জীবনের নতুন মান
আপনার বয়স যখন আরো কম ছিলো, কর্মজীবনে প্রবেশ করার প্রথম দিকে আপনি হয়তো উন্নতমানের বিলাসবহুল জীবন যাপনের রঙিন স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবের কঠোর কষাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে কদাকার রূপ ধারণ করেছে বহুদিন আগেই।
আজ এই বইটি পড়ছেন। এটি যদি গভীর আগ্রহ এবং মনোযোগর সাথে আপনি পড়তে শুরু করে থাকেন, আনকোরা উদ্দীপনায় ভরপুর হয়ে উঠেছেন। আপনি। উন্নত মানের, উপভোগ্য জীবন যাপন করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়-এর বদলে এখন আপনি জানেন এবং ভাবছেন, উন্নত মানের সুখ সমৃদ্ধিতে ভরা। সুখকর জীবন যাপন আপনার দ্বারা অনায়াসে সম্ভব।
নাকি এখনও আপনার সন্দেহ রয়েছে? ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে যে-কোনো সাফল্য অর্জন করা সম্ভব?
সন্দেহ থাকলে, আপনার প্রথম কাজ, সন্দেহ দূর করা। সন্দেহ দূর করতে হলে বইটা আবার শুরু করুন প্রথম থেকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন এমন একটিও। বাজে কথা আমি বলেছি কিনা যেটার উপযুক্ত ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ দিতে অসমর্থ হয়েছি। আমার প্রতিটি বক্তব্য যদি আপনার মনে হয় সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং যুক্তিযুক্ত–কেবলমাত্র তাহলেই দূর হবে আপনার সন্দেহ।
.
মানুষের জীবন কি
মানুষের জীবন অসংখ্য অভ্যাসের সমষ্টি। অভ্যাসগুলো হলো উপাদান। অভ্যাস নামক উপাদানের সমষ্টি আপনার জীবন। ঘুম থেকে জাগার পর থেকে আবার ঘুমুতে যাবার আগে পর্যন্ত আপনি যা যা করেন তার প্রায় সবগুলোরই ভিত্তি হলো অভ্যাস। আপনি সাফল্যের পথে একজন নবাগত যাত্রী, বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করতে যাচ্ছেন। নিজেকে অবশ্যই তৈরি করতে হবে আপনার। নতুন এবং উন্নতমানের জীবনের অধিকার লাভ করার জন্যে।
নিজেকে তৈরি করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এক কোটি টাকা পেলে কি করবেন তা যদি পরিষ্কার জানা না থাকে আপনার, টাকাটা পেলে হয় আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে, নয়তো পাঁচ ভূতকে লুটে নিতে সুযোগ করে দেবেন।
সাফল্য লাভের চাবিকাঠি রয়েছে আপনারই হাতে। এখন আপনি জানেন দৈনন্দিন জীবনে কি কি করলে মাস শেষে, বছর শেষে কি কি লাভ করতে যাচ্ছেন আপনি। আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি সাফল্য লাভ করা না করা একান্তভাবে নির্ভর করছে আপনারই উপর-ফর্মুলাটা কাজে প্রয়োগ করলে সাফল্য অবধারিত, প্রয়োগ না করলে পিছিয়ে পড়া অনিবার্য পরিণতি। যাদুবিদ্যাটি শেখা হয়ে গেছে আপনার। এই ফর্মুলা বা যাদুবিদ্যাই আপনাকে ঠেলে নিয়ে যাবে সাফল্যের অনন্ত দিগন্তের দিকে।
কাম্যবস্তু অসংখ্য, সবই এক এক করে অর্জন করবেন আপনি। সেগুলো ব্যবহার করবেন, উপভোগ করবেন, সুখী হবেন। কিন্তু কাম্যবস্তু অর্জন করে সুখে। জীবন যাপন করতে হলে উন্নতমানের জীবন সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা থাকা। চাই আপনার।
আপনার কাম্যবস্তুর সংখ্যা যত বেশিই হোক সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) টাকা। খ) সামাজিক পদ-মর্যাদা। গ) ক্ষমতা।
এই তিনটে যথেষ্ট পরিমাণে অর্জন করে নিয়েই উন্নততর জীবনের অধিকারী হবার জন্যে নতুনভাবে যাত্রায় বের হবেন।
উন্নত জীবনের সন্ধানে বেরুবার আগে কি দরকার আপনার, বলতে পারেন? হ্যাঁ, দরকার প্রস্তুতির। কিন্তু তারও আগে দরকার পরিকল্পনার একটা ছক। ছকের একটা নমুনা এখানে খাড়া করা যাক।
(১) একটা আরো ভালো বাড়ি।
বাড়ি শুধুমাত্র চলনসই একটা মাথা গোঁজবার ঠাই নয়। বাড়ি আপনার এমন হওয়া উচিত যে বাড়িতে যতোক্ষণ থাকবেন প্রতিটি মুহূর্ত যেন আরামদায়ক, আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে। বাইরে যখন থাকবেন, বাড়িতে ফেরার জন্যে যেন আপনার মধ্যে একটা ব্যাকুলতার সৃষ্টি হয়। বাড়িটাকে হতে হবে এমনই আকর্ষণীয় সেটি যেন আপনাকে চুম্বকের মতো টানতে পারে।
আপনার এবং আপনার পরিবারের সকল সদস্যের জন্যে বাড়িটাতে যথেষ্ট সংখ্যক কামরা থাকতে হবে, থাকতে হবে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং অতিথিদের জন্যে অতিরিক্ত রূম। প্রতিটি রূমের সাথে সংলগ্ন বাথরূম থাকা অবশ্যই দরকার।
আপনার এবং আপনার স্ত্রীর জন্যে দুটো বিশেষ ঘর প্রয়োজন। আপনি হয়তো আপনার অবসর সময়টা নিজস্ব একটা হবির পিছনে খরচ করতে চান। নির্জনতা দরকার আপনার। লাইব্রেরী বা ড্রয়িংরূমে কখন কে থাকে না থাকে, ঢোকে না ঢোকে, তারচেয়ে আলাদা একটা রূম থাকাই সবদিক থেকে ভালো।
আপনার স্ত্রী হয়তো সেলাই-এর ভক্ত। কিংবা, আড়ালে ছবি আঁকতে ভালবাসেন তিনি। তার জন্যেও দরকার একটা আলাদা, ব্যক্তিগত কামরা।
আপনার বাড়ির সামনে ও পিছনে বাগান থাকবে। সামনে তো থাকবেই। পিছনে যদি প্রচুর জায়গা থাকে, জায়গাটা ফেলে রাখবেন না-চমৎকার একটা সুইমিংপুল হতে পারে ওই জায়গাটায়। সুইমিংপুল ছাড়া বাড়ি ঠিক যেন গ্যারেজ ছাড়া গাড়ির মতো–অপরিকল্পিত। আজকাল এটার বেশ চল হয়েছে-বিদেশে তো বটেই, দেশেও।
(২) ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা।
বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না, ভবিষ্যতের জন্যেও অনেক কিছু। করণীয় আছে আপনার। বর্তমানের প্রচুর আয় থেকে ভবিষ্যতের জন্যে নিয়মিত কিছু সঞ্চয় করুন। এমন সব জিনিস কিনে রাখুন, দরকারের সময় যা সহজেই বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন। নিজেকে নয় শুধু, সঞ্চয়ের প্রতি উৎসাহী করে তুলুন পরিবারের সকলকে। অল্প অল্প করে সবাই মিলিতভাবে সঞ্চয় করলে মোটা টাকা জমাতে খুব বেশি দেরি হয় না। প্রতিরক্ষা বণ্ড, প্রাইজ বণ্ড, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট ইত্যাদি ধরনের যতোরকম সঞ্চয়ের মাধ্যম আছে, সবগুলো ব্যবহার করুন।
জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দেয়াটা একটা ভালো ইনভেস্টমেন্ট তো বটেই, ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ হিসেবেও গণ্য করা চলে এই ধরনের ইনভেস্টমেন্টকে।
(৩) ছেলেমেয়েদের শিক্ষা।
নতুনমানের জীবন যাপন কালে আপনি আপনার ছেলেমেয়েদেরকে শুধু যে লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন তাই নয়, আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আপনার ছেলেমেয়েরা দেশের বা বিদেশের সবচেয়ে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পায়।
পরি চল্পনার ছকে এরপর একে একে আপনি যোগ করতে পারেন অনেক কিছু: আরো ভালো গাড়ি, বাড়ির ইনটেরিয়র ডেকোরেশন, আরো ব্যাপক আকারে। নতুন ব্যবসা, ইত্যাদি।
.
কাজ-বিশ্রাম-খেলা
আপনার জন্যে আমি একটা প্রোগ্রাম রচনা করেছি।
আপনি কাজ করবেন। আপনি বিশ্রাম নেবেন। আপনি খেলাধুলা করবেন।
আপনি কাজ করবেন কেন? আপনি কাজ করবেন সুখী হবার জন্যে।
আপনি বিশ্রাম নেবেন কেন? আপনি বিশ্রাম নেবেন অবসন্নতার হাত থেকে। দূরে থাকার জন্যে।
আপনি খেলাধুলা করবেন কেন? আপনার জীবনে খেলাধুলার কি ভূমিকা? কাজ করে যে তার একান্ত ভাবেই দরকার হয় চিত্তবিনোদনের। আপনি চিত্তবিনোদনের জন্যে খেলবেন।
সত্যি কথা বলতে কি, খুব অল্পসংখ্যক লোক তাদের বিশ্রামের সময়টা। উপভোগ করে। বিশ্রামের সময়টা পুরোপুরি বিশ্রাম নিতে হবে-এই নিয়ম সবাই। মানে না।
বিশ্রামের সময় কাজের কথা আপনি ভাববেন না। ভাববেন না ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। কোনো সমস্যা সে-সময় কোনোমতেই যেন আপনার মাথার ভিতর ঢুকে না পড়ে। আপনার জানা দরকার, মনকে বিশ্রাম না দিলে দেহ বিশ্রাম। গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
কাজ করার সময় আপনার মধ্যে থেকে শক্তি ক্ষয় হয়, মানসিক এবং দৈহিক। দু’ধরনেরই। এই শক্তি ফিরে পাবার একমাত্র উপায় পরিপূর্ণ, নির্ভেজাল বিশ্রাম গ্রহণ।
সুবিন্যস্ত জীবনের জন্যে খেলাধুলা একান্ত জরুরী। আপনি যখন ঘুমান তখন আপনার অবচেতন মন স্বাভাবিকভাবে কাজে বসে। কিন্তু আপনার অবচেতন মন যখন খুশি থাকে, যখন আনন্দে হাবুডুবু খায় তখন আপনার অবচেতন মন দ্বিগুণ। গতিতে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আপনার অবচেতন মনকে বেশি খাটাবার জন্যে আপনি খেলাধুলা করবেন।
খেলাধুলার উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। অবশ্য যে খেলাই আপনি খেলুন সেটিকে হতে হবে সঠিক ধরনের। জুয়া খেলাটাও খেলা, কিন্তু সঠিক খেলা নয় এটি আপনার জন্যে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বসে আছেন বন্ধ একটি রূমে, রূমের ভিতরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে, ঘামের গন্ধ পাচ্ছেন নাকে-মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয় পরিবেশটা। এই খেলার আরো একটা বড় দোষ, দৈহিক ব্যায়াম হচ্ছে না আপনার। সবচেয়ে বড় আপত্তির কারণ, এই খেলার অন্যতম উপাদান নগদ টাকা; পকেট ভর্তি করে টাকা নিয়ে বসতে হবে। আপনাকে, উঠে আসতে হবে শূন্য পকেট নিয়ে।
শরীর এবং মন দুটোই উপকৃত হয় এমন খেলা অনেক আছে। সাঁতার, নৌকো চালানো, মাছধরা, টেনিস, ব্যাডমিন্টন–আরো কতো রকম। এগুলোর যে কোনো একটি খেলে যদি আনন্দ পান, উপকৃত হবেন।
.
কাজের সময় পাঁচ ঘণ্টা
প্রখ্যাত এক মনোবিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন নির্দিষ্ট ক’টা কাজ একনাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টা করার পর যে কেউ কাজটির প্রতি চরম বিরক্ত এবং ক্লান্ত হতে বাধ্য। সৌভাগ্যই বলতে হবে, কদাচ কেউ কোনো নির্দিষ্ট কাজ নিয়ে একনাগাড়ে মগ্ন থাকে। আপনার কাজের মাঝখানে রয়েছে লাঞ্চ-আওয়ার, টি-আওয়ার। বিরতির পর আবার আমরা সেই একই কাজে ফিরে আসি।
একটা কাজ দীর্ঘক্ষণ না করাই ভালো। কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য, নতুনত্ব থাকলে। কাজের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে, অল্প সময়ে বেশি কাজ করা যায়।
.
নেতৃত্ববোধ
নিজস্ব একটা ভাবমূর্তি গড়ে তোলা দরকার আপনার।
আপনি কারো চাকর নন, আপনারও কেউ চাকর নয়, আপনি আপনার নিজের মতো, আর কারো মতো নন আপনি।
নিজেকে আপনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে মনে করুন। নিজেকে আর সকলের চেয়ে দ্র, আর সকলের চেয়ে সৎ, সত্যবাদী, উদার, নীতিবান, বিবেকবান বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। কারো নিচে নন আপনি এই রকম চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আপনাকে। এমন একটা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব থাকবে আপনার মধ্যে, যে আপনি কোনো কামরায় প্রবেশ করা মাত্র সবাই কথাবার্তা বন্ধ করে আপনার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চোখ তুলে তাকাবে, আপনাকে সানন্দে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে।
মানুষকে সৎ এবং সঠিক পথ দেখান, পরামর্শ দিন–প্রচুর শ্রদ্ধা এবং সুনাম অর্জন করতে পারবেন। প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করুন, তার বক্তব্যে মনোযোগ দিন, তার দুঃখে কাতর হোন, তার আনন্দে আনন্দ প্রকাশ করুন, আপনি তার জন্যে চিন্তা করুন, তার কষ্ট অনুভব করেন বুঝতে দিন তাকে, সে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করবে, আপনার ভক্ত হয়ে উঠবে সে।
নেতা হিসেবে কল্পনা করুন নিজেকে। কিন্তু নেতা হিসেবে নিজেকে কল্পনা করার আগে আপনাকে জানতে হবে নেতা মানে কি।
নেতা মানে শাসক বা শোষক নয়। নেতা মানে পথ-প্রদর্শক, সৎপরামর্শদাতা, সাহায্যকারী। নেতা হতে হলে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে হবে। নেতাকে হতে হয় সদয়, মিষ্টভাষী, অভিজ্ঞ, বিবেচক। সত্যিকার নেতা নিজেকে নেতা বলে ঘোষণা করে না। তার কাজই তাকে নেতৃত্ব এনে দেয়।
আপনি নিজেকে নেতা বলে কল্পনা করুন, সুকর্মের মাধ্যমে নেতৃত্ব গ্রহণ করুন মানুষের কাছ থেকে।