১১. ছবির স্যুটিং

নোমান বলছিল ছবির স্যুটিং খুব বিরক্তিকর। আমি দেখছি ব্যাপারটা মোটেই সে রকম না। আমার বিরক্তিতো লাগছেই না। বরং মজা লাগছে। আমি ছবির কিছুই জানি না। তবু বুঝতে পারছি। সফিক সাহেব ছবির কাজ খুব ভালই বুঝেন। একেবারে এলাহি কারবার। দিনের বেলা কাজ হচ্ছে অথচ মাঠের মাঝখানে মাঝখানে লাইট জ্বলছে। বড় বড় রাংতা মোড়া বোর্ড হাতে লোকজন ছোটাছুটি করছে। এই বোর্ডগুলো রিফ্রেকটর।

ক্যামেরাম্যান একজন বিদেশী, কলিন্স বোধহয় নাম। অসীম ধৈর্য এই সাহেবের। ঝাঁঝাঁ রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।

সারাদিন ধরে একটা দৃশ্য হচ্ছে। জাহেদা ছুটতে ছুটতে বনে ঢুকে গেল।

সফিক সাহেব বললেন, দৃশ্যটা এমনভাবে নিতে হবে যেন দর্শকের মনে ভয়ের ছাপ পড়ে। মেয়েটা যখন দৌড়ে যাবে তখন মাঠে কয়েকটা ছাগল থাকবে। মেয়েটার দৌড়ে যাওয়া দেখে ছাগলগুলো উল্টো দিকে ছুটতে থাকবে। এতে দৃশ্যটি অন্য রকম হয়ে যাবে। মেয়েটা যখন বনে ঢুকবে তখন বনের পাখিরা কিচকিচ করে উঠবে। এতে ভয়টা আরো বাড়বে।

উনার কথাগুলো আমার ভাল লাগল। বলতে ইচ্ছা করল বাহ বেশতো। অহনা অভিনয়ও করছে এত সুন্দর। ছাগলগুলো যখন তাকে দেখে ছুটছে তখন সে এক পলকের জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকাল ছাগলগুলোর দিকে তারপর আবার ছুটতে শুরু করল। দাঁড়ানোর কথা সফিক তাকে বলেন নি। এটা সে করেছে নিজ থেকে।

সফিক বললেন, তোমার দাঁড়িয়ে পড়াটা খুব সুন্দর হয়েছে। ওয়ান্ডারফুল।

ক্যামেরাম্যান সাহেব বললেন, Well done!

অহনা হাসতে হাসতে বলল, থ্যাংকস।

সফিক বললেন, আজকের মত প্যাক আপ। কাল সকাল থেকে আবার সুটিং। আশা করছি কাল দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলব।

অহনা বললেন, আমি আজ আরো খানিকক্ষণ কাজ করতে রাজি আছি। আজ আমার কাজ করতে খুব ভাল লাগছে।

সফিক বললেন, আজ থাক। আমি টায়ার্ড। কলিন্সের দিকে তাকিয়ে দেখ রোদে টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে। নোমান বেচারাও টায়ার্ড। ছাগলের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে তার অবস্থা কাহিল। এসো নৌকায় বসে সবাই চা খাই।

অহনা বললেন, চল যাই।

সফিক বললেন, আজ চাঁদনী আছে। রাতের খাবার পর আমরা কিছুক্ষণ নৌকায় করে ঘুরব। কি বল অহনা?

আচ্ছা যাও ঘুরব।

রাতের নৌকায় গানের আসর হবে। অহনা দু একটা গান কি আজ আমাদের শুনাবে?

অহনা হাসতে হাসতে বললেন, খুব ভালমত অনুরোধ করলে শুনাতেও পারি।

অনুরোধ মানে তুমি চাইলে আমি সবার সামনে দূর থেকে ক্রলিং করে এসে তোমার পায়ে ধরতে পারি।

সফিক হাসছেন। অহনা হাসছেন। কে বলবে এদের মধ্যে কোন সমস্যা আছে। এদের হাসি কৃত্রিমও নয়। সহজ সরল হাসি। এই হাসির উৎস ভালবাসা। অন্য কিছু নয়। সেই ভালবাসার জন্ম যদি ঘৃণাতে হয় তাতে কিছু যায় আসে না।

 

রাতে অনেকক্ষণ গান হল। নৌকা ঘাটে বাঁধা। বেশ বড় নৌকা। ছাদ খোলা। পাটাতনে তিরপল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা চারজন শুধু আছি। সাহেব গান শুনতে আসেন নি। তিনি নাকি একা একা গাজা খাবেন। বাংলাদেশে এসেছেন আরাম করে গাঁজা খাবার জন্যে। নোমান আজকের দিনের পরিশ্রমের জন্যেই বোধহয় পাটাতনে কান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। বেশ কয়েকটা তাকিয়া আছে। বেচারার মাথার নিচে একটা দিয়ে দিলে আরাম করে ঘুমাতে পারত। আমার দিতে লজা লাগছে।

সফিক সাহেব বসেছেন অহনার পাশে। আমি অন্য দিকে। অহনা পরপর তিনটি গান করলেন। সবার শেষে গাইলেন

নিশীথে কী করে গেল মনে কী জানি, কী জানি।
সে কি ঘুমে, সে কি জাগরণে কী জানি, কী জানি।।

গাইতে গাইতে টপ টপ করে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। চাঁদের আলোয় কান্নাভেজা মুখ এত সুন্দর দেখায়? আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি। এমন একটি গুণী মেয়েকে ভালবেসে কষ্ট পাওয়াতেও আনন্দ আছে। এদেরতো অঞ্জলি পেতেই ধরে রাখতে হয়।

অহনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে হঠাৎ কঠিন স্বরে বললেন, রাত একটার সময় এখান থেকে একটা ট্রেন যাবে ঢাকায়। আমি ঐ ট্রেনে চলে যাব। নোমান যাবে আমার সঙ্গে।

সফিক অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?

অহনা বললেন, মানে টানে জানি না। আমার ভাল লাগছে না। এই নোমান উঠতো। ওঠ। তুমি আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবে।

সফিক বললেন, তোমার যদি যেতেই হয় তুমি যাবে কিন্তু একা যাবে কেন? আমরা সবাই যাব। তুমি চলে গেলে আমরা এখানে থেকে করব কি?

না। আমি একা যাব। তোমরা পরে আসবে। শুধু নোমান আমার সঙ্গে যাবে।

সফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, দেখ অহনা–নোমানের স্ত্রী এখানে আছে। সে তার স্ত্রীকে ফেলে চলে যাবে এটা তুমি কেন ভাবছ? হঠাৎ করে তোমার কি হয়েছে। আমি জানি না। তবে তুমি পাগলের মত আচরণ করছি।

মোটেই পাগলের মত আচরণ করছি না। যা করছি ঠাণ্ডা মাথায় করছি।

নোমান তোমার সঙ্গে যাবে। আর তার স্ত্রী এখানে থাকবে?

অহনা তীব্ৰ গলায় বলল, হ্যাঁ এতে তেমন কোন সমস্যা হবার কথা না। আশা করা যেতে পারে গভীর রাতে তুমি তার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেবে না। আর যদি দাও তাতেও ক্ষতি নেই এই মেয়ের অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়ে অভ্যাস আছে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কি বলছে এই মেয়ে? সে কি সত্যি এসব বলছে না। আমি ভুল শুনছি?

সফিক চিৎকার করে বললেন—চুপ কর। You are out of your mind.

তুমি চেঁচিও না। I am not out of my mind. I never was. যা বলছি ঠিকই বলছি। এই দারুণ রূপবতী এবং পুণ্যবতী মহিলার একটি অবৈধ মেয়ে আছে। এতিমখানায় বড় হচ্ছে।

আমি মূর্তির মত বসে রইলাম। নোমানের ঘুম বোধহয় ঠিকমতো ভাঙেনি। সে হতভম্ব হয়ে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার অহনার দিকে। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি কি পানিতে পরে যাচ্ছি? সফিক ছুটে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। শান্ত স্বরে বললেন–নোমান তুই অহনাকে নিয়ে যা। আমি নবনীকে দেখব। তুই চিন্তা করিস না। যা প্লীজ যা।

নোমান অহানার সঙ্গে চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য সে একবারও পেছনের দিকে তাকাছে না। সফিক বললেন, নবনী তুমি কিছু মনে করো না। ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও এরকম করে। আমি হাত জোড় করে ওর হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, সফিক ভাই! আপনি কি আমাকে আমার বড়মামার কাছে পৌঁছে দেবেন?

অবশ্যই দেব। তুমি যেখানে আমাকে নিতে বলবে আমি সেখানেই তোমাকে নিয়ে যাব। অহনার ব্যবহারে আমি যে কি পরিমাণ লজিত তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।

আপনার লজ্জিত হবার কিছু নেই। আমি দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। আমার জীবনের একটা অংশ আমার কাছে অস্পষ্ট। আমার ধারণা অহনা ভাবী সত্যি কথাই বলেছেন।

আমার এমন লাগছে কেন? শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমি নৌকার উপর বসে আছি। নৌকাটা খুব দুলছে। এত দুলছে কেন নৌকাটা? নৌকার পাটাতনে এটা কি কাক না? ঐ বুড়ো কাকটা না? আবার কতদিন পর কাকটাকে দেখলাম— আমি বললাম, এই এই আয়।

তলপেটে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। আমার শরীর একটি শিশু বাস করছে। ওর কোন ক্ষতি হচ্ছে নাতো? ও ভাল থাকবে তো? প্ৰচণ্ড মানসিক যাতনায় না-কি আপনা। আপনি এবোরসান হয়ে যায়। এটা যেন না হয়। সব কিছুর বিনিময়ে আমি তার মঙ্গল চাই।

নবনী তোমার কি খারাপ লাগছে? এক কাজ কর এই পাটাতনে শুয়ে পর। তাকিয়াটা মাথার নিচে দাও।

সফিক ভাইয়ের কথা খুব অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। তিনি আমাকে শুইয়ে দিলেন। চাঁদটা এখন ঠিক আমার চোখের উপর। চাঁদের আলো এত তীব্ৰ হয়? আমার চোখ বলছে যাচ্ছে।

নদী থেকে পানি নিয়ে তিনি আমার চোখে মুখে দিচ্ছেন। শান্তি শান্তি লাগছে। নদীর পানি এত ঠাণ্ডা।

নবনী শোন, হা করে নিঃশ্বাস নাও। হা করে নিঃশ্বাস নিলে ভাল লাগবে।

আমি নিজের জন্যে না। আমার বাচ্চাটির জন্যে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এই পৃথিবীতে তাকে আসতেই হবে।

আমার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। আমি প্ৰায় ফিসফিস করে বললাম, সফিক ভাই। আমার পেটে তিন মাসের একটা শিশু আছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এবোরসান হয়ে যাবে। প্ৰচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।

তুমি নড়বে না। যেভাবে আছ সেই ভাবে শুয়ে থােক। একটুও নড়বে না।

তিনি দৌড়ে চলে যাচ্ছেন। একটু বাতাস নেই তারপরেও নৌকাটা এত দুলছে কেন? মনে হচ্ছে। আমি গড়িয়ে পানিতে পড়ে যাব। নৌকার পাটাতনে বুড়ো কাকটা গুটি গুটি পায়ে আসছে আমার দিকে। আমি বললাম, এই যা যা। কাউকেই এখন আমার কাছে আসতে দেয়া যাবে না। নিজেকে রক্ষা করতে হবে। শিশুটির জন্যেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। আধো ঘুম আধো জাগরণে বুঝতে পারছি— আমার শরীরের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা শিশুটিকে রক্ষা করার যে প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করছি, এরকম তাগিদ। আগেও একবার অনুভব করেছিলাম। আমার আজকের অনুভূতি নতুন নয়। আরো একবার জীবন বাজি রেখেছিলাম একটি শিশুর জন্যে। অস্পষ্ট ধোয়ার মত স্মৃতি, গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। বড় মামা আমাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। যেন কেউ আমার খোঁজ না জানে। মামা কেন এই কাণ্ডটি করেছিলেন এখন স্পষ্ট হচ্ছে।

কেমন আছে আমার ঐ বাচ্চাটা? কত বড় হয়েছে? ওকি ওর বাবার মত হয়েছে? পরিচয়হীন ঐ মেয়েটির মাথায় ভালবাসার মঙ্গলময় হাত কেউ কি ফেলবে না?

চাঁদটা মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসছে। কি তীব্র তার আলো?

রক্তে আমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে। এত রক্ত মানুষের শরীরে থাকে?

পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এত রক্ত পায়ের শব্দ। নোমান কি আসছে? সে যদি আসে তাহলে তাকে একটা কথা বলে যেতে চাই। কথাগুলো বলার মত শক্তি আমার থাকবেতো? আমি বলব, এই দেখ আমি মরে যাচ্ছি। যে মানুষ মরে যাচ্ছে, তার উপর কোন রাগ কোন ঘেন্না থাকা উচিত না। আমি অনেককাল আগে একটা মানুষকে যে ভাবে ভালবেসেছিলাম তোমাকেও ঠিক সেই ভাবেই ভালবেসেছি। ভালবাসার দাবি আছে। সেই দাবি খুব কঠিন দাবি। ভালবাসার সেই দাবি নিয়ে তোমার কাছে হাত জোড় করছি। আমার একটা মেয়ে আছে। কোন একটা এতিমখানায় বড় হচ্ছে তুমি কি ওকে তোমার কাছে এনে রাখবে? প্রথমে হয়ত তাকে ভালবাসতে পারবে না। কিছুদিন পর অবশ্যই পারবে। ওতো আমারই একটি অংশ। আমিতো তোমাকে ভালবেসেছি।

এক খণ্ড বিশাল মেঘ চাদটাকে ঢেকে দিয়েছে। চাঁদের আলো এখন আর চোখে লাগছে না। চারদিকে কি সুন্দর লাগছে। কি অসহ্য সুন্দর। হতাশা, গ্লানি, দুঃখ ও বঞ্চনার পৃথিবীকে এত সুন্দর করে বানানোর কি প্রয়োজন ছিল কে জানে?*

————-
* নবনীর প্রতিটির চরিত্র কাল্পনিক।

5 Comments
Collapse Comments
আমি ইমরান । কওমি মাদ্রাসা থেকে পড়া লেখা করেছি । June 9, 2021 at 3:57 pm

গল্পের বাকি অংশ নেই কেন ? হুমায়ূন আহমেদ তার প্রতিটা গল্প/উপন‌্যাসের হেপি ইন্ডিং রাখেনা কেন ? উনি বেচে থাকলে আমি হয়তো উনার বিরুদ্ধে মামলা টামলা কিছু করে বসতাম ।
আল্লাহ আপনাকে জান্নাত বাসি করুক । আমিন ।
* পাঠকদেরকে অতৃপ্ত রেখে আপনি কি ভাবে জান্নাতে তৃপ্তির ডেকুর দিবেন ? *

Bangla Library (Administrator) June 11, 2021 at 10:35 pm

গল্প এখানেই শেষ।

আবদুর রহিম বাদল March 4, 2022 at 8:22 am

প্রতিটি বই এর বানান ভুল দৃষ্টকটু।

আবদুর রহিম বাদল March 4, 2022 at 8:26 am

প্রতিটি বই এর বানান ভুল দৃষ্টিকটু।

কেনো জানি না হুমায়ূন আহম্মেদ স্যার তার গল্পগুলোকে এভাবে জীবন্ত করেন।। পাঠকদের মনে কিন্তু রেখে গল্পের ইতি টানেন। গল্পটা তিনি এভাবে শেষ না করলেও পারতেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *