॥ ১১ ॥
জয়সলমীর স্টেশনে নেমে প্রথমেই যেটা করলাম সেটা হচ্ছে একটা খাবারের দোকানে গিয়ে চা আর একটা নতুন রকমের মিষ্টি খেয়ে খিদেটাকে মিটিয়ে নিলাম। ফেলুদা বলল—মিষ্টি জিনিসটা নাকি দরকার—ওতে গ্লুকোজ থাকে—সামনে পরিশ্রম আছে—গ্লুকোজ এনার্জি দেবে।
স্টেশনের বাইরে এসে দেখলাম গাড়ি-টাড়ির কোনও বালাই নেই। একটা জিপ আছে দাঁড়িয়ে, তবে সেটা যে ভাড়ার নয়, সেটা দেখেই বোঝা যায়। টাঙ্গা এক্কা সাইক্ল-রিকশা ট্যাক্সি কিচ্ছু নেই। আমরা যখন ট্রেন থেকে নেমেছিলাম তখন একটা কালো অ্যাম্বাসাডর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম; এখন দেখছি সে গাড়িটাও নেই। ফেলুদা বলল, ‘জায়গাটা ছোট সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কাজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব বেশি নয় নিশ্চয়ই। ডাকবাংলো একটা আছে সেটা গাইড-বুকে লিখেছে। আপাতত সেটার খোঁজ করা যাক।’
যে যার মালপত্তর হাতে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কাছেই একটা পেট্রোল স্টেশনে একটা লোককে জিজ্ঞেস করতেই সে রাস্তা বাতলে দিল। বুঝলাম যে ডাকবাংলোয় যাবার জন্য পাহাড়ে উঠতে হবে না, সেটা পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে সমতল জমির উপরেই। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার বালির উপর টায়ারের দাগ দেখে ফেলুদা বলল, ‘অ্যাম্বাসাডরটাও এই রাস্তাতেই গেছে বলে মনে হচ্ছে।’
প্রায় মিনিট পনের হাঁটার পর একটা একতলা বাড়ির সামনের কাঠের ফলকে লেখা দেখে বুঝলাম আমরা ডাকবাংলোয় এসে গেছি। বাংলোর সামনেই দেখি কালো অ্যাম্বাসাডরটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের দেখতে পেয়েই বোধহয় একটা খাকি শার্ট খাটো ধুতি আর পাকানো পাগড়ি পরা বুড়ো লোক পাশের একটা আউট-হাউস থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। ফেলুদা তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল সে চৌকিদার কি না। লোকটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিল। তার চাউনি দেখে বুঝলাম যে আমাদের আসাটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত, আর ব্যাপারটা সে একটু সন্দেহের চোখে দেখছে, কারণ পারমিশন ছাড়া বাংলোয় থাকতে দেয় না এটা আমি জানি।
ফেলুদা বাংলোয় থাকার প্রশ্নটাই তুলল না। সে বলল যে আপাতত সে শুধু মালগুলো রেখে যেতে চায়, তারপর পারমিশনের চেষ্টা করে দেখবে। চৌকিদার বলল সেটার জন্য রাজার সেক্রেটারির কাছে যেতে হবে। রাজবাড়ি কোনদিকে সেটাও সে হাত তুলে দেখিয়ে দিল। দূরে গাছপালার মাথার উপর দিয়ে হলদে পাথরের তৈরি প্যালেসের খানিকটা অংশও দেখতে পেলাম।
চৌকিদার মালগুলো রাখতে দিতে কোনও আপত্তি করল না। তার একটা কারণ অবিশ্যি এই যে, ফেলুদা ইতিমধ্যে তার হাতে একটা কড়কড়ে দু’ টাকার নোট গুঁজে দিয়েছে। একটা ঘরের মধ্যে সুটকেস বিছানা রেখে ফ্লাস্কগুলোতে জল ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করা হল কেল্লায় যেতে হলে কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।
‘ইউ ওয়ান্ট টু গো টু দ্য ফোর্ট?’
প্রশ্নটা এল বারান্দার ও-মাথা থেকে। একটি ভদ্রলোক ও দিকের একটা ঘর থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছেন। ফরসা রং, বয়স চল্লিশের বেশি নয়, খুব মন দিয়ে ছাঁটা সরু একটা গোঁফ চোখা নাকের নীচে। এবার আরেকটু বেশি বয়সের আরেকটি ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথম ভদ্রলোকটির পাশে দাঁড়ালেন। এঁর হাতে একটা লাঠি—যেমন লাঠি আমরা যোধপুরের বাজারে দেখেছি—আর গায়ে কেমন যেন একটা বেখাপ্পা কালো স্যুট। এরা দু’জনে কোন দেশী সেটা বোঝা গেল না। লক্ষ করলাম দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি একটু যেন খোঁড়াচ্ছেন, আর সেই জন্যেই বোধহয় তার লাঠির দরকার হচ্ছে।
ফেলুদা বলল, ‘ফোর্টটা একবার দেখতে পারলে মন্দ হত না।’
‘কাম অ্যালং উইথ আস্—উই আর গোয়িং দ্যাট ওয়ে।’
ফেলুদা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য কী জানি ভেবে যেতে রাজী হয়ে গেল।
‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্। দ্যাট ইজ ভেরি কাইন্ড অফ ইউ।’
আমরা গাড়ির দিকে যাবার সময় লালমোহনবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘এরা আবার চলন্ত মোটরগাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চাইবে না তো?’
গাড়ি কেল্লার দিকে রওনা দিল। লাঠিওয়ালা ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর ইউ ফ্রম ক্যালকাটা?
ফেলুদা বলল, ‘হ্যাঁ।’
বাঁদিকে বালির উপর দূরে দেখলাম দেবীকুণ্ডের মতো কতগুলো স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। ফেলুদা বলল ও জিনিসটা নাকি রাজস্থানের সব শহরেই রয়েছে।
আমাদের গাড়ি ক্রমে পাহাড়ের গা বেয়ে চড়াই উঠতে আরম্ভ করল।
মিনিটখানেক ওঠার পর পিছন থেকে আর একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। গাড়িটা ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছে। অথচ আমরা যে খুব আস্তে চলছিলাম তাও নয়। তা হলে লোকটা বার বার হর্ন দিচ্ছে কেন?
ফেলুদা দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে পিছনে বসেছিল। সে হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে কাচের মধ্যে দিয়ে দেখে নিয়ে আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘রোক্কে, রোক্কে!’
আমাদের গাড়ি রাস্তার এক পাশে থামতেই আমাদের ডান পাশে এসে দাঁড়াল একটা ট্যাক্সি—তার স্টিয়ারিং ধরে হাসিমুখে বসে আমাদের সেলাম জানাচ্ছেন গুরুবচন সিং।
আমরা তিনজনেই নেমে পড়লাম। ফেলুদা ভদ্রলোক দু’জনকে ইংরিজিতে বলল—আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমাদের নিজেদের ট্যাক্সিটা পথে খারাপ হয়ে গিয়েছিল—সেটা এসে পড়েছে।
গুরুবচন বলল ভোর সাড়ে ছ’টায় নাকি একটা চেনা ট্যাক্সি জয়সলমীর থেকে ফিরছিল—তার কাছ থেকে স্পেয়ার চেয়ে নিয়েছে। নব্বই মাইল রাস্তা নাকি সে দু’ ঘণ্টায় এসেছে। এখানে এসে পেট্রোল স্টেশনটায় দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ কালো অ্যাম্বাসাডরটার ভিতর আমাদের দেখতে পায়।
আরও খানিকটা পথ যেতেই আমরা একটা বাজারের মধ্যে এসে পড়লাম। চারদিকে দোকানপাট গিজগিজ করছে, লাউডস্পিকারে হিন্দি ফিল্মের গান হচ্ছে, একটা ছোট্ট সিনেমা হাউসের বাইরে আবার হিন্দি ছবির বিজ্ঞাপনও রয়েছে।
‘আপলোগ কিল্লা দেখনে মাংতা?’ গুরুবচন সিং জিজ্ঞেস করল। ফেলুদা ‘হ্যাঁ’ বলতে গুরুবচন সিং ট্যাক্সি থামাল। ‘ইয়ে হ্যায় কিল্লেকা গেট।’
ডানদিকে চেয়ে দেখি এক পেল্লায় ফটক—তারপর পাথরে বাঁধানো রাস্তা চড়াই উঠে গেছে আর একটা ফটকের দিকে। বুঝলাম, এটা বাইরের গেট আর ভেতরেরটা আসল গেট। দ্বিতীয় গেটের পিছন থেকেই খাড়াই উঠে গেছে জয়সলমীরের সোনার কেল্লা।
গেটের বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখলেই প্রহরী বলে বোঝা যায়। ফেলুদা তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল সকালের দিকে কোনও বাঙালি ভদ্রলোক একটি ছোট ছেলেকে সঙ্গে করে কেল্লা দেখতে এসেছিলে কি না। ফেলুদা হাত দিয়ে মুকুলের হাইটটাও বুঝিয়ে দিল।
—আয়া থা, কিন্তু এখন নেই, চলে গেছে।
—কখন?
—আধ ঘণ্টা হবে।
—গাড়িতে এসেছিল?
—হাঁ—এক টেক্সি থা।
—কোন দিকে গেছে বলতে পারো?
প্রহরী পশ্চিম দিকের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। আমরা সেই রাস্তা ধরে অলিগলি দোকানপাটের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগলাম। লালমোহনবাবু সামনে বসেছেন গুরুবচনের পাশে, আমি আর ফেলুদা পিছনে। কিছুক্ষণ চলার পর ফেলুদা হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আপনার অস্ত্রটা আনেননি তো সঙ্গে?’
লালমোহনবাবু অন্যমনস্কতার মধ্যে হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চমকে বললেন, ‘ভোপালি? ইয়ে-মানে-গিয়ে-আপনার—ভোজালি?’
‘হ্যাঁ আপনার নেপালী ভোজালি।’
‘সে তো সুটকেসে স্যার।’
‘তা হলে আপনার পাশে রাখা জাপান এয়ার লাইন্সের ব্যাগ থেকে মন্দার বোসের রিভলভারটা বার করে কোটের তলায় বেল্টের মধ্যে গুঁজুন—যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়।’
লালমোহনবাবুর নড়াচড়া থেকে বুঝলাম তিনি ফেলুদার আদেশ পালন করছেন। এই সময় তার মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল।
‘কিছু না’, ফেলুদা বলল, ‘গোলমাল দেখলে স্রেফ ট্যাঁক থেকে ওটি বার করে সামনের দিকে পয়েন্ট করে দাঁড়িয়ে থাকবেন।’
‘আর পে-পেছন দিয়ে যদি—’
‘পেছনে কিছু হচ্ছে বুঝলে আপনি নিজে ঘুরে যাবেন, তখনই সেটা সামনে হয়ে যাবে।’
‘আর আপনি? আপনি বুঝি আজ, মানে, নন-ভায়োলেন্ট?’
‘সেটা প্রয়োজন বুঝে।’
ট্যাক্সিটা বাজার ছাড়িয়ে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ল। আমরা এর মধ্যে আরও দু’-একজনকে জিজ্ঞেস করে অন্য ট্যাক্সিটা কোন পথে গেছে জেনে নিয়েছি। তা ছাড়া রাস্তায় বালির উপর মাঝে মাঝে টায়ারের দাগ দেখতে পাচ্ছিল আর তাতেই বুঝতে পারছি যে আমরা হেমাঙ্গ হাজরার রাস্তাতেই চলেছি।
গুরুবচন সিং বলল, ‘ইয়ে হ্যায় মোহনগড় জানেকা রাস্তা। আউর এক মিল জানা সেক্তা। উস্কে বাদ রাস্তা বহুৎ খারাপ হ্যায়। জিপ ছোড়কে দুস্রা গাড়ি নেহি যাতা।’
এক মাইলও অবিশ্যি যেতে হল না। কিছু দূর গিয়েই দেখতে পেলাম রাস্তার এক ধারে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ডানদিকে খানিকটা দূরে রয়েছে একসঙ্গে অনেকগুলো পরিত্যক্ত একতলা ছাত-ছাড়া খুপরির মতো পাথরের বাড়ি। বুঝলাম, এটাও হচ্ছে একটা প্রাচীন গ্রাম, যেমন গ্রাম আমরা এর আগে আরও দু’-একটা দেখেছি। এ সব গ্রাম থেকে লোকজন নাকি বহুকাল আগে চলে গেছে; শুধু দেয়ালগুলো পাথরের তৈরি বলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
গুরুবচন সিংকে অপেক্ষা করতে বলে আমরা বাড়িগুলোর দিকে এগোলাম। সর্দারজি দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে অন্য ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেল—বোধহয় জাতভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা মারতে।
চারিদিকে থমথম করছে। পিছনদিকে চাইলে দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় জয়সলমীরের কেল্লা। রাস্তার উলটোদিকে খাড়াই উঠে গেছে পাহাড়। তার ঠিক পায়ের কাছে একটা প্রকাণ্ড খোলা জায়গা জুড়ে মাটিতে পোঁতা শিল-নোড়ার মতো হলদে পাথরের সারি। ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, ‘যোদ্ধাদের কবর।’
লালমোহনবাবু খসখসে মিহি গলায় বললেন, ‘আমার কিন্তু আবার লো ব্লাড প্রেশার।’
‘কিচ্ছু ভাববেন না’, ফেলুদা বলল, ‘দেখতে দেখতে হাই হয়ে যেমনটি চাই তেমনটি হয়ে যাবে।’
বাড়িগুলোর কাছে এসে পড়েছি। সারি সারি বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সোজা রাস্তা। বেশ বুঝলাম এ গ্রাম বাংলাদেশের গ্রামের মতো নয়। এর মধ্যে এটা সহজ জ্যামিতিক প্ল্যান আছে।
কিন্তু ট্যাক্সির যাত্রীরা কোথায়? মুকুল কোথায়? ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা কোথায়?
মুকুলের কিছু হয়নি তো?
হঠাৎ খেয়াল হল কানে একটা শব্দ আসছে—এখনও খুবই আস্তে—কিন্তু কান পাতলে শোনা যায়। খট্—খট্—খট্….
অত্যন্ত সাবধানে একটুও শব্দ না করে আরও কয়েক পা এগিয়ে দেখলাম, একটা চৌরাস্তায় এসে পড়েছি। আমরা এখনও দুটো রাস্তার ক্রসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। ডানদিক দিয়ে শব্দটা আসছে। রাস্তার দু’ দিকে দশ-বারোটা বাড়ির সারি—তাদের দেওয়াল আর দরজার ফাঁকগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা ডানদিকের রাস্তাটা ধরেই পা টিপে টিপে এগোতে লাগলাম।
ফেলুদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বলল, ‘রিভলভার’—আর সেই সঙ্গে তার নিজের হাতটাও চলে গেল কোটের ভিতর। আড়চোখে দেখলাম লালমোহনবাবুর হাতেও রিভলভার এসে গেছে, আর সেটা অসম্ভব কাঁপছে।
হঠাৎ একটা খচমচ আওয়াজ শুনে আমরা থমকে দাঁড়ালাম, আর তারপরমুহূর্তেই দেখলাম রাস্তার শেষ মাথায় বাঁদিকের একটা বাড়ির দরজা দিয়ে মুকুল দৌড়ে বেরিয়ে এল—তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে আরও দ্বিগুণ জোরে ছুটে এসে ফেলুদার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে হাঁপাচ্ছে, তার মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে।
আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কী হয়েছে, কিন্তু ফেলুদা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমার কথা বন্ধ করে দিল।
ফিসফিস করে ‘একে একটু দেখুন’ বলে মুকুলকে লালমোহনবাবুর জিম্মায় রেখে ফেলুদা নিঃশব্দে এগিয়ে চলল যেখান থেকে মুকুল বেরিয়েছে সেই দিকে। আমিও চললাম তার পিছন পিছন।
এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা বাড়ছে। মনে হল কে যেন পাথর নিয়ে নাড়াচাড়া করছে—খট্—খটাং-খুট্—খুট্…
বাড়িটার কাছে পৌঁছে দেয়ালের দিকটায় ঘেঁষে গেল ফেলুদা।
আর তিন পা বাড়াতেই দরজার হাঁ করা ফাঁকটা দিয়ে দেখলাম ডক্টর হাজরাকে। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে পিঠ করে পাগলের মতো একটা ডাঙা পাথরের স্তূপ থেকে একটার পর একটা পাথর তুলে এক পাশে ফেলছেন। আমরা যে এসে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি, সেটা তাঁর খেয়ালই নেই।
আর এক পা সামনে এগোল ফেলুদা—তার হাতে রিভলভার ডক্টর হাজরার দিকে উঁচোনো।
হঠাৎ উপর দিক থেকে একটা ঝটপট শব্দ।
একটা ময়ূর পাঁচিলের উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছে।
মাটিতে পড়েই তীরবেগে ছুটে গিয়ে ময়ূরটা উপুড় হওয়া ডক্টর হাজরার বাঁ কানের ঠিক নীচে একটা সাংঘাতিক ঠোকর মারল। ডক্টর হাজরা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে হাত দিয়ে ঠোকরানোর জায়গাটা চেপে ধরতেই তার সাদা শার্টের আস্তিনটা লাল হয়ে উঠল।
এদিকে ময়ূরটা ঠোকর মেরেই চলেছে। তার মধ্যেই ডক্টর হাজরা পালাতে গিয়ে আমাদের সামনে দেখে ভূত দেখার মতো ভাব করলেন। আমরা দরজা ছেড়ে পিছিয়ে দাঁড়ালাম, আর ময়ূর তাকে ঠুকরে ঘর থেকে বার করে দিল।
‘গুপ্তধনের জায়গায় যে ময়ূরের বাসা থাকবে, আর তার মধ্যে যে ডিম থাকবে—এটা বোধহয় আপনি ভাবতে পারেননি—তাই না?’
ফেলুদার গলার স্বর ইস্পাত, তার রিভলভার ডক্টর হাজরার দিকে তাগ করা। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে ডক্টর হাজরাই শয়তান, আর তার শাস্তিও হয়েছে চমৎকার, কিন্তু অন্য অনেক কিছুই এখনও এত ধোঁয়াটে রয়েছে যে মাথাটা কেমন জানি গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। ডক্টর হাজরা মাটিতে উপুড় হয়ে আছেন। তাঁর ঘাড়টা আস্তে আস্তে ফেলুদার দিকে ফিরল, তাঁর বাঁ হাতটা এখন একটা রক্তাক্ত রুমাল সমেত ক্ষতের উপর চাপা।
ফেলুদা বলল, ‘আর কোনও আশা নেই, জানেন। এবার আপনার দু’-দিকের রাস্তাই বন্ধ।’
ফেলুদার কথা শেষ হবার আগেই ডক্টর হাজরা হঠাৎ চোখের পলকে দাঁড়িয়ে উঠে একটা উন্মাদ দৌড় দিলেন উল্টোদিকে। ফেলুদা রিভলভারটা নামিয়ে নিল—কারণ সত্যিই পালাবার কোনও পথ নেই। উল্টোদিক থেকে আমাদের দুজন চেনা ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। যার হাতে লাঠি নেই, তিনি খপ করে ক্রিকেট বল লোফার মতো ডক্টর হাজরাকে বগলদাবা করে নিলেন।
এবারে লাঠিওয়ালা ভদ্রলোকটি ফেলুদার দিকে এগিয়ে এলেন। ফেলুদা রিভলভারটা বাঁ হাতে চালান দিয়ে ডান হাতটা ভদ্রলোকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আসুন ডক্টর হাজরা।’
অ্যাঁ! ইনিই ডক্টর হাজরা?
ভদ্রলোক ফেলুদার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘আপনিই তো বোধহয় প্রদোষ মিত্তির?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার নাগরা পরার দরুন ফোসকাটা এখনও সারেনি বলে মনে হচ্ছে…’
আসল ডক্টর হাজরা হেসে বললেন, ‘পরশু সুধীরবাবুকে ট্রাঙ্ক কল করেছিলাম। উনিই বললেন আপনি এসেছেন। যা বর্ণনা দিলেন, তা থেকে চিনতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আলাপ করিয়ে দিই—ইনি হলেন ইনস্পেক্টর রাঠোর।’
‘আর উনি?’ ফেলুদা হাত-কড়া পরা মাথা হেঁট-করা ময়ূরের ঠোকর-খাওয়া ভদ্রলোকটির দিকে দেখাল। ‘উনিই বুঝি ভবানন্দ?’
‘ইয়েস’, বললেন ডক্টর হাজরা, ‘ওরফে অমিয়নাথ বর্মন, ওরফে দ্য গ্রেট বারম্যান—উইজার্ড অফ দ্য ইস্ট।’