১১. জনৈক নগ্নপদ বৃদ্ধ

দিল্লীর পথেঘাটে জনৈক নগ্নপদ বৃদ্ধকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। তার চক্ষু কোটরাগত। অনাহারে-অর্ধহারে শরীর ভেঙে গেছে। সে কপর্দকহীন। তার বেশির ভাগ সময় কাটে হালুইকারির দোকানের আশপাশে। দোকানিদের কেউ কেউ একটা লাড়ড়ু, একটা লুচি ছুড়ে দেয়। বৃদ্ধ তা লুফে নেয়। খাবারের সন্ধানে সে শ্মশানঘাটেও বসে থাকে। সেখানে গুড় মাখানো চিড়া বিতরণ করা হয়। বৃদ্ধ উড়ুনি পেতে চিড়া গ্ৰহণ করে। বৃদ্ধ উচ্চবর্ণের ব্ৰাহ্মণ। কিন্তু সে পৈতা লুকিয়ে ফেলেছে। ব্ৰাহ্মণরা উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। বৃদ্ধ নিরুপায়। উচ্ছিষ্ট খাদ্যগ্রহণে তার কোনো আপত্তি নাই। দিল্লী শহরের অন্য ভিক্ষুকদের সঙ্গে তার এখন কোনো তফাত নেই। খাদ্য নিয়ে ভিক্ষুকদের সঙ্গে সে কাড়াকড়িও করে।

ভিক্ষুকো ভিক্ষুকং দৃষ্টা
শ্বতুল্যং গুরগুরায়তে

(কুকুর। যেমন অন্য কুকুরকে দেখলে গর্জন করে, ভিক্ষুকও সেরকম অন্য ভিক্ষুককে দেখলে গর্জন করতে থাকে।)

এই বৃদ্ধ আমাদের পরিচিত। তাঁর নাম হরিশংকর। আচার্য হরিশংকর। তিনি শত মাইল হেঁটে দিল্লী এসেছেন সম্রাট হুমায়ূনের সাক্ষাৎপ্রত্যাশী হয়ে।

সম্রাট তাঁর অতীত জানেন না। কাজেই সম্রাটের কৃপা প্রার্থনা তিনি করতে পারেন। সম্রাট সন্দেহ করবেন না। সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টার তিনি ত্রুটি করেন নি। সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ভিক্ষুককে রাজদরবারে ঢোকানো যায় না। সম্রাটের দর্শনপ্রার্থীদের উপহার নিয়ে যেতে হয়। আচার্য হরিশংকরের কাছে তার নোংরা উড়ুনি ছাড়া কিছু নেই।

প্রতি শুক্রবার হাতির পিঠে চড়ে সম্রাট জুমার নামাজ পড়তে যান। এই সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হরিশংকর সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে নানান অঙ্গভঙ্গি করেন, উচ্চস্বরে কাদেন। তাতে লাভ হয় না। সম্রাট তাকান না।

এখন হরিশংকর লাফ দিয়ে হাতির সামনে পড়ার চিন্তাভাবনা করছেন। সাহস সঞ্চয় করতে পারছেন না।

এক জুমাবারে হরিশংকর রাস্তার পাশ থেকে দৌড়ে এসে সম্রাটের হাতির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়ার দৃশ্য না দেখাই ভালো।

চারদিক থেকেই হৈচৈ হচ্ছে। ঘণ্টা বাজছে। ভীত হরিশংকর চোখ খুললেন।

আশ্চর্য! হাতির পিঠের হাওদায় বসা সম্রাট তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কি তাকে চিনতে পারছেন? উত্তেজনায় হরিশংকর কুর্নিশ করতে ভুলে গেল।

সম্রাট বললেন, আপনি কি আচার্য হরিশংকর?

হরিশংকর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সেখান থেকে উঠে হাতজোড় করে বললেন, সম্রাট আমাকে চিনতে পেরেছেন। আমার জীবন ধন্য। আমি শের শাহ’র হাতে বন্দি ছিলাম। কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছি। আমি সম্রাটের দেখা পেয়েছি, আমার জীবন ধন্য।

আমার দেখা পাওয়ার জন্যেই কি আপনি এসেছেন?

হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে হরিশংকর আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

সম্রাট বললেন, আপনার অতি মলিন বেশ, ভগ্ন শরীর দেখে আমি ব্যথিত। কাল রাজদরবারে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

 

সম্রাট হুমায়ূন হরিশংকরকে সভাসদের পদ দিলেন। তিনি সম্রাটের উপদেষ্টাদের একজন হলেন। সম্রাট হুমায়ূনের অনেক বড় বড় ভুলের মধ্যে এটিও একটি।

সাত দিনের মধ্যে আচার্যের চেহারায় জেল্লা ফিরে এল। নতুন পোশাকে তাকে দরবারে মোটেই বেমানান মনে হলো না। তিনি অবশ্যি নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে মৌনী ভাব ধরলেন। যদিও তিনি জানেন—

বিদ্যা স্তব্ধস্য নিষ্ফলা

(যে কথা কইতে ভয় পায়, তার বিদ্যা নিষ্ফল হয়।)

আচার্য হরিশংকর অপেক্ষায় আছেন। কথা বলার সময় অনেক পাওয়া যাবে। কিছু কথা সম্রাটকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বলতে চান। কী বলবেন তা ভেবে রেখেছেন। সম্রাটের সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না।

যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে সম্রাট ব্যস্ত। মিত্র রাজাদের কাছে সাহায্য চেয়ে সম্রাটের চিঠি নিয়ে রাজদূতরা যাচ্ছেন। তিনি নিজের ভাইদের সঙ্গে ঘনঘন বৈঠক করছেন। মীর্জা কামরান পবিত্র কোরান শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে সম্রাটের ডানহাত হয়ে কাজ করবেন।

মীর্জা কামরানকে নিয়ে সম্রাটের সামান্য আশঙ্কা ছিল। সেই আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে।

রাজজ্যোতিষীদের শুভক্ষণ বের করতে বলা হয়েছে। সম্রাট নিজে ইস্তেখারা নামাজ পড়েছেন। ইস্তেখারার নামাজের পর অজু করে ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্নে নির্দেশ আসে। স্বপ্নে যা দেখা যায়। তার সবটাই প্রতীকী। এই প্রতীকের অর্থ-উদ্ধার বেশিরভাগ সময় কঠিন হয়।

সম্রাট স্বপ্নে দেখেছেন। ধবধবে সাদা একটা বিক গাছে বসেছে। গাছের পাতা খাচ্ছে।

স্বপ্নের তফসিরকারীরা স্বপ্নের অর্থ করেছেন। এইভাবে–

বক মাংসাশী। সে জীবন্ত মাছ, পোকামাকড় ধরে ধরে খায়। স্বপ্নে সে তার স্বভাব পরিবর্তন করে তৃণভোজী হয়ে গাছের পাতা খাচ্ছে। প্রতীকীভাবে বক হলো শের শাহ। কারণ সে পাখির মতোই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। বক যেমন ধবল সাদা, শের শাহ’র মাথার পাগড়িও ধবল সাদা। স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ অর্থ—বক তার স্বভাব পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ শের শাহ স্বভাব পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তন হবে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে।

রাজদরবারের সবাই স্বপ্নের তফসিরে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। শুধু আচার্য হরিশংকর মৌন রইলেন।

সম্রাট বললেন, আচার্য হরিশংকর, আপনি চুপ করে আছেন কেন? স্বপ্নের এই ব্যাখ্যার বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে?

আচার্য হরিশংকর বললেন, আমার বলার আছে। তবে আমি মৌন থাকতে চাচ্ছি। জ্ঞানীদের সামনে কথা বলার অর্থ নিজের মূর্খতা ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা।

হুমায়ূন বললেন, আপনার বক্তব্য আমি শুনতে চাচ্ছি।

হরিশংকর বললেন, আমি মনে করি এই বক সম্রাট নিজে। সম্রাটের অন্তর অতি পবিত্র। পবিত্রতার রঙ সাদা। বকও সাদা। বক মাছ না খেয়ে পাতা খাচ্ছে, কারণ সে কৌশল পরিবর্তন করেছে। স্বপ্নের মাধ্যমে সম্রাটকে যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করতে বলা হচ্ছে।

হুমায়ূন বললেন, আপনার ব্যাখ্যা আমি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলাম। যুদ্ধযাত্রায় আপনি আমার সঙ্গী হবেন।

হরিশংকর বললেন, সম্রাট যে আদেশ করবেন তা-ই হবে। তবে আমার উপস্থিতি আপনার জন্যে অমঙ্গলস্বরূপ। আমাকে রাজধানীতে রেখে যাওয়াই আপনার জন্যে শুভ হবে।

 

শুভদিন দেখে হুমায়ূন শের শাহকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে যুদ্ধযাত্রা করলেন। শেষ মুহুর্তে মীর্জা কামরান সরে দাঁড়ালেন। কারণ নদীর এক মাছ খেয়ে তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিছানা থেকে উঠে বসার ক্ষমতাও নেই। এই অবস্থায় যুদ্ধযাত্রা করা যায় না। তবে তিনি পাঁচ শ ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দিলেন। তারা কিছুদূর গিয়ে পাঞ্জাবে ফিরে এল। সম্ভবত এরকম নির্দেশই তাদের উপর ছিল।

হুয়ায়ূন ভাইকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চিঠিতে লেখা–

ভাই কামরান,
তোমার অসুখের খবর শুনে ব্যথিত বোধ করছি। আমার ব্যথা আরও প্রবল হয়েছে, কারণ শের শাহ্ নামক দস্যুর পরাজয় তুমি নিজের চোখে দেখতে পেলে না।

যুদ্ধক্ষেত্রে আমি কল্পনা করে নেব তুমি আমার পাশেই আছ। কল্পনার শক্তি বাস্তবের চেয়ে কম না।

আমার প্রধান ভরসা কল্পনার তুমি এবং তোপখানার দুই প্রধান উস্তাদ আহমাদ রুমী ও হোসেন খলিফা। শুধু এই দুজনই কামান দেগে শের শাহ’র বাহিনীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে।

আমি তোমার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি। আশা করছি তুমি তোমার বিজয়ী ভ্রাতাকে অভ্যর্থ্যনা করার জন্যে তোরণ নির্মাণ করে অপেক্ষা করবে।

যদি দ্রুত আরোগ্য লাভ করো, তাহলে বড়ভাইকে সাহায্য করার জন্যে কনৌজে চলে আসবে।

তোমার বড়ভাই
হুমায়ূন মীর্জা

সম্রাট এই চিঠি সম্রাট হিসেবে লিখলেন না। ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের চিঠি গেল। সম্রাটের সীলমোহর চিঠিতে পড়ল না।

 

কামরান মীর্জা অসুস্থের ভান করলেন। বড় বড় হেকিমরা তার কাছে আসা-যাওয়া করতে লাগল। হেকিমরা ঘোষণা করলেন, কামরান মীর্জাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। এই জঘন্য কাজ কে করেছে তা জানার চেষ্টা শুরু হলো। সন্দেহ অন্তঃপুরের দিকে। রাজপরিবারের নারীরা আতঙ্কে দিন কাটাতে লাগলেন।

এবারের যুদ্ধে হুমায়ূন কোনো রাজপরিবারের মহিলা সদস্য নিয়ে যান নি। কামরানের আদেশে তাদের সবাইকে গৃহবন্দি করা হলো।

কামরান মীর্জা বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমীরদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে লাগলেন। সব আমীরকে একসঙ্গে ডেকে বৈঠক না, আলাদা আলাদা বৈঠক। এক বৈঠকে আচার্য হরিশংকরের ডাক পড়ল। তিনি দিল্লী থেকে লাহোরে এসেছেন অসুস্থ মীর্জা কামরানের শারীরিক কুশল জানার জন্যে।

মীর্জা কামরান বললেন, শুনেছি আমার বড়ভাই আপনার সূক্ষ্ম বুদ্ধি এবং জ্ঞানের একজন সমাজদার।

হরিশংকর বললেন, সম্রাট হাতি, আমি সামান্য মূষিক।

যুদ্ধক্ষেত্রে হাতি মারা পড়ে। মুষিকের কিছু হয় না।

হরিশংকর বললেন, হাতির মৃত্যুতে যায় আসে, মুষিকের মৃত্যুতে কিছু যায় আসে না বলেই মূষিকের কিছু হয় না।

আপনার কী ধারণা? সম্রাট শের শাহকে পরাজিত করতে পারবেন?

আমি কি নিৰ্ভয়ে আমার মতামত জানাব?

অবশ্যই।

সম্রাট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবেন।

কারণ?

প্রধান কারণ আপনি। আপনি না থাকায় তার মনোেবল ভেঙে গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মনোবলের বিরাট ভূমিকা আছে।

মীর্জা কামরান বললেন, আচার্য হরিশংকর! সম্রাট বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। তাঁর আছে বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী।

শের শাহ’র কূটবুদ্ধির কাছে বিশাল গোলন্দাজ বাহিনী দাঁড়াতেই পারবে না, হুমায়ূন পরাজিত এবং নিহত হবেন।

নিহত হবেন?

প্রথমবার ভাগ্যগুণে প্ৰাণে বেঁচে গেছেন। ভাগ্য বারবার সাহায্য করে না।

সম্রাট পরাজিত হলে দিল্লীর সিংহাসনের কী হবে?

নির্ভর করছে আপনার কর্মকাণ্ডের উপর। আপনি যদি অসুস্থতার ভান করে বিছানায় শুয়ে থাকেন, তাহলে দিল্লীর সিংহাসন চলে যাবে শের শাহ’র হাতে। আর আপনি যদি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন, সৈন্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন তাহলে দিল্লীর সিংহাসন আপনার।

আপনি কি আমার উজিরদের একজন হতে রাজি আছেন?

না।

না কেন?

যতদিন সম্রাট জীবিত ততদিনই আমি সম্রাটের অনুগত নফর। কোনো কারণে সম্রাটের প্রাণহানি হলে আমি আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করব। তার আগে না।

 

আছরের নামাজের পরপর মীর্জা কামরান বিছানা ছেড়ে উঠলেন। ঘোষণা করলেন, আল্লাহপাকের অসীম করুণায় তিনি রোগমুক্ত হয়েছেন। তিনি রোগমুক্তি-স্নান করে মাগরেবের নামাজ আদায় করার প্রস্তুতি নিলেন। রোগমুক্তি উপলক্ষে রাজমহিষীরা সবাই উপহার পেলেন। যারা গৃহবন্দি ছিলেন, তাদের বন্দিদশা দূর হলো। সর্ব সাধারণের কাছে গেল। তিন হাজার রৌপ্য মুদ্রা। আমীররা খেলাত পেলেন। আচার্য হরিশংকরকে দেওয়া হলো রত্নখচিত ভোজালি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *