১১. জায়গাটা অন্ধকার

জায়গাটা অন্ধকার।

দুটি জড়াছড়ি করা লিচুগাছ চারদিক অন্ধকার করে রেখেছে। জহুর লিচু-গাছ দুটির নিচে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এ বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। বসার ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের অস্বচ্ছ আলো আসছে জানালা গলে। জহুর একবার দেখল শাড়িপরা একটি মেয়ে জানালার ওপাশ দিয়ে হেঁটে গেল। কে? যদি ভাইয়ের বৌ মিনু ভাবী? একটি ছোট্ট ছেলে পড়ছে। বদি ভাইয়ের ছেলে নিশ্চয়ই। আর কেউ তো থাকবে না এখানে। জহুর একটু কাশল। বাড়ির ভেতর থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তী কণ্ঠে কেউ বলল, কে, কে?

জহুর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না। কত বার এসেছে এ বাড়িতে, প্রতি বারই তার এরকম হয়েছে। মিনু ভাবী যত বার বলেছেন, কে, কে? তত বারই সে অন্য এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করেছে এবং প্রতি বারই ভেবেছে আর আসবে না এ বাড়িতে। তবু এসেছে। মিনু ভাবী বেশ কয়েক বার বলেছেন, আপনি সরাসরি আসেন না কেন? প্রায়ই দেখি লিচুগাছের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর আসেন। অত্যন্ত সহজ এবং সাধারণ কথা। তবু জহুর কুলকুল করে ঘেমেছে।

মিনু দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। রোগামতো লম্বা একটি মেয়ে। গলায় পাতলা একটি চেইন। মুখে সব সময় পান। জহুর যত বার গিয়েছে তত বার বলেছে, পান দেব আপনাকে ভাই?

জ্বি-না, ভাবী।

না কেন? খেয়ে দেখেন। কাঁচা খয়ের আছে। ও কি, মাথা নিচু করে ফেললেন যো যা ভাবছেন তা না ভাই। পান-পড়া দিচ্ছি না।

মিনু খিলখিল করে হাসত। গলা ফাটিয়ে হাসতেন বদি ভাই। এই জাতীয় রসিকতা বড়ো পছন্দ ছিল বদি ভাইয়ের। কিন্তু শেষের দিকে কী হল কে জানে, জহুর লক্ষ করল বদি ভাই তাকে দেখলেই কেমন গম্ভীর হয়ে পড়তেন। এক দিন পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, তুই এত ঘনঘন আসিস না, বুঝলি?

কেন?

লোজন নানান কথা বলে। কী দরকার?

জহুর অবশ্যি তার পরেও গিয়েছে। যদি তাই শেষমেষ কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন। শুধু বদি ভাই না, মিনু ভাবীও অস্বস্তি বোধ করত। বেশিক্ষণ থাকত না সামনে। ইশ, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে বলেই চট করে উঠে পড়ত।

জহুর সিগারেটটা ফেলে দিল।

হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল মিলু। ভয়ার্ত স্বরে বলল, কে ওখানে? কে?

আমি। আমি জহুর।

মিনু বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

ভাবী, আমাকে চিনতে পারছেন তো?

মিনু মৃদু স্বরে বলল, ভেতরে আসেন জহুর ভাই।

জহুর ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়াল।

আপনি ছাড়া পেয়েছেন শুনেছি। আপনি না আসলে আমি নিজেই যেতম।

ভালো আছেন ভাবী?

হুঁ।

এইটি আপনার ছেলে? কী নাম?

রতন। এই, চাচাকে মালিকুম দাও।

রতন কিছু বলল না। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল। বদি ভাইয়ের মতো বড়ো বড়ো চোখ হয়েছে ছেলেটির।

জহুর ভাই, আপনি বসেন। এই চেয়ারটায় বসেন।

জহুর বসল না। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে ফেলল, ভাবী, আমি একটা কথা জানতে এলাম। আপনার মনে কি আমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে? আপনি কি কোনো দিন ভেবেছেন আমি এই কাজটা করেছি?

মিনু ভাবী কঠিন স্বরে বললেন, ছিঃ জহুর ভাই, ছিঃ! আপনি আমাকে এত ছোট ভাবলেন?

জহুর ক্লান্ত স্বরে বলল, জেলখানাতে আমার একটা কষ্টই ছিল। আমি শুধু ভাবতাম, আপনি কি বিশ্বাস করেছেন আমি এই কাজটা করেছি?

মিনু লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। জহুর দেখল, মিনু ভাবীর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। শুধু মাথার ঘন চুল একটু যেন পাতলা হয়েছে। কপালটা অনেকখানি বড়ো দেখাচ্ছে। গায়ের রংটাও যেন একটু ফর্সা হয়েছে। বয়স বাড়লে গায়ের রং ফর্সা হয় নাকি, কে জানে?

জহুর ভাই, আপনি বসেন।

জহুর বসল। মিনু চলে গেল ভেতরে। শুধু ছেলেটি ঘুরঘুর করতে লাগল। মনে হয় গঙ্গট করতে চায়। জহুরের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে শুধু তাকিয়ে রইল। ভেতরে টুনটুন শব্দ হচ্ছে। চা বোধ হয়। চা এবংহালুয়া। জহুরের মনে হল সে অনন্তকাল ধরে এ বাড়ির কালো কাঠের চেয়ারে বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *