১১ জুন, শুক্রবার ১৯৭১
ইয়াহিয়া সরকার বেশ ভালো ফ্যাসাদেই পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। বিশ্বব্যাঙ্ক ও জাতিসংঘকে ভালোমতো বুঝিয়ে উঠতে পারছে না যে, পূর্ব পাকিস্তানে যা চলছে, তা বিচ্ছিন্নতাবাদী কতিপয় দুষ্কৃতকারীর নাশকতামূলক কাজের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ মাত্র। এবং সে ব্যবস্থা গ্রহণ শেষে আইন ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পর পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী এখন রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজে প্রাদেশিক সরকারকে সাহায্য করছে। প্রদেশের সর্বত্র এখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অফিস, আদালত, স্কুল-কলেজ সব পুরোদমে চলছে। কল-কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন চলছে। বাস, কোচ, ট্রেন, স্টিমার সব পুরোদমে চলছে। জনপ্রিতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি ইয়াহিয়া মোটেও ভোলেন নি। পূর্ব পাকিস্তানের ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক আন্দোলনের জন্যই তার ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনাটি একটুখানি পিছিয়ে গেছে মাত্র। কিন্তু তার লক্ষ্য অভ্রান্ত রয়েছে :তিনি নির্বাচন বিফলে যেতে দেবেন না। জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা তিনি অতিশীঘ্রই ঘোষণা করবেন। তবে হ্যাঁ, জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গিয়ে তিনি দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে দিতে পারেন না। সেই জন্যই একটুখানি দেরি হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের খুঁজে বের করার জন্য ইয়াহিয়া বেগম আখতার সোলায়মানকে ঢাকা পাঠিয়েছে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণার পর পরই। বেগম আখতার ঢাকায় এসে ইতোমধ্যেই অনেক আওয়ামী লীগ এম.এল.এ ও এম.পি.এ-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন। খবরের কাগজে প্রকাশ : তিনি ১০৯ জনের স্বাক্ষর যোগাড় করে ফেলেছেন! (খুবই নিবেদিতপ্রাণ করিতকর্মা মহিলা, বোঝা যাচ্ছে।)।
বার বার এসব কথা বলে, রেডিও-টিভি খবরের কাগজের প্রচার মাধ্যমে এত সব সাফাই গেয়েও পাকিস্তান সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে ভোলাতে পারছে না। চলতি বছরের বৈদেশিক ঋণের মে-জুন মাসের কিস্তি ৩ কোটি ডলার শোধ দেওয়া পাকিস্তানের পক্ষে এখনই সম্ভব নয় বলে এইড কনসর্টিয়ামের কাছে পাকিস্তান ছয় মাসের সময় চেয়েছিল গত মাসের পয়লা তারিখেই। সে সময় দেওয়া হবে কি না, এখনো পর্যন্ত তার কোন সুরাহা হয় নি। গত মাসের শুরুতেই এসব বিষয়ে সরজমিনে তদন্ত (পাকিস্তানি প্রচার মাধ্যমের ভাষায় আলোচনা!) করার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের এইড-টু-পাকিস্তান কনসর্টিয়াম-এর চেয়ারম্যান মিঃ পিটার কারগিল একদল সহকর্মী নিয়ে ইসলামাবাদে হাজির। কয়েকদিন সেখানে খোদ প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমদ পর্যন্ত অনেক বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কি হলো, আল্লা জানে। কদিন পর এম.এম. আহমদ দৌড়ালেন ওয়াশিংটনে, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার কাছেদরবার করতে। তারপরও তো মাস কাবার হয়ে গেল। মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া ২৪ মে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাও ঘাষণা করলেন। কিন্তু কোথায় কি? বিশ্বব্যাঙ্ক মিশন এখন দশদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তান সফর করছে।
ওদিকে উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানকে সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে, তবে সে সাহায্য জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করতে হবে। পাকিস্তান তাতে রাজি নয়। পাকিস্তান সরকার জোর গলাতে মাথা নেড়ে বলছে–পাকিস্তানের নিজস্ব রিলিফ সংস্থা এসব সাহায্যসামগ্রী বিতরণের কাজে যতেষ্ট পটু। কিন্তু উ থান্ট-ভবী তাতে ভুলছে না!
জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর রিফিউজীজ প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানও এখন ঢাকায়। তাকে বোধহয় মুশকিল আসান হিসেবে ইয়াহিয়া জাতিসংঘ থেকে ডেকে এনেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় যেসব প্রকৃত পাকিস্তানি, বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতকারীদের ভীতি ও হুমকি প্রদর্শনের মুখে পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য হয়ে সীমান্তের অপর পারে গমন করেছেন তাদের সকলকে সাদরে ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসিত করবেন এই মর্মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক বিবৃতিতে আশ্বাস প্রদান করেছেন। এবং এর প্রেক্ষিতে গত সপ্তাহেই ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পথের ওপর অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছে।
ঢাকায় আসার আগে প্রিন্স সদরুদ্দিন ইসলামাবাদে কয়েকদিন ছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে যথাযোগ্য ব্রিফিং নেবার জন্যই। গতকাল ঢাকায় পৌঁছেই প্রিন্স ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, খাটি পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন সম্পর্কে গভর্নর থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে। তিনি আজই চুয়াডাঙ্গা আর বেনাপোলের কাছে দুটো অভ্যর্থনা কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসেছেন।
(কি নিষ্ঠা! কি উদয়াস্ত পরিশ্রম!)
ওদিকে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত তিনদিন আগেই উথান্টকে জানিয়েছেন যে, আমেরিকান সরকার আরো অতিরিক্ত পনের মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছেন ভারতে পূর্ব পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের সাহায্যের জন্য। আরো খবর-মিসর ভারতে পাঠাচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে কলেরা ভ্যাকসিন।
কল্পনার চোখে দেখলাম ইয়াহিয়া এ খবর পেয়ে মাথার চুল ছিড়ছেন। আর উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিনকে কোন কম্মের নয় বলে গাল দিচ্ছেন!
আজ থেকে ঢাকায় সান্ধ্য আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহার।