দরজার গোড়ায় প্রদীপকে উমা ধরিয়া ফেলিল। কহিল,—“আপনার সঙ্গে দেখা হবার ইচ্ছাটা আমার একান্ত আন্তরিক ছিল বলেই ত’ আজ বাস-এ আমাদের দেখা হয়ে গেল। কিন্তু সেই দেখা অসম্পূর্ণ রাখতে হবে এমন দুর্ঘটনা অবশ্যি এখনো ঘটেনি।”
প্রদীপ আশ্চর্য হইয়া উমার মুখের পানে তাকাইল। দুইটি উজ্জ্বল আয়ত চক্ষু বুদ্ধিতে দীপ্তি পাইতেছে, ছোট সঙ্কীর্ণ ললাটটিতে প্রতিভার স্থির একটি আভা বিরাজমান। কৃশ দেহটি ঘিরিয়া স্নানাভ যৌবনের যে একটি লালিত্য লীলায়িত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা মুহূর্তের জন্য প্রদীপের ক্লান্ত মন ও চক্ষু আবিষ্ট করিয়া তুলিল। উমার এই ছুটিয়া ডাকিতে আসাটির মধ্যে কোথায় যে একটি সযত্নসমৃদ্ধ সুস্নিগ্ধ স্নেহের স্বাদ আছে, তাহা আবিষ্কার করিতে গিয়া এই মেয়েটির প্রতি প্রদীপের মায়ার আর শেষ রহিল না। কিন্তু কি বলিবে তাহাই ভাবিয়া লইবার জন্য প্রদীপ এক পলক অপলক চোখে উমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
উমা কহিল,—“এখুনি পালাতে চাইলেই আমি ছাড়ব আর কি। আপনার সঙ্গে আমার কত যে কথা আছে, তা এতদিন ভেবে ভেবে আমি শেষ করতে পারিনি। দাঁড়ান, সব আমাকে ভেবে নিতে দিন।”
প্রদীপ ম্লান হাসিয়া কহিল,—“সময় নেই, উমা। তা ছাড়া আমার সঙ্গে মিশতে দেখলে মা খুসি হবেন না।”
উমা নির্ভীক কণ্ঠে কহিল,—“আপাতত নিজে খুসি হলেই আমার স্বচ্ছন্দে চলে যাবে খন। বেশ ত, এ বাড়িতে ডেকে এনে আপনাকে যদি অপমানিত করে থাকি, দাঁড়ান, আমি আপনার মেস্-এ যাব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে প্রকাও ইতিহাস শেষ করা যাবে না।”
—“তুমি পাগলের মতো কী বকতে সুরু করূলে?”
—“বকূলেই পাগল হয় না এবং ঢের পাগল আছে যারা মোটেই বকে না। আমি বছিও না, পাগলও হইনি। দেখবার ইচ্ছাটা আন্তরিক হলে দৈবাৎ এক আধবার মাত্র দেখা হতে পারে, কিন্তু দেখাটা যখন আবশ্যকীয় হয় তখন ইচ্ছাটা খালি আন্তরিক হলেই চলে না, দস্তুরমত ঠিকানা জানা দরকার। আপনার ঠিকানা যদি না দেন, তবে বলব মা’র থেকে বৌদির ঠিকানা না পেয়ে আপনি ছোট ছেলের মত অভিমান করেছেন। পুরুষ-মানুষের রাগ আমি সইতে পারি, কিন্তু ছিচকাদুনের মত অভিমান আপনাদের মানায় না কক্ষনো।”
প্রদীপ আবার ভালো করিয়া উমাকে না দেখিয়া পারিল না। উহার সাদাসিধে শাড়িখানা যেন নিমেষে তাহার অজস্র স্নেহে মাখিয়া উঠিল, উহার দুই চোখে যেন অদেখা আকাশের ছায়া পড়িয়াছে! কিন্তু নারীর রূপকে সে ধ্যানী বা কবির চোখেই দেখিতে শিখিয়াছে, তাই এই দৃপ্ত সাহসিকাকে ভারতোদ্ধারবাহিনীর অগ্রবর্তিনী করা যায় কি না, তাহাই ভাবিয়া তাহার আশা ও আনন্দ একসঙ্গে উথলিয়া উঠিল। কহিল,—“কিন্তু আমাকে নিয়ে তোমার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? ভবিষ্যৎ বলে আমার যেমন কিছু নেই, তেমন আমার। ঠিকানাও আমি নিজেই খুঁজে পাই না। স্থায়িত্ব জিনিসটা আমার ধাতে সয় না। আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, স্নেহ, জীবন-মরণ সব কিছু স্বল্পায়ু বলেই আমরা কাজ করতে এত বল পাই এবং তাড়াতড়ি করে ফেলবার জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ি।”
উমার দুইটি চোখের কোলে তরল হাসি টলটল করিয়া উঠিল। কহিল,—“আমি দার্শনিকতা বুঝি না। সোজা স্পষ্ট কথা বলতে পারলে বেঁচে যাই। অবশ্যি আপনার দেশসেবায় আমি ব্ৰতধারিণী হ’তে পাবে না, সে আমার বোকা মুখ ও বেচারা চেহারা দেখেই বুঝতে পারছেন, কিন্তু দেশসেবা ছাড়া জীবনে আর বড় কাজ নেই এ-কথা আপনি বুদ্ধিমান হলে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন না। তেমন কোনো কাজে আপনাকে দরকার হলে কোথায় আমি কড়া নাড়ব?”
প্রদীপ কহিল,—“তোমাকে ঠিকানা দিতে পারলে আমিই বেশি খুসি হতাম, উমা, কেননা কড়া-নাড়ার প্রতীক্ষা করে বসে থাকৃতে আমার হয় ত’ ভালই লাগত। কিন্তু আজ এখানে আছি, কালকেই হয় ত’ লাহোর, দু’দিন পরেই কে জানে ফের রেঙ্গুন পাড়ি মারতে হবে। এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকলে খালি মনে হয় বৃথা আয়ুক্ষয় করছি। অন্তত চছি—এটুকু চেতনা না থাকলে মরতে আর আমার বাকি থাকে না।”
-“হেঁয়ালি রাখুন দিকি—বড়ো বড় কথা বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে বলবেন। ঠিকানা না থাকে, এমন একটা জায়গার নাম করুন যেখানে মাঝে মাঝে গিয়ে দু’ দণ্ড আপনার সঙ্গে বসে কথা কইলে সমাজ বা আইনের চোখে দণ্ডনীয় হবে না। মা বোধ হয় আসছেন নেমে, বলুন, শিগগির করে।”
প্রদীপ ফটু করিয়া বলিয়া বসিল: “১৬, শ্ৰীগোপাল মল্লিকের লেইন। ওটা একটা মে। তোমার যদি কিছু বক্তব্য থাকে, চিঠি লিখো, কেমন?”
উমা হাসিয়া কহিল,-“কলমের চেয়ে পা চালাতে আমি বেশি ভালোবাসি। কিন্তু বৌদিদির ঠিকানা আপনি সত্যিই চান? তার সঙ্গে দেখা করবেন?”
কাহার পদশব্দে সচকিত হইয়া প্রদীপ নিদারুণ বিস্ময়ে তাকাইয়া দেখিল, অরুণা সিড়িতে নামিয়া আসিয়াছেন। চলিয়া যাইবার শেষ চেষ্টা করিয়া কহিল,—“দরকার নেই। ঠিকানা নিয়ে সে-বাড়িতে গেলেও যে ফিরে যেতে হবে না তার ভরসা কি? তবে নমিতার ইচ্ছা যদি কোনোদিন সত্যিই আন্তরিক হয়ে উঠে,আকাশের কোটি গ্রহ-নক্ষত্র ষড়যন্ত্র কলেও আমাদের দেখা হওয়াকে কিছুতেই খণ্ডাতে পাবে না কেউ।” বলিয়া বাহিরের জনাকীর্ণ রাজপথে প্রদীপ মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।
মা’র দৃষ্টির সামনে সঙ্কুচিত হইয়া উমা উপরে উঠিয়া আসিল। মা-ও পুনরায় ঘরে আসিলেন। তারপরে এমন একটা তুমুল গোলমাল সুরু হইল যাহাতে শচীপ্রসাদও, প্রদীপের প্রতি যতই কেন না অপ্রসন্ন থা, সম্পূর্ণ সায় দিতে পারিল না। তক্তপোষের এক ধারে শচীপ্রসাদ এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল, এখন তাহাকেই মধ্যস্থ মানিয়া মেয়ের এই নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে অরুণা বিচার-প্রার্থিনী হইয়া দাঁড়াইলেন। শচীপ্রসাদ সম্প্রতি পরোক্ষে উমার উমেদারি করিতেছিল বলিয়া, তাহার বিপক্ষে কিছু বলিতে তাহার মন উঠিতেছিল না, তাই তাহার সমস্ত রাগ গিয়া পড়িল প্রদীপের উপর। খুব জ্ঞানীর মত মুখ করিয়া শচীপ্রসাদ বলিল,-“ও-সব undesirableদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়াই উচিত নয়। সুধী যদি বেঁচে থাকৃত, তার বন্ধু তার একটা মানে ছিল, কিন্তু এখন তার পক্ষে এ-বাড়িতে ঢোকা অনধিকার প্রবেশ ছাড়া আর কি বলব।”
উমা মা’র অন্যায় তিরস্কার শুনিয়াই বিমুখ হইয়া উঠিয়াছিল, এখন এই অযাচিত সমালোচনায় সে আর সংযম রাখিতে পারিল না। উদ্দীপ্তকণ্ঠে কহিল,—“আর কিছু বলবেন কি করে? আপনাদের কি চোখ আছে না চোখের স্বচ্ছতা আছে? উনি নিজে যেচে এখানে আসেন নি, আমিই ওঁকে ডেকে এনেছিলাম। তা ছাড়া দাদা মারা গেছেন বলেই ওঁকেও আমরা ভূত বানিয়ে ফেল্ব আমাদের এ অকৃতজ্ঞতা বিধাতা ক্ষমা করবেন না। উনি আমাদের সংসারে অবাঞ্ছনীয় হলেন, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। ওঁর সংস্পর্শে এলে একটা নূতন জগতের আবিষ্কারের রোমাঞ্চ অনুভব করতে পেতেন নিশ্চয়।”
শচীপ্রসাদ ভাবিল, উমাকে অযথা চটাইয়া দিয়া সে ঠকিয়া গিয়াছে; কিন্তু কি করিয়া নিক্ষিপ্ত তীর ফিরাইয়া আনা যায়, তাহারই একটা দিশা খুঁজিতেছিল এমন সময় অরুণাই তাহাকে রক্ষা করিলেন। কহিলেন,–“কিন্তু অমন গুণ্ডাকে রাস্তা থেকে ধরে আনবারই বা এমন কি দায় পড়েছিল?”
—“দায় পড়ত যদি আমার বা তোমার প্রাণান্তকর অসুখ হ’ত— তখন রাত জেগে গা-গতর ঢেলে সেবা করবার দরকার পড়ত যে। যদ্দিন তিনি দাদার সেবা করেছেন, ততদিন তিনি মহাপুরুষ, সাধু; আর আজ তিনি তার দেশের সেবা করছেন বলেই গুণ্ডা। আমাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের সঙ্গে যে তার সঙ্ঘর্ষ বেধেছে।”
শচীপ্রসাদ টিপ্পনি কাটিল: “দেশ কথাটা বানান করা নেহাৎ সোজা বলে সবাই তা নিয়ে ফেঁপরদালালি করে।”
উমা কহিল,—“দেশ বানান্ করা সোজা বটে, কিন্তু বানানো সোজা নয়। সেটা দয়া করে মনে রাখবেন।”
রূঢ় কথা শচীপ্রসাদও কহিতে জানে, কিন্তু কথায়-কথায় কোথায় আসিয়া পৌঁছিবে তাহার ঠিকানা কি! তাহার চেয়ে চুপ করিয়া সিল্কের রুমাল দিয়া ঘাড়টা বার পনেরো রগড়াইলে বরং কাজ দিবে।
কথা কহিলেন অরুণা : “কিন্তু এমন বেহেড় বকাটের সঙ্গে তোর আবার অত ঘটা করে সম্পর্ক রাখতে যাওয়া কেন? আমি ভাবছি আসচে হপ্তারই তোকে হষ্টেলে ভর্তি করে দেব।”
উমা চুলগুলি লইয়া টানা-হেঁচড়া করিতেছিল; কহিল,—“তার মানে আমাকে প্রদীপদা-র প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে চাও। হষ্টেলে ত’ আমি যাবই, তা বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবারই বা কি দরকার? কিন্তু হষ্টেলে গিয়ে সত্যিই যদি আমাকে দীপদা-র সাহচর্য থেকে সরে থাকতে হয়, তা হলে সেটা আমার সীতার বনবাসের চেয়েও অসহনীয় হবে।”
এই প্রগল্ভ দুর্বিনীত মেয়েটাকে প্রহার করিতে পারিলেই বুঝি অরুণা সন্তুষ্ট হইতেন, কিন্তু তাহাতে বাধা ছিল। তাই কণ্ঠে বিষ ঢালিয়া তিনি কহিলেন,—“তুই আর ওর চরিত্রের কী জানিস? পরের বাড়ির বৌর ওপর কেন ওর এত দরদ, তা তুই বুঝবি কি করে?
না বুঝিলেও উমাকে বুঝাইয়া না দেওয়া পর্যন্ত অরুণার স্বস্তি ছিল। শচীপ্রসাদ এ-বাড়িতে সম্পূর্ণ আগন্তুক নয়, অরুণার দিক হইতে তাহার সঙ্গে একটা সম্পর্কের সূত্র খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইবে না। তাই তাহার সামনে প্রদীপের নিন্দাটা শিষ্টাচারের বহির্ভূত হইবে না ভাবিয়াই, অরুণা তাহাকেই সম্বোধন করিলেন :
—“ভেবেছিলাম সুধী-র বন্ধু, ভদ্রলোক, লেখাপড়া শিখেছে—কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে এমন খারাপ, তা মোটেই আন্দাজ করতে পারিনি, শচী। মরা-বন্ধুর প্রতি এতটুকু যার শ্রদ্ধা নেই, তাকে পুলিশেই ঠিক সম্মান দেখাতে পারবে।”
এইটুকু ভূমিকা করিয়া অরুণ। সবিস্তারে নমিতার সঙ্গে প্রদীপের নীতিবিরুদ্ধ সন্নিধ্যের একটা বিশ্রী বর্ণনা দিয়া ফেলিলেন। পাছে পুত্রবধুর কল্পিত বিশ্বাসঘাতকতায় স্বর্গগত পুত্রের আঘাত লাগে, সেই ভয়ে স্নেহময়ী অরুণা সমস্ত কলঙ্ক প্রদীপের মুখেই মাখাইয়া দিলেন। অবনীবাবুর কাছে প্রদীপ-নমিতা-সংস্পর্শের যেটুকু বিবরণ পাইয়াছিলেন, তাহাতে সুবিধামত একটু বর্ণচ্ছটা না মিশাইলে চলিত না, তাই সহসা উমার সম্মুখে প্রদীপ একেবারে কালো ও কলুষিত হইয়া উঠিল। অরুণা ফোড়ন দিলেন : “দেশের নাম করে যেদিন থেকে গুণ্ডামি শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই ওর প্রতি আমি আস্থা হারিয়েছি।”
শচীপ্রসাদও রসনাকে নিরস্ত করিতে পারিল না : “চেহারা থেকেই যারা মনস্তত্ব আবিষ্কার করেন, সে-সব লোকের কথায় বিশ্বাস। আমার ঘোল আনা। ওঁর চেহারা দেখেই আমার মনে হয়েছিল, লোকটা ভালো নয়। এর পর এ-সব পাড়ায় পা দিলে ওঁকে রীতিমত অসুবিধায় পড়তে হবে।”
উমার মুখ পাংশু হইয়া, গলা শুকাইয়া, নিমেষে যে কেমন করিয়া উঠিল বুঝা গেল না। না পারিল তীব্র প্রতিবাদ করিতে, না বা পারিল অভিযোটা আয়ত্ত করিতে। প্রদীপ উত্তুঙ্গ গিরিচূড়া হইতে নামিয়া আসিয়া একান্ত অকিঞ্চিৎকর পিপীলিকার সমান হইয়া উঠিল। ইচ্ছা হইল প্রদীপকে ডাকিয়া আনে, সে নিমেষে এই সব অতি-মুখর নির্লজ্জ কটুভাষণের বিরুদ্ধে তাহার অগ্নিময় ভাষার বাণ হানিয়া এই দুই আততায়ীকে অভিভূত করিয়া ফেলুক।
আর কিছুই না বলিয়া উমা নিজের ঘরে অসিয়া, একটা চেয়ারে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। যাক, এই সব ব্যাপার লইয়া মাথা না ঘামাইলেও তাহার চলিবে। সে এখানে পড়িতে আসিয়াছে, মন দিয়া পড়িয়া পরীক্ষা-সমুদ্রগুলি পার হইতে পারিলেই তাহার ছুটি মিলিবে। পরে কি হইবে এখন হইতে ভাবিয়া রাখার মত মূখতা আর কি আছে? তাহার মত অবস্থার মেয়ে দেশের জন্য কতটুকু কাজ করিতে পারে, সে বিষয়ে প্রদীপদা’র সঙ্গে খোলাখুলি একটা পরামর্শ করিতে পারিলে মন্দ হইত না, কিন্তু আপাতত তাহা স্থগিত রাখাই সমীচীন হইবে। কাজের জন্য প্রথমত খানিকটা যোগ্য ত’ দরকার, মনকে সেই আশ্বাস দিয়া সে সেলফ, হইতে একটা বই টানিয়া লইয়া পড়িতে বসিল।
এমন সময় শচীপ্রসাদ ঘরে ঢুকিয়া তাহাকে ফের উদ্বস্ত করিয়া তুলিল। শচীপ্রসাদের বয়স বাইশ, চেহারা দোহারা, পরনের জামা-কাপড়গুলি অত্যুগ্ররূপে পরিচ্ছন্ন। কামানো দাড়ি-গোঁফ, ব্যাক্-ব্রাশড় চুল,-মুখে একটা মেয়েলি-ভাবের কৃত্রিম কমনীয়তা আছে। কলেজের ছাত্র হিসাবে খুবই ভালো, এই বৎসর সসম্মানে বি, এ পাশ করিয়াছে, —বোধ হয় শীঘ্রই বিলাত যাইবে আই-সি-এস্ হইবার জন্য। উহার বাবার ইচ্ছা, শচীপ্রসাদ বিলাত যাইবার আগে এখানেই পাণিগ্রহণটা সারিয়া লয়; পিতার ইচ্ছার অনুবর্তী হইয়া শচীও তাই ঘন-ঘন এই বাড়িতে আসা-যাওয়া করিতেছে। অবনীবাবু অস্পষ্ট করিয়া মত দিয়াছেন বটে, কিন্তু উমার আগে এক মেয়ে নিজের অনিচ্ছায় বিয়ে করিয়া, স্বামীর দুর্ব্যবহারের জন্য মারা গিয়াছিল বলিয়া চট করিয়া মত দিয়া ফেলিতে অরুণা ইতস্তত করিতেছিলেন। মেয়েকে খোলাখুলি কিছু প্রশ্ন না করিয়া বিবাহের যোগাড়যন্ত্র করিবারও কোনো অর্থ নাই, কেননা, দেশের হাওয়া বদলাইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মেয়েও এমন স্বাতন্ত্রসাধিকা হইয়া উঠিয়াছে যে, তাহাতে বিয়ের নামে নাক সি টকাইয়া একদিন বাহির হইয়া পড়াটা তাহার পক্ষে বিচিত্র নয়। সুতরাং স্বয়ং শচীপ্রসাদকেই বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ও নির্বিঘ্ন অবকাশের সুবিধা ছাড়িয়া দিয়া তাহারা স্বামী-স্ত্রী নেপথ্যে বসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছেন।
খবরটা উমার কানে যাইবে না, উমা তেমন নিরীহ ছিল না, কিন্তু সে বোধ করি বুঝিত যে বিবাহের প্রস্তাবের মধ্য দিয়া প্রেমের শুভাবির্ভাবের সূচনা হয় না। শচীপ্রসাদ তাহার সঙ্গে ব্যবহার করিত ভীরু ভক্তের মত নয়, অনেকটা কর্তৃত্বসম্পন্ন প্রভুর মত। অর্থাৎ উমার চিত্ত জয় করিবার জন্য প্রেম দিয়া নিজের চিত্ত-প্ৰসাধন করিবার প্রয়োজন সে বুঝিত না। জোয়ারের জলের মত উমার যৌবন উদ্বেল হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া তাহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিতেছিল। উমার বাবা-মা যখন সঙ্কেত করিয়াছেন, তখন কোনো ব্যতিক্রমের জন্য তাহাকে জবাবদিহি করিতে হইবে
ভাবিয়া সে পরম নিশ্চিন্ত ছিল। নতুবা, তাহার রোমান্টিক বা কল্পনাপ্রবণ হইবার বয়স ত’ ইহাই। হাত বাড়াইয়াই যখন উমাকে আয়ত্ত করা যায়, তখন তাহাকে আকাশচারিণী শশীলেখার সঙ্গে তুলনা
বামন হইয়া অশ্রুবিসৰ্জন করিবার কোনো মানে হয় না। উমা সুন্দর, শোভনাঙ্গী; তাহা ছাড়া অবনী বাবুর সম্পত্তি উমার আঙুলের ফাঁক দিয়া নিশ্চয়ই তাহার হাতে আসিয়া পড়িবে। অতএব শচীপ্রসাদ যদি বুদ্ধিমান হয়, তবে অযথা কালবিলম্ব করিলে সৌভাগ্যলক্ষ্মীর কাছে সে হাস্যাস্পদ হইবে।
অথচ, শচীপ্রসাদের এই সকল অধিকার খাটানোর জন্যই তাহার প্রতি উমা প্রসন্ন হইতে পারে নাই। এমন নিলিপ্তের মত আত্মনিবেদনের লজ্জা হয় ত’ তাহাকে সঙ্গোপনে আহত করিত। সে এমন করিয়া তাহার ব্যক্তিত্বকে মুছিয়া ফেলিতে চাহে না। নিশীথ রাত্রি ভরিয়া কাহাকে ভাবিয়া আকাশের তারাগুলির দিকে তাহার চাহিয়া থাকিতে ইচ্ছা করে; কেহ আসিবে, এই অসম্ভব একটি বিশ্বাস লালন করিয়া সে তাহার অনতি-উদঘাটিত যৌবনকে পূজার দীপশিখার মত আগ্রহ-কম্প উন্মুখ করিয়া রাখিবে, সে না আসিলে তাহার পড়ায় মন বসিবে না, চুল বাঁধিতে বাধিতে জন-যান-মুখর রাজপথের পানে চাহিয়া, সে সানন্দে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিবে। জীবনের এমন কতগুলি মুহূর্ত বাঁচিয়া সে এত অনায়াসে ফুরাইয়া যাইতে চাহে না। শচীপ্রসাদ যদি তাহার ঘরে নিঃশব্দ পদপাতে একটি ভয়-ভঙ্গুর অনুচ্চারিত প্রার্থনা লইয়া প্রবেশ করিত, তাহা হইলে উমার সৰ্ব্বদেহমন রোমাঞ্চময় হইয়া উঠিত কি না কে জানে!
শচীপ্রসাদ হাসিয়া বলিল,-“চল রায়স্কোপে যাই, পর্দায় আবার তোমার সেই লরা লা প্লতে দেখা দিয়েছেন।”
বই হইতে উমা মুখ তুলিল না; কহিল,—“ফিল্ম দেখে পয়সা খরচ করাকে আর ক্ষমা করতে পারূব না। বরং বিকেলে বেরিয়ে আমার জন্যে যদি একটা কাজ করতে পারেন, ত’ ভালো হয়।”
শচীপ্রসাদ ঘাবড়াইয়া গিয়া কহিল,—“কি?”
দুইটি স্থির জিজ্ঞাসু চোখ মেলিয়া উমা বলিল,—“শ্রীগোপাল মল্লিকের লেইটা কোথায় জানেন?”
—“না; কেন?”
—“তবে দয়া করে একটু খোঁজ নিয়ে আসবেন, ওখানে যেতে হলে বাস থেকে কোথায় নামূলে সুবিধে।”
শ্রীগোপাল মল্লিকের লেইনে নিশ্চয়ই উমার কোনো সহপাঠিনী আছে বিশ্বাস করিয়া শচীপ্রসাদ একটু প্রফুল্লই হইয়া উঠিল হয় ত’। উমার পরিচয়ের সূত্রে আরেকটি মেয়ের কাছে আসিতে পারিলে যে ভালোই হয়, সে-দুৰ্বলতা শচীপ্রসাদের বয়সের ছেলের পক্ষে অমার্জনীয় নয়। এবং সেই অনামা মেয়েটির সান্নিধ্যে যে শচীপ্রসাদ স্বাভাবিক সঙ্কোচে তাহার সমস্ত আচরণটিকে সুমধুর করিয়া তুলিত, তাহাতে আর সন্দেহ কি! তাই সেই গলিটার অবস্থান ও আয়তন-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সে আমৃতা-আমৃত করিয়া কহিল,—“কারো সঙ্গে দেখা করূতে যাবে? বেশ ত, চল না, দু’জন বেরিয়ে পড়ি। কাছা কাছি কোথাও হবে হয় ত’। কলকাতার রাস্তা খুঁজে বেড়াতে আমার ভালোই লাগে। বেশ একটু বেড়ানোও হবে খন।”
বইয়ের পৃষ্ঠায় ফের চোখ নামাইয়া উমা বলিল,-“না, সেখানে আমাকে একলাই যেতে হবে। আপনি দয়া করে একটু জেনে এলেই চলবে।”
শচীপ্রসাদ ভাবিত হইল। এইবার তাহার স্বরে আর বিনয়স্নিগ্ধ কুণ্ঠা রহিল না। আরেকটু সরিয়া আসিয়। সে জিজ্ঞাসা করিল, “সেখানে কে আছে শুনতে পাই?”
উমা টলিল না, কহিল,—“সব কথাই কি সব্বাইকে বলতে হয়?”
—“অন্তত আমাকে তোমার বলা দরকার।”
—“এমন অনেক কথা আছে, যা নিজেকে পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলা যায় না।”
রুক্ষস্বরে শচীপ্রসাদ বলিয়া উঠিল,—“আমাকে না বলে আমার সাহায্য করাটা অসঙ্গত হবে।”
উমা একটু হাসিল; বলিল,—“আপনি সাহায্য করলেও এগোপাল মল্লিকের লেইনটা বাড়ির দরজায় চলে আসত না, হেঁটেই যেতে হত। হাঁটুতে আমি একলাই পারি।”
এই বলিয়া বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইতে যাইতেই তাহার নজর পড়িল যে, বইটা একটা রেলওয়ে-সম্পর্কিত আইনের ইস্তাহার। এতক্ষণ তাহার মনকে শ্ৰীগোপাল মল্লিকের লেইনের সন্ধানে পাঠাইয়া, সে এত মনোযোগ সহকারে ইহাই পড়িতেছিল নাকি!
তাড়াতাড়ি বইটা রাখিয়া দিয়া, উমা উঠিয়া দাঁড়াইল। শচী প্রসাদের কিছু বলিবার আগেই সে হাসিয়া কহিল,—“আপনার বায়স্কোপের পয়সা বাঁচিয়ে দিলাম। ও পয়সাটা চোখ মেলে কোনো পুয়োর-কাণ্ডে দিয়ে দেবেন।”
শচীপ্রসাদের কণ্ঠে বিষ আছে : “ভিক্ষা দেওয়াকে আমি পাপ মনে করি। তুমি না গেলেই যে বায়স্কোপ পটল তুলবে এমন কথা না ভাবলেই তোমার বুদ্ধি আছে স্বীকার কবুব। আমার পাশে একটা মাড়োয়াড়ি বসলেও ফিল্ম, আমি কম enjoy করব না।”