তোর খুব কষ্ট হয়েছে, নারে নবিতুন?
হুঁ হুঁ কিচ্ছু বলে না নবিতুন। শুধু কদমের আলিঙ্গনের মাঝে কুঁ কুঁ অস্ফুট এক খুশির শব্দ তুলে সামান্য একটু কেঁপে যায় মাত্র। শরীরটাকে গুটিয়ে নিয়ে কেমন ছোট্টটি হয়ে আসে নবিতুন। আরো নিবিড় হয়ে সেঁটে যায় কদমের বুকের ভেতর।
কদম অনুভব করে তুলতুলে নরম কুসুম কুসুম গরম ওর নবিতুন। কদম অনুভব করে ওর বুকের উমে কেমন নিশ্চিন্ত নবিতুন। পাটিপাতা ডাঁটির মতো চিকনচাকন মসৃণ কালচে-সবুজ দুখানি বাহু নবিতুনের। কদমের গলায় লতিয়ে রয়েছে সে বাহু।
শালতি শালতি হাত কদমের। সে হাতের পীড়নে বুঝি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কদমের ভেতরে মিশে যায় নবিতুন। কুঁ কুঁ অস্ফুট সেই মৃদু গুঞ্জন তুলে বুঝি মূৰ্ছা যায় নবিতুন।
সকাল হয়েছে সেই কখন। বাইরে গিয়ে কত কাজ সেরে এসেছে নবিতুন। বাসি ফেন দিয়ে কুঁড়ো মেখে খাইয়েছে হাঁস-মুরগিগুলোকে। আণ্ডাপাড়া মুরগিটাকে বেঁধে রেখেছে। বজ্জাত মুরগি চুপেচাপে কোরবানদের ঘরে গিয়ে ডিম পেড়ে এসেছে গতকাল। তাই নবিতুন খের ভর্তি কোরার ভেতর মুরগিটাকে বসিয়ে তার পা-টা বেঁধে দিয়েছে খরের পালার সাথে। কাজকর্মগুলো সেরে ও আককিকে পাঠিয়ে দিয়েছে মিজি বাড়ি। মিজিদের ঝাঁকি জালটা চেয়ে আনবে।
তারপর ঘরে ঢুকে সারেংয়ের আনা নতুন আরশিটার সুমুখে দাঁড়িয়েছে নবিতুন। বাস তেলের বোতল খুলে হাতে নিয়েছে একটুখানি তেল। দুহাতের তালুতে মেখে নিয়েছে তেলটা। একটি ফোঁটাও যাতে না পড়ে যায় মাটিতে, তাড়াতাড়ি তেলমাখা হাতের দুটো তালু বিছিয়ে দিয়েছে মাথা ভর্তি চুলের ওপর। আস্তে-আস্তে চুলগুলো পাট করে খোঁপা বেঁধেছে।
তেলের ভুরভুর সুবাসটা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। বুঝি তার চেয়েও বেশি সুবাস নবিতুনের মনের ভেতর। সুগন্ধে ভরে যায় ওর মনটা। কেমন ফুলে ফুলে নিঃশ্বাস টানে ওর বুকটা। কাংগইটাকে নাকের কাছে এনে গন্ধ টানে নবিতুন। সুগন্ধমাখা হাত জোড়া অনেকক্ষণ ধরে রাখে নাকের ওপর।
তারপর কাংগইটাকে পরিষ্কার করে রেখে দেয়। টেনে নেয় পাউডারের কৌটোটা। ওই পাউটারে একই সুবাস, তেলটার চেয়ে একটু বেশি উগ্র। চালের গুঁড়ির মতো মিহিন গন্ধভরা পাউটার কয়েক চিমটে হাতে তুলে নেয় নবিতুন। আস্তে-আস্তে ঘষে ঘষে গালে মাখে। এভাবেই নাকি মাখতে হয়, কদম ওকে দেখিয়ে দিয়েছে। পাউটার মাখা শেষ হলে কৌটোটা বন্ধ করে রেখে দেয় টিনের তোরংয়ে।
এমনি সময় মনে পড়ে যায় গত বিকেলে ভিজিয়ে রাখা রস পিঠেগুলোর কথা। হাঁড়ির ঢাকনিটা খুলে পিঠেগুলো দেখে নেয় নবিতুন। টিপে টিপে দেখে। না, রসে ভিজে, রস খেয়ে ফুলে উঠেছে, নরম আর টসটসে হয়ে আছে পিঠেগুলো। নবিতুনের আঙুলের সামান্য চাপ খেয়েই দুফাঁক হয়ে গেছে একটা পিঠা। ভারি খুশি লাগে নবিতুনের। রসে ভেজা এই চিতই পিঠা খুব ভালবাসে কদম।
আবারও আরশিটার সুমুখে এসে দাঁড়ায় নবিতুন। পাটিপাতা রঙ মুখটা ওর সুন্দর। পাউটার লেগে বুঝি আরো সুন্দর হয়েছে সে মুখ।
অজানাতেই ওর হাতটা চলে যায় তোরংয়ের দিকে। তোরং থেকে তুলে আনে একটি কাচের কৌটো। ঢাকনাটা খুলে মুখের কাছে এনে গন্ধটা শোকে নবিতুন। চমৎকার গন্ধ। বাস তেল আর পাউটারের চেয়ে চমৎকার। কৌটোটার ভেতর ধবধবে সাদা তরল মতো কি যেন, ছাই নামটাও মনে থাকে না নবিতুনের। বড় ঠাণ্ডা জিনিস। নখের আগায় সামান্য একটু তুলে নিয়ে কি ভেবে কৌটোটা বন্ধ করে তোরংয়ে রেখে দেয় নবিতুন। না এসসনোটা এতক্ষণে মনে পড়ল নামটা একটু ভালো লাগে না নবিতুনের। সেই বিয়ের সময় প্রথম যখন এনে দিয়েছিল কদম, তখনও না। এখনও না। কেমন ভেজা ভেজা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। গালের চামড়ায় পাতলা কাইয়ের মতো লেগে থাকে। বিশ্রী লাগে নবিতুনের।
কাজ সারা, কাজ সারা নবিতুনের। অথচ লোকটা এখনো ঘুমোচ্ছে — এই, ওঠ ওঠ। চৌকিটায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে লোকটার পাশে বসে নবিতুন। কিন্তু মজল সারেংয়ের ব্যাটাটা এখনো বড় ত্যাঁদড়। ঘুমোয়নি। ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে দেখছিল নবিতুনের সাজ। লোকটা ফিরে আসার পর রোজই তো এমনি করে সাজে নবিতুন। সাজ সেরে ওকে ডাক দেয়। আজও ডাকতে এসেছে। অমনি সাঁ করে দুটো হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে নেয় কদম। টেনে নিয়ে পুরে রাখে বুকের ভেতর।
বাইরে এখন রৌদের ঢল। বেড়ায় ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রৌদ্র এসে রৌদের ঝাঝারি বানিয়েছে মাটির মেঝেতে।
কদমের বুকের ভেতর তুলতুলে নরম কুসুম কুসুম গরম নবিতুন আর শব্দ করছে না, কাঁপছে না। নবিতুন এখন তৃপ্তি আর সার্থকতার শেষে ঝরে পড়া পাতা। অবশ। নিস্পন্দ। নিথর।
যেন ভালো করে দেখবার জন্য ওর মুখটাকে বুকের তলা থেকে তুলে আনল কদম। কয়েক ফোঁটা রৌদ্র দৌড়ে এসে চিকিমিকি এঁকে গেল নবিতুনের মুখে। কালচে-সবুজ পাটিপাতা মসৃণ নবিতুনের মুখ, রৌদের চিকিমিকি ফোঁটায় আরো সুন্দর। আরও সুন্দর নবিতুন, কেননা, একটুক্ষণ আগের সেই সার্থকতায় ঝরে পড়ার আনন্দটি এখনো লেপে রয়েছে ওর মুখ। চোখ-বোজা নবিতুন এখন সার্থকতার নিটোল ছবি।
বাইরে বুঝি আককির পায়ের আওয়াজ। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নবিতুন। বিস্রস্ত শাড়িখানা শরীরে প্যাঁচিয়ে নেবে পড়ে চৌকি ছেড়ে।
কিন্তু টান পড়ে আঁচলে। ওর মুখটাকে তখন গালের উপর টেনে নিয়েছে কদম। নবিতুন বলে, ছিঃ।
আবারও ছিঃ? ওর মুখটা ছেড়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসে কদম– ছিঃ মানে কি, নবিতুন কি ভুলে গেছে? বুঝি সে-কথাটা মনে করেই হাসছে কদম– ছিঃ বলেও সরে যেতে পারে না নবিতুন। সারেংয়ের মুখের ওই হাসিটা চুম্বকের মতো টেনে রাখে ওকে। সাগরফেরা মানুষ। দেশ-দেশান্তর যার নখের ডগায়। সেই কদম সারেংই বুঝি অমন করে হাসতে জানে। আর কেউ পারে না ওর মতো হাসতে। চোখ নামিয়ে নেয় নবিতুন।
সাগরফেরা নাবিক। তার বুঝি তিয়াস মেটে না। আবারও হাত বাড়ায় কদম। ছিঃ মেয়েটা এসে পড়বে যে! দৌড়ে পালিয়ে যায় নবিতুন।
তৃপ্তির সাথে ফুড়ত ফুড়ত রস টেনে টেনে রস পিঠে খায় কদম। মাঝে মাঝে দু-একটা তুলে দেয় আককির খোরায়। অমনি ওর হাতটা চেপে ধরে নবিতুন, বলে, মেয়ে তো সারা বছরই খাচ্ছে। তুমিও খাও। বিদেশে কি পাওয়া যায় এসব?
বিদেশে যে আরও কত কি পাওয়া যায় বামনছাড়ির নবিতুন বা আককি যা চোখেও দেখবে না কোন দিন, সেসব কথায় না গিয়ে কদম একটা পিঠে ফেলে দেয় আককির খোরায়। বলে, আহা সারা বছর যেন রস পিঠে বানাস তুই। বানায় নাকিরে আককি?
অর্ধেকখানি পিঠে মুখে পুরে দিয়েছে আককি। ভর্তি গাল নিয়ে বাপজানের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার উপায় নেই ওর।
কিন্তু নবিতুন সঙ্গে সঙ্গেই আরও দুখানি পিঠে আর এক করসুল রস ঢেলে দিয়েছে কদমের বাসনে।
কদম হাসে। হাতে উঠিয়ে নেয় একখানি পিঠে। হাতটা এগিয়ে দেয় নবিতুনের মুখের দিকে। বলে, নে এটা তুই খা।
ফস করে মুখটা ঘুরিয়ে এক হাত সরে যায় নবিতুন। চোখ শাসায়। দাঁত কামরায়। দাঁতের নিচে ঠোঁট চেপে ধরে সাবধান করে দেয় কদমকে। সাবধানীটা একটুও মানে না কদম। হাতটা আর একটু লম্বা করে বলে, খা।
ছিঃ। ছিঃ। দিনে-দিনে আক্কেল আন্দাজের যেন মাথা খাচ্ছে সারেং। বিদেশ ঘুরে ঘুরে হায়া-শরম খুইয়ে এসেছে সব। বিয়ের লায়েক মেয়ের সামনে অমন করে হাত বাড়িয়ে বলে কি না, তুই খা। ছিঃ ছিঃ।
ছিঃ রীতিমতো চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠল নবিতুন। বুঝি নিরস্ত্র হয় কদম। নিরস্ত্র হয়ে শুধায়, তোর জন্য রেখেছিস? দেখি হাঁড়িটা?
ত্রস্তে হাঁড়িটার দিকে হাত বাড়ায় নবিতুন। কিন্তু ততক্ষণে ঢাকনা খুলে হাঁড়িটা দেখছে কদম। পিঠে নেই একটাও। একেবারে তলায় ছোট ছোট কয়েকটা ভাঙা পিঠের টুকরো, একটু রসের তলানি।
হাতের পিঠেটা টুপ করে হাঁড়ির ভেতর ফেলে দেয় কদম।
ফিক করে হেসে দেয় নবিতুন।
জালটা নিয়ে যাও। খুব মাছ উঠেছে গাংয়ে। মিজি বাড়ি থেকে চেয়ে আনা জালটা কদমের হাতে তুলে দেয় নবিতুন। বলে আবার অন্য মাছ ধর আর না ধর, দুটো ইঁচা মাছ ধরবাই।
ইঁচা মাছ? মাত্র দুটো ইঁচা মাছ দিয়ে করবি কি? শুধায় কদম। আর ওর নজরে পড়ে কুলোর উপর ছড়ানো এক গুচ্ছ ঢেঁকিশাক।
নবিতুনের খুব পছন্দ ঢেঁকিশাক। কদমেরও। তবে রান্নাটা হতে হবে ইঁচা মাছ দিয়ে।
উপুড় হয়ে ঢেঁকিশাকের আগাগুলো এলোমেলো করে দেয় কদম। আককির সুমুখে শরমে বুঝি মাটির তলায় পালিয়ে যেতে চায় নবিতুন। সেই কবে, ঢেঁকিশাক কুরুতে গিয়েই তো মরণ হয়েছিল নবিতুনের।
সাগর ফেরা নাবিকের সেই হাসি। সেই হাসি দিয়ে নবিতুনের কলজেটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল কদম। জালটা ওর পিঠে।
বুয়া গো বুয়া। তোমায় দেখে হিংসায় মরি। বয়স বাড়ে মানুষ হয় বুড়ো, এই তো জানি! কিন্তু তোমার বেলায় সব নিয়মই যেন উলটো। বয়স বাড়ছে আর তোমার জোয়ানকিটা কেবলই ফেটে পড়ে। শরবতি এসে হেসে ঢলে পড়ে নবিতুনের পিঠে।
শ্বশুরবাড়ি বছর কাবার করে আবারও নাইওর এসেছে শরবতি। ওর ছেলেটা এখন হাঁটতে শিখেছে।
হিংসা করিস? খুশিতে মনটা ডগমগ, তবু কৃত্রিম কোপে মুখভার করে শুধায় নবিতুন।
হিংসা করব না? দেখ না আমার দিকে চেয়ে। এক বিয়ানিতেই কেমন বুড়ি হয়েছি। আর তুমি? এখনো যেন আবিতি কন্যা। হয়তো চাপা কোন দুঃখ আছে শরবতির। কিন্তু বলে ও তেমনি হেসে-ঢলে।
ততক্ষণে আরো অনেকেই এসে পড়েছে। কোরবানের বৌ এসেছে। গুঁজাবুড়ি এসেছে। আর যারা কখনো আসেনি দুঃখের দিনে– বেরা বাড়ির সমিরন, বেপারী বাড়ির টুককির মা, ওরাও এসেছে নবিতুনের সুখ দেখতে।
তাই তো বলি রূপ আজ এত খোলতাই কেন? এ কোন দেশের নকশা গো নবিতুন বুয়া। এতক্ষণে বুঝি নবিতুনের শাড়িটার ওপর দৃষ্টি পড়েছে শরবতির। কলে বোনা পাতলা সবুজ জমিনের ওপর ময়ূর আঁকা শাড়ি। শরবতি আঁচলটাকে একেবারে চোখের কাছে এনে গভীর মনোযোগে দেখে ময়ূরের ছবি।
টুককির মা আঁচলটা একবার ধরেই রেখে দেয়। বলে, ওমা! একি শাড়ি গো। পাড় নেই?
সবিস্ময়ে দেখল ওরা। সত্যি পাড় নেই শাড়িটায়। পাড় নেই সে কেমন শাড়ি। সে তো তেনা, তেনারই শামিল।
আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে শরবতিই জবাব দেয় সন্দেহবাদী টুককির মার। বলে, বেপারী বাড়ির বাইরে তো আর যাও না। ভালো মানুষের বৌরা সব পাড় ছাড়া শাড়ি পরে আজকাল। সে খবর রাখ? চৌধুরী বাড়ির ছোট বৌর ছাপা শাড়িগুলো দেখেছ?
এককথায় বুঝি চৌদ্দ কথা শুনিয়ে দেবে শরবতি। বলেও কি বিপদে পড়ল টুককির মা! তাড়াতাড়ি পানের বাটাটা টেনে নিয়ে চোখ নামায় টুককির মা!
সুপুরির কৌটাটা ওদের সুমুখে এগিয়ে দেয় নবিতুন। নিজেও একটা খিলি পুরে দেয় মুখে। তারপর ময়ূর আঁকা শাড়িটাকে বারবার মেলে ছড়িয়ে দেয় পায়ের কাছে, বুকের দিকে পিঠের ওপর। ওরা দেখুক। ঢেঁকিশাকগুলো কোটা হয়ে গেছে নবিতুনের। এবার কাঁঠালের বিচির খোসা ছাড়ায়। ছাড়ায়ে বিচিগুলো জাঁতিতে ফেলে কুটুর কুটুর কেটে চলে নবিতুন। তারই ফাঁকে চলে ওদের কথাবার্তা।
জাঁতি চলে কুটুর কুটুর। আর টুনটুন বাজে নবিতুনের হাতের চুড়ি। কবজি থেকে কুনুই অবধি চুড়িতে ভরা নবিতুনের হাত। কত রঙের কত কিসিমের চুড়ি। বেলোয়ারি চুড়ি। প্লাস্টিকের চুড়ি। নীল চুড়ি। লাল চুড়ি। আর ওদের মাঝে রাণীর মতো দুগাছি রুলি।
সোনার মতোই চকচকে রুলি জোড়া। আসলও হতে পারে। মিশলেও হতে পারে। তবে সোনা যে কিছু আছে ওতে, সন্দেহ নেই কারো। জাঁতিটা ওঠে আর পড়ে। আঙুলগুলো, হাতের কব্জিটা দরকারের চেয়ে একটু বেশি করেই বুঝি নড়ে আর বেলোয়ারি চুড়ির বাজনা বাজে টুনটুন টুনটুন। দুচোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে থাকে সমিরন, টুককির মা। হাতটাকে জাঁতির ওপর স্থির করে ধরে রাখে নবিতুন ওরা দেখুক। আর একটু ভালো করে দেখুক।
ওরা দেখে, কোরবানের বৌ আর শরবতির হাতেও বেলোয়ারি চুড়ি। নবিতুন দিয়েছে ওদের!
কুচি কুচি করে বিচিগুলো কাটা সারা হয়ে গেল। হাঁড়িতে পানি ভরে কুচিগুলো ভিজিয়ে রাখল নবিতুন। কদমের প্রিয় হইল্যা মাছের শুঁটকি দিয়ে কাঁঠালের বিচি রান্না রাতের জন্য করবে নবিতুন। কুচিগুলোকে তাই ভিজিয়ে রাখতে হবে দিনভর। তবেই রান্নার পর দাঁতের তলায় পড়ে গলে যাবে মোমের মতো। স্বাদ হবে মনের মতোন।
খোসাগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে হাতটা ধুয়ে নিল নবিতুন। তারপর হাত দুটো উঠিয়ে নিল খোঁপার দিকে, খোঁপাটাকে আর একটু আঁট করে বাঁধবে বলে। অমনি চুরিগুলো যেন খিলখিলিয়ে উঠল। সবগুলো চুড়ি ঝনাক করে নেমে এলো কনুইর দিকে।
বেড়ার ফুটো দিয়ে একরাশি রৌদ্র এসে চ্যাপটা হয়ে লেগে আছে নবিতুনের হাতের পিঠে। সে রৌদে ঝকমকিয়ে উঠেছে নীল চুড়ি লাল চুড়ি। হাত দুটো ঘুরিয়ে দুলিয়ে খোঁপা বাঁধল নবিতুন। যেন ইচ্ছে করেই হাত জোরা খোঁপার ওপর অনেকক্ষণ ধরে রাখল নবিতুন। ওরা দেখুক।
ওরা দেখছে। লাল চুড়ি নীল চুড়ি। ধাঁধা ফেলছে ওদের চোখে।
খোঁপা বাঁধা হয়ে গেল। হাত দুটো নাবিয়ে আনল নবিতুন। টি-নি-টি-রি-নি-নি ঝরাক করে চুরিগুলোও এ ওর গায়ে হেলে পড়ে নেমে এলো কব্জির দিকে।
ওরা দেখল নবিতুনের সুখ। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বেরা বাড়ির সমিরন, বেপারী বাড়ির টুককির মা। নবিতুনের সুখে নিজের নিজের দুঃখের কথাই বুঝি মনে পড়ে ওদের। তাই যাবার আগে আর একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ওরা। ওরা চলে গেল।
সগির মা গুঁজাবুড়ি। সেও চুপচাপ দেখছে নবিতুনের সুখ। এতক্ষণ কোন কথা বলেনি ও। এবার এক কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ নবিতুনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল গুঁজাবুড়ি।
ওরে আমার বোনঝি! আমার বুকের ধন। বলিনি? বলিনি তখন, সবর কর, ছিদ্দতে ডরাস না, আসবে সুখের দিন। বলিনি? সত্যি কাঁদছে গুঁজাবুড়ি। শোকে অথবা আনন্দে। চোখ গড়িয়ে তার জলের ধারা।
বুঝি থ মেরে যায় নবিতুন। থ মেরে বসে থাকে শুকনো আর শক্ত চেলা কাঠের মতো গুঁজাবুড়ির দুখানি হাতের বেড়ে।
আহা কত শুনেছি কোরান-কিতাবের কথা। আজকাল তো কোরান-কিতাবের কথা কেউ বলেও না, শোনেও না। সেই-সব কিতাবে বলেছে সবর যে করে কপালে তার সুখ, আখেরাতে তার বেহেশত। সেই কিতাবের কথাটা যে একেবারে চোখের সামনেই ফলে গেল। হাতের বেড় থেকে নবিতুনকে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মোছে আর বলে গুঁজাবুড়ি।
যেন কি বলবে কি করবে ভেবে না পেয়ে সাততাড়াতাড়ি রসপিঠের হাঁড়িটাই টেনে নেয় নবিতুন। কদমের তুলে রাখা পিঠেটার অর্ধেকখানি খেয়েছিল নবিতুন। বাকি অর্ধেকখানি তুলে শরবতির ছেলেটাকে খেতে দেয় ও। তারপর ভাঙা টুকরো আর রসটুকু খোরায় ঢেলে তুলে দেয় গুঁজাবুড়ির হাতে। আজ সুখের দিনে গুঁজাবুড়ির কথাগুলো সত্য বলেই যেন বিশ্বাস হয় নবিতুনের। সুখের দিনে মনে হয় না গুঁজাবুড়ি শয়তান, গুঁজাবুড়ি লুন্দর শেখের কুটটি মাগী। ব্যভিচারের দূতী গুঁজাবুড়ি, সে যেন কবেকার দুঃস্বপ্ন। হাঁড়িটার তলায় পিঠের টুকরাটাকরি এখন বুঝি লেগে আছে। হাত গলিয়ে তলানিটাকে আবারও ছেঁচে ছেঁচে তুলে আনে নবিতুন। ঢেলে দেয় গুঁজাবুড়ির খোরায়।
নবিতুন বলেছিল কচুবাটা ঠোসে জ্বালিয়ে দেবে গুঁজাবুড়ির মুখে। সে মুখে নিজের পান্তাটা তুলে দিয়েছিল নবিতুন। সে মুখে আজ মিষ্টির রস ঢেলে দিল নবিতুন। চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে শরবতি।
পরম তৃপ্তি ভরে মিষ্টি রসটা ঢোঁকে ঢোঁকে গিলে নেয় গুঁজাবুড়ি। তারপর জিভ দিয়ে খোরাটাকে চেটেপুটে খায়। বারবার জিভের লালা লেগে বুঝি কি এক তৃপ্তি আর আনন্দ-ভরা চোখে চেয়ে থাকে নবিতুন।