১১. ছদরুদ্দিন সাহেব খাটে আধশোয়া হয়ে বসা

ছদরুদ্দিন সাহেব খাটে আধশোয়া হয়ে বসা। তাঁর সামনের চেয়ারে বিজু। বিজুর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। হাত মুঠি করা। ঘরে আর কেউ নেই তবে তিথি মাঝে-মাঝে দরজার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে এবং চলে যাচ্ছে। তিথির চোখে ভয়।

ছদরুদ্দিন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, তুই আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছিস?

বিজু কঠিন গলায় বলল, হ্যাঁ। দশ দিনের মধ্যে চলে যাবেন।

দশ দিনের মধ্যে চলে যাব?

হ্যাঁ, আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। বড় আপার ঘুমাবার জায়গা নেই। আমি ঘুমাই। বারান্দায়। বিশ্বাস না হলে এক বার এসে দেখে যাবেন।

সোমাকে আমার এখানে পাঠিয়ে দিলেই হয়। তিথির সাথে থাকবে।

বড় চাচা, আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না। বাড়িটা আপনি দশ দিনের মধ্যে ছাড়বেন।

কেন?

আবার বলছেন কেন? আপনি জানেন না কেন?

না, জানি না।

এই বাড়ি আমাদের।

কে বলেছে তোকে?

কি বলছেন আপনি? কে বলেছে মানে?

যা, একটা দলিল এনে আমাকে তুই দেখা যে এই বাড়ি তোর। যেদিন দেখাবি সেই দিনই ছেড়ে দেব। আর শোন বিজু, তোর মাথাটা বেশি গরম হয়ে আছে। মাথা এত গরম করিস না। এই বয়সে মাথা যদি এত গরম হয় তা হলে বাকি জীবনটা কি করবি?

আপনি দয়া করে উপদেশ দেবেন না। উপদেশের আমার দরকার নেই।

তা নেই। তোর যে জিনিসের দরকার সেটা হল জুতোর বাড়ি। নেংটা করে তোকে। জুতো দিয়ে পেটানো দরকার। আর মাথাটা কামিয়ে দেওয়া দরকার।

বিজু থমথমে মুখে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে যাবার সময় পিছনে-পিছনে তিথি আসছে। তিথি নরম গলায় বলল, বিজু ভাইয়া।

বিজু জবাব দিল না।

তিথি বলল, আমরা এই বাড়িতে থাকব না বিজু ভাইয়া। এই বাড়ি ছেড়ে দেব। সবাই মামার বাড়িতে চলে যাব। আগেই যেম, শুধু বাবা যেতে চাচ্ছে না বলে যাচ্ছি। না। বাবা মামাদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না। দেখলেই কেমন পাগলের মতো হয়ে যান। বিজু ভাইয়া, তুমি রাগারাগি করো না। আমরা থাকব না।

বিজু কোনো জবাব দিল না। তবে তিথি যে শান্ত-সহজ ভঙ্গিতে এতগুলো কথা বলতে পারল তাতে সে অবাক হল। ও সেদিনও পুঁচকে মেয়ে ছিল, আজ কেমন গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বিজুর মনে হল বড় চাচার মেয়েগুলো বড়চাচা কিংবা বড় চাচির মতো খারাপ হয় নি। চেহারা ভালো না, কিন্তু মেয়েগুলো ভালো। বিশেষ করে তিথি। এর গলায় সে কোনোদিন একটা উঁচু স্বর শোনে নি। তিথির সঙ্গে সোমার কোথায় যেন মিল আছে।

 

সাইফুদ্দিন সাহেব আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরবেন ভেবেছিলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। কাল রাতে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর-জ্বর লাগছে। যেদিন সকাল সকাল ফিরবেন। ভাবেন সেদিনই ফেরা হয় না। ছ সাত জন রুগী বসে আছে। তাঁর জন্যে এতগুলো রুগী অপেক্ষা করবে এটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। শেষ বয়সে পসার বাড়তে শুরু করল কি-না কে জানে! খারাপ সময়টা বোধহয় কেটে যাচ্ছে। দিনের পর দিন গিয়েছে একটা রুগী পান নি। কম্পাউন্ডারের যে কাজ ইনজেকশান দিয়ে দুটাকা নেওয়া সেই কাজও করতে হয়েছে। জীবনের শেষে এসে সুদিনের মুখ দেখছেন। ডাক্তার হিসাবে আগে যা ছিলেন এখনো তাই আছেন, তা হলে রুগী আসছে কেন? বয়সের কারণে কি চেহারায় ডাক্তার ভাবটা বেশি এসেছে? হতে পারে। তাঁর মাথায় চুল লম্বা। সব চুল পেকে ধব ধব করছে বলে চেহারায় একটা ঋষি-ঋষি ভাব এসে গেছে।

তিনি পর্দা সরিয়ে ডাকলেন, এখন কে? আপনি? আসুন।

ছেলে কোলে নিয়ে মধ্যবয়সী এক লোক ঢুকল। ছেলের বয়স চার-পাঁচ। রোগা লিক-লিক করছে। চেহারা দেখেই বোঝা যায় এর একমাত্ৰ অসুখ অপুষ্টি।

থোকার কি হয়েছে?

পেটে ব্যথা। কাল সারা রাত ঘুমাতে দেয় নাই। ছটফট করছে।

ব্যথা কি এখনো আছে?

কিছু বলছে না।

কি খোকা, ব্যথা আছে?

ছেলে না সূচক মাথা নাড়ল। সাইফুদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, ব্যথা থাকলেও অনেক সময় ছেলেরা ডাক্তারের ভয়ে বলে, না।

ঠিক বলেছেন ডাক্তার সাহেব।

দেখি থোকাকে এখানে শুইয়ে দিন তো। কি খোকা, আমাকে ভয় লাগে?

খোকা হেসে ফেলল। দীর্ঘ সময় নিয়ে সাইফুদ্দিন সাহেব রুগীকে দেখলেন। তাঁর পসার বাড়ছে। তাঁকে আরো সাবধান হতে হবে। পসারের সাথে সাথে দায়িত্ব চলে আসে।

রুগী দেখে শেষ পর্যন্ত বেরুতে বেরুতে নটা বেজে গেল। এখান থেকে বাড়ি প্রায় আধ মাইলের মতো। এইটুকু পথ হেঁটে হেঁটে যান। এতে শরীরটা ঠিক থাকে। রাতে সুনিদ্ৰা হয়।

রাস্তায় নামতেই দেখলেন বিজু দাঁড়িয়ে আছে। তিনি হাসিমুখে বললেন, কি রে বিজু তুই।

তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। মেলা রুগী আসছে দেখি তোমার কাছে।

তিনি তৃপ্তির হাসি হাসলেন। বিজু বলল, রিকশা নেবে না হাঁটবে?

চল হাঁটি। তুই কিছু বলবি?

হাতে একটা জুলন্ত সিগারেট থাকলে বিজর কথা বলতে সুবিধা হয়। তবে বাবার সঙ্গে তো আর সিগারেট হাতে কথা বলা যায় না। বিজু সিগারেট ফেলে দিল। আস্ত সিগারেট ফেলে দিতে মায়া লাগল। সাইফুদ্দিন সাহেব বললেন, সোমার ব্যাপারে কিছু বলবি?

না। আচ্ছা বাবা, দাদার মৃত্যুর পর তোমাদের সম্পত্তির ভাগটাগগুলো কীভাবে হল।

সম্পত্তি আছেই বা কি আর ভাগই বা কি হবে।

তবু যা আছে সেটার কথাই বল।

কাগজপত্রে তো কিছু নাই, মুখে মুখে ভাগ।

বল কি?

কেন, কি হয়েছে?

বিজ জবাব দিল না। এক দলা থথ ফেলে মুখ বিকৃত করল। তার অনেক পরিকল্পনা মাথায়। এখন মনে হচ্ছে সব পরিকল্পনায় পানি লেগে গেছে। কোনো পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে না। ঢাকা শহরের এমন সুন্দর একটা জায়গায় তাদের সাড়ে পাঁচ কাঠা জমি। পুরনো বাড়িটা ভেঙে ব্যাংক লোন নিয়ে ছতলা দালান তোলা যায়। নিচের তলায় হবে ডিপার্টমেন্ট স্টোর, উপরে ফ্ল্যাট। একেক ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট, মোট দশটা ফ্ল্যাটে চার হাজার করে ভাড়া হিসাব করলেও হয় চল্লিশ হাজার। ডিপার্টমেন্ট স্টোর সে নিজে চালাবে। সব পাওয়া যাবে এখানে। একটা স্ন্যাকস কর্নার থাকবে। ভিডিও কর্নার থাকবে আজকাল ভিডিও ব্যবসা জমজমাট। লোকজন বাজার করতে এসে পছন্দসই একটা ক্যাসেট নিয়ে চলে যাবে।

বিজু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।

সাইফুদ্দিন সাহেব বললেন, কি হয়েছে রে বিজু?

বিজু এক দল থুথু ফেলল, জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। বড় গরম লাগছে। আজ আবার গরম পড়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *