১১. চৈত্র মাসের শেষ দিকের কথা

চৈত্র মাসের শেষ দিকের কথা। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা মিলিয়েছে। হরিচরণের শরীর খারাপ করেছে। তার প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শরীর খারাপের কারণ আধিভৌতিক। সন্ধ্যাবেলায় তিনি ঘাটে বসেছিলেন। আকাশে ঘন মেঘ থাকায় আগেভাগে অন্ধকার নেমেছে। দিঘির ডানপাশে জোনাকি পোকার বড় একটা ব্যাক বের হয়েছে। এরা দলবেঁধে পশ্চিম দিকে এগুচ্ছে। হরিচরণ গভীর আগ্রহে এদের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করছেন। দিঘির পাড় থেকে বের হয়ে এরা লেবুতলায় কিছুক্ষণ স্থির হলো। সেখান থেকে উড়তে উড়তে বেত ঝোপের পাশে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য হয়ে আবার দেখা দিল। এখন এরা যাচ্ছে শিউলি গাছের দিকে।

হরিচরণ তাকালেন শিউলি গাছের দিকে। হঠাৎ তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তিনি স্পষ্ট দেখলেন- শিউলি গাছের নিচে ফ্রক পরা এক মেয়ে। মেয়েটার দৃষ্টি তাঁর দিকে। সে হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে আছে। তার দিকে দৃষ্টি পড়ার পর সে গাছের আড়ালে চলে গেল। অতি দ্রুত যে গেল তাও না। ধীরে পা ফেলে গেল, তবে সে তার দৃষ্টি একবারের জন্যেও ফিরিয়ে নিল না। হরিচরণের মেয়েটাকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না। মেয়েটা শিউলি। ঢেউ খেলানো চুল, রোগা শরীর, লম্বাটে মুখ।

হরিচরণ চাপা গলায় ডাকলেন, কে! কে গো! গাছের আড়াল থেকে কেউ উত্তর দিল না। তবে হরিচরণ কিশোরীর পাতলা হাসির শব্দ শুনলেন। এটা কি কোনো বিভ্রান্তি? কোনো মায়া? তিনি যদি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। তাহলে কি মেয়েটা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে? হরিচরণ পুকুরের দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন—

যা দেবীযু ভ্ৰান্তরূপেনু সংস্থিতা
দেবী ভ্ৰান্তিরূপে অবস্থান করেন।

তিনি আবার তাকালেন শিউলি গাছের দিকে। হ্যাঁ, মেয়েটাকে আবার দেখা যাচ্ছে। সে এখন গাছে হেলান দিয়ে আছে। মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই তো তার রোগা রোগা ফর্সা পা। হরিচরণ উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে চাপা গলায় ডাকলেন- মা শিউলি!

মেয়েটি এবার হাত ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। হরিচরণ মন্ত্ৰমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি চোখে পালকও ফেলছেন না। তার কাছে মনে হচ্ছে, পলক ফেললেই এই ছায়াময়ীকে আর দেখা যাবে না।

জঙ্গল আলো করে বিদ্যুৎ চমকালো। মেয়েটাকে আর দেখা গেল না।

 

হরিচরণ নিজের ঘরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তার মাথার কাছে হারিকেন জুলছে। বী-দিকের জানালা খোলা। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। হরিচরণ মাঝে মাঝে সামান্য কাঁপছেন। তিনি বুকের ব্যথা নিয়ে শুয়েছিলেন। সেই ব্যথা বাড়ছে। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

হারিকেন হাতে মফিজ ঢুকলেন। চিন্তিত গলায় বললেন, আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?

হরিচরণ বললেন, একটা কাগজ-কলম নিয়ে আমার পাশে বসো? কিছু কাজ আছে।

আপনার কি শরীরটা খারাপ করেছে?

হুঁ।

ডাক্তার খবর দেই?

ডাক্তার কবিরাজ পরে খবর দিবে। আগে কাগজ-কলম নিয়ে বসো।

মফিজ কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। হরিচরণ বললেন, আমার ধারণা আমি বাঁচব না। আমি আমার বিষয়সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করব। সাক্ষী হিসেবে থাকবে তুমি এবং মাওলানা ইদরিস।

মফিজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আমার পক্ষে সাক্ষী হওয়া সম্ভব না।

সম্ভব না কেন?

আমার নাম মফিজ না। আমার নাম জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়।

হরিচরণ বিছানা থেকে উঠে বসলেন। তাকালেন তীক্ষ্ণচোখে। জীবনলাল বললেন, আমি আপনার আশ্রয়ে আত্মগোপন করে আছি।

বিপ্লবী?

জীবনলাল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

হরিচরণ বললেন, আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। যাই হোক, আমি আমার সমুদয় বিষয়সম্পত্তি একজনকে দান করতে চাই–তার নাম জহির। সে মুসলমান ছেলে। তার বিষয়ে একটি বিচিত্র স্বপ্ন দেখেছিলাম বলে এই সিদ্ধান্ত।

জীবনলাল বললেন, স্বপ্নের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না।

হরিচরণ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, স্বপ্ন তুচ্ছ না। এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে তর্কে যাব না। যা লিখতে বলেছি লেখা। কাগজ-কলম নিয়ে বসো। আমার শরীর এখন ভালো। এই ভালো থাকবে না। শরীর স্পর্শ করে অনেকের রোগ সারিয়েছি। নিজেরটা পারব না।

জীবনলাল বললেন, সাধারণ কাগজে লেখা দানপত্র টিকবে না। আপনার

ঘরে কি স্ট্যাম্প আছে? আপনি এত বড় ব্যবসায়ী। জমিদারিও আছে। কোম্পানির স্ট্যাম্প তো থাকার কথা।

হরিচরণ বললেন, বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। স্ট্যাম্প আছে। বড় ঘরের সিন্দুকে স্ট্যাম্প আছে।

সিন্দুকের চাবি কোথায়? হরিচরণ বালিশের নিচ থেকে চাবি বের করে দিলেন।

জীবনলাল স্ট্যাম্প এবং কলম নিয়ে পাশে বসলেন। শান্ত গলায় বললেন, ছেলের বাবার নাম কী? বাবার নাম লাগবে।

বাবার নাম ভুলে গেছি। মায়ের নাম মনে আছে। জুলেখা।

ঠিকানা কী?

জুলেখা থাকে বেশ্যাপল্লীতে। রঙিলা বেশ্যাপল্লী।

জীবনলাল চমকে তাকালেন। হরিচরণ বললেন, তুমি যা ভাবছ তা-না। জুলেখা আমাকে বাবা ডাকত। আমি তাকে কন্যাসম জ্ঞান করেছি।

দানপত্র লেখা হলো। হরিচরণ দস্তখত করলেন। বুড়ো আঙুলের ছাপ দিলেন। জীবনলালের দিকে তাকিয়ে বললেন, সাক্ষী হিসেবে তুমি নিজ নামে দস্তখত কর।

জীবনলাল দস্তখত করলেন। হরিচরণ বললেন, দানপত্রে মাওলানা ইদরিসের দস্তখত নিয়ে আস। ভালোকথা, দানপত্র তোমার হেফাজতে রাখবে। ব্যবস্থা নিবে যেন দানপত্র মতো কাজ হয়।

ঠিক আছে।

এখন আমাকে ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে যাও।

আপনার শরীর খুবই খারাপ, আপনি শুয়ে থাকুন, আমি ডাক্তার ডেকে আনি।

হরিচরণ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, তোমাকে যা করতে বলছি সেটা কর। তারপর ডাক্তার-কবিরাজ যা আনবার আনবে।

হরিচরণকে বারান্দার ইজিচেয়ারে শুইয়ে জীবনলাল ডাক্তারের সন্ধানে গেলেন। বৃষ্টি নেমেছে জোরেশোরে। বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। হরিচরণ চোখ বন্ধ করলেন। উপনিষদের মঙ্গলাচরণ আবৃত্তি করলেন—

ওঁ ভদ্ৰং কর্নেভি; শৃণুয়াম দেবা
ভদ্ৰং পশ্যেমাক্ষ ভিৰ্যজত্ৰাঃ।
ধ্যাশেম দেবহিতং যদায়ু :
ওঁ শান্তি : শান্তি : শান্তি।

হে দেবগণ, কান দিয়ে যা কিছু ভালো তাই যেন শুনতে পাই। যা কিছু ভালো তাই যেন চোখ দিয়ে দেখতে পাই। আমার জন্যে নির্দিষ্ট যে আয়ু দেবতারা ঠিক করে দিয়েছেন, তা যেন শান্তিময় হয়।

হরিচরণ চোখ খুললেন, অবাক হয়ে দেখলেন, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তাঁর কন্যা শিউলি এগিয়ে আসছে। কী আশ্চর্য, তার পায়ে লাল টুকটুক জুতা। এই জুতাই তো পূজার সময় তিনি এনে দিয়েছিলেন। জুতাজোড়া পায়ে দেবার আগেই তার মৃত্যু হলো। তার মা জুতাজোড়া সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন। আহারে কতদিন আগের কথা। শিউলি এসে হরিচরণের সামনে থমকে দাড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি!

হরিচরণ দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শিউলি ঠোঁট টিপে হাসছে এবং পায়ে পায়ে এগুচ্ছে। হরিচরণ অপেক্ষা করছেন কখন তার মেয়ে এসে তার হাত ধরে। হরিচরণ ঢোলের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ঢোল, করতাল বাজিয়ে নাম জপ হচ্ছে। বহু মানুষ একত্রে হরি হরি করছে। সেই শব্দ সমুদ্র গর্জনের মতো।

 

হরিচরণের বাড়িতে ঢোল, করতাল বাজছে না। নামজপও হচ্ছে না। তবে জহির যে প্ৰকাণ্ড কেরায়া নৌকায় নিরুদ্দেশ যাত্ৰা করেছে সেখানে নাম জপ হচ্ছে। নৌকা কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। জানার আগ্রহও বোধ করছে না। তার হাতে একটা কানাকড়িও নেই। সকাল থেকে সে কয়েক দফা পানি ছাড়া কিছুই খায় নি। এখন ক্ষিধেয় নাড়িতুড়ি জুলে যাচ্ছে। সে গভীর আগ্রহে নৌকার গলুইয়ে বসা এক বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ কোঁচড়ভর্তি মুড়ি নিয়ে বসেছে। তার হাতে পাকা মৰ্তমান কলা। সে এক গাল মুড়ি মুখে দিচ্ছে এবং কলায় কামড় দিচ্ছে। জহিরের মনে হচ্ছে, এরচে’ সুন্দর কোনো দৃশ্য সে তার জীবনে দেখে নি।

বৃদ্ধ জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, মুড়ি খাইবা?

জহির বলল, না।

বৃদ্ধ বলল, না কেন? মুখ দেইখা বোঝা যায় ভুখ লাগছে।

জহির বলল, আমি মুসলমান।

বৃদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে একটু সরে গিয়ে বলল, সেইটা বলো। সে একটা মৰ্তমান কলা জহিরের দিকে গড়িয়ে দিয়ে বলল, ফল খাও। ফলে দোষ লাগে না।

কলাটা গড়াতে গড়াতে জহিরের পায়ের কাছে এসে থামল। জহির কলাটার দিকে তাকিয়ে রইল। হাতে নিল না।

বৃদ্ধ বললেন, তোমার নাম কী?

জহির বলল, আমার নাম লাবুস। মোহাম্মদ লাবুস।

বৃদ্ধ বলল, লাবুস আবার কেমন নাম?

জহির বলল, খুবই ভালো নাম।

 

উকিল মুনসির স্ত্রী লাবুসের মা’র মন বিষণ্ণ। লাবুস কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়েছে। অথচ এই ছেলেটার প্রতি তাঁর মমতার কোনো সীমা ছিল না। লাবুসের মা তাহাজুদের নামাজ শেষ করে দীর্ঘসময় নিয়ে প্রার্থনা করলেন। যেন তার লাবুস ভালো থাকে সুখে থাকে। কোনো একদিন যেন ফিরে আসে। তার কাছে।

রাত অনেক। লাবুসের মা খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। উকিল মুনসি বাড়িতে নেই। গানের দল নিয়ে সুনামগঞ্জ গিয়েছেন। কবে ফিরবেন তার ঠিক নেই। লাবুসের মা নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। স্বামীর জন্যে খুব খারাপ লাগছে। তিনি ঠিক করলেন, রাতে ঘুমাবেন না। এবাদত বন্দেগি করে রাতটা পার করবেন।

দরজার পাশে খুঁট করে শব্দ হলো। লাবুসের মা ঘাড় ফিরিয়ে অবাক হলেন। ফুটফুটে একটা মেয়ে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে চাপা হাসি। যেন বড়ই আনন্দময় কোনো ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে। লাবুসের মা বললেন, তুমি কে গো? তুমি কোন বাড়ির?

মেয়েটি বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি।

কী খবর?

আমার বাবা মারা গেছেন।

লাবুসের মা অবাক হয়ে বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন। কিন্তু তোমার মনে আনন্দ। ঘটনা। কী? তোমার নাম কী? তোমার বাবার পরিচয় কী?

আমার নাম শিউলি। আমার বাবার নাম হরিচরণ। তিনি বান্ধবপুরের ছয় আনির জমিদার। আমি যাই?

মেয়েটা খুব স্বাভাবিকভাবেই দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। লাবুসের মা মেয়েটার পেছনে পেছনে গেলেন। কাউকে দেখতে পেলেন না।

 

মাওলানা ইদরিস বিসমিল্লাহ বলে দানপত্রে দস্তখত করতে করতে বললেন, জীবনলাল নামের যে সাক্ষী উনাকে তো চিনলাম না। উনি কে?

জীবনলাল বললেন, আমার নাম জীবনলাল। আমি আপনার কাছে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি। তার জন্যে ক্ষমা করবেন।

মিথ্যা পরিচয় কেন দিয়েছেন জানতে পারি?

আমি বিপ্লবী দলের মানুষ। মিথ্যা নাম নিয়ে পালিয়ে আছি। হরিচরণ বাবুও আমার আসল পরিচয় আজ জেনেছেন। আমরা আসল পরিচয় কখনো প্ৰকাশ করি না।

আমার কাছে তো করেছেন।

জীবনলাল বললেন, আপনার কাছে পরিচয় কেন প্ৰকাশ করলাম নিজেও বুঝতে পারছি না। দুর্বল মুহূর্তে মানুষ এইসব কাণ্ড করে। অসুস্থ হরিচরণ বাবুকে দেখে মনটা দুর্বল হয়েছে।

মাওলানা ইদরিস ইতস্তত করে বললেন, ইসলাম ধর্ম বিষয়ে আপনি আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। সবই আমি মনেপ্ৰাণে বিশ্বাস করেছি। কথাগুলি কি সত্য?

যা বলেছি। সবই সত্য। একজন বিধমীও তো আপনাদের ধর্ম বিষয়ে জানতে পারে। পবিত্র কোরান শরিফ বাংলাভাষায় একজন হিন্দু প্ৰথম অনুবাদ করেছেন। এটা কি জানেন?

মাওলানা ইদরিস বিস্মিত হয়ে বললেন, জানি না। আজ প্রথম শুনলাম। উনার নাম কী?

গিরিশ চন্দ্র সেন। তাঁর এই কাজের জন্যে মুসলমানরা তাকে সারাজীবনই যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে। মুসলমানরা তাকে ডাকত ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন।

মুসলমান কখনোই তাঁকে শুধু গিরিশ চন্দ্র ডাকত না। তিনি সবার কাছে ভাই গিরিশ চন্দ্ৰ।

মাওলানার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, বড় সুন্দর একটা ঘটনা আপনার কাছে শুনলাম। খুবই আনন্দ পেয়েছি। আনন্দে চোখে পানি এসেছে। আপনাকে শুকরিয়া। এই বাংলা কোরান শরিফ কীভাবে সংগ্ৰহ করা যায় একটু বলবেন?

আমি ব্যবস্থা করে দিব। উঠি? আসসালামু আলায়কুম।

মাওলানা বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম। তার ভেতরে সামান্য অস্বস্তি কাজ করছে। একজন বিধমীর সালামের উত্তরে ওয়ালাইকুম সালাম বলা কি ঠিক হচ্ছে? এই বিষয়ে হাদিস-কোরানের বিধানইবা কী? নিজের স্বল্পজ্ঞানের জন্য নিজের উপরই রাগ লাগছে।

জীবনলাল ঘর থেকে বের হবার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, মাওলানা সাহেব, একটা কথা। আপনার একটা বিষয় দেখে অবাক হয়েছি। হরিচরণ বাবু বিপুল বিষয়সম্পত্তি একজন অনাত্মীয় ছেলেকে দিয়ে গেছেন। এই বিষয়ে আপনার কোনো কৌতূহল হলো না কেন?

মাওলানা বললেন, একটা হাদিসে পড়েছিলাম, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সালাম বলেছেন, ‘প্রতিবেশীর বিষয়ে অকারণ কৌতূহল দেখাইবে না।’ হাদিসটা মানি। তাছাড়া হরিচরণ বাবু অতি সাধু পুরুষ। উনি যা সিদ্ধান্ত নিবেন ঠিকই নিবেন। তারপরও আসল ব্যাপার অন্যখানে।

আসল ব্যাপার কী?

সমস্ত সিদ্ধান্তই আল্লাহপাকের। উনি ঠিক করেছেন জহির বিপুল সম্পত্তির মালিক হবে। বাকি সবই উছিলা।

 

বান্ধবপুর বাজারে একজন ক্যাম্বেল পাশ এলএমএফ ডাক্তার আছেন। নাম সুধিন দাস। তিনি সারাবছরই নানান রোগব্যাধিতে শয্যাশায়ী থাকেন। আজও তাই। প্রবল জ্বরে তিনি অচেতন প্ৰায়। তাঁর দুই মেয়ের একজন তাঁর পায়ে তেল মালিশ করছে, অন্য মেয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। এই অবস্থাতেই তিনি হরিচরণের বিষয়ে বিধান দিলেন, রসুন-সরিষার তেলের মালিশ। এতেই রাতটা নির্বিঘ্নে কাটবে। সকালে মিকচার দিয়ে দিব।

জীবনলাল বললেন, উনার বুকে ব্যথা। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

সুধিন ডাক্তার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, রসুন এই রোগের একমাত্র বিধান। আজ অমাবস্যাও না, পূর্ণিমাও না। রোগী মারা যাবে না। বেশিরভাগ বৃদ্ধ মারা যায় অমাবস্যা পূর্ণিমার টানে। রোগী টিকে থাকবে। সকালে নাড়ি দেখে মিকচার দিব।

জীবনলাল সুধিন ডাক্তারের ঘর থেকে বের হলেন। বাজারে নামকরা একজন কবিরাজ থাকেন। চান্দসির ক্ষত চিকিৎসা করেন। রাতে তিনি বাজারে থাকেন না। তাঁর বাড়ি খুঁজে বের করতে হলে স্থানীয় কারো সাহায্য দরকার। দুৰ্যোগের রাতে বাজারে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

মফিজ ভাই, এত রাতে এখানে কী করেন?

ধনু শেখ ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকখানি দূরে তাঁর তিনসঙ্গী। একজনের হাতে বর্শা। ধনু শেখের মুখ দিয়ে ভকভক করে দেশী মদের গন্ধ আসছে। জীবনলাল কিছু বলার আগেই ধনু শেখ বলল, আসল খবর কি শুনছেন?

আসল খবর কী?

ময়মনসিংহ থেকে পুলিশের এসপি জনকিন্স সাহেব স্বয়ং এসেছেন লঞ্চ নিয়ে। তারা খবর পেয়েছেন, এই অঞ্চলে একজন বিপ্লবী লুকিয়ে আছে।

জীবনলাল কিছু বললেন না।

ধনু শেখ বলল, আপনাকে সাবধান করার জন্যে বললাম। আপনি তো সেই লোক, ঠিক বলেছি না? আমার অনুমান ঠিক আছে না ভাইসাহেব?

জীবনলাল বললেন, পুলিশকে খবর দিয়ে কি আপনি এনেছেন?

ধনু শেখ বলল, আমি যদি পুলিশ খবর দিয়ে আনতাম—আপনাকে সাবধান করতাম না। পুলিশ নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হতাম। আপনাকে ধরিয়ে দিতাম। ব্রিটিশ রাজ বলত, মারহাবা। একটা কথা, আপনার সঙ্গে কি অস্ত্ৰ আছে?

জীবনলাল বললেন, আছে।

ধনু শেখ বলল, আমার বুদ্ধি শোনেন। নৌকা নিয়া হাওর পাড়ি দেন। ব্রিটিশ পুলিশ রাত বিরাতে হাওর পাড়ি দিবে না। তারা হাওর ভয় পায়। আমি নৌকার ব্যবস্থা করে দিব। আমার নিজের নৌকা আছে। ভালো মাঝি আছে।

জীবনলাল বললেন, আমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন কেন?

আপনাকে বন্ধু হিসেবে নিয়েছিলাম। এই কারণে। আমি লোক খারাপতবে যত খারাপ সবাই ভাবে তত খারাপ না। একবার আমি যারে বন্ধু ভাবি সে বাকি জীবনের বন্ধু। আপনি আমার বন্ধু। আপনার সঙ্গে অনেক সুখ দুঃখের আলাপ করেছি। এখন ইচ্ছা করলে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। ইচ্ছা না করলে নাই।

জীবনলাল বললেন, নৌকা ঠিক করে দিন। হাওর পাড়ি দিব। তার আগে রঙিলা বাড়ির একটা মেয়েকে আমার দেখার শখ।

হতভম্ব ধনু শেখ বলল, রঙিলা বাড়ির মেয়ের সাথে আপনার কী?

মেয়েটার রূপের প্রশংসা শুনেছি।

চান বিবির কথা বলছেন? আসল নাম জুলেখা।

হ্যাঁ জুলেখা।

ধনু শেখ বিরক্ত গলায় বলল, খামাখা সবাই তার রূপের কথা বলে। এমন কিছু না। এরচে’ পরীবিবি নামে একজন আছে— ছোটখাটো। কিন্তু ধানী মরিচ।

আমি জুলেখাকে একনজর দেখব।

চলেন ব্যবস্থা করে দেই। তবে দেরি করা ঠিক হবে না। ইংরেজ পুলিশ, এরা জোকের চেয়েও খারাপ। লবণ দিলে জোঁক ছেড়ে দেয়, ইংরেজ পুলিশ ছাড়ে না।

 

জীবনলাল দাঁড়িয়ে আছেন জুলেখার সামনে। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। ধনু শেখ দরজার বাইরে। তার লোকজন নৌকা আনতে গেছে। নৌকা রঙিলা বাড়ির ঘাট থেকে ছাড়বে। রঙিলা বাড়ি জায়গাটা উঁচু। পুলিশের আগমন আগেই টের পাওয়া যাবে।

জীবনলাল বললেন, তোমার নাম জুলেখা?

জুলেখা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

এই কাগজটা যত্ন করে রাখ।

কাগজটা কী?

এটা একটা দানপত্র। হরিচরণ বাবুর দানপত্র। এর বেশি ব্যাখ্যা করতে পারব না। তুমি কি বাংলা পড়তে পার?

পারি।

অবসর সময়ে পড়বে। আর এই পুঁটলিটা রাখা। পুঁটলিতে একটা রিভলবার আছে। আমার লোকজন এসে কোনো একদিন তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।

 

রঙিলা বাড়ির ঘাটে নৌকা চলে এসেছে। জীবনলাল নৌকায়। ধনু শেখ বন্ধুকে বিদায় জানাতে নৌকায় উঠেছে। সে জীবনলালের হাত ধরে বলল, নিশ্চিন্ত মনে যান। মাঝিকে বুঝিয়ে বলে দিয়েছি। সোজা চলে যাবেন মদনপুর। মদনপুর থেকে লঞ্চে উঠবেন সোজা নারায়ণগঞ্জ। একবার নারায়ণগঞ্জ পৌঁছলে কোনো বাপের ব্যাটা আপনেরো ধরতে পারবে না। ইচ্ছা করছে। আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যাই। সেটা সম্ভব না। অতিরিক্ত মদ্যপান করেছি। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আচ্ছা ভাইসাহেব তাহলে বিদায়। আল্লাহ হাফেজ।

পুলিশ তখন হরিচরণের বাড়ি ঘেরাও করেছে। বাড়িতে বারান্দায় মরে পড়ে থাকা বৃদ্ধ হরিচরণ, আর কেউ নেই। জীবনলাল নৌকা নিয়ে সরে পড়েছে, এই খবর তাদের কাছে অজানা।

 

এসপি জনকিন্সের কাছে ধনু শেখ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত লঞ্চ নিয়ে হাওরের দিকে গেলে বিপ্লবী জীবনলালকে পাওয়া যাবে- এই খবর দেয়া হয়েছে। জীবনলালের সঙ্গে অস্ত্ৰ আছে, এই তথ্যও জানানো হয়েছে। জনকিন্স সাহেব দলবল নিয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা হলেন। যাবার আগে ধনু শেখকে বললেন, এই ভয়ঙ্কর বিপ্লবী যদি ধরা পড়ে তাহলে তিনি চেষ্টা নেবেন যেন ধনু শেখ ‘খান সাহেব’ টাইটেল পান।

 

তারিখ ১৩ই এপ্রিল। সন ১৯১৯। ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ড তখন তুঙ্গে।

এই দিনেই পাঞ্জাবে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে অমৃতসরের জালিওয়ানওয়ালাবাগে এক হাজার মানুষ নির্মমভাবে নিহত এবং দুই হাজার আহত হয়। ডায়ার তখনই কার্ফু জারি করে, যে কারণে কোনো চিকিৎসা সাহায্য না পৌঁছায়, ময়দানে ও রাস্তায় শত শত মানুষ প্ৰাণ ত্যাগ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ রাজের ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।

তুরস্কের সুলতান ছিলেন ভারতীয় মুসলমানসহ পৃথিবীর সকল সুন্নি মুসলমানের খলিফা। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ নেয়ায় ব্রিটিশ রাজ সুলতানের পদচ্যুতি ঘটায়। সুলতানের অধিকার রক্ষার জন্যে শুরু হয় খেলাফত আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *