ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে চিঠি
ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে চিঠি এসেছে। রফিক লিখছে–সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার শরীর খারাপ। মা যেন একবার তাকে দেখতে যায়।
শাহেদাকে সেই চিঠি দেখানো হয়েছে। তিনি কিছু বলেন নি। ঝুমুর বলল, তুমি কি দেখতে যাবে? শাহেদা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছেন। সেই প্রশ্নেরও জবাব দেন নি। ঝুমুর বলল, তুমি যদি যেতে চাও, আপাকে বলতে হবে। দেখা করতে চাইলেই তো দেখা হয় না। ঘুস-টুস খাওয়াতে হয়। আগে থেকে না জানালে আপা ব্যবস্থা করবে কীভাবে? শাহেদা তারপরেও জবাব দিলেন না। ঝুমুর বলল, তুমি কি আপার সঙ্গে কথা বলবে? আপা ঘরেই আছে। আজ সে কোথাও যাবে না।
তুই স্কুলে যা। তোকে এত কথা বলতে হবে না।
আমি আজ স্কুলে যাব না। আপার সঙ্গে সারাদিন গল্প করব।
কর যা ইচ্ছা।
মিতু দরজা ভিজিয়ে শুয়ে আছে। ছোট বোনের সঙ্গে গল্প করার ব্যাপারে তার তেমন আগ্ৰহ দেখা যাচ্ছে না। ঝুমুর কয়েকবার কাছে গেল, বিছানার পাশে বসল। মিতু তাকিয়ে দেখল–কিছু বলল না
আপা মাথা বিলি দিয়ে দেব?
মিতু না-সূচক মাথা নাড়ল।
শুয়ে আছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
শরীর খারাপ লাগছে না। শরীর ভালোই, আরাম করছি। বিকেল পর্যন্ত শুয়ে থাকব।
তারপর?
বিকেলে বেরুব।
ঝুমুর আপার চোখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, রাতে শুটিং আছে?
হুঁ।
সারারাত শুটিং চলবে?
মিতু হাঁ-সূচক মাথা নেড়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে পাশ ফিরল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝুমুর তুই কি আমার একটা কাজ করে দিবি?
অবশ্যই দেব।
একটা চিরুনি কিনে আনবি। সুন্দর একটা চিরুনি।
চিরুনি দিয়ে কী করবে?
চিরুনি দিয়ে মানুষ কী করে।
তোমার তো চিরুনি আছে এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
মবিন ভাইকে দেব। ঐ দিন দেখলাম ওর চিরুনি নেই।
আমিও তাই আন্দাজ করছিলাম।
জানালার পর্দা টেনে দে তো।
ঝুমুর উঠে পড়ল। জানালার পর্দা টেনে দিতে বলার অর্থ–আমি এখন ঘুমুব। আপা তাকে খুব ভদ্রভাবে বলছে, তুই উঠে চলে যা।
আপা তুমি চা খাবে? চা বানিয়ে আনব?
না।
ঝুমুর ইতস্তত করে বলল, তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আপা, জরুরি কথা।
বল।
আমি এই বছর পরীক্ষা দেব না। সামনের বছর দেব।
মিতু কিছু বলছে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আপা আমি একদম পড়াশোনা করতে পারছি না। বই নিয়ে বসি অন্য কথা ভাবি। সামনের বছর আমি খুব মন দিয়ে পড়ব। পরীক্ষায় দেখবে খুব ভালো করব। ঠিক আছে আপা?
মিতু চোখ না মেলেই বলল, আমার হ্যান্ডব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে একটা চিরুনি কিনে না।
এখনি যাব?
এক সময় গেলেই হবে।
পরীক্ষার ব্যাপারে তো তুমি কিছু বললে না।
মিতু চাপা গলায় বলল, পরীক্ষা দেয়া না-দেয়া তোর ব্যাপার। আমার আর বলার কী আছে?
রাগ করছ না তো?
না। তুই এখন ঘর থেকে যা।
ঝুমুর চিরুনি কিনতে বের হয়ে গেল। তখন ঘরে ঢুকলেন শাহেদা। তাঁর হাতে চায়ের কাপ। পিরিচে দু’টা বিসকিট। মিতু বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, চা খাব না। মা। তুমি খেয়ে ফেল। বিসকিটও খাব না।
সকালে নাশতাও খাস নি। খিদে জমাচ্ছি। দুপুরে এক গামলা ভাত খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুব।
শাহেদা মেয়ের পাশে বসে চা খাচ্ছেন। মিতু বলল, বিসকিট খাও মা। তোমার খাওয়া দেখি।
খাওয়া দেখার কী আছে?
অনেক কিছুই আছে। পৃথিবীর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো খাওয়া। সেই খাওয়া দেখাটা তুচ্ছ করার মতো কিছু না।
বাড়িওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে, শুনেছিস?
হুঁ। ঝুমুরের কাছে শুনলাম।
বাড়ি দেখেছিস?
না।
এক তারিখের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে তো।
বললেই তো বাড়ি ছেড়ে দেয়া যায় না।
আমি বলেছি ছেড়ে দেব।
বলেছ, ভালো করেছ। আমি বুঝিয়ে বলব।
আমি এখানে থাকতে চাই না। লোকজন আজেবাজে কথা তোর নামে ছড়াচ্ছে।
যেখানে যাবে সেখানেও তো ছড়াবে।
শাহেদা চুপ করে গেলেন। চায়ে বিসকিট ভিজিয়ে তিনি বিসকিট খাচ্ছেন। মিতু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।
আজ রান্না কী মা?
নলা মাছ নিয়ে এসেছিল। রাতে খাবি। দুপুরে ডাল ভাত।
দুপুরেই রাঁধ মা। আরাম করে খাই। রাতে আমি থাকব না। রাতে শুটিং আছে।
আজ শুক্রবারে। শুক্রবার তো শুটিং থাকে না।
আজ আছে।
ঐ দিন না বললি ছবির কাজ শেষ হয়ে গেছে?
প্যাঁচওয়ার্ক বাকি আছে। কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার করা হবে।
রাতে ফিরবি না?
না।
শাহেদা মুখ শক্ত করে বসে আছেন। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চায়ের কাপে তিনি এখন আর চুমুক দিচ্ছেন না। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। মিতু শঙ্কিত গলায় বলল, কিছু বলছ মা?
শাহেদা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর বাবাকে কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি। মুখটা খুব মলিন। তিনি বললেন–তুমি এত কষ্ট করছ, কেন? কষ্ট করার দরকার কি? এই টিনটা রাখ, এখানে ইঁদুর মারা বিষ আছে। তুমি নিজে খাও–মেয়ে দু’টাকে খাওয়াও, দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এই বলে তিনি একটা টিনের কৌটা আমার হাতে দিলেন।
রাতদিন এইসব ভাব এই জন্যেই স্বপ্নে দেখেছি।
তোর বাবা কথাটা কিন্তু ভুল বলে নি।
মিতু হাসছে। শাহেদা বললেন, হাসছিস কেন?
এমনি হাসছি। তুমি ঝাল ঝাল করে নলা মাছ রাঁধ তো মা। ইঁদুর মারা বিষ আবার মিশিয়ে দিও না। আমার এখন মরার কোনো রকম ইচ্ছা নেই।
শাহেদা নড়লেন না। বসেই রইলেন। মিতু বলল, এক কাজ করলে কেমন হয় মা, আজ আমি রান্না করি, রান্না করে তোমাকে খাওয়াই। তুমি চুপচাপ শুয়ে বিশ্ৰাম কর। আরেকটা কথা শোন, সংসারের সমস্যা নিয়ে তুমি মোটেও ভাববে না। আমি কী করব তোমাকে বলি, ঝুমুরকে বিয়ে দিয়ে দেব। ওর আর পড়াশোনা হবে না। ওর পড়াশোনায় মন নেই। মোটামুটি ধরনের একটা ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। ওর চেহারা ভালো–ছেলে পাওয়া কোনো সমস্যা হবে না। তোমাকে আমি বলি নি। এর মধ্যেই একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলেটা ব্যাংকে চাকরি করে। ছোট চাকরি। তবে সংসারের দায়দায়িত্ব নেই। দু’জন মিলে ওরা সুখেই থাকবে। মবিন ভাই এর মধ্যে একটা চাকরি পেয়ে যাবে। তখন আমি বিয়ে করব। তুমি থাকবে আমার সংসারে। মাঝে মাঝে ঝুমুরকে গিয়ে দেখে আসবে। এখন তুমি আসি তো আমার সঙ্গে, রান্নার সময় যদি ভুল-টুল করি তুমি ধরিয়ে দেবে। আরেকটা কথা মা–এর পরে যদি কোনোদিন স্বপ্নে বাবাকে দেখ তোমার কাছে ইঁদুর মারা বিষ গছিয়ে দিতে চাচ্ছে তাহলে তুমি তাঁকে কিন্তু কঠিন ধমক দেবে।
মিতু বিছানা থেকে নামল। তার মাকে হাত ধরে তুলল। মিতুর মুখ হাসি হাসি।
শাহেদা বললেন, ঝুমুরকে বিয়ে করতে চাচ্ছে যে তার নাম কি?
আমানুল্লাহ্। অগ্ৰণী ব্যাংকে কাজ করে।
কী রকম কাজ? দারোয়ান টারোয়ান না তো?
না দারোয়ান না, ক্লার্ক।
তোকে সরাসরি বলেছে?
আমাকে বলে নি, মবিন ভাইকে বলেছে।
ওকে কেন বলবে? ও কে? তার কিছু বলার থাকলে সরাসরি তোকে কিংবা আমাকে বলবে। ছেলেটার দেশ কোথায়?
আমি মা কিছুই জানি না। আমি খোঁজ নিয়ে বলব।
কবে খোঁজ নিবি?
আজই খোঁজ নেব। এফডিসিতে যাবার আগে মবিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তারপর যাব।
মবিন শুয়ে ছিল। মিতুকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল, আরো তুমি।
মিতু বলল, অবেলায় শুয়ে আছ কেন?
বেকার মানুষের আবার বেলা, অবেলা, কালবেলা? তুমি এই সময় যে?
এটা কি নিষিদ্ধ সময়?
না নিষিদ্ধ হবে কেন? এস ভেতরে এস? আমার চিরুনি এনেছ?
হুঁ।
সিগারেট?
না। সিগারেট আনা হয় নি।
কতক্ষণ থাকবে?
রাত আটটা পর্যন্ত থাকতে পারি। কিন্তু তোমার তো সময় হবে না।
সময় হবে না তোমাকে কে বলল?
সন্ধ্যাবেলায় তোমার টিউশানি আছে না?
ছিল–এখন নেই। সন্ধ্যাটায় আমি এখন স্বাধীন। গতকাল সন্ধ্যায় কী করেছি। জান, একটা সিনেমা দেখে ফেললাম, ‘জানি দুশমন’। আশায় আশায় গিয়েছিলাম, হয়তো তোমাকে দেখব। জানি দুশমন ছবিতে তুমি কাজ কর নি। তাই না?
না!
টেপী কি করেছে? সুন্দর মতো একটা এক্সট্রা মেয়ে দেখলাম। নায়িকার সঙ্গে নদীতে পানি আনতে গেল।
টেপী ঐ ছবিতে কাজ করেছে কিনা বলতে পারছি না।
দেখা হলে জিজ্ঞেস কোরো তো। ওর সঙ্গে এখন দেখা হয় না?
কম হয়।
ছবির ঐ মেয়েটাকে দেখে মনে হলো, এ নিশ্চয়ই টেপী। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল, জোড়া ভুরু।
জোড়া ভুরু! তাহলে টেপী না। টেপীর জোড়া ভুরু না।
মবিন আগ্রহের সঙ্গে বলল, টেপীর কথা আমার প্রায়ই মনে হয়। ওকে আমার দেখার খুব ইচ্ছা। একদিন তোমার সঙ্গে এফডিসিতে যাব। মেয়েটাকে দেখে আসব।
আচ্ছা।
ও আছে কেমন?
ভালোই আছে। দারুণ এক বড়োলোকের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। সেদিন এফডিসি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে গেল।
বল কী! সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
টেপী নিশ্চয়ই খুব খুশি।
না খুশি না। ও দেখলাম খুব ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠল। মুখটা কান্নাকান্না।
কেন বল তো?
বড়লোকেরা গাড়ি পাঠিয়ে তো আর গল্প করার জন্যে নিয়ে যায় না, প্রেম করার জন্যেও নিয়ে যায় না–অন্য কারণে নিয়ে যায়। সবাই সেটা জানে। কাজেই সবার চোখের উপর দিয়ে বিরাট এক গাড়িতে করে যাওয়া খুব লজ্জার ব্যাপার না?
অস্বস্তির ব্যাপার তো বটেই। দারুণ বড়লোকদের জন্যে দারুণ বড়লোক মেয়ে পাওয়া সমস্যা না–তারা পথেঘাটের মেয়েদের গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবে কেন?
মিতু হাই তুলতে তুলতে বলল, পথের মেয়েদের সঙ্গে যত সহজ হওয়া যায় অন্যদের সঙ্গে তো তত সহজ হওয়া যায় না। পথের মেয়ের আলাদা আনন্দ আলাদা থ্রিল। যাই হোক টেপীকে নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কিছু নিয়ে কথা বল।
কী কথা শুনতে চাও?
যা ইচ্ছা বল। তার আগে কাছে আস তো আমি তোমার চুল আঁচড়ে দিই। নাকি আমি চুল আঁচড়ে দিলে লজ্জা লাগবে?
না লজ্জা লাগবে না।
মবিন এগিয়ে এল। খুব কাছে এল না। মাথা এগিয়ে দিল। যেন গায়ের সঙ্গে গা লেগে গেলে মস্ত বড়ো অন্যায় হয়ে যাবে। মিতু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তুমি কি ঝুমুরের জন্যে একটা ছেলে যোগাড় করে দেবে? আমি ওর বিয়ে দিয়ে দেব।
বাচ্চা মেয়ে বিয়ে দেবে কেন?
ওরা এখনই বিয়ে হওয়া ভালো। বিয়ে হলে মা মানসিক শান্তি পাবেন। মা ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন। মা’কে আমি অবশ্যি বলেছি আমানুল্লাহ নামের এক ছেলে ঝুমুরকে বিয়ে করতে চায়। এতেই মা খুশি।
আমানুল্লাহ কে?
মিতু হাসতে হাসতে বলল, আমানুল্লাহ কেউ না। আমার বানানো এক নাম। মা’কে খুশি করার জন্যে গল্পটা তৈরি করা।
তিনি খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ খুশি হয়েছেন। অভিনয় তো আমি ভালো পারি–যাই বলি এত সুন্দর করে বলি, সবাই বিশ্বাস করে।
আমার বেলাতেও তাই করা?
না।
কখনো না?
মাঝে মাঝে করি। যখন করি তখন খুব খারাপ লাগে।
মবিন হাসছে। মিতুও হাসছে। মিতু বলল, চুল আঁচড়ানোটা ভালো হয় নি। এস আবার আঁচড়ে দিই। এরকম শক্ত হয়ে থাকবে না–আমার শরীরে কুষ্ঠ হয় নি যে ছোঁয়া লাগলে তোমার ক্ষতি হবে।
মবিন হড়বড়িয়ে বলল, কী যে তুমি বল!
ঠিকই বলি–তুমি আমার সঙ্গে সব সময় এমন ভাব করা যেন আমি তোমার ছাত্রী। তুমি আমাকে পড়াচ্ছ এবং আমার মা একটু দূরে বসে পড়ানো কেমন হচ্ছে লক্ষ করছেন।
মবিন হাসল।
মিতু কঠিন গলায় বলল, আমি সামান্য এক্সট্রা মেয়ে হতে পারি। কিন্তু আমার হাত দু’টা সুন্দর। সুন্দর না? দেখা কী সুন্দর লম্বা লম্বা আঙুল!
সে তো সব সময়ই দেখছি।
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখ। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলে তোমার মান যাবে?
মবিন বিস্মিত হয়ে বলল, আজ তোমার কী হয়েছে বল তো?
কিছু হয় নি। হবার মধ্যে যা হয়েছে তা হলো তোমার দেয়া শাড়িটা পরেছি। বেগুনি রং আমার অসহ্য কিন্তু শাড়িটা পরার পর নিজেকে এত সুন্দর লাগছে কেন কে জানে। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠেছি। তোমার কাছে কি আমাকে সুন্দর লাগছে না?
লাগছে।
সত্যি লাগছে, না আমাকে খুশি করার জন্যে বলছ?
সত্যি লাগছে।
তাহলে তোমার আজ ভয়ঙ্কর বিপদ।
তার মানে?
আমি আজ কোথাও যাব না। সারারাত গল্প করব। যদি ঘুম পায় তোমার এই খাটে তোমার পাশে শুয়ে থাকব। তোমার কি একটাই বালিশ?
মবিন তাকিয়ে আছে। তার চোখে পলক পড়ছে না। মিতু বলল, এভাবে তাকিয়ে থাকবে না। আমি মন ঠিক করে এসেছি।
তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
মিতু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই বোধহয়। ক’টা বাজে দেখ তো?
সাতটা।
তুমি ওঠ, স্যান্ডেল পরে নাও। আমাকে বাসে তুলে দেবে। রাতে আমার শুটিং আছে। এতক্ষণ ঠাট্টা করছিলাম। আমি কী সুন্দর অভিনয় পারি দেখলে তো? আমার কথা বিশ্বাস করে ভয়ে ঘেমে-টেমে একেবারে অস্থির। এত ভয় পাচ্ছিলে কেন?
না মানে, লোক জানাজানি হলে তোমার অসম্মান। আজ রাতে তোমার শুটিং?
হুঁ। কিছু প্যাঁচওয়ার্ক দরকার পড়ে গেল। নরমাল টাইমে শিডিউল পাচ্ছিল না। আজই শেষ।
শেষ হলেই ভালো। সারারাত জেগে কাজ করা কী বিশ্ৰী ব্যাপার!
সবাই সুশ্ৰী ব্যাপার করবে তা তো হয় না। কাউকে কাউকে বিশ্ৰী ব্যাপারও করতে হয়। আমরা কিন্তু রিকশা নেব না। হেঁটে হেঁটে বাসস্টেশন পর্যন্ত যাব। আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছে।
অনেকখানি রাস্তা তো।
অনেকখানি রাস্তাই তোমার সঙ্গে হেঁটে পার হব। তুমি আমার হাত ধরে থাকবে। অন্ধকার রাস্তা–কেউ দেখবে না।
মনিব বলল, চল তোমাকে এফডিসি পর্যন্ত দিয়ে আসি।
কোনো দরকার নেই। আমি একাই যাব।
আমি সঙ্গে গেলে অসুবিধা আছে?
আছে। এক্সট্রাদের সঙ্গে যে সব পুরুষ মানুষ থাকে তাদের দালাল দালাল মনে হয়। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে সবাই আড়চোখে তোমাকে দেখলে, আমার অসহ্য লাগবে। আমাদের বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে যাব। পরিচিত সবাইকে ক্যান্টিনে চা-টা খাইয়ে দেব। তুমি কী বল?
সেটা মন্দ না।
তারা বাসস্টেশনে চলে এসেছে। ঢাকা যাবার বাস আসছে দেখা যাচ্ছে। মিতু বিষন্ন ভঙ্গিতে বলল, এতটা রাস্তা আমরা পাশাপাশি হেঁটে এলাম, তুমি কিন্তু একবারও আমার হাত ধর নি।
ও সরি। দেখি তোমার হাত।
থাক দেখতে হবে না। বাস চলে এসেছে।
দিলদার খাঁ দরজা খুলেই বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, এতক্ষণে। ক’টা বাজে জান?
রেশমা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, বাস পথে জ্যামের মধ্য পড়েছে। অ্যাকসিডেন্টের জন্যে এয়ারপোর্ট পুরা দুঘণ্টা বন্ধ। কী করব বলুন।
রাত বাজে এগারটা, পার্টি এতক্ষণ তোমার জন্যে বসে থাকবে? আমার নিজেরও একটা বদনাম হয়ে গেল। কথা রাখতে পারলাম না।
সরি দিলদার ভাই।
এখন সরি বলে লাভ কী? রাত ন’টা পৰ্যন্ত পার্টিকে ধরে রেখেছি। তারপর বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবস্থা করেছি। হুট করে তো কাউকে পাওয়া যায় না। পার্টির পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে।
রেশমা বলল, আমি এখন কী করব?
