দরজা খুলে দেয় শুচু। আর তার কপালে লিউকোপ্লাস্ট দেখে চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে সে। ট্যাক্সির ভাড়া একশো বিরাশি টাকা বাদ দিয়ে তিন হাজার আটশো আঠারো টাকা সে খরচ করবে শুচুর বিয়েতে।
শুচুর চিৎকারে মা ছুটে আসে দরজায়। ভাই আসে। আর দেবনন্দন। অসময়ে তাকে দেখে, কপালে লিউকোপ্লাস্ট দেখে আলোড়ন পড়ে যায়।
সে ঘরে আসে। বসে পড়ে বিছানায়। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার কথা, জ্ঞান হারাবার কথা গোপন করে যায়। শুধু লোহার দরজায় ধাক্কা লাগার কথা বলে। সকলকে বিচলিত হতে বারণ করে। মা চা করতে ছুটে যায়। ভাই গভীর চোখে জরিপ করে। শুচু চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বারবার তাকে শুয়ে পড়তে অনুরোধ করে। বাবা টিভি বন্ধ করে দেয়। আর দেবনন্দন লাজুক মুখে কাছে আসে। সে চিকিৎসকের কাছে যাবে কিনা জানতে চায়।
সে দেবনন্দনের হাত ধরে এবং যদিও তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল, তবু উঠোনে গিয়ে বসার প্রস্তাব দেয়। শুচু মোড়া পেতে দিতে যাচ্ছিল, সে তখন তাদের শতরঞ্চিখানা উঠোনে বিছিয়ে দিতে বলে। সে, দ্রেবনন্দন এবং বিশ্বদীপ সেখানে বসে কথা বলতে পারবে তা হলে।
শুচু তার দিকে তাকায়। চোখে চোখে নীরব কথা বিনিময় হয়ে যায় তাদের, আর শুচুর মুখ চাপা হাসিতে ভরে ওঠে। সে মভির গভীরে ঢুকে পড়ে দেখতে পায়, বোনের সঙ্গে এই নিঃশব্দের মা বিনিময়ে তার মন আলোয় ভরে যাচ্ছে। এ ভাষা একান্তভাবে তাদের কারও এতে কোনও অধিকার নেই। এই বিশাল জগতের কোধেপড়ে থাকা তাদের নিঃস্বপ্রায় সংসারে আগলে রাখার মতো একান্ত নিজস্ব কিছু আছে এখনও। কত দিন, কত দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি, কত উদ্বেগ, যন্ত্রণা ও কষ্টের উপলব্ধি তাদের তিন ভাইবোনকে একসঙ্গে বিষণ্ণ করেছে। একজন আরেকজনের সান্ত্বনা হয়েছে কতবার! যেন দুঃখের বিপুল বোঝ—তারা তিনটি ভাইবোন ভাগ করে নিয়েছে বলে হালকা হয়ে গেছে আর শুধু দুঃখও তো নয়—কত য়ে উপকরণহীন মুখ, কত যে অকারণ হাসি-সব মিলে গড়েপিটে দিয়ে গেছে তাদের এ নিজস্ব ভাষা।
পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা দিলে আরও ভাল লাগা অতএব ঢুকে যায় প্রাণে। সে মার কাছে চিড়েভাজা আবদার করে বসে। কাঠখোলে ভাজা ময়। তেলে ভাজা। পেঁয়াজকুচি, কাঁচালংকা আর নুন দিয়ে ভাজা। মার কী যে হয়, আপত্তি করে না। শুভদীপের অন্তর নিঃসৃত ভাললাগা তারও অস্তর স্পর্শ করে বুঝি এবং আহত ছেলের প্রতি মমত্ববোধে অনুভূতি কোমল হয়ে থাকে। অতএব সে বলে না, এতখানি চিড়ে নেই ঘরে,কিনে আনতে টাকা লাগকে। বলে না, তেলে টান পড়বে মাসান্তে। কোনও গোপন ভাণ্ডার থেকে টাকা নিয়ে সে বিশ্বদীপকে চিড়ে আনতে দোকানে পাঠায়। নিজে রান্নাঘরে বঁটি পেতে পেঁয়াজ কুটতে বসে। এইসব ছোটখাটো কাজের জন্য সে শুচুকে বলতে পারত। কিন্তু শুচু দেবনন্দনের কাছে কাছে ঘুরছে। মায়ের ভাল লাগছে। তার মন বলছে শুভদীপ রাজি হবে। নিশ্চয়ই হবে। বড়ছেলের প্রতি বুক থেকে স্নেহ উপচে পড়ে তার। ছেলেটা ভাল। জানে সে। মনের গভীরে জানে। বড় শুদ্ধ ছেলে শুভ। বড়ই নরম। এবং একে-একে শুচু ও বিশ্বর প্রতিও স্নেহ ধাবিত হতে থাকে। সে মনে মনে বলে, তার সব সন্তানই ভাল। চমৎকার। অভাবে অভিযোগ নেই, এতটুকু দাবি নেই, সারাক্ষণ হাসিমুখে আছে। শুধু বড়টাকে যেন গম্ভীর লাগে আজকাল। মনমরা; অন্যমনস্ক। মা কারণ বোঝে না। ভাবে, ছেলে বড় হলে বিয়ে দিতে হয়। কিন্তু অভাবের সংসারে বউ আনবে কি! শুতে দেবে কোথায়! নিয়মিত ডালভাতও তো দিতে পারবে না। মার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কী সুন্দর দেখতে তার ছেলেদের। চাঁদের কণারা সব। বাপের সমস্ত সৌন্দর্য খাঁজ কোট বসানো। কিন্তু সংসারের হাল তো ফেরে না। মার চোখে জল আসো মানুষটা করে থেকে অসুস্থ। মেয়েটাও কী এক পোড়াকপাল নিয়ে জন্মাল! পেঁয়াজের ঝাঁঝে জল উপচে.চোখ থেকে গালে নেমে আসে। কান্না আড়াল করে মা। পেঁয়াজের রস দিয়ে কান্নাকে আড়ালে রাখে। আর কপালে হাত ঠেকায়। যেন বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটার যেন শান্তিতে সুখে থাকে তারা।
শুভদী পরিষ্কার হতে কলপারে যায়। তিনদিনের ছুটি নেবার সংকল্প করে সে। তার বিশ্রাম প্রয়োজন। কল থেকে মুখে জলের ঝাপটা দেবার জন্য কোমর ঝোঁকাতেই কপাল টনটন করে, মাথা ঘুরে যায়। কলের মাথাটি ধরে কোনওমতে সামলে নেয় সে।
বিশ্রাম চাই। তার বিশ্রাম চাই। বহু দিন ছুটি নেয়নি। সেই কবে, ক্ষত দিন আগে মাইথন গিয়েছিল ছুটি নিয়ে। সে আর চন্দ্রাবলী।
চোখে-মুখে ভাল করে জল দেয় সে। ঘাড়ে জল দেয়া পা ধোয়া তারপর ঘরে যায়। বিশ্বদীপ ফিরে আসে তখন। কিছু বাদামও এনেছে সে। নিজের টাকায়। মাকে পাই-পয়সা হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর তখন আঁদুরে বসে শুচু আর দেকনন্দন গাঢ় চোখে তাকাচ্ছে পরস্পর। তাদেরও তৈরি হয়েছে নিজস্ব নৈঃশব্দ্যের ভাষা, পৃথিবীতে এই ভাষাই সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং ভঙ্গুর।
শুভদীপ এসে মাদুরে শুয়ে পড়ে তখন। শুচু তার আদেশমতো বালিশ আর চাদর আনতে যায়। শীতের পোশাক কেউই চড়ায়নি গায়ে এখনও তবু তার শীতশীত করে। বিশ্বদীপ একধারে বসে সিগারেট ধরায়। আর শুভদীপ আচমকা দেবনকে মূর্খ সঙ্গমকারী বলে গালাগালি দিয়ে ওঠে। শুচুর প্রসঙ্গ দেবনন্দন তার কাছে এড়িয়ে গিয়েছে বলে কৃত্রিম ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে। দেবনন্দন লাজুক হাসে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে অপারঙ্গমতা কবুল করে। ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করতে থাকে, অনেক বার বলবে বলে ভেবেছে। পারেনি। কেন পারেনি সে জানে না।
শুচু বালিশ ও চাদর নিয়ে আসে। শুভদীপ তাকে ঘরে যেতে নির্দেশ দেয়। শুচু দেবনন্দনের চোখে চোখ রেখে কোনও এক অকুতি অর্পণ করে চলে যায়। মা চিড়েভাজার বাটি সাজিয়ে নিয়ে আসে। তারা চা খাবে কি না জানতে চায়। সে মাকে চা নিয়ে এখানে বসতে অনুরোধ করে। সকলেই অনুমান করে অতঃপর কী হতে চলেছে। একটি উদ্বিগ্ন আবহ ঘুরপাক খেতে থাকে উঠোনে। বিশ্বদীপ হাওয়া হালকা করার জন্য নিজের চাকরির কথা পাড়ে। সম্ভাব্য চাকরির সুবিধা-অসুবিধা জানিয়ে দেবনন্দনের মতামত চায়। এর আগেও তাদের মধ্যে এই কথা হয়েছে। আজও হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তবু আবারও একই প্রসঙ্গে তারা কথা বলে। দেবনন্দনও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খুলে বলে। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে সে নিজের বাড়ির একতলায় একটি সাইবার কাফে খুলবে। বিশ্বদীপ তার ভাবনাকে সমর্থন জানায়। শুভদীপ চুপ করে থাকে। যা-যা বলতে হবে সব মনে মনে সাজিয়ে নেয়। তখন শুচু চা নিয়ে আসে। গ্যাসের কাছে যেতে দেওয়া হয় না তাকে। তাই সে বাহকমাত্র। শুভদীপ শুচুকে দেখতে দেখতে এ কথাও বলবে বলে ভাবে যে শুচু রান্না করতে পারবে না। হঠাৎই সে দেবনন্দনের প্রতি বন্ধুত্ব অনুভব করে না আর। অভিভাবকত্বের বোধ তাকে একটি পৃথক সত্তায় টেনে আশৈশবের বন্ধুত্বের থেকে আড়াল করে দেয়। সে টের পায়, এমনই কোনও আড়াল থাকায় দেনন্দনও তাকে কিছু বলতে পারেনি। অনেকবারের মতো আরও একবার সে উপলব্ধি করে, যতই সচেতনভাবে অস্বীকার করা যাক, সমস্ত মানুষের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে সমাজ-সংসার। কিছু কিছু অস্বীকারের পর থাকে যোজনবিস্তৃত স্বীকারের দায়। নিজের অজান্তেই সেই সব স্বীকারের ভার কাঁধে নিয়ে পথ চলে মানুষ।
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মা এসে বসে। শুচু চলে যায়। মা আসন্ন আলোচনার প্রাক্কালে বিষাদ অনুভব করে। যে কাজ তার বড় ছেলে করতে যাচ্ছে এখন, সেই কাজ করার কথা ছিল যার, সে এখন অদ্ভুত অসুখে সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে টিভি দেখছে ঘরে। সে বড় বেদনায়, বড় বিচলনে বলে ফেলে বিশ্বদীপ, শুভদীপের বাবাকে একবার ডাকা হবে কি না। শুভদীপ কিছু বলার আগেই বিশ্বদীপ নাকচ করে দেয়। শুভদীপনীরব সমর্থন করে। মা আর কথা বাড়ায় না। মনে মনে লজ্জিত হয়। এই আসরে স্বামীকে আনার কথা বলা কোনও প্রগলভতা হয়ে গেল কি না সে বুঝতে পারে না। জড়সড় হয়ে সে শুভদীপের মাথার কাছে বসে।
দেবনন্দন বিয়েটা কবে নাগাদ করতে চায়, এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করে শুভদীপ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, জানায় দেবনন্দন। যদি তারা রাজি থাকে তবে সে কালই শুচুকে বিয়ে করে নিতে চায়। এই শীঘ্রতার কারণ সে নিজেই ব্যাখ্যা করে। শুচুর সময় কম সে জানে সময় অনিশ্চিত তা-ও সে জানে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে শুচুকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে চায়। মা জিগ্যেস করে এ বিষয়ে দেবনন্দনের আত্মীয়দের মতামত আছে কি না। দেবনন্দন সরাসরি তাকায়। জানিয়ে দেয়, আত্মীয়দের মতামত অপেক্ষা করে না সে। পরোয়াও করে না। তার বাবা-মা যখন চলে গেল পর পর, সে তখন একুশ পেরোয়নি, শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে গেল যেই, আত্মীয়রা পাততাড়ি গুটোল, এমনকী বছরে একবার খোঁজ নিত কি না সন্দেহ নেই। কারণও অবশ্য ছিল, বাবার রেখে যাওয়া টাকা ও বাড়ির বিষয়ে কাকা, মামা ও পিসিদের আগ্রহ দেখে সে শক্ত ব্যবহার করেছিল। সে একাই সামলাতে পারবে সব—এমন ঔদ্ধত্য অনায়াসে দেখিয়েছিল। সে মনে করিয়ে দেয়, তার যখন টায়ফয়েড হয়েছিল, হাসপাতালে নিতে হয় তাকে, খবর দেওয়া সত্ত্বেও দেখতে আসেনি কেউ। তখন শুভদীপ ও শ্যামলিম তার দেখাশুনো করে। জলবসন্ত হল যেবার, সেবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
মা মনে করতে পারে সবই। সেই সময় তারা এমনকী আলোচনাও করেছিল নিজেদের মধ্যে যে দেবনন্দনের আত্মীয়রা ভাল নয়।
দেবনন্দন বলে যায়, বিয়ে হলে সে এমনকী জানাবেও না কারওকে। লৌকিকতা বলতে বন্ধুদের খাইয়ে দেবে একদিন। শুভদীপ অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্যে মনে করিয়ে দেয় তখন। শুচু কোনও ভারী কাজ করতে অক্ষম। এমনকী রান্নাও সে করতে পারবে না। সাধারণ দুকাপ চাও না। উনুনের পারে থাকা নিষিদ্ধ তার পক্ষে। তাকে নিয়মিত নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকের কাছে। নিয়মিত দিতে হয় ওষুধ। তার প্রতি নজর রাখতে হয়, কখন বেড়ে ওঠে রোগ। আর বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যায় সে। এখানে যেমন আছে শুচু, যতখানি যত্নে ও আদরেততখানি পারবে কি দিতে, দেবনন্দন, এমন প্রশ্নও করে বসে।
প্রত্যেকেই তার এই স্পষ্টভাষে স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনে মনে এই ভাষ্যের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারে না। দেবনন্দন মাথা নিচু করে থাকে। বহুক্ষণ। তারপর মুখ তোলে। আলোর আভায় করুণ দেখায় সেই মুখ। সে শান্তভাবে বলে, সে জানে, সমস্তই জানে। সে তো শুচুকে দেখে আসছে প্রায় তার বালিকাবেলা ৰ্থেকেই। শুচুর অনাদর সে হতে দেবে না এতটুকু, এমন কথাও সে দিয়ে বসে। যেন অপরাধী হিসেবে শনাক্ত সে আর তাকে দিয়ে কবুল করিয়ে নেওয়া হচ্ছে নানান প্রতিজ্ঞা।
মা তখন সান্ত্বনাবাক্য বলে বলে যে তারা সবাই সম্পূর্ণ আস্থা রাখে দেবনন্দনের ওপর। তবু শুচুর দাদা হিসেবে এই কর্তব্য করে নিচ্ছে শুভদীপ। বন্ধুত্বের খাতিরে করে নিচ্ছে, আত্মীয়তার খাতিরে করে নিচ্ছে।
দেবনন্দন মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিছু-বা অভিমানী দেখায় তার মুখ। মা তখন ঘোষণা করে আরও একটি কথা আছে তার। এবং দেবনন্দনের হাত জড়িয়ে ধরে মা। অনুনয় করে বলে, মেয়েকে তারা কিছুই দিতে পারবে না সাজিয়ে গুছিয়ে। এমনকী একটি খাটও নয়। অতি সামান্য যা সঙ্গতি আছে:তা বাবার স্বাস্থ্যের জন্য আগলে রাখতে হবে। দেবনন্দন মাথা নিচু করে রাখে। কোনও কথা বলে না। হ্যাঁ-না বলে না।
এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এ বারে কথা বলে বিশ্বদীপ। প্রতিবাদের সুরে বলে–কেন এত কথা! দেবনন্দন তাদের চিরকালের চেনা। এত দিন ধরে আসছে-যাচ্ছে, তাদের কোন কথাটা জানেনা দেবনন্দন। তা হলে নতুন করে এই সমস্ত নাটকের মহড়া কেন!
আবারও এক স্তব্ধতা নেমে আসে। বিশ্বদীপ মাকে তারিখ ঠিক করে ফেলার নির্দেশ দেয়। মা শুভদীপের দিকে তাকায়। শুভদীপ উঠে বসে। দেবনন্দনকে জড়িয়ে ধরে। শুচু চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে—এ ভাবনা তাকে আবেগপ্রবণ করে দেয়। চোখের জল উপচে দু এক ফোঁটা দেবনন্দনের পোশাকে পড়ে যায়। সে মুখ তুলতে চায় না: তৎক্ষণাৎ আবেগপ্রবণতা প্রকাশ করতে চায় না। দেবনন্দন বন্ধুর বিহ্বলতা টের পায়। এবং তারা কিছুক্ষণ, বেশ কিছুক্ষণ, পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকে।
অতঃপর উঠে আসে শুভদীপ। হাসে। শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন হাসি। মাকে সেও দিন ঠিক করতে বলে দেয়। উজ্জ্বলতম দেখায় মায়ের মুখ। আকৰ্ণবিস্তার হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় অভিব্যক্তি। এবং এক-একটি মুক্তোবিন্দু চোখ থেকে ঝরে পড়ে। একই সঙ্গে হাসিতেকীদে আর কান্নায় হাসতে থাকে মা। এবং উঠে দাঁড়ায়। আঁচলে জল মোছে। শুভদীপ-বিশ্বদীপের বাবাকে খবরটা দিতে হবে বলে ঘরের দিকে পা বাড়ায় আর যেতে যেতে শুফুকে নির্দেশ দেয় কাপ ও চিড়েভাজা-খাওয়া বাটিগুলো তুলে নিতে।
তারা তখন আলোচনা করে। বিবাহের দিন ও উত্তরপৰ্ব নিয়ে আলোচনা করে। শুভদীপ জানতে চায়, এই তিনদিনের মধ্যেই বিয়েটা সম্পন্ন করা যায় কিনা, কারণ সে ছুটি নেবে। সবটাই নির্ভর করছে মায়ের ওপর। বিশ্বদীপ বলে। কারণ শুভ দিনক্ষণ দেখতে চাইবোমা। তখনি মা এসে পড়ে। বাবা সে সংবাদ শুনে অত্যন্ত খুশি–এ সংবাদ পরিবেশন করে যায়। পাশের বাড়ির ভর্তি জ্যাঠাইমার কাছ থেকে পঞ্জিকা আনতে ছোটে। আলিবাবার বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় শুভদীপের। প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে জঙ্গল থেকে আলিবাবা ফিরে এলে পর বউ যেমন কাশেমের বাড়ি কুনকে আনতে ছুটেছিল!
ব্যয়বাহুল্যে তাদের বাড়ির সমস্ত-পালাপার্বণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে কবেই। পঞ্জিকাও লাগে না তাই। শুভদীপের ভয় হয়, মা হয়তো আনন্দে বলে বসতে পারে, শুচুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের সব ঠিকঠাক, বিয়ের সম্বন্ধ দেখা চলছে, বিয়ের বাজার করতে যেতে হবে, বিয়ের জোগাড় এই সব কাজে মেয়েদের ক্লান্তি নেই। উৎসাহ আকাশপ্রমাণ। মা যদি বলে দেয়, তবে লৌকিকতার দাবি উঠতে পারে। সমস্ত জ্ঞাতিগোষ্ঠী হয়তো তখন নতুন মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে এল। সে এত বড় খরচ সামলাতে পারবে না। আশীর্বাদ করতে এলে তাকেও তো অন্তত মিষ্টিমুখ করাতে হবে।
দেবনন্দন কথা বলে তখন। বিয়ের সমস্ত ব্যয়ভার সে বহন করতে চায়। শুভদীপ দৃঢ়স্বরে না বলে। বিয়ের দিনের খরচ সমস্তই তার। দেবনন্দন জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। শুভদীপ জানতে চায় দেবনন্দন অগ্নিসাক্ষী করতে চায় কিনা। দেবনন্দন অসম্মতি জ্ঞাপন করে। বিয়ে নিবন্ধীকরণ করবে সে। তারা আলোচনা করে তখন।তিনজনের আলোচনায় স্থির হয়, যে দিনই ঠিক হোক–দেবনন্দন সেকালবেলা চলে আসবে এ বাড়ি। শুচুকে নিয়ে তারা চলে যাবে শিবাগী মায়ের মন্দিরে। সেখানে শুচুকে সিন্দুর দেবে দেবনন্দন। বিকেলে যাবে বিবাহ নিবন্ধকারের কাছে। রাতে সকলে বাইরে খেয়ে ফিরবে।
মা তখন পঞ্জিকা নিয়ে আসে। জেঠিমা ছিল না বাড়িতে। তাই কেউ কিছু জিগ্যেস করারও ছিল না। মা চোখে চশমা এঁটে ঘরে বসে পঞ্জিকা দেখে কিছুক্ষণ। তিনদিন পর একটি শুভদিন পাওয়া যায়। এটা অগ্রহায়ণ মাস। শুচু এ মাসে জন্মায়নি। মা দেবনন্দনের জন্মমাস জানতে চায়। সে জানায় তার শ্রাবণ। অতএব তিনদিনের পরের দিনটি স্থির হয়ে থাকে। শুভদীপ স্থির করে, তিনদিন নয়, সে চারদিন ছুটি নেবে।