ঠিক দুপুরবেলায় ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল শ্যাম। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখল-শেষ সিগারেট। সেটা ধরিয়ে নিয়ে প্যাকেটটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে বাঁ পায়ে নিখুঁত একটা শট করল সে। প্যাকেটটা রেলিং টপকে গিয়ে দেয়ালে লেগে পড়ল সিঁড়ির বাঁক ঘুরবার চাতালে, শ্যাম আপনমনে হাসল—গো-ও-ও-ল! রেলিঙে ঝুঁকে ভারসাম্য রাখল, তারপর মসৃণ রেলিঙে হাত ছুঁইয়ে তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল। পায়ে করে আবার সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নেয় সে। তারপর পায়ে পায়ে সেটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে—ইন আউট…ইন আউট…ইন আউট–আপনমনে বলে সে। অনেক স্মৃতি অনেক কথা ও দৃশ্য, ভাঙা শব্দ বুকের ভিতরে, মাথার ভিতরে ঝিলমিল করে ওঠে তার। কচ্ছপের পিঠের মতো এক ঢাল সবুজ মাঠ, একটা সাদা বল, আর সে ছুটছে আর ছুটছে…সামান্য হাসে সে, খাস টানে, তারপর আবার নামতে থাকে।
বড় রাস্তায় এসে এসপ্ল্যানেডের বাস ধরল শ্যাম।
নির্দিষ্ট জায়গায় ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়াল শ্যাম। চোখের রোদ-চশমা খুলে নিল। মৃদু হাসল।
আবছা দেখা যেতে লাগল লীলার অবয়ব। তারপর জলের গভীর থেকে যেভাবে আস্তে আস্তে মাছ উঠে আসে জলের ওপরে, তেমনি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল সেই দুখানি সাদা ব্যস্ত হাত, গোল সুন্দর মুখখানা, কপাল-ঢাকা চুল। আজ তার সাদা ব্লাউজ। মাথায় উঁচু করে বাঁধা মস্ত খোঁপা।
দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। চমকে উঠল না লীলা, মুখ ফাঁক হয়ে গেল না। বরং জুড়ে গেল ঠোঁটে ঠোঁট, ভ্রূ কুঁচকে উঠল, দৃঢ় হয়ে গেল চোয়ালের হাড়। এক পলক দেখা হতেই সে তার চোখ সরিয়ে নিল। ব্যস্ত হয়ে গেল কাজে।
শ্যাম জানত এরকমই হবে। এরকমই হয়। মৃদু হেসে সে দাঁড়িয়ে রইল। ক্রমে অলীক এক আবছায়ার মধ্যে চলে যেতে লাগল তার চারপাশ, পথ-চলতি লোকজন, লুপ্ত হয়ে গেল সময়ের বোধ। আর কেবলই রেলগাড়ির শব্দ, হরিণের খুরের আওয়াজ, নিঃশব্দ এক বৃষ্টিপাতে ভরে আসে তার বুক, শরীরের ভিতরে ধীর গম্ভীর মেঘ ডেকে ওঠে।
চোয়াড়ে চেহারার একটা নোক লীলার সঙ্গে কথা বলছে। লোকটার পরনে গাঢ় গরম প্যান্ট, গায়ে সাদা সোয়েটার। লোকটা খুব ভদ্রভাবে হাসছে, কিন্তু তার মতলব শ্যাম পরিষ্কার বুঝতে পারে। সে নানা কথায় ভোলাচ্ছে লীলাকে। ওই তো লীলার মুখ-চোখ কোমল হয়ে এল, স্বপ্ন দেখার মতো অলস হয়ে এল চোখ, দু’টি ব্যস্ত হাত কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে আছে কাউন্টারের ওপর। লীলার ঠোঁটে চাপা আনন্দের হাসি! বোধহয় ঘরে আর কেউ নেই, কিছুক্ষণের অবসর পেয়ে গেছে লীলা। টেলিফোনটাও বোধহয় বাজছে না, কিংবা বাজলেও উত্তর দিচ্ছে না লীলা।
লোকটাকে শ্যামের চেনা মনে হয়। অনেকক্ষণ সে দেখে। সেই লোকটা কি, শ্যাম যার পিছু নিয়েছিল। লোকটা, ওই বদমাশ লোকটা এখানে কেন তা বুঝল না শ্যাম, সে শুধু মনে মনে আর্তনাদ করে উঠলকথা বোলো না। ওর সঙ্গে কথা বোলো না। কী কথা ওর সাথে? মুখ ফিরিয়ে নাও, কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ো। অনেকক্ষণ ধরে তোমার টেলিফোন বেজে যাচ্ছে, উত্তর দাও। বাইরে সন্ধে হয়ে এল, তুমি কাজ সেরে নাও। ওর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আপনি এখন আসুন…! কিংবা আরও কোনও কর্কশ কথা বলো লীলা, ওকে বের করে দাও। কিংবা আমাকে চোখের ইশারায় ডাকো, আমি ভিতরে গিয়ে ওকে বের করে আনছি। আমি ওকে চিনি, ও ভিড়ের মধ্যে লোকের পকেট হাতড়ে দেখে, মেয়েদের বুক ছুঁয়ে আসে ওর লোভী হাত। কথা বোলো না আর। লীলা, চুপ করো। কী কথা ওর সাথে! তুমি কি জানো না যে, একজন তোমাকে দেখছে?
বোধহয় টেলিফোন বাজল। লীলা একটু হেলে কানে চেপে ধরল টেলিফোন, ডান হাতে সে হলুদ পেনসিলটা ঠুকতে লাগল ডেস্কের ওপর, তবু লোকটার দিকে চেয়ে আছে সে, মৃদু হাছে। লোকটা সোয়েটারটা দু হাত দিয়ে একটু টেনে নামায়, ডেস্কের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ায় টেলিফোনটার দিকে। লীলা মাথা নাড়ে, পিছনে একটু হেলে সরে যায়। হাসে।
ওরা খেলছে–শ্যাম টের পায়। সমস্ত শরীর রি-রি করে ওঠে শ্যামের। আত্মবিস্মৃতি ঘটে যেতে থাকে। কী সাহস ওই লোটার! কেবল কাছে দাঁড়িয়ে থেকে, কেবল কথা বলে বা কেবল চোখের দৃষ্টিতে ও নষ্ট করে দিচ্ছে লীলার পবিত্রতা।
আর লীলা জানে যে শ্যাম তাকে দেখছে। তবু তার হৃক্ষেপ নেই। কিংবা কে জানে, লীলা তার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে কি না!
এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যায় শ্যাম। কী করছে তা বুঝতে পারে না। দরজার খুব কাছে এসে সে দাঁড়ায়। কাচের পাল্লায় তার লম্বা, শীর্ণ, এলোমেলো পোশাক পরা চেহারাব ছায়া ভেসে ওঠে। তার নিশ্বাসের ভাপ লেগে আবছা হয়ে যায় খানিকটা কাচ। তীব্র চোখে সে ভিতরের দিকে চেয়ে থাকে।
টেলিফোন রেখে সোজা হয়ে বসেই হঠাৎ শিউরে ওঠে লীলা, চিৎকার করে উঠতে গিয়েও মুখে হাত চাপা দেয়, অসহায় দুটি চোখ বিশাল হয়ে যায়। চোয়াড়ে চেহারার লোকটা বিদ্যুদবেগে চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়ায়। শ্যাম দেখে, তার দুটো হাত মুঠো পাকানো, কিন্তু হতভম্বের মতো শ্যামের দিকে চেয়ে আছে।
শ্যাম মৃদু হাসে। তারপর এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে আসে আবার। ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় নিশ্চিন্ত মনে। শান্তচোখে চেয়ে থাকে হতভম্ব বিব্রত লোকটার দিকে চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দেয়–সাবধান! আমি পাহারায় আছি।
লোকটা একটুক্ষণ তাকে দেখে, তারপর অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নেয়। লীলা মুখ নিচু করে বসে আছে। দু’জন সুট পরা সাহেব ভিতরে ঢুকে গেল। তারা লীলার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলল। শ্যাম লক্ষ করে যে লীলার মুখ অল্প লাল, সে অনায়াসে হাসছে না আর, মাথা নেড়ে থমথমে মুখে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। ঘর খালি হয়ে গেল আবার। চোয়াড়ে চেহারার লোকটা লীলার দিকে ফিরে কী যেন জিজ্ঞেস করল। লীলা মাথা নাড়লনা। চোখ নিচু করে রইল। লোকটার মুখে সামান্য হতাশা ফুটে উঠছে। শ্যাম দেখে। লোকটা একটু ইতস্তত করে, তারপর কাউন্টারের ওপরে রাখা ফোলিও ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। দরজার বাইরে এসে লোকটা থমকে শ্যামের দিকে এক পলক তাকায়। শ্যাম গ্রাহ্য করে না। লোকটা বাঁ দিকে হেঁটে চলে গেল।
নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে থাকে শ্যাম। নড়ে না।
আস্তে আস্তে তার চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। ঘরের মধ্যে লীলাকে উজ্জ্বল দেখায়। বাচ্চা মেয়ের মতো অভিমানী গম্ভীর তার মুখ। শ্যাম হাসে। তার ঠোঁট নড়ে ওঠে—তোমাকে ওখানে মানায় না। এত ভিড়ের মধ্যে আর এত লোকজনের চোখের সামনে তোমাকে মানায় না। ভেবো না, আমি তোমার জন্যেই একদিন পৃথিবীকে খুব নির্জন করে দেব, চুপ করিয়ে দেব সবাইকে। গভীর শরবনের জঙ্গলে। ড়ুবিয়ে দিয়ে যাব সমস্ত শহর।…কে ওই লোক যার সঙ্গে তুমি কথা বলছিলে? ওরকম হৃদয়হীন চেহারার লোক পৃথিবী থেকে যত কমে যায় তত ভাল। তুমি কখনও ওই লোকের সঙ্গে দূরে যেয়ো না।
কাজ শেষ হয়ে গেলে লীলা সতর্কভাবে একবার দরজার দিকে চেয়ে দেখল। তারপর একটা টেলিফোন করল। পিছনে হেলান দিয়ে বসে রইল চুপচাপ। ঘরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া-আসা করল অনেক লোক, শ্যাম তাদের লক্ষ করল না। লীলার বসে থাকার ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারল যে, সে কারও অপেক্ষায় আছে। মৃদু হাসল শ্যাম, কেননা সে জানে যে, তাতে লীলার কোনও লাভ নেই।
কিন্তু অনেকক্ষণ কেউ এল না। লীলা উঠে ভিতরে গেল, আবার ঘুরে এল, কাউন্টারের উপর ঝুঁকে দরজার দিকে পিঠ করে কিছু একটা দেখার ভান করে অপেক্ষা করল। আবার অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে একটু হেঁটে বেড়াল। তারপর ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে পঁাড়াল লীলা। পিছনে আলো, তাই লীলাকে ছায়ার মতো দেখায়। কাচের খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল লীলা। শ্যাম স্পষ্ট বুঝতে পারে, ওই অন্ধকার মুখ থেকে দুটি অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ করছে, বলছে, কী চাও রাস্তার লোক? কী চাও অচেনা?
সে দুটি প্রশ্নই শুনতে পায় যেন। অমনি কেঁপে ওঠে তার শরীর, ভুল পেয়ে বসে তাকে। সে বিড় বিড় করে বলে, আমি জানি না আমি কী চাই। আমি জানি না।
অস্থিরভাবে চোখ সরিয়ে নেয় শ্যাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে সে শুনতে পায় দূরের রাস্তায় বাঁক নিয়ে ছুটে আসছে একটা মোটরসাইকেল, তারপর তার গতি ক. সে, ধীরে ধীরে মোটর-সাইকেলটা তার ঠিক পিছনে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ায়। নিথর হয়ে যায় শ্যাম। অবশ চোখে চেয়ে দেখে, তার পাশ দিয়ে চটপট পায়ে একটি ছেলে চলে গেল কাচের দরজাটার দিকে। চাপা কালো প্যান্ট আর সাদা পুল-ওভার পরা, ছোট করে ছাটা মাথার চুল, একটু বেঁটে কিন্তু মজবুত চেহারার ছেলেটি দরজার দিকে হাত বাড়াতেই যেন মন্ত্রবলে দরজা খুলে গেল। সেই প্রথম দিন শোনা একটু তীক্ষ্ণ কিন্তু মিষ্টি গলাটি শুনতে পেল শ্যাম, এত দেরি! কখন টেলিফোন করে বসে আছি…
ছেলেটি হাসে, এই বিশ্রী ট্রাফিকে আসা যায়? ঘুরে আসতে হল, তাও ক্লিয়ার রাস্তা পেলুম না…কী ব্যাপার?
কই! কিছু না।
কিছু না?
না।
দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে এল শ্যামের দিকেই। নড়ল না শ্যাম। লীলা ছেলেটির বাঁ পাশে ছিল, যে-পাশে শ্যাম। কয়েক পা হাঁটার মধ্যেই লীলা কৌশলে ছেলেটির ডান পাশে সরে গেল। তারপর তাকে পেরিয়ে গেল তারা। শ্যাম ঘাড় ঘোরাল না। শুনতে পেল স্টার্টারে লাথি মারার শব্দ, তারপর গুর গুর করে ডেকে উঠল মোটরসাইকেল। দূরের দিকে ছুটে গেল। সরল একটি গাছের মতো সে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে পেট্রলের গন্ধের সঙ্গে আর-একটি মিষ্টি মৃদু গন্ধ, বোধহয় পাউডারের। আগে অনেক পাউডারের গন্ধ চেনা ছিল শ্যামের। এখন ভুলে গেছে, মৃদু হেসে সে মাথা নাড়লনা, সে এ-গন্ধটা চেনে না।
তোমার কি অনেক প্রেমিক? ভাল, কিন্তু দেখো, একদিন পৃথিবী খুব নির্জন হয়ে যাবে। তখন তোমার লুকিয়ে থাকার নিরাপদ জায়গা থাকবে না, থাকবে না পালিয়ে যাওয়ার সহজ পথ।
ভিড়ের ভিতরে পথ করে ধীরে হাঁটছিল শ্যাম। হাঁটতে হাঁটতে বলছিল, আমি জানি না কী করে ভয় দেখাতে হয় চোয়াড়ে চেহারার বিশ্রী স্বভাবের লোকদের, আমি জানি কীভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হয় মোটর-সাইক্লিস্টদের। তুমি কেন দেখিয়ে দাওনি আমাকে! কেন ছেলেটিকে বলোনি যে, এই লোকটার জন্যই আমি রাস্তায় একা বেরোতে পারছিলুম না। কিংবা তুমি সেই চোয়াড়ে চেহারার লোকটাকেও বলতে পারতে–আমাকে বাঁচাও।
হাঁটতে হাঁটতে অভিভূতের মতো হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে শ্যাম। কেন? পিছন থেকে চলন্ত একটা লোক তার গায়ে ধাক্কা খায়। শ্যাম টাল খেয়ে হেসে ওঠে-কেন ধরিয়ে দাওনি আমাকে? তারপর আবার হেঁটে যায়।
বস্তুত পৃথিবী খুব নির্জন হয়েই গেছে। খুব জীবন্ত মানুষজন শ্যামের চোখে পড়ে না। ব্র্যাকেটে ঝোলানো জামাকাপড় হেঁটে যাচ্ছে, ট্যাক্সিডার্মি করা মুখ কিংবা শরীর তার চোখে পড়ে। এলোমেলো আলোয় পড়ছে চলন্ত ছায়া, ভেঙে যাচ্ছে। নানা রাস্তায় ঘুরে বেড়াল শ্যাম। একটিও চেনা মুখ চোখে পড়ে না, একটিও প্রিয় মুখ চোখে পড়ে না। হঠাৎ মনে হয়, একশো বছর একটানা ঘুমিয়ে হঠাৎ জেগে উঠে সে আর কিছুই চিনতে পারছে না। একশো বছর ধরে পচে গলে ঝরে গেছে চেনা-পরিচয়, একশো বছর ধরে বিস্ফোরিত হয়ে গেছে প্রিয় মুখগুলি। অল্প কুয়াশা জমে আছে চার দিকে, বেশি দূরে চোখ যায় না। মনে হয় কুয়াশা কেটে গেলেই দেখা যাবে বিদেশ। দেখা যাবে, লীলা একা নির্জন রাস্তার শেষে কাচের দরজার ওপাশে তার অপেক্ষায় আছে। তাকে দেখলেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসবে, তারপর তাবা দু’জন পরিত্যক্ত জনহীন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে পরস্পরকে না-ছুঁয়ে। যে-কোনও বাড়িতেই তাদের জন্য সুন্দর বিছানা পাতা থাকবে, দোকানে দোকানে সাজানো থাকবে জিনিস, তারা একবার স্পর্শ করবে বলে গাছে গাছে ফুল ফুটে ফল ফলে থাকবে। তাদের দু’জনের উদ্দেশেই তখন রোদ বা বৃষ্টিপাত ঘটবে পৃথিবীতে।
না, শ্যাম মাথা নাড়ে। পৃথিবীতে এরকম কিছুই ঘটে না। সে জানে। তাই পৃথিবী এখনও মেন সুন্দর নয়। এখনও এখানে রয়ে গেছে কিছু অহংকারী মোটর-সাইক্লিস্ট আর কিছু চোয়াড়ে লোক।
.
হোটেলে আজ মিত্রকে না দেখে সামান্য চমকে গেল শ্যাম। রোজ যে দেখা হয় তা নয়। তবু আজ খেতে বসে বড় একা লাগল শ্যামের। সামনের উলটো দিকের শূন্য চেয়ারটার দিকে চোরা চোখে চেয়ে দেখল অনেকবার। সামান্য সন্দেহে তার মন দুলে গেল। খাবারের তেমন কোনও স্পষ্ট স্বাদ পেল না শ্যাম। খেয়ে গেল।
হোটেলের ম্যানেজার লোকটার সঙ্গে কোনও দিনই প্রায় কথা বলে না শ্যাম। দরজার কাছে একটা খুদে টেবিল কোলে করে বসে থাকে বিনয়ি এবং মোটা থলথলে লোকটি, দুটি ঢুলুঢুলু চোখ, দেখলে মনে হয়, সন্ধের দিকে এক-আধ ছিলিম গাঁজা খায় ম্যানেজার। কথা কম বলে, হাসে অনেক বেশি কিন্তু শব্দ হয় না, কখনও শ্যাম শোনেনি যে লোকটা ছোকরা চাকর কিংবা ঠাকুরকে চেঁচিয়ে বকছে। বস্তুত বকাঝকা করার জন্য আলাদা একজন লোক রাখা আছে—সে-লোকটা চাকরদের ওপরওয়ালা। ম্যানেজার শুধু চুপচাপ বসে থাকে শান্তভাবে। শ্যাম লক্ষ করেছে, দিনে দিনে লোকটা আরও শান্ত হয়ে যাচ্ছে, নড়াচড়া কমে যাচ্ছে আরও। মুখের হাসিতে আরও বিনয় ও উদাসীনতা ফুটে উঠছে, মুখের কথা কমে গেছে অনেক। লোকটার মাথার ওপরে পিছনের দেয়ালে লোকটার মৃত বাবার একটা ছবি টাঙানো আছে, ছবির চারধারে একটা গত বছরের শুকনো বেলফুলের মালা। মাঝে মাঝে শ্যামের সন্দেহ হয় যে, হয়তো খুব শিগগিরই এ-লোকটাও তার ছেলেকে খুদে টেবিলের কাছে নিজের পুরনো জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে একলাফে উঠে যাবে ওপরের দেয়ালে তার বাবার ছবির পাশে। তারপর ওরকমই একটা শুকনো বেলফুলের মালা পরে ছবি হয়ে যাবে একদিন, খুব শিগগিরই! নয়তো যেখানে বসে আছে। সেখানেই বসে থেকে আস্তে আস্তে একদিন সিমেন্ট কংক্রিটের মতোই জমে যাবে লোকটা ঠান্ডা পাথর হয়ে যাবে, আর নড়বেই না কোনও দিন।
আজ বেরোবার মুখে শ্যাম খুদে টেবিলটার সামনে একটু দাঁড়াল। বাইরের দিকে চেয়ে দেখল, কুকুর—অনেক কুকুর বসে আছে। রোজ যেমন থাকে। অকারণে শ্যাম মৃদু হেসে বলল, আঃ, কুকুর! তারপর এক দুই তিন করে গুনে গেল। এগারোটা।
এত কুকুর! শ্যাম মৃদু হেসে শান্ত লোকটির দিকে তাকাল, এত কুকুরকে আপনি রোজ ভাত দেন?
দিই। বড় বিনয়ে হাসল লোকটি। চোখ বুজে গেল হাসিতে।
এগারোটা কুকুরকে? শ্যাম চোখ বড় করে তাকাল—আপনার খুব বেশি পুণ্য জমে যাচ্ছে! খুব তাড়াতাড়িই পুণ্য করে নিচ্ছেন আপনি, সময় থাকতেই!
বড় বিনয়ে লোকটি ঘাড় কাত করল, বলল, এগারোটার বেশি কমও হয়।
হয়?
হয়। লোকটা বিষণ্ণ চোখে কুকুরগুলোর দিকে তাকাল, বলল, দিনে দিনে বাড়ছে। আরও বাড়বে।
কেন?
কেন! লোকটি চিন্তিত মুখে শ্যামের দিকে তাকাল, খাবার পাচ্ছে না কোথাও। দেশের যা অবস্থা, ক্রমে ক্রমে এখানে এসে জুটছে।
ঠিক। শ্যাম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে। বস্তুত দেশের খাদ্যাবস্থা বহুকাল হয় শ্যামের আর জানা নেই। তবু লোকটার এত কথা বলা শুনতে তার ভাল লাগছিল।
সব কটাই বাজে কুকুর নয়। লোকটা বলল, লক্ষ করে দেখুন, মাঝখানের সাদা কুকুরটা—ওর গায়ে অনেক বড় বড় লোম এখনও আছে, প্রকাণ্ড ঝোলানো কান, ওটা স্প্যানিয়েলের ক্রস-ব্রিড। আর ওই যে একটা ছাইরঙা, দেখলে আর বোঝা যায় না, ওটা বোসেদের কুকুর ছিল—অ্যালসেশিয়ান। গায়ে ঘা। হয়ে পচে-টচে রাস্তার কুকুর হয়ে গেছে। খুঁজলে মশাই, ওদের মধ্যেও বলতে বলতে হাসল লোকটি, একজন খদ্দেরকে এতক্ষণ দাড় করিয়ে রেখেছিল, তাকে পয়সা গুনে দিতে টেবিলের ওপরটা ডালার মতো তুলে ফেলল।
একটু অপেক্ষা করল শ্যাম, তারপর মুখ তুলতেই বলল, মিত্রকে দেখেননি আজ! সুবোধ মিত্রকে?
অমায়িক হাসল লোকটি; মাথা নাড়ল, না। এখনও আসেননি। বলে সস্নেহে কুকুরগুলির দিকে চেয়ে রইল। শ্যাম লক্ষ করল, কুকুরগুলি বড় স্নেহে এবং ভালবাসায় শান্ত লোকটির দিকে চেয়ে আছে।
আর কথা না বলে বেরিয়ে এল শ্যাম। সে কুকুরগুলির ভিতর দিয়ে হেঁটে গেল, তারা একটু সরে পথ করে দিল। সন্দেহজনক স্প্যানিয়েলটির দিকে একবার আদরের হাত বাড়িয়েও হাতটা টেনে নিল শ্যাম। তাতেই খুশি হয়ে কুকুরটা ল্যাজ নেড়ে দিল। ভিখিরি ব্যাটা-শ্যাম মনে মনে গাল দিল তাকে।
শ্যামের মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে একটা সন্দেহ। কাছেই সুবোধ মিত্রর বাসা। ইচ্ছে করলে একবার ঘুরে আসতে পারে শ্যাম। কিন্তু ইচ্ছে হয় না। যদি তেমন কোনও ঘটনাই ঘটে থাকে, তবে তার গিয়ে কী লাভ? বরং এখন গেলে পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। ভাবতেই ভয়ংকর অলস লাগল শরীর। শ্যাম হাঁটতে হাঁটতে একটু দাঁড়াল। হাই তুলল। যদি ঘটনাটা ঘটেই থাকে তবে বলতেই হয় যে, মিত্র কথা রাখেনি। সতেরোটা ঘুমের বড়ির অর্ধেক বখরা শ্যামের পাওনা ছিল।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল শ্যাম। তার ক’টা বড়ি পাওনা ছিল? হিসেব করলে কটা দাঁড়ায়। আটটা না ন’টা! অর্ধেক নেওয়ার কথা বলেছিল মিত্র, কিন্তু ঠিক ক’টা তা বলেনি। শ্যাম ভেবে দেখল, আর-একজনকে দলে নিলেও ঠিক ঠিক তিন ভাগ করা যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে বড় সমস্যায় পড়ে গেল শ্যাম। সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোল যে, ভাগ-বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রে সতেরো সংখ্যা বিশ্রী। তারপর আবার হাঁটতে লাগল।
পৃথিবী অনেক নির্জন হয়ে গেছে। ক্রমে ক্রমে আরও যাবে। আস্তে আস্তে তার একার হয়ে যাবে সবকিছু। মিত্রকে দিয়ে শুরু হল হয়তো বা। কিংবা ঠিক তা নয়—আরও আগে থেকে—
তার মাথার ভিতরে অমনি বগরী পাখির মতো গুরু গুরু করে ডেকে উঠল একটি প্রায়-ভুলে-যাওয়া মোটরসাইকেলের আওয়াজ। মৃত্যুকূপে সেই খেলার মতো ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে আবার নীচে নেমে যেতে লাগল। শ্যাম দ্রুত হাঁটতে থাকে।