কী আর করবে? বাসায় চলে যাবে।
এত রাতে বাসায় যাব না। ভোরবেলা যাব। রাতটা আপনার বাসায় থেকে যাই।
দিলদার বিরক্ত গলায় বলল, আরো সর্বনাশ! বাসায় থাকতেই পারবে না। তোমার ভাবি এইসব ব্যাপারে অসম্ভব স্ট্রিক্ট।
বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকব।
অসম্ভব। বসার ঘরের সোফা কেন, বারান্দায় শুয়ে থাকলেও সে ঝাঁটাপেটা করবে।
রেশমা বলল, ঠিক আছে থাকব না। ঘরে ঢুকতে দিন। ভয়ঙ্কর তৃষ্ণা হয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব–তারপর ভেবে ঠিক করব কী করা যায়।
দিলদার খাঁ নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।
পুরনো অসুখটা কি আবার তাঁকে ধরেছে? সেই ভয়াবহ অসুখ? যে অসুখ গভীর গোপনে লুকিয়ে থাকে, হঠাৎ বের হয়। যখন বের হয় তখন সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনা আচ্ছান্ন করে দেয়।
মোবারক সাহেবের চিন্তা-চেতনা গুলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বসে আছেন তার এল সি থ্রি পারসোনাল কম্পিউটারের সামনে। পর্দায় দাবার বোর্ড। এবারের চাল তার দেয়ার কথা। পর্দায় ফ্ল্যাসিং সাইন উঠছে। সুন্দর চাল তাঁর আছে। মন্ত্রীর সামনের বড়ে এক ঘর এগিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষের নাইটকে বেকায়দায় ফেলা। তিনি চাল দিচ্ছেন না। মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর ভেতর থেকে একজন কেউ বলছে, অর্থহীন, এই চাল দেয়া অর্থহীন। কে বলছে? তাঁর পুরনো অসুখটা বলছে?
হ্যাঁ সেই পশুটাই বলছে। কিন্তু পশুটাকে এখন আর পশু বলে মনে হচ্ছে না। পশুর গলার স্বর মধুর। প্রথম যৌবনের কিশোরী প্রেমিকার কণ্ঠস্বরের মতো। তাঁর প্রথম যৌবনে কোনো কিশোরী প্ৰেমিকা ছিল না। থাকলে অবশ্যই সে এরকম কণ্ঠে কথা বলত।
কণ্ঠস্বর বলল, দাবার চাল দিয়ে কী হবে?
তিনি যুক্তি দিতে চেষ্টা করলেন। ক্ষীণস্বরে বললেন, আনন্দ। খেলার আনন্দ। জয়পরাজয়ের আনন্দ।
জয়-পরাজয়ের আনন্দ সবার জন্যে নয়। এই খেলায় জয় করেও তুমি আনন্দ পাবে না। পরাজিত হয়েও তুমি আনন্দ পাবে না। একটু শুধু ক্লান্ত হবে। তুমি ক্লান্ত হবার জন্যে খেলছ?
না।
তাহলে শুধু শুধু খেলছ কেন?
খেলছি না তো আমি বসে আছি।
এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে?
জানি না।
অনন্তকাল বসে থাকবে?
অনন্তকাল বসে থাকব। কেন? আমি এখন উঠব। হাত-মুখ ধোব, কফি খাব, তারপর ঘুমুতে যাব।
কারো কারো জন্যে সময় থেমে যায়। তোমার জন্যে সময় থেমে গেছে। তুমি যাই কর তোমার কাছে মনে হবে তুমি অনন্তকাল ধরে করছি। সত্যি না?
হ্যাঁ সত্যি।
তুমি যখন তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বল— তোমার কাছে মনে হবে তুমি অনন্তকাল ধরে কথা বলছি। তুমি যখন হাতে কফির পেয়ালা নেবে তখন মনে হবে অনন্তকাল ধরেই কফির পেয়ালা হাতে তুমি বসে আছ।
আমি কি অভিশপ্ত?
সব মানুষই অভিশপ্ত। ওরা তা জানে না বলে ওরা হেসে খেলে জীবন ধারণ করছে। তুমি জেনে গেছ। তোমার মতো আরো অনেকেই জেনেছে। জাপানের নোবেল পুরস্কার পাওয়া সেই ঔপন্যাসিকের নাম যেন কি?
কাওয়াবাতা।
হ্যাঁ কাওয়াবাতা। তিনি যখন সব পেয়ে গেছেন তখন তিনি আত্মহত্যা করেন। এরকম উদাহরণ আরো আছে। আছে না?
আছে? কবি মায়াকোভস্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে… পুশকিনকেই বা বাদ দেবে কীভাবে?
পুশকিন ডুয়েলে মারা গেছেন।
একই কথা। ব্যাপার একই। জীবন তাদের কাছে অসহ্য বোধ হয়েছিল। তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। তুমিও বুঝে গেছ…
আমার বিশাল কর্মকাণ্ড, ব্যবসা…
তাদের কর্মকাণ্ড কি তোমার চেয়ে কম ছিল?
মৃত্যু আমাকে কী দেবে?
কিছুই দেবে না। এটা কি অনেক বড় উপহার না?
সে রকমই মনে হচ্ছে।
একটা বইয়ের শেষ পাতায় কী লেখা থাকে–দি এন্ড। সমাপ্তি। মৃত্যু তোমাকে শেষ পাতায় এনে দেবে। এটা কি আনন্দময় একটা ব্যাপার না?
হ্যাঁ। আমাকে তুমি এখন কী করতে বল?
তুমি তোমার কম্পিউটারে লেখ–The End. সুন্দর করে লেখ। কম্পিউটারের পর্দায় তিনি লিখলেন
The End.
এত ছোট করে লিখেছ কেন? বড় টাইপে লেখা। সব ক্যাপিটেল লেটারে।
তিনি লিখলেন–
THE END.
আর তখন বিশ্ৰী শব্দে ইন্টারকম বাজতে লাগল। তিনি ইন্টারকমের রিসিভার কানে নিলেন। ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম।
তিনি যন্ত্রের মতো বললেন, কী ব্যাপার ইদরিস?
একটা মেয়ে এসেছে স্যার। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।
কে এসেছে?
এই বাড়িতে সে আগে একবার এসেছিল।
টেপী?
নাম বলল রেশমা।
ও আচ্ছা।
ওকে কী বলব স্যার?
মোবারক সাহেব চুপ করে রইলেন। তার ভেতরে সেই পশু কিছু বলে কিনা শুনতে চেষ্টা করলেন। কেউ কিছু বলছে না। তিনি আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ইদরিস রেশমাকে উপরে নিয়ে এস।
জুি আচ্ছা স্যার।
রেশমা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ভয়ে ভয়ে উঠছে। সিঁড়ির মাথায় মোবারক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। মোবারক সাহেবের মুখ হাসি হাসি।
তিনি দূর থেকে বললেন, কী ব্যাপার বল তো?
রেশমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে একটু যেন বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে। সে বলল, আমি আমার চুলের ফিতাটা ফেলে গিয়েছিলাম। নিতে এসেছি।
মোবারক সাহেবের মনে হলো, বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। সুন্দর জবাব দিয়েছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে মনের ভেতেরের পশুটাকে অনেকক্ষণের জন্যে আটকে রাখা যাবে।
তুমি কি ফিতা নিয়েই চলে যাবে?
আপনি থাকতে বললে থাকব।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, এস! এস! মোবারক সাহেব হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। রেশম ইতস্তত করছে। মোবারক সাহেব বললেন, ধর আমার হাত ধর।
রেশমা হাত ধরল। মোবারক সাহেব বললেন–তুমি হঠাৎ করে আসায় আমি যে কী ভয়ঙ্কর খুশি হয়েছি তুমি কোনোদিনও তা জানবে না। তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাইবে তাই পাবে। এটাকে মাহেন্দ্ৰক্ষণ হিসেবে ধরে নাও। বল কী চাও?
রেশমা বলল, আমি কি অন্য কারো জন্যে কিছু চাইতে পারি?
হ্যাঁ পার।
আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ আছে। চা বাগানের একটা চাকরির তার খুব শখ। ভালো একটা চাকরি।
মোবারক সাহেব বললেন, আমার সঙ্গে আসি। আমি কম্পিউটারে তার নাম-ঠিকানা তুলে নিচ্ছি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা করব।
মোবারক সাহেব তাঁর কম্পিউটার থেকে The End লেখা মুছে ফেললেন। জরুরি লেখা ফোন্ডার ওপেন করে বললেন–
বল রেশমী, নাম বল।
রেশমা নাম বলল।
তুমি কি খেয়ে এসেছ?
জ্বি না।
আশ্চর্য! আমিও খাই নি। ইদরিসকে বলি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। তুমি কী খেতে পছন্দ কর?
আমি সবকিছুই পছন্দ করি। আপনি কী পছন্দ করেন?
জানি না। আসলেই জানি না। মজার ব্যাপার কী জান মিতু অনেকদিন পর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কী পছন্দ করি।—ঐ ভদ্রলোকের ঠিকানা কী বল? মেইলিং অ্যাড্রেস।