একাদশ পরিচ্ছেদ
জলাশয়ের কেন্দ্রে ঢেউ উঠিলে সে ঢেউয়ের বৃত্ত ক্রমবিস্তীর্ণ হইয়া একসময় যেমন দুরতম কোণে অবস্থিত জলজ উদ্ভিদের ক্ষুদ্র পাতাটিতে কম্পন জাগায়, তেমনি সমগ্র পৃথিবীতে ঘটিয়া যাওয়া কয়েকটি ঘটনার প্রভাব মহাদেশ পার হইয়া কাজলকে স্পর্শ করিল। জাপানে পরমাণু বোমা পড়িয়া বিশ্বযুদ্ধ থামিলে পৃথিবীসুদ্ধ লোক হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে ব্যাপারটার নৃশংসতায় অবাক হইয়া গেল। যুদ্ধ যাহারা করে তাহাদের নিকট আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অনেক বাছা বাছা যুক্তি থাকে। আমেরিকা বলিল–এই শেষপর্বেও জাপান যেভাবে মরীয়া হইয়া যুদ্ধ চালাইতেছিল, তাহাতে পরমাণু বোমা ব্যবহার করা ছাড়া অবিলম্বে এই নিরর্থক লোকয় বন্ধ করিবার আর কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু কিছু লোক এই যুক্তি মানিল না, তাহারা বলিল–জাপান যেভাবে কোণঠাসা হইয়া আসিতেছিল, তাহাতে যুদ্ধ আর কয়েকদিন বাদে আপনিই থামিয়া যাইত। মৃতপ্রায়, হতবল একটা জাতির নিরস্ত্র ও অসামরিক জনগণের উপর এই মহাশক্তিশালী অস্ত্রের প্রয়োগ নিজের শক্তি দেখাইবার একটা অমানবিক পন্থা মাত্র। বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ শান্তিবাদী দার্শনিকেরা এই মতের পক্ষ লইলেন। যাঁহার বস্তু ও শক্তির অভেদ নির্ণায়ক সূত্র অনুযায়ী বোমা বানানো হইয়াছিল, সেই আইনস্টাইন স্বয়ং ধ্বংসদেবতার নির্মম রুপ দেখিয়া মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন। এই ভয়ানক অস্ত্র ব্যবহার না করিবার জন্য তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করিয়া চিঠি দিয়াছিলেন, সে চিঠি খোলাই হইল না। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট বদল হইয়া গেল। যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে কে খোঁজ রাখে কোথাকার একটা পাগলা বৈজ্ঞানিক কী বলিতেছে! প্রথমে নেভাদার মরুভূমিতে এবং পরে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার জোরদার পরীক্ষা হইয়া গেল।
অনেকদিন আগে রেললাইনের ধারে একটা মরা গরুকে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া কাজলের মনে ভয়ানক ধাক্কা লাগিয়াছিল। তখনও তাহার বাবা বাঁচিয়া আছে। তাহার ভীত, আতঙ্কিত মুখ দেখিয়া অপু সস্নেহে তাহাকে একহাত দিয়া জড়াইয়া বুকের কাছে আনিয়া অনেক সানা দিয়াছিল। এখন বাবা নাই, যেদিকে তাকানো যায় জীবনের কোনোক্ষেত্রে নির্ভর করিবার মতো একটা ব্যক্তিত্ব নাই। বীভৎসতার নগ্নরূপ দেখিয়া কাজল কেমন যেন দমিয়া গেল। তাহা হইলে কী কাব্য, দর্শন, সংগীত মিথ্যা? সম্পূর্ণ অর্থহীন? শৈশব হইতে মানবসভ্যতার শুভ প্রভাব সম্বন্ধে তাহার যে গভীর বিশ্বাস, তাহা কী কেবলই কথার কথা? বারবার তাহার মনে পড়িতেছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা মা ইট গ্রিভ মাই হার্ট টু সি হোয়াট ম্যান হ্যাজ মেড অফ ম্যান!
কিছু ভালো লাগে না। কবিতা বিস্বাদ লাগে, ভালো গান শুনিতে ইচ্ছা করে না, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আশাবাদী সাহিত্যকর্মকে হাসির গল্প বলিয়া মনে হয়। চোখের উপর দিয়া মিছিল করিয়া যায় তেজস্ক্রিয়তার কামড়ে আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত নিরপরাধ নরনারীর দল। কাহারও গায়ে দগদগে ঘা, কাহারও শরীর হইতে মাংস খসিয়া পড়িতেছে, কেহ বা কোটর হইতে বাহির হইয়া আসা নিজের গলিত চোখ হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। কোথাও বা সোকাহত মা নর্দমা হইতে আঁচল ভিজাইয়া জল আনিয়া মৃত শিশুর মুখে দিয়া তাহার জ্ঞান ফিরাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছে। কোথাও নির্জনে গিয়া বসিলেই এইসব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসিয়া ওঠে। মনে হয় পৃথিবী সম্পূর্ণ গ্লানিমুক্ত না হইলে এই পাখির ডাক, মায়াময় রঙে রাঙানো সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত, মালকোষের শিহরণ জাগানো আলাপ–কোনও কিছুরই কোনো মূল্য নাই। এই মুহূর্তে যখন বিধ্বংসী কামানের গর্জনে দিগন্ত কাঁপিতেছে, বোমারু বিমানের সার্চলাইটের আলোতে রাত্রির আকাশ শতধা বিভক্ত, তখন সেই সৌন্দর্যহীন, নিরাপত্তা ও বিশ্বাসহীন পৃথিবীতে সুকুমার বৃত্তির স্থান কোথায়?
ভারতের স্বাধীনতা আসন্ন। সংবাদপত্রের খবরে বিভিন্ন মহলের তৎপরতায় সেই আশ্বাস ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ইহাও স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে, ইংরাজ যাইবার সময় ভারতকে দুইটি পৃথক রাষ্ট্রে ভাগ করিয়া দিয়া যাইবে। যে ঐশ্বর্য তাহারা নিজেরা ভোগ করিতে পারিল না, কুটিল ইংরাজ তাহা অপরকেও সুখে ভোগ করিতে দিবে না। দুই রাজ্য কীভাবে এবং কিসের ভিত্তিতে ভাগ হইবে তাহা লইয়া সর্বত্র জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হইল। দেশের ভিতর যেসব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় এতদিন শান্তিতে বাস করিত, পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির কোন অভাব ছিল না—এইবার সেই সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বের শান্ত জলে ইংরাজ নিক্ষিপ্ত ঢিল আসিয়া পড়িল।
এম.এ. পরীক্ষার ফল বাহির হইলে নিজের নম্বর দেখিয়া কাজল অবাক হইল না, হতাশও হইল না। সে যেমন ভাবিয়াছিল তেমনই ফল হইয়াছে। সেনেট হাউসের দেয়ালে টাঙানো উত্তীর্ণ ছাত্রদের নামের তালিকায় নিজেদের নাম দেখিয়া প্রভাত ও কাজল গোলদীঘিতে আসিয়া বসিল। প্রভাত বলিল—তোকে স্যালুট করতে ইচ্ছে করছে, বুঝলি?
কাজল হাসিয়া বলিল–কেন রে, আমি কী দোষ করলাম?
-তুই দেখিয়ে দিলি কত কম পড়াশুনো করেও এম.এ. পাশ করা যায়। আমার রেজালট ধরাবাঁধা হিসেবের মধ্যেই হয়েছে কিন্তু তোরটা অ্যাচিভমেন্ট্। এখন কী করবি ভাবছিস?
গোলদীঘির জলে একটি কিশোর সাঁতার শিখিবার প্রচেষ্টায় আপ্রাণ হাত-পা ছুঁড়িতেছিল, সেইদিকে তাকাইয়া দেখিতে দেখিতে কাজল বলিল–মাকে গিয়ে খবরটা দেব–
-না, ইয়ার্কি নয়। কিছু ভেবেছিস এ বিষয়ে?
-নাঃ। আমাকে তো জানিস, ভেবে আমি কিছু ঠিক করতে পারি না। হঠাৎ কিছু শুরু করে দেব–
প্রভাত কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল–তুই খুব ইমপালসিভু আমি জানি। কিন্তু আমাদের ছেলেমানুষি করার বয়েস গেছে। ঘোট হোক, বড়ো হোক—একটা কোন কাজ শুরু কর। কেবলমাত্র টাকা উপার্জনের জন্য বলছি না, জীবনে একটা স্থিরকেন্দ্র থাকা দরকার, তাই বলছি।
-তুই কী করবি?
—ম্যাথু আর্নল্ড্ সম্বন্ধে রিসার্চ করব ভাবছি। মনে আছে, বছরদুয়েক আগে তুই-ই আমার মাথায় আর্নলড় ঢুকিয়েছিলি? তারপর দেখি কী করা যায়—
কাজল অন্যমনস্কভাবে সেনেট হাউসের মাথার দিকে তাকাইয়াছিল, এবার প্রভাতেব দিকে চোখ নামাইয়া বলিল—একটা কথা মনে হচ্ছে–
-কী রে?
—এতদিন আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করছিলাম, রোজ দেখা হবার একটা ব্যাপার ছিল। এবার জীবিকা অর্জনের জন্য কে কোথায় ছিটকে যাবে তার ঠিক নেই। তুই কিন্তু আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি, বুঝলি? একা মানুষ বাঁচে না–
উত্তরে প্রভাত কেবল একটু হাসিল।
আরও কিছুক্ষণ গল্প করিবার পর প্রভাত ট্রামে উঠিয়া নিজের বাড়িতে পাশের খবর দিতে গেল। ট্রেন ধরিবার আগে কাজল বসু ও গুহের দোকানে ঢুলি তাহার খবর জানাইতে। আজ প্রথমে বসু আরামকেদারা দখল করিয়া গা এলাইয়া রহিয়াছেন। দ্বিজেনবাবু সম্ভবতঃ কিছু পরে আসিয়া বিপাকে পড়িয়াছেন। সম্প্রতি তিনি পাশেই একটি চেয়ারে বসিয়া কী একটা পত্রিকার পাতা ওলটাইতে ওলটাইতে পরিস্থিতির উপর সতর্ক নজর রাখিতেছেন। প্রমথবাবু কোনো কারণে একবার আরামকেদারা ছাড়িলেই তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি দখল করিবেন। কিন্তু বসু ও গুহ পাবলিশার্সের অপর অংশীদারের নিশ্চিন্ত বিশ্রামের ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতেছে দ্বিজেনবাবুর প্রতীক্ষা কিছু দীর্ঘ হইবে।
কাজলের পাশের খবর শুনিয়া দুই বন্ধু যথার্থই খুশি হইলেন। দ্বিজেনবাবু একজন কর্মচারীকে তখনই সন্দেশ আনিতে পাঠাইলেন। পুরোনো দিনের অনেক গল্প হইল, অপু বাঁচিয়া থাকিলে ছেলের কৃতিত্বে সে আজ কত খুশি হইত সে কথা বলিয়া দুইজনে দুঃখ করিলেন। দ্বিজেনবাবু বলিলেনতোমাকে কেমন যেন বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কেন বল তোতা?
কাজল প্রথমে বুঝিতে পারিল না নিজের মনের ভাব কী করিয়া গুছাইয়া বলিবে, তাহার পর মনে হইল বলিতে হইলে ইহাই সর্বাপেক্ষা ভালো স্থান। সে বলিল—আমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, না? আসলে বর্তমান সময়টাই আমার খাপ খাচ্ছে না। পৃথিবী জুড়ে এতবড় একটা যুদ্ধ হয়ে গেল, কত লোক মারা পড়ল ভাবুন তো কাকা! হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যে মূল্যবোধের অনুসরণ করে এসেছে, সব মিথো হয়ে গেল? যাই করতে যাচ্ছি, কেবলই মনে হচ্ছে—এসবের আসলে কোন মানে নেই। সাধারণ মানুষের শান্তিপ্রিয়তার কোন দাম নেই, তাদের জীবনেরও কোন মূল্য নেই। পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতারা ইচ্ছে করলেই যুদ্ধ বাধাতে পারে যে কোন সময়ে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কিছু এসে যায় না। তাহলে?
দ্বিজেনবাবু খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন—ঠিকই বলেছ, বর্তমান দুনিয়ার যা হালচাল তাতে আশাবাদ বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন। কিন্তু জানো তো, সকালের আলো ফুটবার আগে রাত্রির অন্ধকার সবচেয়ে কালো হয়ে আসে? যুদ্ধ রাষ্ট্রবিপ্লব কিছু নতুন কথা নয়ইতিহাস খুললেই দেখবে যুগে যুগে এসব হয়ে আসছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে বগীর হাঙ্গামা পর্যন্ত শান্তির চেয়ে অশান্তিই বেশি। মানুষের যা কিছু শ্রেষ্ঠ কীর্তি, তা কিন্তু এসবের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে। রুপার্ট ব্রুক বা উইলফ্রেড ওয়েনের কথা ভাবো–তুমি দূর থেকে কাতর হচ্ছ, তারা রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন, হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্ব থেকে মৃত্যুকে দেখেছেন। তার মধ্যেই কিন্তু লিখেছেন অমর কাব্য। এখানেই মানুষের জয়–
তারপর কাজলের দিকে তাকাইয়া হাসিয়া বলিলেন–তুমিও তো লেখো, লেখকের অনেক দায়িত্ব। উদ্যত রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের গাইতে হবে জুঁইফুলের গান–
বাড়িতে আসিয়া কাজল দেখিল মায়ের শরীর ভালো নয়। দুপুর হইতে পেটে কেমন একটা ব্যথা হইতেছে। সম্প্রতি ব্যথাটা পিঠের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ছেলের এম.এ. পাশের খবর পাইয়া হৈমন্তী ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল। কাজল বলিল—উঠছো কেন মা, শুয়ে থাকে। আমি বরং তোমার পাশে বসে গল্প করি–
হৈমন্তী শুনিল না, বলিল—না, আমার মানত ছিল তোর পাশের খবর এলে দাঁড়াহরির লুট দেবো। যা, মোড়ের দোকান থেকে কড়াপাকের সন্দেশ কিনে নিয়ে আয়। আসবার সময় রায়বাড়ি, মুখুজ্যেবাড়ি আর অমিয়বাবুর বৌকে বলে আসবি, বলবি-মা বলেছে এক্ষুনি আসতে, হরির লুট হবে–
নিজের পাশের জন্য হরির লুটের নিমন্ত্রণ করিতে কাজলের লজ্জা করিতেছিল। কিন্তু মায়ের আগ্রহে পাড়াসুদ্ধ লোককে বলিয়া আসিতে হইল। সন্দেশ কিনিয়া বাড়ি ফিরিয়া দেখিল মা তখনও বসে নাই, সাধারণ শাড়ি ছাড়িয়া গরদের কাপড় পরিয়াছে এবং খাটের বাজু ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হৈমন্তীর মুখ দেখিয়া মনে হয়, ব্যথার জন্য তাহার দাঁড়াইতে বেশ কষ্ট হইতেছে। মায়ের জন্য কাজলের হঠাৎ খুব মমতা হইল। ঠাকুরমার ঝুলি হইতে আধুনিক সামাজিক উপন্যাস পর্যন্ত সর্বত্র সত্মায়ের যে রক্তশীতলকারী চিত্র আঁকা হইয়াছে, ইহার সহিত সে বিভীষিকার কোনই মিল নাই। পাষণ্ড লেখকগুলিকে ডাকিয়া তাহার মাকে দেখানো উচিত।
দিন-দুই বাদে একদিন পথে স্কুলের মাস্টারমশাই কালিদাসবাবুর সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। ইনি সেকালের গ্র্যাজুয়েট, ইংরাজি হইতে বিজ্ঞান পর্যন্ত সব বিষয়েই প্রয়োজন হইলে ক্লাস লইতেন। শোনা যায় পিরিয়ড কামাই যাইতেছিল বলিয়া একবার ড্রইংয়ের ক্লাসেও বক আঁকিয়া কাজ চালাইয়া দিয়াছিলেন। শিক্ষকতাকে যাঁহারা বৃত্তি না ভাবিয়া ব্রত হিসাবে লইয়াছিলেন, সেই বিবল মানুষদের ইনি একজন শেষ প্রতিভূ। এই টাইপটাই ধীরে ধীরে শেষ হইয়া আসিতেছে। ক্লাসে কালিদাসবাবু যে কেবলমাত্র পাঠ্যবিষয় পড়াইতেন তাহা নয়, মুখে মুখে ইতিহাসের গল্প শোনাইতেন, মহাপুরুষদের জীবনের কাহিনী বলিতেন। ইহাতেই শেষ নয়, ছুটির পর উৎসাহী কিছু ছাত্রকে স্কুলের পিছনের মাঠে লইয়া গিয়া কুস্তির পঁাচ শিখাইতেন। জামা ও গেঞ্জি খুলিয়া ঘাসের উপর রাখিয়া মালকোচা মারিয়া নিজে ছাত্রদের সঙ্গে কুস্তি লড়িতেন। কাজলও উৎসাহে পড়িয়া কিছুদিন এই দলে ভিড়িয়াছিল। সে একবার কালিদাসবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—স্যার, আপনি জুজুৎসু জানেন, না? আমরা শিখতে চাই–
কালিদাসবাবু হাসিয়া বলিয়াছিলেন-বাপু হে, ভারতীয় কুস্তির রীতিতে এমন অনেক প্যাঁচ আছে যার কাছে জাপানী জুজুৎসু লাগে না। আগে সেগুলো শেখো, তারপর জুজুৎসুর কথা ভাবা যাবে।
কাজল পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল—ভালো আছেন স্যার?
—কে? অমিতাভ নাকি? অনেকদিন তোকে দেখি না–কী পড়ছিস এখন?
–আমি এবার এম.এ. পাশ করলাম স্যার, এই কদিন আগে রেজাল্ট বেরিয়েছে—
–বাঃ, খুব আনন্দের কথা। কী সাবজেকট যেন ছিল–ইংরিজি না?
–হ্যাঁ স্যার।
–কী করবি ভাবছিস এখন?
কাজল বলিল—কিছু ঠিক করিনি স্যার। এই তো সবে ফল বেরুল–
কালিদাসবাবু বলিলেন—তুই তো আজকাল কাগজে গন-টন লিখছিস। তোর দুটো গল্প আমি পড়েছি। বেশ ভালো লেখা। তোর লেখা নিয় মাস্টারমশাইদের মধ্যে আলোচনা হয়—
কাজলের খুব আনন্দ হইল। ছোটবেলায় যে শিক্ষকদের কাছে পড়িয়াছে তাহারা তাহার লেখা পড়িয়া আলোচনা করিয়াছেন! মানুষের অহং তৃপ্ত হইবার মতো ব্যাপার বটে!
দিনদুয়েক বাদে সন্ধ্যাবেলা কাজল নিজের ঘরে বসিয়া লিভিংস্টোনের জীবনী পড়িতেছে, এমন সময়ে খট্ খট্ করিয়া বাহিরের দরজার কড়া নড়িয়া উঠিল। দরজা খুলিয়া সে দেখিল কালিদাসবাবু দাঁড়াইয়া আছেন। সে অবাকও হইল, খুশিও হইল। সে যখন স্কুলের ছাত্র, তখনও মাস্টারমশাই কোনোদিন তাহাদের বাড়ি আসেন নাই। এই প্রথম।
ঘরে আসিয়া কালিদাসবাবু খাটের এককোণে বসিলেন, উপুড় করিয়া রাখা বইটা হাতে লইয়া বলিলেন–এই বইটা পড়ছিলি বুঝি? লিভিংস্টোনের জীবনী? খুব ভালো, বই পড়ার অভ্যেস মানুষকে মহং করে, মনটাকে বড় করে। দেখবি যারা বই পড়তে ভালোবাসে তারা কখনও ছোটাখাটো নীচতা করতে পারে না।
কাজল মাকে ডাকিয়া মাস্টারমশাইয়ের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল। তিনি হাসিয়া বলিলেন—আলাপ হয়ে ভালোই হল বৌঠান, আপনার কাছ থেকে একটা অনুমতি নেবার আছে। সত্যি বলতে কী, সেজন্যেই আজ এসেছি। অমিতাভ তো এবাব এম.এ. পাশ করেছে, বর্তমানে কোন কাজও করছে না। ওকে আমি আমাদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে যেতে চাই। আপনার কোন আপত্তি হবে না তো?
কাজল শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল, খুব আনন্দও হইল। স্কুলের মাস্টারমশাইদের শ্রদ্ধা করিতে হয়, দেখা হইলেই প্রণাম কবিতে হয় নিজেরও যে কোনদিন সেই শ্রেণিভুক্ত হওয়া সম্ভব তাহা যেন ঠিকঠাক বিশ্বাস হয় না।
কালিদাসবাবু কাজলকে বলিলেন—তোর যদি অসুবিধে না থাকে তাহলে এই সোমবার থেকেই কাজ শুরু কর। পৌনে এগারোটার ভেতর স্কুলে আসবি।অবশ্য প্রথম দিন সাড়ে দশটায় যাওয়াই ভালো। এখন তোকে স্কেল দিতে পারব না। থাউকে কিছু টাকা ধরে দেবো, কাবণ স্কুলে এখন কোনো পোস্ট খালি নেই, তোকে বাড়তি হিসেবে নিচ্ছি। আট-দশমাস পরে মণীন্দ্রবাবু রিটায়ার করবেন, সেই জায়গায় তোকে পাকাপাকিভাবে নিয়ে নেব
হৈমন্তী জলখাবারের ব্যবস্থা করিতে গেলে কালিদাসবাবু অনেক কথা বলিলেন। স্কুলে এখন কোন হেডমাস্টার নাই, সবচেয়ে সিনিয়ার টিচার হিসাবে তিনিই কাজকর্ম দেখিতেছেন। শিক্ষকদের মধ্যে নানাবুপ দলাদলি শুরু হইয়াছে। ভালোভাবে ইংবাজি পড়াইবাব মতো কেহ নাই। বয়স্ক শিক্ষক রাখিলে এ অবস্থায় উন্নতি ঘটানো যাইবে না। তরুণ এবং আদর্শবাদী শিক্ষক, যাহার ভিতর উৎসাহ ও স্বপ্ন এখনও মরিয়া যায় নাই, স্কুলকে বাঁচাইতে হইলে এখন তেমন একজনকে প্রয়োজন। কাজলের এইসব গুণ আছে বলিয়া তিনি মনে করেন।
প্রথমদিন স্কুলে যাইবার জন্য রওনা হইয়া কাজলের মনে হইল রাস্তায় যত লোক সবাই তাহার দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া আছে, সবাই যেন ধরিয়া ফেলিয়াছে সে স্কুলে ছাত্র পড়াইতে যাইতেছে। দশটা পনেরোতেই সে পৌঁছাইয়া গেল। এগারোটা হইতে ক্লাস শুরু, একমাত্র কালিদাসবাবু টিচার্স রুমে খাতাপত্র লইয়া কী যেন করিতেছেন, অন্য কেহই এখনও আসে নাই। কাজলকে দেখিয়া তিনি বলিলেন—এই যে অমিতাভ, এসে গিয়েছিস দেখছি। বোস ওই চেয়ারটায়। সবাই আসতে এখনও দেরি আছে। দাঁড়া, অ্যাটেনডেনস রেজিস্ট্রারে তোর নামটা তুলে দিই, তারপর সই কর
টেবিলের উপর হইতে একটা মোটা খাতা লইয়া কালিদাসবাবু তাহাতে যথাস্থানে কাজলের নাম লিখিলেন, তাহার পর খাতাটা তাহার হাতে দিয়া বলিলেন—নে, সই কর—
কাজল নির্দিষ্ট খোপে জীবনে প্রথম চাকুরির হাজিরাজ্ঞাপক সই দিল।
-বোস না, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?
ছাত্রজীবনে এই ঘরে বিভিন্ন কারণে অজস্রবার আসিতে হইয়াছে এবং শিক্ষকদের সামনে তটস্থ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হইয়াছে, কেহ বসিতে বলেন নাই। সেই মজ্জাগত অভ্যাস ও মনোভাব অকস্মাৎ ত্যাগ করা কঠিন। সে লজ্জিত গলায় সংকুচিত হইয়া বলিল—ঠিক আছে স্যার, আমি কেশ আছি–
কালিদাসবাবু হাসিয়া বলিলেন–বুঝেছি। আচ্ছা তুই এক কাজ কর, লাইব্রেরি ঘরে চলে যা। ছোকরা টিচাররা ওই ঘরটায় বসার ব্যবস্থা করেছে—তুইও যা। প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়লে এসে প্রেয়ারে যোগ দিবি। তারপর দেখি তোকে কী ক্লাস দেওয়া যায়–
লাইব্রেরির জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি বিশেষ বড়ো নহে। চারিদিকের দেওয়াল ঘেঁষিয়া কয়েকটি কাঁচের পাল্লা লাগানো আলমারি। মাঝখানে একটি লম্বা টেবিল, তাহার দুইদিকে দুইটি বেঞ্চি এবং এদিক ওদিক ছড়ানো কয়েকটি চেয়ার। আলমারিগুলিতে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের বেশ কিছু ভালো বই রহিয়াছে, কিন্তু সেগুলি পারতপক্ষে ছাত্রদের পড়িতে দেওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই। ছাত্ররাও যে সকলেই বিশ্বসাহিত্য পড়িবার জন্য ভয়ানক উৎসাহী এমন নয়, তবু দুই-একজন ছেলে বই পড়িতে চাহিলে লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক শিবলালবাবু দেশলাইয়ের কাঠি দিয়া অর্ধনিমীলিত চোখে কান খোঁচাইতে খোঁচাইতে উদাস গলায় বলেন–বই পড়বি? কিনে পড়গে যা—এসব দামি বিলিতি বই, হাতে হাতে বেশি ঘুরলে নোংরা হয়ে যাবে–
অত্যুৎসাহী কেহ বলে–নোংরা হবে না স্যার, মলাট দিয়ে পড়ব—
–তাই? বাঃ, ভালো কথা। বেশ, হেডমাস্টারমশাইকে বলে দেখ—
হেডমাস্টার! কী সর্বনাশ! সাধ করিয়া কে আত্মহত্যা করে?
কাজল গিয়া বসিতে বসিতেই একজন অল্পবয়েসী শিক্ষক ঘরে ঢুকিল। কাজলকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–আপনি কী কাউকে খুঁজছেন?
-না, আমি—মানে আজ থেকে কালিদাসবাবু বললেন এখানে বসতে–
দশমিনিটের মধ্যেই দুইজনের পরিচয় বেশ গাঢ় হইয়া গেল। ছেলেটির নাম রমাপদ, বছর দেড়েক হইল বি.এ. পাশ করিয়া এখানে পড়াইতেছে। বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার কী একটা গ্রামে। একলা একটি ছোট ঘর ভাড়া করিয়া থাকে ও নিজে রান্না করিয়া খায়। সাহিত্যে বেশ উৎসাহ। কাজলের নাম শুনিয়াই সে বলিল—ও আপনি অপূর্ব রায়ের ছেলে, না? আপনি নিজেও তো লেখেন? আপনার লেখা আমি পড়েছি
এমন সময়ে প্রার্থনার ঘণ্টা পড়িল। রমাপদ বলিল–চলুন, প্রেয়ারে যাওয়া যাক। পরে জমিয়ে গল্প করা যাবে। আপনি কী কোনো ক্লাস পেয়েছেন?
না এখনও কালিদাসবাবু কিছু বলেন নি-–
–বেশ, যতক্ষণ হাল্কা থাকবেন ততক্ষণই ভালো। চলুন—
প্লেয়ারের পর সকল শিক্ষকেরাই টিচার্স রুমে আসিলেন। কালিদাসবাবু বলিলেন—অমিতাভ, তুমি সেভেন বি-র খাতাটা নিয়ে ক্লাসে যাও, ওটা দুলালবাবুর বাংলা গদ্যের রাস—তিনি এখনও আসেন নি। তারপর দেখি আর কী দেওয়া যায়–
শিক্ষকজীবন শুরু হইয়া গেল।
ইংরাজ শাসকের উদ্দেশ্য সফল হইল। স্বাধীনতা আসিয়া পড়িল বটে, কিন্তু দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষের আগুন জ্বলিয়া উঠিল। কাজল প্রথমে ব্যাপারটার গুরুত্ব ঠিকঠাক উপলব্ধি করিতে পারে নাই। খবরের কাগজে কলিকাতার নানা সংবাদ প্রকাশিত হইতেছিল বটে, কিন্তু সেই বিবরণ নিতান্তই গুটিকয়েক অক্ষরের সমষ্টি মাত্র। পৃথিবী এত সুন্দর, জীবন এত মধুর–এখানে খারাপ কিছু ঘটিতে পারে না। মানুষ কখনও মানুষের প্রতি এতটা নির্মম হইতে পারে না।
অথচ সে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখিয়াছে, হিরোশিমার তাণ্ডব দেখিয়াছে, জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদীদের উপর আইখম্যানের অমানবিক অত্যাচারের কথা সে জানে। মানুষের মানবিকতার উপর এই বিশ্বাস নিষ্ঠুর বাস্তবকে ভুলিয়া থাকিবার জন্য তাহার মনের একটা কারসাজি মাত্র। মানুষ সব মিলাইয়া মোটের উপর ভালোই, কারণ তাহার সভ্যতা অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করিয়াও আজ এত হাজার বছর টিকিয়া আছে। কিন্তু তাহারই মধ্যে মাঝে মাঝে এক-একটা উন্মত্ততার যুগ আসে, পৃথিবীব্যাপী অশান্তির অন্ধকার ঘনাইয়া আসে। কাজলের কেমন মনে হয়, আসলে দুই পক্ষের মানুষগুলি কেহই খারাপ নহে, অদৃশ্য এক তৃতীয়পক্ষ নিজেদের কূট স্বার্থ বজায় রাখিবার জন্য দুইজনকে লড়াইয়া দিয়াছে।
নানাবিধ গোলযোগের মধ্যে দেশ স্বাধীন হইল। স্বাধীনতা আনিতে যে রক্তপাতের প্রয়োজন হয় নাই, নিরর্থক ভ্রাতৃবিরোধে সেই রক্ত দেশের মাটিতে ঝরিয়া পড়িল। তবু তো এখন দেশ স্বাধীন। জাতীয় জীবনে নতুন একটা উদ্দীপনার জোয়ার আসিয়াছে। কেবল প্রভাত একদিন মির্জাপুর স্ট্রীটে তাহাদের পরিচিত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে কাজলকে বলিল–স্বাধীন হয়ে সবাই খুব খুশি, কিন্তু ইট ইজ টু আর্লি টু রিজয়েস–
বিস্মিত কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কেন?
-এতদিন সবকিছু অসুবিধের জন্য আমরা ইংরেজকে দায়ী করে এসেছি। এবার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের ঘাড়ে—সামনে অনেক সমস্যা অমিতাভ, সেখানে ব্যর্থ হলে কাকে দায়ী করব? এবারই আসল পরীক্ষা শুরু হল—
কাজল রাজনীতি বোঝে না, কিন্তু প্রভাতের কথাগুলি তাহার যথার্থ বলিয়া মনে হইল।