১১. জাহিন খুব অবাক হয়ে দেখছে

জাহিন খুব অবাক হয়ে দেখছে। এত সুন্দর কোনো মেয়ে সে বোধহয় এর আগে দেখে নি। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, মাথাভর্তি চুল ঢেউয়ের মতো নেমে এসেছে। এমন চুল যে হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে মন খারাপ লাগে। মেয়েটা মুখ টিপে কি সুন্দর ভঙ্গিতেই না হাসছে।

তোমার নাম জাহিন, তাই তো?

হ্যাঁ।

তোমার জ্বর হয়েছিল, সেরেছে?

হ্যাঁ!

আমি কে তা কি তুমি জানো?

জাহিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে। অবশ্যই জানে। এই পরীর মতো মেয়েটা তার মা।

তুমি এত রোগা কেন?

জানি না।

তোমার মাথায় চুল এত কম কেন? দেখো তো আমার মাথায় কত চুল। হাত ছুঁয়ে দেখো। আমি ভেবেছিলাম তোমারও মাথাভর্তি চুল থাকবে তোমার বাবা কি বাসায় আছে?

আছে।

ছবি আঁকছে?

না। ছবি আঁকার ঘরে চুপচাপ বসে আছে।

চুপচাপ যে বসে আছে সেটা বুঝলে কি করে?

পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি মাঝে মাঝে দেখি।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখার দরকার কী? স্টুডিওতে সরাসরি ঢুকে যাও না কেন? বাবা রাগ করে?

রাগ করে না। কঠিন চোখে তাকায়!

আমি তোমার দিকে কোন চোখে তাকাচ্ছি বলো তো?

জাহিন হাসল। লজ্জার হাসি। তার হঠাৎ অসম্ভব লজ্জা লাগছে। আবার অসম্ভব ভালো লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে মার চুল স্পর্শ করল।

জাহিন, বলো তো আমি কে?

মা।

কার মা?

জাহিন আবার লজ্জা পেয়ে হাসল। কিন্তু কার মা তা বলল না।

তুমি কি আমার নাম জানো?”

জানি।

বলো, আমার নাম কী বলো?

আপনার নাম রুবি।

আমার সম্পর্কে আর কী জানো?

আপনি খুব সুন্দর নাচতে পারেন।

 তুমি কি আমার কোলে আসবে?

জাহিন না সূচক মাথা নাড়ল। যদিও তার খুব ইচ্ছা করছে কোলে উঠতে। রুবি বলল, আমার কোলে আসবে না কেন, আমি কি খারাপ মেয়ে?”

জাহিন ক্ষীণস্বরে বলল, অল্প খারাপ।

কেন? তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম সেই জন্য?

হুঁ।

আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?

কোথায়?

তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানেই যাব। চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডন, বুড়িগঙ্গা নদী।

আপনি কি স্বাতী আন্টিদের বাসা চেনেন?

না, চিনি না। ঠিকানা বের করে সেখানে অবশ্যই যেতে পারি। স্বাতী আন্টিটি কে?

বাবার সঙ্গে তার বিয়ের কথা হয়েছিল। তারপর হয় নি।

হয় নি কেন?

আমি জানি না।

তবু তোমার অনুমানটা কী?

স্বাতী আন্টির বাবাকে পছন্দ হয় নি। বাবাকে কেউ পছন্দ করে না।

আর কে পছন্দ করে নি?

আপনি করেন নি।

ও হ্যাঁ, তাও তো ঠিক। তুমি তাকে খুব পছন্দ করো?

হুঁ।

কেন?”

বাবাকে তো পছন্দ করতেই হয়। বাবা-মাকে পছন্দ না করলে পাপ হয়।

শুধু পাপের ভয়ে বাবাকে পছন্দ করো?

বাবা ভালো।

বাবা তোমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায়? শিশু পার্কে নিয়ে যায়?…

কোথাও নিয়ে যায় না তবু ভালো।

তুমি কি জানো, আমি তোমাকে আমেরিকা নিয়ে যেতে এসেছি?

জানি। বাবা বলেছে।

তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

জাহিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রুবি বলল, আমি জানি বাবাকে ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এখানে থাকার চেয়ে আমার সঙ্গে যাওয়াই তোমার ভালো। কেন সেটা জানো?

জানি। বাবা বলেছে।

কী বলেছে?

এখানে আমার একা একা থাকতে হয়। বাবা সারাদিন ছবি আঁকে। আমার দেখার কেউ নেই।

আমার কাছে তুমি খুব ভালো থাকবে। তুমি আরও দুজন ভাইবোন পাবে। এরা ভীষণ দুষ্টু আবার ভীষণ ভালো। তুমি হবে তাদের সবার বড় বোন। তাদের দেখেশুনে রাখবে। তোমাকে খুব বড় স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। খুব আনন্দ নিয়ে বড় হবে। তারপর যদি বাবার কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়, ফিরে আসবে।

জাহিন কিছু বলছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এখন তার একটু কান্না কান্নাও লাগছে। রুবি বলল, তুমি আমার সঙ্গে গেলে তোমার বাবার জন্যও ভালো হবে। সারাক্ষণ তোমাকে নিয়ে তার যে দুশ্চিন্তা সেটা থাকবে না। সে নিজের মনে কাজ করতে পারবে। সে হয়তো ভালো একটা মেয়েকে বিয়ে করে আবার সংসার শুরু করবে। কে জানে, তোমার স্বাতী আন্টি হয়তো ফিরে আসবে। অনেক সময় আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে সংসারে থাকলে মেয়েরা তাকে বিয়ে করতে চায় না।

জাহিন খুব মন দিয়ে কথা শুনছে। কথাগুলো তার কাছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। রুবি বলল, চলো এখন আমরা বেড়াতে বের হই। তোমার বাবাকে হ্যালো বলে যাই। তুমি কাপড় বদলে ভালো একটা জামা পরো।

এটাই আমার সবচেয়ে ভালো জামা।

এটাও অবশ্যি মন্দ না। তবে আজ আমরা অনেকগুলো ভালো জামা কিনব। তোমার চুলগুলোও সুন্দর করে কেটে দিতে হবে। অনেক কাজ। আমরা আজ প্রথম কোথায় যাব?

স্বাতী আন্টিদের বাড়িতে।

ও হ্যাঁ। তোমার বাবার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিতে হবে।

.

স্বাতীর সঙ্গে তাদের দেখা হলো না।

নাজমুল সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, আমার মেয়েটার শরীর ভালো না। তোমরা আরেক দিন এসো। জাহিন বলল, আমি শুধু দূর থেকে উনাকে একটু দেখেই চলে যাব।

নাজমুল সাহেব তারপরেও বললেন, আজ আজ না। আরেক দিন।

.

জাহিন স্বাতীদের বাড়ি থেকে মন খারাপ করে বের হয়েছে। রুবি বলল, আমরা। আবার আসব। দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে দেখা করে যাবই, তাই না জাহিন?

হ্যাঁ।

একটা কবিতা আছে না, একবার না পারিলে দেখ শতবার। আমরা শতবার দেখব। কি বলো জাহিন?

হুঁ।

এখন কোথায় যাওয়া যায়। চিড়িয়াখানায়?

 হুঁ।

চিড়িয়াখানার কোন প্রাণীটা তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?

জানি না।

জানো না কেন?

জাহিন জবাব দিল না। রুবি বলল, আমার মনে হচ্ছে তোমার চিড়িয়াখানায় যাবার তেমন ইচ্ছা নেই। এর উত্তরেও জাহিন কিছু বলল না। রুবি বলল, অন্য কোথাও যেতে চাও?

হুঁ।

বলো কোথায়। তুমি যেখানে যেতে চাও, আমি নিয়ে যাব।

লিলি আন্টিদের বাড়িতে যাব।

লিলি আন্টি কে?

জাহিন উৎসাহের সঙ্গে বলল, উনি একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন খুব ঝড়-বৃষ্টি হলো। আমরা ঝড়-বৃষ্টিতে খুব হুটোপুটি করেছি। শিল কুড়িয়েছি। বাড়ির সামনে পানিভর্তি একটা গর্ত আছে না? আমরা দুজন ধপ করে গর্তে পড়ে গেলাম। আমরা দুজন খুব বন্ধু।

উনি কি একদিনই এসেছিলেন?

হুঁ।

একদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল?

হুঁ।

বন্ধুত্ব অবশ্যি হবার হলে একদিনেই হয়। হবার না হলে কখনই হয় না। তোর বাবার সঙ্গেও আমার একদিনেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। খুব মজার ঘটনা। শুনবে?

জাহিনের শুনতে ইচ্ছা করছে না। কারণ, এই মহিলা তাকে লিলি আন্টিদের বাড়িতে নিয়ে যাবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। লিলি আন্টির ঠিকানা তার কাছে আছে। তিনি কাগজে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু উনি তো ঠিকানা চাচ্ছেন না।

হয়েছে কি শোনো। ছবির একটা এক্সিবিশন হচ্ছে। আমি আমার বাবার সঙ্গে এক্সিবিশন দেখতে গেলাম। একটা ছবির সামনে থমকে দাঁড়িয়েছি। কী যে সুন্দর ছবি! টিনের ঘরের বারান্দায় একটি তরুণী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে মেয়েটি মুখ ধুচ্ছে। ছবিটবি তো আমি বুঝি না। জীবনে কোনো ছবি দেখে এত অবাক হই নি। আমি ছবির আর্টিস্টের কাছে গিয়ে বললাম, ছবিটা আমার এত ভালো লাগছে কেন বুঝিয়ে দিন।

আর্টিস্ট হেসে ফেলল। তোর বাবা যে খুব সুন্দর করে হাসে সেটা নিশ্চয়ই তুই জানিস?

জানি।

সেই হাসিও দেখি ছবির মতোই সুন্দর। এই যে তোর বাবাকে ভালো লাগল, লাগলই। গল্পটা সুন্দর না জাহিন?

হু। আমরা লিলি আন্টিদের বাসায় কখন যাব?

এখনই যাওয়া যায়। কিন্তু আমার কাছে তো ঠিকানা নেই।

আমার কাছে ঠিকানা আছে।

জাহিন কাগজের টুকরাটা বের করল।

.

কোনো বাড়ির সদর দরজা এমন করে ভোলা থাকতে পারে তা রুবির ধারণায় ছিল না। দরজা খোলা। তারা কলিং বেল বাজাচ্ছে। কেউ আসছে না। অথচ ভেতরে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। জাহিন তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কি ভেতরে ঢুকে যাব?

রুবি বলল, সেটা কি ঠিক হবে? অপরিচিত একটা বাড়ি। কেউ এলে পরিচয় দিয়ে তারপর ভেতরে যাওয়া উচিত।

কেউ তো আসছে না।

তাই তো দেখছি। চলো ঢুকে পড়ি।

তারা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রুবি অবাক হয়ে দেখল অবিকল পরীর মতো মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে তাদের দেখে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসছে। এসেই মেয়েটি জাহিনকে কোলে তুলে নিল। জাহিন মেয়েটির শাড়িতে মুখ চেপে রেখেছে। তার ছোট্ট শরীর কাঁপছে। সে কাঁদছে। রুবির বিস্ময়ের সীমা রইল না।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাবার পর লিলি লজ্জিত ভঙ্গিতে রুবির দিকে তাকাল। রুবি বলল, যে মেয়েটি আপনার কোলে বসে কাঁদছে আমি তার মা। হুট কর ঢুকে পড়েছি।

খুব ভালো করেছেন।

লিলি কিশোরীদের মতো গলায় পেঁচিয়ে বলল, মা দেখো! দেখো কে এসেছে। ফরিদা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন, কে এসেছে?

জাহিন এসেছে। জাহিন।

জাহিনটা কে?

লিলি জবাব দিতে পারছে না। সে লজ্জিত ও বিব্রত মুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহিন মেয়েটা তাকে খুব লজ্জায়ও ফেলে দিয়েছে। কেঁদে কেঁদে তার শাড়ি প্রায় ভিজিয়ে ফেলেছে। এত কাঁদছে কেন মেয়েটা?

বাড়ির সবাই এসে ভিড় করছে। রুমু ঝুমু এসেছে, বড় চাচা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, ছোট চাচাকেও দেখা যাচ্ছে। কাজের দুই বুয়াও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। রুবি বলল, আমার মেয়েটা কিছুক্ষণ থাকুক আপনার কাছে। আমি পরে এসে নিয়ে যাব।

লিলি হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারল না। জাহিনের কান্নার কারণে তার নিজেরও এখন কান্না এসে গেছে।

জাহিনের মা চলে যাচ্ছেন, সে তাঁকে এগিয়ে দিতে পর্যন্ত গেল না। অভদ্রের মতো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। ফরিদা বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি! এই মেয়ে কে?

একজন আর্টিস্টের মেয়ে মা, হাসনাত সাহেবের মেয়ে?

তুই কাঁদছিস কেনরে লিলি। মেয়েটা কাঁদছে, তুইও কাঁদছিস। ব্যাপারটা কি?

ফরিদার বিস্ময় কিছুতেই কমছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *