১১.
টাকার ব্যাপারে আমার কাউকে তেমন বিশ্বাস হয় না। না ব্যাঙ্ক, না পোস্ট অফিস। আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হল মাসি।
মধু গুপ্ত লেন-এর বাড়ির সামনে দুটো রকে আজ বড় তরফ বা ছোট তরফের কেউ ছিল না। কিন্তু ছোট তরফের রকে গুটি চারেক ছোকরা ছেলে বসে আছে।
বড় তরফের সদরে ঢুকবার মুখে ছেলেগুলোর একজন আমাকে ডাকল, এই যে মোসাই, শুনুন।
নানা চিন্তায় মাথাটা অন্য রকম। ডাকটাও কেমন যেন। শরীরটা কেঁপে গেল।
দু পা এগিয়ে বললাম, কী?
যে ছেলেটা ডেকেছিল তার মুখখানার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি, এ ছোকরা বিস্তর পাপ করেছে। মুখে কাটাকুটির অনেক দাগ, শক্ত ধরনের চেহারা, চোখ দুটোয় একটা অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দৃষ্টি। তার বাঁ হাতটার বুড়ো আঙুল বাদে আর চারটে আঙুল নিশ্চিহ্ন। আঙুলহীন হাতের চেটোটা খুন্তির ডগার মতো দেখাচ্ছে। সেই আঙুলহারা হাতের চেটোয় খুব কর্তৃত্বের একটু হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল।
কাছে যেতেই বলল, কোথায় যাচ্ছিলেন?
গিরিবাবুর বাড়িতে।
গিরিবাবু কে হয় আপনার?
আত্মীয়।
কীরকম আত্মীয়?
ভড়কে গিয়েছিলাম। আত্মীয়তাটা মনে করতে একটু সময় লাগল। তারপর বললাম, সম্পর্কে মামা।
অন্য একটা ছেলে ওপাশ থেকে বলল, ছেড়ে দে সমীর। আসে মাঝে মাঝে। রিলেটিভিটি আছে। যান দাদা, ঢুকে পড়ুন।
কিছু বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই হঠাৎ কপাটের আড়াল থেকে গামছা-পরা খালি গায়ে গিরিবাবু বেরিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে ভিতরবাগে টেনে নিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললেন, কী বলল ওরা বলো তো?
আমি কে জিজ্ঞেস করছিল। অবাক হয়ে বলি, কী হয়েছে মামা?
আর বলো কেন উপল ভাগনে, আমাদের বড় বিপদ চলছে। বাড়ির বাইরে বেরোনোই এখন মুশকিল। কেউ এলে তারও বিপদ।
এই বলে গিরিবাবু আবার কলঘরে ঢুকে যান।
বাড়িটা থমথম করছে। বড়গিন্নি সিঁড়ির মাঝ বরাবর পর্যন্ত নেমে এসেছিলেন, আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, কে? কে? ও উপল বুঝি?
দেখি, বড়গিন্নি বেশ রোগা হয়ে গেছেন। মুখ থমথমে। মাঝসিঁড়ি থেকেই আবার কী ভেবে উপরে উঠে গেলেন।
মাসি আমাকে দেখে একটা চোখে বড় করে চাইল। মুখখানায় নরম কয়েকটা ঢেউ খেলে গেল যেন।
আয়।
এমনভাবে বলল যেন এতক্ষণ আমার জন্যই বসে ছিল মাসি। যেন আমার জন্যই সব সময়ে বসে থাকে।
জলচৌকিতে বসে বললাম, কী ব্যাপার গো মাসি?
মাসি শ্বাস ছেড়ে বলল, মানুষ কি আর মানুষ আছে! সেই গুন্ডা ছেলেটা জ্বালিয়ে খাচ্ছে বাবা। ভাবগতিক যা দেখছি, শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচবার জন্য কর্তা-গিন্নি মিলে কেতকীকে না ওই গুন্ডাটার হাতেই তুলে দেয়। ওরা তো রকেই বসে থাকে, তোকে ধরেনি?
ধরেছিল।
সবাইকে ধরছে। পাছে মেয়ে পাচার করে দেওয়া হয় সেইজন্য পাহারা দিচ্ছে। ছোট তরফ ওদের পক্ষে। দুই তরফে দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে।
কেতকী কোথায়?
তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না। একদম ঘরবন্দি। দিনরাত কান্নাকাটি। মাসি এই বলে একটু শ্বাস ছাড়ে। তারপর একটা চোখে আমার দিকে অভিমানের দৃষ্টি দিয়ে বলে, তুই যদি একটু মানুষের মতো হতিস।
হেসে বলি, দুনিয়ায় মানুষের অভাব কী! আমার জন্য তুমি আর অত ভেবো না মাসি।
তোর কথা ছাড়া আর যে কোনও ভাবনা আসে না মাথায়। মাসি মুখ করুণ করে বলল, তোর কথা ভাবতে ভাবতেই সারা দুনিয়ার কথা ভাবি। মনে হয়, পৃথিবীটা যদি আর-একটু ভাল জায়গা হত, অভাব-টভাব যদি না থাকত, মানুষ যদি আর-একটু দয়ালু হত, তবে আমার উপলটার এত দুর্দশা হত না। তোর যে খিদে পায় সে যদি সবাই বুঝত!
অবাক হয়ে বলি, উরে বাবা, কত ভাবো তুমি।
কত ভাবি। এই যে কাক, কুকুর, বেড়ালদের ভূত-ভোজন করাই তাও তোর কথা ভেবে। ভাবি কী, ওরা যদি আশীর্বাদ করে তবে আমার উপলের একটা গতি হবে হয়তো।
খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকি।
মাসি বলে, বড় ভাল ছিল মেয়েটা। তোর সঙ্গে মানাতও খুব।
গুন্ডাটা কি ওকে বিয়ে করতে চায় মাসি?
তাই তো শুনি, আমার মনে হয়, ছোট তরফের টাকা খেয়ে এ সব করছে।
বাজে কথায় সময় নষ্ট। আমি টাকাটা বের করে হাতের চেটোর আড়ালে মাসির কোলে ফেলে দিয়ে বললাম, সাবধানে রেখো।
মাসির একটা চোখই পটাং করে এত বড় হয়ে গেল। বলল, ও মা! তোর কি তা হলে কিছু হল? ও উপল, কোথায় পেলি?
বিরক্ত হয়ে বলি, অত জেরা করো কেন বলো তো?
মাসি গলা নামিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, ভাল টাকা তো! চুরি ছ্যাঁচড়ামি করিসনি তো বাপঠাকুর!
এই কি আমার ওপর তোমার বিশ্বাস?
মাসি আঁচলের আড়ালে টাকা লুকিয়ে নিয়ে রেখে এল। এসে ফিসফিস করে বলল, কেতকী তোকে ডাকছে।
কেন?
যা না। সিঁড়ির নীচেকার ঘরে আছে। একটু বসে যা, বড় কর্তা কলঘর থেকে বেরিয়ে কাপড় মেলছে, ও ওপরে যাক।
একটু বাদে সিঁড়িতে কম্প তুলে গিরিবাবু ওপরে উঠে গেলেন। মাসি ভাত বাড়তে বসল। আমি সুট করে বেরিয়ে সিঁড়ির আড়ালে সরে যাই।
এ ঘরটায় মাসি থাকে। পরদা সরাতেই কেতকীকে দেখলাম। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শোওয়া, চুলগুলি ঝেঁপে আছে ওর মুখ আর মাথা। ডাকতে হল না, কী করে যেন টের পেয়ে ও উঠে বসল। তখন দেখি, ওর চেহারাটা খুব ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেছে। মোটা গরাদ দেওয়া ছোট জানালা দিয়ে একটুখানি আলোর যে আভা আসছে ঘরে তাতে দেখা যায়, কেতকী অনেক কাল হয়ে গেছে বুঝি। সমস্ত মুখ ফুলে আছে অবিরল কান্নার ফলে।
কোনও ভূমিকা না করেই কেতকী ভাঙা স্বরে বলল, আমি যাব।
অবাক হয়ে বলি, কোথায়?
যেখানেই হোক। এ বাড়ির বাইরে।
আমি কৃশকায় মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকি। কত বাধা ওকে ঘিরেছে আজ! বললাম, তোমার যাওয়ার কোনও জায়গা ঠিক করা আছে?
ও মাথা নেড়ে বলল, না।
তা হলে?– আমি দ্বিধায় পড়ে বলি।
কেতকীর চোখে ফের জল এল। তীব্র সেই চোখে চেয়ে বলল, আজ মা কী বলেছে জানেন? বলেছে, তোকে নিয়ে যখন এত অশান্তি তখন তুই ওই গুণ্ডাটাকেই বিয়ে কর। অথচ মা ক’দিন আগেই মিথ্যে সন্দেহ করে আমাকে মেরেছিল। আমি এ বাড়িতে থাকব না। আমাকে কোথাও নিয়ে যাবেন?
বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খাই। আশা জাগে, লোভ জাগে, ইচ্ছের নানা রঙের বর্ণালী খেলা করে। কিন্তু আমি কোথায় নিয়ে যাব ওকে? আমার তো কোনও জায়গা নেই।
আমি মাথা নিচু করে বলি, সেটা কি হয়?
কেন হয় না উপলদা? আমার লজ্জা করার সময় নেই, নইলে এত সহজে কথাটা বলতে পারতাম না। শুনুন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
এত চমকে গিয়েছিলাম যে, মাথাটা চক্কর মারল। খাটের স্ট্যান্ড ধরে সামলে নিলাম। একটু সময় নিয়ে বললাম, কেন আমাকে বিয়ে করবে কেতকী?
এ প্রশ্নটা সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে জটিল।
কেতকী বলল, করব। ইচ্ছে। আপনি রাজি নন?
আমি মৃদুস্বরে বলি, শুনে লজ্জা পাই কেতকী। আমি বড় সামান্য মানুষ।
কেতকীর মুখ উদাস হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে রইল শূন্যের দিকে চেয়ে। তারপর আস্তে বলল, পিসি বলেছিল, আপনি রাজি হবেন।
বিপদের মধ্যে পড়ে তুমি উলটোপালটা ভাবছ। বিপদ কেটে গেলে দেখবে, এ এক মস্ত ভুল।
কেতকী মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, এরকম কথা জীবনে এই প্রথম বললাম উপলদা। বেহায়ার মতো। আর কাউকে বলিনি কখনও।
বলে উপুড় হয়ে পড়ল বালিশে। কাঁদতে লাগল।
আমি কখনও ব্যায়াম-ট্যায়াম করিনি। গায়ে জোর নেই। তেমন কিছু সাহসও আমি রাখি না। কোনওক্রমে বেঁচে আছি পৃথিবীতে, এই ঢের। কেতকীর জন্য আমি কী করতে পারি?
ঘর থেকে বেরোবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই বিবেকের সঙ্গে দেখা। সেই কালো জোব্বা পরা কেশো বুড়ো, হাতে বাদ্যযন্ত্র। কাশতে কাশতে বলল, কাজটা কি ঠিক হল উপলচন্দের?
তার আমি কী জানি বিবেকবাবা? দুনিয়ার মানুষ অধিকাংশ কাজই করে ভাল-মন্দ না ভেবে। তারা তো সবটা দেখতে পায় না।
তবু ভেবে দেখো আর একবার।
বলো কী বিবেকবাবা, শেষে গুন্ডার হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে প্রাণটা যাবে। যদি প্রাণ বাঁচাতে পারিও তা হলেও বা বউ নিয়ে খাওয়াব কী? আবার মেয়ে ভাগানোর জন্য ঝামেলাও কি কম হবে?
এই সময়টায় আমার বিবেকের একটা জোর কাশির দমক এল। সেই সুযোগে আমি পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসি।
সদরের বাইরে পা দিতেই দেখি, ছোট তরফের রকে ছেলে-ছোকরাগুলো কেউ নেই। ছোট কর্তা রাঙা নতুন গামছা পরে দাঁড়িয়ে। ভারী হাসি-হাসি আহ্লাদি মুখ। আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে বললেন, আরে উপল ভায়া যে! তোমার তো দেখাই একদম পাই না। ভোল পালটে গেছে, অ্যাঁ! ভাল জামাকাপড়, চেহারাও দিব্যি ফনফন করছে! পেশকারি পেয়োচ নাকি, অ্যাঁ!
খুব হাসলেন। সম্পর্কে মামা হন, তবু বরাবরই ছোট তরফ ভায়া বলে ডাকেন আদর করে।
বললাম, ছোট মামা, ভাল আছেন তো!
বেশ আছি, বেশ আছি!
বলে এই গরমকালে নাইকুণ্ডলীতে আঙুল দিয়ে তেল ঠাসতে ঠাসতে অন্য হাতে আমাকে কাছে ডেকে গলা নামিয়ে বললেন, ও বাড়ির কী সব গণ্ডগোল শুনছি হ্যাঁ! ব্যাপারখানা কী জানো কিছু?
একটু গাড়ল সেজে বললাম, আমিও শুনছি। কে একটা মাস্তান ছেলে নাকি কেতকীকে বিয়ে করতে চাইছে।
ছোট কর্তা খুব গম্ভীর মুখে শুনে মাথা নেড়ে বললেন, আমিও পাড়ায় কানাঘুষো শুনছি। কী কেলেঙ্কারি বলো তো! তা দাদা বলছে-টলছে কী?
খুব ঘাবড়ে গেছেন।
ছোট কর্তা আহ্লাদের ভাবটা চেপে রাখতে পারলেন না। প্রায় হেসেই ফেললেন বলা যায়। মুখটা নামিয়ে বললেন, কেতকীর ভাবগতিক কিছু বুঝলে?
না।
ছোটবাবু একটা দুঃখের শ্বাস ফেলে বললেন, এ সব ব্যাপার কি আর ঠেকানো যায়! আজকালকার ছোঁড়াছুঁড়িদের কারবার সব। আমি বলি কি উদ্যোগ-আয়োজন করে বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়! আজকাল আর বংশ-টংশ জাত-ফাত কে-ই বা মানছে। আমেরিকা ইউরোপে তো শুনি হরির লুট পড়ে গেছে। নিগ্রোয়, চিনেম্যানে, সাহেবে, হিন্দুতে একেবারে বিয়ের খিচুড়ি। এ দেশেও হাওয়া এসে গেছে। দাদাকে বুঝিয়ে বোলো, বংশ-টংশর মর্যাদা আঁকড়ে থাকলে আর চলবে না। ছেলেটাকে আমি মোটামুটি চিনি। খারাপ তেমন কিছুই নয়, একটু হাত-ফাত চালায় আর কী!
আমি বললাম, বলব।
ছোটবাবু একটু হেসে বললেন, তোমার তা হলে ভালই চলছে বলো! পোশাক-আশাক চেহারা দেখে এক ঝটকায় চিনতেই পারিনি। মানুষের উন্নতি দেখলে বড় আনন্দ হয়। করছ-টরছ কী আজকাল?
ওই টুকটাক।
খুব ভাল, খুব ভাল। দেখছ তো চারদিকে কেমন বেকারের বন্যা এসেছে! এই রকটাই এখন নিজের দখলে থাকে না, পাড়ার ছেলেছোকরা সব এসে বসে। তাড়াতেও পারি না। তাড়ালে যাবে কোথায়! তা এই বেকারের যুগে তোমার কিছু হয়েছে দেখে বড় খুশি হলুম ভায়া।
দু-চারটে কথা বলে কেটে আসি। বুঝতে পারি, ছোট তরফ লোক ভাল নয়, বড় তরফকে বেইজ্জত করতে কোমর বেঁধে নেমেছে। এ পাড়ায় ছোট তরফেরই হাঁকডাক বেশি, তাঁর নিজের একটা ক্লাবও আছে।
কিন্তু ছোট তরফের দোষ দিয়ে কী হবে! আমিও কি লোক ভাল? তার চেয়ে দুনিয়ার ভাল-মন্দের ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়াই কাজের কাজ। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হাঁটছি। বুকের মধ্যে একটা বড় কষ্ট ঘনিয়ে উঠছে। কেতকীর কথাগুলো ট্রেসার বুলেটের মতো ছুটে আসছে বার বার। ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আজ আমার বড় আনন্দের দিন হতে পারত। হল না। হয় না।
গলির তেমাথায় আঙুলহারা সমীরের সেই স্যাঙাত দাঁড়িয়ে ছিল। রোগা শুটকো চেহারা, লম্বা চুলে তেলহীন রুক্ষতা, মস্ত মোচ চিনেদের মতো ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে ঝুলে পড়েছে। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, একটা কথা বলব?
ছেলেটা কানকি মেরে চেয়ে বলল, বলুন।
বললাম, বিয়ে-টিয়ের অনেক ঝামেলা। মেয়েটাও রাজি হচ্ছে না। তার চেয়ে ব্যাপারটা অন্যভাবে মিটিয়ে ফেললে হয় না?
ছেলেটা অন্য দিকে চেয়ে বলল, বিয়ে কে চাইছে মসাই? ক্যাস ছাড়তে বলুন, সব মিটিয়ে নিচ্ছি।
নেবেন?
আলবত নেব। ক্যাস ছাড়লে আমরা কেতকীর বিয়েতে পিঁড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে আসব। ওর বাপকে রাজি করান।
আমার সর্বাঙ্গ উত্তেজনায় কাঁপছে। মাথার মধ্যে টিক টিক শব্দ। বললাম, সমীরবাবু ছাড়তে রাজি হবেন?
ছেলেটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সমীরের কি মেয়েছেলের অভাব পড়েছে নাকি! সামনে হাড়কাটা গলি থাকতে! ও সব ভড়কি দিচ্ছে। তবে আমরা দু’চারদিন ফুর্তি-টুর্তি করব, মাল-ফাল খাব, ফাংশান করব, তার জন্য দু’হাজার ছাড়তে বলুন। যদি রাজি না হয় তবে কেস সিরিয়াস হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে তো খুব রিলেটিভিটি আছে। দেখুন বলে।
আপনারা কি গিরিবাবুর কাছে টাকা চেয়েছিলেন?
না। টাকা চাইব কেন? গিরিবাবু আমাদের পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল, তাই সমীরের জেদ চেপে গেছে, এসবার-ওসপার করে দেবে। আমরা কেলো করতে চাই না। ও সব ভদ্রঘরের, শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করে সমীর বরং আরও ফেঁসে যাবে, ওর ক্লাস এইট-এর বিদ্যে। অনেক বুঝিয়েছি সমীরকে। রাজি হচ্ছে না। কিন্তু আমরা জানি, ক্যাস পেলে ও কে ছেড়ে দেবে।
মাথার ভিতরটায় টাকড়ুমাড়ুম বাজছে। এক বার অস্ফুট দাঁড়ান বলে দৌড়ে ফিরে আসি। সদরে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা। বেরোচ্ছেন। খুব সাবধানে উঁকি দিয়ে রাস্তাঘাট দেখে নিচ্ছেন, চৌকাঠের বাইরে পা দেওয়ার আগে।
আমাকে দেখে বললেন, ফিরে এলে যে!
একটা জিনিস ফেলে গেছি।
উনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, অ৷ তা এসো নিয়ে, তোমার সঙ্গে বাসরাস্তা পর্যন্ত যাবখন।
মাসিকে গিয়ে বললাম, কেতকীকে বাঁচাতে চাও তো পাঁচশোটা টাকা গুনে এনে দাও। আমার গুনবারও সময় নেই।
মাসি মুহূর্তের মধ্যে এনে দিল। আমি পাখনা মেলে উড়ে বেরিয়ে এলাম। গিরিবাবু সঙ্গ নিলেন বটে, কিন্তু আমার দৌড়-হাঁটার সঙ্গে তাল দিতে না-পেরে পিছনে পড়ে রইলেন।
ছেলেটা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে ছিল। তার বুক পকেটে ঝট করে টাকাটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, বাকিটা সামনের সপ্তাহে।
ছেলেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। আস্তে বলল, কত আছে?
পাঁচশো।
পলকের মধ্যে ছেলেটা ভীষণ বিনয়ি হয়ে বলল, গিরিবাবু দিলেন?
মানুষ চরিয়ে খাই। পলকের মধ্যে বুঝলাম, এক্ষুনি ঘটনার লাগাম নিজের হাতে ধরে ফেলতে হবে। গিরিবাবু টাকা দিয়েছে এমন কথা মিথ্যে করে বললে ওরা বড়বাবুকে পেয়ে বসবে। ফের টাকার দরকার হলে আবার ঝামেলা করবে। গম্ভীর হয়ে বললাম, না। আমিই দিচ্ছি। কিন্তু আর কোনও ঝামেলা হলে বাকি টাকাটা তো দেবই না, উলটে অন্য রকম ঝামেলা হয়ে যাবে।
ছেলেটা সদ্য টাকা খেয়েছে। যারা টাকা খায় তাদের ব্যক্তিত্ব থাকে না। ভাল-মন্দের জ্ঞান নষ্ট হয়ে যায়। এ ছেলেটাও মাস্তানি ঝেড়ে ফেলে একটু খোশামুদে হাসি হেসে বলল, ঝামেলা হবে কেন? সমীর সালাকে আমরা টাইট দিচ্ছি। আপনি ডেফিনিট থাকুন।
গিরিবাবু পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন খুব তাড়াতাড়ি। ছেলেটা সেদিকে তাকালও না।
ছেলেটার আরও কয়েকজন সাঙাত এসে চারধারে দাঁড়িয়ে গেল। টাকার ব্যাপারটা আড়াল থেকে লক্ষ করে থাকবে। টাকার গন্ধ গোলাপ ফুলের মতো, যারা গন্ধ নিতে জানে তারা ঠিক গন্ধ পায়।
ছেলেটা সঙ্গীদের দিকে চোখ মেরে আমাকে বলল, তা হলে ফের সামনের সপ্তাহে, কেমন?
হ্যাঁ। কিন্তু ছোটবাবু কী হবে?
ছেলেটা মাথাটা সোজা রেখেই বলল, ছোটবাবু ফোতো কাপ্তান। দশ-বিশ চাক্কি ঝাঁক দিতেই আমাদের দম বেরিয়ে যায়। ওর মামলায় আমরা আর নেই। তবে ওর ছেলে সন্তু আমাদের দোস্ত, কিন্তু তাকে টাইট দেওয়ার ভার আমার। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যান।
নিশ্চিন্ত হয়েই আমি বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। নিজের ভিতরটা বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। টাকাটা চলে গেল হাত থেকে। সামনের সপ্তাহে আরও যাবে। যেন এই যাওয়ার জন্যই হুড়মুড় করে টাকাটা এসেছিল।
বাসরাস্তায় ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে বড়বাবু দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে বললেন, চেনো নাকি ওদের?
চেনা হল। আপনি আর ভাববেন না বড় মামা, সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি। আর কেউ হুজ্জত করবে না।
মিটে গেল মানে? কী করে মেটালে?
একটু মহৎ হতে ইচ্ছে করল। অনেককাল মহৎ হইনি। বললাম, সে শুনে আপনার কী হবে? তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, আর কেউ কিছু করতে সাহস পাবে না।
বড়বাবু অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে আছেন। এ কয়দিনে তার বয়স বহু বেড়ে গেছে, আয়ুক্ষয় হয়েছে অনেক। একটা বহুদিনকার চেপে রাখা শ্বাস হুস করে ছেড়ে বললেন, সত্যি বলছ উপল ভাগ্নে! তুমি কি হিপনোটিজম জানো?
জানি বড়মামা। হিমনোটিজম সবাই জানে। যাক গে, কেতকীর বিয়ের আর দেরি করবেন না। এই বেলা দিয়ে দিন।
কার সঙ্গে দেব? ওই হাতকাটা সমীরের সঙ্গে?
আরে না না।— হেসে ফেলে বলি, কলকবজা নেড়ে দিয়ে এসেছি বড়মামা, এখন আপনারা বিয়ে দিতে চাইলেও সমীর উলটো দৌড়ে পালাবে। তার কথা বলিনি। ভাল পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দিন।
কিন্তু ছোট তরফ?
রা কাড়বে না।
ঠিক বলছ?
তিন সত্যি।
বড়বাবুর মন থেকে সন্দেহটা শতকরা আশিভাগ চলে গিয়েও বিশভাগ রইল। সেই তলানি সন্দেহটা মুখে ভাসিয়ে তুলে বললেন, ইঞ্জিনিয়ার ছেলে একটা হাতেই রয়েছে। বড্ড খাঁই তাদের। তা এখন আর সে সব ভেবে দেরি করলে হবে না দেখছি।
লাগিয়ে দিন।
যদি ভরসা দাও তো এ মাসেই লাগাব। কলকাতায় দুই দিনে বিয়ের জোগাড় হয়।
অন্যমনস্ক ও উদাস স্বরে ‘তাই করুন বড়মামা’ বলে বিনা ভূমিকায় হাঁটতে থাকি। টের পাই, বড়বাবুর চোখ আমাকে বহু দূর পর্যন্ত প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখতে থাকে।
অনেক দিন বাদে নিজেকে বেশ মহৎ লাগছে।