একাদশ অধ্যায় —জীবদের ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রম
নূতন প্রজাতিদের মন্থর এবং পর্যায়ক্রমিক আবির্ভাব—এদের পরিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন হারলুপ্ত প্রজাতিরা পুনরাবির্ভূত হয় না—একটি একক প্রজাতির মত প্রজাতিদের গোষ্ঠীরা তাদের আবির্ভাবে এবং অন্তর্ধানে একই সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করে—বিলুপ্তি—সমগ্র পৃথিবীতে জীবন-আকারদের যুগপৎ পরিবর্তনসমূহ—পরস্পরের এবং জীবিত আকারদের সঙ্গে বিলুপ্ত প্রজাতিদের সম্বন্ধে– প্রাচীন আকারদের বিকাশ-একই অঞ্চলের একই ধরনগুলোর পর্যায়ক্রম—পূর্ববর্তী এবং বর্তমান অধ্যায়ের সারাংশ।
জীবের ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রম সম্পর্কিত কিছু বিষয় ও নিয়ম প্রজাতিদের অপরিবর্তনশীলতা সম্বন্ধে এবং পরিবৃত্তি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মন্থর ও পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর সম্বন্ধে সাধারণ মতবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা এখন আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
নূতন প্রজাতিরা, স্থলে ও জলে, একটির পর অন্যটি অতিশয় মন্থরভাবে আবির্ভূত হয়েছে। লিয়েল দেখিয়েছেন যে টার্শিয়ারি ধাপে প্রাপ্ত কয়েকটি সাক্ষ্যপ্রমাণের বিরোধিতা করা কখনওই সম্ভব নয়; এবং ধাপগুলির মধ্যে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা প্রতিবছর হচ্ছে, এবং লুপ্ত ও বর্তমান আকারদের মধ্যে অনুপাতটিকে আরও পর্যায়ক্রমিক করার চেষ্টা হচ্ছে। অধিকাংশ সাম্প্রতিক স্তরগুলোর কয়েকটিতে, যদিও বছর দ্বারা পরিমাপ করলে সন্দেহাতীতভাবে অতিশয় আদিম, হয় স্থানীয়ভাবে, অথবা যতদূর আমরা জানি পৃথিবীতে প্রথমবার আবির্ভূত হয়ে শুধুমাত্র এক অথবা দুটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয় এবং শুধু এক অথবা দুটি নূতন হয়। গৌণ (দ্বিতীয় পর্যায়ক্রমিক) ভূস্তরগুলো আরও ভঙ্গিল হয়; কিন্তু ব্রনের মন্তব্যানুসারে, প্রত্যেক গঠনস্তরে সমাহিত অনেক প্রজাতির হয় আবির্ভাব অথবা অন্তর্ধান যুগপৎ হয় না।
বিভিন্ন গণ ও শ্রেণীর অন্তর্গত প্রজাতিরা একই হারে অথবা একই মাত্রায় পরিবর্তিত হয় না। পুরানো টার্শিয়ারি স্তরগুলোতে, অসংখ্য বিলুপ্ত আকারের মধ্যে কিছু জীবন্ত খোলকী প্রাণীদের এখনও দেখতে পাওয়া যেতে পারে। ফ্যালকনার এ বিষয়ে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ দিয়েছেন, কারণ হিমালয়ের প্রান্তদেশের পাললিক স্তরে অনেক লুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সরীসৃপদের সঙ্গে একটি জীবিত কুমির দেখতে পাওয়া গেছে। সিলুরিয়ান পর্বের লিঙ্গুলা গণের অন্তর্গত প্রজাতিরা জীবিত প্রজাতিদের থেকে অল্প ভিন্ন হয়; পক্ষান্তরে সিলুরিয়ান পর্বের অন্য কম্বোজ (মোলাস্কা) প্রাণীদের অধিকাংশই এবং সমস্ত বর্মী বা খোলকী (ক্রাস্টেসিয়ান) প্রাণীরা বিপুলভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। স্থলভাগের উৎপাদনগুলো সম্ভবত সামুদ্রিক উৎপাদনগুলোর তুলনায় দ্রুতহারে পরিবর্তিত হয়েছে, যার একটি সুন্দর উদাহরণ সুইজারল্যান্ডে লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্বাস করার কিছু কারণ আছে যে উচ্চ শ্রেণীভুক্ত জীবরা নিম্ন শ্রেণীভুক্ত জীবদের তুলনায় আরও দ্রুত পরিবর্তিত হয়—যদিও এই নিয়মের ব্যতিক্রম আছে। যেমন পিকটেট মন্তব্য করেছেন যে জৈবিক পরিবর্তনের পরিমাণটি প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক তথাকথিত ভূস্তরে একই হয় না। তথাপি যদি আমরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত ভূস্তরগুলোর তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে সমস্ত প্রজাতিদের কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে। একটি প্রজাতি যখন পৃথিবী থেকে একদা বিলুপ্ত হয়, আমার বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে একই সমরূপ আকারটি কখনও পুনরায় আবির্ভূত হয়। এই নিয়মটির সবচেয়ে শক্তিশালী আপাত ব্যতিক্রম হচ্ছে এম. ব্যারান্ডের তথাকথিত উপনিবেশগুলো’ (কলোনিগুলো), যা একটি পুরানো গঠনস্তরের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য প্রবেশ করে, তারপর পূর্বে অবস্থিত প্রাণীটির পুনরাবির্ভাব ঘটায়; কিন্তু একটি ভিন্ন ভৌগোলিক প্রদেশ থেকে অস্থায়ী প্রচরণের ঘটনা সম্পর্কে লিয়েলের ব্যাখ্যাটি মনে হয় সন্তোষজনক।
এইসব তথ্য আমাদের তত্ত্বের সঙ্গে সঠিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ, যা একটি অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসীদের আকস্মিকভাবে অথবা যুগপৎভাবে কিংবা একটি সমমাত্রায় পরিবর্তন ঘটানোর জন্য দায়ী বিকাশের স্থায়ী নিয়মকে অন্তর্ভুক্ত করে না। রূপান্তর প্রক্রিয়াটি নিশ্চয় মন্থর হবে এবং একই সময়ে শুধুমাত্র কতিপয় প্রজাতিকেই সাধারণতঃ প্রভাবিত করবে; কারণ প্রত্যেক প্রজাতির পরিবর্তনশীলতা অন্যদের তুলনায় স্বাধীন। এরূপ পরিবর্তনগুলো অথবা এককীয় পার্থক্যগুলো, যা উদ্ভূত হতে পারে, কম অথবা বেশী মাত্রায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সঞ্চিত হবে কিনা, যা কম অথবা বেশী স্থায়ী রূপান্তর ঘটায়, তা অনেক জটিল ও অনিশ্চিত সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল হবে—সুফলদায়ক পরিবৃত্তির ওপর, আন্তঃসঙ্করণের স্বাধীনতার ওপর, দেশটির ভৌত অবস্থার মন্থর পরিবর্তনের ওপর, নতুন উপনিবেশ স্থাপনকারীদের অভিবাসনের ওপর এবং অন্য অধিবাসীদের প্রকৃতি বা স্বভাবের ওপর, যাদের সঙ্গে পরিবর্তনশীল প্রজাতিরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। সুতরাং এটি কোন মতেই আশ্চর্যজনক নয় যে অন্যদের তুলনায় একটি প্রজাতি দীর্ঘতর সময় একই রূপ বজায় রাখবে; অথবা, যদি পরিবর্তিত হয়, কম মাত্রায় পরিবর্তিত হবে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের বর্তমান অধিবাসীদের মধ্যে সদৃশ সম্পর্কগুলো আমরা লক্ষ্য করি; উদাহরণস্বরূপ, ম্যাডেইরার স্থলভাগের বর্মী বা খোলকী প্রাণীরা এবং কোলিউপটেরাস পতঙ্গরা ইউরোপ মহাদেশে এদের খুব নিকট সম্বন্ধযুক্তদের থেকে বিশেষভাবে ভিন্ন হয়, পক্ষান্তরে, সামুদ্রিক বর্মী বা খোলকী প্রাণী ও পাখিরা অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। আগের একটি অধ্যায়ে ব্যাখ্যাত অজৈব এবং জৈব পরিবেশের সঙ্গে উচ্চতর জীবদের আরও জটিল সম্পর্কগুলো দ্বারা সামুদ্রিক এবং নিম্নতর উৎপাদনগুলোর তুলনায় স্থলভাগের এবং উচ্চতর জীবদের পরিবর্তনের আপাত দ্রুত হার সম্পর্কে আমরা বোধহয় বুঝতে পারি। যে-কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অনেকেই যখন রূপান্তরিত এবং উন্নত হয়, তখন আমরা প্রতিযোগিতার নিয়মানুসারে এবং জীবনসংগ্রামে জীবের সঙ্গে জীবের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো অনুসারে, বুঝতে পারি যে—কোন আকার, যা কিছুমাত্রায় রূপান্তরিত এবং উন্নত হয় না, ধ্বংস হতে বাধ্য। অতএব অনেক সময় অন্তর আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে একই অঞ্চলের সব প্রজাতিরা কেন অন্ততঃ রূপান্তরিত হয় তা আমরা বুঝতে পারি, কারণ অন্যথায় এরা বিলুপ্ত হবে।
একই শ্রেণীর সদস্যদের পরিবর্তনের গড় পরিমাণ দীর্ঘ এবং সমান সময়ে বোধ হয় প্রায় একই হতে পারে; কিন্তু জীবাশ্মপূর্ণ স্থায়ী ভুস্তরগুলোর পুঞ্জীভবন অবনমিত অঞ্চলে বিরাট পরিমাণ পলির ওপর নির্ভর করে বলে আমাদের ভূগঠনস্তরগুলো ব্যাপক অনিয়মিত সবিরাম সময়ের অন্তরে প্রায়শই মূলত সঞ্চিত হয়েছে; ফলস্বরূপ, পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলোতে সমাহিত জীবাশ্ম দ্বারা প্রদর্শিত জৈবিক পরিবর্তনের পরিমানটি সমান হয় না। এই মতানুসারে প্রত্যেক ভূগঠনস্তর সৃষ্টির একটি নূতন এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে না, বরং একটি মন্থরভাবে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল নাটকের আকস্মিকভাবে নেওয়া শুধুমাত্র একটি আকস্মিক দৃশ্যকে চিহ্নিত করে।
আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি কেন একদা বিলুপ্ত একটি প্রজাতি কখনও পুনরাবির্ভূত হবে না, এমনকি যদি জৈবিক এবং অজৈবিক একই জীবন-পরিবেশ পুনর্বার ফিরে আসে তাহলেও না। কারণ যদিও একটি প্রজাতির বংশধর প্রকৃতিমণ্ডলে অন্য প্রজাতির স্থান পূরণের জন্য (এবং সন্দেহ নেই যে এটি অসংখ্যবার ঘটেছে) অভিযোজিত হয়েছে এবং একে স্থানচ্যুত করেছে, তথাপি পুরাতন এবং নূতন দুটি আকার একইরূপ হবে না, কারণ উভয়েই তাদের ভিন্ন ভিন্ন পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে প্রায়শই পেয়ে থাকবে; এবং ইতিমধ্যে ভিন্ন হওয়া জীবরা একটি ভিন্ন উপায়ে পরিবর্তিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সব লক্কা পায়রা যদি বিনষ্ট হত, তাহলে এটি সম্ভবপর যে পায়রা-প্রেমিকরা বর্তমান জাত থেকে কদাচিৎ পৃথক করা যায় এখন একটি নূতন জাত সৃষ্টি করত; কিন্তু পিতামাতা পাহাড়ী পায়রারা যদি এভাবে লুপ্ত হত এবং আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে প্রাকৃতিক অবস্থায় এদের উন্নত বংশধররা সাধারণতঃ এদের পিতামাতা আকারকে স্থানচ্যুত এবং ধ্বংস করেছে, তাহলে এটি অবিশ্বাস্য যে বর্তমান জাতটির সমরূপ একটি লক্কা পায়রা পায়রাদের যে-কোন প্রজাতি থেকে অথবা গৃহপালিত পায়রাদের সুপ্রতিষ্ঠিত যে-কোন জাত থেকে সৃষ্টি করা যেতে পারত, কারণ পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনসমূহ নিশ্চয় কিছুমাত্রায় ভিন্ন হবে এবং নূতন সৃষ্ট ভ্যারাইটি তার জনকের থেকে কিছু বৈশিষ্ট্যমূলক পার্থক্য সম্ভবত বংশগতভাবে পাবে।
প্রজাতিগোষ্ঠীরা, অর্থাৎ গণ ও গোত্রগুলো, কম অথবা বেশী দ্রুত হারে এবং কম ও বেশী মাত্রায় পরিবর্তিত হয়ে একটি একক প্রজাতির মত আবির্ভাব ও অন্তর্ধানের একই সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করে। একদা ধ্বংস হওয়ার পর একটি গোষ্ঠী কখনও পুনরাবির্ভূত হয় না; অর্থাৎ এর অবস্থান, যতদিন এটি স্থায়ী হয়, নিরবচ্ছিন্ন হয়। আমি জানি এই নিয়মের কিছু আপাত ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু ব্যতিক্রমগুলো আশ্চর্যজনকভাবে অল্প। এত অল্প যে ই. ফরবেস, পিকটেট এবং উডওয়ার্ড (যদিও সকলে আমার মতের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন -এর মত বিজ্ঞানীরা এর সত্যতা স্বীকার করেন; এবং নিয়মটি তত্ত্বটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ একই গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিরা, যতদিনই স্থায়ী হোক না কেন, অন্যদের এবং সকলের একটি সাধারণ জনকের রূপান্তরিত বংশধর হয়। উদাহরণস্বরূপ, লিঙ্গুলা গণের প্রজাতিরা, যারা সমস্ত যুগে পর্যায়ক্রমিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে, সর্বনিম্ন সিলুরিয়ান পর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু প্রজন্মের একটি ধারাবাহিক শ্রেণীর দ্বারা নিশ্চয় সংযুক্ত হয়ে থেকেছে।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীগুলো কোন কোন সময় ভুলবশতঃ মনে হয় আকস্মিকভাবে উদ্ভূত হয়েছে, এবং এই বিষয়টির একটি ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছি আমি। তা যদি সত্য হয়, তাহলে তা আমার মতবাদের পক্ষে সর্বনাশা হবে, কিন্তু এরূপ ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম; সাধারণ নিয়মটি হচ্ছে সংখ্যার একটি ক্রমিক বৃদ্ধি, যতক্ষণ না গোষ্ঠীটি সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছায় এবং তারপর আগে অথবা পরে একটি ক্রমিক হ্রাস, একটি গণের অন্তর্গত প্রজাতিদের সংখ্যা অথবা একটি গোত্রের অর্ন্তগত গণসমূহের সংখ্যাকে যদি প্রজাতিদের সন্ধান পাওয়া যায় এমন পর্যায়ক্রমিক ভূতাত্ত্বিক গঠনস্তরগুলোর মধ্য দিয়ে উত্থিত পরিবর্তিত গভীরতার একটি উল্লম্বরেখা দ্বারা সূচিত হয়, তাহলে রেখাটি একটি তীক্ষ্ণ বিন্দুতে নয় বরং আকস্মিকভাবে এর নিচের প্রান্তে আরম্ভ হয়েছে বলে কোন কোন সময় ভুলবশতঃ মনে হবে; একটি জায়গার জন্য সমান গুরুত্ব রেখে তারপর ক্রমশ ওপরের দিকে এটি পাতলা হয়, এবং অবশেষে প্রজাতিদের হ্রাস এবং বিলুপ্তিকে চিহ্নিত করে ওপরের স্তরগুলোতে পাতলা হয়। একটি গোষ্ঠীর প্রজাতিদের সংখ্যার এই ক্রমিক বৃদ্ধি যথাযথভাবে তত্ত্বটির অনুরূপ হয়, কারণ একই গণের প্রজাতিরা এবং একই গোত্রের গণগুলো শুধুমাত্র মন্থর ও ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে; রূপান্তর এবং সম্পর্কিত আকারদের একটি সংখ্যার উৎপাদন এক মন্থর ও ক্রমিক প্রক্রিয়া—একটি প্রজাতি প্রথমে দুটি অথবা তিনটি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে, পরে এগুলো ধীরে ধীরে প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়, তারপর এগুলো একইরূপে ধীরে ধীরে অন্য ভ্যারাইটি এবং প্রজাতি সৃষ্টি করে এবং একটিমাত্র কাণ্ড থেকে একটি বিরাট বৃক্ষের শাখাবিন্যাসের মত গোষ্ঠীটি বিরাট হয়ে ওঠা পর্যন্ত এরূপ চলতে থাকে।
বিলুপ্তি
প্রজাতিদের এবং প্রজাতি-গোষ্ঠীদের অন্তর্ধানের বিষয়ে এতক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী, পুরানো আকারদের বিলুপ্তি এবং নূতন ও উন্নত আকারদের উৎপাদন ঘনিষ্ঠভাবে একত্রে যুক্ত। পর্যায়ক্রমিক যুগের বিপর্যয় দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীদের বিনষ্ট হওয়ার পুরানো ধারণাটি অতি সাধারণভাবে এমনকি সব ভূতত্ত্ববিদদের দ্বারাও পরিত্যক্ত হয়েছে, যেমন এলি ডে বিউমণ্ট, মুর্চিসন, ব্যারান্ডে এবং আরও অনেকে, যাঁদের সাধারণ মতবাদ এই সিদ্ধান্তে আসতে স্বাভাবিকভাবে পথপ্রদর্শন করবে। পক্ষান্তরে, টার্শিয়ারি ভূস্তরসমূহ পর্যালোলোচনার পর আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে প্রজাতিরা এবং প্রজাতি-গোষ্ঠীরা প্রথমে এক জায়গা থেকে, পরে অন্য জায়গা থেকে এবং অবশেষে পৃথিবী থেকে একের পর এক ক্রমশ বিলুপ্ত হয়। তবে অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে, যেমন একটি যোজকের বিচ্ছিন্ন হওয়ার দ্বারা এবং সংলগ্ন সমুদ্রে অসংখ্য নূতন অধিবাসীদের প্রবেশের দ্বারা অথবা একটি দ্বীপের অবশেষে অবনমনের দ্বারা বিলুপ্তি প্রক্রিয়াটি দ্রুত ঘটে থাকতে পারে। একক প্রজাতিরা ও প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠীগুলো উভয়েই অসমান সময়কাল স্থায়ী হয়; যেমন আমরা দেখেছি কিছু গোষ্ঠী আমাদের জ্ঞাত বহু প্রাচীন জীবনের প্রথম আবির্ভাব থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে; পুরাজীবীয় যুগ শেষ হওয়ার আগে কিছু বিলুপ্ত হয়েছে। যে-কোন একটি প্রজাতি অথবা গণের স্থায়ী হওয়ার সময়কালের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই বলেই মনে হয়। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে প্রজাতিদের একটি সমগ্র গোষ্ঠীর বিলুপ্তি এদের উৎপাদনের তুলনায় সাধারণতঃ একটি মন্থর প্রক্রিয়া : আগের মত এদের আবির্ভাব এবং অন্তর্ধান পরিবর্তনশীল পুরুত্বের একটি উল্লম্বরেখা দ্বারা যদি সূচিত করা হয়, তাহলে প্রথম আবির্ভাব ও প্রজাতিদের প্রথম সংখ্যাবৃদ্ধিকে চিহ্নিতকারী নিম্নতর প্রান্তের তুলনায়, তাদের বিলুপ্তিকে চিহ্নিতকারী উচ্চতর প্রান্তের দিকে, এটি ক্রমশ আরও সরু হতে শুরু করবে। কয়েকটি ক্ষেত্রে, অ্যামোনাইটদের মত সমগ্র গোষ্ঠীদের বিলুপ্তি মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে বিস্ময়করভাবে হঠাৎ হয়েছে।
প্রজাতিদের বিলুপ্তি অকারণ রহস্যের জালে জড়িত রয়েছে। কয়েকজন লেখক এখনও মনে করেন যে যেহেতু একটি এককের নির্দিষ্ট জীবনকাল থাকে, সেহেতু প্রজাতিদেরও একটি নির্দিষ্ট স্থায়িত্বকাল আছে। প্রজাতিদের বিলুপ্তি সম্পর্কে আমি যা বলেছি তার তুলনায় অন্য কেউ বেশী বিস্ময়কর কিছু বলেননি। অতি সাম্প্রতিক ভূতাত্ত্বিক যুগ পর্যন্ত এখনও জীবিত খোলকী প্রাণীদের সঙ্গে সহাবস্থান করা ম্যাস্টোডন, মেগাথেরিয়াম, টক্সোডন এবং অন্যান্য বিলুপ্ত বিস্ময়কর প্রাণীদের জীবাশ্মের সঙ্গে, লা প্লাটাতে একটি ঘোড়ার দাঁতগুলি সমাহিত অবস্থায় দেখে, আমি অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম; কারণ দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিয়ার্ডদের দ্বারা এদের প্রবর্তনের সময় থেকে ঘোড়া সমগ্র দেশে বন্য প্রকৃতির হয়েছে এবং অচিন্ত্যনীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে—এটি লক্ষ্য করে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম যে আপাতভাবে এত অনুকূল পরিবেশে পূর্বের ঘোড়াকে কি এত সাম্প্রতিককালে বিনষ্ট করা যেতে পারে! কিন্তু আমার বিস্ময় যুক্তিহীন। অধ্যাপক ওয়েন তখনই আবিষ্কার করেছিলেন যে দাঁতগুলো একটি বিলুপ্ত প্রজাতির, যেগুলো বর্তমান ঘোড়ার মত। কিছুমাত্রায় বিরল অবস্থায় যদি এই ঘোড়াটি এখনও জীবিত থাকত, তাহলে কোন প্রকৃতিবিদ এর বিরলতায় অন্ততঃ আশ্চর্য অনুভব করতেন না; কারণ বিরলতা হচ্ছে সমস্ত দেশের সমস্ত শ্রেণীর অসংখ্য প্রজাতির একটি বৈশিষ্ট্য। যদি আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি—কোন প্রজাতি কেন বিরল হয়, তাহলে তার উত্তর হল যে এদের জীবন-পরিবেশের কিছু প্রতিকূলতা রয়েছে; কিন্তু ঐ কিছুটা যে কি তা আমরা কদাচিৎ বলতে পারি। জীবাশ্ম-ঘোড়াটি বিরল প্রজাতি হিসেবে এখনও জীবিত আছে মনে করে, অন্য সকল স্তন্যপায়ীর উপমা থেকে, এমনকি মন্থর জননক্ষমতাসম্পন্ন হাতির উপমা থেকে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় গৃহপালিত ঘোড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্তকরণের ইতিহাস থেকে আমরা নিশ্চয় আঁচ করতে পারব যে আরও অনুকূল পরিবেশে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এটি সমগ্র মহাদেশে পূর্ণ হবে। কিন্তু আমরা বলতে পারব না যে প্রতিকূল পরিবেশগুলি কি ছিল যা এদের বৃদ্ধিতে বাধা দিয়েছিল, যথা এক অথবা একাধিক বাধা ছিল কিনা, এবং ঘোড়ার জীবনের কোন্ বয়সে এবং কি পরিমাণ এরা বিক্রিয়া করেছিল। যদি, ক্রমে ক্রমে ক্রমপরিমাণে অনুকূল হতে পরিবেশ মন্থরভাবে অপসারিত হত, তাহলে নিশ্চিত রূপে আমরা বিষয়টি জানতে পারতাম না, তথাপি জীবাশ্ম-ঘোড়া নিশ্চয় বিরল থেকে বিরলতর হয়ে থাকবে এবং অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে—কোন সার্থক প্রতিযোগী এর স্থান অধিকার করে থাকবে।
এটি মনে রাখা সবসময় অত্যন্ত কষ্টকর যে প্রত্যেক জীবের বৃদ্ধি আমাদের অজানা বিরুদ্ধ শক্তিগুলোর দ্বারা অনবরত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে; এবং এইসব একই অজানা শক্তিগুলো বিরলতা এবং অবশেষে বিলুপ্তি ঘটাতে যথেষ্ট। এই বিষয়টি সম্পর্কে এত অল্প জানা যায় যে বারংবার প্রকাশিত কথাটি শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে এত বিরাট বিস্ময়কর ম্যাস্টোডন এবং আরও প্রাচীন ডাইনোসরাসরা বিলুপ্ত হয়েছে; যেন শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষমতাই জীবন—সংগ্রামে বিজয় এনেছিল। পক্ষান্তরে, ওয়েনের বক্তব্য অনুসারে, শুধুমাত্র আকার কিছু ক্ষেত্রে প্রভূত পরিমাণ খাদ্যের জন্য দ্রুত ধ্বংস হওয়াকে নির্ধারণ করবে। ভারতবর্ষ অথবা আফ্রিকায় মানুষের বসবাসের পূর্বে, কোন কারণ নিশ্চয় বর্তমানের হাতিদের অনবরত বৃদ্ধিকেনিয়ন্ত্রণ করেছিল। সুদক্ষ বিচারক ডঃ ফ্যালকনার বিশ্বাস করেন যে প্রধানতঃ পতঙ্গরাই এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে, যারা এদের অনবরত বিরক্ত এবং দুর্বল করে; এবং আবিসিনিয়ায় আফ্রিকান হাতিদের সম্পর্কে এটিই ব্রুসের সিদ্ধান্ত ছিল। এটি নিশ্চিত যে পতঙ্গরা এবং রক্তশোষক বাদুড়রা দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি অংশে প্রাকৃতিক পরিবেশে অভ্যস্ত বৃহত্তর চতুষ্পদদের অবস্থান নির্ধারণ করে।
আরও সম্প্রতি টার্শিয়ারি ভূস্তরে অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে বিরলতা হচ্ছে বিলুপ্তির পূর্বাবস্থা; এবং আমরা জানি যে সেইসব প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে ঘটনা, যারা হয় স্থানীয়ভাবে অথবা সামগ্রিকভাবে মানুষের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ১৮৪৫ সালে আমি যা বলেছিলাম তা আমি পুনরাবৃত্তি করতে পারি যে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বে প্রজাতিরা সাধারণতঃ বিরল হয় বলে স্বীকার করা এবং একটি প্রজাতির বিরলতায় বিস্মিত না হওয়া এবং প্রজাতিদের অস্তিত্ব লোপ পাওয়ায় ভীষণভাবে বিস্মিত হওয়া, এর অর্থ প্রায় এটি স্বীকার করার সমতুল যে কোন মানুষের অসুস্থ অবস্থা তার মৃত্যুর পূর্বাবস্থা এবং মানুষটির অসুস্থতায় আদৌ বিস্মিত না হওয়া, কিন্তু অসুস্থ মানুষটি মারা গেলে তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়া এবং সন্দেহ করা যে কোন হিংস্র কাজের ফলেই সে মারা গেছে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বটি এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে প্রত্যেক নূতন ভ্যারাইটি এবং পরিশেষে প্রত্যেক নূতন প্রজাতি তাদের প্রতিযোগীদের ওপর কিছু সুবিধামূলক প্রাধান্য বিস্তারের মাধ্যমে সৃষ্ট ও প্রতিপালিত হয়েছে, ফলস্বরূপ কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত আকারদের বিলুপ্তি অনিবার্যরূপে ঘটে। আমাদের গৃহপালিত উৎপাদনগুলোর ক্ষেত্রেও একইরূপ হয়; কোন নূতন এবং অল্প উন্নত ভ্যারাইটি উদ্ভূত হলে, সেটি প্রথমে সন্নিহিত অঞ্চলের কম উন্নত ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত করে; আরও উন্নত হয়ে উঠলে আমাদের ছোট শিংওয়ালা গোমহিষাদির মত তারা দূরাঞ্চলে পরিবাহিত হয় এবং অন্য দেশগুলোর অন্য জাতদের স্থান গ্রহণ করে। এরূপ নূতন আকারদের আবির্ভাব এবং পুরানো আকারদের অন্তর্ধান, স্বাভাবিক ও কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট উভয়েই একত্রে যুক্ত হয়। বর্ধনশীল গোষ্ঠীগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্ট হওয়া বিশেষ আকারদের সংখ্যা বিনষ্ট হওয়া পুরানো বিশেষ আকারদের সংখ্যার তুলনায় কোন কোন সময় সম্ভবত বিরাটতর হয়েছে; কিন্তু আমরা জানি যে প্রজাতিরা অন্তত পরবর্তী ভূতাত্ত্বিক পর্বে অনির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধি পায় না, অতএব পরবর্তী সময়গুলো লক্ষ্য করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে নূতন আকারদের সৃষ্টি প্রায় একই সংখ্যক পুরানো আকারের বিলুপ্তির কারণ হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে যে সব দিক থেকে অতিশয় সমরূপ আকারদের পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতাটি সাধারণতঃ অত্যন্ত কঠোর হবে। অতএব একটি প্রজাতির উন্নত এবং রূপান্তরিত বংশধররা পিতামাতা প্রজাতিদের সাধারণতঃ ধ্বংস ঘটাবে; এবং যে-কোন একটি প্রজাতি থেকে যদি অনেক নূতন আকার উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে ঐ প্রজাতির নিকটতম আত্মীয়দের অর্থাৎ একই গণের প্রজাতিদের ধ্বংসের সম্ভাবনা প্রবল হবে। আমার বিশ্বাস মত এরূপে একটি প্রজাতি থেকে উদ্ভূত কিছু নূতন প্রজাতি অর্থাৎ একটি নূতন গণ একই গোত্রের অন্তর্গত একটি পুরানো গণকে স্থানচ্যুত করে। কিন্তু এটি প্রায়শই ঘটেছে যে-কোন একটি গোষ্ঠীর একটি নূতন প্রজাতি একটি ভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্গত একটি প্রজাতির দ্বারা অধিকৃত স্থান অধিকার করেছে এবং তার ধ্বংসের কারণ হয়েছে। অনেক সম্বন্ধযুক্ত আকাররা যদি সার্থক অনুপ্রবেশকারী থেকে উদ্ভূত হয়, তাহলে অনেককেই তাদের স্থানত্যাগ করতে হবে এবং এরা সাধারণতঃ সম্বন্ধযুক্ত আকার হবে যারা সাধারণভাবে বংশগত হীনতা সহ্য করবে। কিন্তু প্রজাতিরা একই অথবা ভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্গত হোক বা না-ই হোক, যারা উন্নত এবং রূপান্তরিত প্রজাতিদের জন্য নিজেদের স্থানত্যাগ করেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েকটি কোন বিস্ময়কর জীবন-পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে অথবা কোন দূরবর্তী বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে দীর্ঘদিন ধরে প্রায়শই সংরক্ষিত হয়ে থাকতে পারে, যেখানে এরা কঠোর প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত হয়ে থাকবে। যেমন, মধ্যজীবীয় যুগের ভূস্তরে খোলকী প্রাণীদের একটি বিরাট গণ ট্রিগনিয়ার কিছু প্রজাতি অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রগুলিতে বেঁচে আছে; এবং গ্যানয়েড মাছদের বিরাট এবং প্রায় বিলুপ্ত গোষ্ঠীর কতিপয় সদস্য আমাদের স্বাদু জলে এখনও বসবাস করে। সুতরাং, কোন গোষ্ঠীর সৃষ্টির তুলনায় তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি সাধারণতঃ একটি মন্থরতর প্রক্রিয়া।
পুরাজীবীয় যুগের শেষের দিকে ট্রাইলোবাইটদের এবং মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে অ্যামোনাইটদের মত সমগ্র গোত্র অথবা অর্ডারদের আপাতভাবে হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হওয়া সম্পর্কে, আমরা নিশ্চয় স্মরণ করব পর্যায়ক্রমিক ভূস্তরগুলোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে ইতিমধ্যে কি বলা হয়েছে; এবং এই সময়ের ব্যবধানে অতি মন্থর নিশ্চিহ্নকরণ হয়ে থাকতে পারে। অধিকন্তু, আকস্মিক অভিবাসন অথবা অতি দ্রুত বিকাশের দ্বারা যখন একটি নূতন গোষ্ঠীর অনেক প্রজাতি একটি অঞ্চল অধিকার করে নেয়, তখন পুরানো প্রজাতিদের অনেকেই অনুরূপ দ্রুত হারে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে; এবং এরূপে এদের স্থানত্যাগ করা আকাররা সাধারণভাবে আত্মীয় হবে, কারণ এরা একই হীনতার অংশীদার হবে।
আমার মনে হয়, একটি প্রজাতি এবং প্রজাতিদের সমগ্র গোষ্ঠী যে উপায়ে বিলুপ্ত হয়েছে, তা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ, বিলুপ্তিতে অবাক হওয়া আমাদের উচিত নয়; যদি আমাদের অবাক হতেই হয়, তাহলে কয়েক মুহূর্ত কল্পনা করে আমাদের নিজস্ব অনুমান হওয়া উচিত যে আমরা অনেক জটিল ও অনিশ্চিত সম্ভাবনার কথা জানি যেগুলোর ওপর প্রত্যেক প্রজাতির অবস্থান নির্ভর করে। কিছুক্ষণের জন্য যদি আমরা ভুলে যাই যে প্রত্যেক প্রজাতি অনির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধির প্রবণতাযুক্ত হয় এবং কিছু নিয়ন্ত্রণ সবসময় ক্রিয়া করে, যা কদাচিৎ আমরা অনুভব করি, তাহলে সমগ্র প্রকৃতিমণ্ডল সম্পূর্ণ অস্পষ্ট হয়ে থাকবে। আমরা যখন বিশেষভাবে বলতে পারি কেন একটি প্রজাতি অন্য একটির তুলনায় সংখ্যায় বেশী হয়, কেন একটি প্রজাতিকে একটি নির্দিষ্ট দেশের পরিবেশানুগ করা যেতে পারে এবং অন্য একটিকে করা যায় না—একমাত্র তখনই আমরা সঠিকভাবে অনুভব করতে পারি কেন বিশেষ প্রজাতির অথবা প্রজাতি-গোষ্ঠীর বিলুপ্তির কারণ আমরা দেখাতে পারি না।
সমগ্র পৃথিবীতে জীবন-আকারগুলির যুগপৎ পরিবর্তন
জীবন-আকাররা সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় যুগপৎ পরিবর্তিত হয়—এই বিষয়টির তুলনায় যে-কোন জীবাশ্মমূলক আবিষ্কার কদাচিৎ আরও আশ্চর্যজনক হতে পারে। এভাবে আমাদের ইউরোপীয় চুনাপাথর স্তরসমষ্টি অতিশয় ভিন্ন জলবায়ু অধ্যুষিত অনেক দূরবর্তী অঞ্চলেও দেখা যেতে পারে, যেখানে খনিজ চুনাপাথরের একটি ক্ষুদ্রাংশও দেখা যায় না; যেমন উত্তর আমেরিকায়, দক্ষিণ আমেরিকার বিষুব অঞ্চলে, টিয়েরা ডেল ফুয়েগোতে, উত্তমাশা অন্তরীপে এবং দক্ষিণ ভারতে। এইসব দূরবর্তী জায়গায়, কোন কোন স্তরে জৈব অবশিষ্টাংশগুলো চুনাপাথর যুগের জৈব অবশিষ্টাংশের সঙ্গে একটি অভ্রান্ত সদৃশতা প্রদর্শন করে। ব্যাপারটা এই নয় যে সর্বত্র একই প্রজাতি পাওয়া যায়; কারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রজাতিটি সমরূপ হয় না, কিন্তু এরা একই গোত্র, গণ এবং গণের খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং কোন কোন সময় বাইরের ভাস্কর্যের মত তুচ্ছ বিষয়ের দ্বারা একইভাবে বর্ধিত হয়। অধিকন্তু, যা ইউরোপের চুনাপাথরে পাওয়া যায় না বরং ওপরের অথবা নিচের স্তরসমষ্টিতে পাওয়া যায় এমন অন্য আকাররা পৃথিবীর এইসব দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে একই অর্ডারের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার কতিপয় পর্যায়ক্রমিক পুরাজীবীয় স্তরসমষ্টিতে জীবন-আকারের সমরূপ সমান্তরালতা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ লক্ষ্য করেছেন; লিয়েলের মতানুসারে, ইউরোপীয় এবং উত্তর আমেরিকার টার্শিয়ারি যুগের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। এমনকি যদি উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে সাধারণ কতিপয় অশ্মীভূত প্রজাতিকে দৃশ্যের বাইরে রাখা হয়, তাহলেও পুরাজীবীয় এবং টার্শিয়ারি স্তরসমূহের জীবনের পর্যায়ক্রমিক আকারদের সাধারণ সমান্তরালতা স্পষ্টই রয়ে যাবে এবং কতিপয় স্তরকে সহজেই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারবে।
এইসব পর্যবেক্ষণ পৃথিবীর সামুদ্রিক অধিবাসীদের ক্ষেত্রে করা হয়েছে; দূরবর্তী অঞ্চলের স্বাদুজলের এবং স্থলভাগের উৎপাদনগুলো একই সমান্তরাল উপায়ে পরিবর্তিত হয় কিনা, তা বিচার-বিশ্লেষণ করার মত যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। এরা এভাবে পরিবর্তিত হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। এদের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য না জেনে যদি মেগাথেরিয়াম, মাইলোডন, ম্যাক্সাউচেনিয়া এবং টক্রোডন প্রাণীদের লা প্লাটা থেকে ইউরোপে আনা হত, তাহলে কেউ সন্দেহ করত না যে এখন জীবিত সমস্ত সামুদ্রিক খোলকী প্রাণীদের সঙ্গে এরা সহাবস্থান করেছিল; কিন্তু যেহেতু এইসব ব্যতিক্রমী বিস্ময়কর প্রাণীরা ম্যাস্টোডন ও ঘোড়ার সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল, সেহেতু সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে পরবর্তী টার্শিয়ারি স্তরের কোন এক সময়ে এরা বসবাস করেছিল।
যখন বলা হয় যে সামুদ্রিক জীবন-আকাররা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যুগপৎ পরিবর্তিত হয়েছে, তখন নিশ্চয় ধরে নেওয়া উচিত নয় যে এই অভিব্যক্তি একই বছর অথবা একই শতাব্দীর সঙ্গে সম্পর্কিত, এমনকি এটাও ধরে নেওয়া যায় না যে এর একটি সঠিক ভূতাত্ত্বিক অর্থ আছে; কারণ যদি ইউরোপে বর্তমানে জীবিত সব সামুদ্রিক প্রাণী এবং প্লিস্টোসিন উপপর্বে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীদের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে জীবিত প্রাণীদের তুলনা করা হয়, তাহলে সবচেয়ে দক্ষ প্রকৃতিবিদও কদাচিৎ বলতে সমর্থ হবেন যে ইউরোপের বর্তমান অথবা প্লিস্টোসিন উপপর্বের অধিবাসীরা দক্ষিণ গোলার্ধের অধিবাসীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সদৃশ ছিল কিনা। আবার কয়েকজন সুদক্ষ পর্যবেক্ষক মনে করেন যে ইউনাইটেড স্টেট্স-এর বর্তমান উৎপাদনসমূহ ইউরোপের বর্তমান অধিবাসীদের তুলনায় কোন পরবর্তী টার্শিয়ারি পর্বের সময় ইউরোপের অধিবাসীদের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত এবং এটি এরূপ হলে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতীরে বর্তমানে সঞ্চিত জীবাশ্মপূর্ণ স্তরগুলো এখন থেকে কিছু পরিমাণে পুরানো ইউরোপীয় স্তর হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হওয়ার যোগ্য হবে। তা সত্ত্বেও, দূরবর্তী ভবিষ্যতের যুগে তাকালে, অল্পই সন্দেহ থাকতে পারে যে মোটামুটি সমস্ত আধুনিক স্তরসমষ্টি, যথা ইউরোপের, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার এবং অস্ট্রেলিয়ার উচ্চতর প্লিস্টোসিন এবং আরও সঠিকভাবে আধুনিক স্তরসমষ্টিকে, যেখানে জীবাশ্ম অবশিষ্টাংশসমূহ কিছু মাত্রায় সম্পর্কিত হয় এবং যেখানে শুধুমাত্র নিচের পুরানো সঞ্চয়সমূহে প্রাপ্ত ঐ আকারসমূহকে অন্তর্ভুক্ত না করে ভূতাত্ত্বিক অর্থে যুগপৎ হিসেবে সঠিকভাবে শ্রেণীভুক্ত করা হবে।
পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে জীবন-আকারদের উপরোক্ত ব্যাপক অর্থে যুগপৎ পরিবর্তনের ঘটনাটি এম. এম. ডে ভার্নেউইল এবং ডি আর্কিয়াক-এর মত শ্রদ্ধেয় পর্যবেক্ষককের রীতিমতো বিমুগ্ধ করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন অংশের পুরাজীবীয় জীবন—আকারসমূহের সমান্তরালতার কথা উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, “এই অদ্ভুত অনুক্রম দ্বারা বিমুগ্ধ হয়ে আমরা যদি উত্তর আমেরিকার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি এবং যদি অনুরূপ ঘটনাশ্রেণী আবিষ্কার করি, তাহলে এটি সঠিক বলে মনে হবে যে প্রজাতিদের এইসব রূপান্তর, এদের বিলুপ্তি এবং নূতনদের প্রবর্তন, শুধুমাত্র সামুদ্রিক প্রবাহসমূহের পরিবর্তনগুলোর জন্য অথবা কমবেশী স্থানীয় অন্য কারণগুলোর জন্য হতে পারে না, বরং সমস্ত প্রাণীজগৎকে নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মগুলোর ওপর নির্ভর করে।” এম. ব্যারান্ডে একই পরিণতির পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেছেন। অতিশয় ভিন্ন জলবায়ুতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে জীবন-আকারদের এইসব বিরাট বিরাট পরিবর্তনের কারণ হিসেবে প্রবাহদের পরিবর্তনসমূহকে, জলবায়ুকে অথবা অন্যান্য ভৌতিক পরিবেশকে দেখা বাস্তবিক পক্ষে অতিশয় নিরর্থক। ব্যারান্ডের বক্তব্য অনুসারে, কোন বিশেষ নিয়মের দিকে আমাদের নিশ্চয় লক্ষ্য করা উচিত। আমরা এটি আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যখন আমরা জীবনের বর্তমান বিস্তার সম্বন্ধে আলোচনা করি এবং বিভিন্ন দেশের ভৌতিক অবস্থা এবং তাদের অধিবাসীদের প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক কত অল্প তা লক্ষ্য করি।
সমগ্র পৃথিবী জুড়ে জীবন-আকারদের সমান্তরাল পর্যায়ক্রমের বিষয়টি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। পুরানো আকারদের ওপর কিছু প্রাধান্যের দ্বারা নূতন প্রজাতিরা সৃষ্টি হয়; এবং আকারগুলি, ইতিমধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং নিজ দেশের পুরানো আকারদের ওপর কিছু প্রাধান্য বিস্তার করেছে এমন আকাররা অসংখ্য নূতন ভ্যারাইটি অথবা জায়মান প্রজাতির জন্ম দেয়। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আমাদের হাতে স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে—প্রভাবশালী অর্থাৎ যারা অতিশয় সাধারণ এবং ব্যাপকভাবে চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত এমন উদ্ভিদরা অসংখ্য নূতন ভ্যারাইটির জন্ম দেয়। এটাও একান্তই স্বাভাবিক যে অন্য প্রজাতিদের অঞ্চলগুলো ইতিমধ্যে কিছু পরিমাণে অধিকার করছে এমন প্রভাবশালী, পরিবর্তনশীল এবং চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে বিস্তারশীল প্রজাতি হবে তারাই যাদের আরও ব্যাপকভাবে বিস্তারের এবং নূতন দেশগুলোতে অন্য নূতন ভ্যারাইটি এবং প্রজাতির জন্ম দেওয়ার সবচেয়ে ভাল সম্ভাবনা থাকবে। জলবায়ুগত এবং ভৌগোলিক পরিবর্তন, অদ্ভুত আকস্মিক ঘটনা এবং যার মধ্য দিয়ে এদের অতিক্রম করতে হয় এমন বিভিন্ন জলবায়ুতে নূতন প্রজাতিদের ধীরে ধীরে অভ্যস্তকরণের ওপর নির্ভর করে ব্যাপ্তির প্রক্রিয়াটি প্রায়শই অতি মন্থর হবে, এবং অবশেষে প্রাধান্য বিস্তার করবে। এটি সম্ভবপর যে অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রের সামুদ্রিক অধিবাসীদের তুলনায় ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশসমূহের স্থলভাগের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্তি মন্থরতর হবে। অতএব আমরা সামুদ্রিক উৎপাদনগুলোর তুলনায় স্থলভাগের উৎপাদনগুলোর পর্যায়ক্রমে সমান্তরালতার একটি কম মাত্রা দেখার আশা করব।
আমার মনে হয়, এরূপে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে জীবনের একই আকারদের সমান্তরালতা এবং ব্যাপক অর্থে যুগপৎ ও পর্যায়ক্রমে প্রভাবশালী প্রজাতিদের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে বিস্তার ও পরিবর্তনশীলতার দ্বারা নূতন প্রজাতির সৃষ্টির নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এরূপে সৃষ্ট নূতন প্রজাতিরা নিজেরাই প্রভাবশালী হয়, কারণ তারা তাদের ইতিমধ্যেই প্রভাবশালী পিতামাতাদের ওপর এবং অন্য প্রজাতিদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং আবার বিস্তৃত ও পরিবর্তিত হয় এবং নূতন আকারদের সৃষ্টি করে। পরাজিত এবং নূতন ও বিজয়ী আকারদের জন্য স্থানত্যাগকারী পূর্বতন আকাররা সাধারণ হীনতার স্বভাবকে বংশগতভাবে প্রেরণ করে গোষ্ঠীগুলোতে সাধারণতঃ সম্বন্ধযুক্ত হবে; এবং যেহেতু নূতন ও উন্নত গোষ্ঠীগুলো সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তৃত হয়, পূর্বতন গোষ্ঠীগুলো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়; এবং সর্বত্র আকারদের পর্যায়ক্রম এদের প্রথম আবির্ভাবে এবং সর্বশেষ অন্তর্ধানে উভয়েরই সঙ্গে সমরূপ হতে প্ৰবণ হয়।
এই বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত আর একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য আছে। জীবাশ্ম পরিপূর্ণ বিরাট স্তরসমষ্টির অধিকাংশই যে অবনমনের যুগে পুঞ্জীভূত বা সঞ্চিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে আমার বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তিসমূহ আমি আগেই পেশ করেছি; এবং জীবাশ্মদের বিষয়ে বিবেচনা করলে, অসীম স্থায়িত্বকালের ফাঁকা বিরামকালগুলো সেইসব যুগে ঘটেছিল যখন সমুদ্রতল হয় স্থির অথবা উত্থান অবস্থায় ছিল এবং যখন জীবের ধ্বংসাবশেষকে চাপা দিতে এবং সংরক্ষণ করতে যথেষ্ট দ্রুত হারে পলি সঞ্চিত হয়নি। এইসব দীর্ঘ বিরামকালে, আমি মনে করি, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীরা একটি বিশেষ পরিমাণে রূপান্তরিত হয়েছিল ও বিলুপ্ত হয়েছিল, এবং পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে অধিক পরিমাণে প্রচরণ হয়েছিল। যেহেতু আমাদের বিশ্বাস করার কারণ আছে যে একই আলোড়নের ফলে বিরাট বিরাট অঞ্চলগুলো প্রভাবিত হয়েছে, সেহেতু এটি সম্ভবপর যে যথাযথ সমকালীন স্তরসমষ্টি পৃথিবীর একই অঞ্চলের বিরাট এলাকায় প্রায়শই পুঞ্জীভূত হয়েছে; কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত করার কোন অধিকার আমাদের নেই বললেই চলে যে এটি নিশ্চয়ই ঘটেছে এবং বিরাট অঞ্চলগুলো একই আলোড়নের ফলে অনিবার্যভাবে প্রভাবিত রয়েছে। যখন একই যুগের না হলেও প্ৰায় কাছাকাছি যুগের দুটি স্তর দুটি অঞ্চলে পুঞ্জীভূত হয়ে থেকেছে, তখন আগের অধ্যায়সমূহের ব্যাখ্যানুসারে জীবন-আকারদের একই সাধারণ পর্যায়ক্রম উভয়েতেই আমাদের দেখতে পাওয়া উচিত; কিন্তু প্রজাতিরা যথাযথভাবে সমরূপ হবে না, কারণ রূপান্তর, বিলুপ্তি ও অভিবাসনের জন্য অন্য অঞ্চলের তুলনায় একটি অঞ্চলের একটু বেশী সময় লেগে থাকবে।
এই ধরনের ঘটনা ইউরোপে ঘটেছে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ইয়োসিন উপপর্বের সঞ্চয়গুলো সম্পর্কে তাঁর উৎকৃষ্ট স্মৃতিকথায় মিঃ প্রেস্টভিচ্ দুটি দেশের পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলোর মধ্যে একটি নিবিড় সাধারণ সমান্তরালতা টানতে সমর্থ হয়েছেন; কিন্তু তিনি যখন ফ্রান্সের কোন কোন স্তরের সঙ্গে ইংল্যান্ডের স্তরগুলোর তুলনা করেন, যদিও তিনি উভয় ক্ষেত্রেই একই গণগুলোর অন্তর্গত প্রজাতিদের সংখ্যার একটি অদ্ভুত মিল দেখেছেন, তথাপি দুটি অঞ্চলের নৈকট্য বিবেচনা করে বলেছেন যে প্রজাতিরা নিজেরা এমনভাবে ভিন্ন হয় যে তা বিবেচনার অযোগ্য—বাস্তবিকপক্ষে, যতক্ষণ না এটি ধরে নেওয়া হয় যে দুটি সমুদ্রকে একটি যোজক পৃথক করেছিল, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন অথচ সমকালীন প্রাণীকুল বসবাস করত। পরবর্তী টার্শিয়ারি স্তরসমষ্টির কয়েকটি সম্পর্কে লিয়েল একইরূপ পর্যবেক্ষণ করেছেন। ব্যারান্ডে-ও দেখিয়েছেন যে বোহেমিয়া এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পর্যায়ক্রমিক সিলুরিয়ান সঞ্চয়গুলোতে একটি আশ্চর্যজনক সাধারণ সমান্তরালতা আছে; তা সত্ত্বেও তিনি প্রজাতিদের মধ্যে আশ্চর্যজনক পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন। যদি কতিপয় স্তর একই যুগে এইসব অঞ্চলে সঞ্চিত না হয়ে থাকে—একটি অঞ্চলে একটি স্তর প্রায়শই অন্য অঞ্চলের বিরামকালের অনুরূপ হয় এবং যদি উভয় অঞ্চলে প্রজাতিরা কতিপয় স্তরসমষ্টির পুঞ্জীভবনের সময় এবং এদের মধ্যে দীর্ঘ বিরামকালের সময় মন্থরভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে দুটি অঞ্চলের কতিপয় স্তরের জীবন-আকারদের সাধারণ পর্যায়ক্রম অনুসারে একই অর্ডারে বিন্যস্ত করা যেতে পারত, এবং অর্ডারটি ভুলবশতঃ মনে হয় সমান্তরাল হবে; তা সত্ত্বেও, প্রজাতিরা দুটি অঞ্চলে আপাত অনুরূপ স্তরগুলোতে একই হবে না।
পরস্পরের সঙ্গে এবং জীবিত আকারদের সঙ্গে বিলুপ্ত প্রজাতিদের সম্বন্ধ
বিলুপ্ত এবং জীবিত প্রজাতিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ সম্পর্কে আমরা এখন আলোচনা করব। এরা সকলে কয়েকটি প্রধান শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, এবং এই ঘটনাটি উদ্ভবের পদ্ধতিটির সঙ্গে একই সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাধারণ নিয়ম অনুসারে একটি আকার যত বেশী প্রাচীন, জীবিত আকারগুলোর থেকে তা তত বেশী ভিন্ন হয়। কিন্তু যেমন বাকল্যান্ড বহু আগে বলেছিলেন যে বিলুপ্ত প্রজাতিদের সকলকে হয় এখন জীবিত গোষ্ঠীগুলোতে অথবা এদের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে। জীবনের বিলুপ্ত আকাররা বর্তমানের গণ, গোত্র এবং অর্ডারদের মধ্যে শূন্যস্থানগুলোকে পূরণ করতে সাহায্য করে, এটি নিশ্চয়ই সত্য; কিন্তু এই বক্তব্যকে প্রায়শই অগ্রাহ্য করা হয় অথবা এমনকি অস্বীকার করা হয় বলে এ বিষয়ে কিছু বলা এবং উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন। একই শ্রেণীর বিলুপ্ত অথবা জীবিত প্রজাতিদের দিকে যদি আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ রাখি, যদি আমরা উভয়কেই একটি সাধারণ ব্যবস্থায় যুক্ত করি, তাহলে এর তুলনায় শ্রেণীটি কম নিখুঁত হয়। অধ্যাপক ওয়েনের লেখাগুলিতে বিলুপ্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সাধারণীকৃত আকারদের সম্পর্কে অনেক কথা বলা আছে; আগাসির লেখাগুলিতে ভাববাদী অথবা সাংশ্লেষিক টাইপের কথা পাওয়া যায়; এই পদগুলো ইঙ্গিত দেয় যে এই আকাররা প্রকৃতপক্ষে মধ্যবর্তী অথবা যুক্তকারী সংযোজক। অন্য একজন বিখ্যাত জীবাশ্মবিদ এম.গাউড্রি অতি বিস্ময়করভাবে দেখিয়েছেন যে অ্যাটিকাতে তাঁর দ্বারা আবিষ্কৃত জীবাশ্ম-স্তন্যপায়ীদের অনেকেই বর্তমান গণগুলোর মধ্যেকার শূন্যস্থান পূরণ করতে সমর্থ। কুভিয়ের রোমন্থনকারী (রুমিন্যান্ট) এবং হাতি ও গণ্ডার (প্যাকিডার্ম) স্তন্যপায়ীদের একেবারেই ভিন্ন দুটি অর্ডার হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এত সংখ্যায় জীবাশ্ম—সংযোজক আবিষ্কৃত হয়েছে যে ওয়েনকে সমগ্র শ্রেণীবিভাগের পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং তিনি কোন কোন হাতি ও গণ্ডারদের রোমন্থনকারীদের সঙ্গে একই উপ-অর্ডারে স্থাপন করেছিলেন; উদাহরণস্বরূপ, তিনি শুয়োর এবং উটের মধ্যে আপাত গুণগত পার্থক্যের ধাপকে ভেঙে দিয়েছেন। আঙ্গুলাটা (Ungulata) অথবা খুরওয়ালা চতুষ্পদ প্রাণীরা এখন জোড় অথবা বিজোড় পদাঙ্গুলিযুক্ত প্রাণীতে বিভক্ত হয়েছে; কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাক্রাউচেনিয়া নামক প্রাণীরা এই দুই বিরাট বিভাগকে কিছু পরিমাণে যুক্ত করে। কেউ অস্বীকার করবে না যে হিপারিওন প্রাণীরা বর্তমান ঘোড়া এবং কোন কোন প্রাচীনতর খুরওয়ালা প্রাণীর মধ্যবর্তী স্তর। স্তন্যপায়ীদের শৃংখলে এক আশ্চর্যজনক সংযোজক দক্ষিণ আমেরিকার টাইপোথেরিয়াম প্রাণীরা, অধ্যাপক জারভাইস দ্বারা প্রদত্ত নামে যা প্রকাশ পায় এবং যাকে বর্তমান কোন অর্ডারে স্থাপন করা যেতে পারে না। সাইরেনিয়া নামক প্রাণীরা স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একটি অতি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী তৈরী করে; এবং বর্তমানের ডুগং ও ল্যামেন্টিন প্রাণীদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে পিছনের পায়ের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, এমনকি কোন লুপ্তপ্রায় অঙ্গও নেই; কিন্তু অধ্যাপক ফ্লাওয়ার-এর মতানুসারে হ্যালিথেরিয়াম প্রাণীর একটি হাড়ে পরিণত হওয়ার জন্য ঊরু-অস্থি ছিল, যা “শ্রোণীর একটি সুচিহ্নিত অ্যাসিটেবুলামে গ্রন্থিবদ্ধ”, এবং এরূপে এটি সাধারণ খুরওয়ালা চতুষ্পদ প্রাণীদের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে, যার সঙ্গে সাইরেনিয়া প্রাণীরা অন্যান্য বিষয়ে সম্বন্ধযুক্ত। সেটাশিয়া প্রাণীরা অথবা তিমিরা অন্য সমস্ত স্তন্যপায়ীদের থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন, কিন্তু টার্শিয়ারি পর্বের জিউগ্লোডন ও স্কোয়ালোডন প্রাণীদেরকে কয়েকজন প্রকৃতিবিদ একটি স্বতন্ত্র অর্ডারের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাদেরকে অধ্যাপক হাক্সলে সন্দেহাতীতভাবে সেটাশিয়া প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেছেন, “এবং যারা জলজ মাংসাশীদের মধ্যে সংযোজক হিসেবে বিবেচিত হয়।”
এমনকি পাখি ও সরীসৃপদের মধ্যে এখনই উল্লিখিত প্রকৃতিবিদদের দেখানো ব্যাপক গুণগত পার্থক্যটি আশাতীতভাবে একদিকে উটপাখি এবং বিলুপ্ত আর্কিওপটেরিক্স দ্বারা এবং অন্যদিকে ডাইনোসোরিয়ানদের কম্পসোগন্যাথাস নামক একটি গোষ্ঠীর দ্বারা অংশত যুক্ত হয়েছে। ডাইনোসোরিয়ান গোষ্ঠীটি সমস্ত স্থলজ সরীসৃপদের অধিকাংশ বিশালাকায় প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত করে। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের প্রসঙ্গে ব্যারান্ডে জোরের সঙ্গে বলেন যে একজন বড় বিশেষজ্ঞ, যাঁর নাম করা যাবে না, প্রতিদিন শেখান যে, পুরাজীবীয় প্রাণীদের নিশ্চয় বর্তমান গোষ্ঠীদের সঙ্গে শ্রেণীভুক্ত করা যেতে পারে, তথাপি সেই প্রাচীন যুগে গোষ্ঠীগুলো এখনকার মত পরস্পরের থেকে এত স্পষ্টভাবে ভিন্ন ছিল না।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ কোন বিলুপ্ত প্রজাতি অথবা প্রজাতি-গোষ্ঠীকে যে-কোন দুটি জীবিত প্রজাতির অথবা প্রজাতি-গোষ্ঠীগুলির মধ্যবর্তী হিসেবে বিবেচনা করার বিরোধিতা করেছেন। যদি এই বক্তব্যের অর্থ এই হয় যে একটি বিলুপ্ত আকার তার সমস্ত বৈশিষ্ট্যে দুটি জীবিত আকার অথবা গোষ্ঠীদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী, তখন বিরোধিতাটি সম্ভবত যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু একটি প্রাকৃতিক শ্রেণীবিভাগে অনেক জীবাশ্ম-প্রজাতি নিশ্চয়ই জীবিত প্রজাতিদের মধ্যে স্থানগ্রহণ করে, এবং কোন কোন বিলুপ্ত গণ জীবিত গণগুলোর মধ্যে, এমনকি স্বতন্ত্র গোত্রের অন্তর্গত গণগুলোর মধ্যে স্থানগ্রহণ করে। বিশেষভাবে মাছ এবং সরীসৃপদের মত অতি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে যে বর্তমানে অনেক বৈশিষ্ট্য দ্বারা পৃথক করা যায় এমন প্রাচীন সদস্যরা কিছু কম সংখ্যক বৈশিষ্ট্য দ্বারা পৃথক হয়, যাতে করে মনে হয় দুটি গোষ্ঠী এখনকার তুলনায় পূর্বে পরস্পরের কাছাকাছি ছিল।
এটি একটি সাধারণ বিশ্বাস যে একটি আকার যত বেশী প্রাচীন হয় তত বেশী সেটি বর্তমানে পরস্পরের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন গোষ্ঠীর কয়েকটি দ্বারা যুক্ত হতে প্রবণ হয়। সন্দেহ নেই এই বক্তব্য সেইসব গোষ্ঠীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, যারা কালক্রমে ভূতাত্ত্বিক যুগসমূহে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে; এবং প্রস্তাবটির সত্যতা প্রমাণ করা কষ্টকর হবে, কারণ মাঝেমাঝে এমনকি লেপিডোসাইরেন-এর মত একটি জীবন্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেও আবিষ্কৃত হয়েছে যে সম্বন্ধগুলো অতিশয় স্বতন্ত্র গোষ্ঠীসমূহের দিকে নির্দেশিত হয়। তথাপি যদি আমরা একই শ্রেণীর আরও সাম্প্রতিক সদস্যদের সঙ্গে প্রাচীনতর সরীসৃপ এবং ব্যাট্রাচিয়ানদের, প্রাচীনতর মাছ, প্রাচীনতর মস্তকপদীদের (সেফালোপড) এবং ইওসিন পর্বের স্তন্যপায়ীদের তুলনা করি, তাহলে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বক্তব্যটিতে সত্যতা আছে।
এখন দেখা যাক এইসব তথ্য এবং সিদ্ধান্তসমূহের কতখানি রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভব তত্ত্বটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিষয়টি কিছুটা জটিল বলে চতুর্থ অধ্যায়ে প্রদত্ত চিত্রটির দিকে ফিরে তাকাতে পাঠকদের অনুরোধ করব আমি। আমরা অনুমান করতে পারি যে বাঁকা হরফে সংখ্যায়িত অক্ষরগুলি গণসমূহকে এবং তাদের থেকে অপসরণশীল বিন্দুখচিত রেখাগুলি প্রত্যেক গণের প্রজাতিসমূহকে সূচিত করে। চিত্রটি অতিশয় সরল, অল্প কয়েকটি গণ এবং অল্প কয়েকটি প্রজাতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এটি আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। আনুভূমিক রেখাগুলি পর্যায়ক্রমিক ভূতাত্ত্বিক স্তরসমষ্টিকে সূচিত করতে পারে, এবং সর্বোচ্চ রেখার নিচে সমস্ত আকাররা বিলুপ্ত হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। তিনটি জীবিত গন a^14, q^14, p^14 একটি ছোট গোত্র সৃষ্টি করতে পারে; এবং b^4 ও f^14 নিকট-সম্বন্ধীয় অথবা উপ—গোত্র এবং o^14, e^14, m^14 একটি তৃতীয় গোত্র সৃষ্টি করতে পারে। এই তিনটি গোত্র এবং পিতামাতা আকার (A) থেকে অপসৃত উদ্ভবের কয়েকটি রেখার ওপর বেশ কিছু বিলুপ্ত গণ একত্রে মিলে একটি অর্ডার সৃষ্টি করবে, কারণ সকলেই তাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে সাধারণ কিছু বিষয় বংশগতভাবে পেয়েছে। বৈশিষ্ট্যে অপসরণের দিকে অনবরত প্রবণতার পদ্ধতি অনুযায়ী, যা এই চিত্রের দ্বারা পূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, একটি আকার যত বেশী আধুনিক হয়, তত বেশী এটি আদিম পূর্বপুরুষের থেকে ভিন্ন হয়। অতএব আমরা নিয়মটি বুঝতে পারি যে সবচেয়ে আদিম জীবাশ্মরা বর্তমান আকারদের থেকে বেশী ভিন্ন হয়। তবে বৈশিষ্ট্যের অপসরণকে একটি প্রয়োজনীয় আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করা উচিত নয়, এটি প্রকৃতিমণ্ডলে অনেক এবং বিভিন্ন অঞ্চল এরূপে অধিকার করতে একটি প্রজাতির বংশধরদের সমর্থ হওয়ার ওপরেই শুধুমাত্র নির্ভর করে। সুতরাং এটি সম্পূর্ণ সম্ভবপর যে, যেমন আমরা কিছু সিলুরিয়ান আকারদের ক্ষেত্রে দেখেছি, একটি প্রজাতি তার অল্পভাবে পরিবর্তিত জীবন-পরিবেশ সাপেক্ষে অল্প অল্প করে রূপান্তরিত হতে থাকবে এবং তা সত্ত্বেও এটি দীর্ঘ সময় ধরে নিজের একই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রাখবে। এটি চিত্রটিতে F^14 অক্ষর দ্বারা সূচিত হয়েছে।
আগের বক্তব্য অনুযায়ী, (A) থেকে উদ্ভূত বিলুপ্ত এবং সাম্প্রতিক সমস্ত আকাররা একটি অর্ডার সৃষ্টি করে; এবং অনবরত বিলুপ্ত হওয়ার প্রভাবে ও বৈশিষ্ট্যের অপসরণের জন্য এই অর্ডারটি কয়েকটি উপ-গোত্রে এবং গোত্রে বিভক্ত হয়েছে, এদের কয়েকটি সম্ভবত বিভিন্ন যুগে বিনষ্ট হয়েছে এবং কয়েকটি বর্তমান কাল পর্যন্ত টিকে রয়েছে।
চিত্রটির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে যদি অনেক বিলুপ্ত আকার যারা পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টিতে চাপা পড়ে রয়েছে বলে মনে হয়, শ্রেণীটির নিচের দিকে কয়েকটি স্থানে আবিষ্কৃত হত, তাহলে সর্বোচ্চ রেখার ওপর তিনটি জীবিত গোত্রকে পরস্পরের থেকে কম ভিন্ন বলে মনে হত। উদাহরণস্বরূপ, a^1, a^5, a^10, f^8, m^3, m^6, m^9 গণসমূহকে খুঁড়ে তোলা গেলে, এই তিনটি গোত্র এত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হবে যে এরা সম্ভবত একটি বিরাট গোত্রে যুক্ত হবে, যা একইভাবে রোমন্থনকারী (রুমিন্যান্ট) এবং কোন কোন হাতি, গণ্ডার (প্যাকিডার্ম) ইত্যাদির ক্ষেত্রে ঘটেছে। তা সত্ত্বেও যিনি বিলুপ্ত গণগুলোকে মধ্যবর্তী হিসেবে বিবেচনা করতে আপত্তি করেছিলেন, যেগুলো এরূপে তিনটি গোত্রের জীবিত গণগুলোকে একত্রে যুক্ত করে, তিনি অংশত সঠিক হবেন, কারণ এরা মধ্যবর্তী হয়; প্রত্যক্ষভাবে নয়, বরং অনেক ব্যাপকভাবে ভিন্ন আকারদের মাধ্যমে একটি দীর্ঘ এবং ঘোরা পথেই শুধুমাত্র মধ্যবর্তী হয়। মাঝের আনুভূমিক রেখাগুলির একটির উপরে, অথবা উদাহরণস্বরূপ VI নং—এর ওপর—কিন্তু এই রেখার নিচে একটিও না—অথবা ভূতাত্ত্বিক স্তরসমষ্টিতে অনেক বিলুপ্ত আকার যদি আবিষ্কৃত হত, তাহলে গোত্রদের শুধু দুটিকে (বাঁদিকের a^14 ইত্যাদি এবং b^14 ইত্যাদির ওপরেরগুলো) একটিতে সংযুক্ত করা উচিত হত; এবং তারপর দুটি গোত্র থাকবে, যারা জীবাশ্মসমূহ আবিষ্কারের পূর্বের অবস্থার তুলনায় পরস্পরের থেকে কম ভিন্ন হবে। অতএব আবার যদি সর্বোচ্চ রেখাটির ওপর আটটি গণের দ্বারা (a^14 থেকে m^14) গঠিত তিনটি গোত্র আধ ডজন প্রধান বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরস্পরের থেকে ভিন্ন হয় বলে অনুমান করা যায়—তাহলে গোত্রগুলি, যারা VI চিহ্নিত যুগে অবস্থিত ছিল, কম সংখ্যক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা পরস্পরের থেকে নিশ্চয় পৃথক হবে; কারণ এরা উদ্ভবের প্রাথমিক অবস্থায় এদের পূর্বপুরুষের থেকে কম মাত্রায় ভিন্নমুখী হবে। এরূপে এটি ঘটে যে আদিম ও বিলুপ্ত গণরা তাদের রূপান্তরিত বংশধরদের মধ্যে অথবা তাদের জ্ঞাতি সম্পর্কীয়দের মধ্যে বৈশিষ্ট্যে কম অথবা বেশী মাত্রায় প্রায়শই মধ্যবর্তী হয়।
চিত্রটিতে যা সূচিত হয়েছে তার তুলনায় প্রকৃতিতে প্রক্রিয়াটি আরও বেশী জটিল হবে, কারণ গোষ্ঠীগুলি আরও অসংখ্য হবে, অতি অসমান সময় ধরে তারা স্থায়ী হবে এবং বিভিন্ন মাত্রায় রূপান্তরিত হবে। যেহেতু ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের শেষ খণ্ডটির আমরা অধিকারী, এবং যা অতি খণ্ডিত অবস্থায় রয়েছে, সেহেতু বিরল ঘটনাগুলো ছাড়া, প্রাকৃতিক সিস্টেমের ব্যাপক ব্যবধানসমূহ পূরণ করার এবং এরূপে স্বতন্ত্র গোত্র অথবা অর্ডারগুলোকে যুক্ত করার আশা করার কোন অধিকার আমাদের নেই। যা আমাদের আশা করার অধিকার আছে তা হচ্ছে যে সেই গোষ্ঠীগুলো, যারা জ্ঞাত ভূতাত্ত্বিক যুগে অধিক রূপান্তরিত হয়েছে, তারাই প্রাচীনতর স্তরসমষ্টিতে পরস্পরের দিকে অগ্রসর হবে; সুতরাং প্রাচীনতর সদস্যরা একই গোষ্ঠীগুলোর বর্তমান সদস্যদের বৈশিষ্ট্যের তুলনায় পরস্পরের থেকে বৈশিষ্ট্যের কয়েকটিতে কম ভিন্ন হবে; এবং আমাদের দক্ষ জীবাশ্মবিদদের সমসাময়িক সাক্ষ্য দ্বারা এটি প্রায়শই প্রমাণিত হয়।
এরূপে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটি অনুযায়ী পরস্পরের সঙ্গে এবং জীবিত আকারদের সঙ্গে বিলুপ্ত আকারদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধের প্রসঙ্গের অন্যতম বিষয়গুলো সন্তোষজনক উপায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং এটি অন্য কোন মতবাদ অনুযায়ী ব্যাখ্যার অযোগ্য।
এই একই তত্ত্ব অনুযায়ী, এটি প্রণিধানযোগ্য যে পৃথিবীর ইতিহাসে যে-কোন একটি বিরাট যুগে প্রাণীকুল পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের মধ্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যে মধ্যবর্তী হবে। এরূপ প্রজাতিরা, যারা চিত্রটিতে উদ্ভবের ষষ্ঠ বিরাট ধাপে বসবাস করত, হচ্ছে পঞ্চম ধাপে বসবাসকারী রূপান্তরিত বংশধর এবং সপ্তম ধাপে আরও বেশী রূপান্তরিত হওয়া বংশধরদের পিতামাতা; সুতরাং ওপরে এবং নিচে জীবন-আকারদের মধ্যে এরা বৈশিষ্ট্যে প্রায়শই মধ্যবর্তী হতে কদাচিৎ বিফল হয়। তবে আমরা কতিপয় পূর্ববর্তী আকারদের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি স্বীকার করব, যে-কোন একটি অঞ্চলে অন্য অঞ্চল থেকে নূতন আকারদের অভিবাসন স্বীকার করব, এবং পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টির মধ্যে দীর্ঘ ও ফাঁকা বিরামকালের সময় বিরাট পরিমাণ রূপান্তর স্বীকার করব। এগুলো স্বীকার করলে, প্রত্যেক ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রাণীকুল পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রাণীকুলদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে বৈশিষ্ট্যে মধ্যবর্তী হবে। একটি উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যেমন প্রথম আবিষ্কারের পর ডিভনিয়ান পর্বের জীবাশ্মগুলিকে জীবাশ্মবিদরা ওপরের কার্বন পর্ব এবং নিচের সিলুরিয়ান পর্বের জীবাশ্মদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যে মধ্যবর্তী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীকুল সঠিকভাবে প্রয়োজনানুসারে মধ্যবর্তী হয় না, যেহেতু অসমান বিরামকাল পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টির মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে।
বক্তব্যটির সত্যতা সম্পর্কে এটি প্রকৃত আপত্তি নয় যে প্রত্যেক প্রাণীকুল সামগ্রিকভাবে পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রাণীকুলের মধ্যে বৈশিষ্ট্যে প্রায়শই মধ্যবর্তী হয়, কোন কোন গণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাস্টোডন এবং হাতিদের প্রজাতিরা—যখন ডঃ ফ্যালকনার এদের দুটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছিলেন—প্রথমতঃ পারস্পরিক সম্বন্ধ অনুসারে, দ্বিতীয়তঃ এদের অবস্থানের যুগ অনুসারে, বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। চরম বৈশিষ্ট্যের প্রজাতিরা প্রাচীনতম অথবা অতি সাম্প্রতিক কালের হয় না; অথবা বয়সে, বৈশিষ্ট্যে মধ্যবর্তী হয় না। কিন্তু উদাহরণস্বরূপ এক্ষেত্রে এবং এরূপ অন্য ক্ষেত্রে এটি অনুমান করে যে প্রজাতিদের প্রথম আবির্ভাব এবং অন্তর্ধানের সাক্ষ্যপ্রমাণটি সম্পূর্ণ ছিল, যা প্রায়শই হয় না, আমাদের বিশ্বাস না করার কারণ আছে যে পর্যায়ক্রমিকভাবে সৃষ্ট আকাররা অনুরূপ সময় ধরে স্থায়ী হয়। একটি অতি প্রাচীন আকার পরবর্তী সময়ে অন্যত্র সৃষ্ট একটি আকারের তুলনায় আরও বেশী সময় স্থায়ী হয়ে থাকতে পারে, বিশেষ করে ভিন্ন জেলাগুলোতে বসবাসকারী স্থলভাগের উৎপাদনসমূহের ক্ষেত্রে। বড় জিনিসের সঙ্গে ছোট জিনিসের তুলনা করলে দেখা যায়—যদি গৃহপালিত পায়রার অন্যতম জীবিত এবং বিলুপ্ত জাতসমূহকে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিন্যস্ত করা হত, তাহলে এই বিন্যাস এদের সৃষ্টির সময়ের অর্ডারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সঙ্গতিপূর্ণ হত না, এমনকি এদের অন্তর্ধান বিন্যাসের সঙ্গে কম সঙ্গতিপূর্ণ হবে; কারণ বর্তমানের পাহাড়ী পায়রারা এখনও জীবিত আছে এবং পাহাড়ী পায়রা ও গিরাবাজ পায়রার মধ্যে অনেক ভ্যারাইটি বিলুপ্ত হয়েছে; এবং গিরাবাজ পায়রারা, যাদের চঞ্চুর দৈর্ঘ্যের বৈশিষ্ট্যটি চরম হয়, ছোট ঠোঁটওয়ালা লোটন পায়রাদের তুলনায় আগে উদ্ভুত হয়েছিল, এই লোটন পায়রারা এক্ষেত্রে শ্রেণীটির বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত।
একটি মধ্যবর্তী ভূস্তরে জৈবিক ধ্বংসাবশেষ বৈশিষ্ট্যে কিছু মাত্রায় মধ্যবর্তী হয়, এই বক্তব্যটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ঘটনাটি হচ্ছে যে, যা সমস্ত জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা জোরের সঙ্গে বলে থাকেন, দুটি পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টির জীবাশ্মরা দুটি দূরবর্তী ভূস্তরের জীবাশ্মদের তুলনায় পরস্পরের সঙ্গে আরও বেশী ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়। পিকটেট একটি সুপরিচিত উদাহরণ দিয়েছেন এ চুনাপাথর স্তরসমষ্টির কয়েকটি ধাপের জীবাশ্মরা সাধারণভাবে সদৃশ হয়, যদিও প্রত্যেক ধাপের প্রজাতিরা ভিন্ন হয়। এটির সাধারণত্ব সাপেক্ষে এই তথ্যটি শুধুমাত্র প্রজাতিদের অপরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে অধ্যাপক পিক্টেটের বিশ্বাসকে সম্ভবত নাড়া দিয়েছে। সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমান প্রজাতিদের বিস্তার সম্পর্কে যিনি সুপরিচিত তিনি প্রায়শই একই অবস্থায় রক্ষিত প্রাচীন অঞ্চলে ভৌতিক অবস্থার দ্বারা নিবিড়ভাবে ধারাবাহিক ভূস্তরসমূহে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিদের গভীর সদৃশতা বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন না। স্মরণ করা উচিত যে জীবন-আকাররা, অন্ততঃ যারা সমুদ্রে বাস করে, সমগ্র পৃথিবীতে প্রায়শই যুগপৎ পরিবর্তিত হয়েছে, সুতরাং অতিশয় ভিন্ন জলবায়ু এবং পরিবেশে পরিবর্তিত হয়েছে। প্লিস্টোসিন পর্বের সময় আবহাওয়ার বিস্ময়কর পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করুন, যা সমগ্র তুষারযুগকে অন্তর্ভুক্ত করে, এবং লক্ষ্য করুন সমুদ্রের অধিবাসীদের বিশেষ আকাররা অল্পই প্রভাবিত হয়েছে।
ঘনিষ্ঠভাবে ধারাবাহিক স্তরসমষ্টির জীবাশ্মরা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়, যদিও ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়, উদ্ভবের তত্ত্ব অনুযায়ী এটির সম্পূর্ণ অর্থ স্পষ্ট হয়। যেহেতু প্রত্যেক ভূস্তরের পুঞ্জীভবন প্রায় ধারাবাহিক হয় না এবং যেহেতু পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টির মধ্যে দীর্ঘ বিরামকাল রয়ে থাকে, যেটি আমি বিগত অধ্যায়ে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, সেহেতু যে-কোন একটি অথবা দুটি স্তরে প্রজাতিদের মধ্যে সমস্ত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের আবিষ্কার করার আশা করা আমাদের উচিত হবে না, যারা এইসব যুগের শুরুতে এবং শেষে আবির্ভূত হয়েছিল : বছর দ্বারা পরিমাপ করা অতি দীর্ঘ, কিন্তু ভূতাত্ত্বিকভাবে মাপলে কেবল পরিমিত দীর্ঘ সময় অন্তরে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত আকারদেরই আমাদের দেখতে পাওয়া উচিত অথবা যেমন এদের কোন কোন বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিমূলক প্রজাতি বলেছেন; এবং এইগুলো আমাদের নিশ্চয় পাওয়া উচিত। বিশেষ আকারদের মন্থর এবং বিরল বোধগম্য পরিবর্তনসমূহের এরূপ সাক্ষ্য আমরা লক্ষ্য করি, যেহেতু আমাদের আশা করার অধিকার আছে।
জীবিতদের তুলনায় প্রাচীন আকারদের বিকাশাবস্থা
চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে জীবদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পৃথকীকরণ এবং বিশেষীকরণের মাত্রাটি, যখন পূর্ণাবস্থা প্রাপ্ত হয়, হচ্ছে সর্বোত্তম মান, যা এদের নিখুঁততার অথবা উচ্চ পর্যায়ের মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমরা আরও দেখিয়েছি যে যেহেতু অঙ্গগুলোর বিশেষীভবন প্রত্যেক জীবের পক্ষে লাভজনক, সেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রত্যেক জীবের জৈব সংগঠনকে আরও বেশী বিশিষ্ট ও নিখুঁত করার প্রবণতাযুক্ত করবে এবং এভাবে উন্নততর করবে, তা সত্ত্বেও এটি সরল জীবন-পরিবেশের জন্য সরল এবং অনুন্নত দেহগঠন সমেত অনেক জীব সৃষ্টি করতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি জৈবসংগঠনের অবস্থা হ্রাস ও সরল করতে পারবে, তথাপি এইসব হ্রাসপ্রাপ্ত জীবরা তাদের নূতন জীবন-পরিবেশে ভালভাবে মানিয়ে নিতে পারবে। অন্য একটি এবং আরও সাধারণ পদ্ধতিতে, নূতন প্রজাতিরা তাদের পূর্বসূরীদের তুলনায় উৎকৃষ্টতর হয়, কারণ জীবনসংগ্রামে যাবতীয় পুরনো প্রজাতিদেরকে তাদের পরাজিত করতে হয়। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে যদি প্রায় সদৃশ আবহাওয়ায় পৃথিবীর ইয়োসিন অধিবাসীদের বর্তমান অধিবাসীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়া হত, তাহলে পরবর্তীদের দ্বারা পূর্ববর্তীরা পরাজিত হত এবং নিশ্চিহ্ন হত। এরূপে জীবনসংগ্রামে বিজয়ের এই মৌলিক পরীক্ষাটির দ্বারা এবং অঙ্গগুলির বিশিষ্টতার মান দ্বারা আধুনিক আকাররা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুযায়ী প্রাচীন আকারদের তুলনায় উচ্চতর পর্যায়ের হওয়া উচিত। এটাই কি ঘটনা? অধিকাংশ জীবাশ্মবিদরা হ্যাঁ বলে উত্তর দেবেন এবং সম্ভবত এই উত্তরকে সত্য বলে স্বীকার করতে হবে, যদিও এটি প্রমাণসাপেক্ষ।
এই সিদ্ধান্তে এটি সঠিক আপত্তি নয় যে সেই অতি দূরবর্তী ভূতাত্ত্বিক যুগ থেকে কোন কোন ব্র্যাকিওপড প্রাণীরা অল্প পরিবর্তিত হয়েছে, এবং স্থলভাগের ও স্বাদুজলের কোন কোন খোলকী প্রাণীরা এখনও পর্যন্ত জানা তাদের আবির্ভাবের সময় থেকে একইরকম রয়েছে। এটি কোন অনতিক্রম্য বাধা নয় যে ফোরামিনিফেরা প্রাণীরা, ডঃ কার্পেন্টারের মতানুযায়ী, এমনকি লরেন্সিয়ান যুগ থেকে জৈবিক গঠনে অগ্রগতি করেনি; কারণ কিছু জীব সরল জীবন-পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে থাকবে, এবং এইসব নিম্নস্তরের প্রোটোজোয়ার তুলনায় কোন্ জীব ভালভাবে অভিযোজিত হতে পারত? ওপরের মতো এইসব আপত্তি আমার মতবাদের পক্ষে ভয়ঙ্কর হবে, যদি প্রযোজনীয় আনুষঙ্গিক হিসেবে এটি জৈবসংগঠনের অগ্রগতিতে অন্তর্ভুক্ত হত। এরা এরূপে ভয়ঙ্কর হবে, যদি, উদাহরণস্বরূপ, উপরোক্ত ফোরামিনিফেরা প্রাণীরা লরেন্সিয়ান যুগে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল বলে প্রমাণ করা যেতে পারত অথবা উপরোক্ত ব্র্যাকিওপডরা ক্যামব্রিয়ান যুগে আবির্ভূত হয়েছিল বলে প্রমাণ করা যেতে পারত; কারণ এক্ষেত্রে, কিছু মান পর্যন্ত এইসব জীবের বিকাশের জন্য যথেষ্ট সময় না থাকতে পারত, যাতে তখন এরা পৌঁছেছিল। যখন যে-কোন নির্দিষ্ট লক্ষণ পর্যন্ত অগ্রগতি হয়, তখন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুযায়ী এদের আরও নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির আর প্রয়োজন থাকে না; যদিও এরা প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক ধাপের সময় অল্পভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে, যাতে শেষে এরা এদের পরিবেশের অল্প পরিবর্তন সাপেক্ষে নিজেদের স্থান ধরে রাখতে পারে। উপরোল্লিখিত আপত্তিগুলো এই প্রশ্নটির ওপর নির্ভর করে যে আমরা কি জানি পৃথিবীর বয়স কত এবং কোন্ যুগে জীবনের বিভিন্ন রূপগুলো প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল? এবং এগুলো ভালভাবে বিতর্কিত হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে জীবদেহের অগ্রগতি হয়েছে কিনা, এই সমস্যাটি অনেক দিক থেকেই অত্যন্ত জটিল। ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণসমূহ, যা সর্বদাই ত্রুটিপূর্ণ, অভ্রান্তভাবে দেখায় না যে পৃথিবীর জানা ইতিহাসে জীবদেহের বহুলাংশে অগ্রগতি হয়েছে। এমনকি বর্তমান যুগে, একই শ্রেণীর সদস্যদের দিকে লক্ষ্য করে প্রকৃতিবিদরা একমত হন না যে কোন্ কোন্ আকারদের সর্বোচ্চ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত : এভাবে কেউ কেউ সেলাসিয়ান বা হাঙ্গরদেরকে সর্বোচ্চ মাছ হিসেবে গণ্য করেছেন, যাদের দেহগঠন কোন কোন প্রধান বিষয়ে সরীসৃপদের কাছাকাছি; অন্যরা টেলিওস্টিয়ানদের সর্বোচ্চ হিসেবে গণ্য করেছেন। গ্যানয়েডরা সেলাসিয়ান এবং টেলিওস্টিয়ানদের মধ্যবর্তী হয়; পরেরটি বর্তমানে সংখ্যায় সর্বাধিক; কিন্তু আগে সেলাসিয়ান ও গ্যানয়েডরাই শুধু ছিল; এবং এক্ষেত্রে, উচ্চ পর্যায়ের মান হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য বলা হত যে দেহগঠনে মাছরা উন্নতি করেছে অথবা পশ্চাৎগামী হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের মান হিসেবে স্বতন্ত্র টাইপের সদস্যদের তুলনা করার চেষ্টা করা সম্ভবত নিরর্থক; কে সিদ্ধান্ত করবে যে একটি মৌমাছির তুলনায় একটি কাল্ মাছ উচ্চ বর্গের কিনা—যে-পতঙ্গটি সম্পর্কে বিখ্যাত ভন বেয়ার বিশ্বাস করতেন যে “প্রকৃতপক্ষে এটি একটি মাছের তুলনায় আরও বেশী সংগঠিত, যদিও অন্য ধরনের?” জটিল জীবনসংগ্রামে এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য যে খোলকী প্রাণীরা (ক্রাস্টেসিয়ান), যারা তাদের নিজস্ব শ্রেণীতে অতি উচ্চ বর্গের নয়, সর্বোচ্চ কম্বোজ (মলাস্কা) শ্রেণীর প্রাণী মস্তকপদীদের (সেফালোপড) পরাজিত করতে পারত; এবং এভাবে খোলকী প্রাণীরা যদিও অতিশয় বিকশিত নয়, যদি সমস্ত কিছু বিচারের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে এরা সবচেয়ে উচ্চবর্গের। কোন্ কোন্ আকারগুলো দেহগঠনে সবচেয়ে বেশী উন্নত এটি সিদ্ধান্ত করার স্বাভাবিক অসুবিধে ছাড়া যে-কোন দুটি যুগে একটি শ্রেণীর শুধুমাত্র সর্বোচ্চ সদস্যদের তুলনা করা আমাদের উচিত নয় – যদিও সমতা আনার জন্য সন্দেহাতীতভাবে এটি একটি এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—বরং এই দুটি যুগের উচ্চ এবং নিম্ন পর্যায়ের সমস্ত সদস্যদের তুলনা করা উচিত। একটি প্রাচীন যুগে উচ্চ এবং নিম্নবর্গের কম্বোজ জাতীয় প্রাণীরা, যেমন মস্তকপদী এবং ব্র্যাকিওপডরা সংখ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে ছিল, বর্তমানে উভয় গোষ্ঠী ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে দেহগঠনে মধ্যবর্তী অন্যরা বিরাটভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; ফলস্বরূপ কয়েকজন প্রকৃতিবিদ বলেন যে কম্বোজ প্রাণীরা বর্তমানের তুলনায় পূর্বে আরও উন্নত পর্যায়ের ছিল; কিন্তু উল্টোদিকে আর একটি বিষয় বলা যেতে পারে যে ব্র্যাকিওপডরা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে, এবং প্রকৃতপক্ষে যদিও সংখ্যায় অল্প বর্তমানের মস্তকপদী প্রাণীরা তাদের আদিম প্রতিনিধিদের তুলনায় আরও বেশী সংগঠিত। সমগ্র পৃথিবীর যে-কোন দুটি যুগের উচ্চ এবং নিম্ন শ্রেণীদের আপেক্ষিক আনুপাতিক সংখ্যা আমাদের তুলনা করা উচিত: উদাহরণস্বরূপ, যদি বর্তমানকালে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের পঞ্চাশ হাজার ভ্যারাইটি বেঁচে থাকে, এবং যদি আমরা জানি যে পূর্বের কোন যুগে শুধুমাত্র দশ হাজার ভ্যারাইটি বেঁচে ছিল, তাহলে সর্বোচ্চ শ্রেণীতে সংখ্যার এই বৃদ্ধির দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত, যা নিম্ন আকারদের বিরাটভাবে স্থানচ্যুতির ইঙ্গিত দেয় এবং দেহগঠনে দৃঢ় অগ্রগতির ইঙ্গিত বহন করে। পর্যায়ক্রমিক যুগের অসম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত প্রাণীকুলের দেহগঠনের মানগুলি এরূপ জটিল সম্পর্কসমূহের মধ্যে নিখুঁতভাবে তুলনা করা কত অসুবিধাজনক, এভাবে তা আমরা লক্ষ্য করি।
বর্তমানের কোন কোন প্রাণী (ফনা) ও উদ্ভিদ (ফ্লোরা) কুল লক্ষ্য করলে আরও স্পষ্টভাবে এই বাধাটি উপলব্ধি করা যায়। যে অস্বাভাবিক উপায়ে ইউরোপীয় উৎপাদনগুলো নিউজিল্যান্ডে বিস্তৃত হয়েছে এবং স্থানসমূহ অধিকার করেছে, যেখানে দেশজরা পূর্বে নিশ্চয় অধিকার করেছিল, এটি লক্ষ্য করে আমরা নিশ্চয় বিশ্বাস করব যে যদি গ্রেট ব্রিটেনের সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদদের নিউজিল্যান্ডে এনে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে অসংখ্য ব্রিটিশ আকাররা সময়ের গতিতে সম্পূর্ণরূপে অভিযোজিত হবে এবং অনেক দেশজদের ধ্বংস করবে। বিপরীতক্রমে, দক্ষিণ গোলার্ধের অধিবাসীরা কদাচিৎ ইউরোপের কোন কোন অংশে বন্য হয়েছে এই তথ্যটি থেকে আমরা মনে করতে পারি যে যদি নিউজিল্যান্ডের সমস্ত উৎপাদনগুলোকে গ্রেট ব্রিটেনে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কোন বিশেষ সংখ্যক জীব আমাদের দেশজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলসমূহ অধিকার করতে সমর্থ হবে কিনা। এই মতানুসারে, গ্রেট ব্রিটেনের উৎপাদনসমূহ নিউজিল্যান্ডের উৎপাদনসমূহের তুলনায় উচ্চ পর্যায়ের হয়। তথাপি দুটি দেশের প্রজাতিদের পরীক্ষা করে অতি দক্ষ প্রকৃতিবিদও এই ফল আগে দেখতে পারতেন না।
আগাসি এবং কয়েকজন দক্ষ বিচারক জোরের সঙ্গে বলেন যে প্রাচীন প্রাণীরা একই শ্রেণীর অন্তর্গত বর্তমানের প্রাণীদের ভ্রূণের সঙ্গে কিছু পরিমাণ সদৃশ হয় এবং বিলুপ্ত আকারদের ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ক্রম বর্তমানের আকারদের ভ্রূণ সংক্রান্ত বিকাশের সঙ্গে প্রায় সমান্তরাল হয়। এই মতবাদ আমাদের তত্ত্বের সঙ্গে চমৎকারভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আমি দেখাতে চেষ্টা করব যে পূর্ণবয়স্কটি তার ভ্রূণ থেকে ভিন্ন হয়, কারণ পরিবর্তন প্রাথমিক বয়সে বাধা হিসেবে উপস্থিত হয় না এবং সমরূপ বয়সে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়াটি, যেখানে ভ্রূণ প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে, বংশানুক্রমিকভাবে অধিক সংখ্যক পার্থক্য অনবরত প্রাপ্তবয়স্কটিতে যুক্ত করে। এরূপে প্রজাতির পূর্বের এবং কম রূপান্তরিত অবস্থার প্রকৃতি দ্বারা সংরক্ষিত একটি ছবি ভ্রূণে থাকে। এই মতবাদটি সত্য হতে পারে এবং তথাপি কখনও প্রমাণিত হতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, জ্ঞাত আদিমতম স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ এবং মাছরা কঠোরভাবে নিজেদের উপযুক্ত শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়, যদিও এইসব আদিম আকারদের কয়েকটি বর্তমানকালের একই গোষ্ঠীদের টিপিক্যাল সদস্যদের তুলনায় পরস্পরের থেকে কম মাত্রায় ভিন্ন হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্যামব্রিয়ানের সর্বনিম্ন স্তরের নিচে জীবাশ্মসমৃদ্ধ স্তর আবিষ্কৃত হচ্ছে ততক্ষণ মেরুদণ্ডী প্রাণীদের সাধারণ ভ্রূণগত বৈশিষ্ট্য সমেত প্রাণীদের অন্বেষণ করা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে—কিন্তু এমন আবিষ্কারের সম্ভাবনা নিতান্তই অল্প।
টার্শিয়ারি যুগের পরবর্তীকালে একই অঞ্চলের একই ধরনগুলোর পর্যায়ক্রম
বহুবছর আগে মিঃ ক্লিফ্ট দেখিয়েছিলেন যে অস্ট্রেলিয়ার গুহায় জীবাশ্ম-স্তন্যপায়ীরা ঐ মহাদেশের জীবিত মার্সুপিয়াল প্রাণীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। লা প্লাটার বিভিন্ন অংশে প্রাপ্ত আর্মাডিলোর বর্মের মত একটি বিশাল বর্ম দক্ষিণ আমেরিকায় এই একই সম্পর্ককে স্পষ্টরূপে দেখিয়ে দেয়, এমনকি এ বিষয়ে অজ্ঞ লোকেদের চোখেও তা ধরা পড়ে। এবং অধ্যাপক ওয়েন চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন যে এখানে এত সংখ্যায় সমাহিত জীবাশ্ম-স্তন্যপায়ীদের অধিকাংশই দক্ষিণ আমেরিকার ধরনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এম.এম.লান্ড এবং ক্লাউসেন দ্বারা ব্রাজিলের গুহা থেকে সংগৃহীত অশ্মীভূত হাড়ের চমৎকার সংগ্রহে এই সম্পর্ক আরও স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। এইসব দ্বারা আমি এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ১৮৩৯ এবং ১৮৪৫ সালে টাইপগুলোর পর্যায়ক্রমের নিয়মটির ওপরে—”একই মহাদেশে মৃত এবং জীবিতদের মধ্যে এই আশ্চর্যজনক সম্পর্ক”-এর ওপর আমি জোর দিয়ে লিখেছিলাম। পরবর্তীকালে অধ্যাপক ওয়েন পুরাতন পৃথিবীর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে একই সাধারণ নিয়মের কথা উল্লেখ করেছেন। এই লেখক কর্তৃক নিউজিল্যান্ডের বিলুপ্ত এবং বিশাল পাখিদের পুনরুদ্ধারেও আমরা একই নিয়ম দেখি। ব্রাজিলের গুহার পাখিদের ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায়। মিঃ উডওয়ার্ড দেখিয়েছেন যে সামুদ্রিক খোলকী (শেল) প্রাণীদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য, কিন্তু কম্বোজ ( মলাস্কা) প্রাণীদের ব্যাপক বিস্তারের জন্য এটি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় না। অন্য অনেক বিষয়ও যোগ করা যেতে পারে, যেমন ম্যাডেইরার বিলুপ্ত ও জীবিত স্থলজ খোলকী প্রাণীদের মধ্যেকার সম্পর্ক এবং আরালো ক্যাসপিয়ান সমুদ্রের ঈষৎ লোনাজলের বিলুপ্ত ও জীবিত জলজ খোলকী প্রাণীদের মধ্যেকার সম্পর্ক।
একই অঞ্চলের একই টাইপদের পর্যায়ক্রমের এই বিশেষ নিয়মটির অর্থ কি? তিনি একজন সাহসী ব্যক্তি হবেন যিনি একই অক্ষাংশে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশের এবং অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান জলবায়ুর তুলনা করে একদিকে ভিন্ন ভৌতিক পরিবেশের এই দুটি মহাদেশের অধিবাসীদের অসদৃশতা এবং অন্যদিকে এইরকম পরিবেশের টার্শিয়ারি যুগের পরবর্তীকালে প্রত্যেক মহাদেশের একই টাইপদের সদৃশতার কারণ দেখাতে চেষ্টা করবেন। অথবা এমনটি দাবী করা যেতে পারে না যে এটি একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ম যে মাসুপিয়াল প্রাণীরা মূলতঃ বা শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়াতে সৃষ্ট হয়েছে; অথবা দত্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণী (এডেন্টাটা) এবং আমেরিকায় অন্য টাইপগুলো শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকায় উদ্ভূত হয়েছে। কারণ আমরা জানি যে আদিম যুগে ইউরোপে অসংখ্য মাসুপিয়াল প্রাণীরা বাস করত; এবং ওপরে উল্লিখিত প্রকাশনায় আমি দেখিয়েছি যে আমেরিকায় স্থলচর স্তন্যপায়ীদের বিস্তারের নিয়ম এখন যা আছে আগে তার থেকে ভিন্ন ছিল। মহাদেশটির দক্ষিণার্ধের বর্তমান বৈশিষ্ট্য দক্ষিণ আমেরিকা আগে ধারণ করেছিল এবং বর্তমানের তুলনায় দক্ষিণার্ধ উত্তরার্ধের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সম্বন্ধযুক্ত ছিল। ফ্যালকনার এবং কাটলের আবিষ্কারসমূহ থেকে একইভাবে আমরা জানি যে বর্তমানের তুলনায় উত্তর ভারতের স্তন্যপায়ীরা আফ্রিকার স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। সামুদ্রিক প্রাণীদের বিস্তার সম্পর্কে ও অনুরূপ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে, একই অঞ্চলের একই টাইপগুলির—দীর্ঘস্থায়ী অথচ অপরিবর্তনীয় নয়—– পর্যায়ক্রমের বিরাট নিয়মটি এতক্ষণে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কারণ পৃথিবীর প্রত্যেক অংশের অধিবাসীরা পরবর্তী ধারাবাহিক কালে ঐ অংশে ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত অথচ কিছুমাত্রায় রূপান্তরিত বংশধরদের রেখে যাওয়ার স্পষ্ট প্রবণতাযুক্ত হবে। একটি মহাদেশের অধিবাসীরা যদি অন্য মহাদেশের অধিবাসীদের থেকে পূর্বে বিরাটভাবে ভিন্ন হত, তাহলে এদের রূপান্তরিত বংশধররা প্রায় একইভাবে এবং মাত্রায় এখনও ভিন্ন হত। কিন্তু অতি আন্তঃপ্রচরণ ধরে নিয়ে, বহু যুগ পরে এবং বিরাট ভৌগোলিক পরিবর্তনের পর দুর্বল আকাররা সবল আকারদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে এবং জীবদের বিস্তারে কোন কিছু ধ্রুব থাকবে না।
বিদ্রূপ সহকারে প্রশ্ন করা যেতে পারে—আমি কি মনে করি যে মেগাথেরিয়াম এবং সম্পর্কিত অন্য বিশালাকার প্রাণীরা, যারা পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাস করত, তারা তাদের অধঃপতিত বংশধর হিসেবে শ্লথ, আর্মাডিলো এবং পিপীলিকাভুক প্রাণীদের রেখে গেছে? মুহূর্তের জন্যেও এটি স্বীকার করা যেতে পারে না। এইসব বিশালাকার প্রাণীরা সামগ্রিকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে এবং কোন বংশধর রেখে যায়নি। কিন্তু ব্রাজিলের গুহাগুলোতে অনেক বিলুপ্ত প্রজাতি রয়েছে, যারা দক্ষিণ আমেরিকায় এখনও জীবিত প্রজাতিদের সঙ্গে আকারে এবং অন্য সব বৈশিষ্ট্যে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত; এবং এইসব প্রজাতিদের কয়েকটি জীবিত প্রজাতিদের প্রকৃত পূর্বপুরুষ হয়ে থাকতে পারে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আমাদের তত্ত্বানুসারে একই গণের সমস্ত প্রজাতিরা হচ্ছে কোন একটি প্রজাতির বংশধর; সুতরাং প্রত্যেকে আটটি প্রজাতি সম্বলিত ছয়টি গণকে যদি একটি ভূতাত্ত্বিক স্তরসমষ্টিতে পাওয়া যেত এবং পরবর্তী স্তরসমষ্টিতে একই সংখ্যক প্রজাতি সম্বলিত ছয়টি সম্পর্কিত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক গণ থাকত, তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারতাম যে পুরানো গণগুলোর প্রত্যেকটির সাধারণতঃ শুধুমাত্র একটি প্রজাতি রূপান্তরিত বংশধরদের রেখে যায়, যারা কয়েকটি প্রজাতি সম্বলিত নূতন গণগুলো সৃষ্টি করে; প্রত্যেক পুরানো গণের অন্য সাতটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং কোন বংশধর রেখে যায়নি। অথবা, এবং এটি সবচেয়ে সাধারণ ঘটনা হবে, ছয়টি পুরানো গণের মধ্যে শুধুমাত্র দুই অথবা তিনটি গণের দুটি অথবা তিনটি প্রজাতি নূতন গণগুলোর পিতামাতা হবে : অন্য প্রজাতি এবং অন্য পুরানো গণগুলো সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। গণ এবং প্রজাতির সংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্ত অর্ডারগুলোতে, যেমন দক্ষিণ আমেরিকার দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (এডেন্টাটার) ক্ষেত্রে হয়, তখনও অল্প কিছু গণ ও প্রজাতি রূপান্তরিত রক্তসম্পর্কিত বংশধর রেখে যাবে।
পূর্ববর্তী এবং বর্তমান অধ্যায়ের সারাংশ
আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি যে ভূতাত্ত্বিক সাক্ষাপ্রমাণ অতিশয় ত্রুটিপূর্ণ; পৃথিবীর কেবল অল্প অংশেই যত্নের সঙ্গে ভূতাত্ত্বিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে; জীবদের শুধুমাত্র কোন কোন শ্রেণী জীবাশ্ম অবস্থায় বিরাটভাবে সংরক্ষিত হয়েছে; আমাদের জাদুঘরগুলোতে সংরক্ষিত নমুনা ও প্রজাতিদের উভয়ের সংখ্যা বংশগুলোর সংখ্যার তুলনায় কিছুই নয়, বংশগুলো একমাত্র স্তরের গঠনের সময় বিলুপ্ত হয়ে থাকবে; অনেক প্রকার জীবাশ্ম-প্রজাতিতে পরিপূর্ণ স্তরগুলোর পুঞ্জীভবনের জন্য অবনমন প্রায় অপরিহার্য; ভবিষ্যতের অবক্ষয়ের তুলনায় বেশীদিন স্থায়ী হতে যথেষ্ট পুরু, আমাদের পর্যায়ক্রমিক স্তরসমষ্টির অধিকাংশের মধ্যে বিরাট বিরাট সময় নিশ্চয় অতিবাহিত হয়েছে; অবনমনের সময় সম্ভবত আরও বেশী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং উত্থানের সময় সম্ভবত আরও বেশী পরিবর্তন ঘটেছে, এবং শেষেরটির সময় সাক্ষ্যপ্রমাণসমূহ সম্ভবত কম নিখুঁতভাবে রক্ষিত হয়েছে; প্রত্যেক স্তর ধারাবাহিকভাবে সঞ্চিত হয়নি; প্রত্যেক স্তরের স্থায়িত্ব প্রজাতিক আকারদের গড় স্থায়িত্বকালের তুলনায় সম্ভবত অল্প; প্রচরণ যে-কোন একটি অঞ্চলে এবং স্তরে নূতন আকারদের প্রথম আবির্ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে; ব্যাপকভাবে বিস্তৃত প্রজাতিরাই প্রায়শঃই পরিবর্তিত হয়েছে এবং প্রায়শই নূতন প্রজাতি সৃষ্টি করেছে; ভ্যারাইটিরা প্রথমে স্থানীয় হয়; এবং অবশেষে, যেহেতু প্রত্যেক প্রজাতি অসংখ্য সংক্রমণ বা উত্তরণগত ধাপ অতিক্রম করেছে, সেহেতু এটি সম্ভবপর যে যুগগুলো, যখন প্রত্যেকে রূপান্তরিত হয়েছিল, যদিও বছর দ্বারা মাপলে অনেক এবং দীর্ঘ হয়, সেই যুগগুলোর তুলনায় অল্প, যে যুগগুলির সময় প্রত্যেকে অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকেছিল। এইসব কারণ একত্রে যুক্ত করলে এটি বহুলাংশে প্ৰমাণিত হয় যে কেন আমরা সূক্ষ্মতম ক্রমিক ধাপগুলো দ্বারা সমস্ত বিলুপ্ত ও জীবিত আকারদের একত্রে সংযুক্তকারী অসংখ্য ভ্যারাইটি দেখি না, যদিও আমরা অনেক সংযোজক দেখি। সবসময় মনে রাখা উচিত যে দুটি আকারের মধ্যে যা পাওয়া যেতে পারত, যে-কোন সংযোজক ভ্যারাইটিকে, যতক্ষণ না সমগ্র শৃংখলটিকে নিখুঁতভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, একটি নূতন এবং ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা উচিত হবে; কারণ এমনটা দাবী করা যায় না যে আমাদের হাতে বিচারের এমন কোন নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড আছে যার দ্বারা প্রজাতি এবং ভ্যারাইটিকে পৃথক করা যেতে পারে।
যিনি ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ত্রুটিপূর্ণতার মতটি বাতিল করেন, তিনি সমগ্র তত্ত্বটিকে সঠিকভাবেই বাতিল করবেন। কারণ, বিফলে বা অকারণে তিনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন—একই বিরাট স্তরসমষ্টির পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলোতে অসংখ্য সংক্ৰমণগত সংযোজকগুলো কোথায় আছে, যারা নিবিড়ভাবে সম্বন্ধযুক্ত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিদের পূর্বে নিশ্চয় সংযুক্ত করে থাকবে? তিনি বিরাট বিরামকালকে অবিশ্বাস করতে পারেন, যা আমাদের ধারাবাহিক স্তরসমষ্টির মধ্যে নিশ্চয় অতিবাহিত হয়েছে; প্রচরণ কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা তিনি উপেক্ষা করতে পারেন, যখন ইউরোপের স্তরসমষ্টির মত যে-কোন একটি অঞ্চলের স্তরসমষ্টিকে বিবেচনা করা হয়; তিনি প্রজাতির সমগ্র গোষ্ঠীর আপাত, কিন্তু প্রায়শই ভুলবশতঃ আপাত হঠাৎ আবির্ভাবের সপক্ষে মতপ্রকাশ করতে পারেন। তিনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন সেইসব অসংখ্য জীবদের ধ্বংসাবশেষ কোথায়, যারা ক্যামব্রিয়ান সিস্টেম সঞ্চিত হওয়ার বহু পূর্বে অবস্থান করে থাকতে পারে? আমরা এখন জানি যে অন্ততঃ একটি প্রাণী তখন ছিল; কিন্তু এই শেষের প্রশ্নটির উত্তর আমরা দিতে পারি শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে যে যেখানে এখন আমাদের মহাসমুদ্রগুলো অবস্থিত, সেখানে বিরাট বিরাট যুগ ধরে এরা বিস্তৃত হয়েছে, এবং যেখানে আমাদের স্পন্দমান মহাদেশসমূহ এখন অবস্থিত সেখানে এরা ক্যামব্রিয়ান সিস্টেমের শুরু থেকেই অবস্থান করে আছে; কিন্তু ঐ যুগের বহু পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা একেবারেই ভিন্ন ছিল; এবং আমাদের জানা যে-কোন প্রাচীনতর স্তরসমষ্টি দ্বারা সৃষ্ট প্রাচীনতর মহাদেশসমূহ রূপান্তরিত অবস্থায় অবশিষ্টাংশ হিসেবে শুধুমাত্র এখন অবস্থিত আছে অথবা এখনও সমুদ্রের তলায় রয়েছে।
এইসব প্রতিবন্ধক অতিক্রম করলে, জীবাশ্মবিদ্যায় অন্য বিরাট ঘটনাসমূহ পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরের সঙ্গে উদ্ভবের তত্ত্বটির সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে খাপ খায়। আমরা এখন বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে নূতন প্রজাতিরা মন্থরভাবে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে সৃষ্ট হয়; কেমন করে এটি হয় যে বিভিন্ন শ্রেণীর নূতন প্রজাতিরা একই হারে অথবা একই মাত্রায় একত্রে পরিবর্তিত হয় না, তথাপি পরিণামে সকলে কিছুমাত্রায় রূপান্তরিত হয়। পুরানো আকারদের বিলুপ্তি নূতন আকারদের সৃষ্টির অনিবার্য পরিণতি হয়। আমরা বুঝতে পারি যখন একটি প্রজাতি একবার বিলুপ্ত হয়, তখন পুনরায় কখনও আবির্ভূত হয় না কেন। প্রজাতিদের গোষ্ঠীসমূহ সংখ্যায় মন্থরভাবে বৃদ্ধি পায় এবং অসমান সময় ধরে স্থায়ী হয়; কারণ রূপান্তর-প্রক্রিয়াটি মন্থর এবং অনেক জটিল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিরাট ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীদের অন্তর্গত প্রভাবশালী প্রজাতিরা অনেক রূপান্তরিত বংশধর রেখে যেতে প্রবণ হয়, যারা নূতন উপ-গোষ্ঠী এবং গোষ্ঠীসমূহ সৃষ্টি করে। যেহেতু এগুলো সৃষ্টি হয়, সেহেতু কম সবল গোষ্ঠীদের প্রজাতিরা, একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হীনতার জন্য একত্রে বিলুপ্ত হওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয় এবং পৃথিবীতে কোন রূপান্তরিত বংশধর রেখে না যাওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয়। কিন্তু প্রজাতিদের একটি সমগ্র গোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি কোন কোন সময় মন্থর প্রক্রিয়া হয়, যখন কয়েকটি বংশধর সংরক্ষিত ও অবিচ্ছিন্ন পরিবেশে বেঁচে থাকে; যখন একটি গোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে বিলুপ্ত হয়, তখন এরা কখনও পুনরাবির্ভূত হয় না, কারণ বংশধারাটি ভেঙে যায়।
আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে প্রভাবশালী আকাররা, যারা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয় এবং অসংখ্য ভ্যারাইটি সৃষ্টি করে, সম্পর্কিত অথচ রূপান্তরিত বংশধরদের দ্বারা সারা পৃথিবীকে পূর্ণ করে দেওয়ার প্রবণতাযুক্ত হয়; এবং এরা জীবনসংগ্রাম গোষ্ঠীদের স্থানচ্যুত করতে সাধারণতঃ সমর্থ হবে। অতএব দীর্ঘ সময় অন্তরে, পৃথিবীর উৎপাদনসমূহ যুগপৎ পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে হয়।
আমরা বুঝতে পারি কেমন করে এটি হয় যে প্রাচীন এবং সাম্প্রতিক জীবনের সব আকাররা একত্রে কতিপয় শ্রেণী সৃষ্টি করে। বৈশিষ্ট্যের ভিন্নমুখীতার অনবরত প্রবণতা থেকে আমরা বুঝতে পারি কেন একটি আকার যত বেশী প্রাচীন হয়, সাধারণত এটি তত বেশী বর্তমানের জীবিতদের থেকে ভিন্ন হয়; কেন প্রাচীন এবং বিলুপ্ত আকাররা, পূর্বে ভিন্ন হিসেবে শ্রেণীভুক্ত দুটি গোষ্ঠী কোন কোন সময় একটিতে একত্রে মিলে গিয়ে বর্তমান আকারদের মধ্যে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে প্রায়শই প্রবণতাযুক্ত হয়; একটি আকার যত বেশী প্রাচীন হয়, বর্তমানে ভিন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে কিছুমাত্রায় তত বেশী এটি মধ্যবর্তী হয়; কারণ একটি আকার যত বেশী প্রাচীন হয়, তত বেশী ব্যাপকভাবে ভিন্ন গোষ্ঠীদের সাধারণ পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় এবং ফলস্বরূপ সদৃশ হয়। বিলুপ্ত আকাররা কদাচিৎ বর্তমান আকারদের প্রত্যক্ষভাবে মধ্যবর্তী হয়; কিন্তু অন্য বিলুপ্ত ও ভিন্ন আকারদের মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি লম্বা এবং ঘোরা পথে মধ্যবর্তী হয়। আমরা স্পষ্টতঃ দেখতে পারি কেন ধারাবাহিক স্তরসমষ্টির জৈবিক ধ্বংসাবশেষসমূহ নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয়; কারণ এরা বংশের দ্বারা নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়। আমরা স্পষ্ট দেখতে পারি কেন একটি মধ্যবর্তী ভূস্তরের জৈব অবশেষসমূহ বৈশিষ্ট্যে মধ্যবর্তী হয়।
ইতিহাসের প্রত্যেক পর্যায়ক্রমিক যুগে পৃথিবীর অধিবাসীরা জীবনযুদ্ধে তাদের পূর্বসূরীদের পরাজিত করেছে এবং উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এবং তাদের দেহগঠন সাধারণতঃ আরও বিশিষ্ট হয়েছে; এবং অসংখ্য জীবাশ্মবিদদের সাধারণ বিশ্বাসটি বিচার করা যেতে পারে যে সামগ্রিকভাবে জৈব সংগঠনটি উন্নত হয়েছে। বিলুপ্ত ও প্রাচীন প্রাণীরা একই শ্রেণীসমূহের অন্তর্গত আরও সাম্প্রতিক প্রাণীদের ভ্রূণগুলির কিছু মাত্রায় সদৃশ হয়, এবং এই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি আমাদের মতবাদ অনুসারে একটি সরল ব্যাখ্যা প্রাপ্ত হয়। পরবর্তী ভূতাত্ত্বিক যুগগুলোর সময় একই অঞ্চলে দেহগঠনের একই ধরনের পর্যায়ক্রম রহস্যাবৃত থাকে না এবং বংশগতির পদ্ধতি অনুযায়ী বোধগম্য হয়।
যদি এরপর অনেকের বিশ্বাস মত ভূতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণটি ত্রুটিপূর্ণ হয়, এবং জোরের সঙ্গে বলা যেতে পারে যে সাক্ষ্যপ্রমাণটি যে আরও বেশী ত্রুটিহীন তা প্রমাণ করা যেতে পারে না, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তিসমূহ আরও বিরাটভাবে হ্রাস পেয়েছে অথবা অন্তর্হিত হয়েছে। বিপরীতক্রমে, জীবাশ্মবিদ্যার সমস্ত প্রধান নিয়মগুলো ঘোষণা করে যে প্রজাতিরা সাধারণ বংশ দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে : প্রাচীন আকাররা পরিবৃত্তি এবং সর্বোত্তমের উদ্বর্তনের সৃষ্ট ফল জীবনের নূতন এবং উন্নত আকারদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়েছে।