙ্গে বলে উঠল, দাদা, আ গায়া! ফির মুলাকাত
বিভূতিদা কম্পিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, বন্দে মাতরম! তখন অন্য সব সেল থেকেও সবাই গর্জন করে বন্দে মাতরম বলে সেই আসামিকে সংবর্ধনা জানাল!
আমি বিভূতিদাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা, বৈকুণ্ঠ সুকুল কে? আগে তো শুনিনি এর কথা!
বিভূতিদা বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ওকে বছর চারেক আগে একবার দেখে ছিলাম পাটনা ক্যাম্প জেলে। একেবারে বাচ্চা! তার কাল ফাঁসি হবে?
পরে আমরা জেনেছিলাম, বৈকুণ্ঠ সুকুল অত্যন্ত দুঃসাহসী অ্যাকশান করেছে। ও মজঃফরপুরের ছেলে–ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকির যোগ্য উত্তরসাধক। ভগৎ সিংদের। ফাঁসির মামলায় রাজসাক্ষি হয়েছিল যে ফণী ঘোষ সে তখন ওই জেলাতে এসে দোকান খুলেছে, দিন-রাত তাকে পুলিশের লোক পাহারা দেয়। সেই অবস্থাতেই তাকে খতম করে দিয়েছে বৈকুণ্ঠ সুকুল। রাজসাক্ষির প্রতি কোনও দয়া নেই। বৈকুণ্ঠ সুকুল তখন ধরাও পড়েনি, ছদ্মবেশে পালিয়ে ছিল বেশ কিছুদিন, তারপর ধরা পড়ল শোনপুরের মেলায়।
যাই হোক, সে-রাত্রে আমাদের ঘুমোবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সবাই লোহার গরাদ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সবাই মনে মনে প্রার্থনা করছি, এ রাত্রি যেন ভোর না হয়। সূর্য। ওঠার পর সুকুল আর ইহজগতে থাকবে না।
হঠাৎ এক নম্বর সেল থেকে সুকুলের ডাক শোনা গেল, বিভূতিদা—
বিভূতিদা সাড়া দিলেন। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দু’জনে কথা হতে লাগল। সুকুল বলছে, দাদা, আপনার পাটনা জেলের কথা মনে আছে? কত গান শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েছিলেন সেই কবিতা, মরণ, হে মোর মরণ!
খট খট করে সেপাইয়ের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। আমরা চুপ। বিভূতিদার সেলের সামনে এসে দাঁড়াল হাবিলদার রেজা। চুপ করে একটুক্ষণ কী যেন ভেবে আবার চলে গেল। ফিরে এল খানিকটা বাদে। এবার তার হাতে এক গোছা সাদা ফুল। আমরা অবাক। কোথা থেকে সে এই ফুল জোগাড় করে এনে দিয়েছিল সুকুলকে, সুকুল আবার। তার খানিকটা পাঠিয়েছে বিভূতিদাকে।
বিভূতিদা হাত পেতে ফুলগুলি নিলেন, একটাও কথা বলতে পারলেন না, হাবিলদার তখনও দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে বিভূতিদাকে জিজ্ঞেস করল, ক্যা শোচ রহা হ্যায়, বাবুজি!
বিভূতিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী আর ভাবব।
হাবিলদার গরাদ ধরে ঝুঁকে এল বিভূতিদার দিকে। তারপর অদ্ভুত আর্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, বাবুজি, এই লেড়কাকে বাঁচানো যায় না? লাটের ওপরে লাট আছে, তারও ওপরে আছে বিলেতের বাদশা বাঁচানো যায় না! যে-কোনও উপায়ে সুকুলজিকে বাঁচানো যায় না!
সেই রুক্ষ, কঠিনহৃদয় সৈনিকের মুখে একথা শুনব আমরা কেউ আশা করিনি। কথা শুনেই টের পেলাম ওর হৃদয়ে খুব একটা ধাক্কা লেগেছে। হাবিলদার রেজা আরও বলল, সে অনেক মানুষকে মরতে দেখেছে, নিজের হাতেও যুদ্ধের সময় মানুষ মেরেছে। এ-জীবনে বাহাদুর সে কম দেখেনি–কিন্তু সুকুলজির মতন দেখেনি কারওকে। বীরপুরুষের এ রকম চেহারা সে কি কখনও কল্পনা করতে পেরেছিল, মরতে যার একটুও ভয় নেই! এ রকম একটা মানুষ যদি দুনিয়া থেকে চলে যায় তা হলে দুনিয়াটা কি শুধু ডরপুকের জন্য?
সুকুল এমনিতেই খুব রূপবান, তারপরও হাবিলদার বলল, ফঁসির হুকুম পাকা হয়ে যাবার পর তার শরীরটা গোলাপের মতন হয়ে উঠছে! গুলাব জ্যায়সাগুল জ্যায়সা খুল রহা হা বাবুজি! আমার জীবন দিয়েও যদি ওকে বাঁচানো যেত! কিছু একটা হয় না।
প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতেই চলে গেল হাবিলদার। সেই সঙ্গে সে আমাদেরও রুদ্ধবাক করে দিয়ে গেল। রাত গম্ভীর হয়ে উঠেছে, কত রাত জানি না, জানি না ভোরের কত দেরি। হঠাৎ সুকুল আবার বলে উঠল, বিভূতিদা, গান শুনব! সেই যে, হাসি হাসি পরব ফাঁসি?
ক্ষুদিরামের ফসির এই গান বাঙালি-অবাঙালি সবারই প্রিয়। রাজবন্দিরা এ গান শোনে মন্ত্রমুগ্ধের মতন। বিভূতিদা উদাত্ত গলায় গান ধরলেন:
একবার বিদায় দে
মা
ঘুরে আসি
হাসি হাসি পরব ফাঁসি মা
দেখবে ভারতবাসী…
দশমাস দশদিন পরে
জন্ম নেব মাসির ঘরে
চিনতে যদি না পারিস, মা,
চিনবি গলায় ফাঁসি..
বিভূতিদা একবার গানটা শেষ করছেন, আর বৈকুণ্ঠ সুকুল চেঁচিয়ে বলছেন, আবার! আবার! কতক্ষণ সে-গান চলেছিল খেয়াল নেই–আমরা সেই গানের মধ্যে মিশে গিয়েছিলাম।
খানিকক্ষণ বাদে সুকুল বলল, দাদা বাঁশি শুনব! আমরা অবাক। জেলখানার মধ্যে বাঁশি কোথা থেকে আসবে। বিভূতিদা মলিন ভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, একটা দেশলাই যদি পেতাম! হাবিলদার রেজা কাছেই দাঁড়িয়েছিল, আমরা খেয়াল করিনি, সে সঙ্গে সঙ্গে এসে একটা দেশলাই বাড়িয়ে দিল। সেই দেশলাইয়ের খোলের মধ্যে এক টুকরো পাতলা কাগজ দিয়ে বিভূতিদা একটা জিনিস বানিয়ে ফেলেছেন, সেটা দিয়ে অনেকটা বাঁশির মতনই আওয়াজ হয়। পাটনা জেলে বিভূতিদা এই রকম বাঁশি বানাতেন, সুকুলের ঠিক মনে আছে।
সেই বাঁশিতে একটা তীব্র করুণ সুর ভেসে উঠল। জেলখানার সমস্ত কঠিন পাথরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই সুর। সুকুল বলল, দাদা, এটা কী গান বাজাচ্ছেন? সুরটা যেন চেনা চেনা—
বিভূতিদা বললেন, এটা বিসমিলের সর ফরোশি কি তমান্নার সুর!
সুকুল যেন লাফিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, দাদা গানটার সব পদ মনে আছে? দাদা একবারটি গান!
তখন আমাদের মনে পড়ল কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার রামপ্রসাদ বিসমিল ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে নিজের লেখা এই উর্দু গান গেয়েছিলেন। অপূর্ব তার বাণী।
সর ফরোশি কি তমান্না
অহমারে,
দিল মে হ্যায়
দেখনা হ্যায় জোর কিতনা
বাজু এ
কাতি মে হ্যায়!
[মৃত্যুকে স্পর্শ করার ভাবনা এখন আমার মনে। দেখতে চাই ঘাতকের বাহুতে, কত বল আছে!]
এ-গানটা অনেকক্ষণ ধরে গাওয়া হল। শেষ পংক্তিতে এসে সুকুল নিজেও গলা মেলাল। শেষ দিকে বিসমিল বলেছিল:
অব্না অগ্লে ওয়ল্লে হ্যায় আউর
না আর মানোকি
ভিড়
সিরফ্ মর্ মিটনেকি হসরৎ আপ
দিলে এ বিসমিল মেঁ হ্যায়।
[এবার থেমে গেছে পূর্বেকার কলগুঞ্জন, মিটে গেছে সব বাসনা। এখন শুধু মৃত্যুকে বরণ করার বাসনা বিসমিলের হৃদয়ে।]
শেষ লাইনে বিসমিলের নাম বদলে দিয়ে সুকুল গাইতে লাগল, দিলে এ সুকুল মে হ্যায়, দিলে এ সুকুল মে হ্যায়, দিলে এ সুকুল মেঁ হ্যায়–কত বার যে, তার ঠিক নেই। খানিকটা বাদে থেমে রইল কিছুক্ষণ। আবার বলল, দাদা, আউর একঠো গান–
বিভূতিদা সেদিন কত গান গেয়েছিলেন খেয়াল নেই। আমরা নিস্পন্দ হয়ে শুনেছি। কাছেই ছায়ার মতন দাঁড়িয়ে আছে হাবিলদার রেজা। সারা পৃথিবী তখন ঘুমন্ত, শুধু জেলখানার কটি প্রাণীই জেগে আছে। তাদের মধ্যে একজন কয়েক ঘণ্টা পরেই অনন্ত ঘুমের মধ্যে চলে যাবে।
একসময় বিভূতিদার গানের স্টক শেষ হয়ে গেল। হাবিলদারকে জিজ্ঞেস করলাম ক’টা বাজে? সে বলল, এক বাজ গয়া।–আর মাত্র চার ঘণ্টা।
বিভূতিদার গানের স্টক শেষ, সুকুল তবুও অনুরোধ করে যাচ্ছে। সে যেন তখন একটা সুরপাগল মানুষ, পৃথিবীতে আর কিছু জানে না। শেষ পর্যন্ত সে বলল, দাদা, সেই গান একবার গাইতে হবে।
কোন গান?
রবীন্দ্রনাথের ওই, মরণ, হে মোর মরণ!
ওটা তো গান নয়, কবিতা!
না, না, ওটাই গাইতে হবে।
ওটা আমার মুখস্থ আছে সুকুল, কিন্তু ওর তো কোনও সুর নেই?
তা জানি না–ওটা গান গেয়ে শোনান!
সেই ভাবে-বিভোর কিশোরকে কে তখন নিরস্ত করবে? ওর কোনও অনুরোধ তখন অগ্রাহ্য করা যায়? রবীন্দ্রনাথের মরণ-মিলন কবিতাটা সুকুলের খুব প্রিয় ছিল– বিভূতিদার কাছ থেকে শুনে শুনে হিন্দি অক্ষরে লিখে নিয়ে মুখস্থ করেছে। বিভূতি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি মানে বুঝতে পারো সব? সে বলেছিল, কেন পারব না! এই তো, ‘আমি করব নীরবে তরণ’ তরণ তো হিন্দিতে যাকে বলে ত্যায়রনা–মানে সাঁতার দেওয়া, তাই না?
সেই দীর্ঘ কবিতা সুকুল তখন গান হিসেবে শুনতে চাইছে। বিভূতিদা তাকে বিমুখ করতে পারলেন না। তিনি তখন দরবারি কানাডায় সুর লাগিয়ে গোটা কবিতাটা গেয়ে যেতে লাগলেন–অত চুপি চুপি কেন কথা কও, ওগো মরণ, হে মোর মরণ!
ও রকম গান কেউ কখনও গায়নি, ও রকম ভাবে কেউ কখনও গান শোনেনি। শুধু তো সুর নয়, কথা নয়–সমস্ত মন প্রাণ ওই গানের মধ্যে। বিভূতিদা ও রকম গান জীবনে আর কখনও গাইতে পারবেন না!
কখন চারটে বেজে গেছে খেয়ালও করিনি। চমকে উঠলাম জেলের পেটা ঘড়িতে যখন ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজল। অমনি জেগে উঠল ভারী ভারী বুটের আওয়াজ। সুকুল তখন হেসে বলল, দাদা, এবার ‘তো সময় হইল নিকট’-এবার শেষ গান হোক! বন্দে মাতরম্? সমস্ত জেল কাঁপয়ে, আকাশ বাতাস-পৃথিবী কাপিয়ে আমরা সকলে মিলে গেয়ে উঠলাম, বন্দে মাতরম্সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা–।
ঝনঝন করে শব্দ হতে লাগল গেট খোলার। হাত-পা বাঁধা সুকুলকে বাইরে আনা হল। আমার তখন ইচ্ছে হচ্ছিল জেলের দরজা ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে একবার ওকে ছুঁই। কিন্তু তার তো উপায় নেই। সুকুলের মুখখানা কিন্তু প্রফুল্ল–সেই অপরূপ চেহারার কিশোরের মুখে একটু ক্লান্তির ছাপ নেই। চেঁচিয়ে বললে, দাদা, ত তো চল্ না হ্যায়। আমাদের সকলের নাম করে বলল, চলি তবে। আবার আমি আসব, দেশ তো স্বাধীন হয়নি–আবার আসব–বন্দে মাতরম্।
আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল সুকুলকে। আমরা তখন…
সূর্যকুমার এতক্ষণ নিঃশব্দে শুনছিল। এবার তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মুখখানা লাল হয়ে গেছে, সারা শরীর কাঁপছে।
হরদা কাশতে কাশতে বললেন, হাবিলদার রেজা তার পরদিনই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল, সেই থেকে একটু পাগলাটে ধরনের হয়। আমরা জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ও আমাদের কাছেই ঘুরে ফিরে আসে–আর অনবরত সুকুলের কথা বলে। সুকুলের জন্য ও এমন আঘাত পেয়েছে যে মানুষ নিজের ছেলে মরলেও বোধহয় এতটা পায় না।
একটুক্ষণ চুপ করে হরকুমার বললেন, ও, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শেষ সময়ে বৈকুণ্ঠ সুকুল একবার মাত্র একটুক্ষণের জন্য নরম হয়েছিল। যাবার সময় বিভূতিদার সেলের সামনে এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর মাথা নিচু করে বলেছিল, দাদা, একটা অনুরোধ শুধু রইল। আপনারা এবার জেল থেকে বাইরে বেরিয়ে বিহারের বাল্যবিবাহ প্রথাটা তুলে দেবার চেষ্টা করবেন!–তারপর ও চলে গেল গটগট করে।
সূর্য আর নিজেকে সামলাতে পারল না, কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কক্ষনও তার চোখে জল দেখা যায় না, মার খেলেও সে কাঁদে না–তবু ওইটুকু বয়সের মধ্যে কোনও দিন সে ও রকম ভাবে কাঁদেনি।
আলিমুদ্দিন মাস্টার সূর্যকে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছিলেন হরকুমার হাত তুলে নিষেধ করলেন ইশারায়। আস্তে আস্তে বললেন, কাঁদুক! কান্না ওর পক্ষে ভালোই!