আজ সকালে বেশ কুয়াশা পড়েছিল। এখন কুয়াশা নেই, কিন্তু চারদিকে সূর্য ওঠার অনেক আগে যেমন অন্ধকার-অন্ধকার তেমনি করে আছে। শীত করছে। হাতের তোলো মরা মাছের মত মনে হচ্ছে। কী যেন কোথায় হলে তারই অপেক্ষায় মুগ্ধ হয়ে আছে বস্তুপুঞ্জ। দ্যালানগুলো যেন ঝুঁকে পড়েছে সম্মুখে, পথটা উঠে গেছে দূরে, যেমন পাহাড়ে। একটা করে গাড়ির শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে সময়কে তোলপাড় করে চলে সাচ্ছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে। মানুষগুলো পর্যন্ত খুব তাড়াতাড়ি পা ফেলে হাঁটছে।
তখন জাহেদা এলো। তার স্কুটার ফটক পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে এসে ভেতরে ঢোকার জন্যে নাক বাড়াল। হাত দিয়ে থামাল জাহেদা। নেমে অত্যন্ত মনোযোগ নিয়ে পয়সা খুঁজতে লাগল ব্যাগে।
আটটা বাজতে আঠার মিনিট বাকি।
বাবর এতক্ষণ বারান্দাতেই দাঁড়িয়েছিল। ফটকে ঢুকেই তাকে দেখেছে জাহেদা। আর বাবরও দেখেছে স্তব্ধ, উদ্বিগ্ন, পাণ্ডুরতাকে। যেন ফাঁসির মঞ্চে যাচ্ছে জাহেদা। পরনেও তার কালো পাজামা, কালো কামিজ, পায়ে কালো ফিতের স্যান্ডেল।
বাবর তার পয়সা দেয়া দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়েই। যেন সে ভুলে গেছে চলা, এক মুহুর্তা অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর টিকটিক করে নেমে এসে সামনে দাঁড়াল। হাসল একটু।
জাহেদা জবাবে হাসল না, কথা বলল না, পয়সা গুণে দিল স্কুটারিওলাকে। বাবর তার ছোট সুটকেশটা নিয়ে বারান্দায় গেল। পেছনে পেম্বনে এলো জাহেদা। দরোজা খুলে ধরল বাবর। মাথা নিচু করে জাহেদা দ্রুত ঢুকল, সমুখেই যে আসন পেল তাতে বসে পড়ল। সুটকেশটা রেখে বাবর হাসল আবার।
এবার জাহেদা ছোট একটু হাসল। কিন্তু চোখ উদ্ভাসিত হলো না সে আলোয়। সেখানে তখনো উদ্বেগ আর শঙ্কায় শাসন।
চা খেয়েছ?
জাহেদা মাথা নাড়ল।
নাশতা হয়নি?
তেমনি নিঃশব্দে মাথা নাড়ল জাহেদা। কোনো কথা না বলে, শুধু গভীর চোখে জাহেদার চোখ একবার বিদ্ধ করে বাবর তখন ভেতরে গেল। জাহেদার জন্য নাশতা সে বানিয়েই রেখেছিল। ভেতরে এসে একবার দেখে নিল সব ঠিক আছে কি-না। মান্নানকে গরম দুধ দিতে বলল। চায়ের জন্যে পানি বসাল বাবর। তারপর বাইরে এসে বলল, এসো।
জাহেদা প্রশ্নের চোখে তাকাল।
নাশতা করবে।
নীরবে জাহেদা তাকে অনুসরণ করল। এসে ডাইনিং টেবিলে বসল। তার বিপরীতে, দূরে বসল বাবর। জাহেদা এক চামচ কর্নফ্লেকস খেল, এক টুকরো রুটি মুখে দিল, ওমলেটের একটা কোণ ভাঙ্গল। একটা ছোট চুমু দিল বাবরের বানিয়ে দেয়া চায়ে।
বাবরের একবার মনে হলো বলে, এত কম খাচ্ছে কেন?–কিন্তু বলতে পারল না। কেমন যেন একটা সম্মোহন তাকেও পেয়ে বসেছে। জাহেদাকে একই সঙ্গে চেনা এবং অচেনা মনে হচ্ছে তার। মন্ত্রমুগ্ধের মত সে তাকিয়ে রইল ঐ কালো কামিজের ওপর জীবন্ত গম্ভীর কোমল মুখখানার দিকে।
জাহেদা একবার চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। পরীক্ষণে চোখ নামিয়ে রুটি ছিড়ল একটু। কিন্তু সেটা মুখে দিল না। আবার তাকাল বাবরের দিকে।
বাবর বলল, টেলিগ্রামটা কখন পৌঁছেছিল?
বিকেল। পাঁচটায়।
অসুবিধে হয়নি তো?
জাহেদা মাথা নাড়ল নীরবে।
সুপার কী বললেন?
কিছু না।
কদিনের ছুটি পেলে?
কিছু বলিনি।
জাহেদা মনোযোগের সঙ্গে চা খেতে লাগল। বাবর তাকে জিগ্যেস করল, তোমার খারাপ লাগছে?
জাহেদা প্রথমে মাথা নাড়ল। তারপর সেটা যথেষ্ট মনে না করে মুখে ছোট্ট করে বলল, না। তারপর চোখ তুলে সে হঠাৎ প্রশ্ন করল, আর কেউ আসেনি?
কে আসবে?
আর কেউ?
তখন বাবর বুঝল জাহেদার কথাটা। জাহেদা মনে করেছে আরো দুএকজন যাচ্ছে তাদের সঙ্গে। বাবর ভাবল একটা কিছু বানিয়ে বলে, পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। এমন কিছু সময় আসে যখন সত্যি বলা অনেক ভাল।
সে বলল, আর কেউ আসার কথা নেই। তুমি তাই মনে করেছিলে নাকি?
জাহেদা-চায়ের কাপ ধরে চুপ করে রইল।
তুমি আর আমিই যাচ্ছি। ভেবেছিলাম একাই যাব। প্রত্যেক বছর এই রকম দুচারদিন ঘুরতে বেরোই। এবার তোমার কথা মনে পড়ল। এই দ্যাখ আটটা পাঁচ বাজে। এক্ষুণি না বেরুলে আরিচার ফেরি পাব না। ওঠ।
বলে সে নিজে ওঠে দাঁড়াল। জাহেদার উঠতে একপলক দেরি হলো। সেই পলকটিকে অনন্ত বলে মনে হলো বাবরের। জাহেদা উঠে দাঁড়াতেই বাবর স্নিগ্ধ হেসে বলল, তুমি গাড়িতে গিয়ে বস।
জাহেদা ইতস্তত করতে লাগল।
কী হলো?
আপনি যান, আমি আসছি।
ও, আচ্ছা।
বাবর বাইরে বেরিয়ে মান্নানকে সব বুঝিয়ে দিল। হুঁশিয়ার করে দিল, বাসা ছেড়ে এক পাও যেন না নড়ে। টাকা দিল কয়েকটা। তখন বাথরুম থেকে জাহেদা বেরিয়ে এলো। বাবর যেন তা বুঝেনি এমনি নির্বিকার মুখে বলল, গাড়িতে যাও। বলে সে দিবোজা বন্ধ করে চাবি দিয়ে জাহেদার পাশে বসে সুটকেশটা পেছনের সিটে ফেলে দিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট করল। খুব সন্তৰ্পণে ফটক দিয়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে পড়ল বড় রাস্তায়। বলল, তোমার চশমা নেই?
আছে।
পরে নাও।
অতি বাধ্য ছাত্রীর মত ব্যাগ খুলে কালো চশমা পরে নিল জাহেদা।
গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল বাবর। গতি বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের মাতামাতিতে জাহেদার গা থেকে মিষ্টি সৌরভ এসে নাকে লাগল বাবরের। সে আপন মনেই হাসল। পার হয়ে গেল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল। তারপর বুড়ো গাছের ছায়া। আরে, রোদ উঠেছে? ডাইনে মাঠ, বায়ে জলা, কয়েকটা বাড়ির পুঞ্জ। পুল, মীরপুরের বাজার। মীরপুর পুলের কাছে গিয়ে পেল লালবাতি। উল্টো দিক থেকে গাড়ি আসছে এখন। বাবর একটা সিগারেট ধরাল।
কিছু বলছ না।
কই, না।
বলে জাহেদা একটু নড়েচড়ে বসল। যা চোখে পড়ল বলল, এখানে এত বালি কেন?
নৌকো করে এনে ফেলেছে যে! বাড়ি তৈরিতে লাগে। দেখছি না। ট্রাক বোঝাই শহরে যাচ্ছে।
ও।
জাহেদা চোখ নিচু করল। বাবর লক্ষ করল আশেপাশে লোকেরা খুব উৎসাহ নিয়ে সরস চোখে জাহেদাকে দেখছে। একজন সমস্ত কটা দাঁত বের করে হাসছে। পকেটে নীল চিরুনি।
লাল বাতিটা সবুজ হলো! ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে পার হলো পুলটা। তারপর ঢালুতে নেমেই বাড়িয়ে দিল গতিবেগ। এবার বাতাস আরো দাপাদাপি করে উঠল। সুবাসে, চুলে, বাতাসের হিম স্পর্শে বাস্তব যেন স্বপ্নে রূপান্তরিত হল। দুপাশে খেত, মাঠ, বাড়ি, জলা, নৌকো, রোদ দ্রুত সরে যাচ্ছে পেছনে। টায়ার থেকে শন শন শব্দ উঠেছে একটা। আর কিছু না। আর কোনো ধ্বনি নয়। গাড়ির ভেতরটা জাহেদার উপস্থিতিতে, রোদের আদরে, উষ্ণ হয়ে উঠেছে।
চুপ করে আছ!
এমনি।
মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে যেতে লাগল ওরা। পার হলো কৰ্ণ নদীর পুল। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাবর বলল, তুমি গাড়ি চালাতে পার?
না।
শিখবে?
জাহেদা ম্লান একটু হাসল।
আমি শেখাতে পারি। শিখে নিও। কেমন?
আচ্ছা।
আবার নেমে এলো সেই বিদ্যুৎপৃষ্ট নীরবতা। বাবর জানে, এখন জাহেদা আর ফিরতে পারবে না। এখন সে ঘটনার হাতে। কিন্তু কোথায় যেন মায়া করতে লাগল তার ওকে ওমান চুপচাপ দেখে। অনেকক্ষণ সেই মায়াটাকে বাড়তে দিয়ে আবার সে বলল, কিছু ভাবছ?
নাহ।
কাল রাতে ঘুম হয়েছিল?
হ্যাঁ।
তোমার ঘরে তুমি একা থাক?
না, আরো দুজন আছে। পাপ্পু আর শরমিন।
তখন নাশতা খেলে না?
খেয়েছি তো।
পাপ্পু কী পড়ে?
আমার সাথে।
শরমিন?
আমার এক ক্লাশ ওপরে।
আচ্ছা, ইকনমিক্স তোমার শক্ত লাগে না।
জাহেদা জবাবে একটু হাসল।
বাবর বলল ইকনমিক্স খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। ওটা সবার পড়া দরকার। মানুষের যা কিছু কাজ, যা কিছু সে বিশ্বাস করে, যা কিছু তার অর্জন, উপলব্ধি-তার পিছনে ইকনমিক্স যে কীভাবে কাজ করে তা তোমাকে বললে অবাক হয়ে যাবে।
জাহেদ হাসল আবার। কিন্তু কোনো কথা বলল না।
বাবর বলল, চুয়িংগাম খাবে? এই নাও।
ড্যাশবোর্ড থেকে বার করে দিল বাবর। বার করতে গিয়ে কাঁধ ছোঁয়াছুয়ি হয়ে গেল। জাহেদা তার বায়ে সরে গেল অনেকখানি।
বাবর একটু হাসল।
খাও, খুব ভাল গাম।
এখন থাক।
সাভার ডেইরী ফার্ম পার হয়ে গেল তারা।
বাবর বলল এরপরে ছোট্ট একটা শালবন আছে। খুব সুন্দর।
কিছুক্ষণ পর শালবনের ভেতর এসে পড়ল তারা; দুধারে সারি সারি গাছ। পথটা একটু উঁচু হয়ে গেছে। লালমাটি। এই একটা নিচু জলা এলো। এই আবার শালবন। একঝাক পাখি ভারি মাতামাতি করছে।
বাবর জিজ্ঞেস করল, ভাল না?
হুঁ।
একদিন তোমাকে রাজেন্দ্রপুর নিয়ে যাব।
জাহেদা চুয়িংগাম মুখ থেকে বের করে সযত্নে কাগজে মোড়াতে লাগল; একটা বল বানাল ছোট্ট। তারপর জানোলা দিয়ে ছুঁড়ে দিল। চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল বাবর।
দূরে হাতের ডাইনে, ঘোড়াপীরের মাজার।
বাবর বলল, এখানে একটা মাজার আছে জান? একটা বুড়ো বটগাছ আছে। তার ডালে অসংখ্য সব লাল কাপড়ের টুকরো বাধা।
কেন?
যাদের ছেলে হয় না, তারা মানত করে, কাপড় বেঁধে দিয়ে যায়। হাজার হাজার। সবুজ পাতা আর লাল কাপড়ের টুকরোয় ভারি সুন্দর লাগে। ছবির মত। আমাদের যে কত অন্ধ বিশ্বাস, কত কুসংস্কার। একদিন নিয়ে যাব তোমাকে।
জাহেদা মুখ নিচু করল।
বাবার বলল, তোমার যখন বিয়ে হবে, আমি বলে দিচ্ছি, প্ৰথমে মেয়ে হবে তোমার। আমি মেয়ে খুব পছন্দ করি। অথচ লোকে কী মন খারাপ করে মেয়ে হলে। লোক দেখান হাসে বটে। কিন্তু ভেতরে নিজেকে খুব ছোট মনে করে। এক সময় তো মেয়ে হলে গলা টিপেই মারত। আমার এক বন্ধুর কথা বলি। তার সঙ্গে তাদের দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দেখি একটা গোল কবর। অবাক কাণ্ড। জিজ্ঞেস করলাম, কার? আমার দাদির?
কবরটা গোল কেন?
আমিও তাই জিগ্যেস করলাম। শুনলাম। ওখানে একটা ইঁদারা ছিল আগে। ওর দাদির তখন অল্প বয়স। কেবল এক ছেলের মা হয়েছে। সেই সময় বাড়িতে কীসের জন্যে যেন কাওয়ালীর আসর হয়েছিল। দাদি ভেতর বাড়ি থেকে চিক তুলে লুকিয়ে তা দেখছিল। সেই কথা জানতে পেরে আমার বন্ধুর দাদা বৌকে সেই রাতেই গোসল করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, ঐ ইদারায় ফেলে দেয়। তারপর সিমেন্ট করে দেয় মুখটা। পরে আমার বন্ধুর বাবা সেখানে একটা মার্বেল পাথরে নাম লিখে দিয়েছেন। বুঝে দেখ, ঐ টুকুন অপরাধ।
সত্যি?
হ্যাঁ আমি নিজে দেখে এসেছি কবরটা। তোমার মন খারাপ করে দিলাম?
জাহেদা কোনো জবাব দিল না। ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে রইল সে সমুখের দিকে চেয়ে। দূরে নয়ারহাটে অর্ধসমাপ্ত পুল। তীরের মত ক্রমাগত কাছে আসছে।
গাড়ি থামিয়ে ফেরির টিকিট কিনে ফিরে এলো বাবর। ঢালু বয়ে সন্তৰ্পণে নামল ঘাটে। ফেরি দাঁড়ানই ছিল। খালাসিরা হাত ইশারা করে ডাকতে লাগল বাবরকে। বাবর বলল, কপাল ভাল সঙ্গে সঙ্গে ফেরি পেলাম। এই রকম সব কটা পেলে চারটের মধ্যে রংপুর পৌঁছে যাব।
রংপুরে থাকব?
হ্যাঁ আজ রাতে। কাল আবার বেরুবা। কাল দিনাজপুরে। পচাগড় পর্যন্ত যাব। ফেরার পথে বগুড়া। বগুড়ার উপর দিয়েই যাব, কিন্তু আজ থামব না।
আগে থেকেই ইপিআরটিসির একটা কোচ দাঁড়িয়েছিল ফেরিতে। বাবরের গাড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। কলকল জল সরিয়ে ওপারে যেতে লাগল ফেরিটা। জাহেদা অবাক হয়ে দেখতে লাগল দুটো নৌকা এক সঙ্গে বেঁধে কেমন পারাপারের ব্যবস্থা হয়েছে।
বাবর বলল, এতক্ষণে সত্যি সত্যি ঢাকা ছেড়ে চললাম।
গাড়ির সঙ্গে গা ঠেকিয়ে জাহেদা দাঁড়িয়ে রইল। নদীর প্রফুল্ল বাতাসে তার চুল মিহি ঝাউয়ের মত মুখে উড়তে লাগল। ভারি চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। যেন জীবনমৃত্যুর চিন্তা করছে জাহেদা।
কী ভাবছ?
কিছু না।
জাহেদা এবার সকালে এই প্রথম নির্মল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভারি অবাক লাগল। বাবরের। এতক্ষণ এই নির্মলতাই সে প্রার্থনা করছিল, কতবার কতভাবে কথা বলতে চেয়েছিল সে জাহেদাকে, আর এখন কী এমন হলো, কী এমন কথা তার ঐ ছোট্ট মাথায় পাখির মত বসল যে আমন সুন্দর হয়ে উঠল তার মুখ? বাবর কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু প্ৰত্যুত্তরে সেও প্রশস্ত হাসিতে নিজেকে সুন্দর করার চেষ্টা করল নদীর ওপর ভাসতে ভাসতে।
ওটা কী লেখা?
জাহেদা খালাসিদের বুকে আঁটা পেতলের তকমার দিকে চোখ ইশারা করল।
তুমি তো বাংলা পড়তে জান না। ওখানে লেখা জনপথ। মানে, হাইওয়ে বলতে পার। তোমাকে বাংলা শেখাব আমি।
জানেন, খুব অসুবিধা হয়। আজকাল একটু একটু বুঝতে পারি। জাহেদা হঠাৎ মুখ তুলে বাবরকে বলল, বাবা আমাকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়িয়েছেন। মা জানেন না ইংরেজি। তাকে চিঠি লিখতে পারি না। লিখলে ইংরেজিতে লিখতে হয়।
তোমার বাবা সেটা পড়ে দেন মাকে?
হ্যাঁ। কিন্তু সব সময় তো সব কথা বাবাকে জানিয়ে লেখা যায় না।
তা ঠিক। এই দ্যাখ না-বাবর একটু কাছে এলো জাহেদার। বলল, তোমার সঙ্গে এতক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলেছি, একেক সময় মনে হয়, যদি তুমি বাংলা বুঝতে।
বুঝি তো। আপনি বাংলাতেই বলবেন। জাহেদা এই প্রথম বাংলায় বলল আজ সকালে।
বলতে পারি। কিন্তু সব কথা, বাংলা সব কথা তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না বলে ভয় হয়। কথার একটা অর্থ, সাধারণ অর্থ, সেটা বোঝা যায়, আরেকটা অর্থ দেশের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে, মানুষের মনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। রক্তের মধ্যে থাকে সেই অর্থটা। সেটা বুঝতে হলে তোমাকে ছেলেবেলা থেকে বাংলা পড়তে হতো। এই যেমন ধর–শ্রাবণ। শ্রাবণ কী জান?
জাহেদা হেসে বলল, জানব না কেন? শ্রাবণ একটা বাংলা মাসের নাম।
শুধু তাই নয়। যদি বাংলা কবিতা পড়তে, বাংলা গান শুনতে, যদি বাংলা তোমার স্মৃতির মধ্যে থাকত তাহলে শ্রাবণ কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বপ্নের জগৎ খুলে যেত। তোমার চোখে। একটা গম্ভীর গান শুনতে পেতে। একটা আকুলতায় তোমার মন হু হু করে উঠত।
আপনি আমাকে শেখাবেন?
কেন শেখাব না? তোমার জন্য আমি সব করতে পারি।
জাহেদা হঠাৎ জিগ্যেস করল, আর কােটা ফেরি আছে?
এরপর একটা। তারপর বড় ফেরি আরিচা থেকে নগরবাড়ি। তারপর আর একটাই মোটে।
আরো তিনটে! জাহেদা মুখ গোল করে বলল।
ওপারে এসে গাড়িতে ঠিকঠাক হয়ে বসে বাবর বলল, তুমি কিছু বল, আমি শুনি। আমি কী বলব?
বলার কথা কত আছে। তোমার কথা বল।
আমার কোনো কথা নেই।
তবু।
ভাবছি, একটা কথা ভাবছিলাম।
কী কথা।
আমি, আমি এখানে কী করছি?
আমার সঙ্গে আছ। কথা বলছ। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। আমরা এখন মানিকগঞ্জে আছি। এই।
আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় কোথায় যেন আছি, জানি না।
বাবর বলল, তুমি আছ অতীত ভবিষ্যতের মাঝখানে, আগেও যেখানে ছিলে, পরেও সেখানে থাকবে।
বাবর শুধু বলল না-কথাটা তার নিজের নয়। নীরবে সে দেখতে লাগল দূরে দ্রুত কাছে আসা বাড়ি, গ্রাম, মানুষ, নৌকো, মুদি দোকান আসছে, সরে যাচ্ছে, আবার সরে যাচ্ছে। এক আধটা বাস ট্রাক সরাৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। চকিত ঝড় তুলে।
বাবর বলল কিছু বল।
জাহেদ চুপ করে রইল।
বাবর তখন বলল, গল্প শুনবে?
কী গল্প? আপনার?
আমি কি গল্প লিখি নাকি? এই এদিকে যা পড়েছি। একটা মজার গল্প বলি কেমন? একটা চুটকি। এক লন্ড্রীর দোকান। লন্ড্রীওয়ালা ছোকরা মানুষ। মেয়েদের দিকে ভারি চোখ তার। বসে আছে কাউন্টারে। এমন সময় এক তরুণী এলো খুট খুট করে। পরনে তার মিনিস্কার্ট। মিনি তো মিনি-যাকে বলে মিনি, কোমরের তলায় এসেই শেষ। ছোঁকরা হা করে তাকিয়ে আছে দেখে তরুণী বলল, ভারি বেয়াদব তো আপনি। ছোঁকরা একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে উত্তর দিল, বেয়াদব নয় ম্যাডাম। ভাবছিলাম। আমাদের লন্ড্রীতে কাপড় ধুলে তো এত খেপে যাবার কথা নয়। বোধহয় পাশের লন্ড্রী থেকে ধুয়েছিলেন?
হা হা করে হেসে উঠল বাবর।
জাহেদা বলল, যাঃ। এটা আবার গল্প নাকি?
আচ্ছা আরেকটা শোন। এক পাগল। রাস্তায় এক দেয়ালে কান লাগিয়ে কী যেন শুনছে। দূর থেকে গোফওয়ালা এক পুলিশ দেখে ভাবল ব্যাপারটা কী? ব্যাটা আধা ঘণ্টা ধরে কান লাগিয়ে শুনছেটা কী? সেও এসে পাগলের পাশে কান লাগিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কিছু শুনতে পেল না। অনেকক্ষণ কান লাগিয়ে রাখল, তবু কিছু শোনা গেল না। তখন মহা খাপ্পা হয়ে পুলিশটা বলল, এই ব্যাটা, এখানে তো কিছু শোনা যাচ্ছে না। পাগল তার জবাবে একগাল হেসে বলল, জি, আমিও কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
জাহেদা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, যা এ রকম হয় নাকি?
আরো শুনবে।
জাহেদা হাসতে হাসতে আরেকটা চুয়িংগাম বের করে মুখে পুরল। তার গোলাপি জিভ টুকু বেরিয়েই ভেতরে চলে গেল। মুগ্ধ হয়ে গেল বাবর। বলল, আরেকটা খাও।
এক সঙ্গে কটা খাব?
ঠিক বলেছ।
কথাটাতে বেশ একটু ওজন আরোপ করল বাবর। জাহেদা লক্ষ করে রাঙ্গা হয়ে গেল যেন।
বাবর জানে এখন কথা বলতে নেই। সে নীরবে গাড়ি চালাতে লাগল। মানিকগঞ্জের সাইনবোর্ড তাদের অভ্যর্থনা জানাল এবং কিছু পরে বিদায়।
জাহেদা বলল, কই, আরেকটা গল্প বলবেন যে!
ভাবছি, কোনটা বলব?
খুব সুন্দর দেখে একটা।
আচ্ছা
বাবর সত্যি মনে করতে পারছিল না কোন গল্প। মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগল সে। একটা সিগারেট ধরাল। তারপর হঠাৎ একটা মনে পড়ে গেল। এই গল্পটা একটু বড়। হাসির নয় কিন্তু। আবার হাসিরও।
তা হোক।
এক দেশে ছিল এক চাষী। তার ছিল এক মেয়ে।
এতে রূপকথা।
কেন, খুব বয়স হয়ে গেছে নাকি তোমার?
হয়েছেই তো।
তোমার মা রূপকথা বলতো?
না বাবা বলতেন, বাংলাতে শুনলে নাকি আমার ইংরেজি খারাপ হয়ে যাবে।
শোননি রূপকথা?
কনভেন্টে কত শুনেছি। সিন্ডারেলা, আলাদিন এন্ড ওয়ান্ডার ল্যাম্প, সেভেন ডোয়াফর্স।
আজ একটা শোন। একটা শুনলে বুঝবে বড়দের জন্যেও রূপকথা হয়। জাহেদা নড়েচড়ে গ্যাঁট হয়ে বসল, যেন বসার ভঙ্গিতে প্ৰমাণ করতে চেষ্টা করল, সে খুঁকি নয়, রীতিমত মহিলা।
বাবর বলতে শুরু করল এক দেশে ছিল এক চাষী, তার ছিল এক মেয়ে। একদিন সে রাজাকে বলল, তার মেয়ে খড় থেকে সোনা বানাতে পারে। বুঝে দেখ, যেন রাজার সঙ্গে তার রোজই দেখা হচ্ছে, এমনি একটা ভাব।
রূপকথায় ওরকম হয়।
শুধু তাই নয়, চাষীর কথাটাও মিথ্যে। বাহাদুরি দেখাবার জন্যে রাজাকে বলেছে তার মেয়ে সোনা বানাতে পারে। মেয়েকে খুব ভালবাসত কিনা? এখন বিপদ দ্যাখ, রাজা চাষীর মেয়েকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বলল, এখানে এক গাদা খড় রইল, যদি কাল ভোরের মধ্যে সব সোনা বানিয়ে দিতে না পার, তাহলে গর্দান যাবে। এই বলে রাজা চলে গেলেন তার প্রাসাদে। কী রকম গর্দভ দেখ রাজা ভদ্রলোকটি। প্রথম কথা একবারও তার মনে হলো না, এই মেয়ে যদি সোনাই বানাতে পারবে তা হলে তার বাপের এত গরীবী হাল কেন? দুই নম্বর, আমি রাজা হলে তো সেই ঘরে গদীনসীন হয়ে বসে দেখতাম কেমন করে খড়কে সোনা বানায়। রূপকথার রাজাদের কোনো কৌতূহল নেই।
আপনার টিপ্পনি রাখুন।
আরে, টিপ্পনি না কাটলে তো এটা বাচ্চাদের গল্প হয়ে যাবে। তুমি আর বাচ্চা নও।
গল্প বলুন।
বলছি।
বাবর একটা ট্রাক পেরিয়ে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাতে চালাতে বলতে লাগল, সারারাত সেই খড়ের গাদার ওপর বসে হোত পা ছড়িয়ে কাঁদল মেয়েটা। সে তো আর সত্যি সোনা বানাতে জানে না। এখন কে তাকে উদ্ধার করবে। এই বিপদ থেকে? এমন সময়ে ঘরের মধ্যে টুক করে লাফিয়ে পড়ল দেড়হাত লম্বা একটা মানুষ। লোকটা সব শুনে টুনে বলল, ঠিক আছে এই খড় সব সোনা বানিয়ে দিচ্ছি, বদলে তুমি আমাকে কী দেবে? চাষীর মেয়ে বলল, আমার গলার এই হারটা দেব। লোকটা সোনা বানিয়ে হারটা নিয়ে চলে গেল। পরের দিন রাজা তাকে আরো একটা বড় ঘরে আরো বেশি খড় দিয়ে বলল, এগুলোও সোনা বানিয়ে দাও। মেয়েটা সারারাত কাঁদল, আবার সেই দেড় হাত মানুষটা এলো। মেয়েটা এবার তাকে হাতের আংটিটা খুলে দিল। পরদিন ঘর ভর্তি সোনা দেখে রাজা মহাখুশি। আরেকটা ঘর ভর্তি খড়কে যদি তুমি সোনা বানিয়ে দিতে পার তাহলে তোমাকে আমি আমার রাণী বানাব, আর যদি না পার তাহলে গর্দান যাবে। রূপকথার শাস্তি শুরুই হয় গর্দান নেয়া থেকে। তাই না?
জাহেদা হাসল। ভাগ্যিস তখন জন্মাইনি।
বাবর বলে চলল, সেদিন রাতেও মেয়েটা কাঁদতে বসল। এলো সেই দেড় হাতি মানুষটা। তাকে বলল সব।
তারার ঘাটে ফেরি পাওয়া গেল না। ফেরি তখন ওপারে। জাহেদা জিগ্যেস করল, কতক্ষণ লাগবে?
এই এক্ষুণি এসে যাবে। তারপর শোন, লোকটা বলল আমি সব সোনা করে দিচ্ছি। কিন্তু আজ তুমি আমাকে কী দেবে? মেয়েটা বলল, আর যে কিছু নেই আমার।
জাহেদা বলল, চাষীর মেয়ে হার আর আংটিই বা পেয়েছিল কোত্থেকে?
রূপকথার চাষীর মেয়েদের ওরকম থাকে। এবার কিন্তু তুমি টিপ্পনি কাটছ।
সঙ্গদোষে।
হেসে উঠল বাবর। বলল লোকটা তখন একটা জিনিস চাইল।
কী?
না, তাকে নয়।
যাহ।
সে চাইল, তুমি যখন রাণী হবে, তারপর যখন ছেলে হবে, সেই ছেলে দিতে হবে। রাজি হয়ে গেল মেয়েটা। ভেবে দেখ, জ্বলজ্যান্ত নিজের ছেলেকে দিতে রাজি হয়ে গেল সে। একেই বলে স্ত্রী বুদ্ধি।
কী বললেন?
কিছু না। তারপর মেয়েটার তো বিয়ে হলো? এক বছর গেল। সত্যি একটা ছেলে হল মেয়েটার। একদিন দোলনায় তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে এমন সময় সেই দেড় হাতি লোকটা এসে হাজির। বলে, ছেলে দাও।
তারপর? মেয়েটি কেঁদে বলল, তোমাকে টাকা পয়সা হীরে জহরৎ যা চাও তাই দেব, তুমি শুধু আমার ছেলেকে নিও না। কী বুদ্ধি! যে লোকটা খড়কে সোনা বানাতে পারে তাকে কি-না সে সাধছে টাকা পয়সা।
গল্পে ওরকম হয়। তারপর?
লোকটা তার কান্না শুনে একটু নরম হলো। বলল, ঠিক আছে, তোমার ছেলে নেব না এক শর্তে, যদি তুমি আমার নাম বলতে পার। তিন বারের মধ্যে বলতে হবে। বলতে না পারলে ছেলে চাই। মেয়েটি বলল। আচ্ছা। তারপর সে চারদিকে চর পাঠাল–দেড় হাত একটা লোক, যাদু জানে, তার নাম কেউ বলতে পারে? সাত দিন সাত রাত পরে চর এসে জানাল, হ্যাঁ মহারাণী নাম জানা গেছে।
কী নাম? জাহেদা জিগ্যেস করল।
বাবর বলল, ফেরি এসে গেছে। আগে ফেরিতে উঠেনি।
ফেরিতে উঠে গাড়ি থেকে বেরুল ওরা। ফেরির পেছন দিকে একটা রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল বাবর। তার পাশে জাহেদা। জাহেদার কালো ছায়া পড়েছে পানিতে। ঢেউয়ের দুষ্টুমিতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে। বাবর একটু সামনে ঝুঁকিল। এবার তার ছায়াটা স্পর্শ করল। জাহেদার ছায়া। প্রীতি চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে বাবর। তারপর চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেল বাতাসে পাজামা কামিজ সেঁটে গেছে জাহেদার ঊরুতে। একটা গভীর Y-এর সৃষ্টি হয়েছে। নিটোল দুটি ঊরু, স্বাস্থ্যে ফেটে পড়ছে যেন। মনে মনে বাবর সেখানে মুখ রাখল। বেড়ালের মত ঘষল খানিক।
জাহেদা বলল, গল্পটা কী হলো?
তখন চমক ভাঙ্গল বাবরের। সে জাহেদার দিকে তাকিয়ে হাসল!
ওপারে গিয়ে বলব। এখন একটু নদী দেখি।
জাহেদা নদীর দিকে তাকিয়েই দেখতে পেল তার ছায়া বাবরের ছায়া ছোঁয়াছোঁয়ি হয়ে আছে। তারপর আকাশের দিকে চোখ রাখল। চিবুকের তলায় লাল কয়েকটা সূক্ষ্ম শিরা তখন দেখতে পেল বাবর। রোদুরে যেন স্বচ্ছ হয়ে গেছে তার গ্রীবা। একটু নিরিখ করলে যেন ভেতরে সব কিছু দেখা যাবে।
চুল উড়ছিল খুব। জাহেদা গাড়ির ভেতর থেকে একটা রুমাল নিযে এলো। মুঠি করে বাঁধল চুলগুলো। টানটান হয়ে চুল বিছিয়ে রইল কপালের দুপাশে; তখন নতুন মনে হলো জাহেদাকে। একেবারে অন্য চেহারা।
বান্দর বলল কালো কামিজে তোমাকে মানায়নি।
খুব মানিয়েছে।
সকালে ভালই লাগছিল। এখন ততটা না। তোমাকে নীলটা মানায়।
আছে সুটকেশে।
তাই নাকি? পরশু তো চিনতেই পারলে না যখন বললাম।
হোস্টেলে গিয়ে খুঁজে বের করেছি।
তোমাদের হোস্টেল সুপার কিছু সন্দেহ করেনি তো?
কেন?
যদি ধরা পড়তে।
বাবা আমাকে আস্ত রাখত না।
ধর, আমি যদি তোমাকে চুরি করি।
ইস, আমাকে চুরি করা সোজা নয় সাহেব।
চলে এলে বিশ্বাস করে?
এসেছি তো?
মুখে বলল বটে কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে জাহেদা নতুন করে বাবরের দিকে তাকাল। আবিষ্কার করতে চেষ্টা করল কিছু। বাবর তখন হেসে বলল, গল্পটা শোন। আটদিনের দিন সেই দেড়হাতি লোকটা এসে হাজির। বল, আমার নাম বল। তিন বারের মধ্যে বলতে হবে। মেয়েটি জানে তার নাম, তবু স্বভাব তো, মেয়েলিপনা করে বলল, তোমার নাম গিরিশৃঙ্গ। উহুঁ হলো না। তাহলে, উদ্ভটবর্তুল? না তাও নয়। তোমার নাম দেড় আংলা। তখন লোকটা বলল, হাঁ হয়েছে কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল তার, সে দাঁড়াম করে পড়ে মরে গেল।
সে-কী!
হ্যাঁ।
লোকটা বোধহয় ওকে ভালবেসেছিল।
সে তোমরা বলতে পারবে; তারপর শোন। আগে নামি।
বাবর জাহেদার হাত ধরে গাড়িতে নিয়ে এলো। গাড়ি যতক্ষণ না ফেরি থেকে রাস্তায় এলো ততক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর সড়কে পড়তেই গতি বাড়িয়ে বলতে শুরু করল সে, একদিন রাজা বলল, রাণী, আজকাল তুমি আর সোনা বানাও না যে। তখন মেয়েটি বলর, সোনা তো আমি বানাতাম না, বানাত একটা দেড় হাতি লোক। বলে সব ঘটনা রাজাকে জানাল সে। রাজা তো রেগে কাঁই। রাণীর মুঠি ধরে জিগ্যেস করল, তার মানে তুমি বলতে চাও একটা অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে পরপর তিন রাত তুমি কাটিয়েছ। তোমার ছেলেকে এক বছর পরে এসে সে চেয়েছে। তারপরও তুমি বলতে চাও এ ছেলে তার নয়, আমার? আমাকে বুদ্ধ, গাধা, গোবর-গণেশ পেয়েছ?
ওমা, সে-কী কথা।
মহারাণী, এই হচ্ছে রূপকথা। বল তো ছেলেটা আসলে কার?
কী যে বলেন।
বল না? তিন রাত লোকটা মেয়েটার ঘরে এসেছে। কিছু হয়নি? শুধু হার আংটি নিয়েই খুশি থেকেছে সে?
দেখুন, দেখুন, সামনে একটা কত বড় পুল। জাহেদা অন্য কথা বলল। তোমার কী মনে হয়ে বল না?
এর পরে তো আরিচা?
হ্যা; আমার কী মনে হয় জান, রাজা আসলে অতটা গৰ্ধভ নয়। ও ছেলেটা ঐ ব্যাটা দেড় আংলারই।
জাহেদা মনোযোগের সঙ্গে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগল। বাবর মনে মনে বলল, তুমিও আমার সঙ্গে তিন দিনের জন্যেই যাচ্ছ। কল্পনায় সে স্পষ্ট দেখতে পেল নিজেকে–জাহেদার ওপর শুয়ে দম বন্ধ করা চুমোয় বেঁধে রেখেছে তাকে। মুখের ভিতরটা সরসর করে উঠল। বাবরের। মাথার ভেতরে কেমন একটা ঝিম সৃষ্টি হল যেন। ঠোঁটে একটা অর্থহীন হাসি। সে গাড়ি চালাতে লাগল।
ছোট্ট একটা হাই তুলল জাহেদা। বাবর ভাবল, এরপর বোধহয় কিছু বলবে। কিন্তু বলল না। মাইলের পর মাইল পার হয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর বাবর বলল, কিছু বলছি না।
এমনি।
তবু কিছু বল।
কী বলব?
কেন, নিজের কথা।
আমার কোনো কথা নেই। বলেই একটুখানি হাসল জাহেদা।
হাসছ যে।
আপনার কথা শুনে মনে পড়ল, ইস্কুলে রচনা লিখতে দিত, একটি পয়সার আত্মজীবনী, একটি ছাতার আত্মজীবনী, একটি পেন্সিলের আত্মজীবনী–এইসব।
সেই রকম করেই না হয় বল। আমি একজন মেয়ে। আমার একটি নাক, দুইটি কান ও দুইটি চোখ আছে। চোখ দিয়ে আমি দেখিয়া থাকি। কান দিয়া শ্রবণ করি।
চাপা হাসিতে প্ৰায় উপুড় হয়ে পড়ল জাহেদা। তার পিঠে আলতো একটা চাপড় দিয়ে বাবর বলল, খারাপ বলেছি?
বাবর জানে এইভাবে এগুতে হয়। এখন একটি চাপড় দিলেও জাহেদা কিছু মনে করবে: না। সত্যি জাহেদা সেটা লক্ষও করল না। হাসতে হাসতে মাথা তুলে বলল, আপনার সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল। সত্যি আমার কিছু বলার নেই।
ভুল। সবারই বলার কথা আছে। তুমি আমাকে বলতে চাও না।
বিশ্বাস করুন।
হ্যাঁ, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।
বিশ্বাস না কচু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল বাবরের। দু পয়সা দাম দিই না। আমি যা চাই তা এমনি তোমার পাজামা ছিঁড়ে ভেতরে যেতে। কী ক্লান্তিকর এই অভিনয়, এই সহাস্য মুখ তৈরি করা, এই কথার মালা গাঁথা। আমি যদি হঠাৎ এখন তোমাকে জড়িয়ে ধরে মুখে রুমাল গুঁজে ধর্ষণ করি? কে বাধা দেবে?
কিন্তু সে হাসল। এবং আরেক বার বলল, তোমাকে বিশ্বাস করি। কণ্ঠ যথাসম্ভব ভিজিয়ে নির্বিকার চিত্তে সে দ্বিতীয় মিথ্যে যোগ করল, আমি চাই তুমি আমাকেও বিশ্বাস কর। কর না?
করি।
আমি কৃতাৰ্থ।
কী যে বলেন।
জান, এর আগে, আর কোনদিন, কেউ, কখনো আমাকে এতটা বিশ্বাস করেনি। নইলে তুমি আসতে না। এই বাস্তবটা স্বপ্ন হয়ে থাকত। প্রিয়জনের সঙ্গে বাস্তবও স্বপ্ন হয়ে যায়, যেমন এখন হয়েছে। বাংলাটা তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ।
তুমি খুব অল্প দিনে শিখতে পারবে। আমি নিজে তোমাকে শেখাব।
বাবর প্রসঙ্গ বদলালো ইচ্ছে করে। জাহেদাকে সে ভাববার অবকাশ দিতে চায় না। একমুখী একটা ঝড়ের মত তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, সেখানে–যেখানে সে নিজেকে দেখছে। জাহেদার সঙ্গে শুয়ে আছে। সদ্য জাত দুটি শিশুর মত।
আর কোনো কথা বলল না কেউ। ওরা আরিচায় এলো। শুনল ফেরি আসতে এখনো এক ঘণ্টা দেরি।
কিছু খাবে জাহেদা? এখানে কি পাওয়া যায়?
আমার সঙ্গে স্যাণ্ডউইচ আছে। এখান থেকে মিষ্টি খেতে পার। চমচম খাবে? ছেলেবেলায় আমি খুব পছন্দ করতাম। খাও না?
জাহেদা মাত্র আধখানা চমচম খেল।
খাও, একটা খেলে এমন কিছু মোটা হয়ে যাবে না।
আপনি কী মনে করেন? সব সময় ফিগারের কথাটা চিন্তা করি?
বকুনি খাওয়া শিশুর মত কাচুমাচু হলো বাবর। দেখে হেসে ফেলল জাহেদা। বলল, আচ্ছা, বলছেন যখন। যা মিষ্টি। এই জন্যে খেতে চাচ্ছিলাম না।
চা খেয়ে নদীর পার দিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। কত অসংখ্য নৌকো। ছোট, বড়, ছৈওলা, মহাজনি, ডিঙ্গি, শালতি কোষা, ছিপ। একটা নৌকা ভারি চোখে ধরল। বাবরের। ঝকঝকে ছৈ, গলুইয়ে গাঢ় কমলা রঙের সারি সারি ত্রিভুজ আঁকা, তিমি মাছের লেজের মত সর সর করে পানি কাটছে গাব দিয়ে মাজা হাল। ভেতর থেকে নীল শাড়ি পরা একটা বৌ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে চলমান পাড়ের দিকে।
হঠাৎ যেন বাবর দেখতে পেল এই রকম একটা নৌকোয় জাহেদাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে সে। নিচে কুলকুল করছে পানি। টিপটিপ করছে জাহেদার বুক। তার দুপায়ের ভেতর স্বপ্ন গুঁজে বিভোর হয়ে শুয়ে আছে সে। বাবর অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করল, তোমাকে একবার নৌকোয় চাই।
কিছু বললেন?
নাতো। হেসে ফেলল বাবর। নৌকোটা ভারি সুন্দর। বৌ বোধহয় বাপের বাড়ি যাচ্ছে।
কী করে বুঝলেন?
শ্বশুর বাড়ি হলে অমন চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকত না।
অবাক হয়ে গেল জাহেদা? বলল, সত্যি, এত কথাও আপনার মাথায় ঢোকে। এই রকম একটা ধাঁধা ছিল না আপনার টিভিতে।
ছিল। বাহ তোমার মনে আছে তো?
হোস্টেলে আমাদের সেট আছে যে। খাবার পর এক ঘণ্টা দেখতে দেয়।
বাবর অন্যমনস্কভাবে হাসল। এখনো তার চোখে নৌকোর স্বপ্নটা ভাসছে। নৌকোয় সে কখনো কোনো মেয়েকে নিয়ে যায়নি। কথাটা মনেই হয়নি তার। এবারে মনে রাখবে। একদিন জাহেদাকে নিয়ে যাবে সে।
বাবর বলল, চল, ওদিকে যাই। মাছ বিক্রি হচ্ছে। দেখবে।
হাঁটতে হাঁটতে বাঁ দিকে চলে গেল তারা যেখানে জেলেরা বড় বড় রুই অবলীলাক্রমে দুহাতে তুলছে, দাম বলছে, মাথা নাড়ছে, আবার মাছটা রেখে দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখল ওরা।
একটা মাছ নেবে?
নিয়ে কী হবে? জাহেদা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।
এমনি দেখতে কত ভাল লাগছে।
চলুন, চলুন। যা ভাল লাগে। তাই কিনতে হয় বুঝি। কী সাংঘাতিক লোক আপনি। চলুন তো।
জাহেদা প্রায় টেনে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে আনল! দূরে দেখা ফেরি জাহাজটা ধীরে ধীরে আসছে। সাদার রংটা প্ৰায় মিশে গেছে নদীর রূপালি পানির সঙ্গে। স্মৃতি বিস্মৃতির মাঝখানে ভাসমান একটা স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
বাবর বলল, ঐ আমাদের ফেরি।
কই?
আরে ঐ তো।
কই, দেখছি নাতো।
এইখানে দ্যাখ। বাবর ডান হাত তুলে বাঁ হাতে জাহেদার মাথাটা ঘুরিয়ে জাহাজের দিকে করে দিল। এবার দেখতে পাচ্ছে?
হ্যাঁ।
বাবর হাতটা সরিয়ে নিল ওর মাথা থেকে। চুলগুলো অদ্ভুত খসখসে। বোধহয় ঘন করে স্প্রে ছড়ায় জাহেদা। কেমন আঠাল আর ভারি।
বাবর বলল, চুলে এত স্পে দাও কেন?
জাহেদা বাবরের চোখের দিকে তাকাল হঠাৎ।
এতটা দিও না। এত সুন্দর চুল, নষ্ট হয়ে যাবে!
আপনি কী জানেন? প্রে না দিলে চুল বানানো যায়?
বানানো মানে?
তাও জানেন না। চুড়ো ফুলে থাকবে কী করে? চুর হবে কী করে?
জাহেদা যেন ভারি মজা পেয়েছে, খিলখিল করে হেসে উঠল।
বাবর গম্ভীর হবার অভিনয় করে বলল, ও, জানতাম না। শিখলাম।
থাক, মেয়েদের এসব শিখতে হবে না।
কোনো কথাই ফেলা যায় না। কখন কোনটা কাজে লাগে।
টিভিতে ধাঁধা দেবেন না কি? বাবর একটু আহতই হলো। তার কি আর কোনো ক্ষেত্র নেই ধাঁধা ছাড়া? সবাই তাকে ঐ একটা ছকে ফেলে দেখে কেন। আবার হঠাৎ মাথার ভেতরে বাঘটা লাফিয়ে উঠল তার। ইচ্ছে করল, নিষ্ঠুর একটা চুমোয় সবটা রক্ত শুষে নেয় জাহেদার, তার পেছনে প্রচণ্ড একটা চাপড় দেয় যেন হাতের পাঁচটা আঙুল নীল হয়ে বসে থাকে।
বাবর স্পষ্ট দেখতে পেল চোখের সমুখে, আকাশ জোড়া, ঈষৎ রক্তাভ একটি নিতম্ব, তাতে পঞ্চনদের মত আঙুলের পাঁচটি নীল দাগ।
হাঁটতে হাঁটতে বাবর বলল, জানি, ছেলেবেলায় স্বপ্ন দেখতাম বড় কবি হবো।
হলেন না কেন?
কবি কি হওয়া যায়?
ইচ্ছে থাকলেই হওয়া যায়। আপনি হতে পারতেন।
পারতাম?
হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস আপনি হতে পারতেন।
কিন্তু হইনি। ক্লাশ এইটে যখন পড়তাম তখন শেফালি ফুল নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম; আর একটা লিখেছিলাম কলেজে থাকতে, তাজমহলের উপর। প্ৰেম সম্পর্কে খুব বড় বড় কথা ছিল ওতে। এখন হাসি পায়।
কেন?
কী, কেন?
হাসি পায় কেন?
হাসি পায়, প্রেম তখন সাংঘাতিক একটা কিছু বলে মনে হতো, তাই।
জাহেদা হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল! এক পলক কোথায় যেন অন্তর্হিত হলো মেয়েটা। বাবর কথাটাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে বলল, চল, আরেকটু চা খাইগে। গাড়ির কাছে এসে বলল, তুমি গাড়িতে বসে খাও। আমি টিকিটটা করে আনি।
ফিরে এসে দেখে, জাহেদা দুহাতে চিবুক রেখে চুপ করে বসে আছে। আর তার কাছে হাত
পাখা বিক্রি করবার চেষ্টা করছে একটা বুড়ো লোক। বাবরকে দেখে লোকটা এগিয়ে এসে কয়েকটা পাখা পাড়িয়ে দিল।
শীতকালে হাতপাখা দিয়ে কী হবেরে বাবা?
নিয়া যান, কত কামে লাগে, আমাগো সাহায্য হয়।
আচ্ছা, দাও একটা।
জাহেদাকে দিয়ে বলল, কেমন, সুন্দর না?
হুঁ!
ও-রকম করে আছ যে? চা খেয়েছ?
হ্যাঁ। আপনি খান।
দাও।
জাহেদা সন্তৰ্পণে চা ঢেলে দিল বাবরকে। জাফরান রং করা নখগুলো ঘিরে ধরল প্লাস্টিকের পেয়ালাটা। পরশু যে রংটা লাগিয়েছিল আজও সেটা আছে। পাঁচটা সযত্ন ফোঁটার মত দেখাচ্ছে কোনো নববধূর কপোলে! বাবরের ইচ্ছে করল। ছয়ে দেখে। বাবর সেই ভবিষ্যতকে দেখতে পেল, যখন কম্পিত আঙুলের ডগায় অন্ধকারে তার পিঠে এসে বসবে ঐ জাফরান ফোঁটাগুলো। বাবর তার ট্রাউজারের ভেতরে বাসনার সঞ্চরণ এবং উথান অনুভব করতে পারল। দগ্ধ হতে লাগল। উত্তাপে। কিন্তু এ উত্তাপ পোড়ায় না, পরিণামে ছাই করে না, নিরবধি শুধু বিকীর্ণ হতে থাকে এবং কিছু করা যায় না।
অসহ্য এই অভিনয়। এই ছলাকলা। এই শোভন সদালাপ। তার চেয়ে যদি এমন হতো, স্পষ্ট বলা যেত। আর সে শুনত।
দাঁতে দাঁত ঘষল বাবর।
জাহেদা এই প্রথম জিগ্যেস করল, চুপ করে আছেন যে!
কই, না।
হেসে ফেলল বাবর। সুন্দর করে হাসল। তার সেই বিখ্যাত রমণীমোহন হাসিটাকে বের করে দেখাল সে। আর মনে মনে বলল, খেলারাম খেলে যা।