একাদশ পরিচ্ছেদ
চরিত্র ও চরিত্র–শক্তি
রায় নরেন্দ্রনাথ সেন বলতেন, ‘এশিয়া আধ্যাত্মিকতায় ইউরোপ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ। ইউরোপ এশিয়ার কাছে আধ্যাত্মিকতা শিখুন—” এ কথার অর্থ আমি এখনও বুঝি না। জ্ঞান, চরিত্র, মনুষ্যত্ব ও কর্ম ছাড়া যদি আধ্যাতিকতা স্বতন্ত্র জিনিস হয়, তবে সে আধ্যাত্মিকতায় কোন কাজে নেই।
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্র, মনুষ্যত্ত্ব ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বললেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠতা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করবার আর কিছুই নাই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে তবে সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোন কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকার নাই।
জগতে যে সমস্ত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের গৌরবের মূল এই চরিত্র-শক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, এ কথার অর্থ এ নয় যে, তুমি লম্পট নাও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা। তুমি পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান এবং ন্যায্য স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করতে লজা বোধ করা।
চরিত্রবান অর্থ এও নয় যে, তুমি বোকা-কারো সঙ্গে কথা বল না। মানুষের দিকে চেয়ে সাহসের সঙ্গে কথা বলতে তোমার ভয় হয়। চরিত্রবান সব সময়েই সাহসী ও নির্ভীক। মানুষ অপেক্ষা নিজের অন্তর্নিহিত সুবুদ্ধি বা বিবেককে সে বেশী ভয় করে। নিজের কাজ ও কথার উপর সে সব সময় দৃষ্টি রাখে। মানুষ তার অপরাধের কথা না জানলেও সে নিজেই তার অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়। চরিত্রবান ব্যক্তি অত্যাচারী বা তস্করকে সম্মান দেখাতে লজা বোধ করে। সাধু সত্যবাদীই তার সম্মানের পাত্ৰ। সে সর্বদাই আত্ম-মর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন।
তুমি চরিত্রবান হবে। জীবনের সকল লক্ষ্যের উপর হবে তোমার লক্ষ্যচরিত্রবান হবার দিকে। নিজের মনকে শাসন করবার দিকে, মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে আত্মাকে বিদ্রোহ করে তোেলবার দিকে, মানুষের মহত্ত্বই এইস্থানে। এছাড়া পৃথিবীতে আর কি আছে, যার জন্য মানুষের জীবনের আবশ্যকতাও হতে পারে?
টাকা-কড়ি, অর্থ-সম্পদ জীবনের উদ্দেশ্য নয়। অন্যায় ও মিথ্যার উপর যে সম্পদের ভিত্তি সে অর্থ তুমি ঘৃণায় বন-জঙ্গলে ফেলে দাও-আঁখি তোমার সেখানে ক্ৰোধে রক্তময় হোক।
চরিত্রবানই সম্মানী। সে-ই মানুষের শ্রদ্ধার পাত্ৰ-সে ভদ্রলোক, জ্ঞানী, কমী, সত্যবাদী মানুষই ভদ্রলোক আর কেহ নয়।
বাড়ীতে দালান মানুষকে অপমান করে, তুমি তোমার গৌরব প্রচার করা। তোমার বাপ নবাবী আমলে বিচারক (কাষী) ছিলেন। সেই খাতিরে তুমি নিজেকে ভদ্রলোক বলতে পার না।
তুমি কি সত্যনিষ্ঠ? তুমি কি মানুষের নিন্দা করতে ঘৃণা বোধ করা? তুমি কি আত্মাকে কলঙ্কিত করতে লজ্জা বোধ করা। তুমি অন্যায়ের শক্র? তুমি নিত্যনতুন জ্ঞান লাভ করতে সচেষ্ট? মানুষের সঙ্গে তোমার ব্যবহার সদাই মধুর। নিজে যা, তাই হয়ে প্রকাশ হতে তোমার সঙ্কোচ হয় না? আমি তোমায় নমস্কার করি, তোমার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করতে চাই না, তোমার মহত্ত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি।
এক যুবক একদিন এক ট্রাক চালকের হাতে একটা সিকি দিয়ে টিকিট আর দুই আনা ফেরত চাইলেন। তখন চালক তাকে দু’আনার পরিবর্তে চৌদ্দ পয়সা দিয়ে বললে, আপনি নেমে যান।
যুবক বললেন— আমি আমার হাতকে কলঙ্কিত করতে চাই না, এই নাও তোমার বাকী পয়সা। তুমি সব চুরি করো, আমি এক পয়সাও নিতে পারি না।
চরিত্রবান ব্যক্তি যে, সে এমন করে মিথ্যা ও নীচতার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। মানুষকে ফাঁকি দিতে পেরেছ বলে নিজেকে চতুর মনে করো না। টিকিট না কিনে রেলে ভ্ৰমণ করতে সক্ষম যদি হয়ে থাক, তবে নিজেকে খুব হীনই মনে কর। গার্ড সাহেব তোমাকে দেখে নাই, কিন্তু বিবেক তোমার ভিতরে বসে তোমার এই নীচতা দেখে অবাক হয়েছে।
লোককে ফাঁকি দিয়ে পয়সা উপায় করে তুমি জানিয়ে দিয়েছ তুমি তস্কর। কর্তব্যকে অবহেলা করে নীচের মতো তুমি মানুষের পয়সা সংগ্রহ করেছ, বুঝবো তুমি নীচ। ঘুষের পয়সা দিয়ে ধর্ম উৎসব করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছ? তোমার বিবেক ভিতর হতে হেসে বলছে, তস্করের ধর্ম কার্যের কোন মূল্য নাই।
মধ্যযুগে ইউরোপে নাইট নামে এক সম্পপ্রদায় ছিল। তারা দুস্থ ও অত্যাচারিত মানুষের সেবা করার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। পীড়িত রমণী জাতির সম্মান রক্ষার্থে তারা প্রয়োজন হলে জীবন পর্যন্ত দান করতেন। ন্যায় ও সত্য ছাড়া আর কিছু জানতেন না। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান বাদ দিয়ে দুস্থ মানুষের দুঃখ মোচনে, চরিত্রবান ব্যক্তি নাইট ছাড়া আর কিছু নয়। চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক করে রাখা, জীবনকে সত্যপরায়ণতা, ভদ্রতা, ন্যায়বান ও নৈতিক শক্তি দিয়ে অলস্কৃত করে রাখা হোক তোমার ব্ৰত। লোভ তোমাকে তোমার সৎ পথ হতে আকর্ষণ করতে পারবে না। তোমার দুর্জয় চরিত্রবলের সম্মুখে পাপ, নীচতা ও দুর্বলতা চুৰ্ণ হয়ে যাবে, তবেই হবে তুমি খাটি ভদ্রলোক।
চরিত্র, চিন্তা ও জীবন যার উন্নত, যিনি সর্বাংশ নিৰ্মল, উচ্চ মানবতা যার লক্ষ্য, তিনিই ভদ্রলোক।
নিম্নলিখিত গল্পে একটা আশ্চর্য উন্নত চরিত্র মাহাত্ম্য প্ৰকাশ পেয়েছে। স্পেনে এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে এক সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি এসে কাতর কণ্ঠে করতে আসছে। এখনই তারা আসবে।” ভদ্রলোক ব্যথিত অথচ ক্ষিপ্ৰকণ্ঠে বললেন— আপনি আর এক মুহুৰ্তও দেরি করবেন না। ভিতরে আসুন।
পরদিন প্ৰাতঃকালে গৃহস্বামী একটা অশ্ব আর একখানি তরবারী এনে অতিথিকে অত্যন্ত বিস্মিত করে বললেন— ভ্ৰাতঃ! এই নাও তরবারি। আর এই ঘোড়া। তোমাকে এই দণ্ডে পালাতে হবে। আমার ছেলেকে তুমি গতকাল হত্যা করেছি। তুমি বিপন্ন হয়ে আমার কাছে এসেছিলে, আমি তোমার রক্ষা ছাড়া ক্ষতি করতে পারি না। তবুও পিতা যখন আমি, আমার মধ্যে দুর্বলতা আসতে পারে— তুমি এই দণ্ডেই পালাও, প্ৰভাত হয়েছে।
চরিত্র যার উন্নত— যিনি ভদ্রলোক, যিনি বোঝেন সম্মান তার কোন জায়গায় নষ্ট হবে। তিনি সম্মানহানির ভয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন না। সম্মান কোথায় এবং কিসে হয়- তাঁর ভাল করে জানা আছে। সিসিলি ও নেপলস দ্বীপের রাজা পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটা লোক একটা বোঝা সামনে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কত লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, কেউ সম্মানহানির ভয়ে বোঝাটি লোকটির মাথায় তুলে দিল না। সম্রাট নিজ হাতে বোঝাটি বেচারার মাথায় তুলে দিয়ে আত্মপ্ৰসাদ লাভ করলেন। যারা পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই নিরুপায় লোকটির দিকে উদাসীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল, তাদেরই সম্মানহানি হয়েছিল।
ঘৰ্মাক্ত কলেবরে তোমার পার্শ্বে এসে একটি লোক দাঁড়ালো। হোক ছোট, তাকে দেখে তুমি কি উঠে দাঁড়িয়ে তোমার চেয়ারখানি ছেড়ে দেবে না? তাতেই যে তোমার মহত্ত্ব, এ তোমার মনুষ্যত্ব কি শিক্ষা দেয় নাই? ধর্ম যে মনুষ্যত্বেরই আর এক নাম।
অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও- আমি বলতে চাইনে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর কর, অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্ট কথা বলা পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটি করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ কর- তাহলেই অনেক হবে।
ছোটলোকের ভিতর অনেক সময় আমরা যে মহত্ত্ব দেখি, তাতে মন আমাদের ভাবে মুগ্ধ হয়ে যায়। পর্যটক পার্ক সাহেব এক সময়ে আফ্রিকায় অত্যন্ত ক্লান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এক গাছের তলায় বসেছিলেন। অনেক জায়গায় তিনি আশ্রয় চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে আশ্রয় দিয়েছিল না, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পার্ক নিরুপায় হয়ে ভাবছিলেন, ক্ষুধার ক্লান্তিতে অথবা বাঘ-ভালুকের হাতে তাকে সেই অজানা দেশে প্ৰাণ হারাতে হবে। এমন সময় এক দরিদ্র অসভ্য রমণী এসে তাকে বললে–আপনাকে একজন ক্লাস্ত পথিক বলে মনে হচ্ছে, আমাদের ছোট কুটিরখানিতে আপনি আসুন। দরিদ্রের আহার দিয়ে আপনাকে তুষ্ট করবো। অসহায় পর্যটক এই বর্বর রমণীর আতিথ্যে জীবন লাভ করেন।
পার্কের সঙ্গে কিছু ছিল না। গায়ের কোটে মাত্র চারটা রুপার বোতাম ছিল। বিদায় নেবার সময় তারই দুটো খুলে দিয়ে তিনি রমণীর মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বকে পুরস্কৃত করলেন।
চরিত্রবান মনুষ্যত্ত্ব-সম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশী অধীর হন। পরের দুঃখের কাছে নিজের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরব বোধ করেন। এক সময় এক যুবক অভাবগ্ৰস্ত হয়ে এক ভদ্রলোকের কাছে চাকরি প্রার্থনা করেন। এই ভদ্রলোকের একজন মানুষ দরকার হয়েছিল। নিয়োগকালে যুবক দেখলেন, আরও এক যুবক সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। কথায় কথায় প্রথম যুবক যখন জানতে পারলেন, তাঁর নতুন বন্ধুটির অভাব তার চেয়েও বেশী, তখন তিনি নিজের অভাবকে গোপন করে বললেন, তার চাকরির কোন দরকার নাই। শেষের যুবকটিই নিযুক্ত হলেন।
চরিত্রবান ব্যক্তি মানুষ অপেক্ষা ন্যায়কে অধিক শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। ন্যায় ও সত্যের জন্য তিনি যে কোন বিপদ মাথায় নিতে সম্মত হন। অর্থ সম্পদ, আত্মীয়-বন্ধু সব পরিত্যাগ করতে পারেন, তবু নিজের বিবেকের বাণীকে অমান্য করতে পারেন না। কাজী গিয়াস উদ্দিন সম্রাটের ভীতিকে উপহাসের চাঃেখে৷ দেখেছিলেন। রাজা চতুর্থ হেনরীর পুত্র যখন তাঁর অপরাধী বন্ধুর জন্য জজের উপর ঘুষি উঠিয়ে বললেন— জজ, আমার বন্ধুকে ছেড়ে দাও। ন্যায়পরায়ণ জজ রাজকুমারের কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। নির্ভীকচিত্তে তিনি তার কর্মচারীকে হুকুম দিলেন-ন্যায়দণ্ড বিধানের অবমাননাকারী রাজকুমারকে জেলে নিয়ে যাও।]
নিজেকে উন্নত ও চরিত্রবান করার উপায় কি? এর জন্য সাধনা চাই। তুমি হয়তো মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্ত। কেমন করে হাসি কথার মধ্যে মিথ্যা বল, তা বুঝতে পার না। হঠাৎ যদি প্ৰতিজ্ঞা করে বাস-পরের দিন থেকে একদম মিথ্যা কথা বলবে না, প্ৰতিজ্ঞা রাখতে পারবে না।
অভ্যাস ভয়ানক জিনিস- একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে ধীর ও সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক কর— সপ্তাহে অন্তত একদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। ছ’মাস ধরে নিজেকে সত্যকথা বলতে অভ্যস্ত কর, তারপর এক শুভদিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা কর, সপ্তাহে দুদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে, সত্যকথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। সাধনা করতে করতে এমন এক দিন আসবে তখন ইচ্ছা করেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করবার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সংগ্রামে হঠাৎ জয়ী হতে কখনো ইচ্ছা করো না–তাহলে সব পণ্ড হবে।
তুমি হয়ত বড় বাচাল— পাগলের মতো বকতে অভ্যস্ত। আস্তে আস্তে অল্প কথা বলতে অভ্যাস করা। যে-কোন সৎগুণই লাভ করতে চাও না কেন, তাড়াতাড়ি করো না। হঠাৎ তুমি মহাপুরুষ হবে, এ অসম্ভব। চিত্তকে শাসনে আনা বড় ভয়ানক কথা। ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে উন্নতির পথে টেনে তোেল। সাধনায় হতাশ হয়ে না, পুনঃপুন চেষ্টা কর, জয়ী হবে। সাধনায় অনেকবার তুমি পদম্মলিত হবে-কিন্তু ভয় পেয়ো না।
তোমার লোভ প্রবৃত্তিই খুব প্রবল অন্যের চেয়ে নিজের ভাগটাই তুমি বড় করে চাও। তাহলে এক কাজ কর-বড় খুঁয়ে ছোটকে গ্ৰহণ করতে চেষ্টা কর। লোভকে জয় করবার আর একটা পন্থা আছে। কোন প্রিয় জিনিসের খানিকটা না খেয়ে কোন শিশু, পশু-পক্ষী বা কুকুরকে দিতে অভ্যাস করবে। মাঝে মাঝে এই করো, তাহলে শুধু লোভ-প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে আসবে তা নয়, পরের সুখের জন্য নিজের কষ্ট স্বীকার করবার অভ্যাসও হবে। সাধনা ছাড়া চিত্তের উন্নতি স্বভাবের মহত্ত্ব লাভ করা যায় না। পরকে সুখ দিতে মন যখন বিরক্ত হবে না, তখনই তো তুমি মহাপুরুষ। এই ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধনা ও জয়ের উপর বড় বড় জয়ের ভিত্তি-এ যেন মনে থাকে।
মানুষ এক গালে চড় দিলে আর এক গাল ফিরিয়ে দেবে, এ আমি বলি না। যতটুকু ত্যাগ স্বীকার ভদ্রলোকদের পক্ষে সম্ভব, সেরূপ ত্যাগ স্বীকার করতে তুমি কখনও কুষ্ঠিত হয়ে না। শুধু ধৌত জামা পরে ও ইটের ঘরে মানুষকে নীচে বসিয়ে, তুমি ভদ্রলোক হতে চেষ্টা করো না। ভদ্রলোক হবার আরও পথ আছে।
ধীরে ধীরে আত্মাকে উন্নত করতে হবে। চিস্তা ও দৃষ্টির সাহায্যে তোমার সকল দোষ হতে তুমি মুক্ত হও। গুরুর আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের কোন মূল্য নাই। তুমি তোমার শ্ৰেষ্ঠ গুরু। গুরু মানুষকে মুক্তি দেন না। মুক্তির মালিক তুমি— এ যদি না মানো, তাহলে বুঝবো তোমার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। জাতি যখন অন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা গুরুর নাম বেশী নেয়। নিজের আত্মাকে একেবারে অস্বীকার করে।
চরিত্রকে উন্নত করো—মিথ্যা, নীচতা, অন্যায় পরের ভাবের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঔদাসীন্য, অসভ্যতা, স্বার্থপরতা যাবে; ধাৰ্মিক ও সাধক কোন আশ্চর্য জীব নয়।
নীচ, স্বার্থপর, মুখ, চোর, পরের সুখ ও পয়সা অপহরণকারী, ঘুষখোর উপাসনা ও উপবাস করুক তাতে কোন লাভ নাই। পরমেশ্বর তোমাদের ভোলেন। না-তিনি চান। সত্য প্ৰাণ, তিনি চান মানুষ। শুধু উপাসনা করে মানুষ মুক্তি পাবে না। তাকে কমী ও পরদুঃখকাতর, জ্ঞানী ও দৃষ্টিসম্পন্ন, চিস্তাশীল ও যুক্তিবাদী মনুষ্যত্বসম্পন্ন এবং ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে। সে কখনও অন্ধের মতো ধর্ম পালন করবে না। পিতা রৌদ্রের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে নিষেধ করছেন-পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন ভয়ে সুবোধ বালকের মতো অগ্নিদগ্ধ ঘরখানিকে রক্ষা করতে সঙ্কুচিত হয়ো না। আত্মার এই জ্ঞান মৃত্যু-জাতির পক্ষে সর্বনাশের কথা।
মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তার ভিতর অজেয় পুণ্যশক্তির আবির্ভাব হয়। সে শক্তিকে দমিয়ে রাখা একেবারেই অসম্ভব। জাতির প্রত্যেক মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তাদের শক্তি হয় অসাধারণ। দুর্জয় শক্তির আধারই চরিত্র। কখনো ভেবো না— মুখতার সঙ্গে চরিত্রের কোন যোগ আছে। লোকটি মুর্থ হলেও তার চরিত্র ভাল, একথা বলার কোন অর্থ নাই। মূর্থের আবার চরিত্র কি? নিরক্ষার মানুষের ভিতর যদি চরিত্রবান লোক দেখতে পাও, তাহলে মনে করো পুঁথির বিদ্যা সে পায় নাই— কিন্তু বিদ্যার উদ্দেশ্য যা, তা তার লাভ হয়েছে। না পড়েও সে বড়।
মুসলিম জাতি চরিত্রবলেই বড় হয়েছিল; এখন সে চরিত্রহীন— তাই সে নিম্নাসন গ্রহণ করছে। জ্ঞান, মনুষ্যত্ব, দৃষ্টি এসব গুণ যখন জাতির ভিতর দেখতে পাই তখনই তাকে বলি সভ্য ও বড়। পতিত জাতির সভ্যতা বিস্তারের অর্থ, মানুষকে উচ্চত্রজীবনে দীক্ষিত করা, উন্নতভাবে ভাবকরা–মানুষকে উদার চরিত্রবান ন্যায়ের সেবক করে তোলা।