১১. জীবনদর্শন ও সাহিত্যবৈশিষ্ট্য
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবন ও কবিতা ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কবিতাই তার জীবন, আর জীবনই তার কবিতা। জীবনদর্শন খুঁজলে তাঁর সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। পক্ষান্তরে সাহিত্যবৈশিষ্ট্যেই ফুটে উঠেছে তার জীবনদর্শন।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সময়ের সন্তান। উনসত্তরের গণঅভুত্থানের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা কিশোর রুদ্রই স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তার কবিতায় তাই ধ্বনিত হয় স্বাধীনতার চেতনা, সংগ্রামের সুর।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তাঁর মতাদর্শ ছিল সাম্যবাদী। ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মনোনয়নে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে সেই চিন্তার প্রমাণ রেখেছেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য কখনোই ছিলেন না কিন্তু গণমানুষের মুক্তিকামী এই কবি মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল-ধর্মান্ধগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি যখন নিজ এলাকা মিঠেখালিতে, তখন ‘অগ্রদূত নামের একটি ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সংঘ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সংঘের সদস্যপত্রের অঙ্গীকার অংশে তিনি লিখেছিলেন, আমি স্বাধীনতা, সামাজিক সাম্য এবং মুক্তমন প্রগতিশীলতার প্রতি আমার সমর্থনকে কার্যকর করতে সংগঠিত থাকবো। সে-সময় তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতাও করেছেন।৮০ রুদ্র ছিলেন সংস্কারমুক্ত এক উদারনৈতিক মানুষ।
যে-কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রুদ্র ছিলেন অগ্রসৈনিক। অজস্র সংগঠনের তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত সংগীত সংগঠন ‘অন্তর বাজাও’ এখনো ক্রিয়াশীল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সংগঠিত করার মুখ্য ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। এর পাশাপাশি কবিতাচর্চায় ছিলেন সার্বক্ষণিক নিবেদিত।
আপাদমস্তক লেখক বলতে যা বোঝায়, রুদ্র ছিলেন তাই। লেখালেখিই ছিল তার ধ্যান ও ব্রত। এ-কারণে কোনো পেশার সঙ্গে রুদ্র নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন নি।
রুদ্র ছিলেন প্রতিবাদী। এই প্রতিবাদ ঝরে পড়েছে তার লেখায় ও জীবনাচরণে। স্বৈরাচার বিরোধিতার কারণে তিনি গঠন করেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। আর এই পরিষদেও যখন স্বৈরকর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেখলেন, তখন তিনি প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করলেন। বিনিময়ে নিগৃহীত হলেন। আর রুদ্রের বিরোধিতা যে ঠিক ছিল, এই নিগৃহই তার প্রমাণ বহন করে।
রুদ্র ছিলেন প্রেমী। তার প্রেম ছিল আন্তরিক ও নিষ্পাপ! যে-কোনো প্রেমে ব্যর্থ হয়েও তিনি কোনো অভিযোগ করেন নি। সব কষ্ট-অপমান মুখ বুঝে সহ্য করার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তাঁর।
রুদ্র এই সমাজটাকে পাল্টাতে চেয়েছিলেন। একটি শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রত্যাশা করতেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী রুদ্র নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে মুখ্য মনে করতেন না। তার সর্বোচ্চ বিশ্বাস ছিল মানবতাবাদে।
রুদ্র তার এই জীবনদর্শন রূপায়িত করেছেন কবিতায়। তার অধিকাংশ কবিতাই জীবনঘনিষ্ঠ। রাজনীতিচেতনাও তার কবিতার অন্যতম উপাচার। একবার এক সাক্ষাৎকার তিনি বলেছেন–’রাজনীতি-সচেতন একজন মানুষের যে-ভূমিকা হবে, একজন কবিও সেই ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সংগ্রামী ভূমিকা ছাড়াও কবিকে একটি বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাহলো পাশাপাশি তাঁকে সংগ্রামী কবিতাও লিখতে হয়।
মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের আন্দোলনে তিনি ছিলেন সরব যোদ্ধা। তিনি জানতেন যে, এসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব কবির নয়, রাজনীতিকের। তাই তার মন্তব্য–’শুধু। কবিদের দিয়ে এ-কাজটি সম্ভব নয়, এর জন্যে প্রয়োজন সৎ-রাজনীতির বাস্তব প্রয়োজন। কবিতা সেই রাজনীতির প্রেরনাদাতা’।৮২ আবার এর মাঝখানে কবিতার শুদ্ধতা রক্ষার প্রতিও তিনি মনোযোগী ছিলেন। কবিতায় রাজনীতি থাকবে কিন্তু অপরাজনীতির প্রভাবমুক্ত হতে হবে। কবিতাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তার মতামত হচ্ছে– ‘রাজনীতি-ব্যবসায়ী এবং লোলুপ আমলাদের হাত থেকে কবিতাকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে, সৎ সমালোচক এবং সৎ পুরস্কারদাতা নিশ্চিত করতে হবে।৮৩
কবিতা ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে কবি অন্যত্র বলেছেন, সাহিত্যের জ্বালানি হচ্ছে। রাজনীতি। আমরা যারা লিখছি, ঠিক একইভাবে পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড আমাদের নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফাঁকা বুলির রাজনীতি, আপোষের রাজনীতি চলছে। রাজনীতি এবং সাহিত্য সমান্তরাল চলতে শুরু না-করলে বড় ধরনের কোনো সাহিত্যের নিদর্শন আশা করা যায় না।৮৪
এসব বিশ্বাস ও উপলব্ধির কারণেই হয়ত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর কবিতায় রাজনীতিকে অঙ্গীকার করে নিয়েছেন। যে-রাজনীতি দলবাজির ঊর্ধ্বে, যে-রাজনীতি জাতির মঙ্গলের স্বপক্ষে সেই রাজনীতিই ছিল তার অন্বিষ্ট। তার রাজনৈতিক কবিতা সম্পর্কে সত্তর দশকের সমালোচক-কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার বলেছেন–
রাজনৈতিক সজ্ঞানতা নির্মাণ করেছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র ইতিবাচক কবি-মানস। তার বিশ্বাসের প্রতি তিনি ছিলেন দৃঢ় ও আন্তরিক। কিন্তু তার অকৃত্রিম প্রত্যয় যখনই বাস্তবের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করেছে, নিজেই দেখেছেন সহযাত্রীর মুখে মুখোশ, দেখেছেন পতন, তখনই পারম্পর্য রক্ষা করতে পারেন নি। মানুষের মৌলিক মুখোশ আমি খুলতে পারি না, শুধু পুড়ে যেতে পারি, পুড়ে যাই, পোড়াই সৌরভ (গলে যাচ্ছে মুহূর্ত, সময়/ মৌলিক মুখোশ)। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক তাদের সৃষ্টি ও চিন্তার প্রতি ষোল আনা বিশ্বস্ত ছিলেন বলে রূঢ় বাস্তবতার চাপে আপোষ অসতোর আশ্রয় না-নিয়ে বেছে নিয়েছিলেন আত্মধ্বংস, সংবেদনশীল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও ছিলেন একই ধ্রুবের পথিক। সেই যে দীর্ঘায়ু বাক্য–নিজের উগরানো বিষ নিজেই ধারণ করে জীবনানন্দ নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তেমনি তার পরিপ্রেক্ষিতে ঋজু রুদ্র হয়েছে তরুণ নীলকণ্ঠ। এরই প্রভাব পড়েছে তার ব্যক্তিজীবনে এবং কবিতায়। একদিকে দ্রোহী, আরেকদিকে রোমান্টিক। নজরুলও ফুল নেব না অশ্রু নেব–ভেবে আকুল হয়েছিলেন। তবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র রোমান্টিকতা ব্যাপৃত ছিল না জড়জগতের অভ্যন্তরে বা পশ্চাতে বিরাজমান কোনো রহস্য অনুসন্ধানে। পুরনো মতাদর্শে আস্থা নিবেদন করে অদেখা অধরা নিখিল দর্শন ও অনুভব ব্যাকুলও ছিলেন না। ক্ষয়িষ্ণঃ সমাজ পরিবর্তনের সদিচ্ছা শক্তিতে রূপান্তর করার প্রয়াসও বায়বীয় রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে এক বস্তুভিত্তিক রোমান্টিকতা। এই রোমান্টিকতায় আমুণ্ডু নিমজ্জিত ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এ তো নিজেকে দগ্ধ করেও স্বপ্ন দেখে যাওয়া, স্রোতের বিরুদ্ধে দৃঢ় পণ। সাঁতার কেটে চলা। তাঁর কবিতাই হচ্ছে এর বড় উদাহরণ। লিরিকের গীতিময়তা তাঁর সুস্পষ্ট। সমাজসংবেদী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নিজস্ব অবস্থান, চারপাশের চরাচরকে দেখেছেন তছনছ করে। তার দ্বান্দ্বিক চাউনি ছিল তাঁর দেখা। বাস্তবের আড়ালে থাকা বাস্তব ধরে টান দিয়েছেন ওই দ্বান্দ্বিক উপলব্ধি দিয়ে। এ-কারণে ভিন্ন মেজাজের চরিত্রের কবিদের সঙ্গে তার স্বাতন্ত্র ছিল স্বচ্ছ ও খোলাখুলি। তাঁর কবি-সত্তা নির্দিষ্ট করেছে সামাজিক সত্তাই।৮৫
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর রাজনীতি-চেতনার মর্মমূলে রয়েছেন আমাদের গৌরবের ইতিহাস–মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সুফল যখন অপাত্রে বণ্টিত হতে থাকে, তখনই তিনি গর্জে ওঠেন। এ-ব্যাপারে সুশান্ত মজুমদারের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধে অর্জিত চেতনা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর তরুণ কবি-মানসকে করেছে আলোড়িত, ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী এবং শক্তিতে সংগঠিত। অনুত্তীর্ণ কৈশোরে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে সে বেড়ে উঠেছে যুদ্ধ-পরবর্তীকালের অব্যাহত অস্থির ঘটনাবলীর ভেতর দিয়ে। ক্রমবর্ধিত রুদ্র দেখেছেন–মুক্তিযুদ্ধের সুফল, সাধারণজনের ত্যাগ, জীবনদান নস্যাৎ হতে, বহুমুখী অমোচনীয় সংকট, মানুষের শঠতা ও স্বার্থসিদ্ধি, যুদ্ধে পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর পুনরাবির্ভাব, সামরিক অভুত্থান, সেনাশাসনে অবরুদ্ধ স্বদেশ, স্বৈরাচারী সরকারের লুণ্ঠন, হত্যা, গুমখুন এবং পরিত্রাণে। মানুষের সংঘবদ্ধ জাগরণ। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি তরঙ্গ কবির মানস-ভূমির উপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় রুদ্রর বেশির ভাগ কবিতা রাজনীতি, সমাজ, মানুষ। সম্পর্কিত এবং জীবনের পক্ষে উচ্চারণযোগ্য পংক্তিমালা। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ বছরের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতের সন্ধানে কোনো অনুসন্ধানী ভবিষ্যৎ পাঠক ইতিহাসের প্রান্তরে ভ্রমণ না-করেও রুদ্র’র কাব্যগ্রন্থগুলির পৃষ্ঠা পাঠ করে প্রকৃত ঘটনা ও সময়ের মর্মোদ্ধার করতে পারবেন। জানতে পারবেন, আমাদের রাজনীতি ও সমাজক্ষয়ের বিবরণ, বাঁচার লড়াইয়ে মানুষের মরিয়া প্রয়াস ও প্রতিজ্ঞা। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাই সমাজ-মন্থন থেকে উদ্ভূত কবি, যে মন্থনে রয়েছে অমৃত ও বিষ–তার সবকিছু আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এ কারণে তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের কোন-না-কোন কবিতা মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পরিপূরক রাজনৈতিক ও মানবিক চিন্তায় স্পন্দিত।
‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন (বাতাসে লাশের গন্ধ/উপদ্রুত উপকূল) কবি’র এই বিবেচনা, কিংবা যুদ্ধদিনের স্মৃতি ‘বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত,/ সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিঁড়ে (হাড়েরও ঘরখানি) তা বাস্তবগ্রাহ্য আয়ুষ্মন বোধে রূপান্তরিত হয়। স্মৃতিসাক্ষী চোখ তুলে দিতে বলেন কবি–
‘উপরে তাকাও, দ্যাখো ওই মুখ চেনো তুমি, ওই যে মানুষ?
শকুনের মতো চোখ, ঠোঁটে রক্ত, কালো শুকনো জমাট রক্ত,
নোখে লেগে আছে দ্যাখো শিশুর মগজ–মাংশ, কুমারীর লজ্জা।
আর দ্যাখো একজন যুদ্ধের মানুষ কী বিমর্ষ, রুগ্ন, ম্লান–,
(২২ নং কবিতা/মানুষের মানচিত্র)
বিমর্ষ, রুগ্ন, ম্লান মানুষের উপর্যুপরি খোঁজ পাওয়া যায়–
‘যে-তরুন অস্ত্র হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছে
যে-তরুনের বিশ্বাস, স্বপ্ন, সাধ,
স্বাধীনতা উত্তরকালে ভেঙে খান খান হয়েছে।
অন্তরে রক্তাক্ত যে তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য,
প্রতারনা আর নির্মমতাকে।
দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসন যার নিভৃত বাসনাগুলো
দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করেছে।
(ইশতেহার/ ছোবল)
স্বাধীনতা-উত্তর নৈরাজ্য, প্রতারণা, খাদ্য-সংকট, দুঃশাসন মানুষের স্বপ্ন ও বাসনা চূর্ণ করে। সেই আশাভঙ্গের বেদনা ও ক্ষুৎপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আহাজারি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ধারণ করেন। মধ্য-সত্তরে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর একাধিক সেনা অভ্যুত্থান তছনছ করে ফেলে সমাজস্তর-কবজা করে ক্ষমতা। রুদ্র প্রশ্ন। করেন, ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো–কোন পক্ষে যাবে (সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি/ ছোবল)?’ একই কবিতায় সেনা-অস্ত্রে গণতহ্যার বিবরণও দিয়েছেন তিনি ‘তোমার বুলেট মানুষের বুক লক্ষ্য কোরে ছুটে যাচ্ছে/ তোমার বুলেট মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নির্যাতনই কেবল রুদ্র প্রকাশ করেন না– প্রতিবাদ, সমষ্টিবদ্ধ মোকাবেলা যা মানুষের সহজাত, তাও মূর্ত করেন কবিতায়।৮৬
রুদ্রের কবিতার মুখ্য উপাদান যে’দ্রোহ’ তা কোনো সমালোচকেরই দৃষ্টি এড়ায় নি। তার প্রায় সব কবিতায়ই ফুটে উঠেছে দ্রোহের সুর। রুদ্রের সেইসব গুণের কথা তুলে ধরেছেন একজন অনুসন্ধানী বিশ্লেষক–
কবিপ্রকৃতিতে ছিলেন তিনি অসামান্য মুক্তিসংগ্রামী, আক্রমণাত্মক কালাপাহাড় ও দ্রোহী সৈনিক। মিছিল ও আন্দোলনের প্রতি ছিল তার আজন্ম পক্ষপাত। সংগ্রামী অনুভাবনায় তিনি ভাবোলে নরোম আস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। চেতনার বর্ণাঢ্য স্পর্শকাতর অনুভূতিকে খারিজ করেন। ‘আমাকে শনাক্ত করো হে যৌবন, যুদ্ধের সন্তান,/আমাকে শনাক্ত করো স্বদেশের দগ্ধ কৃষ্ণচূড়া।’ নিসর্গ চেতনার ভীরুতা, অসহায়তা, কাপুরুষতাকে যুক্তির শেষে অস্বীকৃতি জানান। রুদ্রের কবি স্বভাবী সজ্ঞায় মূর্ত হয়ে ওঠে সংগ্রামী স্বতঃস্ফূর্ততা। কবি তাই কত সহজে উচ্চকণ্ঠ হতে পারেন; যে যাবে না সে থাকুক, চলো, আমরা এগিয়ে যাই। কবির এই আহ্বান যেন সব অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর মতো বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
তাঁর অনিবার্য উপলব্ধিতে প্রথানুযায়ী ভাববিশ্বের ভীরুতা, দ্বিধা, জড়তা, পরোক্ষের মগ্ন চেতনা ঠাই পায় না। তিনি আপতিক নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এভাবে আহ্বান আন্দোলিত করেন : ‘শ্লোগানে কাঁপুক বিশ্ব, চলো, আমরা এগিয়ে যাই/ প্রথমে পোড়াই চলো অন্তর্গত ভীরুতার পাপ,/ বাড়তি মেদের মতো বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা।/ সহস্র বর্ষের গ্লানি, পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রীগুলো,/ যুক্তির আঘাতে চলো মুক্ত করি চেতনার জট।’ (মিছিল)
বাস্তব অস্তিত্বের সংকট অস্বীকার করে কল্পনার ভাবনাবিলাসের নিখিল শূন্যতায় নিঃশীলভাবে নিজেকে সমর্পিত হতে দেন নি। বরং স্থিরপ্রজ্ঞা ও মূর্তসংগ্রামী চেতনায় তিনি মানসিক অভিক্ষেপ ঘটান : ‘লক্ষ্য স্থির আমাদের চলো, আমরা এগিয়ে যাই। আমাদের সাথে যাবে তিতুমীর, সিপাহী বিপ্লব,/ আমাদের সাথে যাবে অস্ত্রাগার দখলের হাত;/ কালবোশেখির মতো রক্তবীজ, বিপুল উত্থান।‘ ঐতিহ্যের উপর হাত রেখে কবি সংগ্রামী বিশ্বাসের ভাবনার অনুরণন ঘটান। ঐতিহ্যের যুগ যুগ সঞ্চিত সুকৃতির প্রণোদনায় আগামীতে ‘বিপুল উত্থানের’ স্বপ্ন দেখেন।৮৭
সহজ প্রকাশভঙ্গির প্রতি তার ছিল প্রবল পক্ষপাত। নিজের বিশ্বাসকে সরাসরি এবং সাহসের সঙ্গে উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন সমান মনোযোগী। কিন্তু তাই বলে শিল্পের দাবিকে অস্বীকার করেন নি কখনো। প্রখর কবিত্বশক্তির বলেই এটি সম্ভবপর। তার কবিতা-সম্পর্কে পঞ্চাশের বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক বলেন–
একদিক থেকে বরং সুকান্তের সরল স্পষ্টবাদিতার সাথে রুদ্রের কবিতার মিল বেশি। তার প্রতিবাদী কবিতার একটি সংকলন ‘ছোবল’-এর পাঠ এদিক থেকে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এর ‘মিছিল’ কবিতাটির সাথে মিছিলের মুখ’-এর প্রকৃতিগত প্রভেদ বিচারে মূল বক্তব্য স্পষ্টতর হবে বলে আমার বিশ্বাস।
রুদ্রের প্রতিবাদী কবিতা প্রসঙ্গে বলতে হয়, অই মেলানোর কাজ সব ক্ষেত্রে সহজ হয়। নি, কিন্তু যেখানে হয়েছে সেখানে সহজ শব্দেই গভীর বোধের অনবদ্য সব স্তবক তৈরি হয়েছে। যেমন :
‘নদীর দিকে ফেরাই পোড়া চোখ
নোনো জলের গন্ধ আসে ভেসে
স্বপ্ন বুনি স্মৃতির খড়ে নাড়ায়
নাড়ায়, ভেতরে কেউ নিবিড় কড়া নাড়ায়।’
এখানে ‘নাড়া’ ও ‘নাড়ায়’ শব্দ দুটোর ব্যবহারিক ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়। অন্যদিকে লৌকিক উপাখ্যানের ভঙ্গিতে লেখা ‘মানুষের মানচিত্র’ বিত্তহীন মানুষের চালচিত্র জীবনের অন্ধকার বীভৎস রূপ নিয়ে পরিস্ফুট। এখানে কবির শক্তির পরিচয় সুস্পষ্ট। প্রয়াত কবি আহসান হাবীব এই ধারায় একসময় কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন। রুদ্র প্রধানত জনচেতনার কবি। অসহায়, বিত্তহীন, দুস্থ জনমানসের ভাষা বলিষ্ঠ অভিব্যক্তিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আর সেই প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই এইসব কবিতার সহজ সারল্য বুঝতে হবে। এখানে সংকেতের আড়াল, প্রতাঁকের জটিলতা, বাক্যবন্ধের রহস্যময়তা আশা করা বৃথা এবং প্রাকৃত উদ্ভাসেই এর লক্ষ্যসিদ্ধি এবং নিরাভরণ সৌন্দর্য।
অথচ একটু অবাক হয়েই লক্ষ করি, ভিন্নধর্মী কবিতায় উৎকর্ষের ছাপ যেন আরো সহজ এবং সচরাচর। একটি উদাহরণ :
‘হাত বাড়ালেই ফুটে থাকা রক্তিম গোলাপ–
তবু যে যার কাটার কাছে ফিরে যায় একদিন,
একদিন যে যার নিঃসঙ্গতার কাছে।’
এই স্তবকের সৌন্দর্য যে এর ব্যঞ্জনায় নিহিত সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।৮৮
রুদ্রের সবগুলো গ্রন্থকে ছাপিয়ে যে-গ্রন্থটি পাঠকমনে বেশি নাড়া দেয় তা হল ‘মানুষের মানচিত্র। আর যদি না-ও লিখতেন, তবু এই একটি গ্রন্থই তাকে বাংলাসাহিত্যে স্থায়ী আসন দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গ্রন্থটি সম্পর্কে বিশিষ্ট সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন–
রুদ্রের এমন অনেক কবিতা আছে যাদের পড়লে মনে হয় ভিতরে কোথাও যেন সশব্দে দ্রোহ ফেটে পড়ছে, ক্রোধে কঁপছে কোনো মানুষ, গর্জন করছে কোনো যুবক, অথবা উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরেছে কেউ। মাঝে মাঝে তার কবিতার ভিতরে কান পাতলে কান্না শুনি, শোকের মাতম শুনি। চোখ ভিজে যায়। কিন্তু পরাজিত হতে দেয় না সে, আমাকে নয়, ক্রন্দনরতা অসহায় নিভৃত গ্রামের মেয়েটিকে নয়, নিজেকে তো নয়ই। আমাদের সময়ে দেশ ও মানুষকে নিয়ে এই ধরনের কবিতা লেখার বিপদ আছে, মানুষ ভাবতে পারে কবি বেসাত করতে নেমেছেন আবেগের, সস্তা দেশপ্রেমের, শ্লোগানের। বৈচিত্র্যহীন অন্ধকার জীবন যখন উঠে আসে কবিতায়, পাঠকও ক্লান্ত হতে পারে, জড়িয়ে পড়তে পারে অবসাদে। এখন অসহায়, দরিদ্র, নিরন্ন মানুষকে নিয়ে কিছু লেখা একটু সেকেলেও হয়ে গেছে, এবং সত্য যে, অনেক কবি আবেগকে শাসন করতে। শেখার আগেই ইনিয়ে বিনিয়ে সর্বহারা মানুষ ও শ্রেণীসংগ্রাম বিষয়ে কবিতা লিখে পাতার পর পাতা ভরেছেন। পাঠকের প্রত্যাশাকে ঐ অসংযত আবেগ যে পথে নিয়ে গেছে, তাতে ইচ্ছাপূরণের সহজ উপায় কিছু দাঁড়িয়ে গেছে। শ্লোগানেই যেন মুক্তি, শ্লোগানসর্বস্বতাই যেন বিদ্রোহের ধর্ম।
রুদ্র সচেতন ছিলেন এই বিপদ সম্পর্কে। তাঁর কবিতায় মাঝে মধ্যে শ্লোগানের ঐতিহ্য উঁকি দেয়, কখনো কখনো দেখি তিনি উচ্চকিত ঘোষণা দেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, যার সাথে বাস্তবের মিল নেই। কিন্তু তেমন উদাহরণ সামান্যই। রুদ্র এই সময়ের রাগী যুবক, তার রাগ যদি তাকে আবেগের কাছে নিয়ে যায় এবং তিনি প্রথাগত কিছু শ্লোগান ধ্বনিত করেন, তবে তাতে কী এমন ক্ষতি? বিশেষ করে, অন্যত্র, তাঁর ভালো কবিতায়, যেখানে তিনি অপ্রতিরোধ্য, এই আবেগ সংহত হয়ে শিল্পীত হয়ে রূপ নেয় এক বিশাল জীবনজিজ্ঞাসার। রুদ্রকে আমার ভালো লাগে এইজন্য যে, যখন অনেক তরুণ অস্তিত্ববাদী সংকটে অথবা উদ্ভটের আবর্তে পড়ে দিশেহারা, তিনি কিছু সেকেলে হয়ে যাওয়া বিষয়কে কবিতা-কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন, মানুষকে নিয়ে লিখেছেন এবং মানুষের জন্য লিখেছেন। একই সংগে, একটি নিজস্ব স্টাইলও তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা গভীর ও অন্তরঙ্গ অথচ বহির্মুখী।
রুদ্রের ‘মানুষের মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ বলে মনে হয়েছে। রুদ্র যে-রকম মানুষকে আদর্শ মনে করেন, এস, এম, সুলতানের মানুষজনের সঙ্গে তার মিল দেখা যায় তারা সাহসী, শক্তিশালী, পেশীবহুল, রাগী। এজন্য প্রচ্ছদে সুলতানের প্রথম রোপণ’ ছবিটি গ্রন্থের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। রুদ্রও ওই গ্রন্থে একটি শুরুর ইঙ্গিত দেন, যে শুরু প্রচলকে শেষ করে পুনরায় হবে। শেষ কবিতাটিতে, শেষ কটি পংক্তিতে তেমন আভাস আছে :
দশজনে পোড়ে আর একজন খোয়ারের বেহেস্ত বানায়,
এই যদি বিচার বিধান তয় মানি না, মানি না—
এই স্বর্গোদ্যান তছনছ করে, তার ভুল বৃক্ষগুলি উৎপাটিত করে, তার সাজানো বাগান উপড়ে ফেলে সাহসী মানুষ আবার করবে প্রথম রোপণ, তার সবচেয়ে প্রিয় অবহেলিত বৃক্ষের চারাটি।
‘মানুষের মানচিত্রে’র সবগুলি (মোট ৩২টি কবিতা আছে এ-গ্রন্থে, চার লাইনের পাঁচটি স্তবক বিশিষ্ট কুড়ি পংক্তির প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি পংক্তি বাইশ মাত্রার) কবিতা সমানভাবে অনুপ্রাণিত করে না আমাকে, দু’একটি কবিতা গ্রন্থের অন্যান্য, বা পূর্ববর্তী কোনো কবিতার প্রতিধ্বনি মাত্র। কোথাও কোথাও আছে পুনরাবৃত্তি, আছে শব্দ ব্যবহারে অসাবধানতা। কিন্তু প্রায় সকল কবিতার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এক প্রাণস্পর্শী চেতনাধারা, যেন বাংলাদেশের মানচিত্রের গভীর থেকে উঠে আসে এক পর্যটক এবং বর্ণনা করে তার দীর্ঘ ভ্রমণের বিবরণ। এই পরিভ্রমণে খণ্ড খণ্ড নানা চিত্রে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়–আমরা দেখি গ্রাম, গ্রামের বিষণ্ণ জীবন, শোষণ, অসহায় মানুষের নুয়ে পড়া শরীর এবং সেই শরীরের উপর চেপে বসা শোষক ও শাসক, লোভী ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীর মেদবহুল দেহ। এইসব চালচিত্র আমাদের পরিচিত, তবুও যেন এসব এমন নগ্নভাবে আমরা কখনো দেখি নি, এসব আর্তি ও কান্না, চিৎকার ও গর্জন আমরা এত কাছে থেকে শুনি নি। আমাদের মর্মমূলে বিধে যায় বাংলাদেশের গহীন গ্রামগুলির গোঙানির শব্দ। রুদ্র এসব কবিতার প্রায় সব কটি লিখেছেন খুলনার মিঠেখালিতে বসে; আন্দাজ করি তার অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা আরো তীব্র করেছে তাঁর অনুভূতিকে, বৈধতা দিয়েছে তার কোলাজ চিত্রগুলিকে। অনেক কবিতায় আছে ছোটগল্পের চমক এবং বিদ্যুৎস্পর্শ। আমরা ভুলি না হরিপদ মুচি ও তার বউটিকে; তার বউয়ের ওপর লেপ্টে থাকা কামুক দারোগাটিকে আমরা সর্বত্র দেখি; আমরা ভুলি না সার্কাসের মেয়ে ডালিমনকে অথবা আশ্বিনের শেষদিনে তালাক হয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিকে। রুদ্র গল্প বলেন, তাদের জীবনী শোনান আমাদের, কিন্তু গল্প শেষ হলে যে হতাশা, সে দুঃখ ঘিরে ফেলার কথা আমাদের, তা তো হয় না। কোথায় যেন একটি আক্রোশেরও জন্ম হয়, প্রতিবাদ জমা হতে থাকে। আমরা হঠাৎ উপলব্ধি করি :
মৃত স্বজনের হাড় মাঝরাতে জেগে উঠে শোনায় কাহিনী,
মাংশের ভেতরে সেই কাহিনীরা জমা হয় রক্তের–ধমনী
সেই কথা শোনে…
এই ধমনী থেকে একদিন নির্গত হবে বিদ্রোহের বারুদ। তেমন সম্ভাবনা আমাদের জন্য তুলে রাখেন কবি, তেমন সম্ভাবনা আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিই একসময়, করে নিতে হয়।
‘মানুষের মানচিত্র’র কবিতাগুলির আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে–যে অনুভতিগুলি কার্যকর এদের কেন্দ্রে তা মোটেও ধার নয়, সরাসরি যাপিত জীবনের চিত্র এসব। রুদ্র এসব চিত্রকে কখনো সচল মনে করেন, তীব্র গতিবেগ সঞ্চারিত হয় তার বিশাল ক্যানভাসে (আবারো সুলতানের কথা মনে আসে), কখনো থামিয়ে দেন সব গতি, মুহূর্তে দৃশ্যপট থমকে যায়, ফ্রিজ হয়ে যায়, আমরা হঠাৎ দর্পণে মুখ দেখার মতো চমকে উঠি; কারণ সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয় যুগান্তের পুঞ্জিভূত শোষণ, নির্যাতন আর অবহেলার ছবি। কখনো কখনো তীব্র কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে কবিতার অন্যত্র, নিঃসঙ্গতা চেপে ধরে দরিদ্র জীবনকে, যেন সব ভাষা স্তব্ধ হয়ে যায়, বঞ্চনার বিশাল বাহু চেপে ধরে মানুষের কণ্ঠনালী। কিন্তু এইসব পরস্পরবিরোধী চিত্র ও শব্দকল্প তৈরি করে একটি অবধারিত ডায়ালেকটিক। এভাবে কবিতাসমূহের ভিতরে সঞ্চারিত হয় উত্তাপ। খুঁটিয়ে পড়লে আমরা দেখব, কোনো কবিতাতেই জীবন আসলে স্থবির নয়; স্থবিরতার বিবরণ আছে, বর্ণনা আছে, কিন্তু একটি প্রত্যয় কবিতার বিষয়-আশয়ই অনিবার্য করে তোলে যে এ-জীবন সচল হবেই, হতে হবে। ফল দাঁড়ায় এই যে, অন্ধকার নিয়ে লিখেও রুদ্র অন্ধকার ছড়ান না বরং আলোকিত করেন মানুষের ভুবন; কান্না ধ্বনিত হলেও, পাঠকের চোখ ভিজে গেলেও, শেষপর্যন্ত একটি প্রতিজ্ঞা তাকে নিতে হয়, যে, আর কান্না নয়।
রুদ্রের ভাষাটি ইতিমধ্যে বহু ব্যবহৃত হয়ে গেছে, আল মাহমুদ থেকে মুহম্মদ নূরুল হুদা পর্যন্ত, এ-ভাষাটি স্থান নিয়েছে সহজিয়া গ্রামীণ চেতনার। কিন্তু রুদ্রের ভাষাটি ঐতিহ্যে স্থাপিত হলেও (অথবা ঐতিহ্যকে এড়িয়ে যেতে না-পারলেও) একান্ত তার নিজস্ব। কারণ কবিতার ভাষা তো পোশাক নয় যে, পরিয়ে দিলেই হল, কবিতার ভাষাতো হওয়া উচিত তার জৈবিক ও অকৃত্রিম ত্বক যা প্রধান চিন্তাটির জন্মের সাথে সাথে নির্মিত হয়ে যায়। রুদ্রের নিজস্ব ভাবনা নিজস্ব উপলব্ধি এই ভাষায় বাস্ময় হয়, কিছুতেই এ-ভাষাকে আরোপিত বলা যায় না।
‘মানুষের মানচিত্র’কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কবির ‘স্বীকারোক্তি’, জলো করেছে তার প্রকাশ। অনেক চমৎকার, প্রায় ভাষায় বর্ণনা না-করার মতো অনুভূতি রুদ্র জোরে সোরে অনুবাদ করে ঐ স্বীকারোক্তিতে আমাদের শুনিয়ে দেন। বত্রিশটি কবিতা যা দিতে পারে, একশ পাতা স্বীকারোক্তি তা দিতে পারে না; রুদ্র খেয়াল করেন নি যে তার স্বীকারোক্তি আসলে ঐ সব কবিতায় উচ্চারিত হয়ে যায়।
‘মানুষের মানচিত্র’ আমি মানুষকে ও তার দেশকে, সময়কে ও ইতিহাসকে পাই; কিন্তু একই সঙ্গে ভবিষ্যৎকে পাই। এই প্রাপ্তি এ-সময়ের জন্য বড় অপ্রত্যাশিত।৮৭। এই গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রাবন্ধিক হেলাল আহমেদ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন, তার অংশ –বিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা যায়–
কবির এই প্রত্যাশা, শোষিত মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম আর দায়বদ্ধতারই ভিন্নতর প্রকাশ ঘটেছে মানুষের মানচিত্র’ নামের তৃতীয় কবিতাগ্রন্থে। অর্থাৎ ‘উপদ্রুত উপকূল’ এবং ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’-এর ধারাবাহিক এবং স্মরণীয় প্রকাশই হচ্ছে মানুষের মানচিত্র। উৎসর্গপত্রের পংক্তিটিও প্রমাণ করে তিনটি কাব্যের মধ্যে কবির চেতনাগত কোনো উল্লম্ফন নেই। কেউ কি বেহুলা নেই হাড়ের খোয়াব নিয়ে বৈরী জলে ভাসে? উৎসর্গপত্রের এই আকুল জিজ্ঞাসাই শোষিত সমষ্টির প্রতি কবির অনাবিল ভালোবাসা, শোষিত মানুষের সংগ্রামে তার অঙ্গীকারবদ্ধতার সাক্ষ্য দেয়। মানুষের মানচিত্রে কবি। মানুষের যাপিত জীবনের ভাষাচিত্র অংকন করেছেন বটে কিন্তু কোন সে মানুষ? এ প্রশ্ন যেমন মৌলিক তেমনি জরুরি। এর সদুত্তর রুদ্র গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধে নিজেই দিয়েছেন : ‘সভ্যতার অগ্রযাত্রার এই পর্যায়ে মানুষ শৃংখলিত হয়েছে তার স্বরচিত কারাগারে। কিন্তু মানুষ কখনোই তার নিয়তিকে প্রতিরোধহীন মেনে নেয় নি। নির্মান এবং বিনাশ মানুষের একান্ত প্রবনতা। ‘মানুষের মানচিত্রে’ সেই শৃংখল, সেই কারাগার, সেই অন্ধকারের উন্মোচন ঘটেছে।’ এই পর্যায়েরও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন রুদ্র গ্রন্থের ‘স্বীকারোক্তি’ অংশের নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে। ‘এই পর্যায়’ বলতে তিনি মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার সেই পর্যায়কেই চিহ্নিত করেছেন যে-পর্যায়ে এসে মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়। ভূমির ওপর মানুষের ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমষ্টিস্বার্থবিমুখ মানুষ স্ব স্বার্থে নির্মাণ করে একটার পর একটা শোষণের খাঁচা। এ-সংকট উত্তরণের গোপন সিঁড়ি নিহিত আছে কেবল শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যে।
কিন্তু শ্রেণীশোষণমুক্ত এই সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় পরশ্রমজীবী ধনিক শ্ৰেণী। নির্মম হলেও সত্য, এই শোষক শ্রেণীই আজ সমাজের নিয়ন্ত্রক। অস্ত্র আর সেনাছাউনিগুলো তাদের দখলে। উৎপাদনব্যবস্থার চাবিকাঠি আর ভূমির মালিকানা তাদেরই হাতে। ফলত শোষণের স্বার্থে, সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার তৈরি করেছে আমাদের চারপাশে। তারা ক্ষুধা দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে। তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে। তারা চিকিৎসাহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে। তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দি করেছে, বুলেট দিয়ে বন্দি করেছে। (স্বীকারোক্তি) এই শোষকশ্রেণীর শোষণের অন্ধকার কারাগারে বন্দি মানুষের যাপিত জীবনের ভাষাচিত্ৰই ‘মানুষের মানচিত্র। জীবনের অন্ধকারের বীভৎস উপস্থিতি এ কাব্যে অনায়াসলভ্য। কবিও বলেছেন, ‘লক্ষ করলে প্রায় প্রতিটি কবিতায় অন্ধকার শব্দটি চোখে পড়বে–এটাও ইচ্ছাকৃত। (স্বীকারোক্তি) প্রকৃত প্রস্তাবে ‘অন্ধকার’ শব্দটির পৌনঃপুনিক প্রয়োগের মধ্য দিয়েই কবি আমাদের সমাজের নির্যাতিত ও শোষিত সমষ্টির জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন।৯০
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শুধু কবিতা-ই লেখেন নি। বিষ বিরিক্ষের বীজ’ নামে একটি নাট্যকাব্যও লিখেছেন। এটি মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থটিও মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নির্ভর একটি উৎকৃষ্ট রচনা। এ-যাবৎ তার ছয়টি গল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। গল্পগুলোও তার সাহিত্যপ্রতিভার উজ্জ্বল স্মারক। তার তিনটি গল্প ‘নিজস্ব লড়াই’, ‘ইতর’ এবং ‘সোনালি শিশির’ সম্পর্কে তরুণ গল্পকার ও প্রাবন্ধিক প্রশান্ত মৃধা লিখেছেন–
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-র গল্পত্ৰয়ী বিষয়ে, বৈচিত্রে, লিপিকৌশলে, চরিত্রের তৎপরতায় একবার গ্রামবাঙলার আবার শহুরে পানশালার প্রতিনিধিত্ব করে। তার লেখনসত্তা স্রষ্টাপ্রতিম নির্বিকার, প্রতিটি গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ অব্দি এতটুকু অতিবিভক্ততা ও কার্পণ্য অনুপস্থিত। গদ্য শরৎচন্দ্রতুল্য সরল, পাঠক বাধ্য হয় গল্পের শেষপর্ব পাঠে মনোযোগী হতে। কাহিনীর চেয়ে চরিত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়া তার স্বভাব কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের প্রতি অভালোবাসা বা অতিভালোবাসার চিহ্ন নেই। একবার ব্যক্তির উত্থান আবার পতন–ক্ষয়িষ্ণ-বিকাশমুখী চরিত্রেই খোসা খুলে দাঁড়িয়ে যায়। এইসঙ্গে ছোটগল্পে দীর্ঘবর্ণনার অবকাশ নেই–তিনি এ-সূত্র মানতেও মনোযোগী। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ গল্পের দশদিকে ছুরিচোখে তাকিয়েও অনেক ক্ষেত্রে গল্প ফেলে ডায়লগের জাল বুনছেন–দ্বন্দ্ব দাঁড়িয়ে যায়, গল্প আহত হয়, তবে রক্ষে মূলগল্প থেমে থাকে না; চলে, চলতে চলতে শেষে তার এই মারপ্যাঁচ কিন্তু পাঠককে গল্পভাবনায়, যা ছোটগল্প পাঠান্তে পাঠক আশা করে–থাকে নি। তবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ গল্প লিখতে চেয়েছেন, বলতে নয়। গতানুগতিক কাহিনী তার গল্পের শরীরে স্থান নিলেও বাজারে কাগজ গরম করা ফেনা-বাষ্প-রস-ফাজিল-মস্করাকে প্রশ্রয় দেন নি, হায়ার করেন নি দেবদাস-পারুল–প্লাস পয়েন্ট তো বটেই! কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-র গল্প–আশ্চর্য সংবাদ গল্প-পাঠক শিবিরে। বাঙলাদেশ ও পশ্চিম বাঙলায় অর্থাৎ বাঙলাসাহিত্যের প্রধান কবিদের অনেকেই কথাসাহিত্যে হাত দেন নি–গদ্য, কবিতার শত্রু এই অজুহাতে। যুগপৎ অনেকই কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাস লিখেছেন, লিখছেন, লিখবেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবি হিসাবে ছিলেন তার কালের সচেতকদের একজন-কী রাজনীতি, কী তার কবিতার ছন্দে। ইচ্ছের ঘোড়া তার ছুটেছিলো কাব্য থেকে কথাশিল্পে–পরিণতি গল্প ফেলে উপন্যাস? অস্বীকার করা যায় এমন মৃত্যু সে-অভিলাসকে না দিলো চন্দ্রে না জ্যোস্নায় ঠাই; আশা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ‘দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার’, এই উক্তিতে–এই তো কানুন!৯১
চিত্রনাট্য ও উপন্যাস রচনার পরিকল্পনা তার ছিল। কিন্তু তার আগেই অমোঘ মৃত্যু আমাদের মধ্য থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। রুদ্রের কবিতাই রুদ্রের আসল পরিচয়। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি কবি। তার কবিপ্রতিভার সামগ্রিক মূল্যায়ন এখনো হয় নি। তার সাহিত্যবৈশিষ্ট্য নিয়ে ষাটের অন্যতম কবি-প্রাবন্ধিক মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন টেকনিকের বির্বতনে যেমন আস্থা ছিল না রুদ্র-র, তেমনি আস্থা ছিল না সচেতনভাবে নতুন শরীরের কবিতা নির্মাণেও। রুদ্র-র ভাষায়, ‘ঠিক এ-মুহূর্তে আমার মাথায় কবিতা বিষয়ক কোনো নিরীক্ষার চিন্তা নেই। নতুন কিছু এলে পরবর্তী কবিতা-কর্মে তার প্রকাশ দেখা যাবে। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই এভাবে–আসলে সচেতনভাবে আলাদা কবি হওয়ার জন্য কোনো আয়োজন ছিল না রুদ্র-র। যে-কারণে কাব্যিক নিরীক্ষা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় নি সে। রুদ্র আগাগোড়া লিখতে চেয়েছে ভালো কবিতা, উত্তীর্ণ কবিতা, পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য কবিতা। যে মৌলিক কবিত্ব শক্তির অধিকারী, সে ভেতরঙ্গেই নতুন কবি। কাজেই কষ্টার্জিত মুদ্রার খেলায় নিজেকে নতুন কবি হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন থাকে না তার। রুদ্র নিজের কবিত্ব সম্বন্ধে এতোখানি নিঃসন্দেহচিত্ত ছিল যে, সে তথাকথিত নতুনত্বের কসরৎ নিয়ে কোনো কালেই ব্যস্ত ছিল না। নতুন কবিতা তো নতুন বাণী নতুন ভাষা নিয়ে আসবেই। ফলে পরিবর্তিত হয়ে চলবে কাব্যভাষা। এই সহজ বিশ্বাসে সমর্পিত রুদ্র তাই বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন ধাচে, বিভিন্ন ছন্দে কবিতা লিখেছে। গীতিকবিতা, মন্ময় প্রেমের কবিতা, তন্ময় বক্তব্যপ্রধান কবিতা, গল্পশ্রয়ী দীর্ঘ কবিতা, নাট্যকবিতা, কাব্যনাট্য– ইত্যাদি প্রচলিত বিভিন্ন আঙ্গিকের দ্বারস্থ হয়েছে সে অকৃপণভাবে। কিন্তু অযাচিতভাবে করে নি কাব্যিক স্বয়ম্ভুত্ব কিংবা আরোপিত নতুনত্ব। একে অন্য ভাষায় বলা যেতে পারে কাব্যিক বিনয় বা সদাচার, যা যে-কোনো বড় কবির মৌলিক পুঁজি। প্রকৃত কবি অকৃপণভাবে গ্রহণ করেন তাঁর পূর্বসূরিদের রচনা ও অভিজ্ঞতা থেকে, প্রভাবিত হন কাব্যজীবনের শুরুতে। কবিতার ক্ষেত্রে অ্যাবসলিউট স্বয়ম্ভু বা নতুন বলে কোনো কথা নেই, থাকতে পারে না। রুদ্র, তাই, তার সক্ষম উত্তরসূরিদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে কাব্যভাষা ও কাব্যপ্রক্রিয়া। এমনকি বিষয়ের ক্ষেত্রেও রুদ্রর কোনো অভিনবত্ব প্রয়াস নেই। রুদ্র-র কাব্যবিশ্বাস ও কাব্যপ্রয়াসের ভেতর লক্ষ করা যায় এক ধরনের অনমনীয় একরৈখিকতা। উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈতসাধনে রুদ্র ব্রতী হয়েছিলো ভিন্নমেরুনিবাসী তার এক শ্রদ্ধেয় অগ্রজের মতোই। পূর্বসূরিদের ধ্যান কম্পনা এভাবেই আত্মস্থ করেছিলো রুদ্র। যেন সে নিজের পৃথিবী নির্মাণ করতে পারে একান্ত আপনভাবেই। দূর পূর্বসূরিদের ভেতর কালিদাস ও বৈষ্ণব কবিবৃন্দ, আধুনিক বাঙালি কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, সুকান্ত, সুভাষ, সমর, জীবনানন্দ এবং তার সমকালীনদের ভেতর আল মাহমুদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ তার কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে নানা প্রয়োজনে। তীব্রভাবে আত্মসচেতন রুদ্র নিজের কাব্যিক অগ্রযাত্রা সম্পর্কে যে অনবহিত ছিলো, এমন নয়। নিজের কাব্যসাফল্য সম্পর্কে স্বভাবজাত কাব্যিক বিনয় নিয়েই সে বলেছে :
একযুগ গেল গায়ে হলুদের দিন,
আরো একযুগ বাকি আয়োজনে যাবে।
কখন আমার শুভদৃষ্টির ক্ষন?
বাসর আমার হবে কতো যুগ পরে??
****
শুরুতেই বলেছি, রুদ্রর মধ্যে যেটুকু প্রশংসার, তাকে খুঁজে দেখাই আমার উদ্দেশ্য তার কবিতার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন নয়। পরিপূর্ণ মূল্যায়নের পক্ষে আমার এই বক্তব্য ইশারা মাত্র। যারা দ্বিমত পোষণ করবেন, তাদেরকেও উসকে দিতে চাই এই মহর্তেই। রুদ্র-র কবিতার বিষয়াবলী কী, তার ছন্দ-প্রকরণ-ভাষা-উপমা-উৎপ্রেক্ষা কতটা বিষয়সম্মত এব্যাপার একাডেমিক আলোচনায় আমি অংশগ্রহণে এ-মুহূর্তে অনাগ্রহী। তীব্র ইতিহাস-সচেতন, স্বকাল-সচেতন, বাঙালির সামাজিক মানসিক ও জাতীয় মানচিত্র সচেতন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বী এই চিরতরুণ কবি নিঃসঙ্গ এক আত্মিক যাত্রা শুরু করেছিলো নতুন এক সভ্যতার স্বপ্নে—’দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।’ সকলের মাঝে থেকে, সব আন্দোলনের অগ্রভাগে নিজেকে সংস্থাপিত করেও সে ঘোষণা করেছিলো আমি একা, এই ব্রহ্মান্ডের একটি বিন্দুর মতো আমি একা। এই বোধ যতটা তার ব্যক্তিক বিপর্যয়জাত, ততোটাই তার আতিক উপলরিজাত। রুদ্র জীবনকে বুঝতে চেয়েছিলো তার নিজের জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে পাঠ করেই, তার আশেপাশের মানুষ-পুস্তকগুলোর সঙ্গে নিজের পৃষ্ঠাগুলোকে মিলিয়েই। তার পাশে প্রবহমান জীবনস্রোতের সঙ্গে তার নিজস্ব স্রোত ছিলো বড় বেশি বৈসাদৃশ্যপূর্ণ, বড় বেশি বেমানান। মানুষের মানচিত্রে’ আঁকা দুঃখী ও বাস্তবক্লিষ্ট মানুষগুলোর ভেতর যে পেশল আদিম শক্তিধর মানুষের উত্থান কামনা করেছিলো সে, সে-ও এক কাব্যিক ইউটোপিয়া। তবে গায়েহলুদের শেষে শুভদৃষ্টির ক্ষণ তো এসেছিলো রুদ্র-র জীবনেও। সভ্যতার সমানবয়সী সেই কাব্যসম্মত কনেটির সাথে শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছিলো রুদ্র-র, কিন্তু বাসর হলো না। হয় কি কোনো কবির?৯২
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনদর্শন ও সাহিত্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান-এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর যে-পরিচিতি মুদ্রিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে–
পঁচাত্তরের পরের সবকটি সরকারবিরোধী ও স্বৈরাচাবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ। প্রতিবাদী কবি হিসেবে খ্যাত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তার কবিতায় বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত। এছাড়া স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে রুদ্রের কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। কবিকণ্ঠে কবিতা-পাঠে যে কজন কবি কবিতাকে শ্রোতৃপ্রিয় করে তোলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।৯৩
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সাহিত্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন, বক্তব্যে তীব্র কিন্তু শব্দ-ও-ছন্দপ্রয়োগে শিল্পময় প্রথানুসারী।৯৪ এ-মন্তব্যের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ ঐকমত্য পোষণ করতে পারি।