ঘাটিয়া, গঙ্গাপুত্র আর অঘোরপন্থী
আমি তো আগেই বলেছি যে কাশী শহরের লজ্জা হল তার পান্ডা। কিন্তু ঘাটিয়া আর গঙ্গাপুত্রদের তা হলে কী বলা হবে? রোজ রোজ গুনতিতে এরা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে এদের শিকারও। বরুণাসঙ্গম ঘাট থেকে অসি ঘাট— এই পাঁচ মাইল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা মন্দির। ঘাটের ধারে ধারে নজরে পড়বে কাঁচা চবুতরা বা কাঠের পাটাতন যার আর এক নাম তক্তপোশ। এগুলো প্রায় ঘাট ছাড়িয়ে গঙ্গার জল ছুঁই-ছুঁই। বিঘত খানেক কেবল ফাঁকা যাতে যাত্রীরা নামা ওঠা করতে পারে, ভিড়ানো যায় নাও। প্রত্যেক চবুতরা বা তক্তপোশের কোনও-না-কোনও মালিক আছে। গায়ে চন্দন লেপে, আধা নাঙ্গা হালতে, বাবু হয়ে তারা এই পাটার উপর বসে থাকে। শুনতে পাবেন এক ঘেয়ে মাপা সুরে আওড়ে চলেছে প্রভুর নাম। কোনও হিন্দু পুণ্যার্থী গঙ্গাতে ডুব দিলেই এই ঘাটিয়াদের হাতে দেবে কিছু না কিছু প্রণামী। উলটে তারা তার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে করবে আশীর্বাদ। কোনও পরদেশি যে এই রীতি রেওয়াজ জানে না তার হুকুম নেই গঙ্গার ধারে যাওয়ার। বিশেষ করে যেখানে ঘাটিয়া তার দখল কায়েম রেখেছে। তাদের পছন্দের প্রণামী কবুল করলে তবেই মেলে ইজাজত। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর এই ঘাটিয়াদের খিলাফ বহু নালিশ শুনেছেন আর হুকুম দিয়েছেন পুলিশকে, যারা গঙ্গায় নাইতে যাবে তাদের যেন হেনস্থা করা না হয়। তখন দেখা যাবে ঘাটিয়ারা অ্যায়সা গালিগালাজ শুরু করেছে যা লেখা চলে না। পুলিশকে নালিশ করলে জবাব মিলবে, “ঘাটিয়াদের মুখ বন্ধ করার কোনও হুকুম আমাদের নেই।” গঙ্গায় যারা ডুব দিতে এসেছে তারা তখন বুঝে যায় রেওয়াজ মাফিক প্রণামী দিলেই সব ঝামেলা খতম।
কোনও কোনও ঘাটিয়া আবার চলে যায় দূর দেশে। ভিড়ে যায় সেই তীর্থযাত্রীদের দলে যারা আসবে কাশী। আবার কখনও পিছু নেয় সেই সব রাজা-মহারাজা আর বাবুদের যারা নানা তীর্থে ঘুরবে। যাত্রীরা কাশী পৌঁছলেই সে এলান করবে এই দলটি হচ্ছে তার যজমান। সেই শুধু করবে তাদের হেপাজত। কারও তখন তাদের কাছ থেকে একটা কানাকড়ি দান নেওয়ার হকও থাকবে না। আর কোনও ঘাটিয়া যদি দখলদারি করে তখন বেধে যাবে কাজিয়া। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর শুধু তাজ্জব হয়ে দেখবেন দুই তরফই কত আজব আজব নালিশ করতে পারে। কোনও বাবু যদি তার ইচ্ছা মাফিক ঘাটিয়া বেছে নেয় তখন আর এক তরফ শুরু করবে হুমকি দিতে। বলবে, ছুরি-চাকু চালাতেও তারা পিছপা নয়। ঘাটিয়ার খুন না দেখে তারা ছাড়বে না।
গঙ্গাপুত্রদের বলা হয় গঙ্গার ঔলাদ। তাদের যত দাপট মণিকর্ণিকাতে। গুনতিতেও তারা কম নয়। মাঝে মাঝেই ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে তাদের ভিতর লেগে যায় দাঙ্গা-ফ্যাসাদ। তবে তারা খুব ভালই বোঝে যে জোটই হল তাদের আসল তাকত। শিকারের তল্লাশিও চলে জোট বেধে। হিন্দুরাই হল তাদের আসল শিকার। গঙ্গার ধারে মণিকর্ণিকা হল আসলে একটা তলাব। যেটাকে ঘিরে বসানো আছে কাটা পাথরের চাঙড়। জোয়ার হলে গঙ্গার পানিতে ভরে ওঠে তলাব। আবার জমির উপর একটা ঝরনা আছে, সেখান থেকেই বুন্দ-বুন্দ পানি এসে জমা হয়। গরমের মরশুমে কেবল নজরে আসে কাদা গোলা পানি। হাজারও আদমি এখানে হর রোজ ডুব দেয় আর পুরো জায়গাটাকে করে আরও নোংরা। আমরা নোংরা বললে কী হবে, হিন্দুরা ভাবে এ এক তয়ম্মুম।১ এখানে ডুব দিলে তার সারা গুনাহ সাফ হয়ে যাবে। সুবাহ হতেই কুণ্ড ঘিরে ভিড় জমে ভক্তজনের। দেখবেন হাতে ধরে আছে একটা করে চাঁদির টাকা। ইন্তেজার কখন মিলবে ডুব দেওয়ার সুযোগ। কারও হিম্মত নেই গঙ্গাপুত্রদের হুকুম বিনা পানিতে ডুব দেয়। কেউ জবরদস্তি করলে হয় জুটবে মার না হলে মরতে হবে বেয়াদপির জন্য। জনাব প্রিন্সেপ-এর বয়ান মোতাবেক:
“গঙ্গাপুত্র (গঙ্গার ঔলাদ)-দের মৌরসি হক হল জমির যে যে কিস্তি গঙ্গা ছুঁয়ে যাচ্ছে তা ভোগ করা। তাদের আমদানির আর একটা রাস্তা পুণ্যার্থীর টাকায় খাড়া করে তোলা মঠ কিংবা মুহর্রিরি (Murhees)। দেখা যাবে এগুলোর চালা হচ্ছে লম্বা আর সমান যাতে চবুতরার কাজটাও হয়। ঘাটিয়া বা মালিকরা চায় যত জলদি এই মঠ ভেঙে যায় যাক। তাতেই তাদের ফয়দা। ফাঁকা জমিটা তখন আবার কোনও যজমানের কাছে বেচে দেওয়া যাবে। এইসব জায়গার কী দাম হতে পারে সেটা মহারাজ সিন্ধিয়ার তজরবা (tajraba) থেকেই বোঝা যায়। সন ১৮২৯, মহারাজের ইচ্ছে হল ভেঙে যাওয়া বীরেশ্বর ঘাটের মেরামত করেন। এই ঘাট মণিকর্ণিকারই লাগোয়া। তিনি ১৫০০০ টাকা কবুল করলেন তাও গঙ্গাপুত্ররা নারাজি। তাদের সেই ভরসাও দেওয়া হয়েছিল যে চবুতরার হক তাদেরই থাকবে কোনও রদবদল হবে না।”
গঙ্গাপুত্র আর ঘাটিয়ারা হল এলাকার সবচেয়ে বড় বদমাশ। মহল্লার যে কোনও অপরাধই ধরে নেওয়া হয় তারাই করেছে। ঔরত আর বাচ্চাদের উপর হামলা চালানো তো মামুলি ঘটনা। পুলিশও এইসব ঘটনাকে পাত্তা দিতে চায় না। কেউ নালিশ দায়ের করলে বলা হয় তা নাকি টুকরার-ই-খুফিফ (tukrar-i-khufeef)। হামলাদার তার দৌলত আর ইজ্জতের জোরেই রেহাই পেয়ে যায়, যদি না ফরিয়াদি ঘাটিয়াদের চেয়েও বেশি কবুল করে। এইসব মামলার কোনও সুরাহা হয় না বললেই চলে। ঘাটিয়াদের আর এক রকম বজ্জাতি হল ভিড়ের মধ্যে কোনও খুবসুরত লড়কি দেখলেই তাকে ঘিরে ফেলে ধাক্কা-ধাক্কি করা। তারপর মওকা বুঝে তার নাক, গলা বা কান থেকে সোনা-চাঁদির-জেবরাত ছিনতাই। একে তো ভিড় তার উপর পাতলা পাতলা সব গলি; বজ্জাতগুলোকে ধরাই মুশকিল। ধরতে পারলেও মাল পাচার হয়ে যাবে জুড়িদারের হাতে। তখন আর মিলবে না সাবুদ। এত জলদি সবটা হয় যে কারও কিছু মালুম হওয়ার আগেই খেল খতম।
ঘাটের খবিশ হল অঘোরপন্থীরা। এরা নিজেদের বলে বাস্তববাদী দার্শনিক আর মনে করে বস্তুতে বস্তুতে কোনও ফারাক নেই। আসল ফারাকটা আমাদের দেখায়। কী নজরে আমরা সেই জিনিসগুলোকে দেখছি। লাথ মারুন বা দোয়া করুন তাদের কিছুতেই কিছু এসে যায় না। নাঙ্গা ঘুরে বেড়ায়, হাতে ধরা মানুষদের খুলি (যার থেকে ভয়ানক বদুবু ছড়াচ্ছে। সেই মাংসই তারা হয়তো খেয়েছে কিংবা আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে এনেছে ঘিলু আর চোখ)। কোনও কিছু দিতে চাইলেই তারা এগিয়ে দেবে সেই খুলি, হোক না সেটা দারু-দুধ বা নোংরা পানি। এমনই তাদের ঢং যে খানা মিললেই হল। হতেই পারে সেটা পচা-গলা মুর্দা লাশ অথবা পচা কোনও খাবার। চুলে জট, লাল চোখ, গায়ে এত ময়লা যে পোকা ঘুরছে। অঘোরপন্থীরা সবার কাছেই ভয় আর ঘেন্নার কারণ। এদের দেখলে মনে হয় মানুষ নয় নেকড়ে। ওঁত পেতে আছে কখন ঝাঁপ দেবে শিকারের উপর। একবার আমার নজরে পড়ল এক অঘোরপন্থী মুর্দা লাশ খাচ্ছে বসে বসে। আমাকে দেখে একবার গর্জন করেই লাশটার কোটর থেকে চোখ খুবলে নিয়ে শুরু করল খেতে। আমার হাতে ছিল গাদা বন্দুক ভাবলাম দিই দেগে, ও তো কোনও আদমি নয় একটা জানোয়ার।
একবার খোদ ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর দেখলেন এক খাবিশ দারু খাচ্ছে খুলিতে করে। একে তো নেশায় চুর তারপর ধরে আছে একটা হাত খানেক লম্বা প্যাঁচালো ছোরা। সেটা চালিয়ে দিলে আর দেখতে হবে না, মৌত হবেই। হুজুর হুকুম করলেন গ্রেফতার করো। দপ্তরের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল ওই খাবিশটার তিন-তিনবার কয়েদ হয়েছে। একবার বলাৎকারের জুলুমে, একবার খুনের চেষ্টায় আর একবার ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানোর অপরাধে। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, হয় সে মোটা রকমের জরিমানা কবুল করুক যাতে এরপর থেকে সিধা রাস্তায় চলে না হলে তাকে তিন সালের জন্য ভরা হবে কয়েদে। এইসব মামলায় জজ সাহেবকে রিপোর্ট করতেই হয়। তিনি মিছিল দেখে খালাস করে দিলেন খাবিশটাকে।
খাবিশটার তো উমর কয়েদ হওয়ার কথা তাই না? নাকি ইসলামি রীতিমাফিক এখানে ইজাজত নেই এই সব জানোয়ারগুলোকে পাইকারি হারে কোতল করার? হিন্দুদের তো দেখি এদের জন্য বড় দরদ। ঘরের দরওয়াজা থেকে এগুলোকে দূর করে দেওয়া হয় না। উলটে তারা দেখায় ভক্তি। জানোয়ারের অধম এই খাবিশগুলোকে তারা দেবতার মতো ইজ্জত দেয়।
১. তয়ম্মুম: নামাজ পড়ার আগে ধুলো দিয়ে দেহের পবিত্রতা সাধন